ইনসাইড থট

আমলাতন্ত্রের দৌরাত্মে কোণঠাসা দেশ ও জাতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ২৫ জুলাই, ২০২১


Thumbnail

বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধান এদেশের জনগণকে দেশের মালিক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবিধানের ৭ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অনুচ্ছেদ ২১ এর (১) বলা আছে- সকল সময়ে জনগণের সেবা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। গণতান্ত্রিক বিধান অনুযায়ী সরকার ও তার প্রশাসন দেশের জনগণের সেবার উদ্দেশ্যেই তাদের সকল কার্যক্রম পরিচালনা করবে। মানুষের জান ও মালের ওপর কর্তৃত্ব করা নয়, বরং জনসাধারণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করাই সরকার ও তার প্রশাসনের কাজ। কিন্তু বর্তমান অভিজ্ঞতার চিত্র পুরো উল্টো। মালিক আজ নেমে গেছে কর্মচারী-শ্রমিকের কাতারে। উপনিবেশিক রাজত্বের মতো যেন কর্মচারী বনে গেছে যেন দেশের মালিক। জনসাধারণের ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ প্রভুর মতোই ছড়ি ঘোরাচ্ছে তারা সব সময়। জনগণ শুধু নয়, খোদ সরকারও অনেকটা যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে তাদের কাছে।

বলছি, দেশে চলমান আমলাতন্ত্রের আগ্রাসী অবস্থার কথা। আমলাদের সীমাহীন দৌরাত্মে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে যেন সবাই। সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ে আমলাতন্ত্রের দাপটে চারদিকে তৈরি হয়েছে চরম হতাশা। শোনা যায়, অনেক সচিবই মন্ত্রীদের গুরুত্ব দেন না (!)। সিদ্ধান্ত নেন নিজেদের মতো করে। এমন একটা ভাব নিয়ে চলাফেরা করেন তারা যে, মন্ত্রী যাবেন, মন্ত্রী আসবেন, কিন্তু তাদের ক্ষমতার কোনো কমতি হবে না তারা চিরস্থায়ী জমিদার সরকারী কর্মচারী। বরং দিনকে দিন পদ-পদবী আরো বাড়বে তাদের। বাড়বে আরো কর্তৃত্ব। উপেক্ষিত মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধি দুঃখ করেন রাজনৈতিক মহলে। সচিবদের দৌরাত্মের কাছে যেন এক প্রকার অসহায় তারা। তাদের ক্ষমতা শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীদের কাছে তদবির করার মধ্যে সীমিত।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের মতো মাঠ পর্যায়েও কর্মরত অনেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা করেন না। সরকারের ভেতর তারা যেন সেজে বসেছে আরেক সরকার। তাদের ইচ্ছে ও অনুগ্রহ ছাড়া যেন কিছুই হয় না। জনপ্রতিনিধিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে কেউ কেউ অতি উৎসাহ নিয়ে যোগ দেন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। অনেক কর্মকর্তাই নিজের অতীত রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রশাসনিক ক্ষমতার সাথে সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রদর্শন করে নিজের কর্তৃত্ব আরো বাড়িয়ে নিতে চান। তারা আচরণে, কার্যক্রমে চলেন রাজনীতিবিদদের মতো করে। আমলাদের সীমাহীন ক্ষমতা প্রদর্শন করার কারণে মন্ত্রী, এমপি, সিটি মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়ররা অনেক সময় নিজের কর্মীদের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। অথচ এদেশের সংবিধান সেই ক্ষমতা বা অধিকার কোনটাই দেয়নি আমলাদের।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য (২) দফায় বলা হয়েছে: ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’ কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমলারা জনগণের সেবা করার পরিবর্তে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টায় মরিয়া সব সময়। নিজেদেরকে তারা সব সময়ই সাধারণ মানুষের তুলনায় সুপেরিয়র মনে করে। সাধারণ জনগণকে বাধ্য করে তাদেরকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতে। অথচ দেশের মালিক সাধারণ এ জনগণের পকেটের টাকাতেই তাদের বেতন হয়, স্ত্রীর শাড়ি-গয়না হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ নির্বাহ হয়। কর্মচারী হিসেবে দেশের মালিক জনগণকে যেখানে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার কথা তাদের, সেখানে নিজেরাই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ববলে স্যার সেজে বসে থাকে। শুধু বসেই থাকে না, চারপাশ নিয়ন্ত্রণ করে ব্যাপকভাবে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে একজন ইউএনও’র কার্যক্রমে দেশবাসী হতবাক হয়েছে। মাহামরি করোনার এ চলমান সংকটকালে অভাবে পড়ে ফরিদ আহমেদ নামের একজন লোক সরকারি তথ্যসেবা নাম্বার ৩৩৩ এ কল করে খাদ্য সহায়তা চেয়েছিলেন। ইউএনও সাহেব খাদ্য নিয়ে তার বাড়িতে পৌঁছেও ছিল। কিন্তু লোকমুখে উক্ত ব্যক্তির একটি বাড়ি আছে, এমন কথা শোনার সাথে সাথে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন ইউএনও সাহেব। খাদ্য সহায়তা তো তাকে করলেনই না, উল্টো ১০০ জনকে তার খাদ্য সহায়তা দিতে হবে মর্মে জরিমানা ঘোষণা করলেন কোনোরকম যাচাই বাছাই ছাড়াই! খাদ্যের অভাবে পড়া লোকটি বাধ্য হয়ে স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে সুদের ওপর টাকা তুলে ষাট হাজার টাকা খরচ করে চোখের পানি মুছতে মুছতে সেই জরিমানা পরিশোধ করলেন। হ্যাঁ, বাড়ি তার একটি রয়েছে বটে। তবে সে বাড়ির মালিক তিনি একা নন। ভাইবোনদের সাথে এজমালি মালিকানা রয়েছে তার বাড়িটির ওপর। মাত্র তিনটি কক্ষের ওপর মালিকানা তার। তিনি একটি হোসিয়ারী ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে চোখ খারাপ হয়ে যায় এবং বিভিন্ন রোগের কারণে এখন ঠিকমত কাজ করতে পারেন না। এখন প্রায় মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করেন। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলমান করোনা সংকটের কারণে ব্যবসাপত্র বন্ধ থাকা কাজ হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঘরে বসেছিলেন তিনি। নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই সরকারি সহায়তা নম্বরে কল দিয়েছিলেন। কিন্তু তার প্রকৃত অবস্থা যাচাই করার মতো এত সময় ও ধৈর্য ইউএনও মহোদয়ের কোথায়! বাড়িওয়ালা শুনেই তিনি জরিমানা করে বসলেন! অথচ এভাবে ১০০ জনকে খাদ্য বিতরণের নির্দেশ দেওয়ার মতো অধিকার দেশের আইন তাকে দেয়ই না। বিষয়টা নিয়ে সারা দেশে যখন নানারকম আলোচনা সমালোচনার জন্ম হলো, তখন করা হলো একটি তদন্ত কমিটি। জেলা প্রশাসনের করা সেই কমিটি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরাকে দায়মুক্তি দিয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার আইয়ুব আলীকে দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিলো। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে কাকে বলে আর। অন্যায় জরিমানাটা করলেন ইউএনও সাহেব আর এর জন্য দায়ী করা হলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি সদস্যকে!তাকে অভিযুক্ত করা হলো, তিনি নাকি সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করেননি। কী অদ্ভুত এ তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন।

নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনা শুধু ছোট্ট একটি উদাহরণ। সারা দেশে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাঠ প্রশাসনের সামনে অসহায়। কী মেম্বার, কী চেয়ারম্যান, কী এমপি। ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা কাউকেই সমীহ করে না। শুধু সচিব নয়, যুগ্ম সচিব, মুখ্য সচিব, অতিরিক্ত সচিব, কারো প্রতাপের সমানেই যেন দাঁড়ানো যায় না। তাদের ভাবখানা এমন যেন, জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদরা নয়, সরকারে টিকিয়ে রেখেছে তারাই। রাজনীতিবিদদের চেয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই যেন সর্বেসর্বা।প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সাথে সচিবালয়ে ঘটা ঘটনাটা সাম্প্রতিক সময়ে সচিবদের দৌরাত্মের অন্যতম বাজে উদাহরণ। নিয়মিত সংবাদ অনুসন্ধান করতে গেলে নজিরবিহীনভাবে সচিবালয়ে ৬ ঘন্টাব্যাপী রোজিনাকে আটকে রাখেন একজন অতিরিক্ত সচিব সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। তার সাথে কী দুর্ব্যবহার যে তারা করেছেন সে সময়ে, তার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। একজন নারী কর্মকর্তাকে দেখা গেছে, তিনি টুটি চেপে ধরছেন সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের। শুধু সাংবাদিক রোজিনার টুটি নয়, সেদিন তিনি যেন গোটা দেশের সব গণমাধ্যমের, সব মানুষের টুটিই চেপে ধরেছিলেন আদতে। শুধু টুটি চেপে ধরে তাকে নির্যাতন করেই ক্ষ্যান্ত হননি তারা। শেষপর্যন্ত অফিশিয়াল সিক্রেট এ্যাক্ট নামের এক ব্রিটিশ আইনে যারা শুধুমাত্র সরকারী কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সেই আইনে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাকে। অথচ ব্রিটিশদের বানানো এ আইন খোদ ব্রিটিশরাও বাতিল করেছে বহু আগেই। কিন্তু এদেশের আমলারা সেই আইন ইতিহাসের আস্তাকূড় থেকে টেনে তুলে এনে তার জালেই আটকে দিলেন সাংবাদিক রোজিনাকে। কী এমন তথ্য নিয়ে পেয়েছিলেন রোজিনা! যে তথ্যের জন্য এমন মারমুখী হয়ে উঠলো আমলারা? হাজার রকম প্রশ্ন ঘুরপাক খায় জনমনে। কিন্তু এসব প্রশ্নের কে চাইবে কার কাছে। প্রজাতন্ত্রের দেশ হয়ে উঠেছে আজ আমলাতন্ত্রের দেশ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঐ অতিরিক্ত সচিব যিনি নাটের গুরু যার কানাডার ৩ টি বাড়ি, লন্ডনে ১ টি, ঢাকায় ৪ টি ফ্লাট রয়েছে আর রয়েছে ৮০ কোটি টাকার সঞ্চয়, কিন্তু তার কোনো শাস্তি হয়নি। শুধু বদলি হয়েছেন মাত্র অন্য মন্ত্রণালয়কে ধ্বংস করার জন্যে কোটি টাকা লুটপাটের জন্যে স্বাস্থ্য দপ্তরের ড্রাইভারের শাস্তি হয় তবে তার কর্তা ব্যক্তি যেন তুলসী পাতা।

আমলাতন্ত্র এখানে এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, আমলাদের ছাড়া না হয় কোনো সিদ্ধান্ত, না হয় কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কমিটি। করোনার এ সংকটকালে মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে জেলা পর্যায়ে কমিটি করা হয়েছে সচিবদের নিয়ে। সচিবরাই যদি সব করবে, তবে মন্ত্রী, এমপি বা জনপ্রতিনিধিরা রয়েছে কী জন্য? প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এত ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব দিলে জনপ্রতিনিধিরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষ থেকে। লোকজন যখন বুঝবে, এমপি মন্ত্রীর আসলে কোনো কাজ নেই। কাজকর্ম, ক্ষমতা যা আছে, তা সব ওই প্রশাসনিক ব্যক্তিদের হাতে। তখন তারা বিভিন্ন প্রয়োজনে রাজনীতিবিদ-জনপ্রতিনিধিদের কাছে ছুটে যাওয়ার অভ্যাস বাদ দেবে। আবার আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছেও ভিড়তে পারবে না সহজে। উভয়দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। মধ্য থেকে আরো ফুলেফেঁপে উঠবে আমলাতন্ত্র। আর জনগণ সরকারের প্রতি আস্তা হারাবে জনরোষ পুনরুজ্জীবিত হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সব সময়ই আমলাতন্ত্রের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দানকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বলি, মনে রেখো, এটা স্বাধীন দেশ। এটা ব্রিটিশের কলোনি নয়। পাকিস্তানের কলোনি নয়। যে লোককে দেখবে, তার চেহারাটা তোমার বাবার মত, তোমার ভাইয়ের মতো। ওরই পরিশ্রমের পয়সায় তুমি মাইনে পাও। ওরাই সম্মান বেশি পাবে। কারণ ওরা নিজেরা কামাই করে খায়।’ বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষকে দেশের মালিক মনে করতেন। আর আমলাদের মনে করতেন মালিকদের সেবার উদ্দেশ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। কর্মচারীর কাজ সব সময় সেবা দিয়ে মালিককে সন্তুষ্ট রাখা।বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশিক দমনমুলক আইন-কানুন পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রের রূপ দিতে। আমলাতন্ত্রের মূল দর্শন পরিবর্তন করে, স্বাধীন বাংলাদেশে একটি জনমুখী আমলাতন্ত্র তৈরি করতে, যার মূল চেতনাই হবে জনগণের সেবা করা। দমন বা শাসন করা নয়। সেই লক্ষ্যে, বঙ্গবন্ধু প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের গুরুত্ব কম দিয়ে জনসম্পৃক্ত মানুষদেরকে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ সরকারের সেবা পায়। বঙ্গবন্ধু তার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য- তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা কমিশন’ গঠন করেছিলেন। এ কমিশনই বাংলাদেশের প্রথম পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। সেই কমিটিতে আমলাদের আধিক্য দেখা যায়নি। ছিলেন চার বা তারও অধিক অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক। বঙ্গবন্ধু অনেক রাজনৈতিক নেতা ও শিক্ষককে সে সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। যেমন অধ্যাপক কবির চৌধুরীকে শিক্ষা সচিবের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ডা: টি রহমানকে স্বাস্থ্য সচিবের দায়িত্ব দেন। ১৯৭২ সালে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয় সেগুলো পরিচালনা করার জন্যে অনেক ব্যবসায়ী ও দলীয় কর্মীকে নিয়োজিত করেছিলেন - যারা ইতোপূর্বে কখনো প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন না কিন্তু, জনগণের কাছের মানুষ ছিলেন। অথচ আজকের কর্মচারীরা এমনভাবে মালিকের আসনে চেপে বসেছে যে, চারপাশের সবাই রীতিমত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তাদের দৌরাত্মের কাছে। বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় ” জেলা গভর্নর” নিয়োগ করেন যার অধিকাংশই ছিলেন জন প্রতিনিধি। বড় বড় দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেন জনপ্রতিনিধিদের। যেমন লন্ডনে এডভোকেট সৈয়দ সুলতান, ওয়াশিংটন জনপ্রতিনিধি এম আর সিদ্দিকী, নয়াদিল্লীতে অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক প্রমুখ।

করোনা মহামারির এ সময়ে নিজেদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে দেশের মানুষের জন্য কাজ করছেন ডাক্তারগণ। পরিবার-পরিজন, ছেলে-মেয়ে সবার কথা ভুলে দিন রাত মানুষের সেবায় পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তারা। এমন একটি সময়ে মুভমেন্ট পাশ থাকার পরও একজন ডাক্তারকে পথে যেভাবে হেনস্তা করলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, যেভাবে তার পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে বলেন, তা কোনোভাবেই আইনের আওতার মধ্যে পড়ে না। সিনিয়র উক্ত ডাক্তার নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলে পরিচয় দেওয়ার পরও প্রকাশ্যে জনসম্মুখে তার সাথে যেভাবে আর্গুমেন্ট করলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, তা তাদের ক্ষমতার দৌরাত্ম্যকে আরো একবার স্পষ্ট করে তোলে। কোন ক্ষমতার বলে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা? তাকে হেয় করার জন্যে রাজাকারের ছেলে হয়েও জোর গলায় দাবী করেন তিনিও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার জন্যে তার গুরুতর শাস্তি হওয়া উচিত। তবে তার শাস্তি হয়নি, তিনি শুধুমাত্র বর্তমান পদ থেকে বদলি হয়েছেন।

সরকার যখন লড়াই করছে করোনা মহামারি মোকাবেলায়, ডাক্তার ও অন্যান্য পেশাজীবীগণ আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি মোকাবেলায়, তখনও থেমে নেই স্বাস্থ্যখাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য। আমলাতন্ত্রের মারপ্যাঁচে স্থবির হয়ে পড়েছে আজ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। আমলাদের অতিরিক্ত খবরদারির কারণে দেশের করোনা চিকিৎসা বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমনকি জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাপিয়ে দেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে করোনা চিকিৎসাও ব্যাহত হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটিসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল কমিটিকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেয়ায় আলোচনা-সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে বারবার। এ কাজগুলো করেছে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কতিপয় স্বার্থান্বেষী কর্মকর্তা। তারা এতই দাপুটে যে মন্ত্রীকেও পাশ কাটিয়ে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যাতে মন্ত্রীকে হতে হয়েছে বিব্রত। বলতে হয়েছে তিনি এসব সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানেন না। তাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এমন বক্তব্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিডিয়াতে বারবার দিয়েছেন। মন্ত্রী-সচিব দ্বন্দ্বে স্বাস্থ্য খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সমন্বয়হীনতা এখন গোটা স্বাস্থ্যখাত জুড়ে। সচিবদের দৌরাত্বে এ সমন্বয়হীনতা যেন আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ইসরাইল নাম বাদ পড়েছে যা কোনো মন্ত্রী মিনিস্টার জানেন না, বাদ দিয়েছেন আমলাকুল।

অদ্ভুত ব্যাপার হলো এসব আমলা-প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য যতই বাড়ুক, কিছুই হয় না তাদের। সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান তারা। নারায়ণগঞ্জের জরুরি খাদ্য সহায়তা কেলেঙ্কারিতে ইউএনওকে বাদ দিয়ে স্থানীয় জনপ্রনিধিকে অভিযুক্ত করা হয়, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে বালিশ দূর্নীতির দায়ে মামলা হয় ঠিকাদারের নামে। অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলারা ছাড়া কারো বাপেরও সাধ্য নেই এসব প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি করে। প্রকল্প পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া কারো পক্ষে কোনো প্রকল্প থেকে একটি সুতোও অন্যায়ভাবে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যদি নেয়ও, তা দেখার দায়িত্ব কিন্তু ওইসব কর্মকর্তাদের ওপরই বর্তায়। যেকোনো প্রকল্পে দুর্নীতির দায় প্রকল্পের পরিচালক কখনোই এড়াতে পারেন না। কিন্তু দেখা যায়, যখনই এমন কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা সামনে আসে, তখন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আড়াল কেউ তৃতীয়পক্ষ বা অপেক্ষাকৃত দুর্বল পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এর দায়ভার।

করোনা ভাইরাসের এ মহামারির সময়ে দেশের জনগণের পাশে সবচেয়ে বেশি থাকার সুযোগ রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিগণের। কিন্তু দেখা গেল, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাহায্য প্রদান কার্যক্রমে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত না করে জেলা পর্যায়ে সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠিক কীসের ভিত্তিতে এ দায়িত্ব পেলেন সচিবগণ? না তারা জনগণের সাথে সম্পৃক্ত, না আছে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে। মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা কী সরকারি অফিসে বসে থেকে সেটাও জানার কথা নয় তাদের। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত করায় সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত সুবিধা প্রাপ্তী থেকে। এর ফলে জনপ্রতিনিধিরা অসহায় জনগণকে ঠিকভাবে সহযোগিতা করতে পারেননি। সরকারের বরাদ্দ ঠিকই হয়েছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী প্রকৃত অসহায়দের কাছে পৌঁছায়নি সহায়তা।

সরকারের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনা, নানা মহতী উদ্যোগ সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে আমলাতন্ত্রের এ লাগামহীন ঘোড়া। জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী তথা মুজিববর্ষ উপলক্ষে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম মহতী উদ্যোগের একটি হলো গৃহহীনদের জন্যে একটি ঘর প্রকল্প। কিন্তু এই প্রকল্পে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যাপক দুর্নীতির ফলে পুরো উদ্যোগটিই সমালোচনার মুখে পড়েছে। জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এ প্রকল্পে দায়িত্ব দেওয়ায় নজির বিহীন দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে দুঃস্থ মানুষদের আশ্রয়ের নিমিত্তে নির্মাণ করা এসব ঘরে। বহু এলাকায় ঘর নির্মাণের পরপরই ধ্বসে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে বহু ঘর। গৃহহীনদের ঘর প্রদানের এ প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অথচ এর জন্য কখনো কোনো আমলা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি। সরকারের মহতী উদ্যোগের সুফল খেয়ে যাচ্ছে আমলাতন্ত্রের বিষপিঁপড়ারা!

আমলা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অসংখ্য ফিরিস্তি হাজির করা যায়। বলতে গেলে আমলাদের অধীনে ছেড়ে দেওয়া সকল প্রকল্পই যেন একেকটি দুর্নীতি ও লুটপাটের আখড়া। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশে। ইউরোপে একেবারে নতুন চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণের খরচ পড়ে কিলোমিটার প্রতি ২৮ কোটি টাকা। চীনে কিলোমিটার প্রতি খরচ পড়ে মাত্র ১৩ কোটি টাকা, ভারতে ১০ কোটি টাকা! বাংলাদেশে একইরকম একটা সড়ক নির্মাণ করতে খরচ করা হয় কিলোমিটার প্রতি ১০৮ কোটি টাকা! ইউরোপের চেয়ে প্রায় ৪গুণ বেশি। চীনের চেয়ে ৮গুণ বেশি। ভারতের চেয়ে ১১গুণ বেশি। পৃথিবীর সকল দেশের চেয়ে বেশি খরচ করে রাস্তা বানালে কী হবে, এসব রাস্তার স্থায়িত্ব যে সব দেশের চেয়ে কম, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এক দিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই অন্যদিক থেকে ভাঙা শুরু হয় এসব রাস্তা! সড়ক নির্মাণের প্রতিটি প্রকল্পে কী পরিমাণ অর্থ নয়ছয় হয়, তা বিশ্বের অপরাপর দেশের নির্মাণ ব্যয়ের সাধারণ চিত্রের সাথে তুলনা করলে সহজেই বোঝা যায়। বছরের পর বছর ধরে একই কায়দায় সড়ক নির্মাণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে চলেছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ আর তাদের পাপের ফল ভোগ করেন জনপ্রনিধিগণ। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের কারণে জনগণের মুখোমুখি হতে পারে না তারা।

কেন আমলারা থাকেন সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে, কেন কোনোভাবেই তাদেরকে অভিযুক্ত করা যায় না, বা করা হয় না? নানা সময়ে এক স্বাস্থ্যখাতের যেসব দুর্নীতি অপকর্মের ফিরিস্তি প্রকাশিত হয়েছে, তার কোনটির জন্যই কখনো কোনো আমলা বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দোষী সাব্যস্ত করতে দেখা যায়নি। সব মন্ত্রণালয়, সব অধিদপ্তর গুলোর অবস্থাও স্বাস্থ্যখাতের মতোই। সব কলকাঠি নাড়েন আমলারা, অথচ তারা থাকেন সব সময় যেন তুলসী গাছের তলায়! পুতঃপবিত্র ভাব ধরে বসে থাকলেও আদতে তারা একেকজন তুলসী তলার ভূত!

কী শিক্ষক, কী ডাক্তার, কী উকিল, কী মোক্তার, কী সাধারণ মানুষ সবার উপরেই পড়েছে আমলাতন্ত্রের ভূতের আছর। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যেন সব দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসেছেন।প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান একজন ডাক্তারকে হেনস্তা করেন ম্যাজিস্ট্রেট! একবারও তার কর্তৃত্ব ও সীমার কথাটা মাথায় আসে না। একবারও তারা ভাবেন না, দেশের আইন তাদেরকে আদতেই এমন ব্যবহার করার অধিকার দেয় কি না। করোনার এ সংকটকালে কখনো ডাক্তারদেরকে ভয় দেখিয়ে নোটিশ দেয়া, কখনো টেলিভিশন মনিটরিংয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি করা, কখনো বয়স্ক নাগরিকদের কান ধরে উঠবস করানো, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুকুর কেটে সেই পুকুর নিজের নামে করে নেওয়া, আবার এই বিষয়ে প্রশ্ন করার দায়ে সাংবাদিককে ক্রসফায়ার দিতে চাওয়ার সাথে সাথে তথ্যমন্ত্রণালয়ের DSA আইনে নামে প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে রাখা কিছুই বাদ নেই এখানে।

আমলাতন্ত্রের যে দৌরাত্ম চলছে দেশে, যেভাবে তারা দেশের সব কাজের কাজি হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপরে, এমনকি রাজনীতিবিদ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরও বাদ দিচ্ছে না, দ্রুতই তাদের লাগাম টানতে না পারলে এ দেশের কপালে দুর্ভোগ আছে। সরকার যতই জনবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করুক, যত বাজেটই বরাদ্দ দিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে, আমলাতন্ত্রের কালো ছায়া সরাতে না পারলে কোনো সুবিধাই জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না। ইঁদুর যেমন ঘরের মেঝের মাটি কেটে বাইরে নিয়ে ফেলে, দুর্নীতিবাজ আমলারাও তাই। ঘাড়ের ওপর বসে থেকে ভেতরটা শুষে খেয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দেশ পরিচালনার জন্য সরকার ব্যবস্থার যেমন প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন আছে আমলাদেরও। কিন্তু কোনভাবেই প্রশাসনিক কাজের বাইরে অতিরিক্ত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা তাদের দেওয়া চলবে না। জনগণের সেবা করাই হবে তাদের একমাত্র মুখ্য উদ্দেশ্য। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও জনগণের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেখার জন্য দায়িত্ব পালন করবে সরকার ও তার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা এ কাজে তাদের দাপ্তরিক সহায়তা প্রদান করবে কেবল। রাষ্ট্রের অধীনে শ্রমিক হিসেবে অর্পিত দায়িত্বগুলোই কেবল পালন করবে তারা। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য আগ্রাসী আমলাতন্ত্রের রাশ টেনে ধরার বিকল্প নেই।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রথম আলোর পর কী ডেইলি স্টারও বিক্রি হবে?


Thumbnail

এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।

প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে অনেকেরই  ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী লোক।

এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।

তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।

এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।

আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম। সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায় যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।

ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।

তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।


প্রথম আলো   ডেইলি স্টার  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে বিএনপির রাজনীতি


Thumbnail

বিএনপির রাজনীতি এখন ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে। রাজনীতিতে একের পর এক ভুল করার কারণে তারা এখন হতাশায় নিমজ্জিত। কোন কী বলতে হবে সেটার খেই হারিয়ে ফেলেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

বিএনপি এখন দাবি করছে যে, তাদের ৬০ লাখ নেতাকর্মী জেলে আছেন। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল যদি ৬০ লাখ কর্মী তাদের থাকত তাহলে এতদিনে তারা কেন আন্দোলনে ব্যর্থ হল? যদি এত সংখ্যক নেতাকর্মী থাকত তাহলে তো অনেক আগেই সরকারের পতন ঘটে যেত। কারণ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এক লাখ নেতাকর্মী হলেই যথেষ্ট। কিন্তু এত সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়েও তারা ব্যর্থ কেন! এত বড় সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে তারা তাদের নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেনি। কোন আন্দোলনই তারা করতে পারল না! বরং তাদের নেত্রীকে সরকারের অনুকম্পায় ফিরোজায় থাকতে হচ্ছে। ফলে স্বভাবতই বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা কত সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আর এত নেতাকর্মী থাকা সত্বেও তাদের নেতাকে লন্ডনে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে! 

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মী যদি জেলে থাকেন তাহলে দেশের জেলখানা গুলোর ধারণ ক্ষমতা কত। এবং সেখানে যদি বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যাই হয় ৬০ লাখ তাহলে এর মধ্যে সাধারণ কয়েদি কোথায় আছেন। তাদেরকেই বা কোথায় রাখা হয়েছে।

কথায় আছে, পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পথ ফিরে পাওয়া যায়! বিএনপির অবস্থায় এখন তাই। তারা রাজনীতির পথের মাঝে রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলেছেন। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনীতি নয় সেটাও বিএনপির নেতাকর্মীরা বোধহয় ভুলে গেছেন কিংবা বুঝতে পারছেন না। অন্য আরেকটি কথায় আছে যে, স্বপ্নে যখন কেউ কিছু খাবে তখন পান্তা খাবে কেন? পোলাও কোরমা খাওয়াই ভালো। বিরিয়ানিও খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং ৬০ লাখ না বলে তাদের বলা উচিত ছিল বাংলাদেশে তো প্রায় ১৮ কোটি লোক আছে এর মধ্যে ৬ কোটি লোকই বিএনপির নেতাকর্মী। তাহলে অত্যন্ত লোকে আরও ভালো ভাবে বুঝত যে, বিএনপি আসলেই অনেক বড় একটি শক্তিশালী দল এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝতে পারত যে, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো। 

তবে বাস্তবতা হল বিএনপি ৬০ লাখ নেতাকর্মী দাবি করলেও আসলে তাদের কোন জনসমর্থনই নাই। যদি তাই থাকত তাহলে তারা নির্বাচন বিষয়টিকে এত ভয় পেত না। নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নিত না। শুধু তাই নয়, বিদেশিও তাদের কোন বন্ধু নাই। যারা আছে সেই বন্ধুদের কথায় দলটি বরং এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। দেশিয় বিএনপির যে সমস্ত বন্ধুরা ছিলেন, বিভিন্ন সময় বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে কিছু লেখালেখি করতেন, তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বপ্ন দেখাতেন তারাও এখন হারিয়ে গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে দলটি এখন অনেকেটা এতিম হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত সামনে দলটির নাম নিশানাও থাকবে না। যারা নিজের দলের নেতাকর্মীর সঠিক সংখ্যা জানেন না তাহলে বুঝতে হবে সেই দলটি এখন কোন পর্যায় গেছে। কতটা দেউলিয়া হলে একটি দলের নেতাকর্মীর সংখ্যা নিয়ে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হন। সুতরাং দলটি যে অচিরেই হারিয়ে যেতে বসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বৈশাখে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে। 

১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’, দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। তাপদাহে এই এপ্রিলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখি/বৈসাবি/বিজু উৎসবের মাস- খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস হলেও। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন- ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।

বিশ্ব পরিস্থিতির সংকট আমাদের বৈশাখি আয়োজনের মধ্যে গরল উগড়ে দিলেও অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন এবারও। এখন আমরা প্রাণিত, আমাদের চিত্ত আনন্দিত এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। অতীতের মতো এবারও সকালে হালখাতা খুলে দোকানে বসবে ব্যবসায়ী, বৈশাখি মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাবে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারাদেশে মঙ্গলশোভা যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো তাও এবার হবে। রমনার বটমূলের প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবারও হচ্ছে।আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছে।‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সকল প্রথা অনুসৃত হচ্ছে।একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতো কৃষকরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত লাভ করে। 

বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০২৩ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন হয়ে এসেছে। অন্যদিকে নব্বই দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের উৎসাহে ২০১৩ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একইসঙ্গে ওইদিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়ক মেলা।

নববর্ষের সকল আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করেও আমরা আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব অত্যন্ত বেশি। নিকট আত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক, আমরা এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে  চাই। সংকট এলে কী করি, কীভাবে অগ্রসর হই, কোথায় যাই, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে, এটাই শান্তচিত্তে আমরা খুঁজছি। ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া নতুন বছরের আগে ছিল কাজ, অকাজ, অকারণ কাজ, যে উপায়েই হোক, জীবনের শেষ নিমেষপাত পর্যন্ত ছুটাছুটি করে, মাতামাতি করে বেঁচে থাকা। ওই কর্ম-নাগরদোলার ঘূর্ণিনেশা আমাদের পেয়ে বসেছে বলেই পৃথিবী হয়েছে শান্তিতে পূর্ণ। অবশ্য দুর্গম হিমালয়শিখরের নিরুদ্বিগ্ন প্রাণিদের জীবন বিপন্ন; জনশূন্য তুষারমরুর বিশ্বস্তচিত্ত সীল এবং পেঙ্গুইনদের নির্বিরোধে প্রাণধারণ করার সুখটুকু বিলীন এখন। বাণিজ্যপুঁজি ও শিল্পপুঁজির দাপটে আফ্রিকা আর দক্ষিণ-আমেরিকার প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলেও আধুনিকতার নামে মৃত্তিকাসংলগ্ন সভ্যতার তিরোধান ঘটেছে। বিচিত্র কর্মের পিছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক। এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।

আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই কর্পোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সকলকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই বরং বৈশাখি আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। পরস্পরের কাড়াকাড়িতে ঘেঁষাঘেঁষিতে যে রিপুর দাবানল জ্বলে উঠে উৎসবে তা প্রশমিত থাকে; কর্মের সঙ্গে শান্তিকে জড়িত করে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করে। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়ো, পদ বড়ো নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়। আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকুর মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্য নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।

এসেছে পহেলা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য- ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভাণ্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখি মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকট কবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এ মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্বলাভের পক্ষে বড়ো মিথ্যার চেয়ে ছোটো সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে অশান্তি মুক্ত করার শপথ নিতে হবে। কারণ- বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘সংখ্যায় আধিক্য মানে অবনমন’


Thumbnail

সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।

সময়ের সাথে সাথে এভাবে পৃথিবীতে প্রায় সবকিছুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও গুণগত মান এবং কার্যকারিতা নিম্নমুখী হচ্ছে। সবকিছুতেই যেন ভেজাল বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তবে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে দিন দিন। শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক এবং সৃজনশীল হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ আশানুরূপ হচ্ছে না। চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা অতিশয় প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে।

এক সময় সমাজে হাজীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তবে সমাজে তাদের অনেক সম্মান ছিল। মানুষ তাদেরকে খুব ইজ্জত করতেন। তাদের চলাফেরা এবং আচার-আচরণ সমাজের আর দশজন মানুষ থেকে আলাদা ছিল যা দেখে তাদের খুব সহজেই চেনা যেত। তাদেরকে মানুষ অনুকরণ করতেন। এখন হজ্জব্রত পালন করা মানুষের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তবে তাদের ঈমানী শক্তিতে আর আগের সেই ধার নেই। হজ্জ করে আসা ব্যাবসায়ী হজ্জ করে এসে আগের চেয়ে অধিক মুনাফা করছে, ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। হজ্জ করে আসা একজন চাকরিজীবী পবিত্র ঘর তাওয়াফ করে এসে আবার আগের মতই ঘুষ, দূর্নীতিতে জড়াচ্ছে। একজন হাজী'র কোনো চারিত্রিক এবং নৈতিক গুণাবলি তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে হাজীদেরকে এখন আর দেখে চেনা যায় না। সমাজে হাজীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সমাজের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে; মানুষের মনুষ্যত্ববোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। 

ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষ দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশে বিগত কয়েক বছরে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এসব শিক্ষার্থী সমাজের মানুষের  ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারেনি। বরং এরা নিজেরাই অনেকে উগ্র, সাম্প্রদায়িক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষী। ইসলাম যেখানে সহনশীলতা, সাম্য, শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধের বার্তা দেয়, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এসব আলেমদের আচরণ ঠিক তার উল্টো! 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখা বুড়ী অসুস্থ হলে তার সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তুলেছেন। যাদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং হিংস্রতার কারণে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত বাধ্য হয়েছিলেন- মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া আলেম নামধারী কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ ঈদ এর পরিবর্তে কেউ ইদ লিখলেই তাকে কাফির, নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের কল্লা কাটার ঘোষণা দেয়! চুন থেকে পান খসলেই এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদগার করে, অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে। যাকে তাকে যখন তখন ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা আসলে কতটা কুরআন এবং রাসূলের অনুসারী! সমাজ, রাষ্ট্রে এমন আলেমের সংখ্যাই বেশি। প্রকৃত আলেমের সংখ্যা খুবই কম। 

সমাজে কেবল এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম নয়, সুশীল নামধারী নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা অনেক শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক মানুষ আছে। এরা দাঁড়ি, টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। এরা দাঁড়ি, টুপীওয়ালা মানুষদের জঙ্গি এবং মৌলবাদী আখ্যায়িত করতে পারলেই নিজেদেরকে প্রগতিশীল ভাবে। দাঁড়ি, টুপি এবং মাদ্রাসার প্রতি এদের এলার্জি সাংঘাতিক রকমের। এরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক মনে করলেও আসলে এরা নিজেরাও চরম সাম্প্রদায়িক। এরুপ প্রগতিশীলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সমাজে দিন দিন এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম এবং প্রগতিশীলতার ভান করা চরম সাম্প্রদায়িক শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এরা উভয়ই সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপস্বরুপ।

আগে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার সংখ্যা ছিল কম। যা ছিল তাও বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোল পাতার ছাউনি ঘেরা নিতান্তই এক একটা কুঁড়ে ঘর। এসি তো দূরের কথা লাইট, ফ্যান ও ছিল না। মানুষের গায়ে তখন দামি পোশাক ছিল না, দামি গাড়ি, আলিশান বাড়ি ছিল না অথচ তখন সমাজে অনেক আদর্শবান মানুষ ছিলেন। যাদের দেশপ্রেম, সততা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল অনুকরণীয়। আজকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার কোনো কমতি নেই। বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোলপাতার ছাউনির পরিবর্তে এগুলো এখন একেকটা আলিশান ভবন। টাইলস কিংবা দামি মার্বেল পাথর বাঁধানো এসব ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ( এসি ) এর ছড়াছড়ি। আজকাল এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় মানুষের শরীরকে শীতল করলেও মনকে পরিশীলিত, নরম এবং পরিশুদ্ধ করতে পারছে না। মানুষ এখন দামি পোশাক, অভিজাত গাড়ি, প্রাসাদতুুল্য বাড়ির মালিক। তাদের এখন সব আছে। নেই কেবল সততা, দেশপ্রেম, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, তরুণ কলামিস্ট, খুলনা।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলাদেশের নির্বাচন: ব্যাপক বয়কট নাকি সর্বজন গৃহীত?

প্রকাশ: ০১:৫৭ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।  

তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।

অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?

দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।  

নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।

তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।

উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।

বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।

দায়বদ্ধতা

এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।

নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।


বাংলাদেশের নির্বাচন   ব্যাপক   বয়কট   সর্বজন গৃহীত  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন