নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:০১ পিএম, ২১ মে, ২০২০
করোনা মোকাবেলায় করোনা ভাইরাস, কোভিড-১৯ ইত্যাদি কথার পাশাপাশি সবচেয়ে যে আলোচিত শব্দটি এসেছে, তা হলো ‘ষড়যন্ত্র’। এটি এখন শুধু নয়, বাংলাদেশে যখনই কোনও সংকট দেখা দেয়, যখন কোনও সন্ধিক্ষণ দেখা দেয়, তখন এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বটি আসে। নির্বাচনে যে দল পরাজিত হয়, তারা বলে ষড়যন্ত্র। সরকারের সমালোচনা করলে বলা হয় ষড়যন্ত্র। অর্থনীতির গতি প্রকৃতি যদি মন্থর হয়ে যায়, সেখানেও দেখা হয় ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশে সরকার, বিরোধীদল সবারই ব্যর্থতা ঢাকার ভালো উপায় হলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে আস্তে আস্তে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ডালপালা মেলছে। আমরা যদি এখন দেখি, মোটামুটি ৫ রকমের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বাজারে ভাসছে। সেগুলো একটু দেখা নেওয়া যাক-
১. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করছে যে করোনা মোকাবেলায় তারা যথেষ্ট সফল হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার চেয়েও তারা সফল হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমালোচনা সহ্য করতে পারছে না। যারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সমালোচনা করছেন, তাদেরকে এই মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা মনে করছেন ষড়যন্ত্রকারী এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে যে, ভেতরে-বাইরে ষড়যন্ত্র চলছে, কাজেই আমাদের চোখ-কান খোলা রাখতে হবে। ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য গণমাধ্যম যেন উল্টোপাল্টা না করে, সেজন্য একটা মিডিয়া সেলও গঠন করা হয়েছে। জেএমআই এর দুর্নীতির কথা যেন গণমাধ্যমে বারবার না আসে, সেজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সদা তৎপর। অর্থাৎ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করলেই সেটি হবে ষড়যন্ত্র। এটি যেন একটি গর্হিত অপরাধ।
২. ত্রাণের তালিকা নিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ৫০ লাখ কর্মহীন পরিবারকে তিনি আড়াই হাজার টাকা করে ঈদ উপহার দেওয়ার যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা বাংলাদেশে শুধু নয়, সারা বিশ্বেই এক বিরল দৃষ্টান্ত। কিন্তু এই উদ্যোগটি ভেস্তে যেতে বসেছে। এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে এক অদ্ভুত কায়দায়। দেখা যাচ্ছে যে, তালিকায় ভুয়া নামের ছড়াছড়ি। ইতিমধ্যে তালিকা থেকে প্রায় ৮ লাখ নাম দুর্যোগ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয় বাদ দিয়েছে।
দুর্যোগ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, একই মোবাইল নম্বরে দুবার টাকা দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সবই তো হলো, কিন্তু এই তালিকা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হলো, তাতে কার ইমেজ নষ্ট হলো? সরকারেরই তো।
তালিকা নিয়ে সত্যানুসন্ধান করা হচ্ছে, কথা বার্তা বলা হচ্ছে, তখন এর মধ্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, একটি ভালো উদ্যোগকে বানচালের ষড়যন্ত্র চলছে। একটি ভালো জিনিসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু এই তালিকা প্রণয়নটাই যে একটা ষড়যন্ত্র, সেই কথাটা আর কে বলবে।
৩. সরকারের সমালোচনা করলেই ষড়যন্ত্র
এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, কোনও বিষয়েই সরকারের সমালোচনা করা ষড়যন্ত্রের নামান্তর হয়ে গেছে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার। এই আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই এর সমালোচনা করা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল যে, এর অপপ্রয়োগ ঘটবে। বাস্তবে তা-ই ঘটেছে। এখন রাষ্ট্রের সমালোচনা আর সরকারের সমালোচনা যেন এক হয়ে গেছে।
সরকারের সমালোচনা করাই গণমাধ্যমের প্রধান কাজ। সরকারের খারাপ কাজগুলো দেখিয়ে দেওয়া, তার অনিয়ম এবং অন্যায়গুলোকে সামনে তুলে আনাই গণমাধ্যমের দায়িত্ব। কিন্তু এখন গণমাধ্যম সমালোচনার জন্য নয়। এখন গণমাধ্যম যদি সমালোচনা করে, সেটা হবে ষড়যন্ত্র।
৪. আওয়ামী লীগের দুর্নীতি নিয়ে ষড়যন্ত্র
করোনাকালে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল। স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণ চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। অনেকের চাকরি চলে গেছে, অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু এই সব নিয়ে যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করা হবে, আওয়ামী লীগের অবক্ষয় নিয়ে যখন কেউ হতাশা প্রকাশ করবে, সেটার মধ্যেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজবে কেউ কেউ। বলা হবে যে, আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্য ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির দুর্নীতি ফুলিয়ে ফাপিয়ে পুরো আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করার একটা প্রবণতা চলছে, এটাও একটা ষড়যন্ত্র।
৫. বিরোধী দলকে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র
বাংলাদেশে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সরকার, বিরোধীদল সবাই সমান। বিরোধী দল তো সারাক্ষণই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে বেড়ায়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর থেকেই তারা নানারকম ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে এগিয়ে আসছে। তবে এবার তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বটি সবচেয়ে চমকপ্রদ। বিরোধীদলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, তাদের ত্রাণ তৎপরতা চালাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে এবং এটি একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী বলেছেন যে, ষড়যন্ত্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীদেরকে ত্রাণ দিতে দেওয়া হচ্ছে না এবং তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অবশ্য এই ষড়যন্ত্রের লাভ কি, সেই উত্তর রিজভীর কাছে নেই।
বাংলাদেশে সবকিছুর মধ্যে ষড়যন্ত্র খোঁজার যে অদ্ভুতুরে বাতিক, সেটা বন্ধ করা সরকার। যেকোনো সমালোচনা আসলে প্রশংসার নামান্তর। সমালোচনাকে আলিঙ্গন করে, নিজেদের সংশোধন করেই সরকার এবং বিরোধীদল এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু অসহিষ্ণুতার কারণে সমালোচনাগুলো সহ্য করার মানসিকতা ইদানিং প্রায় লোপ পেতে চলেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এটি কখনই শুভ নয়।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তীব্র তাপপ্রবাহ
মন্তব্য করুন
হিট অ্যালার্ট আবহাওয়া অধিদপ্তর
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন