এডিটর’স মাইন্ড

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে কু-তর্ক এবং এক-এগারোর কুশীলবদের স্বপ্নভঙ্গ

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

গোপাল ভাঁড় পড়লেন মহাফাঁপরে। ‘বল তো দেখি গোপাল সত্য থেকে মিথ্যা কত দূর?’ প্রশ্ন করলেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র। মাথা চুলকিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে গোপাল নিবেদন করল ‘আজ্ঞে মহারাজ এদের দূরত্ব খুবই কম।’ ‘কী বলছ তুমি?’ গর্জে উঠলেন কৃষ্ণচন্দ্র ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’ ‘অপরাধ মার্জনা করবেন মহারাজ। প্রভুর চোখ থেকে কান যত দূর সত্য থেকে মিথ্যার দূরত্ব তার বেশি নয়। কানে যা শোনা যায় তার বেশির ভাগই সত্য নয়। চোখে যা দেখা যায় তা হলো সত্য।’  গোপালের উত্তরে খুশি হয়ে মহারাজ গোপালকে অনেক ইনাম দিলেন। ভাগ্যিস গোপাল ভাঁড় একালে জন্মগ্রহণ করেননি। তাহলে তিনি দেখতেন, চোখে যা দেখা যায় তাও অধিকাংশ মিথ্যা। ইউটিউব, ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু নয়, মূলধারার কিছু গণমাধ্যম যেন মিথ্যার দোকান খুলে বসেছে। সত্য আর মিথ্যার দূরত্ব সামান্য নয় বরং মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। জ্ঞানী পন্ডিতরাও সত্যের মোড়কে মিথ্যার ব্যবসা করছেন। নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। ১৩ ফেব্রুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিন্ডিদ্র গোপনীয়তা নিশ্চিত করেছেন। ১২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও ছিলেন অন্ধকারে। সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদের নাম গণমাধ্যমে এসেছে, তারা সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানামুখী আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তাদের নিয়ে নানা অবাস্তব, অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য প্রচার করা হয়েছে। স্পষ্টতই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভ-ুল করতে নতুন রাষ্ট্রপতিকে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন কেউ কেউ। একটি মহল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে চায়। এ জন্য নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়ে জল ঘোলার সব আয়োজন করে রাখা হয়েছিল।

এ কারণেই গোয়েবলসীয় অপপ্রচার থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখা হয়েছিল নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে। এতে ষড়যন্ত্রকারীদের হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে যায়। অন্ধকারে তথ্য হাতড়াতে থাকেন মহান সুশীলরা। কিন্তু আমাদের সুশীলরা বিরল প্রজাতির মেধাবী। সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। যে কোনো স্বাভাবিক সুন্দর সিদ্ধান্ত বিতর্কিত করতে এরা জুয়েল আইচের চেয়েও বড় জাদুকর। নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। আর সুশীলরা তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন না, তা কী করে হয়। সাগর সেচে মুক্তা খোঁজার মতো তারা নতুন রাষ্ট্রপতির খুঁত বের করার চেষ্টা শুরু করলেন। এই চেষ্টায় ‘সফল’ হলেন এক-এগারোর কুশীলবদের একজন এবং এক-এগারোর মুখপত্র একটি পত্রিকা। একদিনে একই বিষয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হলো। দুটির বিষয়বস্তু একই। নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি যেহেতু আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার পদে ছিলেন, সেহেতু দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৯ ধারা তার জন্য প্রযোজ্য হবে। ‘কমিশনারগণের অক্ষমতা’ সংক্রান্ত ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কার্যাবসানের পর কোনো কমিশনার প্রজাতন্ত্রের কার্যে কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।’ এ সূত্র ধরে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে ওই সুশীল পন্ডিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের সলতে জ্বালিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হলো মাতম। শুরু হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সাংবিধানিক বিতর্ক। অবশ্য আমি একে বিতর্ক না বলে কুন্ডতর্ক বলতে চাই। কারণ একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে গায়ের জোরে তর্ক তো কু-তর্কই। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবে না।’ অর্থাৎ সরকার তাকে কোনো লাভজনক পদে ‘নিয়োগ’ দিতে পারবে না। প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রপতি কি নিয়োগপ্রাপ্ত? সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন।’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, নিয়োগপ্রাপ্ত হন না। রাষ্ট্রপতি সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি। তাঁকে কে নিয়োগ দেবে? তাঁর নিয়োগপত্রে কে স্বাক্ষর করবেন? তাই দুদক আইনের ৯ ধারা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

এবার দেখা যাক, রাষ্ট্রপতি পদটি লাভজনক কি না। বিষয়টি সংবিধানের ১৪৭ (৩) অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করা হয়েছে। সংবিধানের ১৪৭(৪) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ লাভজনক পদ বা মর্যাদার বলে গণ্য হবে না বলে বলা হয়েছে। কাজেই সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নয়।

সংবিধানের ৪৮(৪) খ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য না হন, সেক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা এবং অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। ৬৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,... ‘কোনো ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী হওয়ার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য হবেন না।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি পদ যে লাভজনক নয় তা সংবিধানেই সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এর মধ্যে ন্যূনতম যদি, কিন্তু, তবে নেই। তারপরও কথা থাকে। সংবিধানের বিভিন্ন অস্পষ্টতার ব্যাখ্যা দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। যেহেতু সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তাই তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না বলে কেউ কেউ দাবি করেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রপতি পদটি ‘লাভজনক’। এরকম যুক্তি দিয়ে হাই কোর্টে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। ওই রিটে হাই কোর্ট রায় দেন রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নয়। এরপর এ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু সুশীল বলে কথা। তারা নিজেরা আইনের শাসনের কথা বলেন অথচ তারাই সবচেয়ে আইন লঙ্ঘন করেন। আমাদের সুশীলরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলেন। অথচ যখন কোনো সুশীল নিয়ন্ত্রিত সরকার ক্ষমতায় এসেছে তখনই বিচার বিভাগকে নিজেদের অনুগত করতে চেয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধ করতে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করেছে। এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু ড. ফখরুদ্দীনের অনির্বাচিত সরকারের অনন্তকাল দেশ পরিচালনার খায়েশ ক্রমশ দৃশ্যমান হতে থাকে। অনির্বাচিত সরকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে এক সুশীল শিরোমণি হাই কোর্টে গিয়ে সাংবিধানিক ফতোয়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘নতুন নির্বাচন না দেওয়া পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকলে সংবিধানের কোনো লঙ্ঘন হবে না।’ বাস্তবে দুই বছর ড. ফখরুদ্দীন সরকারের ক্ষমতায় থাকা ছিল অসাংবিধানিক। এবার আবারও সেই একইভাবে তাদের মতো করে সংবিধানের অপব্যাখ্যা দিলেন একই সুশীল গোষ্ঠী। এই সুশীলই কদিন আগে ‘কয়েক বছর নির্বাচিত সরকার থাকলে কোনো অনিষ্ট হবে না’-এই মর্মে জাতিকে জ্ঞান দিয়েছিলেন। সংবিধানে রাষ্ট্রপতি পদ যে লাভজনক নয়, তা সুস্পষ্ট। এ ব্যাপারে সংবিধানে কোনো ফাঁকফোকর নেই। যিনি বা যারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন, তারা জ্ঞানপাপী বটে, কিন্তু অশিক্ষিত, মূর্খ নন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অজ্ঞতাপ্রসূত নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আরেকটি এক-এগারো আনার নিরন্তর প্রচেষ্টার অংশ এই কু-তর্ক। প্রায় এক বছর ধরেই এক-এগারোর কুশীলবরা সরব এবং সক্রিয়। তারা দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে নানা রকম অসত্য-বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সুশাসন, গণতন্ত্র, দুর্নীতির মতো দাতাদের জন্য নানা মুখরোচক ইস্যুকে সামনে আনছে। রাষ্ট্র মেরামত কাঠামোর কথা বলে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করতে চাইছে। বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অগ্নিসন্ত্রাস, সহিংসতায় উসকে দিচ্ছে। জনগণের মধ্যে আতঙ্ক অস্থিরতা সৃষ্টিই তাদের লক্ষ্য। সুশীলরা চাইছে রাজনৈতিক সহিংসতা। জ্বালাও-পোড়াও। অগ্নিসন্ত্রাস। একজন সাবেক আমলা, দুর্বলচিত্তের ব্যক্তিত্ব বা সুশীলদের পছন্দের কোনো মানুষ রাষ্ট্রপতি হলে ষড়যন্ত্রের সুড়ঙ্গটা পরিষ্কার হতো। সুশীলরা কেউ কেউ আশা করেছিলেন, নতুন রাষ্ট্রপতি গোপনে সুশীলদের সঙ্গে আঁতাত করবেন। অথবা ভয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। চাপে ভেঙে পড়বেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রপতির নাম সুশীলদের ডায়েরিতে ছিল না। প্রধানমন্ত্রী যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যাপারে এভাবে চমকে দেবেন, তা তারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করেছেন যিনি নতজানু হবেন না। প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না। সুশীলদের ক্রীড়নকে পরিণত করা যাবে না নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে। বন্দুকের নলেও তিনি আদর্শ বিকিয়ে দেবেন না। তাঁর অতীত এই বিশ্বাসকে প্রোথিত করেছে। কেউ কেউ মনে করতেই পারেন, রাষ্ট্রপতি পদ তো এখন অলঙ্কারিক। এ নিয়ে এত হিসাব-নিকাশের কী আছে। নির্বাচন, গণতন্ত্র রক্ষায় রাষ্ট্রপতি কী বা করতে পারেন? গণতন্ত্র আক্রান্ত হয় রাষ্ট্রপতিকে ভর করেই। এক-এগারো তার শেষ উদাহরণ। 

নতুন রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল। একটা চ্যালেঞ্জিং সময়ে তাঁকে দেশের প্রথম নাগরিক হিসেবে অভিষিক্ত হতে হবে। দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য তাই নতুন রাষ্ট্রপতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে গণতন্ত্র সুরক্ষার জন্য নতুন রাষ্ট্রপতির কিছু যোগ্যতা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে যখন নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র। আরেকটি অনির্বাচিত সরকার আনার তোড়জোড়।

এমন একজন রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন ছিল যিনি তৃণমূল থেকে উঠে আসা। বিশেষ করে মো. আবদুল হামিদের বিচক্ষণ অভিভাবকত্বের পর এই প্রত্যাশার পারদ অনেক বড় হয়েছিল গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনীত করেছেন, যিনি তৃণমূল থেকে গড়ে ওঠা। পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা যুবলীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন প্রতিকূল সময়ে। নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়ে দ্বিতীয় প্রত্যাশা ছিল পরীক্ষিত এবং আদর্শের প্রশ্নে অটল কেউ যেন রাষ্ট্রপতি হন। আদর্শবান এবং দুঃসময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাড়া কেউ রাষ্ট্রপতি হলে কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবেন না। শেখ হাসিনা এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করেছেন, যিনি আদর্শের পরীক্ষায় শুধু উত্তীর্ণই নন, বরং দৃষ্টান্ত। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এরপর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী ছিলেন বিভ্রান্ত। প্রতিবাদহীন। দিকভ্রান্ত। এ সময় সারা দেশে যে গুটিকয় নেতা জাতির পিতার হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু অন্যতম। প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন। কারাবরণ করেছেন। ’৭৫-পরবর্তীতে কোনো সংকটেই তিনি বিভ্রান্ত হননি। সঠিক পথেই হেঁটেছেন আজীবন, অবিচল।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তৃতীয় প্রত্যাশা ছিল যিনি ব্যক্তিত্ববান, মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেন। হুমকিতে ভয় পান না।  মো. সাহাবুদ্দিন তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব। এর প্রমাণ তিনি দিয়েছেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে। এ সময় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের নাটক শুরু হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সফর করেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন। এ সময় দুদকের পক্ষ থেকে আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন কমিশনার মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। তিনিই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন, পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। বিশ্বব্যাংকের চাপে তিনি নতজানু হননি। ভয় পাননি। অতীতে গ্রামের রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী অথবা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের চাকরি করা সুবিধাবাদীরা রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। এরা এই সর্বোচ্চ পদকে কলঙ্কিত করেছেন। জিল্লুর রহমান, মো. আবদুল হামিদের মতো মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি পদকে দিয়েছেন মর্যাদা। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাই যেন রাষ্ট্রের অভিভাবক হন, এই প্রত্যাশা ছিল সবার। নতুন রাষ্ট্রপতি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

রাষ্ট্রপতি দলমতের ঊর্ধ্বে। তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবকও বটে। তাই রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশার দিকে লক্ষ্য রাখাটাও জরুরি। সাধারণ মানুষ কেমন রাষ্ট্রপতি চেয়েছিলেন? সাধারণ মানুষের প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগের পছন্দের নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কতটা পূরণ করতে পেরেছেন?

সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে চান, একজন বিতর্কহীন ব্যক্তি। যার কর্মজীবনে বড় কোনো বিতর্ক নেই। মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু তেমনি একজন ব্যক্তি। বিচারক হিসেবে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিষ্কলুষ এবং বিতর্কহীন। কর্মজীবনে সেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই তিনি নিজেকে উজ্জ্বল করে মেলে ধরেছেন। জনগণের দ্বিতীয় প্রত্যাশা হলো রাষ্ট্রপতি যেন বিনয়ী, কথাবার্তায় মার্জিত হন। মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর কর্মজীবনে এবং অবসরে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সব সময় তাঁর বাচনভঙ্গি মার্জিত এবং সংযত ছিল। দায়িত্বহীন বিতর্কিত মন্তব্য করে তিনি কখনো হইচই পাকাননি। একজন পরিপাটি রুচিশীল ব্যক্তি হিসেবেই তিনি পরিচিত।

সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দলমতের ঊর্ধ্বে একজন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি চান। তিনি যে কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী থাকতেই পারেন। যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে তাঁর নিজস্ব মত থাকতেই পারে। কিন্তু তিনি এমন একজন ব্যক্তি হবেন, যিনি সবার মতামতের গুরুত্ব দেবেন। সব পক্ষের কথা শুনবেন। বিচারক হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে এরকম একটি অবস্থানেই থাকতে হয়েছে দীর্ঘকাল। তাঁর কর্মজীবনে তিনি দলীয় আদর্শের উগ্র প্রকাশ কখনই দেখাননি। নিজের বিশ্বাসের প্রতি অটল থেকেও তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার প্রমাণ ১৯৯৫ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিসের মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়েই পাওয়া যায়।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাই যখন সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় তখন মানুষের মধ্যে বিস্ময় ছিল, হতাশা ছিল না।

দায়িত্ব গ্রহণের পরই বোঝা যাবে মো. সাহাবুদ্দিন কতটা দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর অতীত বলে তিনি গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য এক অকুতোভয় অভিভাবক হিসেবেই দায়িত্ব পালন করবেন। শেখ হাসিনা আবারও প্রমাণ করলেন তিনি পাকা জহুরি। সবার প্রত্যাশাগুলোকে মাথায় রেখে তিনি যেভাবে নতুন রাষ্ট্রপতির নাম বেছে নিয়েছেন, তা তাঁকে আরও নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেল।

অনেক হিসাব-নিকাশ করেই শেখ হাসিনা নতুন রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত করেছেন। এতে এক-এগারোর কুশীলবদের পাশার দান উল্টে গেছে। তারা বুঝে গেছেন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন হবেন না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন হবেন না। ভয়ে বা প্রলোভনে তিনি সুশীলদের ক্ষমতা দখল করতে দেবেন না। সুশীলদের আরেকটি এক-এগারোর স্বপ্ন ক্রমশ ধূসর এবং ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকেই তাদের রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না-সে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা। সুশীলরা ভেবেছিল হুজুগ তুলে যেভাবে তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার সংকটে বলে অপপ্রচারকে বিশ্বাসযোগ্য করেছে ঠিক একইভাবে সংবিধানের ভারী এবং কঠিন ব্যাখ্যা দিয়ে তারা রাষ্ট্রপতিকেও হটিয়ে দেবে।  সুশীলরা ভালো করেই জানেন, আবদুল হামিদের মতো মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি থাকলে আরেকটি এক-এগারো সম্ভব না।

সংবিধানের ৭(ক) যুক্ত করে প্রধানমন্ত্রী অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের পথ চিরতরে বন্ধ করেছেন।  আর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চমক দেখিয়ে তিনি বঙ্গভবনে ষড়যন্ত্রের দরজা বন্ধ করলেন।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘ধোঁকা’ ধাক্কায় গর্তে বিএনপি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।

সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন, বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন? হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।

আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত, এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে, তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়। মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি। বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি বিপর্যস্ত হয়েছে।

২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২ বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে। ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।

এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর দেশ পরিচালনা করল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায় নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন। মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন। এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায় ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায় মুখ লুকান।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।



লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


বিএনপি   বিএনএম   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে সুবিধাবাদীদের ভীড় এবং সাকিব

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ২২ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ? এই আওয়ামী লীগ কি জাতির পিতার আদর্শের দল? এই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা কি শেখ হাসিনার মতো সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের জন্য? নাকি আওয়ামী লীগকে এখন গ্রাস করছে সুবিধাবাদী, চাটুকাররা। আওয়ামী লীগে অতিথি পাখিদের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দুঃসময়ের কান্ডারীরা? এই প্রশ্নগুলো নতুন করে সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপির বহুরূপী নেতা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ছবি দেখে। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ নির্বাচনের আগে বিএনপি ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন এই তথ্য পুরোনো। বিএনএম নামে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা একটি কিংস পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের কথা ছিলো তার। এজন্য বিভিন্ন দলের লোকজনকে জড়ো করার কাজেও হাত দিয়েছিলেন বিএনপির এই নেতা। তারই অংশ হিসেবে সাকিব আল হাসানকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মেজর (অবঃ) হাফিজ। নতুন এই দলে যোগও দিয়েছিলেন সাকিব। তাদের যুগল বন্দী ছবিতে কাউকে দুঃখিত মনে হয়নি। দু’জনের কেউই ইচ্ছার বিরুদ্ধে ফটোফ্রেমে বন্দী হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিসাব নিকাশ মেলেনি। দেনা পাওনার হিসেব না মেলায় মেজর (অবঃ) হাফিজ বিএনএমের নেতৃত্ব নেননি। সাকিবও ক্ষমতাহীন এই দলে গিয়ে নিজের সদ্য শুরু রাজনৈতিক ক্যরিয়ারকে বিসর্জন দিতে চাননি। সাকিব যখন বুঝতে পেরেছেন, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসছে, তখন তিনি আওয়ামী লীগের দরজায় টোকা দিয়েছেন। নিজের ‘ব্রান্ড’ ভেল্যুকে কাজে লাগিয়ে এমপিও হয়েছেন। অন্য দিকে আদর্শহীন পতিত রাজনীতিবিদ হতে হতে ফিরে আসা মেজর (অবঃ) হাফিজ নিজেকে ‘বীরপুরুষ’ হিসেবে জাহির করার সুযোগ পেয়েছেন। চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে, নিজের সুবিধাবাদী পাপস্খলন করেছেন। এরপর রীতিমতো ইউটার্ন নিয়ে তারেক বন্দনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার শাজাহান ওমরের শূণ্য স্থান পূরণের জন্য বিএনপিতে একজন নির্লজ্জ তেলবাজ চাটুকার দরকার ছিলো। প্রয়োজন ছিলো একজন ভাঁড় জ্যোতিষীর। মেজর (অবঃ) হাফিজ এখন বিএনপির সেই ভাঁড় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। যিনি জ্যোতীষ সাধনার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন বিএনপি খুব শীঘ্রই ক্ষমতায় আসছেন। হতাশার সাগরে ডুবে থাকা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও মেজর (অবঃ) হাফিজের কথায় ‘হতবাক’। নির্বাচনের আগে যে লোকটি, বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের কট্টর সমালোচক ছিলেন। যিনি সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনে না যাওয়ার বিএনপির সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন, তিনিই কিনা তারেকের ‘কাছের মানুষ’ হবার জন্য নিজেকে একজন রাজনৈতিক ক্লাউন হিসেবে উপস্থাপন করলেন। আমি মেজর (অবঃ) হাফিজকে নিয়ে কথা বলতে চাই না। ৭৫ এর পর বাংলাদেশে যে অপরাজনীতির ধারা সেই ধারার রাজনীতিতে মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো বহু পরগাছা আবর্জনা তৈরী হয়েছে। রাজনীতি মানে যাদের কাছে স্রেফ ক্ষমতার হালুয়া রুটির হিস্যা পাওয়া। বিএনএমে তিনি যোগ দিন বা না দিন, তার লোভাতুর, ক্ষুধার্ত চেহারা জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছে। মেজর (অবঃ) হাফিজের মতো নিজের স্বার্থে রং বদল করা রাজনীতিবীদের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে গিয়েছিলেন, একদা দেশে সেরা ক্রিকেট অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসান। কি চমৎকার! রতনে রতন চেনে। 

সাকিব অবশ্য বৈষয়িক হিসেব নিকেশে মেজর (অবঃ) হাফিজের চেয়ে পাকা খেলোয়াড়। ক্রিকেট কেবল খেলা নয়, এটি বড় লোক, ক্ষমতাবান হবার একটা ম্যাজিক সিড়ি-এই ভাবনার আবিষ্কারক সাকিব আল হাসান। ক্রিকেটকে সামনে রেখে তিনি বহুমাত্রিক বাণিজ্যে নিজের বিপুল প্রতিভাকে জাতির সামনে দেখিয়েছেন। কুমিরের ব্যবসা থেকে সোনা। হোটেল ব্যবসা থেকে কসমেটিকস সব জায়গায় তার বিচরণ। যে ক্রিকেট তাকে সবকিছু দিয়েছে, সেই ক্রিকেটকেই তিনি উপেক্ষা করেছেন নিজের আখের গোছোতে। এরকম সুবিধাবাদীরা ভয়ংকর। যেকোন রাজনৈতিক দলের জন্যই বিপদজ্জনক। এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী তরুণকে আওয়ামী লীগ আলিঙ্গন করেছে। মনোনয়ন দিয়েছে এবং এমপিও বানিয়েছে। এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিয়ে কোন সংশয় ছিলো না। আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ ছিলো ভোটার উপস্থিতি, উৎসব মুখর, বিতর্কহীন নির্বাচন। এই নির্বাচনে সাকিবের মতো এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করা ব্যক্তি কতটা প্রয়োজন, সে এক প্রশ্ন বটে। অনেকে বলবেন, গ্লামার বাড়াতে সাকিব, ফেরদৌস এর মতো তারকাদের নির্বাচনের মাঠে দরকার ছিলো। এতে সাধারণ মানুষের নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু তথ্য উপাত্ত এই বক্তব্য সমর্থন করেনা। 

চিত্রনায়ক ফেরদৌসের ধানমন্ডি আসনের চেয়ে অনেক বেশী ভোট পেয়ে জাহাঙ্গীর কবির নানক তার মোহাম্মদপুর আসনে কিংবা বাহাউদ্দিন নাছিম মতিঝিলে। মাগুড়াতেও সাকিব কোন ভোট বিপ্লব করতে পারেন নি। বরং নির্বাচনের পর সাকিবকে ঘিরে নিত্য নতুন বিতর্ক তৈরী হচ্ছে। তার বোন একটি বেটিং অ্যাপের মালিকানায় আছে, এমন সংবাদ নিয়ে কদিন হৈ চৈ হলো। এর রেশে কাটতে না কাটতেই তখন সাকিব-হাফিজের বিএনএম কেলেংকারী। কেউ কেউ বলেছেন, সাকিব নাকি তারেকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। এটা নিশ্চয়ই রটনাকারীদের অপপ্রচার। তবে, সাকিব যখন থেকে জন পরিচিতি পেয়েছেন, তখন থেকে তার মধ্যে এক লোভাতুর অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। বিত্ত, বৈভব ক্ষমতা, নাম যশের জন্য সাকিব সবকিছু করতে পারেন-এরকম একটা ভাবমূর্তি সাকিব তৈরী করেছেন। তাকে কখনো মাশরাফি বিন মর্তুজার মতো আদর্শবান, নীতিবান একজন ব্যক্তিত্ব মনে হয়নি। আওয়ামী লীগে এখন সুবিধাবাদীদের জন্য দরজা যে খুলে দেয়া হয়েছে, সাকিবের সংসদ সদস্য হওয়া তার প্রমাণ। 

মেজর (অবঃ) হাফিজ-সাকিব কান্ডের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তা আরো উদ্বেগজনক এবং আতংকের। সাকিব কান্ড নিয়ে যখন মিডিয়ার তোলপাড় তখন ওবায়দুল কাদের বললেন, মনোনয়ন পাবার আগে সাকিব আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। এর আগে সাকিব কি করেছেন, সেটি নাকি তার (আওয়ামী লীগের) দেখার বিষয় না। কি সাংঘাতিক কথা! তাহলে কি যুদ্ধাপরাধীদের আত্মীয় আত্মীয় স্বজন, জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করলেই সেই ব্যাক্তি পূত-পবিত্র হয়ে যাবেন? লুটেরা, দুর্নীতিবাজ অর্থ-পাচারকারীরা অবলীলায় আওয়ামী লীগে ঢুকে যেতে পারবেন? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য কি দলটি নীতি-আদর্শিক অবস্থানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়? 

আওয়ামী লীগে অবশ্য সাকিবের মতো সুবিধাবাদীদেরই ভীড় এখন বেশী। তারাই এখন ক্ষমতার মধু খাচ্ছেন। হালুয়া-রুটির ভাগ বাটোয়ারাতেও তাদের হিস্যা বেশী। সাকিব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে আসন থেকে জয়ী হয়েছেন সেটির আগের এমপি ছিলেন একজন ত্যাগী পরীক্ষিত তরুন। যার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের দুঃসময় কষ্ট করেছে, সংগঠনকে আগলে রাখার জন্য অনেক কিছু ত্যাগ করেছে। ঐ তরুণের রাজনৈতিক জীবনে কোন বিচ্যুতি নেই। আদর্শ থেকে সরে আসেননি কখনো। এমনকি এবার নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়েও প্রতিবাদ করেননি বিনয়ী এই রাজনীতিবিদ। কারো কাছে প্রশ্ন করেন নি-‘কি আমার অপরাধ’? উন্মুক্ত নির্বাচন সত্বেও অনেকের মতো স্বতন্ত্র ভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হননি। এই তরুণ বয়সে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, রাজনীতিতে আদর্শ নিয়ে টিকে থাকাই আসল জয়। কিন্তু সাকিবের মতো সুসময়ের অতিথি পাখিদের কাছে আপাততঃ কোণঠাসা, দুঃসময়ের যোদ্ধা শিখর’রা। এটি শুধু মাগুরার এই আসনের চিত্র নয়। সারা দেশে এরকম বহু ত্যাগী সংগ্রামী, দুঃসময়ে দলের জন্য সবকিছু উজাড় করা আদর্শবান নেতা কর্মীরা আজ উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগের সুসময় তারা পরিত্যন্ত। অনাহুত। অপাংক্তেয়। তাহলে কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানরা শুধু দুঃসময়ে নির্যাতিত হবার জন্য? দলকে বাঁচাতে জীবন, যৌবন বিসর্জন দেয়ার জন্য? সুসময়ে তারা থাকবেন রিজার্ভ বেঞ্চে। বুক ভরা দুঃখ চেপে শুধু নীরবে গুমড়ে কাঁদার জন্যই কি আওয়ামী লীগের আদর্শবানদের দরকার? 

ইতিহাস বলে, সুবিধাবাদী, চাটুকাররা দুঃসময়ে থাকে না। বঙ্গবন্ধুকে যারা স্তুতির বন্যায় ভাসিয়ে রাখতো তারা ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর দলের পাশে দাঁড়ায় নি, প্রতিবাদ করেনি। সাকিবের চেয়েও বড় তারকা ড. কামাল হোসেন ৭৫ এর পর কি করেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী। ৯১ এর দুঃসময়েও ভাড়াটে সুবিধাবাদীরা সটকে পড়েছে। এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগের সুবিধাবাদীরা তারকারা ভোল পাল্টাতে সময় নেয়নি। প্রয়াত জিল্লুর রহমান, সৈয়দ আশরাফ, মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন, সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী, ব্যরিস্টার শফিক আহমেদের মতো উপেক্ষিতরাই আওয়ামী লীগ সভাপতির পাশে দাঁড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রতিটি সংকটে দল রক্ষায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তেল চিটচিটে পাঞ্জাবী আর রং চটা মুজিব কোট পরা নির্ভীক তৃণমুল। যাদের গায়ে ঘামের গন্ধ, কাঁদা মাটি মাখা গায়ে রক্ত ঝরিয়ে তারাই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছেন, শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার দুঃসময়ে তারাই আওয়ামী লীগকে রক্ষায় রুখে দাঁড়াবে। তাহলে সুসময়ে কেন সুবিধাবাদীরা লুটেপুটে খাবে? আরেকটি দুঃসময় ডেকে আনার জন্য? এই স্বস্তির সুসময়ে আওয়ামী লীগ কেন মূল্যায়ন করে না দুঃসময়ের কান্ডারীদের?   

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগের অনাহূতরা

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২০ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।

এরকম ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে রয়েছেন;

লিয়াকত শিকদার: লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কান্ডারী। দুঃসময়ে একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেখ হাসিনার প্রশ্নে তাকে কখনও আপোষ করতে দেখা যায়নি। কর্মীদের মধ্যে তার বিপুল জনপ্রিয়তা রয়েছে। কিন্তু তারপরেও লিয়াকত শিকদার আওয়ামী লীগে অনাহূত।

ইসহাক আলী খান পান্না: ইসহাক আলী খান পান্না ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার সভাপতি এনামুল হক শামীম মন্ত্রী-এমপি হলেও ইসহাক আলী পান্নার কপালে কিছু জোটেনি। কি তার অপরাধ কেউ বলতে পারে না। 

মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী: মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একজন পরিচ্ছন্ন মেধাবী ছাত্রলীগ নেতা হিসাবে তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। কিন্তু মাঈনুদ্দীন হাসান চৌধুরী এখন অপাংক্তেয়। তাকে কোথাও দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও তিনি নেই। সংসদ সদস্য হিসেবেও তার তিনি জায়গা পাননি। আর মন্ত্রী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর অপরাধ কি কেউ বলতে পারে না। তার সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছিল, তার যারা অনুগত কর্মী ছিল তাদেরও কেউ কেউ এখন মন্ত্রী হয়েছেন, অনেকেই এমপি হয়েছেন। কিন্তু মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী সেই জায়গাতেই রয়ে গেছেন।

বাহাদুর বেপারী: আওয়ামী লীগের আরেকজন মেধাবী ছাত্র নেতার নাম বাহাদুর বেপারী। বিভিন্ন সময় তার মেধা এবং যোগ্যতা নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে চর্চা হয়। ছাত্রলীগের যে কয়েকজন মেধাবী নেতা এসেছিলেন, তাদের মধ্যে বাহাদুর বেপারী অন্যতম। কিন্তু বাহাদুর বেপারীও এখন আওয়ামী লীগের মূল রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। তিনিও এখন প্রায় অনাহূত। তাকে নিয়েও এখন আওয়ামী লীগের মধ্যে খুব একটা চর্চা হয় না। বাহাদুর বেপারী ভবিষ্যতের রাজনীতিতে বড় ধরনের লিড পাবেন বা তার তিনি পাদপ্রদীপে আসতে পারবেন এমনটিও মনে করেন না অনেকে।

অজয় কর খোকন: অজয় কর খোকনও আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী এবং কঠিন সময়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নিয়ে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু অজয় কর খোকনও এখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অপাংক্তেয়। তার কমিটিতে থাকা অনেকেই আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতা হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু অজয় কর খোকন যেন পরিত্যক্ত বাসের মতো আওয়ামী লীগে অপাংক্তেয় হয়ে আছেন।

দুঃসময়ের এসমস্ত ছাত্রলীগের নেতাদেরকে কেন টেনে তোলা হচ্ছে না, কেন তারা পরিত্যক্ত অবস্থায়, অনাহূত অবস্থায় আছেন এটি আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি বড় প্রশ্ন। তবে এদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও যারা ছাত্রলীগ করে এসেছেন, এখন ভালো জায়গায় আছেন তারাও খুব একটা কথা বলতে রাজি হননা। কারণ পাছে তাদের নিজেদের সুবিধাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কেউই এ সমস্ত অনাহূত, ত্যাগী, পরীক্ষিত ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের জন্য কথা বলতে আগ্রহী নন। কেন? সেটি এখন একটি বড় প্রশ্ন।

আওয়ামী লীগ   ছাত্রলীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

ড. ইউনূসের মামলা এবং তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্ত নিয়ে এখন আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। এই সমস্ত আলোচনার মোদ্দা কথা যেটা বেরিয়ে আসছে সেটা হল শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসকে জেলে যেতেই হবে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ড. ইউনূস জেলে যাবেন কবে?

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের চার শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্তকরণ অর্থাৎ কনভিকশন অর্ডার স্থগিত করে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। হাইকোর্ট বলেছে, কোন মামলায় জামিন দেওয়া মানেই দণ্ড স্থগিত হয়ে যাওয়া। আর কনভিকশন বা দোষী সাব্যস্তকরণ কখনও স্থগিত করা যায় না। আর এই রায়ের মধ্য দিয়ে শ্রম আদালতের মামলাটি নতুন মাত্রা পেল এবং এটির একটি নতুন তাৎপর্য তৈরি হল। এই শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও কিছু মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। তাছাড়া হাইকোর্টেও ড. ইউনূস যে ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন তা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। কাজেই হাইকোর্ট যদি শেষ পর্যন্ত ড. ইউনূসকে শ্রম আদালত যে দণ্ড দিয়েছে তা বহাল রাখে তাহলে তাকে আদালতে যেতে হবে। তাছাড়া হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন নিয়ে আছেন। এই জামিনের মেয়াদ রয়েছে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এই জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ড. ইউনূসকে যদি আবার নতুন করে জামিন না দেওয়া হয় তাহলে তাকে জেলে যেতে হবে। 

শ্রম আদালতের এই মামলাটি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে চলতি বছরেই মাঝামাঝি সময় নাগাদ ড. ইউনূসের কারাবরণের ব্যাপারে একটি চূড়ান্ত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। কারণ যে ছয় মাসের দণ্ড এই দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল এবং তার জামিন ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল। এই দুটির যে কোনো একটি পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. ইউনূসের বিষয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। সেই সিদ্ধান্তটি ড. ইউনূসের পক্ষে না গেলে তাকে কারাগারে যেতে হবে। 

তবে এটি ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার একমাত্র উপলক্ষ্য নয়। ইতোমধ্যে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু এই চার্জশিট দাখিলের পরও ড. ইউনূস আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন। এখন এই জামিন যতদিন বহাল থাকবে ততদিন অর্থপাচার মামলায় ড. ইউনূসকে কারাগারে যেতে হবে না। কিন্তু যে কোন কারণে যদি এই জামিন বাতিল হয়ে যায় তাহলে এই অর্থ পাচার মামলাতেও ড. ইউনূসকে কারান্তরীণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অন্য যে মামলা গুলো আছে সেগুলো মূলত আয়কর ফাঁকি দেওয়ার মামলায় এবং টাকা ট্যাক্স এর টাকা পরিশোধের মামলা। যে মামলাগুলোতে ইউনূস পরাজিত হচ্ছেন সে মামলাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি আদালতে দিচ্ছেন। যদিও এখন আদালতে রায়ের পর তার আয়কর ফাঁকির অর্থ পরিশোধ করতেও তিনি উস্ম প্রকাশ করছেন। কিন্তু এই মামলাগুলোতে তার কারাগারে যাওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। মূলত দুটি মামলায় ড. ইউনূসের কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং তা খুব শিগগির বোঝা যাবে। একটি হল শ্রম আদালতে তার যে দণ্ড হয়েছে সেটি এবং অন্যটি অর্থপাচার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলা। এখন দেখার বিষয় যে এই সমস্ত মামলা থেকে জামিন নিয়ে ড. ইউনূস কতদিন বাইরে থাকেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস   শ্রম আদালত   হাইকোর্ট  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মন্ত্রী নন-এমপি নন, তবু তারা ক্ষমতাবান

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

টানা ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। ১৬ বছরে পা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করা আওয়ামী লীগ। টানা ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রে একটা ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদেরকে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন করে একেক মেয়াদে একেক জনকে মন্ত্রী করেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন করে নেতাদের যেমন যোগ্যতা পরিমাপ করেন, ঠিক তেমনি তাদেরকে ক্ষমতাবান করেন। 

তবে টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে এখন দলের নেতা হওয়ার চেয়ে মন্ত্রী হওয়া অনেক লাভজনক বলেই মনে করেন নেতাকর্মীরা। দলের নেতা হয়ে তেমন লাভ নেই। ক্ষমতা হল শুধুমাত্র মন্ত্রী-এমপি হলেই। এই জন্য মন্ত্রী-এমপি হওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের হিড়িক পড়ে যায়। কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন। কয়েকজন মনোনয়ন পান, কয়েকজন পান না। আর মনোনয়ন না পেলে তারা আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোন না কেন ক্ষমতা থেকে অনেকটা দূরে বলে নিজেরাই হতাশা প্রকাশ করেন। কিন্তু এর মধ্যে ব্যতিক্রম আছেন কয়েকজন, যারা মন্ত্রী নন, এমপি নন, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং নিজ যোগ্যতায় তারা ক্ষমতাবানও।

আওয়ামী লীগের যারা এই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন;

সুজিত রায় নন্দী: সুজিত রায় নন্দী আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিলের যে মুষ্টি হাতে গোনা  দু একজনের পদোন্নতি হয়েছিল তার মধ্যে সুজিত নন্দী অন্যতম। পদোন্নতি পেয়ে তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তার নির্বাচনী এলাকা চাঁদপুরে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়ার পরও গত নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা তিনি মেনে নিয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছেন। আওয়ামী লীগে যারা সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন, তারা কেউ মন্ত্রী হতে পারেনি। তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা। অন্যদিকে সুজিত নন্দী যেহেতু নির্বাচন করেননি, সার্বক্ষণিকভাবে দলের দলের জন্য এবং সংগঠনের জন্য সময় দিয়েছেন, তার মধ্যে সেই হতাশা নেই। ফলে তিনি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় এবং ক্ষমতাবান। 

মো. সিদ্দিকুর রহমান: মো. সিদ্দিকুর রহমান আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক। বিজিএমইএ অন্যতম নেতা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মন্ত্রী বা এমপি না হয়েও তিনি সরকারের অন্যতম নীতিনির্ধারক। বিশেষ করে বিজিএমইএ এর নির্বাচন, বাংলাদেশের শ্রম আইন এবং শ্রমিক বিষয়ক বিভিন্ন ইস্যুগুলোকে দেখভাল করার ক্ষেত্রে মো. সিদ্দিকুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত।

বিপ্লব বড়ুয়া: বিপ্লব বড়ুয়া দপ্তর সম্পাদক হলেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে অধিক পরিচিত। মিষ্টভাষী এবং বিনয় এই তরুণ আওয়ামী লীগ মহলেও জনপ্রিয়। বিপ্লব বড়ুয়া প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এবং দপ্তর সম্পাদক হওয়ার কারণে অত্যন্ত ক্ষমতাবান। বিপ্লব বড়ুয়াও আওয়ামী লীগের সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দের একজন যারা নির্বাচন করেননি এবং নির্বাচনের জন্য মনোনয়নও চাননি। নির্বাচন না করার কারণে দলে তার অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। বিশেষ করে সাংগঠনিক বিষয়ে তার ওপর নির্ভরতা বেড়েছে দলের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের। এ কারণে তিনি দলে একজন বিশ্বস্ত দপ্তর সম্পাদক হিসেবে ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।

আমিনুল ইসলাম: আমিনুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। তিনি গত কাউন্সিলে পদোন্নতি পেয়ে পূর্ণ সম্পাদক হয়েছেন। তবে বিভিন্ন টকশো-তে অংশগ্রহণ করার কারণে তিনি জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের আস্থাভাজন হয়েছেন। কাজেই আওয়ামী লীগে ক্ষমতাবান হতে গেলে শুধু মন্ত্রী বা এমপি হতে হয় এমন ধারণা ভুল প্রমাণ করে এরকম আরও কিছু নেতা এগিয়ে আসছেন সামনের সারিতে।

মো. সিদ্দিকুর রহমান   আওয়ামী লীগ   বিপ্লব বড়ুয়া   সুজিত রায় নন্দী  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন