নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৩ জুলাই, ২০২০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের বাজেট অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘করোনায় আতংক নয়, বরং আত্মবিশ্বাস থাকা উচিৎ।’ তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ‘আমাদের মৃত্যুর আগে মরে যাওয়া উচিৎ হবে না।’ ‘বাংলা ইনসাইডারে’ প্রকাশিত আমার আগের ‘গুজব ছড়ানো এবং আতঙ্ক সৃষ্টি বন্ধ করুন’ মতামতে আমি এই বিষয়টিই বলেছিলাম যে, বাংলাদেশে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার, আতঙ্কিত নয়। যদি আমরা প্রত্যেকে একত্রে কাজ করি, তবে আমরা এই করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যেসব কারণে আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়, সেগুলো আমি এখানে একটু উল্লেখ করছি-
১. কোভিড-১৯ সম্পর্কে আমরা এখন অনেক কিছুই জানি
চীনের উহানে গুরুতর নিউমোনিয়া অস্বাভাবিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, এমন রিপোর্ট আসার ৭ দিন পর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিশ্ব প্রথম এই ভাইরাসটি সম্পর্কে জানতে পারে। এর তিন দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর এই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন পরীক্ষাগারে কোভিড-১৯ পরীক্ষার কিট, এই রোগ সংক্রমণের প্রকৃতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। আমরা জানতে পারি যে, এটা প্রাকৃতিক ভাইরাস এবং বাদুড়ে পাওয়া ভাইরাসের সাথে এর মিল রয়েছে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানতে বাংলাদেশেও এর জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে।
২. আমাদের নির্ভরযোগ্য কৌশল ও পরীক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে
অর্থনৈতিক নানা সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ করোনা সংকট নিরসনের প্রচেষ্টা হিসেবে পরীক্ষা করা, বিচ্ছিন্ন করা এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং এর কৌশল গ্রহণ করেছে। যদিও বাংলাদেশে শুরুতে আমাদের প্রতিটি জেলা বা হাসপাতালে পরীক্ষার সুবিধা ছিল না, খুব কম জায়গাতেই টেস্ট করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ দ্রুত পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষার সরঞ্জাম ও সুবিধার জালিয়াতির খবর পাওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশে এখন নির্ভরযোগ্য পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। তবুও এখনও অনেক কিছু করা দরকার। আমি বিশ্বাস করি, দেশব্যাপী সাধারণ জনগণের কাছে পরীক্ষার সুবিধা আরও সহজ করতে সরকার আরও বরাদ্দ দিচ্ছে। এটি বাংলাদেশকে বর্তমান মহামারীর পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেকোনো মহামারী প্রতিরোধে প্রস্তুত রাখতে পারবে। আমাদের মনে রাখা দরকার এবং গর্বিত হওয়া উচিৎ এজন্য যে, বাংলাদশের এখন ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় মৃত্যু ও দুর্যোগ প্রতিরোধের অনন্য সক্ষমতা রয়েছে। আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব এবং দূরদৃষ্টি আমাদের বর্তমান যুদ্ধেও করবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যে কোনও মহামারী প্রতিরোধেও আমাদের প্রস্তুত করবে।
৩. এটাকে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব
আমরা জানি প্রথম দিকে সব কিছু অবরুদ্ধ করলে সংক্রামক রোগের সংক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়। চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এর বড় প্রমাণ। তাদের কঠোর নেতৃত্ব এবং প্রাথমিক পর্যায়ে কঠোর পদক্ষেপের কারণে এই রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে তারা সফল হয়েছে। আমরা শুরুতে ইতালি থেকে আগতদের কোয়ারেন্টাইন করতে পারিনি। তাদের মাধ্যমে দেশে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভ্রমণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। চীন থেকে যারা ফিরে এসেছিল তাদেরও সফলভাবে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিল। সেই সাথে যেসব চীনা নির্মাণকর্মী ও কর্মকর্তারা বাংলাদেশে কাজ করছে, তারাও সরকারের সমস্ত নির্দেশ মেনে চলেছে। এজন্য আমাদের সবার উচিৎ তাদের ধন্যবাদ দেওয়া।
মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে, অনেক পশ্চিমা দেশ এবং ভারতের আগে, দেশব্যাপী লকডাউনের সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। আমাদের এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত এবং অনেক কথা থাকতে পারে তবে আমি দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি যে তাড়াতাড়ি লকডাউন ভাইরাসের তাৎক্ষণিক বিস্তৃতি ঠেকাতে এবং সংক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এর ফলে করোনা প্রতিরোধে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গিয়েছিল। এটি জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছিল।
এখন, সক্রিয় নজরদারি ব্যবস্থা চালু রেখে সীমিত আকারে সব খুলে দেওয়া হয়েছে। এলাকা ভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার ফলে সংক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকবে, আবার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়বে না। অর্থাৎ করোনা এবং অর্থনীতি সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে।
৪. মানুষ সচেতন হচ্ছে, ফলে সংক্রমণ সহজে বাড়ছে না
যদিও সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং জীবিকার কারণে অনেকেই লকডাউন ব্যবস্থা কঠোরভাবে অনুসরণ করা বা সামাজিক দূরত্ব অনুসরণ করতে পারেনি, তবুও আমাদের অবশ্যই বাংলাদেশের সাধারণ জনগণকে কুর্নিশ করা উচিৎ। কারণ সংকট থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগ মানুষ সরকারী পদক্ষেপ অনুসরণ করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক বাইরে যাওয়া সীমাবদ্ধ করছে। বেশিরভাগ মানুষই মসজিদে যাওয়ার বদলে বাসায় বসে প্রর্থনা করছে। এমনকি ঈদের সময়ও মানুষ ঘরে থেকেছে। অনেকে এ বছর কোরবানি পালন না করার বিষয়টিও বিবেচনা করছেন। বেশিরভাগ মানুষ, পরিবার, অফিস, শিল্পক্ষেত্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোনোর সময় মাস্ক ব্যবহার করছে। গণ জমায়েত এড়িয়ে চলছে। ফলস্বরূপ, আমরা দেখতে পাই, দৈনিক সংক্রমণের হার ১৯-২৪ শতাংশের মধ্যে রয়েছে এবং বাড়ছে না। অর্থাৎ সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এখন তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়ে পড়ছে। আমি আশা করছি, আগামী দিনগুলোতে সংক্রমণের হার ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
৫. বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষণগুলো মৃদু বা উপসর্গহীন হয়
চীনে করোনায় ৮০ শতাংশের বেশি সংক্রমণের ক্ষেত্রে খুব হালকা লক্ষণ বা একেবারে উপসর্গহীন ছিল। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ হয় উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত। এই পরিস্থিতি সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। কিন্তু যেহেতু এটা মানুষ ইতিমধ্যেইও জেনে গেছে এবং সচেতন হচ্ছে। সেভাবে তারা তাদের জীবন যাপন এবং আচরণও নিয়ন্ত্রণ করছে। আক্রান্ত ব্যক্তি উপসর্গহীন হতে পারে জেনে মানুষ আরও বেশি সচেতন হচ্ছে। এটা সংক্রমণ ছড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
৬. মৃত্যুর হার কম এবং সুস্থতার হার বেশি
বাংলাদেশে আশ্চর্যজনকভাবে গুরুতর ও জটিল রোগী এবং মৃত্যুর হার খুবই কম, যা মাত্র ১.১ -১.৪ শতাংশের মধ্যে। ইনফেকশন ফ্যাটালিটি রেট আরও কম। আমি মোটামুটি সাহস করে অনুমান করে বলতে পারি, এটা ০.৫ শতাংশের নীচে। সেই তুলনায় সুস্থতার হার অনেক বেশি, প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বা তারও বেশি। এটা জনগণের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে ওষুধসহ বিভিন্ন চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি বা কেনায় তেমন কোনো বিধি নিষেধ নেই। ফলে অনেকেই বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন, বাসায় বসেই ওষুধ পথ্য খাচ্ছেন এবং সুস্থও হয়ে উঠছেন। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অনন্য বলা চলে। কারণ অনেক দেশেই ওষুধপত্র, চিকিৎসা সামগ্রীতে নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধের কারণে এসব মানুষ চিকিৎসকের লিখিত অনুমতি ছাড়া বাসায় নিতে পারে না।
৭. ভ্যাকসিন তৈরিতেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
আমাদের অবশ্যই গর্বিত হওয়া উচিৎ এ কারণে যে, বিশ্বের অনেক দেশ যখন ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাচ্ছে, তখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজস্ব ভ্যাকসিন তৈরি করছে। এটা মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিমা দেশগুলোতে তৈরি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে বা অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশে কাজ করতে বা আসতে সময় লাগবে। অনেক পশ্চিমা দেশ ইতিমধ্যে তার নিজস্ব জনগণের জন্য সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের প্রি-অর্ডার করে ফেলেছে। এমনকি টাকাও পরিশোধ করেছে। বিশ্বব্যাপী ৭ বিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের জন্য আরও সময় এবং অর্থের প্রয়োজন। এ কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নাও পেতে পারে। এক্ষেত্রে সুখবর হলো ভ্যাকসিন তৈরির পথে বাংলাদেশও সাফল্যের সাথে এগিয়ে চলেছে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার এর উন্নয়ন ও উত্পাদনের জন্য সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় সকল সহায়তাও দিচ্ছে। খুব তাড়াতাড়িই হয়তো আমরা আমাদের নিজ দেশে তৈরি ভ্যাকসিন ব্যবহার করতে পারবো।
৮. করোনা চিকিৎসার ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে এবং এগুলো আরও কার্যকর করার কাজ চলছে
বিশ্বব্যাপী করোনা চিকিৎসার বিভিন্ন ওষুধ ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি ওষুধ অসুস্থতা নিরসনে কিছুটা সফলও হয়েছে। আর বাংলাদেশে ওষুধ উন্নয়ন ও উত্পাদনের অনন্য সক্ষমতা রয়েছে। তাছাড়া কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ ওষুধ অনেক কম এবং সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়। দেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ফলে এখন বেশিরভাগ বাংলাদেশী প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো খুব সহজেই কিনতে পারে। ফলে করোনা জটিল রোগীরা বিনা ওষুধে বা বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না।
এটা মনে রাখুন এবং গর্বিত হোন, কারণ এটা কেউ আর বলার সাহস পাবে না যে, বাংলাদেশ "তলাবিহীন ঝুড়ি"। সবাই এখন বাংলাদেশের সাফল্য দেখে শিখবে।
৯. বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ফলাফল বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হচ্ছে, খুব সহজেই এগুলো পাওয়া যাচ্ছে
এখন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুযোগ-সুবিধা এবং মানসম্পন্ন জিনিসপত্র রয়েছে। বিস্তৃত মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সুবিধার কারণে সাধারণ জনগণ খুব সহজেই বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও এর ফলাফল জানতে পারছে। বাড়িতে বসেই মানুষ এখন বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্য এবং মোবাইল অ্যাপস ব্যবহার করছে। এটা তাদের করোনা সম্পর্কিত তথ্যসহ বিভিন্ন তথ্য পেতে সাহায্য করছে। কিছু মানুষ বাদে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই অসত্য সংবাদের ব্যাপারে সচেতন এবং তারা এ ধরনের সংবাদ ছড়ায় না।
আমি শুনছি, অনেক পণ্ডিতরা বলছেন, সীমিত পরীক্ষার কারণে আমরা জানি না যে বাংলাদেশে করোনার প্রকৃত অবস্থাটা আসলে কী। এ বিষয়ে আমি আন্তরিকভাবেই বলতে চাই যে, প্রকৃত অবস্থার তথ্য দিয়ে আমরা কতটুকু, কী করতে পারতাম? সেই তথ্য কীভাবে আমাদের করোনার সংক্রমণ বন্ধ করবে? বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে করোনার সেই প্রকৃত অবস্থার তথ্য কীভাবে আমাদের দেশের মানুষের দুর্ভোগ এবং করোনায় মৃত্যু কমাবে?
উদাহরণস্বরূপ, তর্কের খাতিরে বলছি, বাংলাদেশ যদি আগামীকালের মধ্যে বড় অংকের টাকা খরচ করে ২ লাখ পরীক্ষা করে বলে যে, এর মধ্যে ৪০ হাজার আক্রান্ত। এদের মধ্যে বেশিরভাগই উপসর্গহীন বা মৃদু উপসর্গবাহী। এখন এই ৪০ হাজার লোকের আইসোলেশন, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা কীভাবে করবো?
আমরা জানি যে, আমাদের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বিস্তৃত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যা দরকার তা হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা, খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাওয়া, জনসমাবেশ এড়িয়ে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, করোনা পজিটিভ এবং উপসর্গযুক্ত মানুষের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বা সেলফ কোয়ারেন্টাইন কঠোরভাবে প্রতিপালন করা, মাস্ক ব্যবহার করা এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া।
আমাদের দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা হ্রাস করা এবং জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। মানুষের দুর্ভোগ কমানো এবং অর্থনৈতিক কষ্ট দূর করতে সরকারী যে প্রচেষ্টা তা অব্যহত রাখতে জনগণের সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। চারপাশের সবকিছুর ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধুমাত্র পরীক্ষা করা কার্যকর কোনো কৌশল নয়। তবে একটা কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা বাংলাদেশে খুব বেশি প্রয়োজন।
করোনা বাতাসের মাধ্যমেও ছড়ায়, এটা নিয়ে আজকাল ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এবং মানুষ আতঙ্কিতও হয়ে পড়ছে। যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, সচেতন হই, তাহলে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়াক বা বাতাসের মাধ্যমে ছড়াক, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং সচেতন হওয়া ছাড়া এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ বা আটকে রাখার কোনো উপায় আপাতত নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং প্রশংসিত। রোগব্যাধি, বর্তমানের পরিসংখ্যান, জনভোগান্তি এবং অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন তিনি। সবকিছু বিবেচনা করেই তিনি দূরদর্শী নির্দেশনা প্রদান করছেন। জীবন জীবিকার ভারসাম্য বজায় রাখতে তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। সম্ভাব্য সমস্ত রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখা এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ফলে করোনায় বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুহার যেমন কম, তেমনি ক্ষুধার জ্বালায় কোনো মৃত্যু ঘটছে না।
আতঙ্ক সৃষ্টি এবং অসত্য সংবাদ জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করবে, যা করোনা যুদ্ধে আমাদের পরাজিত করবে। মনে রাখবেন, মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে অনেক প্রচেষ্টা এবং সময়ের দরকার হয়। তবে এটাকে নষ্ট করতে কেবল কয়েকটি ভুয়া খবর, কয়েকটি মিথ্যা এবং কিছু দুর্নীতিই যথেষ্ঠ। সরকার সব জায়গায়, সমস্ত কিছু করতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিটা হচ্ছে একটা যুদ্ধ এবং সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই এই যুদ্ধে জয় পাওয়া সম্ভব।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:৫৯ এএম, ২৬ মার্চ, ২০২৪
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলছেন তারা তো ভোরে উঠেই আগে ভারতীয় টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ব্যবহার করি সবই তো ভারতীয় পণ্য। আমাদের বাজারে কোন জিনিস কিনতে গেলে তো ভারতীয় পণ্যটিই বেশি খুঁজি। তাহলে এখন কি আপনারা পেস্ট দিয়ে ব্রাশ না করে কয়লা ব্যবহার করতে চান? সেটা আপনারা করতে পারেন। কয়লার আজকাল দামও অনেক। আবার ঝামেলা হলো সহজে যাওয়া যায় না। সুতরাং সেটাও আপনাদের জন্য অসুবিধা।
কথায় আছে পাগলে কি না বলে ছাগলে কিনা খায়। সে ধরনের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি আপনারা দিয়ে দিলেন কোন কিছু না ভেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মধ্য দিয়ে আপনারা আরও রাজনৈতিক গহ্বরে ঢুকে গেলেন। এখন ভাবে ঢুকছেন সেখান থেকে আর কোন দিন বের হতে পারবেন কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখন বিশ্বের কোন দেশেরই নিজস্ব পণ্য বলে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে সবার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে আপনারা ভারতকে বর্জন করবেন কি করে। ভারত তো সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি দেশ। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। সে সময় আমাদের ৩০ লাখ সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এর সাথে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রক্ত ঝড়িয়েছেন। আামরা না হয় আমাদের দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি। কিন্তু ভারতীয়রা তো জীবন দিয়েছে প্রতিবেশির জন্য। সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের কন্ধনটা হলো রক্তের। রক্ত দিয়ে ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব আপনি পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ করবেন কি করে? বাসায় আপনার বউ থেকে শুরু করে বাসার কাজের মেয়ে সবাই ভারতের শাড়ি ব্যবহার করেন। তাহলে আগে তাকে বলবেন যে, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন।
রিজভী সাহেব বঙ্গবাজার থেকে একটি চাদর কিনে এনে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে একটা নাটক করেছেন মাত্র। বঙ্গবাজারে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় যেগুলো ভারতের নামে চলে। এটা আমরা জানি। রমজান মাসে ইফতারে আপনি পিয়াজু রাখছেন। এটা বাঙালিদের ইফতারের একটা ঐতিহ্য বলতে পারেন। এটা আমরা খাবই। কিন্তু পেঁয়াজ তো আসে ভারত থেকে। তাহলে এখন তো আপনাকে ইফতারে পিয়াজুও বাদ দিতে হবে। এভাবে আপনি কত বাদ দিবেন। অনেক সময় ভারত থেকে ঝড় আসে। সে সময় তাহলে বাতাসও আপনি নিবেন না। এটা বর্জন করবেন। এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভবই না হয় তাহলে পাগলের প্রলাপ বলে কি আর আন্দোলন হয়। পাগল তো তার নিজের ভালোটা বুঝে। আপনাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান দিন শেষে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই লাভবান করবে। কারণ আপনাদের আন্দোলনের কোন গন্তব্যই নেই। কোন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করলে জনগণের কাছে যেতে পারবেন সেটাও আপনারা বুঝেন না। আপনারা পড়ে আছেন ভারতরে পণ্য বর্জনের ডাক নিয়ে। ফলে জনগণের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এদিকে চাপা পড়ে যাবে। আর সরকারও মহা আরাশ আয়েশে চলবে। আমি জানি না, কোন উৎস থেকে টাকা পয়সা পেয়ে আপনারা নতুন করে এই স্লোগান শুরু করেছেন। কিন্তু আপনাদের এই ডাকে বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগই। কারণ আপনারা এবার বিএনপিকে দলগতভাবে কবরে নামানোর জন্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন।
মন্তব্য করুন
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে
এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত
হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের
সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
এ কথা সকলের কাছে পরিষ্কার যে, নয়মাসে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়া নিয়ে
কোনো বিতর্ক চলতে পারে না। কারণ রবার্ট পেইন তার Massacre, The Tragedy of
Bangladesh গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে- Kill three million of
them and the rest will eat out of our hands. পাকিস্তানি শাসকদের এই সিদ্ধান্তের কারণে
দৈনিক গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয় সারা বাংলাদেশে। এজন্য ১৯৭১ সালে মার্কিন সিনেটর
এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে
সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের
হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০২ সালে
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত
দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কূটনৈতিকরা সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার
বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা প্রেরণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা
একাধিক লেখায় এবং বিশ্বখ্যাত পত্রিকা টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস প্রভৃতির সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানিদের
গণহত্যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে গঠিত
‘হামাদুর রহমান কমিশন’ তাদের পরাজয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রমাণ পায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি
সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনে ঘটনার। আর এই ভয়ঙ্কর গণহত্যায় কেঁপে উঠেছিল
বিশ্ববিবেক। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। দার্শনিক
আঁদ্রে মালরোর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’। প্যারিস ও লন্ডনে সরব হয়ে ওঠেন
মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ব্যাপক এবং নিষ্ঠুরতার
দলিল হিসেবে আজও বিশ্বকে নাড়া দেয়।
আসলে বিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছে কোটি মানুষের প্রাণসংহার। বিশ্বযুদ্ধ
ও জাতিনিধনের সেই পরিকল্পিত ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’ অভিধা পেয়েছে। হিটলারের কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বন্দিশিবির সেই জেনোসাইডের নির্মম ইতিহাসের কথা
বলে। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে
লিখেছেন ‘সারা প্রদেশ জুড়ে হত্যাকাণ্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গণহত্যা
শব্দটির আভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে।’ তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানি
সেনা কর্মকর্তার মুখ থেকে জেনেছিলেন গণহত্যার লক্ষবস্তু ছিল- ক) বাঙালি সৈনিক, পুলিশ,
আনসার প্রভৃতি খ) হিন্দু সম্প্রদায় গ) আওয়ামী লীগের লোক ঘ) কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঙ) অধ্যাপক ও শিক্ষক যাঁরা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি এটাও লক্ষ
করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ছিল নির্বিচার। নিরপরাধ, সাধারণ মানুষকেও শত্রু হিসেবে
গণ্য করেছিল তারা। তাছাড়া তাদের গণহত্যা ছিল ‘শোধন প্রক্রিয়া’ যাকে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান বলে মনে করত। সেই সঙ্গে এই বর্বরোচিত উপায়ে প্রদেশটিকে উপনিবেশে পরিণত
করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পাকিস্তানিদের ভাষ্য ছিল- ‘বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে রক্ষা
করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য পবিত্র করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেজন্য
যদি বিশ লাখ লোককে হত্যা করতে হয় এবং প্রদেশটিকে তিরিশ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে শাসন
করতে হয়, তবুও।’ শাসকদের এ ধরনের মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমাংশের মানুষের ঐক্য ছিল। আর
এজন্যই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের
জনগণ হলেন গণহত্যার নীরব দর্শক।’
বাংলাদেশে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতাড়ন, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে তাদের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছিল। সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হয়েছে। হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যে বর্বরতা দেখিয়েছিল ঠিক একইরকম আচরণ ছিল পাকিস্তানিদের। নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছিল ঠিক ইহুদিদের প্রতি নাজিদের মতো। নাজিরা ইহুদিদের নিচুজাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত এবং তাদের নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিল। অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোভাব ছিল Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation. নাজিরা প্রথমে তরুণ, যুবক এবং সমর্থ পুরুষদের হত্যা দিয়ে নিধনযজ্ঞ শুরু করলেও শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের নির্বিচারে নিধন করতে থাকে ১৯৪১ সালে বলকান অঞ্চল থেকে। যুদ্ধবন্দি হত্যাসহ অন্যান্য নিষ্ঠুরতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় তারা। তাদের অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাদের আরো মিল রয়েছে হিন্দু নিধনের ঘটনায়। একাত্তরে হিন্দুদের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুচিন্তিত ও নির্মম।
কারণ তারা ধর্মভিত্তিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করে তুলেছিল। তারা মনে করত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলমানদের বিদ্রোহের কারণে। এই হিন্দু বিদ্বেষ মনোভাব বছরের পর বছর লালিত হয়ে এসেছে। এজন্য জেনোসাইডে হিন্দু নিশ্চিহ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জনৈক গবেষকের ভাষায়- ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর গোটা দেশে কেবল একটি উদীয়মান ও অস্তগামী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি একাধিক জাতিগত দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। এতে উভয়পক্ষের নির্যাতন শুরু হয় তবে এর সূত্রপাত ঘটে ২৫শে মার্চের আক্রমণের পর। পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনার শিকার হয় দুই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। এর প্রথম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়, যাদের কেবল নির্যাতন করা হয়নি বরং তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসও করা হয়। হিন্দুরা তাদের হৃত অবস্থান কোনদিন উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশেও। সম্প্রদায়গতভাবে তারাই ১৯৭১ সালের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।’ এমনকি ধর্ষণকেও তারা বৈধ বলে মনে করত। চীনের নানকিং-এ জাপানি সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, রাশিয়াতে নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়া ও বসনিয়ার নারী নির্যাতনের সাযুজ্য রয়েছে বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনায়। পাকিস্তানিদের বাঙালি নারী ধর্ষণের লক্ষ ছিল পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে পরাজিত ও বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে না পারার যাতনা তারা মিটাত নারী ধর্ষণ করে। এটা ছিল ভয়ঙ্কর মনোবিকারজাত। সার্বরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ইথনিক ক্লিনজিং-এর উপায় হিসেবে। দেশ-বিদেশী গবেষক ও সাংবাদিকদের রচনায় যুদ্ধকালীন এসব নির্মম বাস্তবতাই উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ শতকের জেনোসাইডের তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের
নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে
চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর
কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও
নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের
আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায়
বিদ্বেষ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের
২৫ মার্চের দাবিকে আরো বেশি তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’
হবে পৃথিবীর মানব জনগোষ্ঠীকে নির্মম নিধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চকণ্ঠ এবং
হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র ভরসার দিন। আশা করা যায় এই
দিবসের চেতনা গণহত্যার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সবচেয়ে জরুরি। চিকিৎসার যদি উন্নতি না হয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার যদি উন্নতি না হয়, মানুষ যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে দেশ গড়া সম্ভব নয়। সেজন্য বঙ্গবন্ধু একটা সুন্দর নীতিমালা পরিকল্পনা গড়ে তোলেন। ওই সময়ই সেটা ছিল আধুনিক যুগোপযোগী এবং বিজ্ঞানসম্মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বঙ্গবন্ধু যে নীতিমালা তখন চালু করে গিয়েছেন সেই পদ্ধতিতে আজকের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একে এক করে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছেন।
সাম্প্রতি ‘স্বাধীনতা সুফল পেতে চাই চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা জাতির পিতার হাতে সূচনা, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দিলেন দিক নির্দেশনা’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিপ্রেক্ষিতের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর। বৈঠকে আলোচক হিসেবে অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন যে আলোচনা করেছেন তার চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হলো।