এডিটর’স মাইন্ড

ড. ইউনূস বনাম রতন টাটা

প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ অক্টোবর, ২০২১


Thumbnail

দুটো খবর দুই দেশের। আপাতদৃষ্টিতে দুই খবরের কোনো মিল নেই। রাজনীতি-নির্বাচন, ই-কমার্সের নামে জালিয়াতি কিংবা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরের ভিড়ে এ দুটি খবর একান্তই মূল্যহীন। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, দুটি ঘটনার অদ্ভুত যোগসূত্র আছে। দুটি ঘটনাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত সোমবার (১২ অক্টোবর) শ্রম আইনের এক মামলায় আদালতে গিয়ে জামিন নিয়েছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দ্বিতীয় ঘটনাটি গত ৮ অক্টোবরের। ওই দিন ভারতে ১৮ হাজার কোটি রুপির বিনিময়ে টাটা গ্রুপের হাতে তুলে দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া এবং এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস। এ ছাড়াও এয়ার ইন্ডিয়া স্যাটসের ৫০ ভাগ মালিকানা কিনে নেয় টাটা। এ দুটো ঘটনার যোগসূত্র খুঁজতে হলে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন মেধাবী মানুষ। শিক্ষক ও গবেষক। একটি গবেষণার জন্য চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ড. ইউনূসের এই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম ছিল মূলত কুমিল্লার বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আকতার হামিদ খানের মডেলের অনুসরণ। এ কার্যক্রমকে সম্প্রসারিত করতে ড. ইউনূস এরশাদ সরকারের সহযোগিতা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ১ অক্টোবর ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। আস্তে আস্তে ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ বিদেশি অনুদানে সম্প্রসারিত হয়। শিক্ষক এবং গবেষক থেকে ড. ইউনূস হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন থেকে গ্রামীণ টেলিকম সবক্ষেত্রেই হাত বাড়ান ড. ইউনূস। ড. ইউনূসের ব্যবসা ছিল ভিন্ন ধরনের। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বলে এসব প্রতিষ্ঠান আয়করমুক্ত থাকে। দেশের গণ্ডী পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি পরিচিতি পান। ২০০৬ সালে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান। এ নোবেল প্রাপ্তির পর গ্রামীণ ব্যাংক অন্তরালে চলে যায়। সব কৃতিত্ব ড. ইউনূসের দখলে চলে যায়। প্রচুর অনুদান, সহায়তায় ড. ইউনূস শুরু করেন সামাজিক ব্যবসার নতুন প্রকল্প। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তাঁর চাকরির বয়সসীমা পেরিয়ে যায়। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আইনি যুদ্ধেও জড়ান এই নোবেলজয়ী। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরে যাওয়ার পর একে একে তাঁর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হতে শুরু করে। অনেকগুলো বন্ধ। তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি ব্যস্ত তাঁকে নিয়ে। পুরস্কার, অনুদান আর খ্যাতির নেশায় এখনো ক্লান্তিহীন ড. ইউনূস। এ বছর টোকিও অলিম্পিকে তিনি পেলেন অলিম্পিক লরেল। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তাঁর এই পুরস্কার প্রাপ্তি অবিশ্বাস্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধারে সুশীল, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। কিন্তু প্রত্যেক কাজেরই একটা সীমারেখা আছে। আছে সুনির্দিষ্ট গণ্ডী। ড. ইউনূস যখন যে পরিচয় প্রয়োজন তখন তা ব্যবহার করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি একজন তুখোড় বক্তা। মটিভেটর। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের গুপ্ত আকাঙ্খাও মাঝে মধ্যে জাগরিত হয়। ব্যবসায়ী হিসেবে অন্যের টাকায় বিত্তশালী হওয়ারও প্রয়াস দেখা যায়। আবার রাষ্ট্রকে প্রাপ্য কর দিতে সব ফাঁকফোকর তিনি খুঁজে বের করেন অবলীলায়। একজন উদ্যোক্তাকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সামনে এগোতে হয়। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন নয়। তিনি সবকিছুই করেছেন মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো। সরকারের টাকায় গ্রামীণ ব্যাংক করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় গ্রামীণ টেলিকম সেখান থেকে গ্রামীণফোনের মালিকানা পর্যন্ত নিয়েছিলেন। ড. ইউনূসের সব প্রতিষ্ঠানেই প্রতারণা, শ্রমিক ঠকানো, নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। একটি প্রতিষ্ঠানও করপোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। গ্রামীণ টেলিকমের কথাই ধরা যাক। ড. ইউনূস শতাধিক কর্মচারীকে স্থায়ী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। করেননি। শান্তিতে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিও পূরণ করেননি। শ্রমিক কল্যাণ তহবিল করেননি। এসব প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস দেশ-বিদেশে সেমিনার করেছেন, বক্তৃতা করেছেন। নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন পদক পেয়েছেন। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেনি, নিজের দেশের জন্য কী করলেন? গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ টেলিকম সর্বত্র শ্রমিক নিগ্রহ, আয়কর ফাঁকির ঘটনার পরও গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। কারণ তিনি সুশীল। তিনি সাধু। ড. ইউনূস দাবি করেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা নারীরা নাকি ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক। মালিকানার প্রধান শর্ত হলো হস্তান্তর। গ্রামীণ ব্যাংকের নারী ঋণগ্রহীতারা কি মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন? ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন, দরিদ্রকে জাদুঘরে পাঠাবেন। দরিদ্র এখন দাঁত কেলিয়ে হাসে। কিন্তু ড. ইউনূসের এসব কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ নেই। কারণ তিনি সুশীল। ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল জয় করে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারপর পিছু হটেন। ওয়ান-ইলেভেনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই দেশের জন্য তিনি কী করেছেন? বন্যা, দুর্যোগ, করোনা মহামারীতে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো এ মানুষটি দেশের জনগণের কোনো উপকার করেছেন কি? ড. ইউনূসের আড়ালে আমরা বাংলাদেশে সুশীলদের একটি অংশের চেহারাটাই দেখি। আমাদের দেশের কিছু সুশীল সবকিছুই করতে চান, কিন্তু অন্যের সমালোচনা ছাড়া কিছুই পারেন না। রাষ্ট্র এবং বিদেশি অর্থে তারা প্রতিষ্ঠান বানান, সেসব প্রতিষ্ঠান টেকসই হয় না। দেশের সবকিছু খারাপ বলে এরা সারাক্ষণ বকবক করেন, কিন্তু দেশের জন্য, জনগণের জন্য কিছুই করেন না। এদের কাজ হলো, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে গুলি চালানো। ড. ইউনূস অধ্যায়টা এ পর্যন্ত রেখে আসুন একটা টাটা অধ্যায়ে মনোনিবেশ করি।

ভারতবর্ষে ১৯৩২ সালে ‘টাটা এয়ারলাইনস’ চালু হয়েছিল। এ এয়ারলাইনসের প্রতিষ্ঠাতা জে আর ডি টাটা। কয়েক বছর পর নাম বদল করে টাটা এয়ারলাইনসের নাম রাখা হয় এয়ার ইন্ডিয়া। ভারতের স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। শুরু হয় টাটার মালিকানাধীন(৫১ শতাংশ)প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক অভিযাত্রা। মুম্বাই থেকে লন্ডনে ফ্লাইট যায় এয়ার ইন্ডিয়ার। কিন্তু এরপরই ঘটে বিপর্যয়। ১৯৫৩ সালে জওহর লাল নেহেরু সব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত নেন। তার আওতায় পড়ে এয়ার ইন্ডিয়াও। সে সময় ভারতের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ই বেসামরিক বিমান চলাচল দেখভাল করত। যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। জে আর ডি টাটাকে ডেকে জগজীবন রাম এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণের সরকারি সিদ্ধান্ত জানান। বিস্মিত, হতবাক হয়েছিলেন জে আর ডি। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন প্রচণ্ডভাবে। গণমাধ্যমে সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রায়ত্তকরণের সিদ্ধান্ত দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। জে আর ডি টাটা আশা করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। কিন্তু নেহেরু অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। তবে টাটাকে সান্ত্বনা দিতে এয়ার ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান করেন। নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। ক্ষোভ, দুঃখ নিয়েও জে আর ডি শেষ বন্ধনটুকু রাখতে রাজি হন। কিন্তু পরবর্তীতে টাটার জন্য আরও বড় অপমান অপেক্ষা করছিল। ১৯৭৮ সালে কংগ্রেস পরাজিত হয় নির্বাচনে। মোরারজি দেশাই হন প্রধানমন্ত্রী। এবার চিঠি দিয়ে জানানো হয় চেয়ারম্যান পদে টাটা থাকবেন না। চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় একজন অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাকে।

টাটার অর্থে, জে আর ডি টাটার মেধা আর শ্রমে গড়া ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ হয়ে যায় সরকারি কর্মী-কর্তাদের লুটের খনি। আস্তে আস্তে টাটা পরিণত হয় এক লোকসানি প্রতিষ্ঠানে। ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতিতে গেলে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিমান পরিবহন কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় দ্রুত পিছিয়ে পড়তে থাকে এয়ার ইন্ডিয়া। ২০১৭ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫২ হাজার কোটি রুপি। এটি ভারতের ১০০ দিনের বাজেটের সমান। টাটা কিনে নেওয়ার আগে এই আগস্ট পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ ৬২ হাজার কোটি রুপি। প্রতিদিন এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনে ২০ কোটি রুপি। এ অবস্থায় ভারত সরকার এয়ার ইন্ডিয়ার বোঝা আর বইতে পারছিল না। বিক্রির দরপত্রে টাটাই সবচেয়ে বেশি দর দেয়। টাটাদের জন্য বিষয়টি অন্যের দখলে থাকা নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার মতোই। ভারত একবার জোর করে টাটার সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল। এখন টাটা ১৮ হাজার কোটি রুপি খরচ করে মধুর প্রতিশোধ নিল। এয়ার ইন্ডিয়া ফেরত পেতে ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ করেননি রতন টাটা। এর পেছনে আবেগই কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। টেন্ডার জয়ের পর রতন টাটার টুইট বার্তাটি আবেগে ঘেরা। টুইটে রতন টাটা লিখেছেন- ‘ওয়েলকাম ব্যাক এয়ার ইন্ডিয়া। এ নিলাম দুর্দান্ত এক জয়। জে আর ডি টাটা আজ আমাদের মধ্যে থাকলে সবচেয়ে খুশি হতেন’ রতন টাটা এয়ার ইন্ডিয়াকে আবার নতুন জীবন দিতে পারবেন কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে সরকার এবং জনগণের কত বড় বোঝা যে টাটা তার নিজের কাঁধে তুলে নিল তা উপলব্ধির জন্য অর্থনীতিবিদ হওয়ার দরকার নেই। এটাকে কী বলবেন, ব্যবসা না দেশপ্রেম?
এবার আসুন দুই প্রেক্ষাপটকে একটু মিলিয়ে দেখি।

ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাষ্ট্রের টাকায়। রাষ্ট্রের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের চাকরি করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি কুক্ষিগত করে ফেলেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের লাভের টাকায় ড. ইউনূস আরও এক ডজন প্রতিষ্ঠান করেছেন। সেগুলোর মালিকানা পেয়েছেন বিনা টাকায়। অন্যদিকে, টাটা গ্রুপের ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। জামসেদ টাটা পিতার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। ১৮৬৮ সালে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজে কিছু করবেন। ১৮৭০ সালে মাত্র ২১ হাজার টাকার পুঁজিতে একটি ট্রেডিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠান করলেন। সেখান থেকে যাত্রা শুরু। টাটা এখন বিশ্বব্যাপী পরিচালিত একটি বহুজাতিক কোম্পানি। ১৫৩ বছরে টাটার সম্পদের পরিমাণ ১০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৮ লাখ মানুষ টাটার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। এয়ার ইন্ডিয়া গড়ে তুলেছিল টাটা। সরকার বিনা টাকায় প্রায় জোর করে কেড়ে নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ভারত সরকার টাটার টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিল। যেমন ড. ইউনূস জনগণের টাকায় গড়া একটি প্রতিষ্ঠান দখল করে নিয়েছিলেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের লাভের টাকায় ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইকবাল কাদির গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠা করলে ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমকে গ্রামীণফোনের সঙ্গে যুক্ত করেন। পরে গ্রামীণফোনের ৫৫ শতাংশের মালিকানা বেচে দেন নরওয়ের টেলিনরের কাছে। এখনো ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম করপোরেশন গ্রামীণফোনের ৩৪ শতাংশের মালিক। ১ টাকা বিনিয়োগ না করেও ড. ইউনূস দেশের প্রধান মোবাইল নেটওয়ার্কের অন্যতম মালিক। গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে ড. ইউনূস কত টাকা পেয়েছেন তার হিসাব কে রাখে। অন্যদিকে দেখুন টাটা নিজের প্রতিষ্ঠানই (এয়ার ইন্ডিয়া) কিনল ১৮ হাজার কোটি রুপি দিয়ে। একজন কোনো টাকা বিনিয়োগ না করেই একের পর এক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। সেই প্রতিষ্ঠানের সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিদেশি কোম্পানির কাছে। অন্যদিকে টাটা নিজের বিনিয়োগে গড়া এয়ার ইন্ডিয়া কেড়ে নেওয়ার দুঃখ বয়ে বেরিয়েছেন ৬৮ বছর। প্রথম সুযোগে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে সেই প্রতিষ্ঠান আবার নিজেদের কাছে ফেরত এনেছেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরি হারানোর পর ড. ইউনূস কী না করেছেন। দেশে-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের কাছে অভিযোগ করেছেন। হিলারি আবার এ জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও ফোন করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে ইউনূসের প্রস্থানে হিলারি প্রচণ্ড রাগ করেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশের স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে যেন বিনিয়োগ না করে সে জন্য বিশ্বব্যাংককে সুপারিশ করেছিলেন। দেখুন একটি পদ হারাতেই কীভাবে প্রতিশোধপ্রবণ হয়ে ওঠেন একজন সুশীল। অন্যদিকে টাটার আস্ত একটা বিমান কোম্পানি কেড়ে নিল ভারত সরকার। টাটা কিছু করল না। এরপরও টাটা ভারতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। কারও কাছে নালিশ করেনি। বরং টাটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বে ভারতের সম্মান বাড়িয়েছে।

ড. ইউনূসের শোকেসে পুরস্কারের শোভা। নোবেল জয়ের টাকা কী করেছেন? তার বক্তৃতা, সেমিনার বা বিদেশে বিনিয়োগ টাকা তিনি কী করেন? গ্রামীণ ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির টাকাই বা তিনি কী করলেন? কেউ কোনো দিন শুনেছেন, ড. ইউনূস গরিব মানুষকে ত্রাণ দিয়েছেন? দুস্থ শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন? প্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করেছেন? না। সামাজিক দায়বদ্ধতার কোনো কর্মকাণ্ডে আমরা এই শান্তিতে নোবেলজয়ীকে পাই না। নিজের নামে একটি সেন্টার করেছেন। ইউনূস সেন্টারের প্রধান কাজ হলো ড. ইউনূসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, তাঁর ইমেজ বাড়ানো। অন্যদিকে টাটা সাসটেইনেবিলিটি গ্রুপ বছরে গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় করে ১ হাজার কোটি রুপির ওপরে। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নে টাটা আলোচিত এবং প্রশংসিত একটি নাম। সমাজসেবায় টাটার অবদান সর্বজনবিদিত।

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তাঁর এই উদ্যোগে বাতাস দেয় এ দেশের চিহ্নিত সুশীল গোষ্ঠী। কিন্তু দেশের অর্থনীতিতে এত বিপুল অবদানের পরও টাটার কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। ভারতের অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ শিল্প গ্রুপ হওয়ার পরও টাটার কারও মন্ত্রী-এমপি হওয়ার খায়েশ হয়নি। রাজনৈতিক দল গঠনেরও অভিপ্রায় জাগেনি। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার নেতৃত্বে টাটা পরিবারের তুলনা করলাম, কিছু বাস্তব কারণে। বাংলাদেশে প্রায়ই একটি মনোভাব দেখা যায়, সুশীলরা প্রচণ্ড সৎ। তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক। মানুষের জন্য জান কোরবান করতে পারেন তারাই। আর ব্যবসায়ীরা হলেন অসৎ, দুর্বৃত্ত, মানুষের টাকা লুটে খান। কিন্তু সুশীলদের শিরোমণি ড. ইউনূসের কর্মকান্ডের এক চিলতে আলোকপাত করতেই আমরা দেখলাম কী অবস্থা। বাংলাদেশে সুশীল নিয়ন্ত্রিত প্রায় সব প্রতিষ্ঠান জবাবদিহিহীন। এর নিয়ন্ত্রকরা প্রতিষ্ঠানে রাজতন্ত্র কায়েম করে রেখেছেন। মৃত্যুর আগে এদের পদ থেকে কেউ সরাতে পারে না। আমি জানি, অনেকেই প্রশ্ন করবেন, বাংলাদেশে কি টাটার মতো প্রতিষ্ঠান আছে? আমাদের শিল্প পরিবারগুলো কি টাটার মতো? বাংলাদেশের ৫০ বছরে বেশ কয়েকটি শিল্প গ্রুপ দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক এগিয়ে নিতে এরা অবদান রাখছে নিরলসভাবে। সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু তারপরও বেসরকারি খাত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অন্যতম সহযাত্রী। টাটা এক দিনে হয়নি। কিন্তু ভারতে বা বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের যে সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হয়, বাংলাদেশে কি তা হয়? সব সময় ব্যবসায়ীদের খুঁত ধরার এক প্রচন্ড প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার সুশীল হলেই তিনি যেন বিচারের ঊর্ধ্বে চলে যান। ড. ইউনূস এবং রতন টাটার ঘটনা একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয়। রাষ্ট্র এবং সমাজে প্রত্যেক শ্রেণি-পেশার মানুষের দায়িত্বের সীমারেখা আছে। এই সীমারেখা অতিক্রম করা উচিত নয়। বাংলাদেশে আমরা দেখি, ব্যবসায়ীরা মন্ত্রী-এমপি হতে চান। আমলারা রাজনীতিবিদ বনে যান। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা করতে চান। আর সুশীল সমাজের একটি অংশ রাজনীতি, ব্যবসা সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নিতে চান।  কিন্তু সীমানার বাইরে গেলে কোনো কাজ যে সফল হয় না তার প্রমাণ ড. ইউনূসের ব্যবসা এবং রাজনৈতিক আকাঙ্খা। আর রাষ্ট্র যে ব্যবসা করতে পারে না এয়ার ইন্ডিয়া তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।  তাই আমরা আমাদের দায়িত্বের সীমার মধ্যেই থাকি। যার যেটা কাজ নয়, সেটা করলে বিপত্তিই বাড়ে।



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘ধোঁকা’ ধাক্কায় গর্তে বিএনপি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন, বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন? হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।

আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত, এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে, তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়। মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি। বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছে।

২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২ বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে। ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।

এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায় নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন। মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন। এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায় ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায় মুখ লুকান।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।



লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   বিএনএম   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদীদের ভীড় এবং সাকিব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২২ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ? এই আওয়ামী লীগ কি জাতির পিতার আদর্শের দল? এই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কি শেখ হাসিনার মতো সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্য? নাকি আওয়ামী লীগকে এখন গ্রাস করছে সুবিধাবাদী, চাটুকাররা। আওয়ামী লীগে অতিথি পাখিদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দুঃসময়ের কান্ডারীরা? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বহুরূপী নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ছবি দেখে। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ নির্বাচনের আগে বিএনপি ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এই তথ্য পুরোনো। বিএনএম নামে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি কিংস পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের কথা ছিলো তার। এজন্য বিভিন্ন দলের লোকজনকে জড়ো করার কাজেও হাত দিয়েছিলেন বিএনপির এই নেতা। তারই অংশ হিসেবে সাকিব আল হাসানকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মেজর (অবঃ) হাফিজ। নতুন এই দলে যোগও দিয়েছিলেন সাকিব। তাদের যুগল বন্দী ছবিতে কাউকে দুঃখিত মনে হয়নি। দু’জনের কেউই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফটোফ্রেমে বন্দী হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসাব নিকাশ মেলেনি। দেনা পাওনার হিসেব না মেলায় মেজর (অবঃ) হাফিজ বিএনএমের নেতৃত্ব নেননি। সাকিবও ক্ষমতাহীন এই দলে গিয়ে নিজের সদ্য শুরু রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিসর্জন দিতে চাননি। সাকিব যখন বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসছে, তখন তিনি আওয়ামী লীগের দরজায় টোকা দিয়েছেন। নিজের ‘ব্রান্ড’ ভেল্যুকে কাজে লাগিয়ে এমপিও হয়েছেন। অন্য দিকে আদর্শহীন পতিত রাজনীতিবিদ হতে হতে ফিরে আসা মেজর (অবঃ) হাফিজ নিজেকে ‘বীরপুরুষ’ হিসেবে জাহির করার সুযোগ পেয়েছেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে, নিজের সুবিধাবাদী পাপস্খলন করেছেন। এরপর রীতিমতো ইউটার্ন নিয়ে তারেক বন্দনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের শূণ্য স্থান পূরণের জন্য বিএনপিতে একজন নির্লজ্জ তেলবাজ চাটুকার দরকার ছিলো। প্রয়োজন ছিলো একজন ভাঁড় জ্যোতিষীর। মেজর (অবঃ) হাফিজ এখন বিএনপির সেই ভাঁড় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। যিনি জ্যোতীষ সাধনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন বিএনপি খুব শীঘ্রই ক্ষমতায় আসছেন। হতাশার সাগরে ডুবে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মেজর (অবঃ) হাফিজের কথায় ‘হতবাক’। নির্বাচনের আগে যে লোকটি, বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের কট্টর সমালোচক ছিলেন। যিনি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে না যাওয়ার বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন, তিনিই কিনা তারেকের ‘কাছের মানুষ’ হবার জন্য নিজেকে একজন রাজনৈতিক ক্লাউন হিসেবে উপস্থাপন করলেন। আমি মেজর (অবঃ) হাফিজকে নিয়ে কথা বলতে চাই না। ৭৫ এর পর বাংলাদেশে যে অপরাজনীতির ধারা সেই ধারার রাজনীতিতে মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো বহু পরগাছা আবর্জনা তৈরী হয়েছে। রাজনীতি মানে যাদের কাছে স্রেফ ক্ষমতার হালুয়া রুটির হিস্যা পাওয়া। বিএনএমে তিনি যোগ দিন বা না দিন, তার লোভাতুর, ক্ষুধার্ত চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো নিজের স্বার্থে রং বদল করা রাজনীতিবীদের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন, একদা দেশে সেরা ক্রিকেট অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। কি চমৎকার! রতনে রতন চেনে। 

সাকিব অবশ্য বৈষয়িক হিসেব নিকেশে মেজর (অবঃ) হাফিজের চেয়ে পাকা খেলোয়াড়। ক্রিকেট কেবল খেলা নয়, এটি বড় লোক, ক্ষমতাবান হবার একটা ম্যাজিক সিড়ি-এই ভাবনার আবিষ্কারক সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটকে সামনে রেখে তিনি বহুমাত্রিক বাণিজ্যে নিজের বিপুল প্রতিভাকে জাতির সামনে দেখিয়েছেন। কুমিরের ব্যবসা থেকে সোনা। হোটেল ব্যবসা থেকে কসমেটিকস সব জায়গায় তার বিচরণ। যে ক্রিকেট তাকে সবকিছু দিয়েছে, সেই ক্রিকেটকেই তিনি উপেক্ষা করেছেন নিজের আখের গোছোতে। এরকম সুবিধাবাদীরা ভয়ংকর। যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্যই বিপদজ্জনক। এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী তরুণকে আওয়ামী লীগ আলিঙ্গন করেছে। মনোনয়ন দিয়েছে এবং এমপিও বানিয়েছে। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিয়ে কোন সংশয় ছিলো না। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ ছিলো ভোটার উপস্থিতি, উৎসব মুখর, বিতর্কহীন নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাকিবের মতো এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করা ব্যক্তি কতটা প্রয়োজন, সে এক প্রশ্ন বটে। অনেকে বলবেন, গ্লামার বাড়াতে সাকিব, ফেরদৌস এর মতো তারকাদের নির্বাচনের মাঠে দরকার ছিলো। এতে সাধারণ মানুষের নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তথ্য উপাত্ত এই বক্তব্য সমর্থন করেনা। 

চিত্রনায়ক ফেরদৌসের ধানমন্ডি আসনের চেয়ে অনেক বেশী ভোট পেয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক তার মোহাম্মদপুর আসনে কিংবা বাহাউদ্দিন নাছিম মতিঝিলে। মাগুড়াতেও সাকিব কোন ভোট বিপ্লব করতে পারেন নি। বরং নির্বাচনের পর সাকিবকে ঘিরে নিত্য নতুন বিতর্ক তৈরী হচ্ছে। তার বোন একটি বেটিং অ্যাপের মালিকানায় আছে, এমন সংবাদ নিয়ে কদিন হৈ চৈ হলো। এর রেশে কাটতে না কাটতেই তখন সাকিব-হাফিজের বিএনএম কেলেংকারী। কেউ কেউ বলেছেন, সাকিব নাকি তারেকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই রটনাকারীদের অপপ্রচার। তবে, সাকিব যখন থেকে জন পরিচিতি পেয়েছেন, তখন থেকে তার মধ্যে এক লোভাতুর অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। বিত্ত, বৈভব ক্ষমতা, নাম যশের জন্য সাকিব সবকিছু করতে পারেন-এরকম একটা ভাবমূর্তি সাকিব তৈরী করেছেন। তাকে কখনো মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো আদর্শবান, নীতিবান একজন ব্যক্তিত্ব মনে হয়নি। আওয়ামী লীগে এখন সুবিধাবাদীদের জন্য দরজা যে খুলে দেয়া হয়েছে, সাকিবের সংসদ সদস্য হওয়া তার প্রমাণ। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ-সাকিব কান্ডের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা আরো উদ্বেগজনক এবং আতংকের। সাকিব কান্ড নিয়ে যখন মিডিয়ার তোলপাড় তখন ওবায়দুল কাদের বললেন, মনোনয়ন পাবার আগে সাকিব আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। এর আগে সাকিব কি করেছেন, সেটি নাকি তার (আওয়ামী লীগের) দেখার বিষয় না। কি সাংঘাতিক কথা! তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের আত্মীয় আত্মীয় স্বজন, জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করলেই সেই ব্যাক্তি পূত-পবিত্র হয়ে যাবেন? লুটেরা, দুর্নীতিবাজ অর্থ-পাচারকারীরা অবলীলায় আওয়ামী লীগে ঢুকে যেতে পারবেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য কি দলটি নীতি-আদর্শিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়? 

আওয়ামী লীগে অবশ্য সাকিবের মতো সুবিধাবাদীদেরই ভীড় এখন বেশী। তারাই এখন ক্ষমতার মধু খাচ্ছেন। হালুয়া-রুটির ভাগ বাটোয়ারাতেও তাদের হিস্যা বেশী। সাকিব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সেটির আগের এমপি ছিলেন একজন ত্যাগী পরীক্ষিত তরুন। যার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের দুঃসময় কষ্ট করেছে, সংগঠনকে আগলে রাখার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। ঐ তরুণের রাজনৈতিক জীবনে কোন বিচ্যুতি নেই। আদর্শ থেকে সরে আসেননি কখনো। এমনকি এবার নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়েও প্রতিবাদ করেননি বিনয়ী এই রাজনীতিবিদ। কারো কাছে প্রশ্ন করেন নি-‘কি আমার অপরাধ’? উন্মুক্ত নির্বাচন সত্বেও অনেকের মতো স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এই তরুণ বয়সে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিতে আদর্শ নিয়ে টিকে থাকাই আসল জয়। কিন্তু সাকিবের মতো সুসময়ের অতিথি পাখিদের কাছে আপাততঃ কোণঠাসা, দুঃসময়ের যোদ্ধা শিখর’রা। এটি শুধু মাগুরার এই আসনের চিত্র নয়। সারা দেশে এরকম বহু ত্যাগী সংগ্রামী, দুঃসময়ে দলের জন্য সবকিছু উজাড় করা আদর্শবান নেতা কর্মীরা আজ উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগের সুসময় তারা পরিত্যন্ত। অনাহুত। অপাংক্তেয়। তাহলে কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানরা শুধু দুঃসময়ে নির্যাতিত হবার জন্য? দলকে বাঁচাতে জীবন, যৌবন বিসর্জন দেয়ার জন্য? সুসময়ে তারা থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। বুক ভরা দুঃখ চেপে শুধু নীরবে গুমড়ে কাঁদার জন্যই কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানদের দরকার? 

ইতিহাস বলে, সুবিধাবাদী, চাটুকাররা দুঃসময়ে থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে যারা স্তুতির বন্যায় ভাসিয়ে রাখতো তারা ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর দলের পাশে দাঁড়ায় নি, প্রতিবাদ করেনি। সাকিবের চেয়েও বড় তারকা ড. কামাল হোসেন ৭৫ এর পর কি করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। ৯১ এর দুঃসময়েও ভাড়াটে সুবিধাবাদীরা সটকে পড়েছে। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীরা তারকারা ভোল পাল্টাতে সময় নেয়নি। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফ, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ব্যরিস্টার শফিক আহমেদের মতো উপেক্ষিতরাই আওয়ামী লীগ সভাপতির পাশে দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে দল রক্ষায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তেল চিটচিটে পাঞ্জাবী আর রং চটা মুজিব কোট পরা নির্ভীক তৃণমুল। যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ, কাঁদা মাটি মাখা গায়ে রক্ত ঝরিয়ে তারাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন, শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার দুঃসময়ে তারাই আওয়ামী লীগকে রক্ষায় রুখে দাঁড়াবে। তাহলে সুসময়ে কেন সুবিধাবাদীরা লুটেপুটে খাবে? আরেকটি দুঃসময় ডেকে আনার জন্য? এই স্বস্তির সুসময়ে আওয়ামী লীগ কেন মূল্যায়ন করে না দুঃসময়ের কান্ডারীদের?   

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের অনাহূতরা

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২০ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।

এরকম ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে রয়েছেন;

লিয়াকত শিকদার: লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী। দুঃসময়ে একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেখ হাসিনার প্রশ্নে তাকে কখনও আপোষ করতে দেখা যায়নি। কর্মীদের মধ্যে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু তারপরেও লিয়াকত শিকদার আওয়ামী লীগে অনাহূত।

ইসহাক আলী খান পান্না: ইসহাক আলী খান পান্না ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার সভাপতি এনামুল হক শামীম মন্ত্রী-এমপি হলেও ইসহাক আলী পান্নার কপালে কিছু জোটেনি। কি তার অপরাধ কেউ বলতে পারে না। 

মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী: মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একজন পরিচ্ছন্ন মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী এখন অপাংক্তেয়। তাকে কোথাও দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তিনি নেই। সংসদ সদস্য হিসেবেও তার তিনি জায়গা পাননি। আর মন্ত্রী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর অপরাধ কি কেউ বলতে পারে না। তার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছিল, তার যারা অনুগত কর্মী ছিল তাদেরও কেউ কেউ এখন মন্ত্রী হয়েছেন, অনেকেই এমপি হয়েছেন। কিন্তু মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী সেই জায়গাতেই রয়ে গেছেন।

বাহাদুর বেপারী: আওয়ামী লীগের আরেকজন মেধাবী ছাত্র নেতার নাম বাহাদুর বেপারী। বিভিন্ন সময় তার মেধা এবং যোগ্যতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে চর্চা হয়। ছাত্রলীগের যে কয়েকজন মেধাবী নেতা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে বাহাদুর বেপারী অন্যতম। কিন্তু বাহাদুর বেপারীও এখন আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। তিনিও এখন প্রায় অনাহূত। তাকে নিয়েও এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে খুব একটা চর্চা হয় না। বাহাদুর বেপারী ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বড় ধরনের লিড পাবেন বা তার তিনি পাদপ্রদীপে আসতে পারবেন এমনটিও মনে করেন না অনেকে।

অজয় কর খোকন: অজয় কর খোকনও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী এবং কঠিন সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অজয় কর খোকনও এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অপাংক্তেয়। তার কমিটিতে থাকা অনেকেই আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু অজয় কর খোকন যেন পরিত্যক্ত বাসের মতো আওয়ামী লীগে অপাংক্তেয় হয়ে আছেন।

দুঃসময়ের এসমস্ত ছাত্রলীগের নেতাদেরকে কেন টেনে তোলা হচ্ছে না, কেন তারা পরিত্যক্ত অবস্থায়, অনাহূত অবস্থায় আছেন এটি আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন। তবে এদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও যারা ছাত্রলীগ করে এসেছেন, এখন ভালো জায়গায় আছেন তারাও খুব একটা কথা বলতে রাজি হননা। কারণ পাছে তাদের নিজেদের সুবিধাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেউই এ সমস্ত অনাহূত, ত্যাগী, পরীক্ষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের জন্য কথা বলতে আগ্রহী নন। কেন? সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগ   ছাত্রলীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

ড. ইউনূসের মামলা এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। এই সমস্ত আলোচনার মোদ্দা কথা যেটা বেরিয়ে আসছে সেটা হল শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসকে জেলে যেতেই হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্তকরণ অর্থাৎ কনভিকশন অর্ডার স্থগিত করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছে, কোন মামলায় জামিন দেওয়া মানেই দণ্ড স্থগিত হয়ে যাওয়া। আর কনভিকশন বা দোষী সাব্যস্তকরণ কখনও স্থগিত করা যায় না। আর এই রায়ের মধ্য দিয়ে শ্রম আদালতের মামলাটি নতুন মাত্রা পেল এবং এটির একটি নতুন তাৎপর্য তৈরি হল। এই শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া হাইকোর্টেও ড. ইউনূস যে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই হাইকোর্ট যদি শেষ পর্যন্ত ড. ইউনূসকে শ্রম আদালত যে দণ্ড দিয়েছে তা বহাল রাখে তাহলে তাকে আদালতে যেতে হবে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন নিয়ে আছেন। এই জামিনের মেয়াদ রয়েছে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ড. ইউনূসকে যদি আবার নতুন করে জামিন না দেওয়া হয় তাহলে তাকে জেলে যেতে হবে। 

শ্রম আদালতের এই মামলাটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে চলতি বছরেই মাঝামাঝি সময় নাগাদ ড. ইউনূসের কারাবরণের ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। কারণ যে ছয় মাসের দণ্ড এই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল এবং তার জামিন ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল। এই দুটির যে কোনো একটি পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসের বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। সেই সিদ্ধান্তটি ড. ইউনূসের পক্ষে না গেলে তাকে কারাগারে যেতে হবে। 

তবে এটি ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার একমাত্র উপলক্ষ্য নয়। ইতোমধ্যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু এই চার্জশিট দাখিলের পরও ড. ইউনূস আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এখন এই জামিন যতদিন বহাল থাকবে ততদিন অর্থপাচার মামলায় ড. ইউনূসকে কারাগারে যেতে হবে না। কিন্তু যে কোন কারণে যদি এই জামিন বাতিল হয়ে যায় তাহলে এই অর্থ পাচার মামলাতেও ড. ইউনূসকে কারান্তরীণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অন্য যে মামলা গুলো আছে সেগুলো মূলত আয়কর ফাঁকি দেওয়ার মামলায় এবং টাকা ট্যাক্স এর টাকা পরিশোধের মামলা। যে মামলাগুলোতে ইউনূস পরাজিত হচ্ছেন সে মামলাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি আদালতে দিচ্ছেন। যদিও এখন আদালতে রায়ের পর তার আয়কর ফাঁকির অর্থ পরিশোধ করতেও তিনি উস্ম প্রকাশ করছেন। কিন্তু এই মামলাগুলোতে তার কারাগারে যাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। মূলত দুটি মামলায় ড. ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা খুব শিগগির বোঝা যাবে। একটি হল শ্রম আদালতে তার যে দণ্ড হয়েছে সেটি এবং অন্যটি অর্থপাচার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলা। এখন দেখার বিষয় যে এই সমস্ত মামলা থেকে জামিন নিয়ে ড. ইউনূস কতদিন বাইরে থাকেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস   শ্রম আদালত   হাইকোর্ট  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মন্ত্রী নন-এমপি নন, তবু তারা ক্ষমতাবান

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

টানা ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। ১৬ বছরে পা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ। টানা ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে একটা ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদেরকে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করে একেক মেয়াদে একেক জনকে মন্ত্রী করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন করে নেতাদের যেমন যোগ্যতা পরিমাপ করেন, ঠিক তেমনি তাদেরকে ক্ষমতাবান করেন। 

তবে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে এখন দলের নেতা হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়া অনেক লাভজনক বলেই মনে করেন নেতাকর্মীরা। দলের নেতা হয়ে তেমন লাভ নেই। ক্ষমতা হল শুধুমাত্র মন্ত্রী-এমপি হলেই। এই জন্য মন্ত্রী-এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের হিড়িক পড়ে যায়। কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন। কয়েকজন মনোনয়ন পান, কয়েকজন পান না। আর মনোনয়ন না পেলে তারা আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোন না কেন ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে বলে নিজেরাই হতাশা প্রকাশ করেন। কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রম আছেন কয়েকজন, যারা মন্ত্রী নন, এমপি নন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং নিজ যোগ্যতায় তারা ক্ষমতাবানও।

আওয়ামী লীগের যারা এই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন;

সুজিত রায় নন্দী: সুজিত রায় নন্দী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিলের যে মুষ্টি হাতে গোনা  দু একজনের পদোন্নতি হয়েছিল তার মধ্যে সুজিত নন্দী অন্যতম। পদোন্নতি পেয়ে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ার পরও গত নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা তিনি মেনে নিয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। আওয়ামী লীগে যারা সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন, তারা কেউ মন্ত্রী হতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা। অন্যদিকে সুজিত নন্দী যেহেতু নির্বাচন করেননি, সার্বক্ষণিকভাবে দলের দলের জন্য এবং সংগঠনের জন্য সময় দিয়েছেন, তার মধ্যে সেই হতাশা নেই। ফলে তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় এবং ক্ষমতাবান। 

মো. সিদ্দিকুর রহমান: মো. সিদ্দিকুর রহমান আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক। বিজিএমইএ অন্যতম নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মন্ত্রী বা এমপি না হয়েও তিনি সরকারের অন্যতম নীতিনির্ধারক। বিশেষ করে বিজিএমইএ এর নির্বাচন, বাংলাদেশের শ্রম আইন এবং শ্রমিক বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুগুলোকে দেখভাল করার ক্ষেত্রে মো. সিদ্দিকুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত।

বিপ্লব বড়ুয়া: বিপ্লব বড়ুয়া দপ্তর সম্পাদক হলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে অধিক পরিচিত। মিষ্টভাষী এবং বিনয় এই তরুণ আওয়ামী লীগ মহলেও জনপ্রিয়। বিপ্লব বড়ুয়া প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এবং দপ্তর সম্পাদক হওয়ার কারণে অত্যন্ত ক্ষমতাবান। বিপ্লব বড়ুয়াও আওয়ামী লীগের সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দের একজন যারা নির্বাচন করেননি এবং নির্বাচনের জন্য মনোনয়নও চাননি। নির্বাচন না করার কারণে দলে তার অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। বিশেষ করে সাংগঠনিক বিষয়ে তার ওপর নির্ভরতা বেড়েছে দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের। এ কারণে তিনি দলে একজন বিশ্বস্ত দপ্তর সম্পাদক হিসেবে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

আমিনুল ইসলাম: আমিনুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। তিনি গত কাউন্সিলে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণ সম্পাদক হয়েছেন। তবে বিভিন্ন টকশো-তে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের আস্থাভাজন হয়েছেন। কাজেই আওয়ামী লীগে ক্ষমতাবান হতে গেলে শুধু মন্ত্রী বা এমপি হতে হয় এমন ধারণা ভুল প্রমাণ করে এরকম আরও কিছু নেতা এগিয়ে আসছেন সামনের সারিতে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান   আওয়ামী লীগ   বিপ্লব বড়ুয়া   সুজিত রায় নন্দী  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন