নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:০৪ পিএম, ১৬ জুলাই, ২০২০
কিছু অপরাধ আছে যা শুধু সমাজের প্রতিষ্ঠিত, সম্মানিত, মার্জিত, শিক্ষিত, ক্ষমতাবান, উঁচু পদমর্যাদার ব্যক্তিরাই জড়িত থাকেন। তারা নিজের অবস্থান, ক্ষমতা ও পদমর্যাদার বলে অপরাধ করে থাকেন। বাংলাদেশের দণ্ডবিধি, সংবিধান ও আইনের কোনও শাখাতেই নির্দিষ্ট করে এই অপরাধের বর্ণনা ও শাস্তির উল্লেখ নেই, যার কারণে দেশের প্রতিটি সেক্টরে এ ধরনের অপরাধ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। এই অপরাধকে বলা হয় হোয়াইট কলার ক্রাইম।
হোয়াইট কলার ক্রাইমের জন্য কোন অস্ত্র প্রয়োজন হয় না, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকারও দরকার নেই। এ ধরনের অপরাধের জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত চতুর, উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ঠাণ্ডা মাথার একজন ব্যক্তি। হোয়াইট কলার ক্রাইমের জন্য মোটিভ হিসেবে কাজ করে শুধুই অর্থনৈতিক লাভ। এজন্য ব্যক্তি তার ক্ষমতা এবং চতুরতা ব্যবহারে পরিকল্পিতভাবে অপরাধটি করে। অন্য সকল অপরাধের মত এখানেও ভিক্টিম থাকে, যারা মূলত একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্র হতে পারে। তবে অন্য সকল অপরাধ থেকে হোয়াইট কলার ক্রাইমকে তদন্ত করা বেশি কঠিন। হোয়াইট কলার ক্রাইমের প্রমাণাদি সহজেই গায়েব করে দেওয়া যায়, অর্থাৎ অপরাধীর কোন চিহ্নই থাকে না। এজন্যই আমাদের দেশে বর্তমানে এ ধরণের অপরাধ প্রতিটি অফিস, আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
যেসব অপরাধ হোয়াইট কলার ক্রাইমের আওতায় পরবে তা হলো: ঘুষ, চাদাবাজি, দুর্নীতি, সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ, অর্থ পাচার, নিরাপত্তা ও পণ্য জালিয়াতি, দলিল জালিয়াতি, ব্যাংক জালিয়াতি, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি, বীমা জালিয়াতি এবং স্বাস্থ্যসেবার জালিয়াতি ইত্যাদি। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যক্তি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পণ্যে ভেজাল মেশানো, পণ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, নিষিদ্ধ পণ্য বিক্রি এবং ট্রেডমার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে হোয়াইট কলার ক্রাইম করে থাকে। এসব অপরাধের জন্য সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় রাষ্ট্র।
হোয়াইট কলার ক্রাইমের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হতে পারলেও দেশের অর্থনীতির উপর এটির সরাসরি প্রভাব পড়ে। এই টাকা বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়। এই অপরাধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় সরকার। যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তেমনি ভাবমূর্তিতে।
সরকারী বিভিন্ন অফিসে যেমন দুর্নীতি রয়েছে, সেটা নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। তেমনি বেসরকারী খাতে অনেকে নাম ভাঙিয়ে সহজেই আশ্রয় নিচ্ছেন দুর্নীতিতে। আমরা হলমার্ক অর্থ কেলেঙ্কারির কথা সবাই জানি। হলমার্ক গ্রুপ ৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ জালিয়াতি করে। এছাড়াও জনতা ব্যাংকের ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা এনন টেক্স গ্রুপ, থারমাক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপ জালিয়াতি করে। সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও বেসিক ব্যাংক, ফরমার্স ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও, যার বেশিরভাগ অর্থ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টে উপার্জিত। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে ঘটে যাওয়া কেন্দ্রিয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ব্যাপারে আমরা সবাই জানি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডেরাল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রক্ষিত ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়। যার মাত্র ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার শ্রীলঙ্কা এবং ফিলিপাইন থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। এ ঘটনার পরে ৪ বছর পার হয়ে গেলেও, ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে, সেই সাথে অপরাধীদের কোন হদিসও জানা যায়নি। তেমনিভাবে করোনাকালে রিজেন্ট হাসপাতাল কিংবা জেকেজি টেস্ট করার জন্য হাজার হাজার নমুনা সংগ্রহ করেছে, যার প্রতিটি টেস্টের জন্য মূল্যও ধরেছে। অন্যদিকে সরকার থেকেও টাকা নিয়েছে বিনামূল্য বলে। এই করোনাকালে কোটি কোটি টাকা আত্নসাত করেছে এই দুই প্রতিষ্ঠান। এর আগের অনৈতিকতার কথা তো বাদই দিলাম।
এছাড়াও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও ক্ষমতার বলে অনেকেই অপরাধের সাথে জড়িত হচ্ছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির জন্য আটক হয় যুবলীগের সমবায় সম্পাদক জি কে শামীম। তার বিরুদ্ধে মাদক, অর্থ পাচার ও আয় বহির্ভূত ২৯৭ কোটি ৯ লাখ টাকার জন্য মামলা দেওয়া হয় এবং এবং তার বাড়ি অফিসে অভিযান করে নগদ ২ কোটি টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার আমানতপত্র জব্দ করা হয়েছে। নরসিংদী যুব মহিলা লীগের নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়া, যাকে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, মাদক ব্যবসা, চোরা চালান, জাল নোটের ব্যবসা, জমি বেদখল ইত্যাদি মামলায় আটক করা হয়।
বাংলাদেশের কালো টাকা মূলত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং এবং সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে পাচার করা হয়। যার প্রকৃত হদিস পাওয়া সম্ভব হয় না।
দেশের এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেকে মনে করেন, এত সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য দুদক একমাত্র সংস্থা । কিন্তু একা তাদের পক্ষে এত বড় কাজ সম্পাদন সম্ভব নয়। এজন্য দেশের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব দূর্নীতি বিরোধী স্বাধীন বিভাগ থাকবে, যেটি ওই প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম ও কর্মচারী-কর্মকর্তাদের উপর নজরদারি করবে। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কাজের জন্য জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনেও হোয়াইট কলার ক্রাইমের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজ দলের দুর্নীতিবাজদেরও ছাড় দেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাগুলো যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কোন ব্যক্তি দুর্নীতির সাথে জড়িত হলে, দ্রুত তদন্ত করে তার সকল অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক। এছাড়াও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকল অফিস, আদালত ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। কালো টাকা যাতে দেশের বাইরে পাচার হতে না পারে সেজন্য এসব টাকা দেশীয় কল-কারখানা প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে বেকারত্ব সমস্যারও কিছুটা সমাধান হয়।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী উপজেলা নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন