এডিটর’স মাইন্ড

কার অপেক্ষায় বঙ্গভবন

প্রকাশ: ১০:০১ এএম, ২১ জানুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

২১ এপ্রিল, ১৯৭৭। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম বঙ্গভবনে তার বেডরুমে গভীর নিদ্রায়। হঠাৎ বুটের শব্দ। চিৎকার চেঁচামেচি। নিদ্রা ভঙ্গ হলো রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের। ঘুম ভাঙতেই প্রচণ্ড শব্দ। কিছু সৈনিক তার বেডরুমের দরজা ভেঙে ফেলল। রাষ্ট্রপতি তখনো বিছানা থেকে পুরোপুরি উঠতে পারেননি। স্টেনগান তাক করে রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে ধরলেন সশস্ত্র সামরিক ব্যক্তিরা। নেতৃত্বে জিয়াউর রহমান। বিচারপতি সায়েম ভয়ে কাঁপছেন। বয়োবৃদ্ধ মানুষ। এরকম পরিস্থিতি ছিল তার চিন্তারও বাইরে। জিয়ার হাতে একটি কাগজ। ধমকের সুরে বললেন, ‘সাইন হেয়ার।’ রাষ্ট্রপতি একটু বিব্রত। ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কী এটা। জিয়া বললেন, ‘ইউ আর সিক। অসুস্থতার কারণে আপনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে রিজাইন করছেন।’ বিচারপতি সায়েম একটু ধাতস্থ হলেন। কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললেন, ‘আমি তো গত সপ্তাহেই স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছি। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।’ এবার জিয়া তার বুকে স্টেনগান তাক করলেন। কঠোর স্বরে বললেন ‘সাইন’। আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেখলেন উপায় নেই। জীবন অথবা রাষ্ট্রপতির পদ যে কোনো একটি তাকে ত্যাগ করতেই হবে। কম্পিত হাতে তিনি কাগজ এবং কলম তুলে নিলেন। স্বাক্ষর করলেন। কাগজটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন জিয়া। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন বিচারপতি সায়েমকে। এর মাত্র কয়েক মিনিট পর সেনাপ্রধান, সামরিক একনায়ক জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। মধ্যরাতে জিয়ার বঙ্গভবন দখলের বিবরণ উঠে এসেছে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিজের লেখা গ্রন্থে। ‘অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেস’ শীর্ষক এ গ্রন্থটি এখন বাজারে পাওয়া যায় না। এর এক বাংলা অনুবাদ আছে বটে। কিন্তু সেটি সেন্সর করা। বাংলা অনুবাদে জিয়ার বঙ্গভবন দখলের কাহিনি নেই। মূল ইংরেজি বইটি বিএনপি ’৯১ সালে ক্ষমতায় এসে নিষিদ্ধ করে। বঙ্গভবন ঘিরে স্বাধীনতার পর যত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ভাগ্য খুব সুখকর নয়। বেশির ভাগ রাষ্ট্রপতি তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দুজন রাষ্ট্রপতি সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশে যারা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাদের দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ধরনের রাষ্ট্রপতি যারা রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার আওতায়। তারা ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতাবান। এদের মধ্যে তিনজন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। যদিও তিনটি ভোটই ছিল বিতর্কিত এবং প্রহসনমূলক। অন্য এক ধরনের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন যারা সংসদীয় গণতন্ত্রের অধীনে। অনেকটা অলঙ্কারিক। এখন বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এখন অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্রের অভিভাবক তিনি। দেশের এ সর্বোচ্চ পদটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চলতি বছর একজন রাষ্ট্রপতিকে বরণ করবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। কার অপেক্ষায় বঙ্গভবন?

এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো আমরা খুব শিগগিরই পাব। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রপতি পদের অতীত ইতিহাস তিক্ততায় ভরা। নানাভাবে গণতন্ত্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হয়েছে বঙ্গভবনে। তাই বঙ্গভবনের নতুন বাসিন্দা নির্বাচন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ‘মুজিবনগর সরকারে’ রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে। তাজউদ্দীন আহমদ কৌশলগত কারণেই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর জাতির পিতা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১০ জানুয়ারি। কালবিলম্ব না করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেন। রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু। ১২ জানুয়ারি নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রায় দুই বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। এরপর ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতি হন মোহাম্মদ উল্লাহ। ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে মোহাম্মদ উল্লাহ মন্ত্রী হন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভয়াবহ ট্র্যাজেডির পর মোহাম্মদ উল্লাহ খুনি মোশতাকের অধীনে উপ-রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতি পদকে হাস্যকর বা খেলো করার ক্ষেত্রে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মোহাম্মদ উল্লাহ অন্যতম। এক সময় তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জামানত হারান। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থাকার পর একজন ব্যক্তি কীভাবে মন্ত্রী, উপ-রাষ্ট্রপতি হন? এসব ব্যক্তিত্বহীন, লোভী বঙ্গভবনে প্রবেশ করলে তা রাজনীতি এবং দেশের জন্য বিপদের কারণ হয়।

১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারির পর দেশে নতুন সরকারব্যবস্থা চালু হয়। সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু মাত্র ২০২ দিনের মাথায় দেশের প্রতিষ্ঠাতা পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বিজয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার কলঙ্কিত অধ্যায় রচিত হয় বাংলাদেশে। খুনি মোশতাকের রাষ্ট্রপতি অধ্যায়কে সর্বোচ্চ আদালত অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছেন। কাজেই খুনি মোশতাকের ৮৩ দিনের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকে আমি স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। মোশতাকের পর ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সায়েম। তার পরিণতির কথা দিয়েই এ লেখা শুরু করেছিলাম। অস্ত্রের মুখে সায়েমকে হটিয়ে সেনাপ্রধান জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। আমার বিবেচনায় এটি ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। কারণ সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় তার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা ছিল গুরুতর সাংবিধানিক অপরাধ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যে অস্ত্রের জোরে জিয়া ক্ষমতায় বসেছিলেন সেই অস্ত্রই তার করুণ পরিণতি ডেকে আনে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নির্মমভাবে নিহত হন। উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য তিনি অযোগ্য ছিলেন। বিচারপতি সাত্তারকে নির্বাচনে যোগ্য করতে সংবিধানে সংশোধনী করা হয়। ১৯৮১-এর ১৫ নভেম্বর সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে পরাজিত করে বিচারপতি সাত্তার নির্বাচনে জয়ী হন। কিন্তু বিচারপতি সাত্তার ও বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপি এবং জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। আবার আক্রান্ত হয় বঙ্গভবন। ২৪ মার্চ ১৯৮২ সালে সামরিক ক্যু সংঘটিত হয় বাংলাদেশে। গদিচ্যুত হন বিচারপতি সাত্তার। ক্ষমতা দখল করে এরশাদ পুতুল রাষ্ট্রপতি বানান। বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। কিন্তু আসল ক্ষমতার মালিক ছিলেন এরশাদ। এরশাদ তার অবৈধ স্বৈরশাসনের প্রতিটি ধাপে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলেন। ১০ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে এরশাদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এরশাদ। রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় সাত বছর দায়িত্ব পালন করেন এ সামরিক একনায়ক। যদিও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং অবৈধ ক্ষমতার দখলদার হিসেবে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ৯ বছর। এরপর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে এক স্বল্পমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। এটি ছিল স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের ফসল। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন। ’৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। প্রধান দুই দল একমত হয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থার রক্তাক্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। সংসদীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রচণ্ডভাবে সংকুচিত হয়। বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদকেই মর্যাদাহীন করে ফেলে। এ সম্পর্কে প্রয়াত ড. আকবর আলি খান তার ‘অবাক বাংলাদেশ, বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি’ গ্রন্থে ‘বঙ্গভবনে বাঁটকু : নির্বাহী বিভাগ কি ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রে’র পথে চলছে?’ শিরোনামে প্রবন্ধে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে এর খানিকটা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি :

‘‘১৯৯১ সালের শেষদিকে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসে অর্থনৈতিক পরামর্শক (Economic Minister) পদ থেকে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে যোগ দিই। অর্থ বিভাগে যোগ দেওয়ার দুই-তিন দিন পর অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি কোনো একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন এবং তাঁকে অপসারণ করে তাঁর জায়গায় জ্যেষ্ঠতম উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করে ফাইল পেশ করতে পরামর্শ দেন। আমি অফিসে ফিরে আসি এবং সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হই যে, মন্ত্রীর অভিযোগসমূহের অনেকাংশেরই সত্যতা রয়েছে। আমি যুগ্ম সচিবকে অবিলম্বে মন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে ফাইল প্রস্তুত করতে অনুরোধ করি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফাইল আমার টেবিলে চলে আসে। নথিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য একটি সারসংক্ষেপ পেশ করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পরিবর্তন-সংক্রান্ত ফাইল রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করতে হতো। কিন্তু এরশাদের পতনের পর সংবিধান সংশোধন করে মন্ত্রিসভা শাসিত সরকার সাংবিধানিকভাবে চালু করা হয়। সংবিধান সংশোধন হলেও তখনো কার্যবিধিমালা সংশোধিত হয়নি। সংবিধান সংশোধনের আগের কার্যবিধিমালায় নির্দেশ ছিল যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি লাগবে। যেহেতু তখনো সংবিধান ও কার্যবিধিমালার মধ্যে অসঙ্গতি ছিল, সেহেতু এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়োজন আছে কি না, সে সম্পর্কে ক্যাবিনেট ডিভিশনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ক্যাবিনেট বিভাগ জানায় যে, যতদিন পর্যন্ত কার্যবিধিমালা সংশোধিত না হবে ততদিন পর্যন্ত এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিতে হবে। যুগ্ম সচিব আমাকে নথি দেখালেন। আমি সন্তুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রপতির জন্য তৈরি করা সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিই।

পরের দিন মন্ত্রী অফিসে আসার পর তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে খবর দিলেন যে, আমি যেন মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে অবিলম্বে দেখা করি। আমি মন্ত্রীর কক্ষে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থমন্ত্রী আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমি কেন রাষ্ট্রপতির জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করলাম? দেশে যে মন্ত্রিসভা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেটা সম্পর্কে কি আমি অবগত নই? সেই প্রসঙ্গেই তিনি ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেন যে, আমি কি মনে করি বঙ্গভবনে উপবিষ্ট বাঁটুক সত্যি সত্যিই দেশ পরিচালনা করছেন? আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে এ কাজ করা হয়েছে বলার পর তাঁর রাগ গিয়ে পড়ল আইন মন্ত্রণালয়ের ওপর। তিনি আইন সচিবকে টেলিফোনে গালিগালাজ করলেন এবং আমাকে বললেন যে, নথি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো যাবে না। আমি বললাম, আপনি লিখে দেন যে প্রধানমন্ত্রীর জন্য সারসংক্ষেপ পেশ করা হোক। তিনি লিখে দিলেন এবং তদনুসারে আবার নথি তাঁর কাছে ফিরে গেল এবং তাঁর ও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ব্যবস্থা গৃহীত হলো।

বিভাগীয় কাজের সমাধান ঠিকই হলো, কিন্তু আমার মনে একটা বড় খটকা জেগে উঠল। তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সম্পর্ক ভালো ছিল না। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি খর্বাকৃতির ছিলেন। কিন্তু বাঁটকু শব্দটি ব্যবহার করে অর্থমন্ত্রী শুধু খর্বাকৃতিকেই পরিহাস করেননি, এর ভিতর অর্থমন্ত্রীর রাজনৈতিক দর্শনও নিহিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্ত্রিসভা শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা গৌণ। মন্ত্রিসভার সদস্যরা যদি দৈত্যের মতো ক্ষমতাবান হন তাহলে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নেহাত বাঁটকুর মতো।’’ (গ্রন্থ : অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি; পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৬)।

আবদুর রহমান বিশ্বাস ১৯৭১ সালে স্থানীয় পর্যায়ের রাজাকার ছিলেন। এর মাধ্যমে বিএনপি দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদকে গুরুত্বহীন করেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবদুর রহমান বিশ্বাস তার মেয়াদ পূর্ণ করেন। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনা সংসদীয় গণতন্ত্রকে কার্যকর করার চেষ্টা করেন। সংসদে চালু করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব। সংসদীয় কমিটিগুলোকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেন। সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদকেও মর্যাদাবান করেন শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রের অভিভাবক পদে নির্বাচন করেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। দেশের প্রথম ব্যক্তিকে শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ রাখতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে। শেখ হাসিনাই রাষ্ট্রপতিকে সম্মান জানানোর রেওয়াজ চালু করেন। বিদেশ সফর করে এসে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তাকে বিভিন্ন পরিস্থিতি অবহিত করার জন্য বঙ্গভবনে যাওয়ার রীতি চালু করেন শেখ হাসিনা। বাঁটকু রাষ্ট্রপতিকে তিনি ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতি’ করেন। ক্ষমতা বড় কথা নয়, রাষ্ট্রপতির সম্মান তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। সংবিধানের মর্যাদা এবং সাংবিধানিক পদের স্বীকৃতি প্রদানের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এর বিনিময়ে তিনি প্রতারিত হয়েছেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন রাষ্ট্রপতি হিসেবে রীতিমতো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে তিনি সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের একটি কারণ বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের বিতর্কিত ভূমিকা। তথাকথিত দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পদে আনলে কী হয়, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তার বড় উদাহরণ। ২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনে বিপুল জয় পায় বিএনপি। বিএনপি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয় দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। কিন্তু বিএনপি রাষ্ট্রপতি চায় একজন ‘বাঁটকু’। একজন গ্রহণযোগ্য, সত্যিকারের অভিভাবক রাষ্ট্রপতি বিএনপি মেনে নেয়নি। দায়িত্ব নিয়েই অধ্যাপক চৌধুরী অনেক ‘লম্বা’ হয়ে গিয়েছিলেন। এ জন্যই তাকে ছেঁটে ফেলার উদ্যোগ নেয় ক্ষমতাসীন বিএনপি। অবস্থা বেগতিক দেখে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ২০০২ সালের ২১ জুন নিজেই সরে দাঁড়ান। তার পদত্যাগের পর আরেকজন ‘বাঁটকু’ ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য খুঁজে বের করতে বিএনপি সময় নেয় ৭৭ দিন। ততদিন স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপির আবিষ্কৃত নতুন ‘বাঁটকু’ হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াজ উদ্দিন আহমেদ। বিএনপি নেতারা যাকে ‘ইয়েস উদ্দিন’ বলে টিপ্পনী কাটতেন। তিনিও সংকটকালে ব্যক্তিত্বহীন, ভাঁড়ে পরিণত হয়েছিলেন। আজ্ঞাবহ হতে গিয়ে পুরো দেশকেই সংকটের গভীরে ঠেলে দিয়েছিলেন ‘ইয়েস উদ্দিন’। দুই বছর অনির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের বুকের ওপর যে চেপে বসেছিল তার প্রধান কারণ ড. ইয়াজ উদ্দিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব। বিএনপির সবচেয়ে ক্ষতি করেছিল দ্বিতীয় বাঁটকু এ রাষ্ট্রপতি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। এবার শেখ হাসিনা বেছে নেন দলের অভিভাবক, রাজনীতিতে বিচ্যুতিহীন আদর্শবাদী নেতা জিল্লুর রহমানকে। এক-এগারোর সংকটেই অবশ্য জিল্লুর রহমান তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতার কল্যাণে জাতির একজন অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। সবার আস্থা, বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ হয়েছিল গোটা দেশ। একজন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্র নামক পরিবারের প্রধান। তার মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয় আবদুল হামিদকে। তৃণমূল থেকে বেড়ে ওঠা অন্তঃপ্রাণ এক রাজনীতিবিদ। সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলেন। সহজ সরল কথায় বঙ্গভবনের সুউচ্চ দেয়াল উপড়ে তিনি জনতার স্রোতে মিশে যেতে পারেন। আদর্শবান কিন্তু একেবারে সাদামাটা একজন মানুষ। দুই মেয়াদে প্রায় ১০ বছর তাঁর বঙ্গভবনে বসবাস এখন সমাপ্তির পথে।

স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রপতিদের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করলাম শঙ্কা থেকে। বঙ্গভবনে ভুল মানুষ যখনই প্রবেশ করেছে তখনই গণতন্ত্র হুমকিতে পড়েছে। অগণতান্ত্রিক শাসকরা একান্ত অনুগতদের বঙ্গভবনে ঢুকিয়ে সর্বোচ্চ পদকে হেয় করেছে। আমরা যেমন মোহাম্মদ উল্লাহর মতো লাজ-লজ্জাহীন রাষ্ট্রপতি চাই না, তেমনি অস্ত্র হাতে কেউ কেউ বঙ্গভবন দখল করে দেশপ্রেমের বাদ্য বাজাক তা-ও প্রত্যাখ্যান করি। আমরা যেমন নাম-পরিচয়হীন কোনো ‘বাঁটকু’ রাষ্ট্রপতি হোক চাই না, তেমনি আবার কোনো সুশীল ছদ্মবেশী সাবেক আমলা অতি নিরপেক্ষতার শক্তিতে ‘বঙ্গভবন’ বিতর্কিত করুক সেটিও চাই না। রাষ্ট্রপতি এ রাষ্ট্রের প্রথম নাগরিক। একজন রাজনীতিবিদ। আদর্শবান ব্যক্তি, যার সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক থাকবে। জনগণ যাকে আপন মানুষ ভাববে। তেমন ব্যক্তি আওয়ামী লীগের আছে। বঙ্গভবনের টিকিট তাকে দিলেই ‘গণতন্ত্র’ সুরক্ষিত হবে। ভুল মানুষের হাতে বঙ্গভবনের চাবি গেলে আবার ‘গণতন্ত্র’ নির্বাসনে যাবে। সামনে কঠিন সময়। বঙ্গভবনের বাসিন্দা নির্বাচন এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আরেকটি এক-এগারোর মঞ্চ প্রস্তুত করছে কারা?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২০ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

২৬ নভেম্বর ২০০৬। একই সাথে রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ড: ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। সংবিধানের সব বিকল্প শেষ না করেই রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলো হাইকোর্টে। একই সাথে উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা এবং চুড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে নির্বাচনী তফসীল ঘোষনা না করার সিদ্ধান্ত চেয়ে তিনটি রীট মামলা দায়ের করা হলো হাইকোর্টে। তিনটি রীট আবেদনের শুনানী চললো তিনদিন ধরে। শুনানী শেষে ৩০ নভেম্বর তিনটি রীটের উপর আদেশ দেয়ার কথা। এসময় বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আর্শীবাদ পুষ্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এক নজীর বিহীন কান্ড করে বসলেন। তিনি তিনটি রীটের শুনানীর কার্যক্রম স্থগিত করে, মামলার সব নথি তলব করলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিচার বিভাগের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপের এটি ছিলো বিএনপি-জামাতের আরেকটি বাজে দৃষ্টান্ত। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল এই ‘ভয়ংকর’ কান্ড সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আমার ২০ বছরের ওকালতি এবং ২০ বছরের বিচারক জীবনে যে মামলার শুনানী হয়ে গেছে এবং কেবল আদেশের অপেক্ষায় আছে সেখানে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ দেখিনি।” এটি প্রথম এবং একমাত্র বিচার বিভাগের কার্যক্রমে বিএনপির হস্তক্ষেপ ছিলোনা। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে ‘বিএনপির ভাবমূর্তি’ রক্ষার জন্য অন্তত ১২ বার বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতির ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির এজলাসে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সেই সময় বিএনপি এবং জামাতপন্থী আইনজীবীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা শুরু করেন ভাঙ্গচুর। চড়াও হন আইনজীবীদের উপর। বাইরে থেকে ভাড়া করা লোক এনে সন্ত্রাস চালালো সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। ভাঙ্গচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয় গাড়ী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুপ্রীম কোর্টের এই নারকীয় তান্ডব বাংলাদেশে এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক ১৭ বছর পর আবার সুপ্রীম কোর্টকে কলংকিত করলো বিএনপি-জামাত। সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে আবার তান্ডব হলো সুপ্রীম কোর্টে। ১৫ ও ১৬ মার্চ ছিলো সুপ্রীম কোর্টের নির্বাচন। ১৪ মার্চ, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সাবেক বিচারপতি সৈয়দ মনসুর চৌধুরী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাত আটটার দিকে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির কনফারেন্স কক্ষে যান বিএনপি জামাতপন্থী শতাধিক আইনজীবী। তারা ভাঙ্গচুর এবং ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই আশংকায় নির্বাচনের দিন ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। এর মধ্যেই ১৫ মার্চ সকালে বিএনপি-জামাত পন্থী আইনজীবীরা নির্বাচন বানচালের জন্য শুরু করেন আক্রমনাত্মক আচরন। তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বিকেল ৩টার দিকে শুরু হয় সহিংসতা। গত ১৫ মার্চ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনা ২০০৬ সালের নভেম্বরের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলো। তাহলে কি আবার একটি এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই সুপ্রীম কোর্ট আক্রান্ত হলো?

শুধু সুপ্রীম কোর্ট কেন? এক-এগারোর কুশীলবরা ২০০৬ এবং ২০০৭ সালের শুরুতে যা যা ঘটিয়েছিল, এখন বাংলাদেশে তার পূনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়া এখন দৃশ্যমান। এক-এগারোর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। তারা বৈঠকের পর বৈঠক করতেন। রাজনৈতিক সমঝোতার আড়ালে দুপক্ষের বিরোধকে উস্্কে দিতেন। সুশীল সমাজের সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। এখন সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কদিন আগেই বিএনপির নেতারা দল বেঁধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাদের কাছে গিয়ে নালিশের সুরে বললেন ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।’ তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী পূণ:ব্যক্ত করলেন। কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনেও নিয়মিত ধর্না দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে হিতোপদেশ দিচ্ছেন প্রায় নিয়মিত। একথা সঠিক যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক এটা সব নাগরিকের প্রত্যাশা। তারা এক উৎসব মূখর পরিবেশে ভোট দিতে চান। কিন্তু একটি দল যদি নির্বাচনে আসতে না চায় তাহলে জনগন আশাহত হওয়া ছাড়া আর কি বা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন কি কাউকে টেনে হিঁচড়ে বা হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে আনতে পারে? নাকি ক্ষমতাসীন দলই বিরোধী দলকে আদর আপ্যায়ন করে ক্ষমতায় বসাতে পারে? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি দলের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সেই দলের একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে ভোট বর্জন করেছিল। আবার ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে কোন শর্ত ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কাজেই বিএনপি তাদের তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী ২০১৮ সালেই পরিত্যাগ করেছে। এখন তারা কেন নতুন করে এই দাবী উত্থাপন করছে? বিএনপি কি নির্বাচন করার জন্য এই দাবী করছে, নাকি নির্বাচন বন্ধ করতে? দেশে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার রাজনৈতিক পটভূমি সৃষ্টির জন্যই কি বিএনপির আন্দোলন? বর্তমান সময়ে এই প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

২০০৭ সালে এক-এগারো আনার আগে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন ড: ইউনূস এবং সুশীল সমাজ। ২০০৬ সালে ড: মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার পান। এর পরপরই তিনি শুরু করেন রাজনৈতিক দলগঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু এই উদ্যোগ অংকুরেই বিনষ্ট হয়। কিন্তু ড: ইউনূস এতে থেমে থাকেননি। তিনি ‘নাগরিক সংলাপে’র আড়ালে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য মাঠে নামেন। ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ শিরোনামে এক সুশীল প্রেসক্রিপশন দেন ড: মুহম্মদ ইউনূস। মূলত: ড: ইউনূসের নেতৃত্বে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়াই ছিলো এক-এগারোর প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু শেষ মুহুুর্তে ড: ইউনূস তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হননি। তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের লিখিত গ্রন্থ ‘শান্তির স্বপ্নে, সময়ের স্মৃতি চারন’ থেকে জানা যায়; ড: মুহম্মদ ইউনূসকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বল্প সময়ের জন্য নয় বরং ১০ বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তার পছন্দের ব্যক্তি ড: ফখরুদ্দিন আহমেদকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল। এখন আবার আলোচনায় ড: ইউনূস। তার পক্ষে ৪০ জন বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বিবৃতির পর এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ড: ইউনূস হাত পা গুটিয়ে নেই। আগামী নির্বাচনে তিনি একটা ফ্যাক্টর। অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি যে চেষ্টা তদ্বির শুরু করেছেন, সেটি আর গোপন নেই। এক-এগারোর সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ছিলেন খুবই তৎপর। তাদের কথা-বার্তা, আর্তনাদ, আকুতি বলেই দিচ্ছিল যে, তারা তৃষ্ণার্ত। ক্ষমতায় আসতে চান। কিন্তু ভোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা তাদের ছিলো না। তাই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তারা। এখনও সুশীলদের তৎপরতা ২০০৬-০৭ সালের মতোই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে তাদের বেদনা যেন অন্তহীন। এখন যে সব সুশীরা গণতন্ত্র এবং সুশাসন নিয়ে কথা বলেন, এদের কেউ কেউ এক-এগারো সরকারের উপদেষ্টা, স্থায়ী প্রতিনিধি কিংবা নীতি নির্ধারক ছিলেন। তখন তারা কি করেছিলেন, যদি একটু স্মৃতির ঝাপসা হয়ে যাওয়া আয়নাটা পরিস্কার করে দেখতেন। তখন কোথায় ছিলো মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায় বিচার, আইনে শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা? এখন সেই সুশীলদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা দায়িত্ব না নিলে শিগ্্গীরই দেশটা রসাতলে চলে যাবে।

এক-এগারো আনতে যারা সক্রিয় ছিলেন সে সময় তারা আবারও তৎপর। একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই কি আবার সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। গত ১৩ মার্চ কাতার সফরের উপর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়। তিনি চাপে আছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ‘কোন চাপ নেই যা শেখ হাসিনাকে দেয়া যায়’। দেশের মানুষ জানে, কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মানুষ শেখ হাসিনা নন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঐ সংবাদ সম্মেলনে এটাও বলেছেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ সেই ষড়যন্ত্রের আলামত দেখা যাচ্ছে। সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ড, পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা, সুশীলদের দৌড়ঝাপ সব একই সূত্রে গাঁথা। সম্মিলিত শক্তি চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করতে। তাহলেই অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পথ তৈরী হবে। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান। বাংলাদেশে এখন যে গণতন্ত্র আছে তাতে অনেক দূর্বলতা দেখা যায়। অনেক সমস্যা, ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। কিন্তু এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অনির্বাচিত এবং অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে ভালো। তাই গণতন্ত্রকে বোতল বন্দী করার নীলনক্সা রুখতে হবে। যারা এক-এগারোর মঞ্চ বানানোর কাজে আদা জল খেয়ে নেমেছেন, তাদের থামাতেই হবে। অবশ্য এক-এগারোর কুশীলব দের জন্য কাল মাক্সের একটি বাণী প্রযোজ্য। মার্ক্স বলেছিলেন ‘ইতিহাসে একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি কখনো হয় না।’ তাই মাক্সীয় সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে আরেকটি এক-এগারো হবে না। অন্তত: যতোক্ষন রাজনীতির মাঠে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জেগে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘এই চোর কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না’

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৮ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

১৭ মার্চ বাংলাদেশ গভীর শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় পালন করল জাতির পিতার জন্মদিন। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। আধুনিক, উন্নত, সুখী, সমৃদ্ধিশালী এক স্বনির্ভর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের এক রূপকল্প তৈরি করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত, ধ্বংসস্তূপে পরিণত এক দেশকে পুনর্গঠনে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির পিতার অতৃপ্তি ছিল। ছিল পদে পদে বাধা। এসব বাধার কথা, উন্নয়নের শত্রুদের কথা তিনি প্রকাশ্যে বলতেন, কোনো রাখঢাক ছাড়াই। ২৬ মার্চ, ১৯৭৫ সালে মহান স্বাধীনতা দিবসে শহীদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ভাষণে তিনি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। ওই ভাষণে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, বেকার সমস্যা দূর না হয়; তাহলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ফাঁকি দেয়, সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায়, সে দুর্নীতিবাজ। যে স্মাগলিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাক মার্কেটিং করে, সে দুর্নীতিবাজ। অর্থ পাচার করে যে, সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে, তারাও দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম শুরু করতে হবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে হবে। সে দুর্গ গড়তে হবে দুর্নীতিবাজদের খতম করার জন্য। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচন করার জন্য। ... এ তো চোরের চোর, এই চোর যে কোথা থেকে পয়দা হয়েছে তা জানি না। পাকিস্তান সব নিয়ে গিয়েছে কিন্তু এই চোরদের তারা নিয়ে গেলে বাঁচতাম।’ (সূত্র : শেখ মুজিব বাংলাদেশের আরেক নাম - ড. আতিউর রহমান। পৃষ্ঠা : ২৬৭-২৬৮)

বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ অর্জন করেছে অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু এখনো সেই চোরের উৎপাত। সেই দুর্নীতিবাজদের উৎসবের নৃত্য। এই দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী লুটেরা এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা এখন দেশের অর্থনীতি, অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা। এরা এ দেশের জন্য ব্যাধি। এরা ভয়ংকর ক্যান্সার। এদের প্রতিহত করতে না পারলে আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়তে পারব না। আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তিও হবে অসম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি আট ভাগের বেশি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সম্মেলনে যোগ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে।’ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩০ বিলিয়ন ডলারের খানিকটা বেশি। এ কথা সত্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। কিন্তু যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও অনেক শক্ত অবস্থানে থাকত। যদি অর্থ পাচার বন্ধ করা যেত, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণের পাহাড় না হতো। বঙ্গবন্ধু যে ‘চোর’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, তারা এখন ‘ডাকাত’ নয়, ‘দানব’-এ পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের সব স্বপ্ন, সব অর্জন রক্তচোষার মতো চুষে খাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতেই হবে। এদের পরাজিত করতেই হবে।

বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অন্যতম অর্থ পাচারকারী দেশ। দেশ থেকে এ পর্যন্ত কত অর্থ পাচার হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছেই নেই। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অর্থ পাচারের যে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা একসঙ্গে যোগ করলে এর পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বিদেশে পাচার না হয়ে যদি এ অর্থ দেশে থাকত, তাহলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হতো ১৩০ বিলিয়ন ডলার। আমরা বিশ্বে ২০তম অর্থনৈতিক শক্তির দেশে পরিণত হতাম। অর্থ পাচার নিয়ে এখন আর কোনো লুকোচুরি নেই। সবাই জানে কারা অর্থ পাচার করেছে। কোথায় করেছে। কিছু কিছু অর্থ পাচারের ঘটনা প্রমাণিত। এই যেমন হঠাৎ করে সংসদ সদস্য বনে যাওয়া শহিদ ইসলামের কথাই ধরা যাক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে শহিদ লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য হলেন। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় মানব পাচার, ভিসা জালিয়াতি এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে তাকে গ্রেফতার করে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কুয়েতের অপরাধ তদন্ত সংস্থা আদালতে প্রমাণ করে যে, শহিদ ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচার করেছেন। চার বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে শহিদ এখন কুয়েতের কারাগারে। তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়েছে বটে। কিন্তু পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ২০২০ সালে বাংলাদেশে একজন ‘গৃহবধূ’র বিপুল বিত্তের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে। শামীমা সুলতানা জান্নাতী নামে বাঙালি এক গৃহবধূ কানাডায় ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডিয়ান ডলারে বাড়ি কিনে হইচই ফেলে দেন। জান্নাতী একজন সংসদ সদস্যের স্ত্রী। শুধু জান্নাতী কেন? কানাডায় বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে, পুরো ‘বাংলাদেশ প্রতিদিনে’ তার স্থানসংকুলান হবে না। কানাডায় আলোচিত অর্থ পাচারকারী প্রশান্ত কুমার হালদার কিছুদিন আগে ভারতে আটক হয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকার পরও প্রশান্ত অবলীলায় পালিয়ে যান। দুর্নীতি দমন কমিশন বলেছিল, প্রশান্ত কুমার হালদার ৫ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। কিন্তু ভারতে আটক হওয়ার পর জেরার মুখে প্রশান্ত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা টাকার পরিমাণ ১০ হাজার কোটির কাছাকাছি। ভারতের তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশান্ত বলেছেন, ‘এ টাকা তার না, তিনি বাহকমাত্র।’ টাকার মালিক কে সবাই জানেন। তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। কানাডায় অর্থ পাচার এবং বেগমপাড়ায় বাংলাদেশিদের বাড়ির ব্যাপারে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন খোলামেলা, রাখঢাক ছাড়াই। ২০২০ সালের নভেম্বরে এক অনুষ্ঠানে ড. মোমেন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের যে গুঞ্জন আছে, তার কিছুটা সত্যতা পাওয়া গেছে। আর প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী টাকা পাচারের ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের সংখ্যাই বেশি।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘মনে করেছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি। এ ছাড়া কিছু ব্যবসায়ী আছেন।’ অর্থাৎ কানাডায় পাচারকারীদের যাবতীয় তথ্য সরকার জানে। এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফরিদপুরের দুই অখ্যাত ছাত্রনেতা বরকত ও রুবেলের কথা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। আগে ছাত্রদল করতেন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুরের ‘জমিদার’ হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বরকত-রুবেল ছাত্রলীগ হয়ে যান। এরপর শুরু হয় ফরিদপুরে লুটপাটের রাজত্ব। ফরিদপুরে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ রাজত্বের অবসানের পর গ্রেফতার হন রুবেল-বরকত। সিআইডি জানায়, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন এ দুজন। মোশাররফ চক্রের বেশ কয়েকজনকে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। এদের বিরুদ্ধে মোট ৫ হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্যপ্রমাণ খুঁজে বের করেছে সিআইডি। কিন্তু এ টাকা উদ্ধারের কোনো অগ্রগতি জাতি জানে না। অর্থ পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) গঠন করেছে। বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০২১-২২) বলা হয়েছে, ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়ানো দেখিয়ে কোনো কোনো পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, ১০০ ডলার দিয়ে আমদানি করে তা ২০০ ডলার দেখানো হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত ১৪ বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বা সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। জিএফআইয়ের তথ্যমতে, শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চালান জালিয়াতির মাধ্যমেই ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাচার হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমদানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’, রপ্তানিতে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর লাগাম টেনে ধরেছেন আবদুর রউফ তালুকদার। এখন একটি এলসি খোলা হলে প্রস্তাবিত আমদানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য আগে যাচাই করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। নতুন গভর্নর আসার আগে বিভিন্ন আমদানি পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য দেখে ভিরমি খেতে হয়। যেমন ১ কেজি স্ট্রবেরি ফলের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে ১ হাজার ডলার! মাল্টা ও কমলা আমদানি করা হয়েছে ৮০০ ডলার কেজিতে। এসব আজগুবি মূল্যবৃদ্ধি যে স্রেফ অর্থ পাচারের জন্যই করা হয়েছে, তা বুঝতে পন্ডিত হওয়ার দরকার হয় না। এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের ফল আমদানি করা হয়েছে। এ ফল কে খেল? শুধু ওভার ইনভয়েসিং নয়, আন্ডার ইনভয়েসিং করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়েছে। এসব অর্থ পাচারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, কানাডায় বেগমপাড়াসহ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এমনকি আফসোর দ্বীপে বিনিয়োগ করা হয়েছে। গার্মেন্ট, ফল ইত্যাদি ব্যবসায় জড়িত কারা কত টাকা পাচার করেছে, কোথায় রেখেছে তা সবাই জানে। সরকারেরও অজানা থাকার কথা নয়। সিঙ্গাপুরে কোন ব্যবসায়ী পাঁচ তারকা হোটেল কিনেছেন, সে খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সিঙ্গাপুরের ধনীদের খাতায় নাম লেখানো বাংলাদেশির টাকা কোত্থেকে সিঙ্গাপুরে গেল? বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করেই কেউ কেউ থাইল্যান্ডে গড়ে তুলেছেন বিশাল সাম্রাজ্য। শুধু আমদানি-রপ্তানি কেন, মোবাইল আর্থিক লেনদেনের জালিয়াতির মাধ্যমেও বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। সিআইডির তথ্যানুযায়ী এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অনেক লুটেরা দুর্নীতিবাজ টাকা পাচার করে সুইজারল্যান্ডে রাখেন। সুইস ব্যাংকগুলোকে অনেকে অর্থ জমা রাখার নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করেন। ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা টাকার পরিমাণ ৮ হাজার ২৭৬ কোটি। ২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি। এক বছরেই সুইস ব্যাংকে পাচার করা অর্থ জমা হয়েছে ৩ হাজার কোটি। এ টাকা কারা পাচার করছে?

দেশ থেকে টাকা পাচার করে ‘কর স্বর্গ’ বা ‘ট্যাক্স হেভেন’ বলে পরিচিত দ্বীপরাষ্ট্রে কোম্পানি খুলেছেন অনেকে। এদের মধ্যে ৮৪ জনের নাম প্রকাশ করেছে ‘পানামা পেপারস’ ও ‘প্যারাডাইস পেপারস’। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) তাদের ওয়েবসাইটে ওই তালিকা প্রকাশ করেছিল বেশ আগে। এ তালিকায় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, তার স্ত্রী-পুত্রের নাম আছে। হাই কোর্টে দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী বলেছিলেন, এদের ব্যাপারে দুদক তদন্ত করছে। কিন্তু সেই তদন্তের পরিণতি কী কেউ জানেন না। যারা অর্থ পাচার করে তাদের অনেকেই সরকারের ঘনিষ্ঠ। সরকারের চারপাশে এদের বিচরণ দৃশ্যমান। এদের অনেকে একসময় বিএনপি এবং হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এখন এরা রং বদল করে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন। ইদানীং পাচার করা টাকা থেকে তারা লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতাকেও হিসসা দেন বলে শোনা যায়। ভবিষ্যৎ শঙ্কামুক্ত রাখতেই এরা দুই নৌকায় পা রাখেন। এরা দেশের স্বার্থ দেখেন না। নিজেদের বীভৎসভাবে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত।

অর্থ পাচারকারীরা যেমন ভয়ংকর ব্যাধি, তেমনি আমাদের অর্থনীতিতে আরেক ব্যাধির নাম ঋণখেলাপি। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক ভাষণে বলেছেন, ‘অনেকে ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার জন্যই ব্যাংক ঋণ নেয়। এরা খেলাপি হয় ইচ্ছাকৃতভাবে।’ রাষ্ট্রপতি যথার্থই বলেছেন, গত কয়েক বছরে কিছু ভুতুড়ে ঋণ ব্যাংকিং খাতকে এক গভীর সংকটে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী গত অর্থবছরের শেষে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্যাডসর্বস্ব, নাম-গোত্রহীন কোম্পানির নামে শত শত কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ করা হয়েছে। স্পষ্টতই বেসরকারি খাতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী তাদের চাকরবাকর, চামচা-চামুন্ডাদের দিয়ে কোম্পানি খুলে রীতিমতো ব্যাংক লুট করেছে। কেউ কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতি করে বিদেশে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির টাকা উদ্ধার হয়নি। ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন বিসমিল্লাহ গ্রুপের মালিক। ছয়টি ব্যাংক থেকে তারা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে। এখন এই গ্রুপের মালিক দুবাইয়ে বসবাস করছেন। এ রকম হায় হায় কোম্পানি হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন বিদেশে আরাম-আয়েশের জীবন কাটাচ্ছেন। আর কষ্টে আছে বাংলাদেশের মানুষ। ব্যাংকিং খাতে মালিকদের সিন্ডিকেট হয়েছে। কয়েকজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংকের মালিকানা। এরা এখন নব্য আওয়ামী লীগ হয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষায় এরা ‘চোর’।

অর্থমন্ত্রী ২০১৮ সালে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না। অর্থমন্ত্রী কথা রাখেননি। গত চার বছরে খেলাপি ঋণ দ্বিগুণ হয়েছে। এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ঋণ আর উদ্ধার হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থ পাচার বন্ধেও অর্থমন্ত্রীর টোটকা কাজে লাগেনি। গত বাজেট বক্তৃতায় পাচারকারীদের জন্য অর্থমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম আট মাসে একজনও পাচার করা অর্থের এক কানাকড়িও ফেরত আনেনি। কেউ তো আত্মস্বীকৃত চোর হতে চায় না। কাজেই ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কর দিয়ে কেউ পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ঝুঁকি নেবে না, এটা সহজেই অনুমেয়। ক্ষমা নয়, কঠোর হতে হবে। না হলে পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে দেশের মানুষ। অর্থ পাচারকারী, ঋণখেলাপি এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন জাতির পিতা। সম্প্রতি এ ক্ষেত্রে কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন। অর্থ পাচারকারী এবং ঋণখেলাপি যে-ই হোক, তাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন। সেই বার্তার সূত্র ধরেই আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রিয় নেতা আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য রাজনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। নাছিম বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে, লুটেরাদের বিরুদ্ধে, ঋণখেলাপি এবং ব্যাংক লুটেরাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এরা হলো দেশের শত্রু, শেখ হাসিনার উন্নয়ন-সমৃদ্ধির বড় বাধা। বাহাউদ্দিন নাছিমের বক্তব্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আকাক্সক্ষার অনুরণন। ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিবাজরা কারও বন্ধু হতে পারে না। এরা গণশত্রু। জাতির পিতা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, তাতে দুটি অংশ ছিল। এক. রাজনৈতিক স্বাধীনতা। দুই. অর্থনৈতিক মুক্তি। রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ যেমন ছিল রাজাকার, আলবদর এবং যুদ্ধাপরাধী। তেমনি অর্থনৈতিক মুক্তির পথে বাধা হলো দুর্নীতিবাজ, অর্থ পাচারকারী এবং ঋণখেলাপি। এরাই এ কালের যুদ্ধাপরাধী। এদের ‘না’ বলতে হবে। এদের বয়কট করতে হবে। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কখনো অর্জিত হবে না। জাতির পিতা এই চোরদের খতম করার ডাক দিয়েছিলেন। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শেষ করতে হবে তাঁর কন্যাকেই। এ যুদ্ধে শেখ হাসিনাকে জয়ী হতেই হবে। ’৭৫-এর পর বাংলাদেশে লুটেরা, কালো টাকার মালিক, দুর্বৃত্তরা মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করে। সামরিক স্বৈরাচার- একনায়কদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এই দুর্বৃত্ত-ডাকাতরা যখন যার তখন তার। সব সরকারের আমলেই এরা চাটুকারিতা করে। রাষ্ট্রের রক্ত চুষে খায়। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ খোঁজে। টানা ১৪ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এসব সুযোগসন্ধানী লুটেরার দল এখন সরকার ও আওয়ামী লীগে ভিড় করছে। এদের অতীত ঘাঁটলে দেখা যায়, এরা এরশাদের সময় লুট করেছে, হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেদের বিত্তবৈভব বানিয়েছে। এখন এরা আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে! এদের কারণে আওয়ামী লীগের ত্যাগী-পরীক্ষিতরা কোণঠাসা। টাকার জোরে এরা মনোনয়ন নেয়, অথবা তাদের পছন্দের লোকজনকে মনোনয়ন পাইয়ে দেয়। লুটেরা টাকা দিয়ে এরা আওয়ামী লীগের কমিটিতে ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে এরা বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এদের ছলনার চোরাবালিতে পা দিলে সরকারের সব অর্জন নষ্ট হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনের আগেই অর্থ পাচারকারী ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুক; এটা জনগণের প্রত্যাশা। ক্ষমতার চারপাশে কোনো লুটেরাকে জনগণ দেখতে চায় না। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই, এদের বয়কট করলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হবে। দেশ বাঁচবে। অর্থনীতি বাঁচবে। এই কঠোর অবস্থান একমাত্র শেখ হাসিনাই নিতে পারেন। অর্থ পাচারকারী, ব্যাংক লুটেরারা বাংলাদেশের ক্যান্সার। রোগ চিহ্নিত হয়েছে। এখন চিকিৎসা দরকার দ্রুত।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

কার পক্ষে খেলছেন ড. ইউনূস

প্রকাশ: ১২:০০ পিএম, ১৩ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে নতুন আলোচনা এবং বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশ্বের বরেণ্য ৪০ জন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এক খোলা চিঠি লিখেছেন। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রায় কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন আকারে গত ৭ মার্চ এ খোলা চিঠিটি প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটন পোস্টের ওই খোলা চিঠি পরে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতেও সংবাদ আকারে প্রকাশিত হয়েছে। খোলা চিঠিতে বলা হয়—নোবেল পুরস্কারজয়ী অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন অনবদ্য পরিশুদ্ধ মানুষ এবং তার কার্যক্রমগুলো বাংলাদেশ সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে। বারবার হয়রানি এবং তদন্তের মধ্যে পড়ছে। এ অবস্থায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন খোলা চিঠিতে স্বাক্ষরদাতা বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। ‘নোবেলজয়ী ইউনূসকে নিয়ে যা হচ্ছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি’ শিরোনামে এ পত্রে বেশ কিছু প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হয়েছে। চিঠির অনেক বক্তব্য খণ্ডিত, অর্ধসত্য এবং তথ্য বিকৃতির দোষে দুষ্ট। যেমন—ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে খোলা চিঠির বক্তব্যে বলা হয়েছে ‘তিনি (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। এটাকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন, যার ঋণগ্রহীতা ৯০ লাখ এবং এদের ৯৭ শতাংশ নারী।’ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি লাখো মানুষকে দরিদ্র থেকে বের করে এনেছে। এ বক্তব্যটি খণ্ডিত ও অর্ধসত্য। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, শুধু ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব নয়। এটি গ্রামীণ ব্যাংকের গবেষণাতেই প্রমাণিত হয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণের উচ্চসুদ বরং একজন গরিব মানুষকে নতুন নতুন ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। এ ঋণ চক্র থেকে বেরোতে পারে না। ড. ইউনূস যতদিন পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (২ মার্চ ২০১১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই সময়ে ঋণের কিস্তি শোধ না করতে পেরে ২৩৭ জন ঋণগ্রহীতা আত্মহত্যা করেন, ১ হাজার ৮১৫ ঋণগ্রহীতা কিস্তি পরিশোধ করতে না পেরে জেলসহ নানা আইনি জটিলতার মধ্যে পড়েন।

একইভাবে বিবৃতিতে ড. ইউনূসের গৃহঋণ প্রকল্প সম্পর্কে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। ২০০ থেকে ৫০০ মার্কিন ডলারের গৃহঋণ দেওয়া শুরু করে যা দিয়ে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি গ্রামীণ পরিবার বাড়ি নির্মাণ করেছে বলে খোলা চিঠিতে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু গৃহঋণ সংক্রান্ত গ্রামীণ ব্যাংকের সমীক্ষাতেই পাওয়া যায় ভিন্ন তথ্য। ২০১২ সালে তৈরি ওই সমীক্ষা বলছে, গৃহঋণের টাকার ৬৭ শতাংশই ব্যয় হয়েছে অন্য খাতে। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গৃহঋণের জন্য টাকা নিয়ে ঋণগ্রহীতারা তা অন্য খাতে বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশে গৃহনির্মাণ বিপ্লব করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভাবিত আশ্রয়ণ প্রকল্প। ‘মুজিববর্ষে থাকবে না কেউ গৃহহীন’—এ স্লোগানের আওতায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ গৃহহীনকে সরকার বিনামূল্যে ঘর দিয়েছে। আরও প্রায় ৫০ হাজার গৃহহীনকে ঘর দেওয়ার কাজ চলছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় একটি দুই কক্ষের বাড়ি নির্মাণ ব্যয় ২ লাখ ৭০ হাজার টাকার মতো। মার্কিন ডলারে প্রায় আড়াই হাজার ডলার। এ মূল্যও অনেক কম বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। সেখানে ৫০০ ডলারের ঘর বানানো অবাস্তব। এটি আসলে বড় ঋণ বড় মুনাফার চিরায়ত ব্যাংকিং ফর্মুলার বাস্তবায়ন।

খোলা চিঠিতে ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের গ্রামীণফোনে করা বিনিয়োগ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকম নজিরবিহীন দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীকে লভ্যাংশের টাকা না দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলা চলমান আছে। ড. ইউনূস আদালতের বাইরে মামলাটি মীমাংসার জন্য অনৈতিক পথ গ্রহণ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। একজন আইনজীবীকে ১২ কোটি টাকা উৎকোচ দিয়ে তিনি মামলা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়াও গ্রামীণ টেলিকমের ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কীভাবে অন্য অ্যাকাউন্টে গেছে যে প্রশ্নের উত্তরও ড. মুহম্মদ ইউনূস এখন পর্যন্ত দেননি। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে। অথচ বিচারাধীন বিষয় নিয়ে ড. ইউনূসের পক্ষে রীতিমতো সাফাই গেয়েছেন ৪০ জন বিশিষ্ট বিশ্বব্যক্তিত্ব। খোলা চিঠিতে তারা ড. ইউনূস সরকারের অন্যায় আক্রমণের শিকার এবং হয়রানি ও তদন্তের মধ্যে পড়ছেন বলে ‘বেদনা’ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের মূল মালিক নারী ঋণগ্রহীতাদের মালিকানা গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ নার্সিংসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কেন নেই—সে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। খোলা চিঠিটি পড়লেই বোঝা যায়, এটি ড. ইউনূস এবং তার প্রচারণা প্রতিষ্ঠান ইউনূস সেন্টার কর্তৃক প্রস্তুতকৃত। বিভিন্ন সময়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তিনি বিক্ষিপ্তভাবে যেসব যুক্তি এবং বক্তব্য দিয়েছিলেন, এ খোলা চিঠি তারই এক সম্মিলিত রূপ। এ খোলা চিঠি যাদের নামে দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠজন। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরসহ যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম এ চিঠিতে দেওয়া হয়েছে তারা সবাই প্রভাবশালী। ড. মুহম্মদ ইউনূসের পক্ষে আগেও তারা খোলামেলা অবস্থান নিয়েছিলেন। বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটন ড. ইউনূসকে ‘ফ্যামিলি ফ্রেন্ড’ হিসেবেই দাবি করেন। ২০১১ সালে যখন ড. ইউনূসকে বয়সজনিত কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব থেকে অবসরে পাঠানো হয়, তখনো হিলারি ক্লিনটন এ ব্যাপারে দেন-দরবার করেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে রীতিমতো ধমক দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শান্ত, ধীর, স্থিরভাবে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেন। প্রশ্ন হলো, এ সময়ে কেন ড. ইউনূসের পক্ষে এ রকম একটি চিঠি মার্কিন প্রভাবশালী গণমাধ্যমে পয়সা খরচ করে ছাপা হলো?

একটি কারণ স্পষ্ট। ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা গ্রামীণ টেলিকম থেকে পাচারের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে, তা থেকে ড. ইউনূসকে বাঁচাতে এই খোলা চিঠি। ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান। তিনি এ পদে থাকা অবস্থাতেই এ টাকা তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে গেছে। একটি কোম্পানির টাকা কীভাবে চেয়ারম্যানের অ্যাকাউন্টে যায়? এ নিয়ে নিরপেক্ষ এবং নির্মোহ তদন্ত প্রয়োজন। কিন্তু ড. ইউনূস বারবার এ তদন্ত বন্ধের চেষ্টা করছেন। এ তদন্ত বন্ধের জন্য তিনি উচ্চ আদালতেও গিয়েছিলেন। এ তদন্ত বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকেও সরব দেখা গেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস কিছুদিন আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে ছুটে গিয়েছিলেন। খোলা চিঠিতে এ তদন্তকেই ‘হয়রানি’ বলা হচ্ছে। তাহলে কি ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইন এবং বিচারের ঊর্ধ্বে? যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা বলে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান প্রত্যাশা করে। তাহলে ড. ইউনূসের ব্যাপারে তদন্তে আপত্তি কেন?

এ সময় এই খোলা চিঠির একটি গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। গত কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলছে। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা পালাক্রমে বাংলাদেশে আসছেন। তারা অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ দিচ্ছেন। এ দেশের সুশীল সমাজের একটি অংশও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে দেশেও এ নিয়ে একটি মতামত সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা অস্বস্তি দৃশ্যমান। বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে প্রচ্ছন্ন একটি কঠোর বার্তা অব্যাহতভাবে দিয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে আগামী নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণযোগ্য মনে করবে কি না তা এক প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলছেন, আগামী নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য কেউ কেউ চক্রান্ত করছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন। ‘নির্বাচন’ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির একটি চেষ্টা দৃশ্যমান। নির্বাচন না হলেই দেশে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। এর ফলে এক-এগারো সরকারের মতো আরেকটি সুশীল নিয়ন্ত্রিত সরকার আসার পথ সুগম হবে। কিন্তু নির্বাচন বানচাল, কিংবা সুশীলদের মসনদে বসানো একা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য দরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও মদত। সে চেষ্টাও বিএনপিসহ সরকারবিরোধী মহল দীর্ঘদিন করছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেই কি ড. ইউনূসকে মাঠে নামানো হয়েছে? সেই জন্য কি মার্কিন বিশ্বস্ত বন্ধুর পক্ষে এই খোলা চিঠি? ২০০৭ সালে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আনার পেছনে ড. ইউনূস নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছিলেন। এবারও কি সেই একই খেলায় নেমেছেন তিনি? কারণ তিনি ভালো করেই জানেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত চলবেই। কোনো চাপেই নতিস্বীকার করার মানুষ নন বঙ্গবন্ধুকন্যা। আর সে জন্যই আগামী নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এ খোলা চিঠি? আবার অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আনতে এটা কি ড. ইউনূসের প্রথম চাল?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘নব্য মোশতাক’রা মাঠে নেমেছে, সাবধান

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১১ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

১৯৭৪-৭৫ সালের সংবাদপত্রগুলোতে তাকালে কিছু খবরে চোখ আটকে যায়। পাটের গুদামে আগুন, কারখানায় রহস্যজনক বিস্ফোরণ, ডাকাতি, ঈদের জামাতে সংসদ সদস্যকে গুলি করে হত্যা, বিভিন্ন স্থানে গণবাহিনীর সন্ত্রাস, নাশকতা, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি, চোরাকারবারিদের উৎপাত। বঙ্গবন্ধু নিজেই এসব ঘটনায় বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ ছিলেন। এদের সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিলেন।  ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু এসব নাশকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন- ‘যারা মনে করেন রাতের অন্ধকারে গুলি করে কিংবা রেললাইন তুলে দিয়ে টেররিজম করে বিপ্লব হয়, তারা কোথায় আছেন জানেন না। পন্থা বহু পুরনো। পন্থা দিয়ে দেশের মানুষের কোনো মঙ্গল করা যায় না।

কিছু দিন ধরে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা আমাকে আবার সেই৭৪ এবং৭৫ সালের কথা মনে করিয়ে দিল। মার্চ বিকালে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে একটি বহুতল ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। প্রাণহানি হয়েছে বেশ কয়েকজনের। আহত হয়েছেন শতাধিক। মার্চ ঢাকার প্রাণকেন্দ্র সায়েন্সল্যাব এলাকায় একটি ভবনে প্রায় একই রকম বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণেও কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ধ্যায় আগুন লাগে। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রায় ৫০০ ঘরবাড়ি পুড়ে যায়। স্থানীয়দের দাবি, এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়। পরিকল্পিত নাশকতা। মার্চ শনিবার বিকালে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অক্সিজেন প্লান্টে বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনায় প্রাণ হারান বেশ কজন। আহত হন অর্ধশতাধিক মানুষ। মার্চ পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জলসাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ২৮ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় নান্নু স্পিনিং মিলে আগুন লাগে। প্রায় একই সময়ে আগুন লাগে আড়াইহাজারের এসপি কেমিক্যালে। ওইদিন সন্ধ্যায় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ঝুট গুদামে আগুন লাগে। ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকালে কে বা কারা আগুন লাগায় রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত গুলশান- এর একটি আবাসিক ভবনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলো কি নিছক দুর্ঘটনা? এসব ঘটনা কি বিচ্ছিন্ন? কাকতালীয়? আমার তা মনে হয় না। এসব ঘটনার পেছনে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে বলেই আমার ধারণা। জনমনে আতঙ্ক, সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা সৃষ্টির জন্য ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।৭৪ এবং৭৫ সালেও ধরনের ঘটনাগুলোকে স্রেফ বিচ্ছিন্ন বলে হালকা করা হয়েছিল। সরকারের ভিতরের লোকজনই সে সময় সত্যকে আড়াল করেছিল। এখনো ঘরের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা শত্রুরা কি একই কান্ড করছে? প্রশ্ন করছি এই কারণে যে, সরকারের মধ্যেই একটি শক্তি সরকারের সব অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যেন আদাজল খেয়ে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের উল্টো কাজ করার প্রকাশ্য প্রচেষ্টা এখন দৃশ্যমান। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অবিশ্বাস্য উন্নতি হয়েছে। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, মানব উন্নয়নেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বে অনুকরণীয় উদাহরণ। মানব উন্নয়নের মধ্যে অন্যতম হলো- ‘কমিউনিটি ক্লিনিক প্রান্তিক পর্যায়ে তৃণমূল মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য মডেল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যকমিউনিটি ক্লিনিকব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্ত। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জনগণের জন্য সহজ করা। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের দরিদ্রতম মানুষটিও স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসবে। কারণেই স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন জাতির পিতা।৭২-এর সংবিধানে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৫(), ১৬ এবং ১৮ () বঙ্গবন্ধু সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সংবিধানের ১৫ ()তে বলা হয়েছে- ‘নাগরিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব গ্রহণ করে যে কটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতি হাজার মানুষের জন্য প্রান্তিক পর্যায়ে একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক নীরব বিপ্লবের সূচনা হয়। গরিব মানুষ স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসে। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিক বন্ধ করে দিয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এই এক নিকৃষ্টতম উদাহরণ। অনাদরে অবহেলায় অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়ে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিক। শেখ হাসিনার সৃষ্টি, তাই এখানে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়। কমিউনিটি ক্লিনিকে তালা ঝুলে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো হয়ে ওঠে গরু-ছাগলের বিচরণক্ষেত্র। পরবর্তীতে অবশ্য বিএনপির তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী . খন্দকার মোশাররফ হোসেন সিদ্ধান্তকে ভুল স্বীকার করলেও আওয়ামী লীগেরনব্য মোশতাকরা বিএনপি-জামায়াতের পথেই হাঁটছে। কমিউনিটি ক্লিনিক হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আগামী অর্থবছর থেকে যেঅপারেশন প্ল্যানকরার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তাতে কমিউনিটি ক্লিনিককে বিএনপি-জামায়াত আদলে ছেঁটে ফেলার ষড়যন্ত্র চূড়ান্ত প্রায়। এটি বাস্তবায়িত হলে কমিউনিটি ক্লিনিক আলাদা কোনোঅপারেশন প্ল্যানবা ওপি দ্বারা বাস্তবায়িত হবে না। এটিপ্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবানামে নতুন কর্মসূচির পেটে ঢুকে যাবে। সংকুচিত হবে এর কার্যক্রম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে নিয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, ‘যেহেতু সরকারের অর্থ সংকট তাই কমিউনিটি ক্লিনিকে অর্থ কাটছাঁট করা হয়েছে।তার মতে, এটি নাকি সাময়িক ব্যবস্থা। কী সাংঘাতিক কথা। সরকারের অর্থ সংকটের প্রথম বলি হবে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ? মনে হলো বিএনপি-জামায়াতের প্রেতাত্মা ভর করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের ঘাড়ে। ভদ্রলোক মহাভাগ্যবান। সম্প্রতি সরকার তাকে আবারও দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে। ভাবখানা এমন যে, তাকে ছাড়া দেশের স্বাস্থ্য খাত অচল হয়ে যাবে।মহাভাগ্যবানএসব ব্যক্তি কীভাবেনাজিলহন তা আমার কাছে এক বিস্ময়। ২০০১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের চিকিৎসকদের ত্রাহি অবস্থা তখন তিনি ছিলেন নিরাপদ দূরত্বে, বহাল তবিয়তে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সময় অধ্যাপক ডা. রুহুল হক, প্রাণ গোপাল দত্ত, অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান কিংবা ডা. আবদুল আজিজের অনন্য ভূমিকার কথা আমরা জানি। আহতদের চিকিৎসার জন্য তারা হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন। সে সময় কোথায় ছিলেন এই দেবদূত? ২০০৭ সালে এক-এগারোর সময়নায়কহয়ে উঠেছিলেন কয়েকজন চিকিৎসক ব্যক্তিত্ব। শেখ হাসিনার চিকিৎসার জন্য অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, অধ্যাপক ডা. বি এম আবদুল্লাহ, অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুনের অসাধারণ তৎপরতা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। অকুতোভয় চিকিৎসকদের আমরা ঝুঁকি নিতে দেখেছি। তখন দুরবিন দিয়েও দুষ্প্রাপ্য ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের যোদ্ধা। কী বিচিত্র! কী ভয়াবহ! এরকম ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর মহান উদ্যোগের গলা টিপে ধরবেন এটাই তো স্বাভাবিক। অর্থ সংকটের কারণে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কার্যক্রম বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় কমিউনিটি ক্লিনিককে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার যুক্তি কেবল অযৌক্তিক নয়, হাস্যকরও বটে। কমিউনিটি ক্লিনিক সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানহীন মূর্খরাই কেবল ধরনের উদ্ভট আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ কমিউনিটি ক্লিনিক কেবল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয় না। কমিউনিটি ক্লিনিক জবাবদিহিতা এবং জনগণের ক্ষমতায়নের একটি রূপকল্প। কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ কর্তৃক পরিচালিত অসাধারণ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোথাও এখন নিরাপদ ডেলিভারি হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর রেফারেল পদ্ধতি এখন স্বাস্থ্য খাতের এক দৃষ্টান্ত। মজার ব্যাপার হলো- নতুন প্রস্তাবিত সেক্টর পরিকল্পনায় এমন কিছু খাত অব্যাহত রাখা হয়েছে যেগুলো অগুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থহীন। শুধু তাই নয়, এসব আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। যেমনউপজেলা স্বাস্থ্যসেবা আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারে স্বাস্থ্য খাতের প্রাণভোমরা কমিউনিটি ক্লিনিক। উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা নয়। বরং উপজেলা স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ কমানোর কথা বলা হয়েছে। অপারেশনাল প্ল্যানে যক্ষ্মা, এইডস এবং এসটিডিকে আলাদা একটি সেক্টর হিসেবে রাখা হয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে বাংলাদেশে মূল কাজটি করে ব্র্যাক, আইসিডিডিআর,বি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আলাদা করা হয়েছে বটে অথচলাইফ স্টাইল অ্যান্ড হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড প্রমোশনালকে (যেটি পুরোপুরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়) আলাদা ওপি হিসেবে রাখা হয়েছে। চমৎকার! স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো বলে একটি বিভাগ আছে। এটিকে বলা হয় দুর্নীতির আখড়া। ব্যুরোর প্রধান এবং একমাত্র কাজ হলো সরকারি অর্থ লুটপাট। একজন করে বাছাই করা মহাদুর্নীতিবাজকে এখানে লাইন ডিরেক্টর পদে বসানো হয়। ব্যুরোর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে শতাধিক মামলা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের আগের লাইন ডিরেক্টর দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড হন। বর্তমান লাইন ডিরেক্টর এসে দুর্নীতির অতীত রেকর্ড তছনছ করে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন। কাজেই এই ওপি কেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে বিলুপ্ত হবে? এটি বিলুপ্ত হলে স্বাস্থ্যের নাদুসনুদুস কর্মকর্তাদের পকেট ভরবে কীভাবে? অথচ স্বাস্থ্যবিষয়ক যে কোনো সচেতনতাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অযোগ্যতার কারণে অপারেশনাল প্ল্যানে এসব জগাখিচুড়ি হচ্ছে, এটি আমি বিশ্বাস করি না। সেক্টর প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য আবার কনসালট্যান্ট ভাড়া করা হয়েছে। সেই তালিকা দেখে ভিরমি খেতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক বিতর্কিত সচিবকে পরামর্শক হিসেবে ভাড়া করা হয়েছে। আমলা স্বাস্থ্য খাতে শাহেদ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। তিনি স্বাস্থ্য সচিব থাকা অবস্থায় পিপিই কেলেঙ্কারি, মাস্ক কেলেঙ্কারির মতো ঘটনাগুলো ঘটেছিল। শাহেদ, সাবরিনা, আরিফ তারই আবিষ্কার। শিয়ালের কাছে মুরগি বন্ধক দেওয়ার মতোই স্বাস্থ্য খাতে পঞ্চম সেক্টর প্রোগ্রাম প্রস্তুতকরণে তাকেই দেওয়া হয়েছে পরামর্শকের দায়িত্ব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বহু যোগ্য সাবেক সচিব রয়েছেন, যারা মন্ত্রণালয়ে সততা, নিষ্ঠা দায়িত্বশীল কাজের জন্য এখনো প্রশংসিত। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, সিরাজুল হক খান, মো. আবদুল মান্নান মন্ত্রণালয়ে আলোচিত সৎ সচিব ছিলেন। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে কেন দুর্নীতির কাদামাখা বিতর্কিত আমলাকে পরামর্শক নিয়োগ করা হলো সে- এক রহস্যময় প্রশ্ন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক দাবি করেছেন- সেক্টর প্রোগ্রাম এখনো প্রস্তাবিত, এটি চূড়ান্ত নয়। শেষ পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক আলাদা সেক্টর হিসেবে থাকতেও পারে। কিন্তু তাতে কী? অভিপ্রায় প্রমাণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তারা কমিউনিটি ক্লিনিককে কী চোখে দেখেন প্রধানমন্ত্রীও ভালো করেই জানতেন, বিএনপি-জামায়াতই তাঁর স্বপ্ন বিনষ্টের একমাত্র প্রতিপক্ষ। দলের ভিতরও এরকমবিভীষণআছে। ভবিষ্যতে কেউ যেন কমিউনিটি ক্লিনিককে ধ্বংস করতে না পারে সে কারণেই তিনি কমিউনিটি ক্লিনিক সহায়তা ট্রাস্ট আইন করেন। আইনের আওতায় কমিউনিটি ক্লিনিক দেখভালের জন্য ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে। কিন্তু ট্রাস্টকেও অকার্যকর এবং বিকলাঙ্গ করে রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ভাগ্যবান এবং প্রবল ক্ষমতাবানও বটে। তিনি নিজেকে সবচেয়ে সফল স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি করেন। সব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। ভাগ্যিস দেশের মানুষেরগোল্ড ফিশমেমোরি। আমার মনে হয় দেশের মানুষের স্মরণশক্তি গোল্ড ফিশের চেয়েও স্বল্প। আলতো ঘুমে এক কাত থেকে অন্য কাত হলে যেমন মানুষ স্বপ্ন ভুলে যায়, ঠিক তেমনি দেশের মানুষও দ্রুত অতীত ভুলে যায়। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। তেমনি আবছা, অস্পষ্ট হয়ে গেছে স্বাস্থ্য খাতে ২০২০ সালের সীমাহীন অনিয়ম এবং দুর্নীতি। ভুলে গেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সীমাহীন অযোগ্যতা এবং ব্যর্থতার কথাও। তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখনো অবলীলায় বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ান। আশির দশকে শেখ হাসিনা যখন স্বৈরাচারের পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গ্রেফতার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন নূর হোসেন, জয়নাল, জাফর দিপালী, কাঞ্চন, সেলিম-দেলোয়ার, সেই সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বৈরাচারের একান্ত দোসরের আদুরে সন্তান হিসেবে বিলাসী জীবনযাপনে সময় কাটিয়েছেন। ২০০৮-এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্কই ছিল না বলতে গেলে। তিনিই আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বছর মন্ত্রী। ইদানীং আবার আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এভাবেই স্বৈরাচারের ভূত আওয়ামী লীগের সঙ্গে লতাপাতার মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। এরকম হঠাৎ আওয়ামী লীগাররা কমিউনিটি ক্লিনিকের বিপক্ষে হাঁটবেন তো অনিবার্য। খন্দকার মোশতাক যেমন বঙ্গবন্ধুর নাম জপতেন সারাক্ষণ তেমনি সরকারের কিছু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা প্রভাবশালী মন্ত্রী সারাক্ষণ শেখ হাসিনার নাম জপেন। অবশ্য কাজ করেন ঠিক উল্টো। প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি যুগান্তকারী উদ্যোগআমার বাড়ি, আমার খামার৯৬ সালে মানব উন্নয়ন উদ্ভাবনটি শুরু হয়েছিল। তখন তার নাম ছিল- ‘একটি বাড়ি একটি খামার।২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচিও বন্ধ করে দেয়। ২০০৯ সালে আবার শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে কর্মসূচি চালু করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এক প্রভাবশালী আমলার হাতে এর সর্বনাশ হয়। তিনি তার প্রিয়ভাজন এক দুর্নীতিবাজ আমলাকে দেন এর দায়িত্ব। ওই প্রভাবশালী কর্মকর্তার আগ্রহে ওই দুর্নীতিবাজ সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। সময় তার দুর্নীতির প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল- ‘একটি বাড়ি একটি খামার সে সময় ওখানে দুর্নীতি এমনই ওপেন সিক্রেট ছিল যে, প্রকল্পের নামই হয়- ‘একটি বাড়ি, একটি খামার, অর্ধেক আমার অর্ধেক তোমার।এখন প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উদ্যোগের একটি প্রকল্পটি উপেক্ষিত। এটিকেও হত্যার চেষ্টা চলছে নীরবে।আশ্রয়ণপ্রধানমন্ত্রীর আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মুজিববর্ষে থাকবে না কেউ গৃহহীন- সংকল্পে আশ্রয়ণ প্রকল্প নতুন গতি পায়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সৎ এবং আদর্শবান মাঠ কর্মকর্তারা কাজ করেছেন, সেখানে গৃহহীনদের ঘরগুলো ঠিকঠাক মতো হয়েছে। আর যেখানে নব্য মোশতাকের দোসররা মাঠ প্রশাসনে আওয়ামী লীগ সেজে কাজ করেছে, সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বারোটা বেজেছে। প্রশাসনের সর্বত্র এখন নব্য মোশতাকদের আধিপত্য দৃশ্যমান। রাজাকার পরিবার, বিএনপি-জামায়াত আদর্শে বেড়ে ওঠা কিংবাযখন যার তখন তারগোছের সুবিধাবাদীরা আমলাতন্ত্রে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে আছেন। জাহাঙ্গীর আলম, খাজা মিয়ার মতো দুঃসময়ে আদর্শ বিকিয়ে না দেওয়া আমলারা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে কোনোমতে টিকে আছেন।

৭৪-৭৫ এর মতো যে নিয়ম করে বিভিন্ন স্থানে আগুন লাগছে তা নয়, ওই সময়ের মতোই চাটুকার সুবিধাবাদীরা ঘিরে ফেলেছেন সরকারের চারপাশ। ত্যাগী, পরীক্ষিত, দুঃসময়ের কান্ডারিরা আজ অবহেলিত, কোণঠাসা। অনেকটাই তাজউদ্দীনের মতো। এটা শুধু সরকার এবং প্রশাসনে নয়, আওয়ামী লীগেও ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। আর কারণেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বিপরীত পথে অনেক ক্ষেত্রেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ সরকার। অর্থ পাচারকারীরা কারণেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। এদের সঙ্গে সরকারের কাদের প্রকাশ্য গোপন সম্পর্ক আছে সবাই জানে। ব্যাংকের টাকা লুট করছে কারা? নব্য আওয়ামী লীগের হয়ে যারা চাটুকারিতায় চ্যাম্পিয়ন তারাই।  এরাই নব্য মোশতাক। এরা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সব অর্জনকে ম্লান করে দেওয়ার ভয়ংকর খেলায় মেতেছে। আওয়ামী লীগ বাইরের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে পারে। কিন্তু ঘরের ষড়যন্ত্রকারীদের কাছেই হেরে যায়।  তাই যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনাকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করেন, লালন করেন, তাদের সতর্ক হতে হবে। নির্ঘুম অতন্দ্র প্রহরীর মতো বারবারই বলতে হবে- ‘নব্য মোশতাকরা মাঠে নেমেছে। সাবধান, হুঁশিয়ার।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অর্থ পাচারকারীরা একালের যুদ্ধাপরাধী

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

মার্চ মাস বাঙালির আবেগের মাস। স্বাধীনতার মাস। ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তি ও স্বাধীনতা বলতে জাতির পিতা রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেছিলেন। ৭ মার্চ জাতির পিতার দেখানো পথেই বাঙালি এগিয়ে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে চালায় নির্মম, নৃশংসতম বর্বরতা। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হওয়ার পরও মাথা নোয়ায়নি বীর বাঙালি। জাতির পিতার নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। আমরা পাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। রক্তে রঞ্জিত পতাকা, মানচিত্র। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই জাতির পিতার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। অর্থনৈতিক মুক্তি। একটি স্বনির্ভর স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। যেখানে সব মানুষ তার মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে। বিশ্বে বাঁচবে সম্মানের সঙ্গে। মাথা উঁচু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সে পথেই গড়ার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ৭৫-এর ১৫ আগস্টের জঘন্যতম ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ঝাপসা হয়ে যায় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। বাংলাদেশ একটা পর মুখাপেক্ষী, পরনির্ভর রাষ্ট্র হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা বলেছিল, ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’; কিংবা যেসব অর্থনীতিবিদ এ দেশ সম্পর্কে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে দারিদ্র্যের মডেল’—তাদের ভবিষ্যদ্বাণী যেন সত্য প্রমাণিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ হারে না। বাঙালি বিজয়ী জাতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই শেখ হাসিনা শুরু করেন জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার সংগ্রাম। শুরু করেন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের দ্বিতীয় যুদ্ধ। ২০০৯ সাল থেকে এই যুদ্ধে দৃঢ়ভাবে লড়াই করছে বাংলাদেশ। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এই যুদ্ধ একটু অন্যরকম যুদ্ধ। শেখ হাসিনা এ যুদ্ধের সেনাপতি। প্রবাসে থাকা রেমিট্যান্স পাঠানো কর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, সোনার ফসল ফলানোর কৃষক, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা হলেন এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা। যে ভাই বা বোনটি প্রবাসে কঠিন পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তিনি এ যুদ্ধে সাহসী সৈনিক। গার্মেন্টসে যে বোনের নিপুণ বুননে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তিনি এই যুদ্ধের যোদ্ধা। যাদের পরিশ্রমে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, তারাই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আর এ যুদ্ধটা অনেকটাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতোই।

’৭১-এ যেমন রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ক্রীতদাস রাখার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল এ দেশের রাজাকার, আলবদর এবং যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী। এ যুদ্ধেও বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিপক্ষ আছে। এরাও ’৭১-এর মতো বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তির প্রতিপক্ষ। এরা বাংলাদেশকে পরমুখাপেক্ষী রাখতে চায়। পরনির্ভর রাখতে চায়। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু রাখতে চায়। গার্মেন্টসকর্মী, রেমিট্যান্সযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীরা যদি একালের মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তখনকার রাজাকার, আলশামস, আলবদর আর যুদ্ধাপরাধী কারা?

এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের উন্নয়নের চিত্রটা একটু বিশদ বিশ্লেষণ করতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের বিপ্লব হয়েছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল—বাংলাদেশের উন্নয়নের একেকটি স্বারক চিহ্ন। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন কেন? কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, প্রবৃদ্ধির হার সবকিছুই ঈর্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে শঙ্কা, তা থেকেও আমরা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারতাম। তিনটি কারণে আমাদের অর্থনীতি এখন সংকটে। তিন ত্রুটির জন্য এখনো আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি বা জাতির পিতার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার দ্বিতীয় ধাপ অর্জন করতে পারিনি। এ তিন ব্যাধি হলো—দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপি। এ তিনটি ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারলেই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। দুর্নীতি যে আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম শত্রু তা চিহ্নিত করেন জাতির পিতা। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পিরোজপুর শহরের গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের নিকট ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্ট কার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন। আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ নীতি এবং আদর্শে অটল বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা এখনো সক্রিয়। দুর্নীতিবাজরা একালের রাজাকার। প্রশাসনে, রাজনীতির মধ্যে দুর্নীতিবাজরা শক্ত শেকড় দৃশ্যমান। এ শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা সম্ভব নয়।

একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে, বাংলাদেশ থেকে যদি বিপুল অর্থ পাচার না হতো তাহলে আমরা অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতাম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সুইস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে জমার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকেই পাচার হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য দেশে অর্থ পাচারের হিসাব যোগ করলে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে আমরা সবাই জানি। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে এরকম ৪৩ জন অর্থ পাচারকারীর নাম এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ডলার সংকটের মুখে সরকার অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ ছাড় দেয়। পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাও ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। অর্থ পাচারকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা একালের যুদ্ধাপরাধী। কারণ, আমরা যতই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি, যতই উপার্জন করি না কেন, অর্থ যদি পাচার হয়ে যায়, তাহলে কিছুতেই আমরা আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারব না। আমরা স্বাবলম্বী হতে পারব না। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি থেকেই যাবে।

আমাদের মুক্তির সংগ্রামের তৃতীয় শত্রু হলো ঋণখেলাপি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সম্প্রতি এক ভাষণে ঋণখেলাপিদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ কেউ ইচ্ছে করেই ঋণখেলাপি হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নেয় পরিশোধ না করার জন্য।’ তার এ বক্তব্য যে কতটা নির্মম বাস্তবতা, তা বোঝা যায় ব্যাংকের ঋণখেলাপির হিসাব থেকেই। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত তিন মাসে শুধু খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে কথাই হয়েছে শুধু। অর্থ উদ্ধারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ভয়ংকর রোগ। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার জন্যই ঋণ নেন, তারা একালের রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী। এদের জন্যই মুক্তির সংগ্রামে এখনো আমরা বিজয়ী হতে পারছি না।

মার্চ মাস আমাদের দ্রোহের মাস। সংকল্পের মাস। নতুন মুক্তিযুদ্ধে তাই এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে। নব্য রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত না করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারব না। স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কিংবা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কোনোটাই অর্জন করা যাবে না।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন