নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:০১ পিএম, ৩০ জুন, ২০২০
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। আমরা ডব্লিউএইচও সভা এবং আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বহুবার একসাথে অংশ নিয়েছি। সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আয়োজিত একটি সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন তিনি। এরপর পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমি তাঁর মেয়েকে জানতে পারি। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমি সবসময়ই খুব শ্রদ্ধা করি। তাঁর কাজ, উত্সর্গ এবং কৃতিত্বের জন্য তাকে নিয়ে আমি গর্বিতও বটে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় কোনো সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে বা যেকোনো উপলক্ষে দর্শকদের কাছে তাঁর এবং তাঁর অর্জন সম্পর্কে কথা বলে আমি সম্মানিত বোধ করি। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি, এর প্রথম কারণ হলো তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন তিনি। ড্রাগ প্রোগ্রামে তার অবদানের জন্যেও তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাছাড়া ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তাঁর সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা সবচেয়ে উদ্ভাবনী কর্মসূচির একটি। এক্ষেত্রে তিনি বিশ্বের প্রথম কয়েক জনের একজনও বটে। এই বীমার ফলে তার সেন্টারে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তিনি অনেক পুরষ্কার এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন। যাই হোক, আমরা অনেক সময় শ্রদ্ধার সাথে তাঁর কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশল সম্পর্কে অসম্মতি জানাতেও সম্মত হয়েছি। যথাযোগ্য সম্মানের সাথে এবং অনেকটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বলছি যে, গত কয়েক বছরে তার কার্যক্রমগুলো বিশেষ করে, টিভি টকশো, মিডিয়া ব্রিফিং এবং সদ্যই কোভিড-১৯ ডায়াগনস্টিক কিট নিয়ে মিডিয়ায় যা চলছে তাতে করে একজন জনস্বাস্থ্য নেতা এবং একজন বিজ্ঞানী হিসাবে ডা. জাফরুল্লাহর নিষ্ঠার বিষয়ে আমার সন্দেহ জাগছে। এর কারণগুলো আমি একটু ব্যাখ্যা করছি-
বিজ্ঞান এবং বাস্তবতা
১. কভিড -১৯ অত্যন্ত সংক্রামক। প্রতিরোধের যথাযথ ব্যবস্থা ছাড়া যেমন- বাড়িতে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বা বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার না করলে একজন সংক্রমিত ব্যক্তি গড়ে আরও দুই থেকে তিন জন সুস্থ ব্যক্তিকে আক্রান্ত করতে পারে। এটি সাধারণ ফ্লুর চেয়ে দ্বিগুণ সংক্রামক।
২. ভাইরাসটি ছড়ানোর সময়কাল হলো ১৪ দিন পর্যন্ত। এই সময়কালে কোনও লক্ষণ ছাড়াই ভাইরাসটি খুব সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি সংক্রামিত লোকদের অন্যকে সংক্রামিত করার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে। করোনার বাহক কোন উপসর্গ দেখা দেওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগেই ভয়ানকভাবে এটি ছড়িয়ে দিতে পারে। অতএব, যাদের হালকা সর্দি-কাছি ছে কেবল তারাই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে, এমনটা নয়।
৩. আমি যদি সঠিক হই, তবে বাংলাদেশে যাদের লক্ষণ রয়েছে বা যাদের কনট্যাক্টে এসেছেন তাদের সবারই পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার সুবিধা এবং ক্ষমতা বাংলাদেশে সীমিত। তাই এমন অনেকেই থাকতে পারেন যারা সংক্রমিত, কিন্তু পরীক্ষা হচ্ছে না। অতএব এমন অনেকেই থাকতে পারেন যারা লক্ষণ উপসর্গ ছাড়াই আমাদের মাঝে ঘুরছেন। তারা অবচেতনভাবেই এই রোগটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
৪. সংক্রমণের হার (যারা পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছেন) ২০-২৩% এর মধ্যে থাকাটা এটাই ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশে বিস্তৃত আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ করোনার বাহক আছেন, যারা পরীক্ষার আওতায় আসছেন না। করোনা প্রতিরোধের জন্য যে নির্দেশনাগুলো রয়েছে, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই মানছে না বা তাদের মানতে বাধ্য করা যাচ্ছে না, বা কোনো কারণে তা মানাতা সম্ভব হচ্ছে না। এই বাস্তবতাগুলো সমক্রমণ নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তোলে।
৫. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৌশল হলো পরীক্ষা, ট্রেস এবং বিচ্ছিন্নতা। ডব্লিউএইচও দেশগুলোকে সর্বাধিক নির্ভুল ডায়াগনস্টিক কিট দিয়ে পরীক্ষার ক্ষমতা বাড়াতে পরামর্শ দিচ্ছে। ডায়াগনস্টিকস কিটের করোনা শনাক্তকরণের সক্ষমতার কমতির ফলে বহু মিথ্যা নেগেটিভ কেস দেখা দেবে। এটা উপসর্গ সহ এবং উপসর্গ ছাড়া সব ধরনের মানুষের জন্যই কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশনে নেওয়া এবং বিচ্ছিন্নতাকরণকে আরও কঠিন করে তুলবে। এর ফলে সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে পড়বে। বহু মিথ্যা পজিটিভ কেসের পাশাপাশি বহু মিথ্যা নেগেটিভ কেসও দেখা দেবে। ভুলভাবে যাদের পজিটিভ বলা হবে, তাদের সেবা দিতে গিয়ে দেখা যাবে সত্যিকারের পজিটিভ কেসের চিকিৎসা সেবা দেওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে। এই পুরো বিষয়টিই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বোঝা আরও বাড়িয়ে তুলবে। রাষ্ট্রের এবং ব্যক্তিপর্যায়ে আর্থিক বোঝা বৃদ্ধির পাশাপাশি এটা অনেকের মানসিক চাপও বাড়াবে।
উপরের এই বাস্তবতা বিবেচনা করে, পরীক্ষার কিটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশকে অবশ্যই যত্নবান হতে হবে। কোভিড-১৯ ডায়াগনস্টিক কিটগুলোর অবশ্যই সঠিকভাবে কেস সনাক্তকরণে উচ্চ সংবেদনশীলতা এবং সুনির্দিষ্টতা থাকা উচিত। যাতে করে এটা স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বোঝার পাশাপাশি কোভিড-১৯ সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতেও সহায়তা করে। অন্যদিকে নিম্নমানের পরীক্ষার কিটগুলো ভ্রান্ত সুরক্ষা দেবে। সেই সঙ্গে জনসাধারণের আস্থা এবং সরকারের প্রচেষ্টাকেও ক্ষুণ্ন করবে। যার আর্থ-সামাজিক পরিণতি হবে ভয়াবহ।
আমি সেই প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু কথা বলি যেটা কোনও চিকিত্সা ডিভাইস বা ডায়াগনস্টিক টেস্ট কিট বাছাই এবং নিবন্ধনের জন্য ডব্লিউএইচও, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বহু দেশ সুপারিশ করেছে-
১. পরীক্ষা কিটের সংজ্ঞা
পরীক্ষা কিটের বিবেচিত বিষয়গুলোর মধ্যে থাকতে হবে- কী রোগ বা কন্ডিশন শনাক্ত করবে, একক পরীক্ষা বা একটি অ্যালগরিদম প্রয়োজন কিনা; এবং পরীক্ষাগুলো একটি গুণগত বা পরিমাণগত ফলাফল প্রদান করতে পারে কিনা। এছাড়াও সর্বোত্তম ক্লিনিকাল ইউটিলিটির জন্য, অবশ্যই পরীক্ষার স্থানটি বিবেচনা করতে হবে (বৃহৎ পরীক্ষাগার নাকি ছোট স্বাস্থ্য কেন্দ্র); এবং এন্ড ইউজার (ভাল প্রশিক্ষিত ম্যাবরেটরি টেকনিশয়ান নাকি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহকারী দরকার হবে)।
২. মার্কেট রিভিউ
প্রস্তাবিত পরীক্ষার কিট স্পেসিফিকেশনে প্রয়োজনীয় নমুনার ধরণের বিবরণ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে; পরীক্ষার অপারেটিং শর্তসমূহ; অতিরিক্ত কী কী সরঞ্জাম প্রয়োজন; এবং কিটটি কতদিন ব্যবহার করা যাবে।
৩. নিয়ন্ত্রক অনুমোদন
কিটের প্রি কোয়ালিফিকেশন নিম্নলিখিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত-
- পণ্য অ্যাপ্লিকেশন পর্যালোচনা; পণ্য পরীক্ষাগার মূল্যায়ন; উত্পাদন সাইট পরিদর্শন।
পরীক্ষার পারফরম্যান্স এবং উত্পাদন মানের দুটোই মূল্যায়ন করতে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
৪. অপটিমাল ডায়গনস্টিক আক্যুরেসি
আদর্শগতভাবে একটি পরীক্ষার পারফরম্যান্স সর্বোত্তম কার্যকারিতা নির্দেশ করে। এই ধরনের মূল্যায়ন কেবলমাত্র পরীক্ষার ডায়াগনস্টিক নির্ভুলতার জন্যই নয় তবে এর রিপিট্যাবিলিটি, পুনঃউৎপাদন এবং ব্যাপক হারে পণ্য ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটা সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতে পারে। এসব তথ্য ব্যবহারকারীদের বাস্তব জীবনে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পরীক্ষা কিট নির্বাচন করতে সক্ষম হবে কিনা তা বুঝতে সহায়তা করে।
৫. প্র্যাকটিসে ডায়াগনস্টিক নির্ভুলতা
ভিট্রো ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার প্রকৃত কর্মক্ষমতা এবং তাদের ব্যবহারের সহজতা উভয়ই নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন বিবেচনা করা উচিত। সর্বশেষ ব্যবহারকারী স্তরের মূল্যায়ন বাস্তব জীবনের পরীক্ষার কার্যকারিতা এবং গুরুত্ব প্রকাশ করতে পারে।
৬. মনিটরিং পারফর্মেন্স
গুণমান নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা পরীক্ষা এবং শেষ ব্যবহারকারীদের তদারকি নিয়মিত হওয়া উচিৎ এবং নথিভুক্ত করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদী গুণগত নিশ্চয়তার আরেকটি উপাদান বিপণন পরবর্তী নজরদারি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) এর টেস্ট কিট মূল্যায়ন কমিটি গণস্বাস্থ্যের কিট সুপারিশ করেনি এবং কম সেন্সিটিভিটি (১১-৪০%) পেয়েছে শুনে শয্যাশায়ী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘কী লজ্জা!’
বিএসএমএমইউ এর মূল্যায়নের ফলাফলের ভিত্তিতে কিটের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তটি কি সত্যিই লজ্জাজনক ছিল? ডা. চৌধুরী যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার করোনা পরীক্ষার কীটের বাছাই ও নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথে একমত হন তবে আমি তাকে শ্রদ্ধার সাথে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলো করতে পারি-
১. গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটটি উপরের প্রাথমিক পাঁচটি ধাপ কি পেরিয়েছিল? যদি তা হয় তবে সেই তথ্য প্রকাশ্যে পাওয়া যাচ্ছে কি?
২. অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি টেস্টিং বা উভয়ই সেটা সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপারে কেন মিক্স আপ ছিল?
৩. আমি প্রিন্ট মিডিয়া থেকে জেনেছি যে কোনও সরকারী কর্মকর্তার উপস্থিতি ছাড়াই ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রাথমিকভাবে আমেরিকার সিডিসিতে পরীক্ষার কিট সরবরাহ করেছিলেন। আমরা কি সিডিসি, মার্কিন মূল্যায়ন রিপোর্ট পেয়েছি?
৪. তিনি মিডিয়াকে বলেছিলেন যে তিনি নিজের কিটস রেজিস্ট্রেশন করতে কাউকে কোনও টাকা দেবেন না! একটি টিভি টকশোতে তিনি তার অর্থ কী তা বোঝাতে ব্যর্থ হন এবং বার বার ইতস্তত করতে থাকেন যে, নিবন্ধন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে বা ব্যয় খুব বেশি হবে বলেই আইসিডিডিআরবি বা বিএসএমএমইউকে কিট সরবরাহ করতে রাজি হননি কিনা।
একজন জনস্বাস্থ্য নেতা হিসাবে তিনি কি জনগণকে নিম্ন সংবেদনশীল টেস্ট কিট ব্যবহারের ফলে বিপুল সংখ্যক মিথ্যা পজিটিভ কেস তৈরি করতে এবং মানুষের জীবনকে বিপদে ফেলতে পারেন? সেটাও আবার শুধু এই কারণে যে, কিট মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল বা বিলম্বিত হবে? সরকার যদি তার কিটের দাবির সাথে একমত হত এবং প্রয়োজনীয় মূল্যায়ন না করত, তবে কীভাবে এটা বিজ্ঞান, উদ্ভাবন, পণ্য বিকাশ এবং এর বিশ্বব্যাপী আস্থা অর্জনে বাংলাদেশকে সহায়তা করতো?
৫. গণস্বাস্থ্যের কিট ব্যবহার করে তার পজিটিভ রেজাল্ট আসাটাকে তিনি কিটের যথার্থতা বলে প্রমাণ করছেন? তার পরীক্ষাটা কি তার কিটের ১১-৪০% সংবেদনশীলতার মধ্যে পড়তে পারে না?
আমি সবসময় আমার দেশের যে কোনও উদ্ভাবন এবং বিকাশের জন্য গর্ববোধ করি। উন্নত স্বাস্থ্য অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং সুশীল সমাজের কাছ থেকে বিশ্ব অনেক কিছু শিখতে পারে। আমি জানি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আন্তরিকতার সাথে বাংলাদেশকে মহামারী কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করার জন্য সর্বোত্তমভাবে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন। একইভাবে, চীন থেকে কাঁচামাল আনতে সরকার আন্তরিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং দ্রুত ও ব্যাপকভাবে এই কিট ব্যবহার করে কম খরচে বেশি সংখ্যক মানুষকে পরীক্কখার আওতায় আনার প্রত্যাশা করছিল।
দুঃখের বিষয়, সমস্ত কঠোর পরিশ্রম এবং আন্তরিক প্রচেষ্টা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দেয় নি! আমি বলব না যে এটি ব্যর্থতা। আমাদের সকলকে অবশ্যই একমত হতে হবে ভুল টেস্ট কিট কোনো সমাধান নয়। একটি ভুল টেস্ট কিট নির্বাচন করে সরকার মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তুলতে পারে না এবং জাতীয় অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে পারে না।
আমি জানি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন সরকার ‘অন্ধকার ঘরে একটি কালো বিড়াল’ ধরার চেষ্টা করছে। কেন এই জাতীয় মিডিয়া সেনসেশন বিজ্ঞান এবং এর বিধিবিধানের প্রতি সম্পূর্ণ অবহেলা করছেন! বিশ্বের অনেক সংস্থাই টেস্ট কিট তৈরিতে বিনিয়োগ করে এবং অনেক সময়ই সফল হয় না। মানসম্পন্ন অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট না থাকার কারণে যুক্তরাজ্য তার অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় অনেক বেশি বিলম্ব করেছে।
কোনো মিডিয়া সেনসেশন বা কেবল আত্মপ্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া কারও সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা উচিৎ নয়, যখন কিনা এর সঙ্গে জনগণের জীবন ও দুর্ভোগ জড়িত থাকে।
আমি একমত যে, ভুল হতে পারে। এ থেকে অবশ্যই শিক্ষা নেওয়া উচিৎ। একটি সুন্দর বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের অতীতের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে কোভিড -১৯ এর বিধ্বংসী অভিজ্ঞতা এবং বিশাল দুর্ভোগের বিষয়ে যা বলেছিলেন, আমি সেটাই এখানে তুলে ধরছি-
“আমরা আমাদের দেশে যা করেছি তাতে আমরা গর্বিত হতে পারি। অবশ্যই এই চ্যালেঞ্জটি আমাদের দুর্বলতা, অন্য অঞ্চলের উপর আমাদের নির্ভরতা প্রকাশ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর জটিলতা এবং আমাদের সামাজিক ও আঞ্চলিক বৈষম্যও সামনে নিয়ে এসেছে। আমি এই সমস্ত কিছু থেকেই শিক্ষা নিতে চাই।’
আমাদের সবারও কি এ রকম আত্মপোলব্ধি এবং বিনয় প্রকাশ করে আত্মপ্রচারণা এড়ানো উচিত নয়? আমাদের লক্ষ্য অবশ্যই স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন বাঁচানো। আমাদের চিকিৎসা পেশাজীবি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানীদেরও অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উপযুক্ত প্রমাণ দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।
ডা. চৌধুরী, স্বাস্থ্য ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আপনার অবদান উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ ও এদেশের জনগণের এখনও আপনাকে দরকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী! আমরা আপনার প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে চাই। আমি কোভিড -১৯ থেকে আপনার দ্রুত এবং সম্পূর্ণভাবে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছি।
লেখক: সিনিয়র স্পেশালিস্ট, লিভারপুল স্কুল অব ট্রপিকাল মেডিসিন, যুক্তরাজ্য।
সাবেক পরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
থাইল্যান্ড ও নামিবিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক প্রতিনিধি।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি
প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা
করবেন।
প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে
আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা
নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না
কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে
সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার
মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ
আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে
অনেকেরই ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী
লোক।
এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই
ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে
যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের
নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।
তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী
পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের
ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে
এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই
এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা
পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা
কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।
আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম।
সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা
দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের
একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায়
যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে
আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব
দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে
প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।
ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক
তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের
ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর
এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।
তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের
মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার
মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের
আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে
বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।
তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে
এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক
হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।