ইনসাইড থট

ভোট ছাড়া নির্বাচন, বেচারা জনগণ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০:০৪ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১


Thumbnail

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত একজন গুণী মানুষ। প্রথিতযশা চিকিৎসক। দুই দফা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। গরিবের জন্য অন্তঃপ্রাণ। বহু দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা বিনামূল্যে করেছেন। রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন সময়ে শেখ হাসিনার চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। যখন কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হলো তখন অনেকের মতো আমিও উল্লসিত হয়েছি। দুর্বৃত্তায়নের রাজনৈতিক চক্র ভাঙতে প্রাণ গোপাল দত্তের মতো মানুষের রাজনীতিতে আসা জরুরি। তার চেয়েও জরুরি, মনোনয়ন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় তাদের সুযোগ করে দেওয়া যাতে তারা রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। কুমিল্লা-৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রয়োজন হয়েছিল সেখানকার সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফের মৃত্যুর কারণে। যেহেতু বিএনপি এখন কোনো নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করছে না তাই এ শূন্য আসনে আওয়ামী লীগ কাকে মনোনয়ন দেয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ প্রয়াত আলী আশরাফের আসনে তাঁর ছেলে মুনতাকিম আশরাফও মনোনয়ন-প্রত্যাশী ছিলেন। একজন জাতীয়ভাবে পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি মনোনয়ন পাবেন, না উত্তরাধিকারের রাজনীতি জয়ী হবে- এ নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল সব মহলে। আওয়ামী লীগ এবং মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি এ মনোনয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার প্রমাণ রাখেন। ১১ সেপ্টেম্বর মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ‘নেতা-মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের সন্তানরা রাজনীতিতে থাকতে চাইলে স্ট্রাগল করে আসুক।’ তাই প্রাণ গোপাল দত্তের মনোনয়ন লাভ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী উত্তরাধিকারের রাজনীতি হটিয়ে যোগ্যতার রাজনীতি সামনে আনলেন। অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এমনিতেই এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। গত কয়েক বছর তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বেশ কাজ করেছেন। জনসংযোগ করেছেন, কাজেই খুব বড় অঘটন না ঘটলে এ উপনির্বাচনে তাঁর বিজয় ছিল মোটামুটি নিশ্চিত। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় দেখা গেল চারজন জমা দিয়েছেন। বাছাইয়ে একজনের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। কিছুদিন ধরেই সারা দেশে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যাচ্ছে। ভোটাররা ভোট দিতে যান না। এমনকি দলের কর্মী-সমর্থকরাও কেন্দ্র থেকে দূরে থাকেন। জনগণের এ উদাসীনতার কারণ নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হচ্ছে এবং হবে। কিন্তু প্রাণ গোপাল দত্তের মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য ব্যক্তিরা যখন নির্বাচনে দাঁড়ান তখন ভোটবিমুখ মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার একটি উপলক্ষ তৈরি হয়। এ ভোট প্রাণ গোপাল দত্তকে জেতানোর জন্য নয়, তাঁকে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত সমর্থন জানানোর জন্য। আমি প্রত্যাশা করেছিলাম এ নির্বাচনের মাধ্যমে ভোট উৎসবে আবার মানুষ ফিরে আসবে। কিন্তু আমি এবং আমার মতো কিছু মানুষ আশাহত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টি এবং ন্যাপ প্রার্থী। জাতীয় পার্টির প্রার্থী লুৎফর রেজা দলটির কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি জেলার আহ্বায়ক। তাঁকে নির্বাচন থেকে কেন সরে যেতে হবে? চাপের মুখে তিনি যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি তা নিশ্চিত। তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা শোনা যায়। জাতীয় পার্টিও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতীয় পার্টি এবং ন্যাপ প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর পর অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বিনা ভোটে এমপি হলেন। বেচারা জনগণ। ভোট দিয়ে প্রাণ গোপালকে স্বাগত জানাতে পারল না। শুধু কুমিল্লা-৭ আসন নয়, ২০ সেপ্টেম্বর দেশের ১৬০ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। স্থানীয় পর্যায়ের এ নির্বাচনেও বিনা ভোটের রেকর্ড হয়েছে। ১৬০টির মধ্যে ৪৫টিতেই ভোট হয়নি চেয়ারম্যান পদে। ইউনিয়ন পরিষদ হলো বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় ক্ষুদ্রতম একক। এ নির্বাচনে বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হবেন এটা অকল্পনীয়। কারণ দলীয় পরিচয়ের বাইরে এ নির্বাচনে অনেকে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ নির্বাচনব্যবস্থায় সর্বশেষ ব্যাধির নাম ভোটবিহীন নির্বাচন। এখন ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পেলেই হলো। এরপর তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া। এজন্য তিনি অন্য প্রার্থীদের ছলেবলে-কৌশলে নির্বাচন থেকে বিচ্ছিন্ন করেন। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী গোঁ ধরে থাকেন সেখানে নির্বাচন হয়। কিন্তু তত দিনে পরিস্থিতি এমন হয় যে মানুষ ভোট দেওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। ফলে ভোট উৎসব হয়ে গেছে বিবর্ণ। যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন, এটাই যেন এখন নিয়তি। কোথাও নামমাত্র ভোট হয়। কোথাও ভোটের আগেই প্রার্থী বিনা ভোটে বিজয়ী হন। এটা যে গণতন্ত্রের জন্য কত বড় সর্বনাশ তা কি বিনা ভোটে জয়ী জনপ্রতিনিধিরা বোঝেন? বাংলাদেশের সংবিধানের ১২২ (১) ধারায় বলা হয়েছে- ‘প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে সংসদের নির্বাচন হবে।’ কিন্তু ভোটই যদি না হয় তাহলে একজন সংসদ সদস্য কি বৈধ? এটি সাংবিধানিক বিতর্কের বিষয়। আমি সে বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্ন, জনগণের ভোট না পেয়েই যদি কেউ জনপ্রতিনিধি হন, তিনি কি মোটেও লজ্জিত হন না? ভোটার এবং প্রার্থীর সম্পর্ক হবে ফেভিকলের মতো। কিন্তু এখন যেন প্রার্থীরা ভোটারদের থেকে দূরে থাকতে চান। সামাজিক দূরত্ব রেখে জনগণের কাছে না গিয়ে জনপ্রতিনিধি হওয়ার এক ব্যাধি ক্রমে সংক্রমিত হচ্ছে দেশে। এ দেশের জনগণ ভোটের অধিকারের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। বুকের রক্ত দিয়েছে। ভোট নিয়ে এ দেশের মানুষই সম্ভবত সবচেয়ে প্রতারিত হয়েছে। বিনা ভোট হলো জনপ্রতারণার সর্বশেষ নজির। অগণতান্ত্রিক, অবৈধ এবং স্বৈরাচাররা ভোটব্যবস্থা নষ্ট করেছে নিজেদের স্বার্থে। ’৭৫-এর পর জিয়া হ্যাঁ-না ভোটের তামাশা করেছেন। জিয়াকে খুশি করতে ‘হ্যাঁ’র বক্সে এত জাল ভোট দেওয়া হয়েছিল যে হ্যাঁ ভোটের সংখ্যা ১০০ ভাগের ওপর চলে গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত হ্যাঁ-না ভোটের কৌতুকে জিয়ার পক্ষে ৯৮ দশমিক ৮০ ভাগ ভোট পড়ে। প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া অব বাংলাদেশ : এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি’ গ্রন্থে সাইফুর রহমানের বরাতে বলা হয়েছিল- ‘এটি ছিল অবিশ্বাস্য এবং অতি উৎসাহীদের কান্ড’। (পৃষ্ঠ-৭১)। ১৯৭৯ সালে জিয়ার নেতৃত্বে আরেকটি ভোট প্রহসন মঞ্চস্থ হয়। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। সাজানো এবং পরিকল্পিত নির্বাচনে সেনা পোশাক পরে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন জিয়াউর রহমান। নির্বাচনী প্রচারণায় জিয়া ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগকে ৪০টির বেশি আসন দেওয়া হবে না। বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ তখন বিভক্ত। একাংশের নেতৃত্বে ছিলেন মালেক উকিল, অন্য অংশের মিজানুর রহমান চৌধুরী। মালেক উকিলের আওয়ামী লীগই ছিল মূল আওয়ামী লীগ। এ আওয়ামী লীগই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ (মিজান) পায় মই প্রতীক। আওয়ামী লীগ (মালেক) ২৯৫ আসনে প্রার্থী দেয়। ৩৯ আসনে জয়ী হয়। আর আওয়ামী লীগ (মিজান) ১৮৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে দুটি আসনে জয়ী হয়। এ নির্বাচন ছিল জনগণের সঙ্গে প্রতারণা। জিয়ার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল জনগণের ভোটাধিকার হরণের আরেক দলিল। সে সময় আওয়ামী লীগের নবযাত্রার সূচনা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। জিয়ার মৃত্যুর পর কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি। এ সময় কোন্দল এড়াতে উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী তিনি (বিচারপতি সাত্তার) ছিলেন নির্বাচনের অযোগ্য। তাকে প্রার্থী করতে সংবিধান সংশোধন করে বিএনপি। আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় ড. কামাল হোসেনকে। এটি ছিল প্রকাশ্য জালিয়াতি এবং ভোট ডাকাতির এক লোমহর্ষক নির্বাচন। কেন্দ্রে পুলিশ বেষ্টিত অবস্থায় প্রশাসনের লোকজন বিএনপি প্রার্থী সাত্তারের পক্ষে সিল দেয়। (সূত্র : দৈনিক সংবাদ, ১৬ নভেম্বর ১৯৮১)। ভোট ছিনতাই করেই রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন বিচারপতি সাত্তার। তবে ভোট ছিনতাই করে রাষ্ট্রপতি হওয়া সাত্তার সিংহাসনে বেশি দিন থাকতে পারেননি। মাত্র চার মাসের মাথায় মঞ্চে আসেন সেনাপ্রধান এরশাদ। আবার একই কায়দায় বেতার-টেলিভিশনে ভাষণ। জিয়ার মতো এরশাদও প্রথমে ছিলেন পেছনে। বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন কাগজ-কলমে রাষ্ট্রপতি। জিয়ার মতোই এরশাদ বলেন, ‘আমি সৈনিক, রাজনীতি আমার কাজ নয়, আমি ব্যারাকে ফিরে যাব।’ জিয়ার মতো জনগণকে প্রতারিত করে এরশাদ সামরিক পোশাকেই দল গঠন করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে এরশাদ সংসদ নির্বাচন দেন। ওই নির্বাচনে ভোট কারচুপি এবং ভোট প্রহসনের এক নতুন ফরমুলা আবিষ্কার হয়। এর নাম ‘মিডিয়া ক্যু’। ওই নির্বাচন নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। সব বিরোধী দল ওই নির্বাচনে যাওয়ার কথা থাকলেও আকস্মিকভাবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। জাসদসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়। ফলে ১৫ দল ভেঙে যায়। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আট দল নির্বাচনে এক গণজোয়ার সৃষ্টি করেছিল। সহিংস এ নির্বাচন শেষে যখন বেতার ও টেলিভিশনে ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় তখন দেখা যায় আওয়ামী লীগ এগিয়ে। মধ্যরাতে হঠাৎ ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ নিশ্চিত জয়ের পথে যাচ্ছে এমন তথ্যের পর ফলাফল ঘোষণা বন্ধ করা হয়েছিল সেদিন। এরপর এক ভুতুড়ে পরিস্থিতি তৈরি হয়। নির্বাচন কমিশনে বসে বানোয়াট ফলাফল তৈরি হয়। ১১ দিন পর ১৯ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফল ঘোষিত হয়।

১৯৮৬-এর নির্বাচন আওয়ামী লীগকে সমালোচিত করেছে, বিএনপিকে লাভবান করেছে। তার চেয়েও বড় কথা, জনগণের আকাক্সক্ষা হরণ করা হয়েছে। জনগণের রায়কে মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে পাল্টে ফেলা হয়েছে। এরশাদের আরেক কৌতুক ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ১৯৮৬-এর ১৫ অক্টোবর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান প্রধান সব বিরোধী দল এ নির্বাচন বর্জন করে। তাতে কি, এরশাদ ১২ জন প্রার্থী জোগাড় করে ফেলেন। এরা যেন প্রার্থী নন, কৌতুক অভিনেতা অথবা ভাঁড়। এদের মধ্যে অলিউল ইসলাম চৌধুরী (ছক্কু মিয়া) কৌতুক অভিনেতা হিসেবে প্রশংসিত হন। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদ ১৯৮৬-এর জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন। ১৯৮৮-এর ৩ মার্চ আবার নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনে আবারও জাতিকে কৌতুক উপহার দেন এরশাদ। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সব বিরোধী দল ওই নির্বাচন বর্জন করে। আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে এরশাদের পৃষ্ঠপোষকাতায় গড়ে ওঠে সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ)। এ জোটে এমন সব দল ছিল যে তাদের খুঁজে বের করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আ স ম আবদুর রব ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের খেতাব পান। ১৯৮৮-এর নির্বাচনেও কোনো ভোট হয়নি। জনগণ ভোট দেয়নি। নির্বাচন কমিশন টেবিলে বসে মনের মাধুরী মিশিয়ে ফলাফল তৈরি করেছে। এরপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তৈরি করেন। এরশাদের পতনের লক্ষ্যে এই এক দফা দাবিতে গড়ে ওঠে তীব্র গণআন্দোলন। এরশাদের পতন হয়। ১৯৯১-এ প্রথমবারের মতো দেশে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। ওই নির্বাচনের পর সবাই আশা করেছিল মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- এ স্লেøাগান বাস্তবতা পাবে। কিন্তু বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে আবার জনগণের ভোটাধিকার হরণের খেলায় মেতে ওঠেন। মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনে নির্লজ্জ কারচুপির ঘটনা ভোটব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে। আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে যায় এ দেশের মানুষ। এ আন্দোলনের মধ্যেই ক্ষমতায় থাকার মরিয়া চেষ্টা করে বিএনপি। ১৯৯৬-এএর ১৫ ফেব্রুয়ারি এক ভুতুড়ে নির্বাচন করে। স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেগম জিয়া বানোয়াট ফলাফল ঘোষণা করেন। গোটা জাতি ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি কলঙ্কিত নির্বাচন অবশ্য বেগম জিয়াকে মাত্র কয়েক দিন ক্ষমতায় রাখতে পেরেছিল। বেগম জিয়া নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এ নির্বাচনে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, কারচুপি হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষপাতও নজর এড়ায়নি। কিন্তু এতসব ত্রুটি-বিচ্যুতির পরও মানুষ ভোট দিতে পেরেছে এবং জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু ২০০১-এর অক্টোবর নির্বাচনের পর বিএনপি ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করতে চায়। এখানেই আবার সংকটে পড়ে গণতন্ত্র এবং নির্বাচন। বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে চায়। তবে তা রাজনৈতিকভাবে নয়, পাশবিক ও সন্ত্রাসী কায়দায়। ১ অক্টোবর ভোটের ফলাফলের পর সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর শুরু হয় নির্মম পাশবিকতা। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ চলে নির্বিচারে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু নিঃশেষের এক মিশনে নামে বিএনপি-জামায়াত। এরপর শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করা শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা ছিল এ মাস্টারপ্ল্যানের চূড়ান্ত বাস্তবায়ন। কিন্তু ওই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। একদিকে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করা অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিজেদের মতো করে সাজানোর পরিকল্পনা নেয় বিএনপি। সাবেক বিএনপি নেতা কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি-জামায়াত জোট। বিচারপতি হাসান যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান থাকতে পারেন সেজন্য সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়ানো হয়। নির্বাচন কমিশনে বসানো হয় একান্ত অনুগত ব্যক্তিদের। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করা হয়। প্রশাসন বিএনপি-জামায়াত পন্থিদের নিয়ে সাজানো হয়। ১০ জনকে ডিঙিয়ে সেনাপ্রধান করা হয় বিশ্বস্ত জেনারেল মইন উ আহমেদকে। এত কিছু করেও শেষরক্ষা হয়নি বিএনপির। ১/১১ ঝড়ে সব ল-ভ- হয়ে যায়। দুই বছর সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত শাসনের পর জনতার জয় হয়। ২০০৮-এর ডিসেম্বর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক। আমি এ নির্বাচনকে অনেকটাই ১৯৭০-এর ভোট বিপ্লবের মতোই মনে করি। জনগণের রায়ের এক স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ২০০৮-এর নির্বাচন। আবার গণতন্ত্রের সড়কে চলা শুরু করে বাংলাদেশ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির নোংরা ও কুৎসিত রাজনৈতিক খেলার কারণেই এ নির্দলীয় ব্যবস্থা বিতর্কিত হয়ে যায়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলোপ হওয়াটা ছিল অনিবার্য পরিণতি। সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের চ্যালেঞ্জটা আসে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের ওপর। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সবকটিতে বিএনপি জয়ী হয়। ওই নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার, ‘সব দলের অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের’ প্রস্তাব দিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী গণভবনে চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। এতসব কিছুর পরও বিএনপি ২০১৪-এর নির্বাচন বয়কট করে। কেন? বিএনপির অনেক নেতাই এ প্রশ্বের উত্তর জানেন না।

২০১৮-তে আবার সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি তখন বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে দেশের জনগণ জানে। যারা অতি উৎসাহী হয়ে ওই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তারা কি আওয়ামী লীগের শুভাকাক্সক্ষী? ২০১৮-এর নির্বাচন আর এখন আমলাদের দৌরাত্ম্যের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা রাজনীতির জন্যই জরুরি। বিনা ভোটের মঞ্চ যেন গণতন্ত্রকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মঞ্চ। ভোট জনগণের একটি অধিকার। জনগণ যত এ অধিকার প্রয়োগ করবে ততই গণতন্ত্র সংহত ও শক্তিশালী হবে। জনগণকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হন, তিনি তো আর জনপ্রতিনিধি থাকেন না। তাই গণতন্ত্র বাঁচাতে ভোটে ফেরাতে হবে জনগণকে। জনগণকে ‘বেচারা’ বানালে গণতন্ত্রই অচল হবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন 



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রথম আলোর পর কী ডেইলি স্টারও বিক্রি হবে?


Thumbnail

এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।

প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে অনেকেরই  ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী লোক।

এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।

তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।

এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।

আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম। সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায় যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।

ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।

তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।


প্রথম আলো   ডেইলি স্টার  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে বিএনপির রাজনীতি


Thumbnail

বিএনপির রাজনীতি এখন ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে। রাজনীতিতে একের পর এক ভুল করার কারণে তারা এখন হতাশায় নিমজ্জিত। কোন কী বলতে হবে সেটার খেই হারিয়ে ফেলেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

বিএনপি এখন দাবি করছে যে, তাদের ৬০ লাখ নেতাকর্মী জেলে আছেন। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল যদি ৬০ লাখ কর্মী তাদের থাকত তাহলে এতদিনে তারা কেন আন্দোলনে ব্যর্থ হল? যদি এত সংখ্যক নেতাকর্মী থাকত তাহলে তো অনেক আগেই সরকারের পতন ঘটে যেত। কারণ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এক লাখ নেতাকর্মী হলেই যথেষ্ট। কিন্তু এত সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়েও তারা ব্যর্থ কেন! এত বড় সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে তারা তাদের নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেনি। কোন আন্দোলনই তারা করতে পারল না! বরং তাদের নেত্রীকে সরকারের অনুকম্পায় ফিরোজায় থাকতে হচ্ছে। ফলে স্বভাবতই বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা কত সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আর এত নেতাকর্মী থাকা সত্বেও তাদের নেতাকে লন্ডনে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে! 

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মী যদি জেলে থাকেন তাহলে দেশের জেলখানা গুলোর ধারণ ক্ষমতা কত। এবং সেখানে যদি বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যাই হয় ৬০ লাখ তাহলে এর মধ্যে সাধারণ কয়েদি কোথায় আছেন। তাদেরকেই বা কোথায় রাখা হয়েছে।

কথায় আছে, পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পথ ফিরে পাওয়া যায়! বিএনপির অবস্থায় এখন তাই। তারা রাজনীতির পথের মাঝে রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলেছেন। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনীতি নয় সেটাও বিএনপির নেতাকর্মীরা বোধহয় ভুলে গেছেন কিংবা বুঝতে পারছেন না। অন্য আরেকটি কথায় আছে যে, স্বপ্নে যখন কেউ কিছু খাবে তখন পান্তা খাবে কেন? পোলাও কোরমা খাওয়াই ভালো। বিরিয়ানিও খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং ৬০ লাখ না বলে তাদের বলা উচিত ছিল বাংলাদেশে তো প্রায় ১৮ কোটি লোক আছে এর মধ্যে ৬ কোটি লোকই বিএনপির নেতাকর্মী। তাহলে অত্যন্ত লোকে আরও ভালো ভাবে বুঝত যে, বিএনপি আসলেই অনেক বড় একটি শক্তিশালী দল এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝতে পারত যে, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো। 

তবে বাস্তবতা হল বিএনপি ৬০ লাখ নেতাকর্মী দাবি করলেও আসলে তাদের কোন জনসমর্থনই নাই। যদি তাই থাকত তাহলে তারা নির্বাচন বিষয়টিকে এত ভয় পেত না। নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নিত না। শুধু তাই নয়, বিদেশিও তাদের কোন বন্ধু নাই। যারা আছে সেই বন্ধুদের কথায় দলটি বরং এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। দেশিয় বিএনপির যে সমস্ত বন্ধুরা ছিলেন, বিভিন্ন সময় বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে কিছু লেখালেখি করতেন, তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বপ্ন দেখাতেন তারাও এখন হারিয়ে গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে দলটি এখন অনেকেটা এতিম হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত সামনে দলটির নাম নিশানাও থাকবে না। যারা নিজের দলের নেতাকর্মীর সঠিক সংখ্যা জানেন না তাহলে বুঝতে হবে সেই দলটি এখন কোন পর্যায় গেছে। কতটা দেউলিয়া হলে একটি দলের নেতাকর্মীর সংখ্যা নিয়ে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হন। সুতরাং দলটি যে অচিরেই হারিয়ে যেতে বসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বৈশাখে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে। 

১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’, দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। তাপদাহে এই এপ্রিলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখি/বৈসাবি/বিজু উৎসবের মাস- খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস হলেও। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন- ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।

বিশ্ব পরিস্থিতির সংকট আমাদের বৈশাখি আয়োজনের মধ্যে গরল উগড়ে দিলেও অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন এবারও। এখন আমরা প্রাণিত, আমাদের চিত্ত আনন্দিত এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। অতীতের মতো এবারও সকালে হালখাতা খুলে দোকানে বসবে ব্যবসায়ী, বৈশাখি মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাবে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারাদেশে মঙ্গলশোভা যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো তাও এবার হবে। রমনার বটমূলের প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবারও হচ্ছে।আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছে।‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সকল প্রথা অনুসৃত হচ্ছে।একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতো কৃষকরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত লাভ করে। 

বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০২৩ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন হয়ে এসেছে। অন্যদিকে নব্বই দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের উৎসাহে ২০১৩ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একইসঙ্গে ওইদিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়ক মেলা।

নববর্ষের সকল আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করেও আমরা আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব অত্যন্ত বেশি। নিকট আত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক, আমরা এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে  চাই। সংকট এলে কী করি, কীভাবে অগ্রসর হই, কোথায় যাই, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে, এটাই শান্তচিত্তে আমরা খুঁজছি। ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া নতুন বছরের আগে ছিল কাজ, অকাজ, অকারণ কাজ, যে উপায়েই হোক, জীবনের শেষ নিমেষপাত পর্যন্ত ছুটাছুটি করে, মাতামাতি করে বেঁচে থাকা। ওই কর্ম-নাগরদোলার ঘূর্ণিনেশা আমাদের পেয়ে বসেছে বলেই পৃথিবী হয়েছে শান্তিতে পূর্ণ। অবশ্য দুর্গম হিমালয়শিখরের নিরুদ্বিগ্ন প্রাণিদের জীবন বিপন্ন; জনশূন্য তুষারমরুর বিশ্বস্তচিত্ত সীল এবং পেঙ্গুইনদের নির্বিরোধে প্রাণধারণ করার সুখটুকু বিলীন এখন। বাণিজ্যপুঁজি ও শিল্পপুঁজির দাপটে আফ্রিকা আর দক্ষিণ-আমেরিকার প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলেও আধুনিকতার নামে মৃত্তিকাসংলগ্ন সভ্যতার তিরোধান ঘটেছে। বিচিত্র কর্মের পিছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক। এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।

আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই কর্পোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সকলকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই বরং বৈশাখি আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। পরস্পরের কাড়াকাড়িতে ঘেঁষাঘেঁষিতে যে রিপুর দাবানল জ্বলে উঠে উৎসবে তা প্রশমিত থাকে; কর্মের সঙ্গে শান্তিকে জড়িত করে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করে। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়ো, পদ বড়ো নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়। আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকুর মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্য নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।

এসেছে পহেলা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য- ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভাণ্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখি মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকট কবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এ মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্বলাভের পক্ষে বড়ো মিথ্যার চেয়ে ছোটো সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে অশান্তি মুক্ত করার শপথ নিতে হবে। কারণ- বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘সংখ্যায় আধিক্য মানে অবনমন’


Thumbnail

সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।

সময়ের সাথে সাথে এভাবে পৃথিবীতে প্রায় সবকিছুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও গুণগত মান এবং কার্যকারিতা নিম্নমুখী হচ্ছে। সবকিছুতেই যেন ভেজাল বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তবে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে দিন দিন। শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক এবং সৃজনশীল হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ আশানুরূপ হচ্ছে না। চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা অতিশয় প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে।

এক সময় সমাজে হাজীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তবে সমাজে তাদের অনেক সম্মান ছিল। মানুষ তাদেরকে খুব ইজ্জত করতেন। তাদের চলাফেরা এবং আচার-আচরণ সমাজের আর দশজন মানুষ থেকে আলাদা ছিল যা দেখে তাদের খুব সহজেই চেনা যেত। তাদেরকে মানুষ অনুকরণ করতেন। এখন হজ্জব্রত পালন করা মানুষের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তবে তাদের ঈমানী শক্তিতে আর আগের সেই ধার নেই। হজ্জ করে আসা ব্যাবসায়ী হজ্জ করে এসে আগের চেয়ে অধিক মুনাফা করছে, ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। হজ্জ করে আসা একজন চাকরিজীবী পবিত্র ঘর তাওয়াফ করে এসে আবার আগের মতই ঘুষ, দূর্নীতিতে জড়াচ্ছে। একজন হাজী'র কোনো চারিত্রিক এবং নৈতিক গুণাবলি তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে হাজীদেরকে এখন আর দেখে চেনা যায় না। সমাজে হাজীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সমাজের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে; মানুষের মনুষ্যত্ববোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। 

ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষ দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশে বিগত কয়েক বছরে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এসব শিক্ষার্থী সমাজের মানুষের  ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারেনি। বরং এরা নিজেরাই অনেকে উগ্র, সাম্প্রদায়িক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষী। ইসলাম যেখানে সহনশীলতা, সাম্য, শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধের বার্তা দেয়, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এসব আলেমদের আচরণ ঠিক তার উল্টো! 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখা বুড়ী অসুস্থ হলে তার সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তুলেছেন। যাদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং হিংস্রতার কারণে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত বাধ্য হয়েছিলেন- মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া আলেম নামধারী কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ ঈদ এর পরিবর্তে কেউ ইদ লিখলেই তাকে কাফির, নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের কল্লা কাটার ঘোষণা দেয়! চুন থেকে পান খসলেই এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদগার করে, অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে। যাকে তাকে যখন তখন ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা আসলে কতটা কুরআন এবং রাসূলের অনুসারী! সমাজ, রাষ্ট্রে এমন আলেমের সংখ্যাই বেশি। প্রকৃত আলেমের সংখ্যা খুবই কম। 

সমাজে কেবল এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম নয়, সুশীল নামধারী নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা অনেক শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক মানুষ আছে। এরা দাঁড়ি, টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। এরা দাঁড়ি, টুপীওয়ালা মানুষদের জঙ্গি এবং মৌলবাদী আখ্যায়িত করতে পারলেই নিজেদেরকে প্রগতিশীল ভাবে। দাঁড়ি, টুপি এবং মাদ্রাসার প্রতি এদের এলার্জি সাংঘাতিক রকমের। এরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক মনে করলেও আসলে এরা নিজেরাও চরম সাম্প্রদায়িক। এরুপ প্রগতিশীলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সমাজে দিন দিন এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম এবং প্রগতিশীলতার ভান করা চরম সাম্প্রদায়িক শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এরা উভয়ই সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপস্বরুপ।

আগে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার সংখ্যা ছিল কম। যা ছিল তাও বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোল পাতার ছাউনি ঘেরা নিতান্তই এক একটা কুঁড়ে ঘর। এসি তো দূরের কথা লাইট, ফ্যান ও ছিল না। মানুষের গায়ে তখন দামি পোশাক ছিল না, দামি গাড়ি, আলিশান বাড়ি ছিল না অথচ তখন সমাজে অনেক আদর্শবান মানুষ ছিলেন। যাদের দেশপ্রেম, সততা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল অনুকরণীয়। আজকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার কোনো কমতি নেই। বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোলপাতার ছাউনির পরিবর্তে এগুলো এখন একেকটা আলিশান ভবন। টাইলস কিংবা দামি মার্বেল পাথর বাঁধানো এসব ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ( এসি ) এর ছড়াছড়ি। আজকাল এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় মানুষের শরীরকে শীতল করলেও মনকে পরিশীলিত, নরম এবং পরিশুদ্ধ করতে পারছে না। মানুষ এখন দামি পোশাক, অভিজাত গাড়ি, প্রাসাদতুুল্য বাড়ির মালিক। তাদের এখন সব আছে। নেই কেবল সততা, দেশপ্রেম, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, তরুণ কলামিস্ট, খুলনা।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলাদেশের নির্বাচন: ব্যাপক বয়কট নাকি সর্বজন গৃহীত?

প্রকাশ: ০১:৫৭ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।  

তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।

অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?

দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।  

নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।

তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।

উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।

বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।

দায়বদ্ধতা

এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।

নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।


বাংলাদেশের নির্বাচন   ব্যাপক   বয়কট   সর্বজন গৃহীত  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন