নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ০৮ মে, ২০২১
করোনা ভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারীতে প্রত্যেকটি দেশের জনজীবন এখন বিপর্যস্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মার্চ ১১, ২০২০ তারিখে এ বৈশ্বিক মহামারীর ব্যাপকতা সম্পর্কে ঘোষণা দেয়। এর মাত্র ১২ মাসের মধ্যে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার এবং বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়। এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশাল অগ্রগতির এক অনন্য নজির। বিশ্বের অনেক দেশ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিকা উদ্ভাবন ও পরীক্ষামূলক কাজে লিপ্ত। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেক, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, রাশিয়ার স্পুটনিক, চীনের সিনোভ্যাক্স, সিনোফার্ম (বেইজিং), সিনোফার্ম (উহান) এবং ভারতের কোভ্যাকসিন এ আটটি টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কিন্তু টিকার এ প্রয়োগের মধ্যেও দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশের মানুষের কাছে এ মহাপ্রতিষেধক থেকে যাচ্ছে প্রায় অধরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীর ৭০% মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য ১১০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। এর মধ্যে ৮৬০ কোটি ডোজ উৎপাদন ও ক্রমান্বয়ে সরবরাহের তথ্য নিশ্চিত হয়েছে। তবে আশঙ্কাজনক তথ্য হচ্ছে এর ৬০০ কোটি ডোজ যাবে উন্নত ও উচ্চ আয়ের দেশে। দরিদ্র ও নি¤œ আয়ের দেশের মানুষের জন্য টিকা সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রায় নেই, যেখানে পৃথিবীর ৮০% লোক বাস করে।
টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ চলছে এ আশার মধ্যেও তাই হতাশার সুর ও মৃত্যুর আশঙ্কা। আশঙ্কার কারণ হচ্ছে মেধাস্বত্ব ও প্রযুক্তি হস্তান্তরে প্রতিবন্ধকতা, আর তাই উন্নয়নশীল দেশের কাছে টিকা না পৌঁছানো। যাকে বলে Vaccine Divide বা টিকা বৈষম্য। কোন আবিস্কারের জন্য উদ্ভাবকের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রয়োজনে মেধাস্বত্বের সৃষ্টি। ইতালিতে ১৪২১ সালে সর্বপ্রথম প্যাটেন্ট সম্পর্কিত মেধাস্বত্ব প্রদানের ব্যবস্থা শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে TRIPS (Trade Related Aspects of Intellectual Property Rights) এর প্রয়োগ শুরু না হওয়া পর্যন্ত মেধাস্বত্বের আন্তর্জাতিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা বাধ্যবাধকতা ছিল না। এ সময় সকল উন্নত দেশ একে অন্যের প্রযু্িক্ত ও উদ্ভাবন আয়ত্ব করেছে মেধাসত্বের বাধা ছাড়াই। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের অর্থনৈতিক বিপর্যয় উত্তরণে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় শুল্ক ও অশুল্ক বাধাসহ অন্যান্য বাধা দূরীকরণের জন্য ১৯৪৮ সালে GATT (General Agreement on Tariffs and Trade) প্রতিষ্ঠা করা হয়। GATT নামক চুক্তি থেকে জাতিসংঘের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) নামক একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৯৫ সালে জন্মলাভ করে। সে সময় কঠিন শর্তাবলী সম্বলিত মেধাস্বত্বের TRIPS চুক্তি প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও উন্নত দেশসমূহের প্রভাবে প্রণীত ও স্বাক্ষরিত হয়। মেধাস্বত্ব সম্পর্কিত TRIPS-এর কঠিন শর্তাবলীর কারণেই তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে টিকা উৎপাদন ও প্রাপ্তিতে আছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা।
এ কারণে অক্টোবর ০১, ২০২০ তারিখে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষকে টিকা না দেয়া পর্যন্ত কোভিড টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিকট আবেদন করে। বিশ্বের শতাধিক দেশ এ আবেদনে সমর্থন করে। নোবেল পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীসহ বিশ্বের ১৭০ জন বিজ্ঞানী টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িক স্থগিতকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের জন্য একইভাবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় আবেদন করে। `The People’s Vaccine Alliance’ মেধাস্বত্ব ছাড়ের প্রস্তাবে সমর্থন দেয় এবং সমর্থন আদায়ে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ অনেক দেশকে অনুরোধ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগতিশীল ১০ জন সিনেটর এ টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিতকরণের প্রস্তাবে সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাননীয় প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ করেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ডিসেম্বর ০৩, ২০২০ তারিখে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৩১তম বিশেষ অধিবেশনে বৈশ্বিক করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে ০৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন এবং তা হচ্ছে মানসম্পন্ন টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত সক্ষমতা তৈরি, টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তর (TRIPS-এর ৬৬.২ ধারা) এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত এপ্রিল ২০, ২০২০ তারিখে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে একইভাবে করোনা ভাইরাসের টিকাকে মেধাস্বত্ববিহীন ‘Global Public Goods’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া এবং এ বৈশ্বিক মহামারী উত্তরণে সম্মিলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেন।
করোনা ভাইরাসের টিকার মেধাস্বত্ব সম্পূর্ণ বা স্বল্পকালীন সময়ে কার্যকর না করার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রবল দাবি ও প্রস্তাব উঠলেও কোন নেই। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাব বিগত ০৬ মাসে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার জেনারেল কাউন্সিলে আলোচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপিত হয়নি। বিশ্বের কিছু ধনী দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং এমনকি করোনা বিপর্যস্ত ব্রাজিল মেধাস্বত্বের প্রয়োগ স্থগিত রাখার প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। সাথে আছে বিশেষ নামকরা ওষুধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সংগঠন International Federation of Pharmaceutical Manufactures Associations (IFPMA), আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ও কিছু মেধাস্বত্বের আইনজীবী। তাদের যুক্তি হচ্ছে মেধাস্বত্বের কারণে গবেষক ও বিনিয়োগকারী গবেষণা ও বিনিয়োগে উৎসাহিত হন এবং এ ধারাবাহিকতা প্রজন্মান্তরে গবেষণায় ও নিত্য নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে। মেধাস্বত্ব এখানে সাময়িকভাবে স্থগিত হলে ভবিষ্যতে এরূপ বৈশ্বিক মহামারীর টিকা, ওষুধ বা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে আগ্রহ কমবে, যা খুবই মারাত্মক ও আত্মঘাতী হবে।
কি অকাট্য ও অমানবিক যুক্তি! মনে হয় এরূপ মহামারী প্রতি দশকে আসে। চতুর্দশ শতকে বিউবোনিক প্লেগ রোগে (১৩৪৬-১৩৫৩) ০৮ বছরে ইউরোপের প্রায় ২০ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল, যার কারণে একে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। এর টিকার প্রয়োগ শুরু হয়েছে ৫৩০ বছর পরে ১৮৯০ সালে। দ্বিতীয় বৈশ্বিক মহামারী স্প্যানিশ-ফ্লু হানা দিয়েছে ১৯১৮-১৯২০ সময়কালে। বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোককে (প্রায় ৫০ কোটি) আক্রান্তকারী এ বৈশ্বিক মহামারীতে প্রায় ০৫ কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছে। আর এ স্প্যানিশ-ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়েছে ১৯৪০ সালে। উভয় ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন, মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের প্রয়োগ ও কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে এ রোগের মহামারী কমেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির কারণে মাত্র ১২ মাসের মধ্যে টিকা আবিষ্কার ও প্রয়োগ হচ্ছে। অথচ মেধাস্বত্ব ও প্রযুক্তির অভাবে তা সকলের কাছে যাচ্ছেনা, বাড়ছে বৈষম্য ও মৃত্যু। বিপন্ন মানবতার চেয়ে মেধাস্বত্বের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার মূল্য কি অনেক বেশি?
TRIPS-এর শর্তাবলী কঠিন হলেও চুক্তির ৩০ ও ৩১ ধারায় কিছু সুযোগ রাখা হয়েছে, যদিও তা বাস্তবায়নে বিঘœ অনেক। যেমন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য ওষুধ প্রস্তুতে জানুয়ারি ০১, ২০৩৩ তারিখ পর্যন্ত মেধাস্বত্বের প্রয়োগ হবে না। একই সঙ্গে চুক্তির ৬৬.২ ধারায় স্বল্পোন্নত দেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর করার বিধান আছে। বাংলাদেশ চাহিদার প্রায় ৯৭ ভাগ ওষুধ উৎপাদন করে এবং ১৫০টির বেশি দেশে রপ্তাণি করে। প্রযুক্তি পাওয়া গেলে এদেশেই এ টিকা উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু প্রযুক্তি সহজে কেউ দেয়না, কারণ ঐ মেধাস্বত্ব ও মুনাফা। TRIPS চুক্তির ৩১ (এফ) ধারায় কোন দেশে জরুরি প্রয়োজনে Compulsory License প্রদান করে মেধাস্বত্বের প্রয়োগ ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু ভারত ২০১২ সালে Bayer-কর্তৃক উদ্ভাবিত ক্যান্সারের ওষুধ এ পদ্ধতিতে প্রস্তুত করায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েছিল। TRIPS চুক্তিতে Voluntary License-এর আওতায় পারস্পারিক সম্মতিতে উৎপাদনের সুযোগ আছে। এরূপ চুক্তির মাধ্যমে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা তৈরি করছে। এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবকের শর্তাবলী মেনে চলতে হয় এবং এরূপ চুক্তিতে স্বার্থ বা মুনাফার প্রশ্ন বেশি থাকে, মানবতা নয়। ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে সেরাম এখন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার সাথে চুক্তি বা বাংলাদেশসহ যেসব দেশে টিকা সরবরাহের চুক্তি করেছিল তাদের কাউকে টিকা সরবরাহ করতে পারছে না। বরং নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে রাষ্ট্রীয় খরচে সেরামের টিকা উৎপাদন ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করে ভারতে ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে তাদের টিকা সরবরাহের মহাসুযোগ ছিল। যাহোক, মেধাস্বত্বের প্রয়োগের পাশাপাশি এরূপ নিষেধাজ্ঞাও এখন টিকা সরবরাহে হুমকি। ইতালি কর্তৃক অস্ট্রেলিয়ায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রপ্তানিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভারতে টিকার প্রয়োজনীয় উপাদান রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা বা সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা সবই বিপন্ন মানবতাকে আরও বিপন্ন করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন ইমিউনাইজেশন ও কয়েকটি উদ্যোগী সংস্থার সাথে সৃষ্ট উদ্যোগ “কোভ্যাক্স” ২০০ কোটি ডোজ টিকা ২০২১ সালের মধ্যে সংগ্রহের প্রচেষ্টা নিয়েছে। ইতোমধ্যে ১০০ কোটি ডোজের নিশ্চয়তা পেয়েছে। ইতোমধ্যে ফাইজার কোভিড রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধ তৈরি করেছে, যা এ বছরের শেষে বাজারে আসবে। তবে সে ক্ষেত্রেও সংকট থাকবে- কারণ ওই মেধাস্বত্ব। ইতোমধ্যে বেশিরভাগ দেশে টিকা সংকট শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী এ সংকট চলতে থাকলে বিশ্বের ৭৫টি দেশ টিকা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে, আর ১১৫টি দেশের জনগণকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এ জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডাইরেক্টর জেনারেল জরুরি ভিত্তিতে উন্নয়নশীল দেশে টিকা দ্রুত উৎপাদনের প্রস্তাব করেছেন। এজন্য প্রয়োজন মেধাস্বত্বের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিতকরণ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর। দুটোরই বিধান আছে TRIPS-এ, কিন্তু প্রয়োগ নেই। সেজন্য কোভিড টিকার মেধাস্বত্ব সাময়িকভাবে স্থগিত করা এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের সক্ষম দেশে টিকা উৎপাদনে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরি।
ড. মিহির কান্তি মজুমদার, সাবেক সচিব।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৯ মার্চ, ২০২৪
বর্তমানে জামায়াত-বিএনপি এবং চরমপন্থী ডান এবং বাম এরা সবাই এক হয়ে গেছে। তারা প্রকাশ্যে এক হয়েছে কি হয়নি এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তাদের কাজকর্ম দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা এক হয়েছে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর চরম আঘাত আনার চেষ্টা করবে। এজন্য তাদের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি আইএসআই থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা সবই তারা পাবে। বিদেশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিও তাদের টাকা পয়সা দেবে। দেশেরও বেশ কিছু ব্যবসায়ী তাদের দুকূল রক্ষার জন্য রাখার জন্য টাকা পয়সা দেবে। সুতরাং কোন দিক থেকে তাদের কোন অভাব হবে না। তারা এবার আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে গুছিয়ে আন্দোলন শুরু করবে। আর এই কারণে তারা এখন ভারত বিরোধী স্লোগান তুলেছে। এই ভারত বিরোধী স্লোগান তোলার পিছনে শুধু বিএনপি-জামায়াত বা চরমপন্থী বাম কিংবা ডানরাই আছে এমন না, এর সাথে বাইরের শক্তিও জড়িত।
মনে রাখতে হবে, এই শক্তি যদি কিছুটা শক্তিও ধারণ করে সেটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যারা আছে তাদেরকে অবিলম্বে একতাবদ্ধ হতে হবে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রকারী এবং ধর্মান্ধ ও চরমপন্থীদের প্রতিহত করার জন্য। আর এ ক্ষেত্রে আমি বলবো আওয়ামী লীগকেই এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে হবে, যেমনটি আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে দিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টিকেও আমি আহ্বান করবো তারাও যেন এই জোটে এক হয়ে যায়। তবে আওয়ামী লীগকে এখানে বদান্যতা দেখাতে হবে। বাম দলগুলোর কার কত ভোট কিংবা জনসমর্থন এটা মূল বিষয় হওয়ার উচিত নয়। এখানে উচিত চরমপন্থীদের প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে এক হতে হবে। এই উদ্যোগ নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এই মুহূর্তে এই দায়িত্ব দার্শনিক রাষ্ট্রনায়নক শেখ হাসিনা যদি আমির হোসেন আমুকে দেন তাহলে খুব ভালো হয়। কারণ আমু ভাই অত্যন্ত স্পষ্ট কথা বলেন। রাজনীতিতে চলার পথে ভুল ভ্রান্তি থাকবে। তার সমস্ত রাজনৈতিক জীবনে একটি মাত্র ভুল হয়েছে। তবে সেটা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন। সুতরাং সেটা আর কোন বিষয় হতে পারে না। আমরা মতে, আমু ভাই ছাড়া হেভিওয়েট কোন নেতা এখন আমির ভাইয়ের মতো সক্ষম নেই। ছাত্রজীবন থেকে আমরা আমু ভাইকে দেখেছি তিনি টকশোতে অত্যন্ত পারদর্শী। আর মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত শক্তিকে এক করতে হলে এখানে আমাদের টকশো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আমু ভাইয়ের নেতৃত্বে রাশেদ খান মেমন, হাসানুল হক ইনু, শেখ সেলিম সাহেব, মনজুরুল আহসান খান এরা সবাই মিলে যদি এক সাথে থাকেন তাহলে আমরা যেকোন ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে পারব।
আমাদের নিজেদের মধ্যে যতই মতপার্থক্য থাকুক না কেন আমরা অবশ্যই মিটাতে পারব। একবার না হলেও দুবার বসতে হবে, দুবারে না হলে তিনবার বসতে হবে। কিন্তু নিজেরা বসে মিটমাট করতেই হবে। আমি কোন রাজনৈতিক দলকে বিলুপ্তের কথা বলছি না। যে যে রাজনৈতিক দল থাকবে। কিন্তু সকলের সামনে একই বিপদ। যদি এই চরমপন্থীরা আবার কোন রকম ভাবে আমাদের আঘাত করে তাহলে সেখানে কে আওয়ামী লীগ, কে জাসদ, কে কমিউনিস্ট পার্টি তারা এই সব বুঝবে না। তারা যাকেই সামনে পাবে তাকেই আঘাত করবে, পুরো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর আঘাত হানবে। এবার উপজেলা নির্বাচনগুলোতে সেরকম ঘটনা ঘটলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ সব চরমপন্থীরা এখন একত্র হচ্ছে। সেজন্য উপজেলা নির্বাচনে আমাদের একটা উপযুক্ত পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় সকলে একতাবদ্ধ হয়ে তাকে সমর্থন দিতে হবে। আমাদের আর সময় নষ্ট না করে একতাবদ্ধ হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো যদি এক হয় তাহলে দেখা যাবে দেশের ১৮ কোটি জনগণ এক হয়ে গেছে। সুতরাং কার কতটা জোর আছে, কার কতটা জনসমর্থন আছে সেটি বিবেচনা না করে ১৪ দল সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে একত্রিত হতে হবে। এটাই এখন মুখ্য বিষয়। তাহলেই আমরা চরমপন্থীদের নতুন ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারবো। আর আমাদের তো একজন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আছেনই। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে লড়তে আমাদের একত্রিত হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী চরমপন্থী মুক্তিযুদ্ধ জামায়াত-বিএনপি ভারত বিরোধী আন্দোলন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:৫৯ এএম, ২৬ মার্চ, ২০২৪
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলছেন তারা তো ভোরে উঠেই আগে ভারতীয় টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ব্যবহার করি সবই তো ভারতীয় পণ্য। আমাদের বাজারে কোন জিনিস কিনতে গেলে তো ভারতীয় পণ্যটিই বেশি খুঁজি। তাহলে এখন কি আপনারা পেস্ট দিয়ে ব্রাশ না করে কয়লা ব্যবহার করতে চান? সেটা আপনারা করতে পারেন। কয়লার আজকাল দামও অনেক। আবার ঝামেলা হলো সহজে যাওয়া যায় না। সুতরাং সেটাও আপনাদের জন্য অসুবিধা।
কথায় আছে পাগলে কি না বলে ছাগলে কিনা খায়। সে ধরনের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি আপনারা দিয়ে দিলেন কোন কিছু না ভেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মধ্য দিয়ে আপনারা আরও রাজনৈতিক গহ্বরে ঢুকে গেলেন। এখন ভাবে ঢুকছেন সেখান থেকে আর কোন দিন বের হতে পারবেন কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখন বিশ্বের কোন দেশেরই নিজস্ব পণ্য বলে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে সবার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে আপনারা ভারতকে বর্জন করবেন কি করে। ভারত তো সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি দেশ। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। সে সময় আমাদের ৩০ লাখ সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এর সাথে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রক্ত ঝড়িয়েছেন। আামরা না হয় আমাদের দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি। কিন্তু ভারতীয়রা তো জীবন দিয়েছে প্রতিবেশির জন্য। সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের কন্ধনটা হলো রক্তের। রক্ত দিয়ে ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব আপনি পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ করবেন কি করে? বাসায় আপনার বউ থেকে শুরু করে বাসার কাজের মেয়ে সবাই ভারতের শাড়ি ব্যবহার করেন। তাহলে আগে তাকে বলবেন যে, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন।
রিজভী সাহেব বঙ্গবাজার থেকে একটি চাদর কিনে এনে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে একটা নাটক করেছেন মাত্র। বঙ্গবাজারে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় যেগুলো ভারতের নামে চলে। এটা আমরা জানি। রমজান মাসে ইফতারে আপনি পিয়াজু রাখছেন। এটা বাঙালিদের ইফতারের একটা ঐতিহ্য বলতে পারেন। এটা আমরা খাবই। কিন্তু পেঁয়াজ তো আসে ভারত থেকে। তাহলে এখন তো আপনাকে ইফতারে পিয়াজুও বাদ দিতে হবে। এভাবে আপনি কত বাদ দিবেন। অনেক সময় ভারত থেকে ঝড় আসে। সে সময় তাহলে বাতাসও আপনি নিবেন না। এটা বর্জন করবেন। এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভবই না হয় তাহলে পাগলের প্রলাপ বলে কি আর আন্দোলন হয়। পাগল তো তার নিজের ভালোটা বুঝে। আপনাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান দিন শেষে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই লাভবান করবে। কারণ আপনাদের আন্দোলনের কোন গন্তব্যই নেই। কোন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করলে জনগণের কাছে যেতে পারবেন সেটাও আপনারা বুঝেন না। আপনারা পড়ে আছেন ভারতরে পণ্য বর্জনের ডাক নিয়ে। ফলে জনগণের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এদিকে চাপা পড়ে যাবে। আর সরকারও মহা আরাশ আয়েশে চলবে। আমি জানি না, কোন উৎস থেকে টাকা পয়সা পেয়ে আপনারা নতুন করে এই স্লোগান শুরু করেছেন। কিন্তু আপনাদের এই ডাকে বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগই। কারণ আপনারা এবার বিএনপিকে দলগতভাবে কবরে নামানোর জন্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন।
মন্তব্য করুন
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে
এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত
হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের
সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
এ কথা সকলের কাছে পরিষ্কার যে, নয়মাসে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়া নিয়ে
কোনো বিতর্ক চলতে পারে না। কারণ রবার্ট পেইন তার Massacre, The Tragedy of
Bangladesh গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে- Kill three million of
them and the rest will eat out of our hands. পাকিস্তানি শাসকদের এই সিদ্ধান্তের কারণে
দৈনিক গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয় সারা বাংলাদেশে। এজন্য ১৯৭১ সালে মার্কিন সিনেটর
এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে
সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের
হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০২ সালে
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত
দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কূটনৈতিকরা সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার
বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা প্রেরণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা
একাধিক লেখায় এবং বিশ্বখ্যাত পত্রিকা টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস প্রভৃতির সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানিদের
গণহত্যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে গঠিত
‘হামাদুর রহমান কমিশন’ তাদের পরাজয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রমাণ পায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি
সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনে ঘটনার। আর এই ভয়ঙ্কর গণহত্যায় কেঁপে উঠেছিল
বিশ্ববিবেক। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। দার্শনিক
আঁদ্রে মালরোর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’। প্যারিস ও লন্ডনে সরব হয়ে ওঠেন
মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ব্যাপক এবং নিষ্ঠুরতার
দলিল হিসেবে আজও বিশ্বকে নাড়া দেয়।
আসলে বিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছে কোটি মানুষের প্রাণসংহার। বিশ্বযুদ্ধ
ও জাতিনিধনের সেই পরিকল্পিত ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’ অভিধা পেয়েছে। হিটলারের কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বন্দিশিবির সেই জেনোসাইডের নির্মম ইতিহাসের কথা
বলে। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে
লিখেছেন ‘সারা প্রদেশ জুড়ে হত্যাকাণ্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গণহত্যা
শব্দটির আভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে।’ তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানি
সেনা কর্মকর্তার মুখ থেকে জেনেছিলেন গণহত্যার লক্ষবস্তু ছিল- ক) বাঙালি সৈনিক, পুলিশ,
আনসার প্রভৃতি খ) হিন্দু সম্প্রদায় গ) আওয়ামী লীগের লোক ঘ) কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঙ) অধ্যাপক ও শিক্ষক যাঁরা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি এটাও লক্ষ
করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ছিল নির্বিচার। নিরপরাধ, সাধারণ মানুষকেও শত্রু হিসেবে
গণ্য করেছিল তারা। তাছাড়া তাদের গণহত্যা ছিল ‘শোধন প্রক্রিয়া’ যাকে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান বলে মনে করত। সেই সঙ্গে এই বর্বরোচিত উপায়ে প্রদেশটিকে উপনিবেশে পরিণত
করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পাকিস্তানিদের ভাষ্য ছিল- ‘বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে রক্ষা
করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য পবিত্র করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেজন্য
যদি বিশ লাখ লোককে হত্যা করতে হয় এবং প্রদেশটিকে তিরিশ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে শাসন
করতে হয়, তবুও।’ শাসকদের এ ধরনের মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমাংশের মানুষের ঐক্য ছিল। আর
এজন্যই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের
জনগণ হলেন গণহত্যার নীরব দর্শক।’
বাংলাদেশে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতাড়ন, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে তাদের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছিল। সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হয়েছে। হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যে বর্বরতা দেখিয়েছিল ঠিক একইরকম আচরণ ছিল পাকিস্তানিদের। নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছিল ঠিক ইহুদিদের প্রতি নাজিদের মতো। নাজিরা ইহুদিদের নিচুজাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত এবং তাদের নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিল। অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোভাব ছিল Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation. নাজিরা প্রথমে তরুণ, যুবক এবং সমর্থ পুরুষদের হত্যা দিয়ে নিধনযজ্ঞ শুরু করলেও শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের নির্বিচারে নিধন করতে থাকে ১৯৪১ সালে বলকান অঞ্চল থেকে। যুদ্ধবন্দি হত্যাসহ অন্যান্য নিষ্ঠুরতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় তারা। তাদের অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাদের আরো মিল রয়েছে হিন্দু নিধনের ঘটনায়। একাত্তরে হিন্দুদের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুচিন্তিত ও নির্মম।
কারণ তারা ধর্মভিত্তিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করে তুলেছিল। তারা মনে করত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলমানদের বিদ্রোহের কারণে। এই হিন্দু বিদ্বেষ মনোভাব বছরের পর বছর লালিত হয়ে এসেছে। এজন্য জেনোসাইডে হিন্দু নিশ্চিহ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জনৈক গবেষকের ভাষায়- ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর গোটা দেশে কেবল একটি উদীয়মান ও অস্তগামী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি একাধিক জাতিগত দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। এতে উভয়পক্ষের নির্যাতন শুরু হয় তবে এর সূত্রপাত ঘটে ২৫শে মার্চের আক্রমণের পর। পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনার শিকার হয় দুই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। এর প্রথম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়, যাদের কেবল নির্যাতন করা হয়নি বরং তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসও করা হয়। হিন্দুরা তাদের হৃত অবস্থান কোনদিন উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশেও। সম্প্রদায়গতভাবে তারাই ১৯৭১ সালের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।’ এমনকি ধর্ষণকেও তারা বৈধ বলে মনে করত। চীনের নানকিং-এ জাপানি সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, রাশিয়াতে নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়া ও বসনিয়ার নারী নির্যাতনের সাযুজ্য রয়েছে বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনায়। পাকিস্তানিদের বাঙালি নারী ধর্ষণের লক্ষ ছিল পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে পরাজিত ও বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে না পারার যাতনা তারা মিটাত নারী ধর্ষণ করে। এটা ছিল ভয়ঙ্কর মনোবিকারজাত। সার্বরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ইথনিক ক্লিনজিং-এর উপায় হিসেবে। দেশ-বিদেশী গবেষক ও সাংবাদিকদের রচনায় যুদ্ধকালীন এসব নির্মম বাস্তবতাই উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ শতকের জেনোসাইডের তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের
নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে
চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর
কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও
নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের
আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায়
বিদ্বেষ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের
২৫ মার্চের দাবিকে আরো বেশি তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’
হবে পৃথিবীর মানব জনগোষ্ঠীকে নির্মম নিধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চকণ্ঠ এবং
হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র ভরসার দিন। আশা করা যায় এই
দিবসের চেতনা গণহত্যার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বর্তমানে জামায়াত-বিএনপি এবং চরমপন্থী ডান এবং বাম এরা সবাই এক হয়ে গেছে। তারা প্রকাশ্যে এক হয়েছে কি হয়নি এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে তাদের কাজকর্ম দেখে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা এক হয়েছে এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর চরম আঘাত আনার চেষ্টা করবে। এজন্য তাদের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারী পাকিস্তানি আইএসআই থেকে শুরু করে সব রকম সাহায্য সহযোগিতা সবই তারা পাবে। বিদেশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিও তাদের টাকা পয়সা দেবে। দেশেরও বেশ কিছু ব্যবসায়ী তাদের দুকূল রক্ষার জন্য রাখার জন্য টাকা পয়সা দেবে। সুতরাং কোন দিক থেকে তাদের কোন অভাব হবে না। তারা এবার আগের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে গুছিয়ে আন্দোলন শুরু করবে। আর এই কারণে তারা এখন ভারত বিরোধী স্লোগান তুলেছে। এই ভারত বিরোধী স্লোগান তোলার পিছনে শুধু বিএনপি-জামায়াত বা চরমপন্থী বাম কিংবা ডানরাই আছে এমন না, এর সাথে বাইরের শক্তিও জড়িত।
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সবচেয়ে জরুরি। চিকিৎসার যদি উন্নতি না হয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার যদি উন্নতি না হয়, মানুষ যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে দেশ গড়া সম্ভব নয়। সেজন্য বঙ্গবন্ধু একটা সুন্দর নীতিমালা পরিকল্পনা গড়ে তোলেন। ওই সময়ই সেটা ছিল আধুনিক যুগোপযোগী এবং বিজ্ঞানসম্মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বঙ্গবন্ধু যে নীতিমালা তখন চালু করে গিয়েছেন সেই পদ্ধতিতে আজকের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একে এক করে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছেন।