দুটো খবর দুই দেশের। আপাতদৃষ্টিতে দুই খবরের কোনো মিল নেই। রাজনীতি-নির্বাচন, ই-কমার্সের নামে জালিয়াতি কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিড়ে এ দুটি খবর একান্তই মূল্যহীন। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, দুটি ঘটনার অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। দুটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত সোমবার (১২ অক্টোবর) শ্রম আইনের এক মামলায় আদালতে গিয়ে জামিন নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দ্বিতীয় ঘটনাটি গত ৮ অক্টোবরের। ওই দিন ভারতে ১৮ হাজার কোটি রুপির বিনিময়ে টাটা গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া এবং এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। এ ছাড়াও এয়ার ইন্ডিয়া স্যাটসের ৫০ ভাগ মালিকানা কিনে নেয় টাটা। এ দুটো ঘটনার যোগসূত্র খুঁজতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন মেধাবী মানুষ। শিক্ষক ও গবেষক। একটি গবেষণার জন্য চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ড. ইউনূসের এই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ছিল মূলত কুমিল্লার বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আকতার হামিদ খানের মডেলের অনুসরণ। এ কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে ড. ইউনূস এরশাদ সরকারের সহযোগিতা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ১ অক্টোবর ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। আস্তে আস্তে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিদেশি অনুদানে সম্প্রসারিত হয়। শিক্ষক এবং গবেষক থেকে ড. ইউনূস হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন থেকে গ্রামীণ টেলিকম সবক্ষেত্রেই হাত বাড়ান ড. ইউনূস। ড. ইউনূসের ব্যবসা ছিল ভিন্ন ধরনের। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলে এসব প্রতিষ্ঠান আয়করমুক্ত থাকে। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিতি পান। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এ নোবেল প্রাপ্তির পর গ্রামীণ ব্যাংক অন্তরালে চলে যায়। সব কৃতিত্ব ড. ইউনূসের দখলে চলে যায়। প্রচুর অনুদান, সহায়তায় ড. ইউনূস শুরু করেন সামাজিক ব্যবসার নতুন প্রকল্প। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে যায়। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইনি যুদ্ধেও জড়ান এই নোবেলজয়ী। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার পর একে একে তাঁর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হতে শুরু করে। অনেকগুলো বন্ধ। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি ব্যস্ত তাঁকে নিয়ে। পুরস্কার, অনুদান আর খ্যাতির নেশায় এখনো ক্লান্তিহীন ড. ইউনূস। এ বছর টোকিও অলিম্পিকে তিনি পেলেন অলিম্পিক লরেল। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁর এই পুরস্কার প্রাপ্তি অবিশ্বাস্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধারে সুশীল, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। কিন্তু প্রত্যেক কাজেরই একটা সীমারেখা আছে। আছে সুনির্দিষ্ট গণ্ডী। ড. ইউনূস যখন যে পরিচয় প্রয়োজন তখন তা ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন তুখোড় বক্তা। মটিভেটর। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের গুপ্ত আকাঙ্খাও মাঝে মধ্যে জাগরিত হয়। ব্যবসায়ী হিসেবে অন্যের টাকায় বিত্তশালী হওয়ারও প্রয়াস দেখা যায়। আবার রাষ্ট্রকে প্রাপ্য কর দিতে সব ফাঁকফোকর তিনি খুঁজে বের করেন অবলীলায়। একজন উদ্যোক্তাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সামনে এগোতে হয়। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন নয়। তিনি সবকিছুই করেছেন মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। সরকারের টাকায় গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় গ্রামীণ টেলিকম সেখান থেকে গ্রামীণফোনের মালিকানা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। ড. ইউনূসের সব প্রতিষ্ঠানেই প্রতারণা, শ্রমিক ঠকানো, নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানও করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রামীণ টেলিকমের কথাই ধরা যাক। ড. ইউনূস শতাধিক কর্মচারীকে স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। করেননি। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেননি। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল করেননি। এসব প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস দেশ-বিদেশে সেমিনার করেছেন, বক্তৃতা করেছেন। নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক পেয়েছেন। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেনি, নিজের দেশের জন্য কী করলেন? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ টেলিকম সর্বত্র শ্রমিক নিগ্রহ, আয়কর ফাঁকির ঘটনার পরও গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। কারণ তিনি সুশীল। তিনি সাধু। ড. ইউনূস দাবি করেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নারীরা নাকি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিকানার প্রধান শর্ত হলো হস্তান্তর। গ্রামীণ ব্যাংকের নারী ঋণগ্রহীতারা কি মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন? ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন, দরিদ্রকে জাদুঘরে পাঠাবেন। দরিদ্র এখন দাঁত কেলিয়ে হাসে। কিন্তু ড. ইউনূসের এসব কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। কারণ তিনি সুশীল। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপর পিছু হটেন। ওয়ান-ইলেভেনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই দেশের জন্য তিনি কী করেছেন? বন্যা, দুর্যোগ, করোনা মহামারীতে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো এ মানুষটি দেশের জনগণের কোনো উপকার করেছেন কি? ড. ইউনূসের আড়ালে আমরা বাংলাদেশে সুশীলদের একটি অংশের চেহারাটাই দেখি। আমাদের দেশের কিছু সুশীল সবকিছুই করতে চান, কিন্তু অন্যের সমালোচনা ছাড়া কিছুই পারেন না। রাষ্ট্র এবং বিদেশি অর্থে তারা প্রতিষ্ঠান বানান, সেসব প্রতিষ্ঠান টেকসই হয় না। দেশের সবকিছু খারাপ বলে এরা সারাক্ষণ বকবক করেন, কিন্তু দেশের জন্য, জনগণের জন্য কিছুই করেন না। এদের কাজ হলো, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালানো। ড. ইউনূস অধ্যায়টা এ পর্যন্ত রেখে আসুন একটা টাটা অধ্যায়ে মনোনিবেশ করি।
ভারতবর্ষে ১৯৩২ সালে ‘টাটা এয়ারলাইনস’ চালু হয়েছিল। এ এয়ারলাইনসের প্রতিষ্ঠাতা জে আর ডি টাটা। কয়েক বছর পর নাম বদল করে টাটা এয়ারলাইনসের নাম রাখা হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ভারতের স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। শুরু হয় টাটার মালিকানাধীন(৫১ শতাংশ)প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক অভিযাত্রা। মুম্বাই থেকে লন্ডনে ফ্লাইট যায় এয়ার ইন্ডিয়ার। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপর্যয়। ১৯৫৩ সালে জওহর লাল নেহেরু সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত নেন। তার আওতায় পড়ে এয়ার ইন্ডিয়াও। সে সময় ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ই বেসামরিক বিমান চলাচল দেখভাল করত। যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। জে আর ডি টাটাকে ডেকে জগজীবন রাম এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্ত জানান। বিস্মিত, হতবাক হয়েছিলেন জে আর ডি। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রচণ্ডভাবে। গণমাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। জে আর ডি টাটা আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। কিন্তু নেহেরু অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। তবে টাটাকে সান্ত্বনা দিতে এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান করেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। ক্ষোভ, দুঃখ নিয়েও জে আর ডি শেষ বন্ধনটুকু রাখতে রাজি হন। কিন্তু পরবর্তীতে টাটার জন্য আরও বড় অপমান অপেক্ষা করছিল। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস পরাজিত হয় নির্বাচনে। মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। এবার চিঠি দিয়ে জানানো হয় চেয়ারম্যান পদে টাটা থাকবেন না। চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাকে।
টাটার অর্থে, জে আর ডি টাটার মেধা আর শ্রমে গড়া ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ হয়ে যায় সরকারি কর্মী-কর্তাদের লুটের খনি। আস্তে আস্তে টাটা পরিণত হয় এক লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গেলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিমান পরিবহন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় দ্রুত পিছিয়ে পড়তে থাকে এয়ার ইন্ডিয়া। ২০১৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ হাজার কোটি রুপি। এটি ভারতের ১০০ দিনের বাজেটের সমান। টাটা কিনে নেওয়ার আগে এই আগস্ট পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ৬২ হাজার কোটি রুপি। প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনে ২০ কোটি রুপি। এ অবস্থায় ভারত সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার বোঝা আর বইতে পারছিল না। বিক্রির দরপত্রে টাটাই সবচেয়ে বেশি দর দেয়। টাটাদের জন্য বিষয়টি অন্যের দখলে থাকা নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার মতোই। ভারত একবার জোর করে টাটার সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। এখন টাটা ১৮ হাজার কোটি রুপি খরচ করে মধুর প্রতিশোধ নিল। এয়ার ইন্ডিয়া ফেরত পেতে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ করেননি রতন টাটা। এর পেছনে আবেগই কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। টেন্ডার জয়ের পর রতন টাটার টুইট বার্তাটি আবেগে ঘেরা। টুইটে রতন টাটা লিখেছেন- ‘ওয়েলকাম ব্যাক এয়ার ইন্ডিয়া। এ নিলাম দুর্দান্ত এক জয়। জে আর ডি টাটা আজ আমাদের মধ্যে থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন’ রতন টাটা এয়ার ইন্ডিয়াকে আবার নতুন জীবন দিতে পারবেন কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে সরকার এবং জনগণের কত বড় বোঝা যে টাটা তার নিজের কাঁধে তুলে নিল তা উপলব্ধির জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। এটাকে কী বলবেন, ব্যবসা না দেশপ্রেম?
এবার আসুন দুই প্রেক্ষাপটকে একটু মিলিয়ে দেখি।
ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাষ্ট্রের টাকায়। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস আরও এক ডজন প্রতিষ্ঠান করেছেন। সেগুলোর মালিকানা পেয়েছেন বিনা টাকায়। অন্যদিকে, টাটা গ্রুপের ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। জামসেদ টাটা পিতার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ১৮৬৮ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে কিছু করবেন। ১৮৭০ সালে মাত্র ২১ হাজার টাকার পুঁজিতে একটি ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠান করলেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু। টাটা এখন বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি বহুজাতিক কোম্পানি। ১৫৩ বছরে টাটার সম্পদের পরিমাণ ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৮ লাখ মানুষ টাটার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এয়ার ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিল টাটা। সরকার বিনা টাকায় প্রায় জোর করে কেড়ে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ভারত সরকার টাটার টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিল। যেমন ড. ইউনূস জনগণের টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিলেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের লাভের টাকায় ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইকবাল কাদির গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করলে ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমকে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যুক্ত করেন। পরে গ্রামীণফোনের ৫৫ শতাংশের মালিকানা বেচে দেন নরওয়ের টেলিনরের কাছে। এখনো ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম করপোরেশন গ্রামীণফোনের ৩৪ শতাংশের মালিক। ১ টাকা বিনিয়োগ না করেও ড. ইউনূস দেশের প্রধান মোবাইল নেটওয়ার্কের অন্যতম মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে ড. ইউনূস কত টাকা পেয়েছেন তার হিসাব কে রাখে। অন্যদিকে দেখুন টাটা নিজের প্রতিষ্ঠানই (এয়ার ইন্ডিয়া) কিনল ১৮ হাজার কোটি রুপি দিয়ে। একজন কোনো টাকা বিনিয়োগ না করেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। সেই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি কোম্পানির কাছে। অন্যদিকে টাটা নিজের বিনিয়োগে গড়া এয়ার ইন্ডিয়া কেড়ে নেওয়ার দুঃখ বয়ে বেরিয়েছেন ৬৮ বছর। প্রথম সুযোগে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান আবার নিজেদের কাছে ফেরত এনেছেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি হারানোর পর ড. ইউনূস কী না করেছেন। দেশে-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে অভিযোগ করেছেন। হিলারি আবার এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও ফোন করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ইউনূসের প্রস্থানে হিলারি প্রচণ্ড রাগ করেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যেন বিনিয়োগ না করে সে জন্য বিশ্বব্যাংককে সুপারিশ করেছিলেন। দেখুন একটি পদ হারাতেই কীভাবে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠেন একজন সুশীল। অন্যদিকে টাটার আস্ত একটা বিমান কোম্পানি কেড়ে নিল ভারত সরকার। টাটা কিছু করল না। এরপরও টাটা ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কারও কাছে নালিশ করেনি। বরং টাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বে ভারতের সম্মান বাড়িয়েছে।
ড. ইউনূসের শোকেসে পুরস্কারের শোভা। নোবেল জয়ের টাকা কী করেছেন? তার বক্তৃতা, সেমিনার বা বিদেশে বিনিয়োগ টাকা তিনি কী করেন? গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির টাকাই বা তিনি কী করলেন? কেউ কোনো দিন শুনেছেন, ড. ইউনূস গরিব মানুষকে ত্রাণ দিয়েছেন? দুস্থ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন? প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করেছেন? না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো কর্মকাণ্ডে আমরা এই শান্তিতে নোবেলজয়ীকে পাই না। নিজের নামে একটি সেন্টার করেছেন। ইউনূস সেন্টারের প্রধান কাজ হলো ড. ইউনূসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, তাঁর ইমেজ বাড়ানো। অন্যদিকে টাটা সাসটেইনেবিলিটি গ্রুপ বছরে গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় করে ১ হাজার কোটি রুপির ওপরে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নে টাটা আলোচিত এবং প্রশংসিত একটি নাম। সমাজসেবায় টাটার অবদান সর্বজনবিদিত।
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর এই উদ্যোগে বাতাস দেয় এ দেশের চিহ্নিত সুশীল গোষ্ঠী। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে এত বিপুল অবদানের পরও টাটার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিল্প গ্রুপ হওয়ার পরও টাটার কারও মন্ত্রী-এমপি হওয়ার খায়েশ হয়নি। রাজনৈতিক দল গঠনেরও অভিপ্রায় জাগেনি। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা পরিবারের তুলনা করলাম, কিছু বাস্তব কারণে। বাংলাদেশে প্রায়ই একটি মনোভাব দেখা যায়, সুশীলরা প্রচণ্ড সৎ। তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। মানুষের জন্য জান কোরবান করতে পারেন তারাই। আর ব্যবসায়ীরা হলেন অসৎ, দুর্বৃত্ত, মানুষের টাকা লুটে খান। কিন্তু সুশীলদের শিরোমণি ড. ইউনূসের কর্মকান্ডের এক চিলতে আলোকপাত করতেই আমরা দেখলাম কী অবস্থা। বাংলাদেশে সুশীল নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিহীন। এর নিয়ন্ত্রকরা প্রতিষ্ঠানে রাজতন্ত্র কায়েম করে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে এদের পদ থেকে কেউ সরাতে পারে না। আমি জানি, অনেকেই প্রশ্ন করবেন, বাংলাদেশে কি টাটার মতো প্রতিষ্ঠান আছে? আমাদের শিল্প পরিবারগুলো কি টাটার মতো? বাংলাদেশের ৫০ বছরে বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক এগিয়ে নিতে এরা অবদান রাখছে নিরলসভাবে। সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তারপরও বেসরকারি খাত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম সহযাত্রী। টাটা এক দিনে হয়নি। কিন্তু ভারতে বা বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের যে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, বাংলাদেশে কি তা হয়? সব সময় ব্যবসায়ীদের খুঁত ধরার এক প্রচন্ড প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার সুশীল হলেই তিনি যেন বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যান। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের দায়িত্বের সীমারেখা আছে। এই সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয়। বাংলাদেশে আমরা দেখি, ব্যবসায়ীরা মন্ত্রী-এমপি হতে চান। আমলারা রাজনীতিবিদ বনে যান। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা করতে চান। আর সুশীল সমাজের একটি অংশ রাজনীতি, ব্যবসা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। কিন্তু সীমানার বাইরে গেলে কোনো কাজ যে সফল হয় না তার প্রমাণ ড. ইউনূসের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক আকাঙ্খা। আর রাষ্ট্র যে ব্যবসা করতে পারে না এয়ার ইন্ডিয়া তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাই আমরা আমাদের দায়িত্বের সীমার মধ্যেই থাকি। যার যেটা কাজ নয়, সেটা করলে বিপত্তিই বাড়ে।
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
মো. সিদ্দিকুর রহমান আওয়ামী লীগ বিপ্লব বড়ুয়া সুজিত রায় নন্দী
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।
টানা ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। ১৬ বছরে পা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ। টানা ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে একটা ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদেরকে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করে একেক মেয়াদে একেক জনকে মন্ত্রী করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন করে নেতাদের যেমন যোগ্যতা পরিমাপ করেন, ঠিক তেমনি তাদেরকে ক্ষমতাবান করেন।