এডিটর’স মাইন্ড

মনোনয়ন পাবেন না আলোচিত ৫

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২


Thumbnail মনোনয়ন পাবেন না আলোচিত ৫

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় অর্ধেক আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যদেরকে মনোনয়ন দিবে না। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্রগুলো এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলছেন, দেড়শ না আরও বেশিও হতে পারে। ইতোমধ্যে গত নির্বাচনে যারা প্রার্থী ছিলেন, নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের এলাকার অবস্থান যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে, এলাকায় তাদের অবস্থা, তাদের জনপ্রিয়তা, তারা কোনো বিতর্কে জড়িয়েছেন কিনা, সংগঠনবিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে আছেন কিনা ইত্যাদি নিয়েও তথ্যানুসন্ধান চলছে, চলছে একাধিক মাঠ জরিপ। তবে এই সমস্ত তথ্য উপাত্তের পাশাপাশি এরকম কয়েকজন নেতা আছেন যারা নিশ্চিতভাবে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না। কারণ, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর ব্যাপারে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি সুস্পষ্ট মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং আগামী নির্বাচনে যে তারা মনোনয়ন পাবেন না এই সম্পর্কে তাদেরকে বার্তাটা পরোক্ষভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম তালিকায় যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন-

হাবিবে মিল্লাত: হাবিবে মিল্লাত সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি। তিনি তার এলাকায় বিভক্তির সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন। তার এলাকায় প্রায় বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগ এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বাইরে গিয়ে তিনি নতুন একটি গ্রুপ তৈরি করেছেন, এমন অভিযোগও উঠেছে। এই কারণেই তাকে সিরাজগঞ্জ আওয়ামী লীগের পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। হাবিবে মিল্লাত ইতোমধ্যেই লাল কার্ড পেয়েছেন বলে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

পঙ্কজ দেবনাথ: বরিশাল-৪ আসন থেকে নির্বাচিত পঙ্কজ দেবনাথকে সাম্প্রতিক সময়ে দলের সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যদিও এ অব্যাহতি মানে এই নয় যে তিনি আর সংসদ সদস্য পদে থাকতে পারবেন না। এখন তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন। তবে আগামী নির্বাচনে তিনি যে বরিশাল-৪ থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন না এটা মোটামুটি নিশ্চিত। 

মুরাদ হাসান: জামালপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচিত মুরাদ হাসান তথ্য প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তারপর তার বিভিন্ন রকম অসংলগ্ন কথাবার্তার জন্য তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন। তার পদত্যাগের পরই তার এলাকার বিভিন্ন কমিটি থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। বর্তমানে পর্দার আড়ালে আছেন মুরাদ হাসান। কিন্তু আগামী নির্বাচনে তিনিও মনোনয়ন পাবেন না বলেই নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। ওই নির্বাচনী এলাকায় একাধিক ব্যক্তি এখন নির্বাচন প্রচারণার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।

হাজী সেলিম: ঢাকা-৭ থেকে নির্বাচিত হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলার রায় হয়েছে এবং ওই মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়নি। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তবে সংসদ সদস্য বাতিল হোক না হোক, সর্বোচ্চ আদালতের রায় যদি শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে তবে আগামী নির্বাচনে হাজী সেলিমকে দেখা যাবে না।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন: ফরিদপুর-৩ থেকে নির্বাচিত দুইবারের এমপি খন্দকার মোশাররফ হোসেন আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। ফরিদপুরে তার ঘনিষ্ঠ লোকজনের ব্যাপক অর্থপাচার, লুটপাট, দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে বছর জুড়েই চাউর হয়েছে এবং এই সমস্ত অভিযোগে তার সহকারী একান্ত সচিব এবং তার ঘনিষ্ঠ কর্মীদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে রাজনীতিতে তিনি এক ধরনের মৌনব্রত অবলম্বন করছেন এবং সবকিছু থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে যে ফরিদপুর-৩ আসন থেকে তিনি নির্বাচন করছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত।

এরকম আরও অন্তত ৩০ জন রয়েছেন, যারা ইতোমধ্যেই মাঠ ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগগুলো রয়েছে সেই সমস্ত অভিযোগগুলোর কারণে তারা আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না বলে বার্তা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতজন নতুন প্রার্থীকে সামনে আনবে সেটি চূড়ান্ত হবে আরও পরে।


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের কৌশল কি আত্মঘাতী

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন। শেষদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমরের ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা। কারাগার থেকে বেরিয়েই এ বিএনপি নেতা যেভাবে ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন, তা বিস্ময়কর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত, রওশন এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, রেকর্ড পরিমাণ স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগে চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়া ইত্যাদি সবই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী কৌশল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে চায়। ভোট উৎসব করতে চায়। সেজন্যই এতসব আয়োজন। বিএনপি এবং তার মিত্রদের বাদ দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার রাজনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত কি আওয়ামী লীগ সফল হবে? নাকি এ কৌশল তাদের জন্য হবে বুমেরাং? এ কৌশলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?

বিএনপি-জামায়াত অংশ না নিলেও এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল। দল এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী হয়েছে ২ হাজার ৭৪১ জন। প্রায় ৮০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীই ৪০০-এর ওপর। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হচ্ছে না। ওই নির্বাচনে বিনা ভোটে এমপি হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব, নাশকতার কারণে শেষ পর্যন্ত জনগণ এবং বহির্বিশ্ব এ নির্বাচন মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নেয়। ওই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে। এবার দেশি-বিদেশি সবাই ২০১৪-এর মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য ক্ষমতাসীনদের সতর্ক করেছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতিও নোনয়নপ্রত্যাশীদের গণভবনে ডেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিনা ভোটে এমপি হওয়া যাবে না। প্রত্যেক আসনে ‘ডামি প্রার্থী’ দেওয়ার কৌশলের কথাও তিনি দলের নেতাকর্মীদের জানিয়েছিলেন। ব্যস, আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সবাই এটাকে সবুজ সংকেত হিসেবে মনে করেন। দলীয় মনোনয়ন যারা পাননি তারা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়াটাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বাম্পার ফলন হয়েছে এই নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও বুঝতে পেরেছেন এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিস্ফোরণ দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরপর থেকে বারবার বলছেন, যথেচ্ছভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া যাবে না। দল ঠিক করে দেবে কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে। দলের সিদ্ধান্ত না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সারা দেশে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ রীতিমতো ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ‘এ’ টিম আর আওয়ামী লীগ ‘বি’ টিমের লড়াই। কোথাও কোথাও ‘সি’ টিম, ‘ডি’ টিমও আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যে যদি ক্ষমতাসীনরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে না পারে, তাহলে সমূহ বিপদ। এর ফলে বহু আসনে নৌকা প্রার্থীর বদলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করতেই পারে যেই জিতুক, এমপি তো শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের। কিন্তু এর সুদূর প্রসারী তাৎপর্য হবে ভয়াবহ। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাতেই আওয়ামী লীগ হয়ে পড়বে বিভক্ত। একপক্ষ অন্যপক্ষের সঙ্গে মারামারি, খুনোখুনি করবে। একে অন্যের চরিত্র হনন করবে। সারা দেশে সংগঠনে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমপি হবেন, তখন তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো হবে কঠিন। কেউ মন্ত্রী হতে চাইবেন, কেউ বিক্রি হবেন। কেনাবেচার বাজারে তারা আওয়ামী লীগের ওপরই যে চাপ সৃষ্টি করবেন না, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে?

এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটগত ঐক্য নিয়ে এখন পর্যন্ত একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। একমাত্র হাসানুল হক ইনু ছাড়া ১৪ দলের আর কোনো নেতার আসন সংরক্ষিত নয়। ২০০৮-এর নির্বাচন থেকে গত তিনটি নির্বাচনী আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে করেছে। মহাজোট এবং ১৪ দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অংশ। জাতীয় পার্টি ছাড়া মহাজোটের শরিক অন্য সব দলই নৌকা প্রতীকে গত তিনটি নির্বাচন করেছে। এবার কী হবে? যদিও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৪ দলের শরিকদের জন্য তারা আসন ছেড়ে দেবে। মনোনয়ন প্রত্যাহার পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে কটি আসন দেবে, তা কি ১৪ দলের শরিকরা মানবে? এ নিয়ে মনোমালিন্য, মান-অভিমান, তিক্ততার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কথাই ধরা যাক। দলটির প্রধান নেতা রাশেদ খান মেননের আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে দলের জনপ্রিয় নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমকে। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই মেননকে বরিশালের একটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তাব দেবে। ওই আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছেন। আছেন বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করবেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন দলীয় সিদ্ধান্ত মানবে? আওয়ামী লীগের স্থানীয় সংগঠন কি মেননের জন্য কাজ করবে, না বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য কাজ করবে? রাজশাহীতে ওয়ার্কার্স পার্টির আরেক নেতা ফজলে হোসেন বাদশার আসনেও হবে একই নাটক। এ লেজে-গোবরে অবস্থায় যদি আওয়ামী লীগের শরিকরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে আমি অবাক হব না। সেটা হবে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার আরেক সংকট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতারা ভালো করেই জানেন ভোটের বাজারে তারা মূল্যহীন। আওয়ামী লীগের প্রতীক এবং কর্মী-সমর্থকরাই তাদের ভরসা। সেই ভরসাতেও অপমান, উপেক্ষা সহ্য করে তারা অনেকটাই চাকরবাকরের মতো জোটে আছেন। কিন্তু এবার সত্যি তাদের একটা অপমানজনক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বড় উদারতা না দেখালে জোট নিয়ে এক অস্বস্তিতে পড়বে আওয়ামী লীগ। আলাদা আলাদা নির্বাচনের যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা তাকে বন্ধুহীন করতে পারে।

জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের আচরণ, কথাবার্তা সবই ছিল সন্দেহজনক। গত দুই বছর ধরেই তিনি কখনো বিএনপির চেয়ে বড় বিরোধী দল, কখনো সুশীলদের চেয়েও বড় বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতেন। এ কারণেই সরকার ‘রওশন এরশাদ’কে একান্ত আপনজন করে রাখত। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কালক্ষেপণ করছিলেন, তখন রওশন এরশাদই ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জি এম কাদেরকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন। নির্বাচনমুখী নেতাদের সামলাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এতে নিশ্চয়ই সরকার খুশি হয়েছে। জি এম কাদেরের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া এবং সমঝোতার কারণেই রওশন এরশাদ জাপায় মাইনাস হয়ে গেলেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু জি এম কাদেরের প্রতি আওয়ামী লীগের আস্থা কি ঝুঁকিপূর্ণ নয়? জি এম কাদেরকে আস্থায় আনতে যেভাবে রওশন এরশাদকে টিস্যু পেপার বানানো হলো, তার ফল খারাপও হতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কী করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ ভুলে যায়নি। ওই নির্বাচনে রওশন এরশাদই শেষ রক্ষা করেছিলেন। এবার জি এম কাদের যে এরশাদের পথে হাঁটবেন না, তা কে বলবে। সেরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হলে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী মাঠে কে ধরে রাখবে? জাতীয় পার্টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল কি ঝুঁকিপূর্ণ হলো না?

এবার নির্বাচনের আগে দুটি ‘কিংস পার্টি’ বেশ সরব হয়েছিল। একটি তৃণমূল বিএনপি, অন্যটি বিএনএম। দুটি দলেরই প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি থেকে লোক ভাঙানো। দুটি দলই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো দলই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। বিএনপি থেকেও বড় কোনো নেতা এসব দলে যোগ দেননি। এখন এই দুটি দল আওয়ামী লীগের দায়ে পরিণত হয়েছে। এরা ভোটে নয়, সমঝোতায় এমপি হতে চায়। সরকার তাদের ভোটে জিতিয়ে সংসদে আনবে এমন প্রত্যাশায় এরা নির্বাচনে এসেছে। এসব দলের যে সাংগঠনিক অবস্থা এবং প্রার্থীদের যোগ্যতা তাতে দুয়েকজন ছাড়া আর কেউ ভোটের মাঠে জামানত রাখতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ। এদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে সরকারকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করাটা কতটা জরুরি। ছোটখাটো অনিয়মও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করবে। গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। কাজেই এত বড় ঝুঁকি সরকার বা আওয়ামী লীগ কি নেবে? আবার ভালো নির্বাচনে এরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে, আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করবে।

আওয়ামী লীগ কেন শাহজাহান ওমরকে দলে ভেড়াল? এ থেকে আওয়ামী লীগ কী পেল? আদর্শহীন ব্যক্তিকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতাসীনরা কি প্রমাণ করল না, তারাও ভাঙাগড়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের এরকম প্রক্রিয়ার যুক্ত হওয়া কি শোভন। এই কৌশলে কি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হলো না?

নির্বাচন প্রসঙ্গ এলেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে। সব দল অংশগ্রহণ করার পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ওই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রধান কারণ ছিল প্রার্থী এবং প্রশাসনের যোগসাজশ। অতি উৎসাহীদের দায়িত্বহীন কাণ্ড। এবার নির্বাচন অনেকটাই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ লড়াই। বিরোধীরা এ নির্বাচনে তৃতীয়পক্ষ। তাই এ নির্বাচনে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ থাকার বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাউকে জেতাতে বা হারানোর দায় নেই কারও। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র, যারা প্রার্থী তারা সবাই প্রভাবশালী। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রার্থীরা নানাভাবে ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতার শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা কি শেষ পর্যন্ত জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করবে, না জয়ী হতে সব অপকৌশল প্রয়োগ করবে?

আগামী কয়েকটা দিন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তপশিল ঘোষিত হয়েছে, মনোনয়নপত্র দাখিলও হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন এখনো অনেক দূরের পথ। এ পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে, তা সামাল দিতে পারবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল কি পারবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ঠিকানায় দেশকে নিয়ে যেতে?


লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


আওয়ামী লীগ   শেখ হাসিনা   নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

নানক-নাছিম বনাম ফেরদৌস-সাকিব

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ০১ ডিসেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে গত ২৬ নভেম্বর। এবারের নির্বাচন বড়ই অদ্ভুত নির্বাচন। এই নির্বাচনে একটিই ফলাফল হতে পারে। সেটি হলো আওয়ামী লীগের বিজয়। বিএনপি এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ যেসব রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের একটাই লক্ষ্য, ‘বিরোধী দল’ হওয়া। তবে এই নির্বাচন টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জের। পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন। আওয়ামী লীগকে যেমন একদিকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে, তেমনি নির্বাচন যেন ‘অংশগ্রহণমূলক’ হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যদি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ না হয়, তাহলে এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে। এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য আরেক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এবারের ভোট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য আবর্জনা পরিষ্কারের এক সুবর্ণ সুযোগ। যেহেতু নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বি নেই, তাই আওয়ামী লীগ পরিচ্ছন্ন, দলের জন্য নিবেদিত প্রাণদের প্রার্থী করার এক বিরল সুযোগ পেয়েছিল। মনোনয়নের আগে এরকম একটি সুস্পষ্ট বার্তাও ছিলো।

২৬ নভেম্বর আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা দেখে আমি একদিকে উচ্ছসিত, অন্যদিকে আতঙ্কিত। আমি উচ্ছ্বসিত একারণে যে মাঠের নেতাদের, কর্মীবান্ধব সংগঠকদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, বাহাউদ্দিন নাছিম, এস.এম কামাল। এরা এবার মনোনয়ন পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কর্মীদের জন্য এটি একটি বিরাট বিজয়। এর ফলে কর্মীরা উচ্ছ্বসিত, উজ্জীবিত। গত পাঁচ বছর যারা সংগঠনকে আগলে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে এরা অন্যতম। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ নানা রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে সবচেয়ে আতঙ্কের রোগ হলো অনুপ্রবেশকারী, চাটুকার, সুবিধাবাদীদের দৌরাত্ম। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অর্বাচীন নেতাদের কারণে কর্মীরা হতাশ এবং বিরক্ত। ত্যাগী পরীক্ষিতদের একটা বড় অংশ নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল সর্বত্রই অনুপ্রবেশকারীদের দাপট রীতিমতো মহামারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এরকম বাস্তবতায় সংগঠনের জন্য নিবেদিত প্রাণ, দুঃসময়ের যোদ্ধারা যদি নির্বাচন থেকেও দূরে থাকতেন, তাহলে এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটি গভীর সংকটে পড়ত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতি মনোনয়ন প্রদানে মাঠের নেতা, দুঃসময়ে কান্ডারী, ত্যাগী পরীক্ষিতদের মূল্যায়ন করেছেন। জনপ্রিয় নেতা মির্জা আজম ছয়বারের এমপি। এবারও তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। মনোনয়ন পেয়েছেন কঠিন সময়ে দলের জন্য কাজ করা আলাউদ্দিন নাসিম চৌধুরীসহ বেশ ক’জন। এই মনোনয়ন প্রাপ্তরা সংগঠন গোছাতেই শুধু অবদান রাখবেন না, কর্মীদের ভোটের মাঠে নামাতেও উৎসাহ যোগাবেন। এই সব মাঠের কর্মীবান্ধবদের প্রার্থী হবার কারণে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়বে, ভোট খরা কাটবে। 

নানক-নাছিমের মনোনয়ন আমাকে আরেকটি কারণে আশাবাদী করেছে। রাজনীতিতে আদর্শে অবিচল থাকলে লক্ষ্য অর্জন যে করা যায়, এরা সেই সত্যটিকে নতুন করে প্রমাণ করলেন। ২০১৮ সালে নির্বাচনে এরা মনোনয়ন বঞ্চিত হন। নিশ্চয়ই একারণে তারা দুঃখিত হয়েছিলেন, বেদনার্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এই বঞ্চনা তাদের আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। তারা হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেননি। রাজনীতি থেকে সরে যাননি। কিংবা অনেকের মতো ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হয়ে নিজেদের লোভের উদগ্র প্রকাশ ঘটাননি। বেদনাকে চাপা দিয়ে রাজনীতিতে আরো নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেছেন নানক, নাছিম, রহমান, কামাল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যখন ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতির আগ্রাসন তখন তারা সংগঠনে মনোযোগী হয়েছেন। হতাশ কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দলের সভাপতির দেয়া দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে নেতার অভাব হয় না। বিচিত্র সব নেতাদের নাদুস-নুদুস শরীরে মঞ্চ ভেঙে পড়ে। কাজের নেতা নয়, এরা সব মতলবী নেতা। নানক, নাছিমরা কাজের নেতা। তাই তাদের মনোনয়ন পাওয়ায় আওয়ামী লীগ রক্ষা পেয়েছে। কর্মীরা অন্তত নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগটা পাচ্ছে। এটা টানা ক্ষমতায় থাকা দলের জন্য একটা বড় সুখবর। 

তবে এই মনোনয়ন তালিকায় কয়েকজনের মনোনয়ন প্রাপ্তি আমাকে উদ্বিগ্ন করেছে, আতঙ্কিত করেছে। এদের মধ্যে আলোচিত দুইজন হলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’ সাকিব আল হাসান এবং চিত্রনায়ক ফেরদৌস।

বিশ্বে ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে আসা নতুন ঘটনা নয়। শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক অর্জুনা রনাতুঙ্গা ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয় ছিলো এক অভূতপূর্ব বিস্ময়। এই বিজয় রনাতুঙ্গাকে দিয়েছিল জাতীয় বীরের মর্যাদা। কিন্তু রাজনীতিতে সুবিধা করতে পারেননি তুখোড় এই অধিনায়ক। সেদিক থেকে ব্যতিক্রম ইমরান খান। ইমরান খান প্রায় একাই পাকিস্তানকে ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন ১৯৯২ সালে। তার নেতৃত্ব গুণ সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল। তিনিও হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানিদের ‘জাতীয় বীর।’ ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ইমরান খান সমাজ সেবায় মন দেন। ক্যান্সারে মারা যাওয়া মায়ের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তিনি গড়ে তোলেন বিশ্বের অন্যতম আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল। পাকিস্তানের মানুষের হৃদয়ে জয় করেন ইমরান; স্পষ্ট কথাবার্তা বলে, সততার নজির স্থাপন করে। তিনি মুসলীম লীগ কিংবা পিপলস পার্টিতে যোগ দিতে পারতেন। এরকম প্রলোভনও ছিলো। কিন্তু প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে নিজেই একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। ইমরান খানের নেতৃত্বে তেহরিক-ই-ইসলাম ধীরে ধীরে বিকশিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ইমরান হন প্রধানমন্ত্রী। ২০২২ সালে নানা ষড়যন্ত্রে ক্ষমতাচ্যুত হন। কিন্তু এখনও পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান জনপ্রিয় নাম। আমাদের সাকিব আল হাসান অবশ্য অর্জুনা রনাতুঙ্গা কিংবা ইমরান খানের ধারে কাছেও নন। বিশ্বকাপ জয় তো দূরের কথা, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তিনি কোন অন্ধকার টানেলে নিয়ে গেছেন তা নিয়ে দিব্যি বিতর্ক হতে পারে। সাকিব মেধাবী ক্রিকেটার কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ যাবৎ কালের সেরা খেলোয়াড়, এনিয়েও বিতর্ক নেই। কিন্তু দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি বারবার বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। কখনো দর্শকদের সাথে অশোভন আচরণ করে, মারমুখী হয়ে। এখনও খুঁজলে আম্পায়ারের দিকে তার তেড়ে-ফুড়ে আসার ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাবে। বুকির সাথে যোগাযোগ, তামিমের সাথে বিরোধ, অখেলোয়াড় সুলভ আচরণ নিয়ে সব সময় আলোচনায় সাকিব আল হাসান। এবার বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভরাডুবির নেপথ্যে সাকিবের রাজনীতি দায়ী-এমনটা বিশ্বাস করেন দেশের বেশীরভাগ ক্রিকেট ভক্ত। বিশ্বকাপের পর তার শাস্তি পাওয়ার কথা, তিনি পেলেন পুরস্কার। গত দুবছর ক্রিকেটের চেয়ে তার মনোযোগ ছিলো ব্যবসা-বাণিজ্যে, টাকা পয়সা উপার্জনে। ক্রিকেট নিয়ন্ত্রকদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে তিনি যা খুশী তাই করেছেন, বাধাহীনভাবে। দেশের জন্য, জনগণের জন্য একটি মহৎ কাজের উদাহরণ নেই এই ক্রিকেটারের জীবনে। তাকে কেন মনোনয়ন দিতে হবে? ক্রিকেটের জন্য সাকিব প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ মানলাম, কিন্তু রাজনীতির জন্য, দেশের জন্য তিনি আদৌ কি প্রয়োজনীয়? এই নির্বাচনে যদি বিএনপি আসতো, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের শঙ্কা থাকতো তাহলে সাকিবের মনোনয়ন প্রাপ্তির একটি যৌক্তির কারণ হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত। তাকে এমন একটি আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে, যে আসনটির বর্তমান এমপি একজন ত্যাগী পরীক্ষিত কর্মী। যার গোটা পরিবারের ত্যাগ এবং আদর্শের লড়াই আওয়ামী লীগের জন্য অনুকরণীয়। ৭৫ এর পর যারা আওয়ামী লীগকে ধ্বংসস্তুপ থেকে টেনে তোলার জন্য কঠোর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন, সাইফুজ্জামান শিখর সেই পরিবারের উত্তরাধিকার। এক-এগারোর সময় শিখরের নিষ্ঠা, দলের নেতার প্রতি আনুগত্য আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। কঠিন সময়ে সাকিব আল হাসান কি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন? ত্যাগীরা শুধু ত্যাগ স্বীকার করবেন, সুবিধাবাদীরা ক্রীম খাবেন?

বাংলাদেশের ক্রিকেটে যেমন এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার চেয়ে ঘোর অমানিশা সিনেমায়। শাকিব খান আর নতুন কয়েকজন সৃষ্টিশীল নির্মাতার পাগলামীতে আমাদের সিনেমা এখন কোন মতে শ্বাস নিতে পারছে। সিনেমার অধিকাংশ তারকাদের কাজ নেই। তাই তারা নানা কাজে ব্যস্ত। রাজনীতিতে নগদ নারায়ণের সৌভাগ্য ভান্ডার আছে, সেজন্য পরিত্যক্ত তারকাদের একটি বড় অংশকে এখন ক্ষমতাসীন দলের চারপাশে ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। গত ১৫ বছরে শোবিজে যতজন আওয়ামী লীগ হয়েছেন, দেশে ততগুলো ব্রিজ হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ। অথচ এই সব শোবিজের সুবিধাবাদীরা দুঃসময়ে কি করে তা নিজেই দেখেছি। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হন বিচারপতি লতিফুর রহমান। এই সময় বিএনপি তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য নির্মাণ করে ‘সাবাশ বাংলাদেশ’ নামে একটি ধারাবাহিক প্রামাণ্য চিত্র। অধ্যাপক ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন উপস্থাপক আর মাহি.বি.চৌধুরী নির্মাতা। এটিএন বাংলায় প্রচারের সাথে সাথে এনিয়ে হৈ চৈ পরে যায়। আওয়ামী লীগের কাছে ছিলো এটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। পাল্টা একটা প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়। দায়িত্ব পরে আমার উপর। প্রতিদিন একটি করে মোট ২১টি প্রামাণ্য চিত্র বানিয়েছিলাম ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ শিরোনামে। ঐ অনুষ্ঠানের জন্য একজন উপস্থাপক খুঁজতে আমরা শোবিজের তারকাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছিলাম। তাদের বলেছিলাম আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার দরকার নেই, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলুন। শমী কায়সার ছাড়া সবাই আমাদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, আমরা শিল্পী। এসব বিতর্কে জড়াতে চাই না। এখন দেখি তারাই মস্ত বড় আওয়ামী লীগার। সারাজীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করা শমী কায়সার অবশ্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। মনোনয়ন পেয়েছেন, সুসময়ে স্তুতি গানে চ্যাম্পিয়ন ‘অবসর প্রাপ্ত’ শিল্পী ফেরদৌস। হঠাৎ বৃষ্টির জন্য আলোচিত এবং জনপ্রিয় হন শিল্পী। এরপর তিনি বাংলা চলচিত্রের জন্য কি করেছেন, তা ফেরদৌসই ভালো বলতে পারবেন। তবে, টানা ১৫ বছর তিনি বিরামহীনভাবে চাটুকারিতার কসরত করেছেন। তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ধানমন্ডিতে। আমি যদ্দুর জানি, ফেরদৌস ধানমন্ডিতে থাকেন না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত এই আসনে একজন বহিরাগতকে মনোনয়ন দেয়ার তাৎপর্য আমি বুঝতে পারিনি। ধানমন্ডিতে কোন যোগ্য লোক নেই? সাকিব আল হাসানকে নিয়ে একটা উন্মাদনা আছে। তার একটা ভক্তকূল আছে। কিন্তু ফেরদৌসের বসন্তকাল চলে গেছে বহু আগে। ফেরদৌসকে নিয়ে ধানমন্ডির আসনে কোন উচ্ছ্বাস নেই, তা আমি হলফ করে বলতে পারি। এই সাবেক নায়ক ধানমন্ডির কয়টা রাস্তার নাম বলতে পারবেন? আওয়ামী লীগের ক’জন কর্মীকে চেনেন? ধানমন্ডি সম্পর্কে তিনি কি জানেন? এই নির্বাচনে এরকম ‘অতিথি পাখি’দের পৃষ্টপোষকতা দিয়ে আওয়ামী লীগ কি বার্তা দিলো? আদর্শ চুলায় যাক, একটু চেষ্টা তদ্বির করলেই আওয়ামী লীগের মতো দলের মনোনয়ন পাওয়া কোন ব্যাপারই না। কিন্তু তারপরও আমি আশাবাদী। ত্যাগী পরীক্ষিত আদর্শবানদের কাছে সব সময়ই পরাজিত হয় সুবিধাবাদী চাটুকাররা। শেষ পর্যন্ত নানক-আযম-নাছিমরাই দুঃসময়ে আওয়ামী লীগের জন্য লড়বে। বসন্তের কোকিলরা উড়ে যাবে কঠিন সময়ে। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মান্না কেন বড়শিতে বিঁধলেন না

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

প্রায় দু সপ্তাহ নীরব থাকার পর মাহমুদুর রহমান মান্না আবার সরব হয়েছেন। আবার রাস্তায় এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত দু সপ্তাহ তিনি কোথায় ছিলেন? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, এ সময় মান্না সরকারের সাথে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দেন দরবার করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেন দরবারের রফা হয়নি। সেই কারণেই মান্না এখন আবার সরব হয়েছেন। আবার বিরোধী দলের লড়াকু সৈনিক হিসেবে মাঠে নেমেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না যা চেয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। 

তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, একদিকে যেমন মান্না সরকারের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন, অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়ার সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। তারেক জিয়ার যে টোপ সেটি বেশি মাত্রায় লোভনীয় হওয়ার কারণে তিনি সরকারের টোপ গেলেননি। আর এ কারণেই মাহমুদুর রহমান মান্না আবার আগের অবস্থানে ফিরে গেছেন। 

২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডব, নাশকতার পর বিএনপি ব্যাকফুটে চলে যায় এবং এই ব্যাকফুটে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির কোনো কোনো নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলে সামনে চলে আসেন মাহমুদুর রহমান মান্না। মাহমুদুর রহমান মান্না নিজে থেকেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চান এমনটাই বলেছিলেন। এরপর সরকারের সঙ্গে তার কয়েক দফা বৈঠক হয়, যেসব বৈঠকে মান্না নির্বাচনকালীন সরকারে তার মন্ত্রিত্ব, বগুড়ার একটি আসনে তার নিশ্চিত বিজয় সহ আরও বেশ কিছু দাবিদাওয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার থেকে তাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় যে, নির্বাচনকালীন সরকারে অনির্বাচিত কোন মন্ত্রীদের রাখার সুযোগ নেই। 

দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে বগুড়া আসন থেকে তিনি জিতবেন কি জিতবেন না এটি সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে ভোটারদের অভিপ্রায়ের ওপর। ভোটাররা যদি ভোট না দেন তাহলে সরকার কাউকে জিতিয়ে আনতে পারে না। অন্যদিকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে হাতছাড়া করতে চাননি লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। আর এ কারণেই মান্না যেন শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে থাকেন এই জন্য তাকে লোভনীয় অফার দেওয়া হয় এবং ভবিষ্যতে তার জন্য অনেকগুলো সুখবর আছে এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়। সবকিছু হিসাব নিকাশ মিলিয়ে মান্না শেষ পর্যন্ত তারেক জিয়ার বড়শিতে বিদ্ধ হচ্ছেন এমন কথা রয়েছে। 

মান্না অবশ্য সরকারের বড়শিতে বিদ্ধ না হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল যে তিনি যেভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বা বিএনপি নির্বাচনে আসবেন বলে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দেখা এবং নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার নীতিতে বিশ্বাসী। দলছুট হয়ে কেউই ঝুঁকি নিতে চাননি এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত হতে চাননি। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা দেখেছেন, যারা বিএনপি ছেড়ে চলে গেছেন তারাই রাজনীতিতে এতিম এবং পরিত্যক্ত হয়েছে। এ কারণেই বিএনপির মধ্যে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী, তারাও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পাননি। আর এ কারণেই শেষ পর্যন্ত মান্নার মিশনও ব্যর্থ হয়েছে। মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি আবার বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু মান্নারা সব সময় সুযোগসন্ধানী। সুযোগের রাজনীতি তাদের কাছে শুধু মাত্র কিছু পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যখন তার পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলেনি, তখন তিনি আর সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাননি। নিশ্চয়ই সরকারের কাছ থেকে তিনি যা পেতেন তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে।

মাহমুদুর রহমান মান্না  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচনের মাঠে ‘কোরবানির হাট’

প্রকাশ: ০৯:৫৪ এএম, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’

সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।

বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।

এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


কল্যাণ পার্টি   নির্বাচন   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতিকে দূষণমুক্ত করার এখনই সময়

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনামুক্ত এবং দূষণমুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

৭৫ এর আগস্ট ট্রাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুটি ধারায় বিভক্ত করেছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ধারা, অন্যটি স্বাধীনতাবিরোধী ধারা। পৃথিবীর কোন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে বিভক্ত থাকে না। একটি দেশের অস্তিত্ব, অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের আদর্শগত বিরোধ আছে, থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে তারা একমত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিক যারাই ক্ষমতায় থাকুক, দেশটির ইসরায়েল নীতির পরিবর্তন হয় না। ভারতে কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে মতপার্থক্য অনেক। কিন্তু, কানাডা প্রশ্নে তারা অভিন্ন। কাশ্মীর ইস্যুতেও তাদের মৌলিক বিরোধ নেই। বিজেপি-কংগ্রেস উভয় দলই পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি ভয়ংকরভাবে বিভক্ত। এই দেশের রাজনীতি এমন যে, একটি বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে অস্বীকার করে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টকে উৎসবের দিন বানিয়ে কুৎসিত উৎসব করে। এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দুইভাবে ব্যাখ্যা করে। ৭১-এ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, সেই রাজাকার, আল-বদর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করে একটি দল। স্বাধীনতাবিরোধী ধারাকে বিকশিত করাই যেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য। মৌলিক প্রশ্নে এই বিভক্তি রাজনীতিকে যেমন জটিল করেছে, তেমনি দেশকেও করেছে বিভক্ত। 

বাংলাদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে। আদর্শের পার্থক্য থাকবে, মতভেদ থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে সবাই থাকবে একমত। জাতির পিতাকে নিয়ে কেউ বিতর্ক করবে না। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নেবে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। এই মৌলিক প্রশ্নে একমত থেকে নানা মত ও পথের রাজনীতি দেশের গণতন্ত্রকে বিকশিত করবে। এটাই আমাদের ঐক্যের সূত্র। কিন্তু ৭৫ এর পর জিয়ার বিভাজনের রাজনীতি, স্বাধীনতাবিরোধীদের কেবল পুনর্বাসিত করেনি, শক্তিশালীও করেছে। এই ধারার মূল দল বিএনপি। 

বিএনপি নামের সংগঠনটি যতদিন থাকবে, ততদিন ‘বাংলাদেশ’ এক হতে পারবে না। দেশের মৌলিক প্রশ্নে ঐক্যমত ছাড়া একটি জাতি কখনো তার অভীষ্ট অর্জন করতে পারে না। ২০০৮ এর নির্বাচনে এদেশের জনগণ ঐক্যের পক্ষে রায় দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিল। ঐ নির্বাচনের পর থেকে আস্তে আস্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে হাটছে বাংলাদেশ। বিভাজনের দেয়াল উপড়ে ফেলছে জনগণ। যুদ্ধপরাধীদের বিচার হয়েছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে এখন আর কেক কেটে ভুয়া জন্মদিন পালনের বিভৎস উৎসব হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বিএনপি’ নামের বিষফোঁড়া যতদিন থাকবে ততদিন ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারবো না। গত ১৫ বছর ভুল রাজনীতির চোরাগলিতে গিয়ে বিএনপি এখন মুমূর্ষু। ২৮ অক্টোবর আত্মঘাতি আন্দোলন দলটিকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। এখন অবরোধ-হরতালের মতো গণবিরোধী কর্মসূচির কারণে বিএনপি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। কিছু অবুঝ বিভ্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের কারণে দলটি এখন লাইফ সাপোর্টে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে গেছে। নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেরাই পড়েছে। বিএনপি ভেবেছিল, তারা নির্বাচন না করলেই বোধ হয় একতরফা নির্বাচন হবে। ২০১৪’র নির্বাচনের মতো ঘটনা ঘটবে। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। বিএনপিকে ছাড়াই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, যুক্তফ্রন্টসহ নানা দল এখন নির্বাচনী মাঠে। শরিকরাও এখন বিএনপিকে গুড বাই জানিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এর ফলে দেশের রাজনীতির বিষাক্ত ধারাকে উপড়ে ফেলার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিভক্তির দেয়াল ভেঙে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এবার এখন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের মধ্যে চমৎকার একটি মিল লক্ষণীয়। সবাই অন্তত মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে। বিএনপি এই নির্বাচনে না আসায় বাংলাদেশের একটা বড় লাভ হলো। এর ফলে মূলধারা থেকে ছিটকে গেল বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা পাপমুক্ত হলো। এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির ধারা। দেশের মৌলিক প্রশ্নে অভিন্ন মতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এদেশকে নিয়ে যাবে নতুন উচ্চতায়। 

তবে, রাজনীতি কুলুষমুক্ত হবে তখনই, যখন আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সুন্দর হওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। এই নির্বাচনও যদি ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে তা হবে এদেশের রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে আবার স্বাধীনতাবিরোধী ধারা শক্তিশালী হবে। পুনর্জন্ম হবে বিএনপির। রাজনীতির শেষ আশার প্রদীপ টুকুও নিভে যাবে। জয়-পরাজয়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর হওয়া জরুরী। একটি ভালো নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তির শেকড় উপড়ে ফেলতে পারে। বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে পারে। 

আরেকটি ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ অক্টোবরের পর মুখ থুবড়ে পড়ে বিএনপির রাজনীতি। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যাবে। এখন সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী উত্তেজনা। এবারের নির্বাচনে শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি আবহ সৃষ্টি হয়েছে। নৌকার পক্ষে একটি জোয়ার উঠেছে। যে সব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তারা সবাই দ্বিতীয় হতে চায়। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সবাই প্রধান বিরোধীদল হতে চায়। আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে, এমনটি স্বপ্নেও ভাবে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তাই রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে। ৭৫ এর পর রাজনীতিতে যে দূষণ তাতে আক্রান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগও। অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য ভোটে জয়ী হতে আওয়ামী লীগকে অনেক আপোষ করতে হয়েছে। আদর্শের বাইরে লোকজনকে মনোনয়ন দিতে হয়েছে। দূর্বৃত্ত, লুটেরারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে হয়েছেন মন্ত্রী, এমপি। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের ভেতর বানের পানির মতো প্রবেশ করেছে হাইব্রিড, চাটুকার, মতলববাজরা। ভাড়াটে রাজনীতিবিদদের অত্যাচারে আওয়ামী লীগ অতিষ্ঠ। গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়নের পরও আওয়ামী লীগের যা বদনাম তা এসব ব্যাংক লুটেরা, অর্থপাচারকারী দূর্বৃত্তদের কারণেই। গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা সত্যিকারের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের সামনে টেনে আনার চেষ্টা করেছেন। এদেরকে বিভিন্ন উপনির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এবারের মনোনয়নে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি মহেন্দ্রক্ষণ। আওয়ামী লীগ যদি এসব অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন না দেয় তাহলে দেশ বাঁচবে, রাজনীতি রক্ষা পাবে। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়। আওয়ামী লীগ কি পারবে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন