এক-এগারোর ১৬তম
বার্ষিকীর দিন রাজনীতির মাঠ ছিল সরগরম। বিএনপি করেছে গণ-অবস্থান কর্মসূচি
আর আওয়ামী লীগ থেকেছে সতর্ক পাহারায়। কর্মদিবসে এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক জনভোগান্তি হয়েছে বটে। কিন্তু তারপরও জনমনে একটা স্বস্তি ছিল লক্ষণীয়। সাধারণ মানুষ শান্তি চায়। নিজেদের কাজকর্ম ঠিকঠাক মতো করতে চায়। যে কোনো রাজনৈতিক
কর্মসূচি তাই জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়। বিএনপির মধ্যে ইদানীং তারিখ বিভ্রাট বা বিভ্রান্তি প্রকট
আকার ধারণ করেছে। বিদায়ী বছরের ২৪ ডিসেম্বর বিএনপি
গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ওই দিন আওয়ামী
লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত ছিল বহু আগেই। এরপর বিএনপি নেতাদের ভুল ভাঙে। গণমিছিলের নতুন তারিখ দেয় ৩০ ডিসেম্বর। বুধবার
(১১ জানুয়ারি) বিএনপি পালন করল গণ-অবস্থান কর্মসূচি।
এবার অবশ্য শুধু বিএনপি নয়, নানা দল, নানা জোট বিএনপির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছে। বিএনপি অবশ্য ঢাকার বাইরে তাদের ১০ সাংগঠনিক বিভাগেও
এ কর্মসূচি পালন করে। কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মসূচি সফল করতে ওইসব বিভাগীয় শহরে যান। এক-এগারো বাংলাদেশের
রাজনীতিতে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের উদ্যোগ হিসেবে এ দিনটি আলোচিত।
এক-এগারো একদিকে যেমন বিএনপির একতরফা প্রহসনের নির্বাচন প্রচেষ্টাকে বানচাল করেছিল, তেমনি ছিল রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠানোর মিশন। বিএনপির একান্ত অনুগত বিশ্বস্ত কতিপয় ব্যক্তি সেদিন বিএনপিকে আসলে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। জেনারেল মইন উ আহমেদ ছিলেন
বেগম জিয়ার একান্ত অনুগত সামরিক কর্মকর্তা। সাতজন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে তাকে সেনাপ্রধান করা হয়েছিল। বেগম জিয়ার প্রত্যাশা ছিল দুঃসময়ে তিনি পাশে থাকবেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদকে
বেগম জিয়াই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। জেনারেল আমিন কিংবা ব্রিগেডিয়ার বারী সবাই ছিলেন বিএনপিপন্থি। আওয়ামী লীগবিরোধী। অনেকেই মনে করেন, এক-এগারো ছিল
বিএনপির সৃষ্টি। গণঅভ্যুত্থানের হাত থেকে বাঁচতেই বিএনপি সেদিন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল। কিন্তু আমি তেমনটি মনে করি না। আমার মতে, এক-এগারো ছিল
বিরাজনীতিকরণের চক্রান্তের অংশ। সুশীল সমাজকে বিনা নির্বাচনে ক্ষমতায় রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন প্রকল্প। সংস্কারের নামে রাজনীতিকে কলঙ্কিত করা। রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের চরিত্র হনন করাই ছিল এক-এগারোর অন্যতম
উদ্দেশ্য। এক-এগারো সরকারের
তথাকথিত রাজনৈতিক সংস্কারের মূল লক্ষ্যই ছিল রাজনীতিমুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক-এগারোর লক্ষ্য
অর্জিত হয়নি। ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেরিতে হলেও নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। এক-এগারোর পরিকল্পনা
ভেস্তে যাওয়ার প্রধান কারণ ছিলেন শেখ হাসিনা। তিনিই প্রথম সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় থাকা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। দ্রুত নির্বাচনের দাবি করেন। রাজনীতিবিদদের ঢালাও গ্রেফতারের প্রতিবাদে সোচ্চার হন। এ জন্য তাঁকে
কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছিল। তাঁর দেশে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল অনির্বাচিত সরকার। সব শেষে তাঁকে
কারান্তরিন করে মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় শেখ হাসিনা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করেন। শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে নিজেই এক-এগারোর অভিজ্ঞতার
কথা বর্ণনা করেছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের। কাউন্সিলের আগে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বসেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, কারান্তরিন সময়ের অভিজ্ঞতা। সেনা কর্মকর্তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে দুই নেত্রীর কাছে যান। শেখ হাসিনার কাছে এসেছিলেন জেনারেল আমিন। এসেই তিনি উত্তেজনা দেখান। রাজনীতিবিদদের গালাগালি করেন। শেখ হাসিনা শান্ত। সবকিছু শোনেন। তারপর তিনি জানান, দেশের জন্য তাঁর পরিকল্পনার কথা। ভিশন-২০২১, রূপকল্প-২০৪১ এর পরিকল্পনা। অন্যদিকে
বেগম জিয়ার কাছে যান ব্রিগেডিয়ার বারী। খালেদা ছিলেন উত্তেজিত। প্রচণ্ড গালাগালি করেন সেনা কর্মকর্তাদের। ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে কী করবেন তারও
বিস্তারিত বিবরণ দেন। ব্যস। দুই নেত্রীর দুই পথের শুরু হয় এখান থেকেই।
এক-এগারো সবচেয়ে ক্ষতি করেছে বিএনপির। ১৬ বছরেও সেই
ক্ষত সারাতে পারেনি দলটি। সেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষাক্ত ছোবলকে আবার আলিঙ্গন করতে চায়। বেহুলার বাসর ঘরে ছিদ্র দিয়ে যেভাবে সাপ প্রবেশ করেছিল, ঠিক তেমনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাংবিধানিক পদ্ধতির মধ্যে ছিল অদ্ভুত ফাঁক। সেই ফাঁক দিয়েই একটি অনির্বাচিত সরকারের অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে সাংবিধানিক বিধান
ছিল, তাতে এর মেয়াদ ৯০
দিন। কিন্তু ৯০ দিনের মধ্যে
যদি ওই সরকার নির্বাচন
করতে না পারে তাহলে
কী হবে, সেই ব্যাখ্যা ছিল না। এ কারণেই ড.
কামাল হোসেন সর্বোচ্চ আদালতে বলেছিলেন, নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে। এতে সংবিধান লঙ্ঘন হয় না। ৯০
দিনের কথা বলে ড. ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। জেনারেল মইন এবং ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের সময়ই রাজনীতিবিদদের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলই বলেছিল, আর না তত্ত্বাবধায়ক
সরকার। পরে অবশ্য দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়। এক-এগারো তাই
গণতন্ত্রের সর্বনাশের দিন। বিএনপি ওইদিন গণঅনাস্থা কর্মসূচি পালন করল। এটি কি কাকতালীয় নাকি
ইঙ্গিতবাহী। বিএনপি কি ১০ দফা
কিংবা রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচির মাধ্যমে আবার একটি এক-এগারো আনতে
চায়? বিএনপি একটি সুশীল সরকার কায়েম করতে চায়? বিএনপি কি গণতন্ত্রের সর্বনাশ
চায়? আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বিরোধী আন্দোলনে মোটেও বিচলিত নন। সরকার অর্থ পাচার, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতি, ব্যাংকিং খাতে সংকট, ডলার সমস্যা, বৈশ্বিক পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে কিছুটা হলেও চাপে আছে। সরকারের কার্যক্রমেও সেই চাপ বোঝা যায়। সেই তুলনায় বিরোধী আন্দোলনে সরকার বেশ ফুরফুরে, চাপমুক্ত। এর কারণ একাধিক।
প্রথমত, বিএনপির নেতৃত্বে আন্দোলনে এখন পর্যন্ত জনসম্পৃক্তি ঘটেনি। দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলন সরকারের
নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারেনি। বিএনপি বাধ্য ছেলের মতো সরকারের অনুমতি নিয়েই কর্মসূচি পালন করেছে। তৃতীয়ত, বিরোধী আন্দোলন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। ভিতরের কোন্দল ভুলে ১৪ বছর ক্ষমতায়
থাকা দলটি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। নেতা-কর্মীরা কাজ পাচ্ছে। আক্রান্ত হলেই আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হয়। সংগঠিত হয়। নিজেদের বিরোধ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী
বিরোধী আন্দোলনকে স্বাগত জানান। তবে এ আন্দোলন দিয়ে
তো সরকার হটানো যাবে না, এটা শেখ হাসিনার মতো পোড় খাওয়া, আন্দোলনে বেড়ে ওঠা রাজনীতিবিদ ছাড়া আর কে ভালো
জানেন। এ জন্যই ১০
জানুয়ারি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে ধাক্কা দিল আর আওয়ামী লীগ
পড়ে গেল এত সহজ নয়।’
আন্দোলনের ধাক্কায় আওয়ামী লীগের পতন কখনো হয়নি। স্বাধীনতার পর জাসদ বঙ্গবন্ধু
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। গণবাহিনী সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালিয়েছে। কিন্তু জাসদ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে পারেনি। ’৯৬ সালে আওয়ামী
লীগই বাংলাদেশের প্রথম সরকার হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে জ্বালাও-পোড়াও করে আওয়ামী লীগকে গদিচ্যুত করা সম্ভব হয়নি। সে তুলনায় এ
আন্দোলন কিছুই না। তাই রাজনীতির ইতিহাস বলে আন্দোলনে এ সরকারের পতন
সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ হেরে যায় ষড়যন্ত্রের কাছে। চক্রান্ত আওয়ামী লীগকে পরাস্ত করে। ’৫৪-তে ষড়যন্ত্র
করেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। ’৭৫-এ ষড়যন্ত্র
শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বাংলাদেশকেই গভীর সংকটে দাঁড় করিয়েছিল। ’৯১-এর নির্বাচন
ছিল আওয়ামী লীগকে হারানোর নীলনকশার নিপুণ বাস্তবায়ন। ২০০১ সালের ষড়যন্ত্রও আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে। গত ৭ জানুয়ারি
ছিল তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের চার বছর পূর্তি। এ উপলক্ষে জাতির
উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই ভাষণে তিনি
বলেছেন, ‘এ বছরের শেষে
অথবা সামনের বছরের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এখন থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী, ক্ষমতালোভী, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনকারী আর পরগাছা গোষ্ঠীর
সরব তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদের লক্ষ্য ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পেছনের দরজা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করা। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা।’ রণকৌশলের প্রধান কাজ আসল শত্রুকে চিহ্নিত করা। প্রধানমন্ত্রী সেই কাজটা করেছেন। আন্দোলন যে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের
জন্য একটি আবরণ এটা তিনি ভালো করেই জানেন। ক্ষমতাচ্যুত করার আসল কাজ হচ্ছে পর্দার আড়ালে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কখনো বাস্তবায়িত হয়?
যখন আওয়ামী লীগ অতি আত্মবিশ্বাসী হয়, ভিতরের বিশ্বাসঘাতকরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোপনে হাত মেলায়। যখন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের যোদ্ধারা দূরে সরে যায়, অবহেলায়, যখন দলের ত্যাগী পরীক্ষিতরা কোণঠাসা হয়, যখন চাটুকারদের আলখেল্লায় সত্য গোপন হয়, সুবিধাবাদীরা যখন ক্ষমতার কেন্দ্রের চারপাশ ঘিরে রয়, বিশ্বাসঘাতকরা যখন বিশ্বস্ততার মুখোশ লাগায়, আওয়ামী লীগ যখন অচেনা মানুষের প্রেমে হাবুডুবু খায়, ঠিক তখনই আওয়ামী লীগ হেরে যায়। ’৭৫-এর আগে তাজউদ্দীন আহমদরা নির্বাসিত হয়েছিলেন। খুনি মোশতাকের মতো চাটুকার এবং সুবিধাবাদীরা বঙ্গবন্ধুর চারপাশে সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করত। মেরুদণ্ডহীন নেতারা প্রতিবাদহীন ছিলেন। ’৯১-এর নির্বাচনে জয়ের আগেই আওয়ামী লীগ জিতেছিল। অতি আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা মন্ত্রিসভার দফতর ভাগবাটোয়ারা করায় ব্যস্ত ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিশ্বস্ততার মুখোশ পরা বিশ্বাসঘাতক বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের প্রেমে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। মেরুদণ্ডহীন কতিপয় আমলার ওপর নির্ভর করেছিল। ভুল মানুষকে পক্ষের লোক ভেবে ভুল করেছিল। এখন পরিস্থিতি কী? আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের বোদ্ধারা কি ক্ষমতার কেন্দ্রে আছেন? নাকি এক-এগারোর সংস্কারপন্থিদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছেন। নিজেদের পরীক্ষিত এবং বিশ্বস্ত আমলাদের বাদ দিয়ে যাদের সামনে আনা হচ্ছে তারা কি কঠিন সময়ে বিশ্বস্ত থাকবেন? নাকি সময় হলে মুখোশটা খুলে ফেলে আসল রূপ দেখাবেন? প্রশাসনে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে যারা নানাভাবে পুরস্কৃত হচ্ছেন, আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়েছেন, তারা কি বৈরী পরিবেশে পাশে থাকবেন? ’৭৫-এ মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন এইচ টি ইমাম। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর তিনি খুনি মোশতাকের অবৈধ মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। এইচ টি ইমাম বিশ্বাসঘাতক নাকি মেরুদণ্ডহীন তা বিচার করবে ইতিহাস। কঠিন সময়ে নীতির প্রশ্নে অটল থাকতে পারেননি আরেক আমলা ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর (রাষ্ট্রপতি) একান্ত সচিব ছিলেন। ১৪ আগস্ট গণভবনে জাতির পিতার শেষ অনুষ্ঠান ছিল ড. ফরাসউদ্দিনের বিদায় অনুষ্ঠান। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতির পিতা। অনুষ্ঠান শেষ করে তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে ফিরে যান। পরদিন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এরপর ফরাসউদ্দিন কী করেছিলেন? তিনি খুনি মোশতাকের কাছ থেকে অনাপত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। আমলারা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো অস্ত্র তুলে নেবেন না। প্রতিরোধ যুদ্ধ করতে জীবন-যৌবন সব কিছু বিসর্জন দেবেন না। ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাবে। ’৭৫-এর পর কজন আমলা চাকরি ছেড়েছেন? কজন আমলা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে খুনি মোশতাক সরকারের অধীনে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন? আদর্শবান রাজনীতিবিদরাই প্রতিরোধযুদ্ধ করেন। জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দেন। আদর্শের বেদিতে যৌবন বলিদান করেন। এরকম কজন নেতা আছেন এখন আওয়ামী লীগে? আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয় মেয়াদে অনেকটাই আমলানির্ভর। এ আমলানির্ভরতা কি ষড়যন্ত্রের সুড়ঙ্গের পথ তৈরি করছে না?
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ মানুষের সন্ধানে মেতেছিল। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। এম এ সাঈদকে করা হয়েছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ২০০১-এর নির্বাচনে ‘বিশ্বস্ত বিশ্বাসঘাতক’দের ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এখন আবার আওয়ামী লীগের মধ্যে নিরপেক্ষ ব্যক্তি খোঁজার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগে গায়ে ধুলোবালি লাগা মানুষেরা অনাহুত। নিরপেক্ষরা বিচক্ষণ, মেধাবী। তাদেরই যোগ্য মনে করা হচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট নেতা। কিন্তু স্মার্ট মানুষ খুঁজতে গিয়ে তার আদর্শ পরীক্ষা হচ্ছে কি? তার ঠিকুজি পরখ না করলে ভবিষ্যতে আবার ধাক্কা খেতে হবে আওয়ামী লীগকে। চার মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তিনজন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়েছে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অরাজনৈতিক ব্যক্তি ছিলেন। আর জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান আবদুল হামিদ হলেন তৃণমূল থেকে বেড়ে ওঠা রাজনীতিবিদ। এ দুজন প্রমাণ করেছেন রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি বিশ্বাস এবং আনুগত্যই বড় সততা। সামনে আওয়ামী লীগকে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। নতুন রাষ্ট্রপতি কি একজন রাজনীতিবিদ হবেন নাকি সাবেক আমলা? ষড়যন্ত্রের জয়-পরাজয় এ সিদ্ধান্তের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি করে। কমিটিতে চমক ছিল। আবদুল জলিল সাধারণ সম্পাদক হন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রয়াত মুকুল বোস। সাংগঠনিক সম্পাদক হন মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, সাবের হোসেন চৌধুরীর মতো সম্ভাবনাময় নেতারা। কিন্তু এক-এগারোর সময় এ তুখোড়, সম্ভাবনাময়রা কী করেছেন সবাই জানেন। রাজনীতিবিদরা যদি নেতৃত্বের প্রতি অকুণ্ঠ অনুগত না থাকেন, আদর্শে অবিচল না হন তাহলে কী হয় এক-এগারো তা শিখিয়েছে। মেধাবী হলেই আদর্শবান নেতা হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের এবার কমিটিতে যেটুকু চমক তা ওই ‘মেধাবী’দের কয়েকজনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে আসা। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া এ মেধাবীরা সংকটে কী করবেন তা দেখার অপেক্ষায় রইলাম। এদের কেউ কেউ পুরস্কৃত হয়েই তাদের জাত চিনিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দিয়ে, দুটি পত্রিকা পড়েন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এর কারণও তিনি একাধিকবার ব্যাখ্যা করেছেন। একজন দেখলাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পেয়েই বিরাজনীতিকরণের মুখপাত্র এক ইংরেজি দৈনিকে কলাম লিখে ফেলেছেন। কী প্রতিভা। এরাই তো ভবিষ্যতে ষড়যন্ত্রের রাস্তা পরিষ্কার করবে। ঘর ঠিক থাকলে বাইরের ষড়যন্ত্র আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে পারে না। ঘরে শত্রুদের বিশ্বাসঘাতকতা, লোভ এবং আপসকামিতা ছাড়া আওয়ামী লীগ কখনো হারেনি। আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো আওয়ামী লীগই। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগই একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা আন্দোলনে পরাস্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ যতবার হেরেছে ততবারই ভিতর থেকে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে। ক্ষমতার কেন্দ্রের চারপাশ আগে দখল করেছে আদর্শহীন, চাটুকার, সুবিধাবাদী, ছদ্মবেশী বহিরাগতরা। ’৭৫, ’৯১, ২০০১-এ আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ঘরের ইঁদুরের বাঁশ কাটা। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ সবসময়ই অপরাজেয়। কারণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এ দলটিকে জনগণের সংগঠনে পরিণত করেছিলেন। এ দেশের মাটি মানুষ, জল-কাদায় বেড়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে হারানোর একমাত্র সূত্র হলো ঘরের ভিতর ‘বিভীষণ’ তৈরি করা। আর এ শঙ্কা তখনই বাড়ে যখন বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের বিনিময়ে এ সংগঠনে সুবিধাবাদী চাটুকারদের ভিড় বাড়ে। অবশ্য এক-এগারো আওয়ামী লীগকে একটি বড় শিক্ষা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ নয় বরং শেখ হাসিনা এক-এগারোর পর নিজেকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন। দলের পুরো নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে। সবকিছু তিনি একাই সামলাচ্ছেন। সরকার এবং দল চালাচ্ছেন একা। তাঁর এ কৌশল সঠিক না ভুল তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এর ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা একটা বৃত্তের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকছে। শেখ হাসিনা যাকে যতটুকু দরকার তাকে ততটুকু ব্যবহার করছেন। সবাই সবটুকু জানেও না। এ কারণেই আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে। শেখ হাসিনা এখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছেই এক দুর্বোধ্য বইয়ের পাতা। ২০১৪- এর নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার কৌশল ছিল আওয়ামী লীগের অজানা। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই নতুন নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা ভাবছিলেন। ২০১৮-এর নির্বাচন এভাবে হবে আওয়ামী লীগের কেউ ভাবতেও পারেনি। সাম্প্রতিক সময় শেখ হাসিনাকে অনেক দৃঢ়, সাহসী এবং প্রত্যয় দীপ্ত মনে হচ্ছে। ৭ জানুয়ারি, ১০ জানুয়ারি এবং ১১ জানুয়ারি তাঁর বক্তৃতাগুলো ভালোভাবে শুনলে বোঝা যায় তিনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী। আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ তিনি তৈরি করে ফেলেছেন। আন্দোলনের জল কোন সাগরে পড়বে সেটাও ঠিক করা। তাই ঘর থেকে বিশ্বাসঘাতকরা কিছু করবে এমনটা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার না। কিন্তু ১৪ বছরে একটা ব্যাপার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে পরিষ্কার। শেখ হাসিনাই একমাত্র প্রতিপক্ষ। তিনিই পথের কাঁটা। ইদানীং বিএনপি এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত গুজব সেল সব কামান তাক করেছে তাঁর দিকে। টার্গেট একটাই- শেখ হাসিনা। সামনের লড়াইটা তাই শেখ হাসিনার একার।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।