এডিটর’স মাইন্ড

জিয়া এনেছিলেন স্যুট পিস, এরশাদ গাভী, মইন ঘোড়া, বেগম জিয়া পুশইন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২২


Thumbnail জিয়া এনেছিলেন স্যুট পিস, এরশাদ গাভি, মইন ঘোড়া, বেগম জিয়া পুশইন

চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী ভারত গিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফর। ৬ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জ্বালানি এবং খাদ্যে সহায়তার অঙ্গীকারসহ দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে বিনাশুল্কে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। ২০২০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। রীতি অনুযায়ী সে সময়ই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত সফরে আমন্ত্রণ জানান। এ ধরনের বৈঠকের আগে দুই দেশের মধ্যে আলোচ্যসূচি নিয়ে নানা ধাপে নানা বৈঠক হয়। এসব বৈঠকের চূড়ান্ত রূপ হলো দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক। এসব বৈঠকে দেওয়া-নেওয়ার কিছু থাকে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। এর অনেকটির সমাধান হয়েছে। অনেক বিষয় নিয়ে দুই দেশের আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের ’৭৫-পরবর্তী যেসব সমস্যা ছিল তার মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, বিচ্ছিন্নতাবাদী দমন, সীমান্ত হত্যা, সমুদ্রসীমা বিরোধ, অভিন্ন নদীর পানির হিস্সা নির্ধারণ ইত্যাদি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গত এক যুগে এসব অনিষ্পন্ন বিষয়ের অনেকটিরই সমাধান হয়েছে। এখনো সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানি চুক্তির মতো কিছু বিষয় রয়ে গেছে। এর মধ্যে সীমান্ত হত্যা অনেকখানি কমে এসেছে। এবারের সফরেও সীমান্ত হত্যা বন্ধে অঙ্গীকার করেছে দুই দেশ। তিস্তার পানি চুক্তি আটকে আছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। কিন্তু দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের মাপকাঠি কখনো দেওয়া-নেওয়ার হিসাবে হয় না। একটি দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অনেকখানি নির্ভর করে প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। প্রতিবেশী বড় না ছোট তা মুখ্য বিষয় নয়। দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দুটি দেশের সম্পর্ক ভালো হলে একে অন্যের উন্নয়নের পরিপূরক হতে পারে। প্রতিবেশীর সঙ্গে বৈরিতা কখনই একটি রাষ্ট্রকে স্বস্তি দেয় না। ভারত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বন্ধু। দুই দেশের সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে, তারা এজন্য ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কার্পণ্য করে না কখনো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ’৭১-এ ভারত এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অকৃপণ সহযোগিতাকে স্মরণ করেছিলেন গভীর শ্রদ্ধায়। পাশাপাশি তিনি এক আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ভারতের অনুগত নয় বরং জাতির পিতা চেয়েছিলেন একটি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক। এ কারণেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরপরই ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা ভারত সফর করেন। এ সফরেই তিনি শ্রীমতী গান্ধীকে সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ রক্ষা করেন। জাতির পিতার জন্মদিনে, ১৯৭২-এর ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরের আগেই ১৫ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত নেওয়া সমাপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়; যা দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিমূল। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এসব চুক্তির মাধ্যমে জাতির পিতা বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা’ নতুন উচ্চতায় উপনীত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দুই দেশের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। ’৭১-এ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, বিজয়ের পর তারাই বাংলাদেশে সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় ভারতবিরোধিতার জিকির শুরু করে। ’৭৫-এ যে অপশক্তি জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারাই ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়ে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল। ’৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ‘ভারতবিরোধিতা’ ছিল সস্তা এক প্রবণতা। ‘ভারত জুজু’র ভয় দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত ধারার পুনর্বাসন হয়। ভারতবিরোধিতা, আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধিতা ধীরে ধীরে পরিকল্পিতভাবে একবিন্দুতে মেলানো হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে। ফেনী পর্যন্ত ভারত হবে। মসজিদে আজান হবে না। ইত্যাদি বক্তব্য গোয়েবলসীয় কায়দায় ছড়ানো হয়। জিয়া, এরশাদ এবং বেগম জিয়া লাগাতারভাবে এসব সস্তা বুলি আওড়িয়েই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। এসব বক্তব্য দিয়ে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ডালপালা মেলার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

১৯৭৫ থেকে ’৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে চটকদার ইস্যু ছিল ‘ভারত’। এমনকি ’৯৬-এর নির্বাচনী প্রচারণায় বেগম জিয়া ফেনীর এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে ফেনী ভারতের দখলে চলে যাবে।’ (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ৩০ মে ১৯৯৬)। কিন্তু ভারত জুজু ওই নির্বাচনে কাজে আসেনি। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি করতে সক্ষম হন। পার্বত্য শান্তিচুক্তি ছিল তাঁর আরেকটি অনন্য অর্জন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আবার একটি স্বাভাবিক সড়কে এগোতে থাকে। এ সময় ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে ‘নতুন কূটনীতি’ শুরু করে। ‘শুধু এক দলের সঙ্গে সম্পর্ক নয়’ এ নীতিতে ভারত বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়। এ আগ্রহ থেকেই বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে নৈকট্য বাড়ায় ভারত। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল ভারত সফর করে। সে সফরে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতির ডালি সাজিয়ে নিয়ে যায় বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর একাধিক বক্তৃতায় সোজাসাপটা এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র-এর বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে র নির্বাচনে বিএনপিকে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়।’

২০০১ সালের নির্বাচনে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিরল এক ঐক্য হয় বিএনপির পক্ষে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান আদালতে জবানবন্দিতে স্বীকার করেন, ওই নির্বাচনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে টাকা দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনের পর ভারতের মোহভঙ্গ ঘটে। পাকিস্তানি মদদে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত অঞ্চল হয়ে ওঠে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্য। ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনার পর ভারত বুঝতে পারে ‘লোভী, অবিশ্বস্ত বন্ধুর চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না।’ বিএনপি এ সময় টাটা নাটক করে। টাটা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে বলে উল্লাসে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকেন তৎকালীন জ্বালানি উপদেষ্টা। টাটা এলো, টাটা এলো বলে বিএনপি নেতারা কোরাস গাইতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করে টাটার বেলুন চুপসে গেল। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ‘গ্যাসের দাম নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় টাটার সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে না।’ কিন্তু ভারতের প্রভাবশালী সাময়িকী ফ্রন্টলাইন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল। তারা এক এক্সক্লুসিভ রিপোর্টে জানাল, ‘বিএনপি সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তার বন্ধু টাটার কাছে বিপুল পরিমাণ উৎকোচ দাবি করেন। টাটার বিনিয়োগ গাইডলাইনে এ ধরনের উৎকোচ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ থেকে টাটা সরে এসেছে।’
অর্থাৎ বিএনপি ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করেনি। নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে তারা ভারতবিদ্বেষ ছড়িয়েছে। আবার ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভারতের কাছে নিজেদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে।

এবার প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের শুরু থেকেই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তারস্বরে চিৎকার করেছেন। মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফরে গিয়ে দিয়ে আসেন, কিন্তু নিয়ে আসতে পারেন না।’ বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। আমাদের পেছনে একটা তিক্ত এবং হত্যাশার অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা প্রতিবার আশা করেছি যে এবার বুঝি তিনি কিছু নিয়ে আসবেন। প্রতিবার দেখেছি দিয়ে এসেছেন, নিয়ে আসেননি।’ বন্ধুত্ব মানে কি দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক? আপনি আপনার বন্ধুর বাসায় গেলেন, গিয়ে বললেন, আমার টিভি নেই, তোমার টেলিভিশনটা দাও। কিংবা আমার পকেটে টাকা নেই। কিছু টাকা দাও। এ রকম গিভ অ্যান্ড টেকের সম্পর্কে আর যা হোক বন্ধুত্ব হয় না। মির্জা ফখরুলের চেয়ে আর এক কাঠি সরস বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বললেন, ‘শেখ হাসিনা ভারতে গিয়ে সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে এসেছেন।’ রুহুল কবির রিজভী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপার বিনোদন। তাঁর কথায় হাস্যরস করা যায়। সিরিয়াস চিন্তা করা যায় না। মির্জা ফখরুল একজন জ্ঞানী মানুষ। রাজনীতিতে আসার আগে শিক্ষকতা করেছেন। এমপি ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন। কাজেই তাঁর মন্তব্য তো আমাদের ভাবাবেই। জাতির পিতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটা সম্মান এবং সমতার ভিত্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু ’৭৫-এর পর বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের সরকার ভারত থেকে কী কী এনেছিল? আমি খানিকটা খুঁজে দেখার চেষ্টা করলাম।

জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রথম ভারত সফর করেছিলেন ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭৭। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে এ সফর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক উন্নয়ন’। দুই দিনের এ সফরে কোনো চুক্তি স্বাক্ষর হয়নি। কোনো সমঝোতা স্বাক্ষরও হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের সঙ্গে জিয়া এক চা চক্রে মিলিত হন। সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জিয়াকে একটি স্যুট পিস উপহার দেন। এ নিয়ে ২০ ডিসেম্বরের ‘আনন্দবাজার’ একটি চমৎকার ইঙ্গিতবাহী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘জিয়াকে উর্দি ছাড়তেই স্যুট পিস দিলেন মোরারজি’। জিয়া তখন একাধারে সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি। তুখোড় রাজনীতিবিদ দেশাই স্যুট পিস দিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে দিলেন উর্দি পরা স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় না। জিয়া তাঁর শাসনামলে আরও দুই দফা ভারত সফর করেছিলেন। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারি ইউনিডো সম্মেলনে যোগ দিতে জিয়া ভারত সফরে যান। জিয়ার ভারত সফরের মাত্র সাত দিন আগে ১৪ জানুয়ারি ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে রাজসিক প্রত্যাবর্তন ঘটে ইন্দিরা গান্ধীর। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শত চেষ্টা করেও মিসেস গান্ধীর সঙ্গে জিয়ার একটি সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে পারেনি। জিয়ার শেষ ভারত সফর ছিল ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৮০। আঞ্চলিক কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে জিয়া ভারতে যান। এবার তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি ফটোসেশনে অংশ নিতে সক্ষম হন। গঙ্গার পানি, সীমান্ত হত্যা ইত্যাদি কোনো বিষয়েই জিয়া টুঁশব্দ করেননি।

জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ ক্ষমতায় এসেই ভারতের মনজয়ের চেষ্টা করেন। ৬ অক্টোবর, ১৯৮২ সালে রওশন এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে ভারত সফরে যান এরশাদ। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র খবর অনুযায়ী এরশাদের সামরিক আইন জারি এবং তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন ভারত সরকারের কাছে। ‘আনন্দবাজার’ জানায়, ভারতের পক্ষ থেকে এরশাদকে এক জোড়া গাভি উপহার দেওয়া হয়। পরের বছর জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এরশাদ আবার দিল্লি যান। এবার তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটি বৈঠক করতে সক্ষম হন। কিন্তু বাংলাদেশের অমীমাংসিত ইস্যু আলোচনার টেবিলেই আনতে পারেননি এরশাদ। ’৮৪-এর ৩ নভেম্বর এরশাদ ভারতে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর শেষকৃত্যে যোগ দিতে। এরশাদের শেষ ভারত সফর ছিল ১৯৮৬ সালের ১৬ জুলাই। এটি ছিল এরশাদের প্রথম এবং একমাত্র রাষ্ট্রীয় সফর। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে এ বৈঠকে গঙ্গার পানি বণ্টন কিংবা স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি।

বেগম জিয়া ক্ষমতায় এসে ১৯৯২-এর ২৫ মে তিন দিনের সফরে ভারতে যান। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মূল আলোচনার বিষয় ছিল অবৈধ বাংলাদেশিদের ভারতে অনুপ্রবেশ বন্ধ। বেগম জিয়া-নরসিমা রাওয়ের বৈঠকের পর ভারত থেকে পুশইন শুরু হয়। তিন দিনের সফর শেষে ঢাকায় ফিরে বেগম জিয়া বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় একজন সাংবাদিক জানতে চান ‘গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না।’ বেগম জিয়া বলেন, ‘আমি তো এ বিষয়টি ভুলেই গিয়েছিলোম।’ যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর শুরু হয় পুশইন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো শুরু করে ভারত। বেগম জিয়া তাঁর সফরেই এ-সংক্রান্ত মুচলেকা দিয়ে এসেছেন বলে সেখানকার গণমাধ্যম দাবি করে। বেগম জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে ২০০৬ সালের ২০ মার্চ ৪০ ব্যবসায়ীসহ ৯৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে দিল্লি যান। বেগম জিয়ার সঙ্গে মনমোহন সিংয়ের বৈঠকটি ছিল তিক্ততাপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের ভূখন্ডে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং হিন্দুদের দেশত্যাগ নিয়েও কথা হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে জঙ্গিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভূমিকা দাবি করেন। এ বৈঠক এতটাই তিক্ততাপূর্ণ ছিল যে দুই দেশ যৌথ ইশতেহার পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। একটি যৌথ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে নিরাপত্তা, বাণিজ্যসহ সব বিষয়ে একত্রে কাজ করার অঙ্গীকার করা হয়। বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় এক ভয়ংকর রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এ প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় আসে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে এক-এগারো সরকার। সেনাসমর্থিত এ সরকারের মূল কর্তৃত্ব ছিল তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের হাতে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের সেনাপ্রধানের আমন্ত্রণে পাঁচ দিনের সফরে জেনারেল মইন উ আহমেদ ভারত সফরে যান। ওই সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে। পাঁচ দিনের সফর শেষে ছয়টি ঘোড়া নিয়ে ফেরেন জেনারেল মইন।

সব আমলের সরকারপ্রধানের ভারত সফরের ইতিবৃত্ত খুঁজে বের করলাম আসলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথার পরিপ্রেক্ষিতে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আর কি কেউ কিছু আনতে পেরেছেন? প্রথম মেয়াদে শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টনের চুক্তি করেছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি বঙ্গবন্ধুর সময় স্বাক্ষরিত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করেন। ’৭৪-এ ওই চুক্তি স্বাক্ষর হলেও ভারতের পার্লামেন্টে অনুমোদিত না হওয়ায় বাস্তবায়ন হয়নি। জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়া কেউই তা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করেননি। শেখ হাসিনার সফল কূটনীতির কারণে ছিটমহলবাসীর বন্দিজীবনের অবসান হয়। শেখ হাসিনাই সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি করেন। সীমান্ত হত্যা বন্ধে উদ্যোগ নেন। এবার কুশিয়ারা নদীর পানির হিস্সা আদায় করেছেন। এনেছেন ট্রানজিট সুবিধা। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যাপারে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করে দুই দেশের সম্পর্কে বিশ্বাস— আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিশ্ব যখন এক মহামন্দার দিকে দ্রুত ধাবমান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভারতে গিয়ে এ দেশের জনগণের জন্য আপৎকালীন খাদ্য ও জ্বালানির নিশ্চয়তা নিয়ে এলেন। এটা যে কত বড় অর্জন, কত বিশাল প্রাপ্তির তা যারা বোঝেন না, তারা আসলে জ্ঞানপাপী।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন

জিয়া   এনেছিলেন   স্যুট পিস   এরশাদ গাভি   মইন ঘোড়া   বেগম জিয়া   পুশইন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

শেখ হাসিনার পর কে?

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

একজন বিদেশীর সাথে কথা হচ্ছিল কদিন আগে। ঢাকার এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ী চালিয়ে তিনি মুগ্ধতার কথা বলেছিলেন। কুড়ি বছর আগে একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন এই উন্নয়নকর্মী। কুড়ি বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া দৃশ্যপট দেখে তিনি উল্লাসিত, আপ্লুত। একটি দেশ কিভাবে এতো কম সময়ে এভাবে উন্নতি করতে পারে? প্রশ্নটা করে নিজেই উত্তর দিলেন। দুটি কারণ, এদেশের জনগণের অদম্য প্রাণশক্তি আর অসাধারন নেতৃত্ব। একজন যোগ্য এবং সঠিক নেতা যে জনগণের শক্তিতে কোথায় নিয়ে যেতে পারেন, তার প্রমাণ বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনা। একটানা কথা গুলো বলে থামলেন ভদ্রলোক। একটু দম নিয়ে, আবার কথা শুরু করলেন। আচমকা আমাকে প্রশ্ন করলেন শেখ হাসিনার পর কে? নিজেই উত্তর দিলেন ‘আই ডোন্ট সি এনি ওয়ান’ (আমি কাউকে দেখিনা)। তার এই প্রশ্ন আমাকে কিছুটা হলেও ভাবনার সাগরে নিয়ে গেল। শেখ হাসিনা গত ২৮ সেপ্টেম্বর ৭৭ তম জন্মদিন পালন করলেন। শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বের বিবেচনায় তিনি অন্যতম প্রবীন রাজনীতিবিদ। এধরনের বয়সে অনেকে অবসর জীবন যাপন করেন। নাতি-নাতনী নিয়ে চুটিয়ে সময় কাটান। কারো কাটে নানা রোগ শোকের সঙ্গে যুদ্ধ করে। কিন্তু শেখ হাসিনা তার আশ্চর্য ব্যতিক্রম। এই বয়সেও তিনি প্রচন্ড ব্যস্ত। কর্মচাঞ্চলে ভরপুর এক উজ্জীবিত মানুষ। এখনও আমাদের চেয়ে তিনি বেশি কাজ করেন। নিজ যোগ্যতা, দক্ষতায় এবং মেধায় তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রনায়ক থেকে হয়েছেন বিশ্বনেতা। দলে এবং দেশে তার কোন বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার বিকল্প একমাত্র শেখ হাসিনাই।

বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দল গুলো এখন এক দফা আন্দোলন করছে। এক দফার মূল দাবী হলো ‘শেখ হাসিনার অধীনে কোন নির্বাচন নয়।‘ বিএনপি নেতারা ইদানিং সারাক্ষণ শেখ হাসিনার সমালোচনায় মুখর থাকেন। সব আক্রমনের কেন্দ্রবিন্দুতেই তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা বিদেশে বসে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের দোকান খুলে বসে নিয়মিত দূর্গন্ধযুক্ত কদর্য নর্দমার মতো বমি উগলাচ্ছেন, তাদেরও প্রধান লক্ষ্য বস্তু এখন ‘শেখ হাসিনা’। শেখ হাসিনাকে সরানোই তাদের জীবনের যেন একমাত্র আরাধ্য। কিন্তু শেখ হাসিনাকে সরিয়ে কাকে আনতে চান তারা? নির্বাচিত না অনির্বাচিত সরকার প্রধান? ধরা যাক, বিএনপির কথাই ঠিক। তারা দেশে একটি শান্তিপূর্ণ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা এটাও বিশ্বাস করে, ‘নিরপেক্ষ এবং অবাধ’ নির্বাচন হলে, বিএনপি জিতবেই জিতবে। খুব ভালো কথা। বিএনপি যদি নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? আমি না, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এবং কূটনীতিকরাও বিএনপি নেতাদের হরহামেশাই এই প্রশ্ন করেন। এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব এবং অন্যান্য নেতারা যে জবাব দেন, তা রীতিমতো কৌতুক। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারেও এর উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে বেগম জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তার অবর্তমানে তারেক জিয়া হবেন সরকার প্রধান।‘ কি সাংঘাতিক কথা। বেগম জিয়া দুটি মামলায় সাজা পেয়েছেন। একটি মামলায় হাইকোর্টে তার সাজা বহাল আছে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দুরের কথা, সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। তাকে বিএনপি মহাসচিব কিভাবে প্রধানমন্ত্রী বানাবেন বুঝলাম না। একই বাস্তবতা লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়ার বেলাতেও। এমনকি আইন ও সংবিধান পাল্টালেও আগামী সরকার প্রধান হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। মির্জা ফখরুল এসব জানেন না, এমনটি নয়। জেনে শুনেই এই অসত্য উচ্চারণ তিনি করছেন। কারণ জনগণকে, বিশেষ করে দলীয় নেতা কর্মীদের উজ্জীবিত রাখা। কর্মীরা যেন হতাশ না হয়ে যান, এজন্যই এধরনের বক্তব্য। কারণ, বিএনপি মহাসচিব ভালো করেই জানেন, শেখ হাসিনার বিকল্প হিসেবে তিনি (মির্জা ফখরুল) জনগণের কাছে তো নয়ই, তার নিজের দলেও কাছেও গ্রহণযোগ্য নন। বেগম জিয়ার দন্ডের কথা যদি বাদও দেই, তারপর তিনি কি শেখ হাসিনার বিকল্প? বিএনপি নেতারাই বলছেন, বেগম জিয়া গুরুতর অসুস্থ। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাহলে কোনটা সত্য? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এক কঠিন দায়িত্ব। শেখ হাসিনা যেভাবে দিনরাত একাকার করে এই দায়িত্ব পালন করছেন। বেগম জিয়া কি অসুস্থ শরীরে তার সিকি পরিমান দায়িত্ব পালন করতে পারবেন? বেগম জিয়া তাই কোন ভাবেই শেখ হাসিনার বিকল্প নন।

তারেক জিয়াকে নিয়ে যে আবেগ, উত্তাপ, তা শুধু বিএনপির তরুণ কর্মীদের মধ্যে। সাধারণ মানুষ তারেক জিয়াকে রাজনীতিবীদ বলে মনে করে না। একজন দূর্নীতিবাজ, দূর্বৃত্ত মনে করে। তারেক জিয়া যদি কোনদিন দূর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে দেশের কি হাল হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে ছায়া প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, দূর্নীতি কাকে বলে, কত প্রকার কি কি। সেই সময়ে হাওয়া ভবনের লুণ্ঠন কাহিনী আরব্য রজনীকেও হার মানায়। কাজেই তারেক জিয়াকে প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প ভাবা এক ধরনের গর্হিত অপরাধ।

বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাধায়ক সরকার চায়। বিএনপির অনেক নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবে তা পরের বিষয়, আগে একজন তত্ত্বাধায়ক সরকার প্রধানের কথা ভাবুন। চোখ বন্ধ করে দেখুন তো শেখ হাসিনার কোন বিকল্প খুঁজে পান কি না? গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। একাই দেশ সামলাচ্ছেন। আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার তিনি। সব কিছুর দিকে তার দৃষ্টি। এদেশের মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন তিনি তিল তিল করে। সব কিছু উপেক্ষা করে। এই মুহুর্তে দেশে তার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে তিনি যে সম্ভাবনার সোনালী বন্দরে নিয়ে গেছেন যেখান থেকে দেশকে এগিয়ে নেয়ার মতো যোগ্য ব্যক্তি কি এই মুহুর্তে বাংলাদেশে কেউ আছেন? গত ১৫ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক ভালো কাজ যেমন আছে, তেমনি এই সরকারের আছে অনেক দূর্বলতা এবং সমালোচনাও। গত ৩/৪ বছরে এই সমালোচনার ক্ষেত্রগুলো বেড়েছে। অর্থপাচার, খেলাপী ঋণ, দূর্নীতি সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পরেছে সমাজের সর্বত্র। কিছু মন্ত্রী অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতায় মানুষ অসন্তুষ্ট হতাশ। সর্বত্র আমলাতন্ত্রে দৌরাত্মে মানুষ অস্থির। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মানুষ আর সহ্য করতে পারছে না। এতো কিছুর পরও মানুষ যে আশা হারায়নি। এর একটি কারণ হলো শেখ হাসিনা। দেশের মানুষ তার উপর আস্থাশীল। জনগণ শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে। নিশ্চয়ই তিনি সংকট উত্তরণে সাহসী পদক্ষেপ নেবেন, এমনটা মনে করেন দেশের বেশির ভাগ মানুষ। দেশের সিংহভাগ জনগণের কাছে শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই।

আওয়ামী লীগ সরকারকে নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি এখন কোন নতুন বিষয় নয়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার ইস্যুতে তাদের রয়েছে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু একটি বিষয়ে এসে তারা আটকে যায়। শেখ হাসিনার বিকল্প কে? শেখ হাসিনাকে বাদ দিলে কে হাল ধরবে এই দেশের। শেখ হাসিনা বিহীন বাংলাদেশ কি আরেকটি আফগানিস্তান হবে না? আমার তো মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যদি শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ থাকতো, তাহলে তারা এতোদিনে পাকিস্তানের মতো কোন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতো। তাই, দেশ পরিচালনা শেখ হাসিনা অবিসংবিদিত নেতা। শেখ হাসিনার পর কে? এই প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছে।

রাষ্ট্রে সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প যেমন কেউ নেই, তেমনি আওয়ামী লীগেও শেখ হাসিনার বাইরে কোন নেতা নেই। আওয়ামী লীগ আরো বেশী শেখ হাসিনা নির্ভর। কিংবা বলা যায় পুরোপুরি শেখ হাসিনা নির্ভর। আমার তো মনে হয় শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ বিভ্রান্ত, মুমুর্ষ এবং প্রায় বিকলাঙ্গ। আওয়ামী লীগের কর্মীরা একমাত্র শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করেন, অন্য নেতাদের উপর তাদের আস্থা নেই। অন্যান্য নেতারা, প্রেসিডিয়াম সদস্য বলি আর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলি, নিজেরা গৎবাঁধা বক্তৃতা দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ করতে পারেন না। একটি সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাকিয়ে থাকেন শেখ হাসিনার দিকে। রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারনের যোগ্যতাও নেই বেশির ভাগ নেতার। শেখ হাসিনা যেন আওয়ামী লীগকে এক সূত্রে গেঁথে রেখেছেন। তিনি না থাকলে এই দলটি ৭৫ এর পরবর্তী অবস্থায় মতো অবস্থায় চলে যাবে। ইদানিং প্রায় আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ হাসিনার উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনা শুনি। শেখ হাসিনার পর দলের হাল কে ধরবেন, তা এখনই ঠিক করা উচিত এমন মত অনেকের। শেখ হাসিনা ৭৭ বছরে পা রাখলেন। আগামী  কাউন্সিলে হয়তো তিনি দলের দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেবেন, এমন শংকা অনেকের। তখন কে হাল ধরবেন আওয়ামী লীগের? শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল নাকি রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী ববি? কে ভালো হবে, এ নিয়ে প্রায়ই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন আড্ডায় নানা আলোচনা হয়। শেখ হাসিনা কেন আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতা এখনই নির্ধারণ করছেন না, এনিয়ে কারো কারো উৎকণ্ঠা কানে আসে। এই সব প্রশ্নের উত্তর দুভাবে দেয়া যায়। প্রথমত, বয়স প্রসঙ্গ। শেখ হাসিনা এখন ৭৭। এই বয়সে তিনি যে পরিশ্রম করেন, তা কজন তরুণ-যুবক করতে পারেন? এই নভেম্বরে জো বাইডেন ৮১ বছর পূর্ণ করবেন। দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থাৎ ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার ঘোষণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট দিয়েছেন। কোথায় তার অবসরের কথা তো কেউ বলেন না। ৮২ বছর বয়সেও মন মোহন সিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার ক্লান্তি কিংবা বার্ধক্য নিয়ে তো কোন প্রশ্ন তোলা হয়নি। কিছু কিছু মানুষের জীবন হয় কর্মমুখরতায় ভরপুর। আমৃত্যু তিনি কাজ করে যান। শেখ হাসিনা তেমনি একজন। তার রাজনীতি থেকে কিংবা সরকার প্রধানের পদ থেকে তার অবসরের ভাবনা অবান্তর। এ সিদ্ধান্তটা একান্তই শেখ হাসিনার। তার প্রতিটি মুহুর্ত জনগণের কল্যাণে নিবেদিত। তাই এখনই তার অবসরের চিন্তাটা না করাই শ্রেয়।

এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের উত্তরাধিকার প্রসঙ্গে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই দলটির নেতৃত্ব কর্মীদের অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত। আওয়ামী লীগ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে উত্তরাধিকারের রাজনীতি করেনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী থেকে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে এসেছেন নিজ যোগ্যতায়। কর্মীদের উপর নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়া হয়নি। শেখ হাসিনাও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এসেছেন দলের অস্তীত্বের প্রয়োজনে। দল বাঁচানোর আর কোন বিকল্প ছিলো না জন্যই শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হয়েছিল। একথা ঠিক, জাতির পিতার কন্যা জন্যই তিনি কর্মীদের ভালোবাসা পেয়েছেন। দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন। কিন্তু গত ৪৩ বছরে আওয়ামী লীগকে তিনি আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছেন নিজ যোগ্যতায়, পরিশ্রম এবং প্রচন্ড ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে। যতো দিন তিনি কর্মক্ষম আছেন, ততোদিন আওয়ামী লীগে তার বিকল্প কেউ হবে না। শেখ হাসিনার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আসবে কর্মীদের স্বত:ফূর্ত আকাঙ্খা থেকে। কর্মীরাই পছন্দ করবেন, কে হবে আওয়ামী লীগের নেতা। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্ব যে গ্রহণযোগ্য হয়না, ভারতের কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাই শেখ হাসিনার পর কে? এই প্রশ্নটা এখন বড্ড অসময়ের প্রশ্ন। এই রাষ্ট্র এবং জনগণকে শেখ হাসিনার এখনও অনেক কিছুই দেয়ার বাকী আছে।

 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আমলারা হঠাৎ নিরপেক্ষ হয়ে যাচ্ছেন কেন?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বুধবার সচিবালয়।। একজন গুরুত্বপূর্ণ সচিবের কাছে গেলেন একজন জনপ্রতিনিধি। সংসদ সদস্য তার নির্বাচনী এলাকার  একটি কাজ সংক্রান্ত ফাইল সচিবের টেবিলে আটকে আছে বলে জানালেন এবং দ্রুত ফাইলটা নিষ্পত্তি করার জন্য অনুরোধ জানালেন। সচিব তার পূর্ব পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠও বটে। কিন্তু এবার তিনি ভিন্ন অবয়বে দেখা দিলেন। সচিব জনপ্রতিনিধিকে বললেন, ‘ফাইল তার নিয়মেই যাবে। এটার জন্য আমাকে তদবির করে লাভ নেই। এখন অনেক ঝামেলায় আছি। দেশে কি হচ্ছে আমরা বুঝি না। এ ধরনের তদবির এখন আর গ্রহণ করতে পারছি না। দুঃখিত।’ 

সচিবের এই আচরণে হতবাক হয়ে গেলেন সংসদ সদস্য। সংসদ সদস্য বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই সচিবের সঙ্গে আমার পরিচয়। তিনি আগে এলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেন। আমার কোন কাজ থাকলে সেই কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট ডেস্ককে ফোন করতেন, দ্রুত কাজ নিস্পত্তি করার জন্য তৎপরতা দেখাতেন। কিন্তু আজকে তিনি যে আচরণটা করলেন তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।

শুধু এই সচিব নয়, সচিবালয়ের চেহারা গত কিছুদিনে পাল্টে গেছে। বিশেষ করে ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েকজনের ওপর যে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তারপর সচিবালয়ের দৃশ্যপট পাল্টাতে শুরু করেছে। অনেকেই এখন নিরপেক্ষ হওয়ার প্রতিযোগীতায় নেমেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা বা আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিরা আসলে তাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো বিতর্কিত ফাইল হলে সেই ফাইলটি নিচে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। ফাইল অনুমোদন না করে ফাইলটিকে ঝুলিয়ে রাখার কৌশল নিয়েছেন অনেক আমলা।

বাংলাদেশে ২০০৯ এর পর থেকে আমলাতন্ত্রের মধ্যে আসতে আসতে রাজনীতিকরণ ঘটে থাকে এবং রাজনীতি প্রশাসনের মধ্যে এমন ভাবে জড়িয়ে যায় যে আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগের কর্মী হয়ে যান প্রশাসনের কর্মকর্তারা। প্রশাসনের কাজের চেয়ে রাজনীতিতে তাদের মনোযোগ ছিল বেশি। কিছুদিন আগেও আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কিভাবে জেতাতে হবে, কোন আসনে কে প্রার্থী হলে জয়যুক্ত হবেন ইত্যাদি নানা আলাপ-আলোচনা হতো সচিবালয়ে। কিন্তু এখন সেই আলাপ-আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। উল্টো কারা ভিসা স্যাংশন খেল, কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কে থাকেন বা কার কোন সম্পত্তি পশ্চিমা দেশগুলোতে আছে সে নিয়ে মৃদু আলাপ আলোচনা হয় বটে। কিন্তু আওয়ামী লীগকে জেতাতে হবে এই ধরনের বক্তব্য এখন কান পাতলে আর শোনা যায় না।

সচিবালয়ে যখন এই অবস্থা তখন মাঠ প্রশাসনের চিত্র নয়। কয়েকদিন আগেই এক ডিসি আওয়ামী লীগকে আবার ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রত্যাহার হয়ে গেছেন। এরপর থেকেই প্রশাসনে মাঠ পর্যায়ে নিরপেক্ষতা দেখা যাচ্ছে। জেলা প্রশাসক, এমনকি ইউএনওরা জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের এড়িয়ে চলছেন। আগে যে সমস্ত আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে চা না খেয়ে দিনের কাজ শুরু করতেন না ডিসি, ইউএনওরা এখন তার উল্টো চিত্র। চাকরি বাঁচানোর জন্য এখন তারা আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে কার্যালয়ে না আসার জন্য অনুরোধ করছেন। যারা সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগের প্রতি অনুরক্ত বা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন তারা ব্যক্তিগত ফোন ব্যবহার করছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলার জন্য। প্রশাসনের মধ্যে একটা নিরপেক্ষতার আবহ তৈরি হচ্ছে ক্রমশ। এর একটা কারণ যেমন ভিসা নিষেধাজ্ঞা অন্যটা হল প্রশাসনের পক্ষপাত নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন। আর ফলে প্রশাসন হঠাৎ করেই যেন নিরপেক্ষ হয়ে গেছে।

সচিবালয়   প্রশাসন   নির্বাচন   ভিসা নিষেধাজ্ঞা   জনপ্রতিনিধি   সরকার  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

শুভ জন্মদিন আপা, আপনি অপরাজিতা

প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

৭৭ বছরেও আপনি ক্লান্তিহীন। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরা। এখনও আপনার উদ্যম, উদ্দীপনা, দিনরাত কাজ করে যাওয়া-সবাইকে অবাক করে, বিস্মিত করে। কান পাতলেই শুনি, লোকজন বলে, ‘একজন মানুষ কিভাবে এতা পরিশ্রম করতে পারে।’ কিভাবে সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে এভাবে অবিরাম ছুটে চলা? আমি জানি স্বপ্ন আপনাকে ঘুমুতে দেয় না। স্বপ্ন পূরণের তাগিদেই আপনি কাজ করে যান সারাক্ষণ। আপনার স্বপ্ন, সোনার বাংলা গড়া। জাতির পিতার বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত, স্বনির্ভর এক সাম্যের বাংলাদেশ। যে দেশে কেউ না খেয়ে থাকবে না, কেউ থাকবে না ঘরহীন। এমন একটি স্বপ্নপূরণ অভিযাত্রা আপনার জন্য সহজ ছিলো না। নানা প্রতিকূলতা জয় করেই আজ আপনি বাংলাদেশকে এনেছেন এই জায়গায়। ঘরে বাইরে আপনাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে কুৎসা, মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার। বার বার আপনার জীবননাশের হুমকি এসেছে। ৭৫ এর পর থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছে, সেই লড়াইটা এখনও চলছে। লড়াই করতে করতে আপনি নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যে আপনিই এখন বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ’মুখ থুবড়ে পরবে আপনাকে ছাড়া। বাংলাদেশ অস্তীত্বের সংকটে পরবে আপনার দিক নির্দেশন ব্যতিরেকে। আপনাকে ছাড়া বাংলাদেশ পথ হারাবে।

৭৫ এ সুদূর জার্মানীতে বসে আপনি শুনেছেন, আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। এ প্রবল শোকের স্রোতের উল্টো পথে সাঁতরিয়ে আপনি আজ অমরত্বের দ্বারপ্রান্তে। ১৯৮১ তে আপনি যখন দেশে ফেরেন, তখন আপনার শত্রুরা ছিলো ভয়ংকর। ক্ষমতাবান। আপনার জীবন ছিলো হুমকির মুখে। কিন্তু ৭৫ এর ১৫ আগস্ট আপনার ‘মৃত্যু ভয়’এর মৃত্যু ঘটিয়েছে। নিজের জীবনটাই সবচেয়ে তুচ্ছ আপনার কাছে। ১৯৮১ তে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর একের পর এক যুদ্ধ করতে হয়েছে আপনাকে। কখনো ঘরে, কখনো বাইরে। সামরিক স্বৈরশাসকের ভ্রু কুটি, ষড়যন্ত্র আপনি নির্ভয়ে মোকাবেলা করেছেন। দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীরা ছিলো ওত পেতে। তারা আপনাকে ‘একান্ত অনুগত’করতে চেয়েছিল। আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল। কিন্তু এইসব ছদ্মবেশী প্রতিপক্ষরা কিংবা খুনী মোশতাকের অপচ্ছায়ারা আপনাকে পরাস্ত করতে পারেনি। ৮২ থেকে টানা নয় বছর আপনি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। আপনার নেতৃত্বে স্বৈরাচারের পতন ঘটে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পথে আবার যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু আবার ষড়যন্ত্র ঘরে-বাইরে। ৯১ এর নির্বাচনে আপনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। অদ্ভুত রহস্যের এক নির্বাচন আপনার দল আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেও সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। সে সময় আপনার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল অনেকে। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ‘এক চাচা’যাকে জাতির পিতা রাজনীতিতে এনেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে ‘গণফোরাম’নামে এক নতুন দোকান খোলেন। কিন্তু আপনি হতাশ হননি। পথ হারাননি। লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বছর পর আপনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। শুরু হয় উন্নয়নের অভিযাত্রা। আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতানার ধারায় হাটতে থাকে বাংলাদেশ। পার্বত্য শান্তি চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি করে আপনি প্রমাণ করেন আপনার দক্ষতা, মেধা এবং যোগ্যতা। পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে এক মানবিক বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার রূপকল্প গ্রহণ করেন আপনি। বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিক, একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়নের মতো বেশ কিছু অনবদ্য উদ্ভাবনী উদ্যোগ গ্রহণ করেন আপনি। কিন্তু বাংলাদেশের এই এগিয়ে চলা অনেকে চায়নি। ৭১ এবং ৭৫ এর শত্রুরা এক হয়। শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। ২০০১ এর ১ অক্টোবরের নির্বাচন ছিলো সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তব রূপায়ন। আবার শুরু হয় অন্ধকার যাত্রা। এক দিকে হাওয়া ভবনের লুণ্ঠন অন্যদিকে জঙ্গীবাদের উত্থান। একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু আপনি লড়াকু যোদ্ধা। বীর। অমিত সাহসী এক মানুষ আপনি লড়াই অব্যাহত রাখেন। চক্রান্ত হয় নতুন করে। আসে এক-এগারো। এবার আপনাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার খেলা শুরু হয়। দলের ভেতর হেভীওয়েট নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতায় আপনি অবাক হননি। বিচলিতও হননি। কারণ আপনি জানেন, সত্যের জয় অনিবার্য। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আপনি একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তারপর গত ১০ বছর বাংলাদেশের ইতিহাস গৌরবের। মর্যাদা পুন:উদ্ধারের। বিশ্বকে চমকে দেয়ার। আধুনিক বাংলাদেশের আপনিই নির্মাতা। কিন্তু এখনও ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। শকুন এবং হায়নারা আবার মাঠে নেমেছে। নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র চলছে। এখন ষড়যন্ত্রের ব্যাপ্তি দেশ ছেড়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পরেছে। কিন্তু আমি জানি আপনি জয়ী হবেন। এই যুদ্ধে আপনার জয়ের বিকল্প নেই। আপনি অপরাজিতা প্রিয় আপা। জন্মদিনের শুভ কামনা।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচনের আগে বড় চমক দেবে আওয়ামী লীগ

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস সময় রয়েছে। নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী। তারা বলছেন, নভেম্বরে তফসিল ঘোষণা করা হবে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে। আর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের চমক দেবে। কি সেই চমক তা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা হচ্ছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একটা বিষয়ে একমত যে, বর্তমান রাজনৈতিক অচল অবস্থা কাটানো দরকার। এই অচল অবস্থা কিভাবে কাটতে পারে তা নিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে নানা রকম আলাপ আলোচনা আছে। অনেকেই বলছেন, প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা এবং সংলাপ প্রয়োজন। যেমনটি হয়েছিল ২০১৮ নির্বাচনে। ২০১৪ নির্বাচনের আগেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে সংলাপের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সংলাপের প্রস্তাব বেগম জিয়া প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এবার কি তেমন কিছু হবে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রধান লক্ষ্য হলো আগামী নির্বাচন করা এবং সেই নির্বাচন যেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক  ভাবে গ্রহণযোগ্য হয় সেজন্য আওয়ামী লীগ সবকিছুই করবে। আর তাই নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বেশ কিছু বড় ধরনের চমক আসতে পারে। তবে কি ধরনের চমক সেটি সম্পর্কে কেউই জানেন না। কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই নিয়ে অনুমান করতে পারেন।

১. বিরোধী দলের সাথে সংলাপ: প্রতিটি নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ করেছে। যদিও এই সংলাপের আগে বলা হয়েছে, আমরা এ ধরনের সংলাপ করবো না, কিসের সংলাপ ইত্যাদি। কিন্তু একটা সময় নাটকীয় ভাবে সংলাপের প্রস্তাব লুফে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালের কথাই যদি আমরা ধরি সেই সময় ড. কামাল হোসেন সরকারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই প্রস্তাব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কিসের আলোচনা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় এই প্রস্তাবটি লুফে নিয়েছিলেন এবং গণভবনে সবাইকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। ওই আলাপ আলোচনার ভিত্তিতেই নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হয়। এবার যদিও সংলাপ নিয়ে একটি নেতিবাচক অবস্থান রয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংলাপ হবে এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগকে দৃশ্যত বিএনপির সঙ্গে একটি সমঝোতার চেষ্টা দেখাতেই হবে।

আওয়ামী লীগ আন্তরিক ভাবে চেয়েছিল বিএনপি নির্বাচনে আসুক। তাদেরকে সমঝোতার জন্য ডাকা হয়েছিল, সংলাপের জন্য ডাকা হয়েছিল কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি যদি আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে পারে তাহলে সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জন্য বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন করার পথ প্রশস্ত হবে। আর সে কারণেই আওয়ামী লীগের বড় চমক হতে পারে যে সংলাপের জন্য বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়া বা এ ধরনের প্রস্তাবকে প্রশ্রয় দেওয়া। 

২. সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা: নির্বাচনের তফসিলের আগেই সরকার তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য চেষ্টা করবে এবং এটি একে নাটকীয় সিদ্ধান্ত হতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, যেহেতু নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসছে এখন শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার রদবদল করবেন না। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রগুলো মনে করছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে সরকারের ইমেজ পুনরুদ্ধার বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ ইত্যাদি নানা বিষয়ের দিকে সরকার নজর দিবে এবং একটি নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে মন্ত্রিসভায় বা সরকারের ভিতর বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে এবং সেটি হবে একটি বড় ধরনের চমক। 

৩. মনোনয়নের ব্যাপারে নাটকের সিদ্ধান্ত: আগামী জাতীয় সংসদের মনোনয়ন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নাটকীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। যারা বিতর্কিত, যারা অজনপ্রিয় তাদেরকে বাদ দিয়ে এমন জনপ্রিয় ব্যক্তিদেরকে নির্বাচনের মাঠে নামাতে পারে তা যা দেখে ভোটাররা উৎসাহিত হয় এবং ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যায়। এরকম একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া দিতে পারে বলেই অনেকে ধারণা করছে। তবে কি ধরনের চমক হবে বা কি ধরনের নাটকীয়তা হবে সেটি বড় বিষয় না। আওয়ামী লীগ অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা রাস্তা খুঁজে বের করবে।

নির্বাচন   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা   আওয়ামী লীগ   বিএনপি  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আবার অনির্বাচিত সরকার?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

কিউবার প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার শত্রুর দরকার নেই।’ এ কথাটি যে কত বড় সত্য তা বাংলাদেশ এখন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। জো বাইডেনের সঙ্গে সেলফি, নৈশভোজে আমন্ত্রণের পর গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ভিসা নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের ওপর যখন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেছিলেন। সেদিনই তিনি জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারির কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এমনই। তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারার আড়ালে থাকে নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ শুরুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিল, বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাইডেনের মিষ্টি কথা স্রেফ সৌজন্যতা। ‘বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চমৎকার’ সম্পর্ক ব্লিঙ্কেনের এমন মধুর বাণী স্রেফ কথার কথা। ভারত কিংবা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রের মত বদলাতে পারেনি। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের মিশনে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সত্যি কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় বসাতে চায়? যারা হবে তাদের একান্ত অনুগত। যেমনটি তারা করেছে পাকিস্তানে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতার হাতবদলের একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কি না, হলেও তা কীভাবে হবে এ নিয়ে এখন নানা বিতর্ক, নানা আলোচনা। বিশেষ করে গত শুক্রবার কয়েকজনের ওপর মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে একটি অসাংবিধানিক বা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করবে। গণতন্ত্রের মৃত্যু হবে। বাংলাদেশকে একাধিকবার এরকম দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশকে কি আবার সেই পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা তারই যেন এক বার্তা।

বিএনপি একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে। প্রতিদিনই সমাবেশ, রোডমার্চের মতো নানা কর্মসূচিতে ব্যস্ত ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। বিএনপি বলছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, এমন একটি অনড় অবস্থান নিয়েছে দলটি। বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও একই দাবিতে আন্দোলন করেছিল। বিএনপির তীব্র আন্দোলনের পরও সরকার সে সময় নির্বাচন করতে সক্ষম হয়। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন সবাই মনে করেছিল এ সংসদ বেশি দিন টিকবে না। দ্রুতই আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ শেষ পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদে কার্যকর থাকে। এটিই বাংলাদেশে ’৭৫-পরবর্তী প্রথম সংসদ যেখানে দেশের প্রধান দুটি দলের (আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) একটির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মেয়াদ পূর্ণ করে। এর আগে ১৯৮৬-এর নির্বাচন বিএনপি বর্জন করেছিল। ’৮৭-তে সংসদ ভেঙে দেন এরশাদ। ’৮৮-এর নির্বাচন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলই বর্জন করে। ’৯০-এ গণআন্দোলনে এরশাদের পতন হলে, ওই সংসদও বিলুপ্ত হয়। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচন করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো তখন একাট্টা হয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছিল। বিরোধী দলের দাবিতে উপেক্ষা করে বেগম জিয়া একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বেগম জিয়া সংসদ ভেঙে দিতে বাধ্য হন। ওই সংসদ একটি কাজ করেছিল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছিল, যা ২০১১ সালে সংবিধান থেকে অপসারিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল দলীয় সরকারের অধীনেই কিন্তু ওই নির্বাচনের পর থেকেই বিএনপিদলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এমনকি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও বর্জন করছে দলটি। এবার অবশ্য প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন এবং দুর্নীতি পশ্চিমাদের জন্য বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা চরমে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে, অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। যুক্তরাষ্ট্র নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে সমর্থন করেনি। কিন্তু ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচন কে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটাই এখন বিএনপির শক্তির প্রধান উৎস। বিএনপি মনে করছে, ২০১৪ সালের মতো এবার আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করলে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা তা মেনে নেবে না। ফলে এ নির্বাচনের আগে-পরে নানা নিষেধাজ্ঞা দেবে। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গুটিয়ে নেবে। একতরফা নির্বাচন করলেও সরকার টিকতে পারবে না—এমন হিসাবেই বিএনপি নেতারা ফুরফুরে আত্মবিশ্বাসী। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত ২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনকে লেখা এক চিঠিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বাজেটের অজুহাত দেখিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে আনুষ্ঠানিক চিঠিতে বলা হলেও এর পেছনে অন্য তাৎপর্য আছে। গত ৬ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফর করে। ওই সফরে তারা প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলেন। নির্বাচন নিয়ে আপাতত বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা নেই, এমন ধারণা থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ সিদ্ধান্ত নিল বলে আমার ধারণা। ইইউ শুধু যে বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই নয়, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যুতে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে সম্প্রতি গৃহীত এক প্রস্তাব বাংলাদেশের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। সেখানে বাংলাদেশ জিএসপি সুবিধা পায়। এ রপ্তানি সংকুচিত হলে কিংবা জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রতিদিন কমছে। এরকম পরিস্থিতিতে ইইউ বাণিজ্য সংকোচন নীতি নিলে তা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো। তাহলে কি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বুঝেশুনেই হুমকি দিয়ে রাখল। ইইউ গণতন্ত্রকে মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মনে করে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত কি আগামী নির্বাচন ব্যাপারে তাদের অনাস্থার প্রকাশ। একতরফা নির্বাচন করলে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবেই কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এ প্রস্তাব। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ যদি নির্বাচনকে স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে একতরফা (বিএনপিকে বাদ দিয়ে) নির্বাচনের ভার কি সরকার বইতে পারবে? ২২ সেপ্টেম্বরে কয়েকজনের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর বিভিন্ন মহলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মুখে যে যাই বলুক, একটা ভয় সঞ্চারিত হয়েছে সরকারের ভেতর। আগামী ৭ অক্টোবর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে। বিএনপি ছাড়া নির্বাচন যে যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না, এটা এখন স্পষ্ট। প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন নিয়েই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের শেষ অবস্থান জানাবেন। যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন চায় না, এমন বক্তব্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই দেওয়া হচ্ছে। ‘বাংলাদেশে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র—এমন অভিযোগ এসেছে শাসক দলের পক্ষ থেকেও। যদিও যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাই বলা হোক না কেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চয়তার জন্য বিশ্ব মোড়লের যে ভূমিকা আছে, তার অস্বীকার করবে না কেউই। বিএনপি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান অবলীলায় একবিন্দুতে মেলানো যায়। বিএনপি বলছে, তারা শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না। আর পরোক্ষভাবে পশ্চিমারা বলছে, বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। তাহলে বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে আর পশ্চিমা দেশগুলো যদি বলে বাংলাদেশের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। সে ক্ষেত্রে কী হবে? গণতন্ত্র কি নির্বাসনে যাবে? দেশে আবার একটি অসাংবিধানিক শাসন কায়েম হবে?

কয়েকজন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিউইয়র্কে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশিদের ওপর মার্কিন ভিসা নীতিতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাইরের দেশ থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হলে বাংলাদেশের জনগণও তাদের নিষেধাজ্ঞা দেবে।’ মার্কিন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই আত্মবিশ্বাসী। ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াবাড়ি নিয়ে তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন। আত্মমর্যাদা এবং সম্মানের অবস্থান ধরে রেখেছেন। কিন্তু সরকারের মধ্যে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের বিপরীত কর্মকাণ্ড করছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা বিতর্কিত, বিভ্রান্তিকর। সকালে তারা এক কথা বলে, বিকেলে বলে আরেক কথা। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং মন্ত্রী যেন মতামত দেওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বললেন, ‘নির্বাচনের আগে আর কোনো ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসবে না।’ এ তথ্য তিনি কোত্থকে পেলেন? আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউইয়র্কে বসে বললেন, তিনি নাকি ভিসা নিষেধাজ্ঞায় ‘ভেরি মাচ হ্যাপি (খুব খুশি)।’ একাধিকবার তিনি যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা দায়িত্বহীনই শুধু নয়, কূটনীতির জন্য বিপজ্জনকও বটে। বিশেষ করে দিল্লিতে জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ছবি তোলার পর ড. মোমেন যা বলেছেন, তারপর তিনি কীভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকেন, তা ভেবে পাই না। যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ভুল বার্তা দিয়ে তিনি সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন কি না, সে প্রশ্ন এখন উঠতেই পারে। সরকারের ভেতর বেশ কিছু মার্কিনপ্রেমী আসলে খুনি মোশতাকের ভূমিকায় অবতীর্ণ কি না, তা ভাবতেই হবে। আওয়ামী লীগের কিছু হাইব্রিড নেতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ান। অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের কারও সঙ্গে ফটোসেশন করেই, সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার বার্তা দেন। সকাল-বিকেল মার্কিন দূতাবাসে ধরনা দেন। পিটার ডি হাসকে রাজার মর্যাদা দিয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে ধন্য হন। এরা এখন কী বলবেন? ‘যুক্তরাষ্ট্রকে চটানো যাবে না’—আওয়ামী লীগে সারাক্ষণ যারা এ বার্তা দেন, ব্লিঙ্কেনকে মেইল দিয়ে যেসব নব্য আওয়ামী নেতা ‘মার্কিন বশীকরণ’ বটিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দেন, তাদের মতলব কী? এরা আসলে কার এজেন্ট। দলের ভেতর এসব অপরিণামদর্শী বাচালদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কি পারবেন দেশে একটি নির্বাচন করতে? নাকি মার্কিন অভিপ্রায়ের বাস্তবায়ন চলছে সরকারের ভেতরেই?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন