নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪:৫৯ পিএম, ১৪ অক্টোবর, ২০২০
কয়েক সপ্তাহ আগে নামিবিয়ার জাতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে আমার কাছে একটি ফোনকল আসে। ওখানে আমি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কাজ করতাম। বলতে গেলে এ বছর সেখানে কারো কোনো মৌসুমী অসুখ-বিসুখই হয়নি। রেডিও কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে আমার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাইলো। দক্ষিণ আফ্রিকায় শীতে প্রতি বছর ১০,০০০ এর বেশি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। কিন্তু এ বছর রোগীর সংখ্যা ছিল খুব অল্প। অস্ট্রেলিয়ায় মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। গত বছর সেখানে ৩ লাখ দশ হাজার রোগী শনাক্ত হয়, আর মারা যায় ৪৩০ জন।
ন্যাশনাল নটিফিয়েবল ডিজিস সারভেইল্যান্স সিস্টেম জানিয়েছে এ বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে ৩৬ জন মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা এটা দেখে হতবাক। তারা মৃত্যুহার এতটা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, মাস্কের ব্যবহার বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, এবং ভ্যাক্সিনের ব্যবহার বাড়ানোর কারণে কি মৌসুমী ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার হার কমেছে ? হতেও পারে।
বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ ও ডাক্তাররা আসন্ন শীতে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়তে পারে ভেবে চিন্তিত। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে বলেছেন। এটা খুবই ভাল লক্ষণ। আমি সাক্ষাৎকারে নামিবিয়ার সরকারকে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে যেকোনো জরুরী অবস্থার মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে বলেছি।
ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। যুক্তরাজ্য, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। সেখানকার হাসপাতালগুলো রোগীর চাপে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ফ্রান্সের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যকর্মী সেবা দিতে দিতে ক্লান্ত। নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগ এবং ঠিকমতো দেখভাল করায় মৃত্যুহার আগের চেয়ে কমেছে। যুক্তরাজ্য এখনও করোনা শনাক্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশটির দীর্ঘদিনের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় ?
অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে কথা বলছেন। আমাদের এখানে কি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে, না এখনও প্রথম ঢেউই চলছে, নাকি প্রথম ঢেউয়ের সাথেই দ্বিতীয় ঢেউ মিশে গেছে ? যা-ই ঘটুক, ১০-১২ শতাংশ আক্রান্তের হার সংক্রমণের ব্যাপকতাকে ইঙ্গিত করে। অতিরিক্ত জনসমাগম, অফিসে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অপর্যাপ্ততা, সামাজিক দূরত্ব মেনে না চলা, এবং ঘরের বাইরে মাস্কে ব্যবহার না করায় সংক্রমণের হার কমছে না।
করোনায় সংক্রমণের ফলে তেমন জটিলতা না হওয়ায় এবং মৃত্যুহার কম থাকায় মানুষের করোনা নিয়ে উদ্বেগ কমেছে। এর চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হওয়ায় অনেকে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে। আমি নিশ্চিত তরুণ এবং অল্পবয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে উপসর্গবিহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত সংক্রমণের হার উচ্চ থাকায় তা ব্যাপক মাত্রায় কমিউনিটি সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
র্যান্ডমাইজড এন্টিবডি টেস্টের ফলাফল থেকে জানা গেছে, ঢাকার ৪৫ শতাংশ মানুষ এবং ৭৫ ভাগ বস্তিবাসী ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪৫ ভাগেরই কোনো উপসর্গ ছিল না। বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকাগুলো কি হার্ড ইমিউনিটির দিকে আগাচ্ছে, নাকি ইতোমধ্যে সেখানে পৌঁছে গেছে?
জনগণের দেশজুড়ে অবাধ যাতায়াতে গ্রামের মানুষও হার্ড ইমিউনিটির দিকে আগাতে পারে। এ খবরে খুশি হওয়ার কিছু নেই। সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার করা, এবং হাত ধোয়ার মত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করতে সরকারের পাশাপাশি রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটি ও এনজিওগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা এসব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে কোভিড-১৯ এবং আসন্ন শীতের মৌসুমী রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারব।
এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কিছু বলি
১.
আমার এক বন্ধুর ছেলের স্ত্রী সন্তানসম্ভাবা। সে গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস পার করছে। কিছুদিন আগে সে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় চিন্তিত ছিল। তার স্বামী পরামর্শের জন্য কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরেও কোনো চিকিৎসা পায়নি। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় কোনো হাসপাতালই তাকে ভর্তি করতে চায়নি। শেষমেশ তার এক বন্ধুর সহযোগিতায় একটি প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ হয়। আল্ট্রাসনোগ্রামসহ প্রয়োজনীয় সব টেস্টের রিপোর্ট স্বাভাবিক আসায় তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তাকে পর্যবেক্ষণের জন্য কিছুদিন হাসপাতালে রাখা হয়েছিল।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মার্চে লকডাউনের শুরু থেকেই বাসা থেকে কাজ করতো এবং কেনাকাটাও করতো অনলাইনে। সে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসেনি, আর তার কোনো উপসর্গও ছিল না। এরপরও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার করোনা টেস্টের রিপোর্ট ছাড়া তার স্ত্রীকে চেকআপ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় দুজনেই টাকা খরচ করে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য রাজি হয়। কাউকে সেবা দিতে অস্বীকৃতি না জানানোর ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্পষ্ট নির্দেশনা আছে।
একবার ভাবুনতো যে মহিলার পয়সা খরচ করে করোনার টেস্ট করানোর সামর্থ্য নেই, ফ্রিতে টেস্ট করানোরও সুযোগ নেই, সে যদি গর্ভাবস্থায় কোনো মারাত্মক জটিলতায় পড়ে সেবা না পায় তার কি হবে। সে কিংবা তার অনাগত বাচ্চা চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে পারে। অনেক দেশেই দেখা যায় সন্তানসম্ভাবা মহিলারা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে হাসপাতালে যান না। আবার হাসপাতালে গেলেও ডাক্তার, নার্সরা করোনার ভয়ে তাদের কাছে ঘেঁষে না। যুক্তরাজ্যে ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং হার্টের অসুখে আক্রান্ত অনেক রোগীই হাসপাতালে যায় না।
ধারণা করা হচ্ছে, এ কঠিন সময়ে বিশ্বজুড়ে প্রসূতি এবং নবজাতকের মৃত্যু আগের চেয়ে বাড়তে পারে। মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কেউ যেন মাতৃত্বকালীন সেবা থেকে বঞ্চিত না হয়। হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের এ সংক্রান্ত সকল নির্দেশনা জানানোর দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। স্বাস্থকর্মীদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা এবং অনিচ্ছার কারণে কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেয়ার মাধ্যমে স্বাথ্যখাতে অর্জিত সফলতাগুলো আমরা ধূলায় মিলিয়ে যেতে দিতে পারি না। স্বাস্থ্যকর্মীরা সেবা দেয়ার সময় যাতে করোনায় আক্রান্ত না হয় সে দিকটি নিশ্চিত করার জন্য স্বাথ্য মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে।
২.
জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদরদপ্তরে নিরাপদ গর্ভধারণ (মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য) নিশ্চিতকরণ নামে একটি বিভাগের পরিচালক থাকাকালীন আমাকে সপ্তাহব্যাপি একটি মিডিয়া ট্রেনিং-এ যেতে হয়েছিল। ক্যামেরা অন করে শুরুতেই প্রশিক্ষক আমাকে বিশ্বজুড়ে মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছিল। প্রসূতি ও নবজাতকের উচ্চ মৃত্যুহার, সাফল্য, ব্যর্থতা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার ব্যাপারে আমার বিভাগের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এরপর তারা আমাকে বাসায় গিয়ে ভিডিওটি দেখতে বলে যাতে আমি নিজের বক্তব্যের ভালো-মন্দ বিচার করে পরদিন আবার প্রস্তুত হয়ে আসতে পারি। নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে গণমাধ্যমের আধুনীকায়ন ঘটেছে এবং জনগণেরও বিভিন্ন বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান আগের চেয়ে বেড়েছে। আমাদের মন্ত্রী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা দেখে আমি হতবাক। যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমের সামনে কথা বলা বন্ধ করতেন তাহলে কতই না ভালো হত!
বাংলাদেশের জনগণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মত চিকিৎসা পাচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য পড়ে আমি হাসি থামাতে পারিনি। বাংলাদেশের কাছে রিজেনারন্সের মনোক্লোনাল এন্টিবডি ড্রাগআছে কিনা আমার জানা নেই। গবেষণার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১০ জনের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। আর ট্রাম্প তাদের মধ্যে একজন। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স পাওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট পদাধিকারবলে তিনি ওষুধটি নিয়েছেন। এছাড়াও মন্ত্রী হাসির খোরাক যোগানোর মত অনেক কথাই বলেছেন। তার অসংলগ্ন কথাবার্তা সরকারের অর্জন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে ম্লান করেছে। সব মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল কর্মকর্তারই কিভাবে গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে হয় সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেয়া প্রয়োজন। আর না হয় তারা কথা কম বলুক বা চুপ থাকুক।
৩.
এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের সনদ দেয়ার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ফেসবুক হাস্যরসাত্মক ভিডিও ও ট্রোলে সয়লাব। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে বলেছিল তারা। এর ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হয়ে তাদের হোস্টেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে শুরু করে। শুধু তাদের বাবা-মাকেই নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে গেটের সামনে রেখে আসার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থীকে বড়দিন না আসা পর্যন্ত সেখানে থাকতে হতে পারে। যেখানে অনলাইন ক্লাসেই পাঠদান করানো হচ্ছে সেখানে কেন তাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার কথা বলা হলো এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে। এটা কি সত্যিই ছাত্রছাত্রীদের ভালোর জন্যে করা হয়েছিল, না কি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টিউশন ফি এর ব্যাপারে আইনি জটিলতা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?
যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকরা তাদের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের পড়াশুনার জন্য বছরে প্রায় ১১ হাজার ইউরো খরচ করে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের এর দ্বিগুণ টাকা পরিশোধ করতে হয়। যুক্তরাজ্যের এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরকে আমি শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে নিয়ে অনলাইন ক্লাস করানোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিকে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন, আর সেজন্যই তারা এটা করছে।
আমরা কি খেয়াল করেছি যুক্তরাজ্য সরকার পরীক্ষা নেয়া ছাড়াই শিক্ষকদের আগের মূল্যায়ণের ওপর ভিত্তি করে জিসিএসই এবং অন্য সনদগুলো শিক্ষার্থীদের প্রদান করেছে ? আমি মনে করি বাংলাদেশের পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্তটি সঠিক। প্রায় ২৬ লক্ষ শিক্ষার্থীকে বদ্ধ ছোট ক্লাসরুমে বসিয়ে এ সংকটের সময় দিনের পর দিন পরীক্ষা নেয়ার কোনো মানেই হয় না। আমরা এ নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে পারি, তবে সেইসাথে আমাদের অবশ্যই এর বিকল্প একটি উপায় সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করার দরকার আছে।
৪.
ধর্ষণ সব সমাজেই ঘৃণিত একটি অপরাধ। আমাদের সবাইকেই এর নিন্দা করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। দিনের পর দিন ধরে এমন হতে দেয়া যায় না। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সমাজকে ধর্ষণ বন্ধে আরো কঠোর হতে হবে। এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে এবং সরকার ও সমাজের টনক নড়াতে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে এবং অনশন কর্মসূচি পালন করছে। এগুলো শুভ লক্ষণ। রাজনোইতিক উদ্দেশ্যে কিছু অসাধু রাজনীতিবিদের এ বিষয়টির অপব্যবহার আমাকে ব্যথিত করেছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরির মত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ধর্ষণের ইস্যুর সাথে অন্য বিষয়গুলো মিলিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের সুযোগ খোঁজা সত্যিই দুঃখজনক।
কয়েকজন নারীর প্ল্যাকার্ডে ‘আমরা ধর্ষিতা হতে প্রস্তুত’ এমন অশালীন বাক্য লিখে সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেয়া আমাকে ব্যথিত করেছে। কয়েকজন মন্ত্রী দেশের ধর্ষণের কারণ হিসেবে পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করেছেন। তাদের এমন অসংবেদনশীল আচরণে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছি। আমি তাদের অনুদ্রোধ করছি, দয়া করে ধর্ষণের মত ঘৃণিত অপরাধ নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা না বলে এবার থামুন। আপনার পরিবারের নারী সদস্যদের কথা ভেবে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের ধর্ষণের মামলা নিতে অনীহা এবং ধর্ষককে গ্রপ্তার করার পরও ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন দেয়ার প্রবণতা আমাকে খুব পীড়া দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় থাকাকালে আমরা বিভিন্ন দেশে যৌন হয়রানির কারণগুলো নিয়ে গবেষণা করতাম। আমরা দেখতাম বেশিরভাগ ঘটনায়ই মেয়েরা তাদের খুব কাছের আত্মীয় দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। সামাজিক ও সংস্কৃতিগত কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও পরিবারের লজ্জার কথা ভেবে অনেক মেয়ে এবং তাদের পিতামাতা এ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা না বলে গোপন রাখেন। এ কারণে আমরা ঘটনার প্রকৃত মাত্রা জানতে পারি না। কোনো মেয়ে বা তার বাবা-মা এ বনিয়ে কথা বলার জন্য এগিয়ে আসলে আমাদের অবশ্যই বিষয়টিকে সংবেদনশীলভাবে দেখতে হবে। এটা সহজ কোনো কাজ নয়। এর জন্য অনেক সাহসের প্রয়োজন। আমাদের অবশ্যই তাদের পাশে থাকা উচিৎ। প্রধানমন্ত্রী নারীর সম্মান রক্ষায় ও ক্ষমতায়নে কতটা সচেষ্ট তা আমি জানি। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য কেউ যেন তা লুণ্ঠন করতে না পারে তা নিশ্চিতে এবং ধর্ষণ বন্ধে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।
প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. হকের লেখা একটি প্রবন্ধ আমি পড়েছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত থাকাকালীন আমি তাঁর সাথে কাজ করেছি এবং তাঁকে খুব ভালো করেই চিনি। তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। তাঁর সাথে কাজ করে আনন্দ পেয়েছি। রুহুল হোক তাঁর প্রবন্ধটিতে বেশি বেশি করোনা টেস্টের কথা বলেছেন। বাংলাদেশে অধিক হারে করোনা টেস্ট করানোর প্রয়োজনীয়তার কথা আমি নানা জনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে শুনেছি। পিসিআর টেস্ট ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য এন্টিজেন টেস্ট পিসিআর টেস্টের মত নির্ভুল না হলেও বেশ নির্ভরযোগ্য। এ পরীক্ষা অল্প সময়ে যেকোনো জায়গায়ই করা যায়। খরচও খুব বেশি না। সম্প্রতি গ্রীসের নতুন শরণার্থী শিবিরগুলোতে অল্প কয়েকদিনে কয়েক হাজার করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এর ফলাফলও পাওয়া গেছে মাত্র ৩০ মিনিটে।
এন্টিবডি টেস্ট সংক্রমণের মাত্রা বোঝার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। এ পদ্ধতিতে কোন শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত তা সহজেই বের করা যাবে। এর মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা যথোপযূক্ত ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আমি আগেই বলেছিলাম কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং আইসোলেশন সুবিধা নিশ্চিত না করতে পারলে শুধু করোনা টেস্ট বাংলাদেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন, দুর্ভোগ এবং মৃত্যুহার কমাতে পারবে না। ভারতেও প্রতিদিন হাজার হাজার পরীক্ষা করে একই কারণে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণ কমানো যায়নি। এমন সুযোগ সুবিধা পর্যপ্ত পরিমাণে না থাকায় অথবা অধিকাংশ জনগণ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় তা করা সম্ভব হচ্ছে না। কোভীড-১৯ এর সংক্রমণ হ্রাস ও মৃত্যুহার কমানো এবং অর্থনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন ও ক্ষুধা দূরীকরণে বাংলাদেশের একটি ভারসাম্যপূর্ন কৌশল প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে ভালোভাবে অবগত আছেন এবং তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি
প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা
করবেন।
প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে
আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা
নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না
কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে
সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার
মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ
আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে
অনেকেরই ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী
লোক।
এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই
ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে
যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের
নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।
তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী
পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের
ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে
এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই
এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা
পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা
কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।
আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম।
সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা
দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের
একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায়
যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে
আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব
দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে
প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।
ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক
তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের
ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর
এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।
তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের
মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার
মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের
আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে
বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।
তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে
এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক
হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।