রবিবার সকাল। বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছি। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস তাই প্রচণ্ড যানজট। গাড়িতে বসে অফিসের টুকটাক কাজ সারছি। এর মধ্যেই আমার এক বন্ধুর ফোন। ধরতেই বলল, ‘দোস্ত খবর শুনছ। কোনো ব্যাংকে বোলে টাকা নাই। আটটা ব্যাংক নাকি দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। আমি তো অল্প কিছু টাকা রাখছি ব্যাংকে। এখন কী করব?’ বন্ধুর টেলিফোন রাখতে না রাখতেই রংপুর থেকে ফোন করলেন এক আত্মীয়। বললেন, ‘ব্যাংকে নাকি টাকা নাই। মাত্র কিছু টাকা আছে ব্যাংকে। এটাই তো সারা জীবনের সম্বল। এখন কী করব।’ অফিসে যেতে যেতে এরকম আরও কয়েকজনের ফোন। সবাই উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত। আমার এক অনুজ একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাকে ফোন করলাম আসলে ঘটনা কী জানার জন্য। তিনি তো হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘ভাই আপনিও কি এসব ফেসবুকের গুজবে বিশ্বাস করা শুরু করলেন? এসব ফালতু খবর একটা মহল ছড়াচ্ছে। কোনো ব্যাংকেই তারল্য সংকট নেই।’ তার কথায় আশ্বস্ত হলাম। তখনই মনে হলো ১৯৭৪ এর কথা। সে সময় একটি স্বনামধন্য পত্রিকায় ‘জাল জড়ানো বাসন্তী’র ছবি ছাপা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বাসন্তীর কোনো কাপড় নেই। লজ্জা নিবারণের জন্য বাসন্তী জালে আব্রু ঢেকেছে। ওই খবর সে সময় হইচই ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধু সরকারকে ঘায়েল করার জন্য সে সময়ই বাসন্তীর সাজানো নাটক ব্যবহার করা হয়েছিল। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বাসন্তী বাসন্তী করে রাজনীতির মাঠে কত না অসত্য কুৎসিত আপত্তিকর কথাই ছড়ানো হলো। ’৮১-র ১৭ মে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাই বাসন্তী নিয়ে মিথ্যাচারের স্বরূপ উন্মোচন করেছিলেন। নিজে গিয়েছিলেন বাসন্তীর বাড়িতে। জানা গেল বাসন্তী একজন প্রতিবন্ধী। ওই ছবি ছিল বানোয়াট। আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির জন্যই সে সময় বাসন্তীর ওই ছবি বানানো হয়েছিল। বাংলাদেশে অপসাংবাদিকতার ইতিহাস বাসন্তীর ছবি সম্ভবত সেরা দৃষ্টান্ত। বাসন্তীকে নিয়ে যারা সে সময় এ নোংরা খেলা খেলেছে তারা কেউই বাসন্তীর জন্য কিছুই করেনি। শেখ হাসিনাই বাসন্তীর জন্য ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন। ’৭৪-এ ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না। সংবাদপত্রে এক সাজানো ছবিই আওয়ামী লীগের অনেকটা সর্বনাশ করেছিল। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। এসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেন গুজবের ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ গুজব হলো- ব্যাংকে টাকা নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন চোখ রাখলে মনে হবে, বাংলাদেশ বোধহয় দেউলিয়া হওয়ার পথে। সরকার পতনের দিনক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো এমন সব গুজব ছড়ানো হচ্ছে, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, প্রথমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এরপর এ নিয়ে বিরোধী নেতারা বক্তব্য রাখছেন। অবশেষে তা মূল ধারার গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আপনাকে অসত্য তথ্য বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ব্যাংকে টাকা নেই, এ গুজব ছড়ানোর আগেই গুজব ছড়ানো হলো আমাদের রিজার্ভে টাকা নেই। বাংলাদেশ দেউলিয়া হওয়ার পথে। ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এটি আমাদের একটা গর্ব করার বিষয় ছিল। কিন্তু করোনা মহামারি আর বৈশ্বিক সংকটের কারণে রিজার্ভ কমছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সব দেশেই রিজার্ভ কমছে বৈশ্বিক সংকটের কারণে। একটি দেশে যদি তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ থাকে তাহলে সেটাকে নিরাপদ মনে করা হয়। বাংলাদেশে এখন যে নিট রিজার্ভ মজুদ আছে তা দিয়ে চার মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তাই রিজার্ভ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে চীনে। অক্টোবরের শেষে দেশটির রিজার্ভ ছিল ৩০৫২ বিলিয়ন ডলার। অথচ জুলাইয়ে এ দেশটির রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার বিলিয়ন ডলার। মাত্র তিন মাসে চীনের রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১ হাজার বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে প্রথম ১০টি দেশের একটি ভারত। জুনের শেষে ভারতের রিজার্ভ ছিল ৫৯৯ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরের শেষে এসে তা কমে ৫২০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ যুক্তরাষ্ট্র রিজার্ভের দিক থেকে প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ২৪২ বিলিয়ন ডলার। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দিক থেকে যে দেশগুলো সংকটে আছে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ‘বিশ্বে অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে সংকটে থাকা দেশ শ্রীলঙ্কা। দেশ এখন দেউলিয়া প্রায়। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জাম্বিয়া খেলাপি ঋণের দেশ। অতি সম্প্রতি বেলারুশও খেলাপির তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এ মুহূর্তে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে যে দেশগুলো আছে তার একটি তালিকাও প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ওই তালিকায় যেসব দেশের নাম রয়েছে সেগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, মিসর, এল সালভাদর, ইথিওপিয়া, ঘানা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, তিউনিশিয়া এবং ইউক্রেন। পাঠক লক্ষ করুন এ তালিকায় বাংলাদেশ নেই। তাহলে বাংলাদেশকে দেউলিয়া বানানোর প্রাণান্ত চেষ্টা কেন? কিছুদিন আগে আইএমএফ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেল। এ সফরের মধ্যেই গুজব ছড়ানো হলো যে, বাংলাদেশকে আইএমএফ ঋণ দিচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিকল্পিত এ গুজবকে লুফে নিলেন কিছু রাজনীতিবিদ। তারা একযোগে বাদ্য বাজাতে শুরু করলেন। এরপর দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যম গুজবকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামল। অর্থনীতিবিদ থেকে সদ্য রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া এক দেবদূত যেন আইএমএফের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ঘোষণা করলেন ‘বাংলাদেশ ঋণ পাচ্ছে না।’ তার বক্তব্য যখন ডাহা মিথ্যা প্রমাণ হলো তখন কোনো গণমাধ্যম তাকে জিজ্ঞাসা করল না ‘আপনি এভাবে অসত্য তথ্য কীভাবে দিলেন’। সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম মিথ্যাচার করলে আপনি জাতির বিবেক, সাহসী মানুষ। আর সত্য তুলে ধরলেই আপনি সরকারের দালাল। সবাই মিলে যেন বাংলাদেশকে পঙ্গু, বিবর্ণ, দেউলিয়া প্রমাণের বিরামহীন চেষ্টা। কিন্তু কেন? পুঁজিবাদী বিশ্বে বলা হয়, সবকিছুর মূলে বাজার এবং অর্থ। বিদেশে বসে যারা নিরন্তর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে তারা যে বিনে পয়সায় এসব করছে না তা বলাই বাহুল্য। তাদের নিয়মিতভাবে মাসোহারা দিয়ে পোষা হচ্ছে। এখন যে পরিকল্পিত গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেগুলোর পেছনেও লোভনীয় অর্থের হাতছানি আছে। বাংলাদেশকে ক্ষতবিক্ষত করতে কেন এত বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে? এর কারণ খুবই সহজ সরল এবং পরিষ্কার। রাজনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই এসব গুজবকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানো। একটি রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা থেকে হটানোর একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ হলো নির্বাচন। সেজন্য জনমত গঠন করতে হয়। ভোটে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেই ক্ষমতাসীন দলকে পরাস্ত করতে হয়। ক্ষমতা থেকে নামাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাতে এখন ভিন্ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপ, অবিরত সরকারের বিরুদ্ধে অসত্য ভিত্তিহীন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে হবে। এসব অপপ্রচার ‘ভাইরাল’ করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপ, এ অপপ্রচারের সূত্র ধরে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারণা করবে। ওই গুজবগুলোকে জায়েজ করবে। তৃতীয় ধাপ, বিরোধী দলের বক্তব্যের সূত্র ধরে মূল ধারার কিছু গণমাধ্যম সংকট, ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে ফলাও করে প্রচার করবে। চতুর্থ ধাপ, ক্ষমতার লোভে অস্থির কিছু সুশীল এ নিয়ে নিয়মিত টকশোতে গিয়ে কথা বলবেন, কলাম লিখবেন। পঞ্চম ধাপ, সবকিছু নিয়ে সরাসরি জনগণের কাছে গিয়ে অসত্য তথ্যগুলো বলা হবে। ষষ্ঠ ধাপ, কিছু কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হবে। সপ্তম ধাপ, দাতা দেশ, সংস্থা এবং পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করে সরকারকে চাপে ফেলা হবে। সাত ধাপ পেরোলেই সাফল্য- এটাই এখন বাংলাদেশের রাজনীতি। চতুর্থ ধাপ পর্যন্ত ঘটনা প্রবাহ দৃশ্যমান। কিন্তু পঞ্চম ধাপের ঘটনাগুলোকে আমরা উপেক্ষা করছি। কদিন আগে সৌদি আরব থেকে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন করলেন। আমার লেখা পড়ে মাঝেমধ্যেই তিনি ফোন করেন। অনেক বিষয়ে পরামর্শ দেন। তিনি আমাকে বললেন, এখানে প্রবাসী ভাইদের কাছে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন গিয়ে কথা বলছেন। তারা কঠিন পরিশ্রম করে দেশে পরিজনকে সুখে রাখার সংকল্পে দৃঢ় এ মানুষগুলোকে বিভ্রান্ত করছে।
তিনি বললেন, ‘প্রবাসীদের বলা হচ্ছে- ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো নিরাপদ না। আপনার টাকা মার যাবে। আপনি টাকা দেন, আমি হুন্ডি করে দিচ্ছি। তার মতে, সৌদি আরবে এখন হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর হিড়িক পড়েছে। টাকা পাঠাতে সময় লাগছে ১০ মিনিট। একজন
অভিবাসী ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়েই ওই রাজনৈতিক ব্যক্তি
বাংলাদেশে ফোন করছেন। পরিবারের ঠিকানা বাংলাদেশে থাকা ব্যক্তিকে জানিয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশের ওই ব্যক্তিটি টাকা
নিয়ে চলে যাচ্ছেন প্রাপকের বাসায়। ফোনে সৌদি প্রবাসীকে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছেন। পরিবারের সদস্য টাকা বুঝে পাওয়ার কথা নিশ্চিত করতেই অপর প্রান্তের কর্মী বলছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
এভাবেই সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, জর্ডানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলছে ‘হুন্ডি মিশন।’
আর এ কারণেই কাগজ-কলমে প্রবাসী আয় কমছে। টাকা
আসছে অবৈধ পথে। শুধু কি বিদেশে? দেশে
কী হচ্ছে? রবিবার সোমবার ব্যাংকে টাকা নেই বলে যে গুজব ছড়ানো
হলো তার নেপথ্যেও বিএনপি এবং জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। ঢাকার একজন বিএনপির পরিচিত নেতা তার ফেসবুকে লিখলেন- ‘ব্যাংক থেকে ৫ লাখ টাকা
তুলতে গেলাম। ব্যাংকে টাকা নেই...।’
এভাবে আমি পাঁচজন বিএনপি নেতার ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলাম। শব্দ আর টাকার অংকের
হেরফের আছে কিন্তু মূল বক্তব্য একই। একজন বিএনপি নেতা তার বাড়িতে রীতিমতো কর্মিসভা করে বলেছেন- সবাই ব্যাংকে যাবে, যার যা টাকা আছে
তুলে নেবে। এভাবে পরিকল্পিতভাবে ব্যাংকিং খাতকে একটা সংকটে ফেলার চেষ্টা চলছে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্বরিত পদক্ষেপের প্রশংসা করতেই হয়। গুজবকে পল্লবিত হতে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। দ্রুত প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জনগণকে আশ্বস্ত করছে। এরকম পদক্ষেপ যদি ডলার নিয়ে সরকার কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক করতে পারত তাহলে দেশের ডলার পরিস্থিতি এত নাজুক হতো
না। সেদিন একজন অর্থনীতিবিদ বলছিলেন, ডলার এখন শেয়ার মার্কেটের মতো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। অনেকে মুনাফার আশায় ডলার কিনে বাসায় রাখছে। এখানেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক কূটকৌশল। এ দুই দলের
বিত্তবান নেতা-কর্মীরা বাজার থেকে মুড়িমুড়কি কেনার মতো ডলার কিনে মজুদ রেখেছেন। ওই অর্থনীতিবিদ বলছিলেন,
পাসপোর্ট, বিদেশ যাওয়ার টিকিট এবং ভিসা ছাড়া এখন ডলার বিক্রি বন্ধ করা উচিত। একজন ব্যক্তি চাল, ডাল, আদা, লবণের মতো ডলার কিনবেন এটা কী করে হয়?
এখন যে প্রবণতা চলছে
তাতে বাজারকে স্থিতিশীল করার জন্য যত ডলারই ছাড়া
হোক না কেন, সংকট
কাটবে না। এখন একটি সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক বাহিনী মাঠে নামানো হয়েছে। এদের কাজ হলো খোলাবাজার থেকে ডলার কিনে সংকট সৃষ্টি করা। এটা তাদের জন্য লাভজনক ব্যবসাও বটে। প্রশ্ন হলো, এত বিপুল ডলার
কেনার টাকা বিএনপি বা জামায়াতের নেতা-কর্মীরা কোথায় পাচ্ছেন। এ প্রশ্নের উত্তর
দিতে গেলে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির মহাসমাবেশগুলোর বৈশিষ্ট্যগুলো খানিকটা খতিয়ে দেখা দরকার। সন্দেহ নেই, বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বিএনপি যে জনসভাগুলো করছে
তাতে বিপুল জনসমাগম হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা সেখানে যোগ দিচ্ছেন। প্রতিটি সমাবেশের আগে অযাচিতভাবে পরিবহন ধর্মঘটের নাটক করা হচ্ছে। এতে ক্ষমতাসীন দলের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে বিএনপির কর্মীরা দুই-তিন দিন আগেই সমাবেশ হবে যে শহরে সেখানে
আসছেন। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে
ফরিদপুরের সমাবেশে কিছু কর্মীর সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। সেখানে কর্মীরা বলছেন, তারা তিন দিন আগে সমাবেশে যোগ দিতে এসেছেন। তাদের আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়ার খরচ কে দিচ্ছে? দল
দিচ্ছে। আগের দিন সমাবেশস্থলে রীতিমতো পিকনিকের উৎসব। বিরিয়ানি, তেহারি, খিচুড়ি রান্নার লোভনীয় দৃশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সাধারণভাবে হিসাব করলে দেখা যায়, একেকটি সমাবেশে ১০ থেকে ১৫
কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। এত টাকা বিএনপি
পাচ্ছে কোত্থকে? গত ২৮ জুলাই
বিএনপি তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব
নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে। এতে দেখা যায়, গত বছর দলটির
আয় হয়েছে ৮৪ লাখ ১২
হাজার ৪৪৪ টাকা। দলের সদস্যদের মাসিক চাঁদা, মনোনয়ন ফরম বিক্রি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে
অনুদান এবং এফডিআরের লভ্যাংশ থেকে এ টাকা আয়
হয়েছে বলে হিসাব বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সময় দলটির ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯৮
লাখ ৪৭ হাজার ১৭১
টাকা। কর্মচারীদের বেতন-বোনাস, ক্রোড়পত্র বিল, অফিস খরচসহ বিভিন্ন খাতে এ ব্যয় হয়েছে
বলে বিএনপির দাখিলকৃত হিসাব বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়েছে। বিএনপির আয়-ব্যয়ের হিসাব
অনুযায়ী দলটি ১ কোটি ১৪
লাখ ৩৪ হাজার ৭২৭
কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে বলে দলটির নেতারা প্রতিদিন গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দেন, সেই দলটির অবস্থাই আসলে শ্রীলঙ্কার মতো। কাগজ-কলমে দায়দেনাগ্রস্ত একটি রাজনৈতিক দল সপ্তাহে ১০-১৫ কোটি টাকা
হাওয়ায় উড়াচ্ছে কীভাবে? বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘মানি ইজ নো প্রবলেম।’
ক্যান্টনমেন্টে বসে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় জিয়া বিএনপি গঠন করেছিলেন। টাকা দিয়ে অন্য দলের লোক ভাগিয়ে এনেছিলেন। দল গঠনের জন্য
ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের হুমকি দিয়ে চাঁদা নিতেন এমন অভিযোগ লিখে গেছেন প্রয়াত বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে এবং বিএনপিকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা
করার জন্য তিনি বলেছিলেন ‘মানি ইজ নো প্রবলেম।’
বিএনপির রাজনীতির মূলমন্ত্র এটি। এখন আবার ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’
তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ দেখছে বাংলাদেশ। টাকা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে বিএনপি-জামায়াত। লবিস্ট নিয়োগ করে সরকারকে চাপে ফেলা হয়েছে। র্যাবের ওপর
নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া
হয়েছিল গত বছর ১০
ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়
মহাসমাবেশ ডেকেছে বিএনপি। একটু কান পাতলেই বিএনপি নেতাদের চাপা উল্লাসের কথা শোনা যায়। ওই দিন নাকি
বাংলাদেশের ওপর আরেকটি বড় নিষেধাজ্ঞা আসছে।
এ নিষেধাজ্ঞা গত বছরের নিষেধাজ্ঞার
চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে। বাংলাদেশ স্তম্ভিত হবে এমন কথাও শুনি। ১০ ডিসেম্বরের সভা
সমাবেশ নিয়ে নয়, আসন্ন নিষেধাজ্ঞা নিয়েই বিএনপি খুশিতে বাকবাকুম করছে। টাকা নাকি কথা বলে। এখন তো তার সত্যতাও
দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা এখন বিএনপি নেতাদের ভাষায় কথা বলছেন। সরকারকে হটাতে বিএনপি টাকার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। মানি ইজ নো প্রবলেম।
কিন্তু টাকাটা আসছে কোত্থেকে? কদিন আগে শুনলাম আওয়ামী লীগের নেতা বলছেন, ‘ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি হুমকি দিয়ে মোটা অংকের টাকা নিচ্ছে বিএনপি নেতারা।’
ব্যবসায়ীরা কি নাদান শিশু।
তাদের ভয় দেখাল আর
কোটি কোটি টাকা বের করে দিলেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে এমন ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। কিছু কিছু ব্যবসায়ী এখন বিএনপিপ্রেমিক হয়ে উঠেছেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনের পর ‘হাওয়া ভবন’
কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল। এসব ব্যবসায়ী তখন ফুলেফেঁপে উঠেছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তারা প্রায়
সবাই রাতারাতি আওয়ামী লীগ হয়ে যান। হাওয়া ভবনের সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে প্রয়াত সৈয়দ আশরাফ যে প্রতিষ্ঠানকে ফ্লাইওভার
নির্মাণের অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন; ভোজবাজির মতো সেই ফ্লাইওভার অনুমোদন পান হাওয়া ভবন ঘনিষ্ঠ সেই ব্যবসায়ী। শুধু তাই নয়, রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্বের মতো পায় পাওয়ার প্ল্যান্ট, আরও নানা ব্যবসা। তারা এখন কী করছেন? একসঙ্গে
অনেক ব্যাংকের মালিকানা পাওয়া প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগ কোথায়? দেশে না বিদেশে? এ
খবর কে রাখে। অনেক
ব্যবসায়ী গ্রুপ এখন দিনে আওয়ামী লীগের সমর্থক সেজে পাঁচতারকা হোটেলে মন্ত্রীদের সঙ্গে ফটোসেশন করছেন। রাতে বিএনপির প্রবাসী যুবরাজের জন্য নজরানা পাঠাচ্ছেন। এমন অভিযোগ বিভিন্ন আলোচনাতেই শোনা যায়। গার্মেন্টের নামে ওভার ইন ভয়েসিং করে
হাজার কোটি পাচার করে যারা ১ কোটি টাকা
অনুদানের চেক নিয়ে গদগদ করতে করতে সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছেন, গভীর রাতে তাদের গোপন ফোনে দূর দেশে কার সঙ্গে কথা হয়? আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে বিএনপির মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ব্যবসায়ীদের খবর কি সরকার জানে
না? ব্যবসায়ীদের
একটি অংশ এখন দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছেন।
জ্বালানি সংকটে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে আর্তনাদ করতে করতে বিএনপিকে সচল রাখার জ্বালানিতে সরবরাহ করছেন বেশ কিছু ব্যবসায়ী। এদের সম্পর্কে খোঁজখবর কি নেওয়া হচ্ছে?
সরকারকে নয় বাংলাদেশকে ব্যর্থ
রাষ্ট্র বানাতে যারা ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’
তত্ত্ব আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করছে তারা রাষ্ট্র এবং জনগণের জন্য ক্ষতিকর। ধ্বংসের
উন্মত্ত রাজনীতিতে অবৈধ টাকার অবাধ প্রবাহ বন্ধ না করলে সামনে
পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে বাধ্য।
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত
হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী
লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা
যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলছেন, ওবায়দুল কাদের যা বলছেন
তা হলো শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতির বক্তব্যের অনুরণন। আওয়ামী লীগ সভাপতি যেভাবে তাকে নির্দেশনা দিচ্ছেন সে বক্তব্যই
তিনি প্রচার করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তারা যেন সারা দেশে আওয়ামী লীগের কোন কোন এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাদের স্বজনরা প্রার্থী
আছেন তার তালিকা তৈরি করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩ টি বিষয়ের প্রতি সুনির্দিষ্ট
নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত, কোন মন্ত্রী-এমপি কিংবা প্রভাবশালী নেতা তার নিকট আত্মীয় বা স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী করাতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী কোন প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, কোন মন্ত্রী এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রশাসন বা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলাতে পারবেন না। এই ৩ টির কোন একটির যদি ব্যত্যয় হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, যারা দলের সিদ্ধান্ত মানবে না তাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপজেলা নির্বাচনের ৩ ধাপে যে তফসিল নির্বাচন
কমিশন ঘোষনা করেছে। তার মধ্যে প্রথম ধাপে ২৭ জন মন্ত্রী এমপির স্বজনরা উপজেলায় প্রার্থী
হয়েছেন। ২য় ধাপে প্রার্থীতার সংখ্যা আরো বেশি হওয়ার কথা। এখানে ১৫২ টি উপজেলার মধ্যে
৮৭ জন মন্ত্রী-এমপির সমর্থন নিয়ে নির্বাচন করার আগ্রহ জানিয়েছে, যারা মন্ত্রী-এমপিদের
নিকট আত্মীয়। আর ৩য় ধাপে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০-২৫০ জন মন্ত্রী-এমপির
আত্মীয় স্বজন উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এখন
যদি তারা নির্বাচন থেকে সরে না দাড়ান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ
করা হবে?
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছেন, আগামী ৩০ এপ্রিল দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, এই বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আওয়ামী
লীগ সভাপতি। তবে সিদ্ধান্ত হবে ধাপে ধাপে। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে প্রার্থী
দিবেন তাদেরকে প্রথমত, দলের পদ হারাতে হবে। দ্বিতীয়ত, আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে
তাদেরকে কালো তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হবে। তৃতীয়ত, যারা মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী আছেন,
তারা মন্ত্রীত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, শেষ পর্যন্ত
কেউ যদি দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হটকারী অবস্থান গ্রহন করে, তাহলে দল থেকে বহিষ্কারের
মতো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র মনে করছে।
তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে অত্যন্ত
কঠোর অবস্থানে আছেন। এ ব্যাপারে তিনি কোন ছাড় দেবেন না। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কালো তালিকায় যদি থাকেন, তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে বাধ্য।
শেখ হাসিনা উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগ মন্ত্রী-এমপি
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
ইরান-ইসরায়েল শেখ হাসিনা শান্তির দূত জো বাইডেন ইরান
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন। শুধু কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবে তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করারও শাস্তিমূলক হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। আর এ কারণে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একের পর এক বৈঠক করছেন এবং মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা যাতে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেন সে জন্য সতর্ক বার্তা ঘোষণা করছেন।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।
ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা।