আওয়ামী লীগ আগামী কাউন্সিল অধিবেশনের
দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে। ২৪ ডিসেম্বর দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম এ রাজনৈতিক দলটির
কাউন্সিল হবে। আওয়ামী লীগের এবারের কাউন্সিল নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের
যে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলনের দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হয়, সেই বৈঠকে দলটির
সভানেত্রী কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এবারের কাউন্সিল হবে অনাড়ম্বর।
এক দিনের। জাঁকজমকবর্জিত। প্রায় ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলটির কাউন্সিল
হওয়ার কথা ব্যাপক ঘটা করে। উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু তা না করে কেন এরকম সীমিত আয়োজনের
নির্দেশনা? এর কারণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশে ক্রমে ঘনীভূত হওয়া অর্থনৈতিক সংকট।
বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ আগামী বছর সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা ঘোষণা করেছে। বলা হচ্ছে,
২০২৩ হবে দুর্ভিক্ষের বছর। ২০২০ সাল থেকেই বিশ্ব নানা সংকটে টালমাটাল। করোনা গোটা বিশ্বকে
গভীর অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে। করোনার সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেন
যুদ্ধ। প্রায় নয় মাস ধরে চলছে এ যুদ্ধ। এ যুদ্ধ ইউরোপকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে। এ
যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ছে। আমাদের অর্থনীতির শক্তি এবং সামর্থ্যরে জায়গাগুলো
ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। প্রবাসী আয়ে কোনো সুখবর নেই। আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী
আয় এসেছে অক্টোবরে। রপ্তানি আয়েও সুখবর নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে।
বিদ্যুৎ সংকট, গ্যাস সংকট শিল্পোৎপাদনকে গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে নিয়ে গেছে। একমাত্র
কৃষি ছাড়া কোথাও কোনো সুখবর নেই। বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। পাচার
হওয়া অর্থ ফেরত আনার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। চিহ্নিত অর্থ পাচারকারী, লুণ্ঠনকারীরা
বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেউ নেই। এত সংকটের মধ্যেও
দুর্নীতি কমেনি। আমলাতন্ত্রের বাড়াবাড়ি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা সংকটের কথা বলছেন। দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। বুধবার নবীন সরকারি কর্মকর্তাদের
এক অনুষ্ঠানে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিলেন প্রধানমন্ত্রী। অনুরোধ
করলেন কৃচ্ছ্রসাধনের। আহ্বান জানালেন এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না রাখার। খাদ্য উৎপাদন
বৃদ্ধির ওপর জোর দিলেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সংযম ও ব্যয় সংকোচের কথা বলছেন, তখন দুই
আমলা শিরোমণির জন্য বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর অনৈতিক ও কুৎসিত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন চলছে।
সেই প্রাসাদে সুইমিংপুলও থাকবে! দেশ যখন সংকটের উত্তাপে বিপন্ন তখন শিরোমণি আমলারা
একটু সাঁতার বিনোদন করবেন না, তা কী করে হয়। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে ওঠা আমলারা যখন
নানা সুযোগ-সুবিধার থালা চেটেপুটে খাচ্ছেন, তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগ কেবল বিএনপির সমালোচনার ভাঙা রেকর্ড অবিরত বাজিয়ে চলেছে। কিছু মন্ত্রী এবং
নেতার বক্তব্য এখন গণবিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী
লীগে নানা জানা-অজানা রোগ বাসা বেঁধেছে। কিছু কিছু রোগ দুরারোগ্য ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে।
অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদী হাইব্রিডরা যেন এখন আওয়ামী লীগকেই গ্রাস করে ফেলছে। দীর্ঘদিন
ক্ষমতায় থাকা দলটির কিছু ব্যক্তি যেন ভিনগ্রহ থেকে আসা এলিয়েন। এদের গাল সামান্য রোদে
মাখনের মতো গলতে থাকে। তৃণমূলের বেশির ভাগ ত্যাগী-পরীক্ষিত কোণঠাসা। তাদের চোখে মুখে
উদ্বেগের ছাপ। দলে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই। কোন্দল, হানাহানি প্রায় সর্বত্র। টাকার
বিনিময়ে পদ বিক্রি হচ্ছে। পদবাণিজ্য, কমিটি-বাণিজ্য আওয়ামী লীগে মহামারির আকার ধারণ
করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলা পরিষদ সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ!
এমপিদের অর্ধেকেরই এলাকার সঙ্গে সংশ্রব নেই। সারা দিন ব্যস্ত থাকেন নানা তদবিরে। চাকরি-বাণিজ্য,
ত্রাণ নয়ছয়, কমিশন-বাণিজ্য এসব নিয়েই ব্যস্ত আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধেক সংসদ সদস্য।
এরা যেন মনে করছেন, এবারই শেষ সুযোগ। যা বানানোর বানিয়ে নিই। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই
বলেন, আগামী নির্বাচনে প্রায় অর্ধেক আসনে মনোনয়ন পরিবর্তন সময়ের দাবি। দলের কয়েকজন
নেতা নিজেদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব এড়াতে বিএনপিবিরোধী চটুল বক্তব্য রাখাটাই একমাত্র কাজ
হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের কথার দাপটে মৃতপ্রায় বিএনপিও এখন জেগে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী
যখন সংকটের কথা বলছেন খোলামেলাভাবে, তখন কিছু মন্ত্রী সংকট আড়ালের লুকোচুরি খেলায় মেতেছেন।
সবকিছু মিলিয়ে দল এবং সরকার কোনোটাই ভালো নেই। ২০০৯ সালে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে দ্বিতীয়বারের
মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এ সময় বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায়
নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু সে উন্নয়নই আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এক বছরের কিছু বেশি সময়
আছে সংসদ নির্বাচনের। এর মধ্যে নানা অস্বস্তি, সমালোচনায় এলোমেলো আওয়ামী লীগ। এ রকম
বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ তার জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত
অত্যন্ত সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৮১-এর ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী
লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় হোটেল ইডেন প্রাঙ্গণে। সেই কাউন্সিলে দল রক্ষার জন্য শেখ
হাসিনাকে নেতা নির্বাচিত করার কোনো বিকল্প ছিল না। সেই থেকে দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে দলের
সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। এ মুহূর্তেও তাঁর কোনো বিকল্প নেই। শেখ
হাসিনা একাই দলের হাল ধরে আছেন। একাই সব ঝড়ঝঞ্ঝা সামলাচ্ছেন। শেখ হাসিনা ছাড়া এ দলটি
মুমূর্ষু। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘একজন কাউন্সিলরও
যদি না চায় তাহলে আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকব না।’ কাউন্সিলর তো দূরের কথা। একজন
কর্মীও শেখ হাসিনার বিকল্পের কথা স্বপ্নেও ভাবেন না। তাই আসন্ন কাউন্সিলে যে দলীয় প্রধান
পদ নিয়ে কোনো আলোচনাই হবে না, তা বলাই বাহুল্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদটি অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। এ পদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আবেগ ও ভালোবাসা জড়িত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান এক যুগ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক থাকা
অবস্থায়ই তিনি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে জনগণের
সংগঠনে পরিণত করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন
রোজ গার্ডেনে গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম
লীগ’ গঠিত হয়েছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি হয়েছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান
ভাসানী। প্রথম সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। কারাগারে থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান
নবগঠিত দলটির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক
অবশ্য সংগঠনের জন্য তেমন কিছু করতে পারেননি। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে
অংশ নিয়ে গ্রেফতার হন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি কারাগার থেকে
মুক্তি পান। মুক্তির পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন শামসুল হক। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী
লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন দলটির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর ঢাকার মুকুল
সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক হন
শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের জাগরণের অধ্যায় শুরু হয়। মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে
সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ছিল। আওয়ামী লীগের প্রতি শুরু থেকেই বাঙালির সমর্থন ও সহমর্মিতা
ছিল। কিন্তু সংগঠন শক্তিশালী করা, জনগণকে সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কাজ শুরু করেছিলেন
বঙ্গবন্ধু। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব যখনই কারাগারের বাইরে থেকেছেন, তখনই সারা দেশ
চষে বেড়িয়েছেন। সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ১৯৫৫ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন
শেখ মুজিব। আওয়ামী লীগের প্রাণ ভোমরায় পরিণত হন তিনি। তরুণ সাহসীদের নেতৃত্বে আওয়ামী
লীগকে এক উজ্জীবিত সংগঠনে পরিণত করেন। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষার
প্রতীক। ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল
অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্য হয়। কাগমারী সম্মেলনের পর মার্চে
মওলানা ভাসানী দলের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান
সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এ কাউন্সিলে ভাসানীর পদত্যাগপত্র গৃহীত
হয়নি। পদত্যাগ করলেও ভাসানীকেই আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে বহাল রাখা হয়। কিন্তু এর কদিন
পরই ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬ জুলাই ভাসানীর উদ্যোগে ঢাকায় গণতান্ত্রিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি
(ন্যাপ) নামে একটি দল আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশকে ভারপ্রাপ্ত
সভাপতি করা হয়। আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে মুজিবের সংগঠন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে
সামরিক শাসন জারি হয়। বন্ধ হয়ে যায় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ১৯৬৪ সালের ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি
সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয় দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভা।
এ সভায় দল পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত হয়। তর্কবাগীশ সভাপতি ও শেখ মুজিব হন সাধারণ
সম্পাদক। এ ধারাবাহিকতায় মার্চের ৬ ও ৭ ঢাকার ইডেন প্রাঙ্গণে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল
অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে তর্কবাগীশ সভাপতি হন। চতুর্থবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন শেখ
মুজিবুর রহমান। এ সময় সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন ‘অসাধারণ’। আওয়ামী লীগের প্রধান
নেতা। বাঙালির স্বপ্নের সারথি। এর পরের ইতিহাস বাঙালির মুক্তির ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর
ছয় দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ’৭০-এর নির্বাচন। শেখ মুজিবই
হয়ে ওঠেন বাঙালির মুক্তির পথপ্রদর্শক। বাংলাদেশের আরেক নাম। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী
লীগের কাউন্সিলে ছয় দফা অনুমোদিত হয়। ওই কাউন্সিলেই আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে কার্যকর
ও অসাধারণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন আরেক ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৬-এর
১৮ মার্চ তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন জনগণের নেতা।
জনজাগরণের কাব্য। তাজউদ্দীন ছিলেন নিভৃত সংগঠক। গোছানো একজন নেতা। একজন জ্ঞানমনস্ক
রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণতা দেওয়াই ছিল তাঁর আরাধ্য। ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট নিখিল
পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। এবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন
আরেক মহিরুহ এ এইচ এম কামারুজ্জামান। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের শেষ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত
হয় ১৯৭০ সালের ৪ জুন। এ কাউন্সিলে দ্বিতীবারের মতো সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ।
আওয়ামী লীগের জন্য এ কাউন্সিল ছিল মহাগুরুত্বপূর্ণ। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত নেতৃত্বই
’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এনে দেন। এনে দেন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের
ম্যান্ডেট। ’৭১-এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার পরিকল্পনার নিখুঁত বাস্তবায়ন
করেন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ।
’৭০-এর ৪ জুনের কাউন্সিল যেমন আওয়ামী
লীগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবারের কাউন্সিলও তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে
আওয়ামী লীগকে দাঁড় করিয়েছে। ’৭০-এর কাউন্সিলে তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত
করে এক ঐতিহাসিক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু কেন সেদিন তাজউদ্দীনকে
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তা বোঝা যায় ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। তাজউদ্দীনকে
সাধারণ সম্পাদক করার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সংগঠনভাবনা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতার আরেকটি প্রমাণ
পাওয়া যায়। আমার বিবেচনায় ওই সময় যদি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অন্য কেউ হতেন তাহলে
প্রবাসী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা অনেক দুরূহ হতো। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশ আওয়ামী
লীগের যাঁরা সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন তাঁরা সবাই ভালো নেতা। সদ্যপ্রয়াত বেগম সাজেদা চৌধুরী,
আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুল জলিল, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। প্রত্যেকেই
জাতীয় নেতা। আওয়ামী লীগের ত্যাগী সংগ্রামী নেতা। কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র দুজন ছাড়া
কেউই ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে উঠতে পারেননি। এদের কেউ কেউ সংকটে বিভ্রান্ত হয়ে
গেছেন। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের
উদ্যোগ নেন সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন। ১৯৭৭ সালের ৩ ও ৪ এপ্রিল হোটেল ইডেনে ক্ষুদ্র পরিসরে
অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল। কিন্তু কাউন্সিল শুরুর আগেই আওয়ামী লীগের কোন্দল
প্রকাশ্য রূপ নেয়। তীব্র কোন্দলের মুখে জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক ঘোষণা করা হয়। তাঁকে
দায়িত্ব দেওয়া হয় ১০ দিনের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের। ১৯৭৮ সালের ৩ থেকে ৫ এপ্রিল
সংকটাপন্ন আওয়ামী লীগ কাউন্সিল করে। এ কাউন্সিলে আবদুল মালেক উকিল সভাপতি হন। দক্ষ
সংগঠক বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় আবদুর
রাজ্জাকের সামনে সুযোগ এসেছিল ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়ে ওঠার। কিন্তু সংকীর্ণ স্বার্থ,
গোষ্ঠীস্বার্থ এবং বিভ্রান্তির চোরাগলিতে আটকে যান আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুবিহীন আওয়ামী
লীগ এক পথহারা বিভ্রান্ত বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়। তৃণমূল থেকে আওয়াজ
ওঠে শেখ হাসিনাকে দরকার। এ সময় মুমূর্ষু আইসিইউতে থাকা আওয়ামী লীগকে বাঁচানোর আর কোনো
বিকল্প ছিল না। ’৮১-এর কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয়। শেখ হাসিনা সভানেত্রী
হওয়ায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলে জাগরণ সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠনের সমর্থকরা আশায়
বুক বাঁধেন। ইতিহাসে অমর হওয়ার এক অনন্য সুযোগ এসেছিল দক্ষ সংগঠক আবদুর রাজ্জাকের সামনে।
বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারের পাশে বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে থাকার এক অনন্য সুযোগ পেয়েছিলেন
এই নেতা। কিন্তু গোষ্ঠীস্বার্থ, মাইম্যান নীতিতে আবদুর রাজ্জাক ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক
হয়ে উঠতে পারেননি। শেখ হাসিনার পথ কঠিন করতে আবদুর রাজ্জাক উপদলীয় কোন্দলের পথে পা
বাড়ান। তাঁর উদ্যোগে ১৯৮২ সালের ১ মে ছাত্রলীগ ভেঙে যায়। এ ধারায় আওয়ামী লীগ ভাঙনের
মুখে পড়ে। ১৯৮৩ সালের ২২ অক্টোবর মহিউদ্দিন আহমদকে সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাককে সাধারণ
সম্পাদক করে বাকশাল গঠিত হয়। এ সময় আবার সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী
শেখ হাসিনা এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে।
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে ক্রমে তিনি ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। সৈয়দা
সাজেদা চৌধুরী প্রমাণ করেন নেতার প্রতি বিশ্বস্ত, আদর্শের প্রতি অনুগত থাকলে সংগঠন
গড়ে তোলা যায়। নেতার আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সাজেদা চৌধুরী হয়ে উঠেছিলেন
দুঃসময়ের কাণ্ডারি। ’৮৭ সালের কাউন্সিলে যখন তিনি পূর্ণাঙ্গ সাধারণ সম্পাদক হন, তখন
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পর জিল্লুর
রহমান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৯২-এর ১৯ থেকে ২১ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিলে।
তিনিও ছিলেন বিশ্বস্ততার প্রতীক। ক্যারিশম্যাটিক নেতা ছিলেন না জিল্লুর রহমান। কিন্তু
নেতার প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততায় অনুকরণীয় নেতা হয়ে থাকবেন চিরকাল। আবদুল জলিলও বিশ্বস্ত
ছিলেন। দলীয় সভানেত্রীর আস্থাভাজন ছিলেন। কর্মীদের খোঁজখবর নিতেন। সংগঠনের জন্য দিনরাত
পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু কঠিন সময়ে সংকটে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেননি। ওয়ান-ইলেভেনের
ধাক্কায় হতবিহ্বল জলিল রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেন। একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক
হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি আওয়ামী লীগের এই পোড় খাওয়া নেতা। আবার কর্মীদের সঙ্গে
নিবিড় যোগাযোগে না থাকার পরও ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল
ইসলাম। ওয়ান-ইলেভেনের কঠিন সময়ে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য ‘মাইনাস ফরমুলা’
আবিষ্কার হয়। মাইনাস ফরমুলা বাস্তবায়নের জন্য গ্রেফতার করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে।
’৭০-এ বঙ্গবন্ধু যেমন তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়
দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনাও তেমনি গ্রেফতারের আগে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ
সম্পাদক করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রমাণ রেখেছিলেন। প্রচারবিমুখ, কর্মীদের থেকে নিজেকে
গুটিয়ে রাখা সৈয়দ আশরাফ সংকটে ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ রাখার ক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সৈয়দ আশরাফ নিভৃতে থাকতে পছন্দ করতেন। খুব বেশি কথা
বলতেন না। কিন্তু যখন কথা বলতেন যখন মূল্যবান কথাই বলতেন। প্রতিদিন গণমাধ্যমের সামনে
যা খুশি বয়ান দিয়ে নিজেকে খেলো করতেন না। তাঁর কথা জনগণ বিশ্বাস করত, পছন্দ করত। ২০১৩
সালের মে মাসে হেফাজতের তাণ্ডবের সময় তার কথাগুলো এখনো কানে বাজে। কী শক্তিশালী, কী
দৃঢ় সেই বক্তব্য। গোটা দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছিল ওই কথায়। সৈয়দ আশরাফ প্রমাণ করেছেন সাধারণ
সম্পাদকের কাজ প্রতিদিন কাগজ দেখে একই কথা বারবার বলা নয়। সাধারণ সম্পাদককে বিশ্বস্ততার
প্রতীক হতে হবে। তার কথাবার্তা হতে হবে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এবার কাউন্সিলে আওয়ামী লীগের
তৃণমূলের কর্মীদের চাওয়া একটাই- একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ সম্পাদক। যিনি নেতার প্রতি বিশ্বস্ত
থাকবেন। আদর্শে থাকবেন অবিচল। সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। কর্মীদের সুখ-দুঃখ
দেখবেন। দলের ত্যাগী-পরীক্ষিতদের পাশে দাঁড়াবেন। দলের কাজ করবেন দিনরাত। তৃণমূল থেকে
উঠে আসা এমন নেতা আওয়ামী লীগে আছে। সামনে কঠিন সময়। এ সময় এ রকম একজন ‘অসাধারণ’ সাধারণ
সম্পাদক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদক
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
ইরান-ইসরায়েল শেখ হাসিনা শান্তির দূত জো বাইডেন ইরান
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।
ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা।