নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৪০ পিএম, ০৮ মার্চ, ২০২১
জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রথমভাগে সংগ্রাম কমিটি গঠন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার, চট্টগ্রামে অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র চালু, সম্মুখ সমরের জন্য স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ ও তাঁদের প্রশিক্ষণের জন্য বারতে প্রেরণ, ভারতে প্রবাসী সরকারের হয়ে শরণার্থী ব্যবস্থাপনা এবং প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ইউরোপ আমেরিকায় জনমত গঠন ও তহবিল সংগ্রহে অসামান্য অবদান রাখা মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর অবদান:
১। প্রাদেশিক ও গণপরিষদ সদস্য হিসেবে ভূমিকা: ১৯৭০ সালের নির্বাচনে চট্টগ্রামের আনোয়ারা-পটিয়া আসন থেকে আখতারুজ্জামান চৌধুরী প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন এবং গণপরিষদ সদস্য হিসেবে তিনি সংবিধানের অন্যতম স্বাক্ষরকারী।
২। তাঁর বাসভবনকে সংগ্রাম কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার: মুক্তিযুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনের সময় তাঁর পাথরঘাটাস্থ বাসভবন (চট্টগ্রাম মহানগর) জুপিটার হাউস থেকে সংগ্রাম কমিটির কর্মকাণ্ড পরিচালনা তথা সংগ্রাম কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। একারণে পরবর্তীতে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর বাসভবন তথা জুপিটার হাউজে অগ্নিসংযোগ করে।
৩। তাঁর বাসভবনস্থ সাইক্লোস্টাইল মেশিনে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র ছাপানো: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে আসার পর আখতারুজ্জামান বাবুর বাসভবন তথা জুপিটার হাউজ থেকে তাঁর নিজস্ব সাইক্লোস্টাইল মেশিনে স্বাধীনতার ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে তা কালুরঘাটস্থ অস্থায়ী বেতারকেন্দ্রে, ভারতে এবং বিভিন্ন স্থানে প্রচারের করা হয়।
৪। চট্টগ্রামে অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র চালু: পঁচিশ মার্চ রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্র শত্রুরা দখলে নিলে চট্টগ্রামে একটি অস্থায়ী বেতার কেন্দ্র চালুর বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ কবি বেলাল মোহাম্মদকে নিয়ে ২৬ মার্চ সকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় স্বাধীনতার ঘোষণাটি রেডিওর মাধ্যমে জনগণকে জানানো প্রয়োজন। এরই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অস্থায়ী বেতারকেন্দ্র চালু করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়।
৫। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজ ভারতে প্রেরণ: পঁচিশে মার্চ রাতে প্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মেসেজটি কিভাবে ভারতে পৌঁছানো যায় সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন ‘জুপিটার হাউজে’ জহুর আহমেদ চৌধুরী, আখতারুজ্জামান চৌধুরী ও এমআর সিদ্দিকি এক জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, আখতারুজ্জামান চৌধুরীর নিকটাত্মীয় ও আনোয়ারা নিবাসী রামগড় থানার ওসি আব্দুল মান্নান চৌধুরীর মাধ্যমে সীমান্তের অপর পাড়ের সাবরুম থানার ওসি মি. মুখার্জীর নিকট পৌঁছানো হবে। সে মোতাবেক ২৬ মার্চ সকাল দশটার দিকে রামগড় থানার ওসি সীমান্ত পেরিয়ে সাবরুম থানার ওসির হাতে মেসেজটিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আলোচনা করে তাঁকে অনুরোধ করেন, যাতে তা দ্রুত ত্রিপুরা--কলকাতা হয়ে দিল্লীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
৬। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ তাঁর আপন ছোটভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ আখতারুজ্জামান চৌধুরীর আপন ছোটভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ বশিরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে জীপযোগে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিয়ে শহরে পৌঁছলে চেরাগী পাহাড়ের পশ্চিমে মোমিন রোডের মোড়ে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে কয়েক বন্ধুসহ শহীদ হন। শোকাহত আখতারুজ্জামান চৌধুরী ছোট ভাইয়ের লাশ দাফন করে যুদ্ধপরিস্থিতি জানার জন্য ছুটে যান কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রে।
৭। মুক্তিযুদ্ধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ ও গণসংযোগ: ছোটভাইয়ের মৃত্যু-পরবর্তী শোক মুহ্যমান আখতারুজ্জামান চৌধুরী আনোয়ারা-পটিয়ায় মুক্তিযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্যাপক গণসংযোগ ও সমাবেশ করেন এবং ছাত্রলীগ-আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের সাথে উপর্যুপরি বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করণে কর্মসূচি ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
৮। দক্ষিণ চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ ও আনোয়ারা-পটিয়ায় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আনোয়ারা ও পটিয়ায় স্বাধীনতা আন্দোলন বেগবান করার জন্য আতাউর রহমান খান কায়সারের সভাপতিত্বে ‘স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় যার অন্যতম সদস্য ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সকল এমএনএ, এমপিএ ও নেতৃবৃন্দের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে চট্টগ্রামে মুক্তিসংগ্রাম সংগঠন ও পরিচালনার জন্য আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়, যার অন্যতম সদস্য ছিলেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু।
৯। বিপুল পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক/মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ভারতের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গমন: এরপর তিনি আনোয়ারা, পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী, সাতকানিয়ার বিভিন্ন স্থানে আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে ধোপাছড়ি সীমান্তপথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে মিজো বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আব্দুল নবী নামের সেনাবাহিনীর এক সুবেদার শহীদ হন। অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সাতদিন পায়ে হেঁটে ভারতের দেমাগ্রীতে পৌঁছান। তথায় ভারত সরকার কর্তৃক পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে সাথীদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে ১৬ এপ্রিল কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে যান।
১০। কলকাতায় প্রবাসী সরকারে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটিতে দায়িত্ব পালন: এপ্রিল মাসে ভারতে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ‘কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর/কমিটি’-এর সদস্য হিসেবে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশী শরণার্থী শিবির ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্যে বিশাল অঙ্কের অর্থের যোগান দিয়েছিলেন তিনি।
১১। প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডন সফর: কলকাতায় কিছুদিন দায়িত্ব পালনের পর তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অফিসিয়াল প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটেনে যান। ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে একাধিক পদযাত্রা, সাংবাদিক সম্মেলন ও জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বিশেষ করে লন্ডনের হাইড পার্কে আবু সাঈদ চৌধুরী, ফণী ভূষণ মজুমদার ও আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বক্তৃতা দারুণ প্রভাব ফেলে। এ সময় লন্ডন সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন আখতারুজ্জামান চৌধুরী। তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতিসহ দেশে বিদেশে জনমত গঠনে সর্বশেষ অবস্থা অবহিত করেন।
১২। প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা সফর: যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের লক্ষে অক্টোবরের শেষের দিকে আমেরিকায় যান। সেখানে তিনি মার্কিন সিনেটর, কংগ্রেস সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা ও সভা-সমাবেশ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালান। বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য জনাব চৌধুরী সরাসরি আমেরিকার ফার্স্ট-লেডি প্যাট নিক্সনের সাথেও দেখা করেন।
১৩। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্বাসনে ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয়: আমেরিকা থেকে লন্ডন হয়ে পুনরায় ভারতে এসে প্রবাসী সরকারের অধীনে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে জড়িয়ে পড়েন। এভাবেই তিনি পরিবার ও পারিবারিক ব্যবসা বাণিজ্য ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস অতিবাহিত করেন। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক তৈরি, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির জন্য ব্যক্তিগত তহবিল থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ’কে সংগঠিত করণ ও দুঃস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের নিঃস্বার্থভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন।
মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ১৯৬৪ সালে দেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। পারিবারিক ব্যবসা বাণিজ্য ত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য সর্বস্ব দিয়ে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ তাঁর সহোদর ছোট ভাই বশিরুজ্জামান চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যক্তিগত তহবিল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে চট্টগ্রামে দৃঢ় ভিত্তি দানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের অবিসংবাদিত এই ত্যাগী নেতা জীবনব্যাপী দলের সাধারণ মানুষ ও দলের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করে যান। পাশাপাশি তাঁর মেধা ও শ্রম দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে তিনি পারিবারিক ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণে মনোনিবেশ করেন। অসাধারণ মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে তিনি একের পর এক সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়তে থাকেন। তাঁর গড়ে তোলা ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তাঁর অসাধারণ নেতৃত্বগুণের কারণে চট্টগ্রাম চেম্বার, এফবিসিসিআই এবং ওআইসি চেম্বারের সভাপতি এবং প্রথমবারের মত বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধি হিসেবে তিনি ’৭৭ জাতি গ্রুপ’ এর ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন, আজীবন নিজস্ব তহবিল দিয়ে দলকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, দলকে চট্টগ্রামে এবং জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদান (প্রেসিডিয়াম মেম্বার হিসেবে) ব্যাংক, বীমা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং ব্যবসায়ী নেতা ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান চৌধুরী সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমৃত্যু তিনি দেশের মানুষ ও দেশের কল্যাণে নিজের অর্থ, মেধা ও শ্রম অকাতরে নিবেদন করে গেছেন।
মাননীয় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী-এর পিতা মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু এবছর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২১ অর্জন করেছেন।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী উপজেলা নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন