এডিটর’স মাইন্ড

তারেক জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতার একটি নমুনা

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৪ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

শেখ সাদী বলেছেন, ‘একটি সুন্দর বাগান নষ্ট করতে একটি বানরই যথেষ্ট।’ বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি কেউ যদি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তাহলে দেখবেন শেখ সাদীর বক্তব্য কতটা সত্য। একজন ব্যক্তির একনায়কতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে পরিচালিত একটি দল রাজনীতিকে কলুষিত করছে। দেশকে করছে সংকটাপন্ন। গণতন্ত্রকে বিপন্ন করার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫১ বছর পার করেছি।  স্বাধীনতার মাসে এসে আমরা যদি ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব এখনো আমাদের রাজনীতিতে অনেক অপূর্ণতা, হতাশা, অপ্রাপ্তির বেদনা। স্বাধীনতার মাসে আমরা যদি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি, স্বাধীন বাংলাদেশে কি এমন রাজনীতি আমরা দেখতে চেয়েছি? আমি নিশ্চিত সবাই এর উত্তরে সমস্বরে বলবেন ‘না’। স্বাধীন দেশে রাজনীতি হবে উন্নয়নের কৌশল নিয়ে। জনগণের কল্যাণ ও ভাগ্য পরিবর্তনের পদ্ধতিকেন্দ্রিক বিতর্ক নিয়ে। স্বাধীন দেশে ভোটের পর যে দলই ক্ষমতায় আসুক তারা মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা, বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে কুন্ডতর্ক করবে না। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি রাজনীতি করবে না। রাজনীতির নামে কেউ রাষ্ট্রবিরোধিতা করবে না। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্টের অপরিণামদর্শী অপ-তৎপরতা চালাবে না। রাজনীতিতে পারস্পরিক সম্মান এবং শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, ৫১ বছর পরও রাজনীতির নামে রাষ্ট্রবিরোধিতা চলে প্রকাশ্যে। সরকারের সমালোচনা এমন মাত্রা ছাড়া হয় যে রাষ্ট্র এবং জনগণ আক্রান্ত হয়। এখনো কেউ কেউ বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তান বানাতে চায়। রাজনীতিকে কলুষিত করে কেউ কেউ চাঁদাবাজি এবং লুটপাটের হাতিয়ার বানায়। এরা রাজনীতির অসুস্থ, কুৎসিত ধারাকে লালন করে। রাজনীতিকে এরা কলঙ্কিত করে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। এদের একজন লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। এই একজন এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় বিষফোঁড়া। তার কারণেই রাজনীতি দূষিত এবং বিষাক্ত হয়ে উঠেছে ক্রমশ।

সম্প্রতি ইউটিউবে দুই দুর্বৃত্তের সঙ্গে তারেক জিয়ার ছবি দেখে চমকে উঠলাম। সাংবাদিক পরিচয়ে এরা চাঁদাবাজ, প্রতারক এবং ঘৃণ্য রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধী। বিদেশে বসে একটি ইউটিউব চ্যানেলের নামে এরা মানুষকে ব্ল্যাকমেল করে। কুৎসিত, নোংরা ভাষায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিষ্ঠিত এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের চরিত্র হনন এদের ব্যবসা। এরা কোনো বিচারেই সাংবাদিক নয়। এরা আসলে দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমা। কিছুদিন আগে দেশের অন্যতম শীর্ষ এক শিল্প পরিবারকে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়ে এরা হাতেনাতে ধরা পড়ে। ওই শিল্প পরিবারের এক কর্মচারীর কাছে এরা ৬ লাখ ডলার চাঁদা দাবি করেছিল। তাদের কথোপকথনের রেকর্ড এখনো ইউটিউবে পাওয়া যায়। ওই কথোপকথনে দেখা যায় এরা কত নিম্নমানের রুচিহীন কুলাঙ্গার। ওই কথোপকথন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর, দেশে-বিদেশে হইচই পড়ে যায়। সবাই এদের কুকর্মে হতবাক হন। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার পর দেশে-বিদেশে বিএনপিপন্থি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিস্ট, বুদ্ধিজীবী এবং সাংবাদিকরাও হতবাক হয়ে যান। বিএনপিপন্থি যারা বিদেশে বসে সরকারের সমালোচনা করেন, তারাও এ নিকৃষ্ট ব্ল্যাকমেলিং মেনে নিতে পারেননি। সবাই ওই দুর্বৃত্ত চাঁদাবাজদের বর্জন শুরু করেন। এমনকি প্রবাসে থাকা একজন বিএনপিপন্থি সাংবাদিক এদের অপতৎপরতাকে ফৌজদারি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সর্বজনীন বয়কটের পরিপ্রেক্ষিতে নিঃশর্ত ক্ষমা চায় এই কুৎসিত দুই কুলাঙ্গার। এরাই নিজেদের লজ্জিত চেহারা দেখিয়ে ক্ষমা চায়। ভবিষ্যতে এরকম জঘন্য তৎপরতা করবে না বলেও নাকে খত দেয়। কিন্তু কিছু মানুষ আছে, যারা একটি অপকর্ম করে ভালো হওয়ার শপথ নেয় এবং দ্রুতই শপথ ভঙ্গ করে। একটি প্রাণী আছে এই জগৎ-সংসারে যার লেজ কখনো সোজা হয় না। শিগগিরই এরাও তাদের লজ্জার মুখোশ খুলে ফেলে। আবার চাঁদাবাজি এবং ব্ল্যাকমেলিংয়ের পুরনো পেশায় ফেরে এরা। বিভিন্ন ব্যবসায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মনগড়া সংবাদ পরিবেশনের ঘোষণা দেয়। বাংলা ছায়াছবির মতো ‘শীঘ্রই আসিতেছে’ এ ধরনের বিজ্ঞাপন দিয়ে এরা টোপ ফেলে। অনেকেই এরকম কুৎসিত, নোংরা অপপ্রচারে ভয় পায়। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আতঙ্কে থাকেন। লোকলজ্জা এবং মানসম্মানের ভয়ে তারা ওই চাঁদাবাজ দুর্বৃত্তদের সঙ্গে গোপনে টাকা-পয়সার লেনদেন করেন। তখন তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট আর প্রচার হয় না। আর যারা এদের এসব ব্ল্যাকমেলিংকে পাত্তা দেন না, তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হতেই থাকে। শুধু ব্যবসায়ীদের থেকেই অর্থ হাতিয়ে নেয় না, অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কদর্য, নোংরা অপপ্রচার করে এরা চাঁদাবাজির জন্য। সমাজে বহুজনের চরিত্র হনন করে এরা নিজেরাই নর্দমার চেয়ে দুর্গন্ধময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবর্জনা বলা হয়। রতনে যেমন রতন চেনে, তেমনি তারেক জিয়াও এই দূষিত নিম্নমানের চাঁদাবাজদের চিনেছেন। এই ত্রয়ীর ছবি অনেক কথা বলে। 

এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হলো। প্রথমত, যে প্ল্যাটফরমে এই দুজন এবং এদের সহযোগীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার ও চরিত্র হনন করছে, সেই প্ল্যাটফরমটি আসলে তারেক জিয়ার নিয়ন্ত্রণে। তারেকই তার মালিক এবং পৃষ্ঠপোষক। তারেকের নির্দেশেই এসব দেশবিরোধী মিথ্যাচার চলছে। তারেকের আগ্রহেই চলছে ব্ল্যাকমেল, চাঁদাবাজি এবং চরিত্র হননের কদর্য এবং কুরুচিপূর্ণ তৎপরতা। এই দুর্বৃত্তদের গডফাদার আসলে তারেক জিয়া। আমি জানি না, বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয় দেখিয়ে, চরিত্র হননের হুমকি দিয়ে এসব দুর্বৃত্ত যে অর্থ পেয়েছে, তার ভাগ তারেক জিয়াও পান কি না। তবে তারেক জিয়ার সঙ্গে এদের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারেক জিয়া এই দুই দুর্বৃত্তের মতোই আচরণ করেছেন। তারেক-মামুনের জুটির মতোই এই দুর্বৃত্তরা বিদেশে বসে চাঁদাবাজি, প্রতারণা, ভয় দেখানোর অপরাধ জুটি করেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেই তারেক জিয়া হাওয়া ভবন গড়ে তুলেছিলেন। হাওয়া ভবনের প্রধান কাজ ছিল চাঁদাবাজি, অবৈধ উপায়ে অর্থ আদায়। জনগণের নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক কারচুপির মাধ্যমে ভোটের ফলাফল নিজেদের পক্ষে আনাটাই ছিল হাওয়া ভবনের মূল মিশন। এ লক্ষ্যেই তারা লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে আগে থেকেই বশীভূত করেছিল। এম এ সাঈদের নির্বাচন কমিশনকে আজ্ঞাবহ এবং অনুগত করেছিল। ভারতে গিয়ে যে কোনো শর্তে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পদলেহন করেছিল। আর এই সম্মিলিত চেষ্টার ফলাফল দৃশ্যমান হয় ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে। ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন পায় অনেক কম। তারেক জিয়া জানতেন যে, জনগণের ভোটে তারা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসনে বিজয়ী হয়নি। বরং ‘সিস্টেমেটিক মেকানিজমে’র কারণেই এই ফল। আর তাই নির্বাচনের রাত থেকেই আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘু নিশ্চিহ্ন করার নৃশংস মিশন শুরু করে তারেক জিয়া। ১ অক্টোবর রাত থেকেই শুরু হয় তান্ডব। সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর চলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর। নির্বিচারে চলে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন। এর একমাত্র কারণ ছিল সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। আর এই পরিকল্পিত সন্ত্রাস পরিচালিত হয় হাওয়া ভবনের নির্দেশনায়। ২০০১ সালের অক্টোবর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু আসল ক্ষমতার মালিক হয় তারেক জিয়ার হাওয়া ভবন। বেগম জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি ছিলেন পুতুল। সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন তারেক জিয়া। মন্ত্রিসভায় প্রায় সব মন্ত্রণালয়ে তারেকের নিজস্ব একজন প্রতিমন্ত্রী হন। মন্ত্রীদের চেয়েও ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন প্রতিমন্ত্রীরা। ব্যবসা, টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি সব কিছু চলে যায় হাওয়া ভবনের নিয়ন্ত্রণে। যে কোনো ব্যবসা করার আগে হাওয়া ভবনে মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে হতো। সরকারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করত তারেকের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুন। বিসিএস, পুলিশের এসআই কিংবা স্কুলশিক্ষক যাই হতে চান না কেন, টাকা দিয়ে হাওয়া ভবনে নাম লেখানো ছিল বাধ্যতামূলক। নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানে তালিকা যেত হাওয়া ভবন থেকে। হাওয়া ভবনের তালিকাভুক্ত ব্যক্তি যোগ্য হোক আর না হোক, লিখিত পরীক্ষায় পাস করুক আর না-ই করুক, তাকে চাকরি দিতে হবে। না হলে নিয়োগকর্তার কপালে নেমে আসত দুর্দশা। বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাওয়া ভবনে মাসোহারা দিতে হতো। টাকার অঙ্ক ঠিক করে দিতেন তারেকের পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ থেকে প্রতি মাসে ভ্যাট দিতে হতো হাওয়া ভবনে। এই ভ্যাট আদায় করতেন তারেক নিয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর এক নম্বর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী। প্রধান বন কর্মকর্তা, রাজউকের চেয়ারম্যানের মতো পদগুলো নিলামে উঠত। হারিছ চৌধুরীর পরিচালনায় নিলামে যিনি সবচেয়ে বেশি অর্থ দিতে প্রস্তাব করতেন, ওই পদে তাকেই নিয়োগ দেওয়া হতো। বিদ্যুতের খাম্বা প্রকল্পের কথা সবাই জানে। এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে রীতিমতো লুণ্ঠন করে তারেক-মামুন জুটি। এসব লুণ্ঠিত অর্থ চলে যেত বিদেশে। বাংলাদেশে অর্থ পাচার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় তারেক জিয়ার নেতৃত্বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে দুর্নীতির এই বরপুত্র। যা দিয়ে লন্ডনে বসে আরাম-আয়েশে রাজকীয় জীবনযাপন করছেন। আর এসব কুলাঙ্গারকে কিছু অর্থ দিচ্ছেন নিয়মিত বমি উগলানোর শর্তে।

তারেক জিয়া চেয়েছিলেন ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ জন্য প্রথম তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করতে সংবিধান সংশোধন করা হয়। এরপর নির্বাচন কমিশনকে একদল ভাঁড়ের আড্ডাখানায় পরিণত করে বিএনপি সরকার। হাওয়া ভবন থেকে দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের তালিকা তৈরি করে দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনকে। এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয় যেন নির্বাচনে বিএনপি ছাড়া আর কোনো দলের বিজয় অসম্ভব হয়ে ওঠে। এসব করেও আশ্বস্ত হতে পারেনি তারেক জিয়া। এ কারণেই আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ‘মাস্টারপ্ল্যান’ গ্রহণ করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘটানো হয় রাজনৈতিক ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা। এ ঘটনা ঘটিয়ে শেখ হাসিনাকে চিরবিদায় করতে চেয়েছিলেন তারেক জিয়া। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী। এরপর এ ঘটনা ধামাচাপা দিতে সাজানো হয় একের পর এক নাটক।

তারেক জিয়া তার পিতার মতোই বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিলেন। এ কারণেই তার পৃষ্ঠপোষকতায় উত্থান ঘটে বাংলা ভাইয়ের। বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন। পাকিস্তানের পরামর্শে এবং মদদে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া শুরু করে তারেক। এর বড় প্রমাণ ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা। তারেকের সঙ্গে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী, উগ্র-মৌলবাদী এবং বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সখ্যের প্রমাণ উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন দলিলে। সেসব দলিল ফাঁস করেছিল উইকিলিকস।

ক্ষমতায় চিরকাল থাকতে মরিয়া তারেক জিয়া সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন। সর্বোচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেন দলীয় ক্যাডার। পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন সর্বত্র চলে তারেকের নিজস্ব বাহিনী গঠনের উৎসব। এ কারণেই সিনিয়র সাতজনকে ডিঙিয়ে জেনারেল মইন উ আহমেদকে করা হয় সেনাপ্রধান। ড. ইয়াজউদ্দিনের মতো একান্ত অনুগত, আজ্ঞাবহ, মেরুদন্ডহীনকে করা হয় রাষ্ট্রপতি। বিএনপির অধিকাংশ নেতা বিশ্বাস করেন, তারেক জিয়ার সীমাহীন দুর্নীতি, অপরিণামদর্শী ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণেই এক-এগারো আসে। আর তাই প্রয়াত সাইফুর রহমান, মান্নান ভূঁইয়া, সাদেক হোসেন খোকা, তরিকুল ইসলামের মতো পোড় খাওয়া নেতারা তারেকের ব্যাপারে এতটুকু সহানুভূতি দেখাননি। এখনো বিএনপির অধিকাংশ তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মী মনে করেন বেগম জিয়া ও বিএনপির আজকের পরিণতির জন্য তারেক জিয়াই একমাত্র দায়ী। বেগম জিয়া ছিলেন পুত্রের ব্যাপারে অন্ধ। ছেলের সব অপকর্মে তার সায় ছিল। বিএনপির বহু নেতাই বলেন, বেগম জিয়া যদি তারেককে ন্যূনতম শাসনে রাখতেন, তাহলে দলটি আজ এ দুরবস্থায় পড়ত না। এক-এগারোতে তারেক এবং তার বন্ধু গিয়াসউদ্দিন মামুন গ্রেফতার হন। বেগম জিয়ার কান্না এবং অনুরোধে মুচলেকায় বিশেষ বিবেচনায় মুক্ত হয় তারেক জিয়া। চলে যান লন্ডনে। যাওয়ার সময় কাগজে লিখিত এই মর্মে মুচলেকা দিয়েছিলেন যে, আর রাজনীতি করবেন না। ঠিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দুই কুলাঙ্গার দুর্বৃত্তের মতোই। কিন্তু বিশেষ প্রাণীর লেজের মতোই তারেক জিয়ার চরিত্রেও পরিবর্তন অসম্ভব। ২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে তারেক জিয়া। এখনো সেই একই অপকর্ম করছেন যা তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত করেছেন। লন্ডনে বসেই চাঁদাবাজি করছেন, কমিটি বাণিজ্য করছেন। বিএনপিতে এখন এটা ওপেন সিক্রেট যে, টাকা ছাড়া ওয়ার্ড কমিটিতেও ঢোকা যায় না। বিএনপিতে যারা নির্যাতিত ত্যাগী তারা কোনো কমিটিতে জায়গা পান না। বিএনপির একেকটি কমিটি ঘোষণা একটি করে বিক্ষোভ এবং বিদ্রোহের জন্ম দেয়। কে কত টাকা দিয়ে কোন পদ পেয়েছেন, তা প্রকাশ্যে আলোচিত হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। বিনা শর্তে ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। তারেকের নির্দেশে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। দুষ্ট লোকেরা বলে, সে সময় তারেকের অর্থের দরকার ছিল। এ জন্যই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। ওই নির্বাচনে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শোনা যায়। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় মনোনয়নবঞ্চিতরা প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, কত টাকার মনোনয়ন বিক্রি হয়েছে। প্রায় সব আসনেই দুই বা ততোধিক প্রার্থী দিয়ে কি একটি দল নির্বাচনে জয়ী হতে পারে?

এখন বিএনপির যে আন্দোলন, তারও প্রধান লক্ষ্য চাঁদাবাজি, এমনটি মনে করেন অনেকে। এর কারণ ২০১৩, ১৪ এবং ১৫ সালের অভিজ্ঞতা। এ সময় তারেকের নির্দেশে অগ্নিসন্ত্রাস, লুটতরাজ আর নাশকতা করেছিল দলটি। ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল সেই সময়ের সহিংস আন্দোলন। এবারও আন্দোলনের শুরুতেই বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ফোন করা শুরু হয়। ফোন করতেন তারেক জিয়া অথবা তার মনোনীত ব্যক্তি। তাদের ভয়ভীতি দেখানো হতো। বিএনপি ক্ষমতায় এলে, তাদের পরিণতি কী হবে, সে সম্পর্কেও ভীতিকর ভবিষ্যদ্বাণী করা হতো। অনেক ব্যবসায়ী চান দুই দিকেই সম্পর্ক রাখতে। হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ, তারেকের অন্যতম অর্থ জোগানদাতা অনেকেই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন। এরা ভীত হয়ে বা বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসতে পারে এমন ধারণা থেকেই তারেক জিয়াকে গোপনে টাকা পাঠাতে শুরু করে। সেই পাচারকৃত অর্থের ছিটেফোঁটা দিয়ে বিএনপি মহাসমাবেশের নামে বিভাগে বিভাগে খিচুড়ি উৎসব করে। তারেক জিয়ার এই চাঁদাবাজির মিশনের সহযোগী ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাঁদাবাজ, প্রতারক হিসেবে খেতাব পাওয়া দুই দুর্বৃত্ত। এই একটি ছবি, চাঁদাবাজ চক্রের সঙ্গে তারেকের গোপন প্রণয় প্রকাশ করে দিয়েছে।

এ ছবিটি তারেক জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহিতার এক প্রামাণিক দলিল। আবর্জনায় ঠাসা তথাকথিত চ্যানেলে প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর অশ্লীল কথাবার্তা প্রচারিত হয়। তারেক জিয়া যেহেতু এই কুরুচি ভান্ডারের পৃষ্ঠপোষক, কাজেই তিনি যে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী এটা তার অকাট্য প্রমাণ। তার নির্দেশেই যে দেশের বিরুদ্ধে কিছু বিকৃত মানুষ কথা বলছে, তা এখন স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার। লন্ডনে পলাতক বিএনপির স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান একটি মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত। অর্থ পাচারের একটি মামলায় হাই কোর্ট তাকে সাত বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করেছেন। হাই কোর্টের এক আদেশ অনুযায়ী তারেক জিয়ার কোনো বক্তব্য বিবৃতি বাংলাদেশে প্রচার নিষিদ্ধ।

বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তারেক জিয়া পরোয়ানাভুক্ত দন্ডিত। মোস্ট ওয়ান্টেড। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও তারেক পরিচিত একজন মাফিয়া ডন বা গডফাদার হিসেবে। কেউ তাকে রাজনীতিবিদ মনে করেন না। কিন্তু আমরা প্রায়ই দেখি বিএনপির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তারেক জিয়া অনলাইনে যুক্ত হন। ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন। এটি আদালত অবমাননার শামিল।

আমি মনে করি, অবিলম্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মহামান্য আদালতের এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি তথাকথিত সাক্ষাৎকারের নামে মোস্ট ওয়ান্টেড তারেক জিয়ার সঙ্গে যে দুই দুর্বৃত্তের ছবি প্রকাশিত হয়েছে, তাদের সব কনটেন্ট বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা দরকার। মহামান্য হাই কোর্ট একরকম বহু যুগান্তকারী প্রণোদিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে দ্রুত রাষ্ট্রবিরোধী এসব আবর্জনায় আকীর্ণ, কথার দুর্গন্ধযুক্ত বমিদূষণ বাংলাদেশে বন্ধ করা দরকার। এ ব্যাপারে মহামান্য বিচার বিভাগের আশু হস্তক্ষেপ জরুরি। না হলে এদের চরিত্র হননের খেলা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। পাশাপাশি দন্ডিত তারেক জিয়াকে অনতিবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।  এ জন্য বিদেশের মিশনসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় সৎ এবং সাহসী মানুষকে বসাতে হবে। কারণ সরকারের ভিতর এখনো ঘাপটি মেরে আছে তারেক জিয়ার অনুচররা। যারা এখনো তারেক জিয়াকে ক্ষমতায় বসানোর খোয়াব দেখে। এরা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। এদের চিহ্নিত করার এখনই সময়।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন 


তারেক জিয়া   রাষ্ট্রদ্রোহিতা  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

‘জয় বাংলা’ লিখে জো বাইডেনের চিঠি এবং মোনালিসার হাসি

প্রকাশ: ১০:০১ এএম, ০১ এপ্রিল, ২০২৩


Thumbnail

২৭ মার্চ রাতে বন্ধু সম্পাদকের ফোন। ফোনে তিনি জানালেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে চিঠি। সম্পাদক বললেন, ‘নানা কারণে সময়ে চিঠি গুরুত্বপূর্ণ।ব্যস এটুকুই। আমি বিভিন্ন সংবাদপত্রের অনলাইনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির বিবরণ পড়লাম।  চিঠিতে গুরুত্বপূর্ণ কী আছে তা খুঁজে বের করার আগেই একজন বিএনপিপন্থি শিক্ষক বুদ্ধিজীবীর ফোন। তিনি বললেন, বাইডেনের চিঠি দেখেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার আলটিমেটাম দিয়েছে। এবার আর ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হবে না। কথা বলতেই তিনি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটালেন। পরদিন সকালে কেবল অফিসে কাজ শুরু করেছি। এরকম সময় আওয়ামী লীগের এক নেতার উচ্ছ্বসিত ফোন। বাইডেনের চিঠি দেখছেন? শেষে দেখেনজয় বাংলাবলছে। আর নেত্রীর কী প্রশংসা। ভালো করে পড়েন। এরপর হাসির ফোয়ারার সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর মিলে এক কলতান হলো। বললেন, ‘এখন তো আমেরিকাও লাইনে। বিএনপির কী হবে?’ বলেই আবারও বেমক্কা হাসির দমকা হাওয়া। রমজান মাসে এত উচ্চৈঃস্বরে না হাসাই ভালো-এমনটা আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফোন রাখলাম। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠি তো একটাই। এই একই চিঠি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই পক্ষকেই খুশি করেছে। দুই পক্ষই মনে করছে চিঠির বার্তা তাদের পক্ষে। চিঠির কী ক্যারিশমা। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই চিঠিকে তাদের বিজয় মনে করছে। যেন ৫০০ বছর আগের মোনালিসার ছবির হাসির রহস্যের মতো। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৫০৩ ১৫০৪ সালে বিখ্যাত ছবি আঁকা শুরু করেন। এক ধনী ফ্লোরেনটাইন ব্যবসায়ীর অনুরোধে তিনি শিল্পকর্মটির কাজ শুরু করেছিলেন। সে ব্যবসায়ী তার স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনির একটি প্রতিকৃতি চেয়েছিলেন। নামকরণের সময় সেকালে ইতালিতেমোনাঅর্থাৎ ম্যাডোনা নারীর সম্বোধন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন যেমন মিস বা মিসেস ব্যবহার করা হয়। মোনাকে লিসার সঙ্গে যুক্ত করেই ছবির নামকরণমোনালিসাকরা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। লিওনার্দো ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চিত্রকল্পটি নির্মাণ করেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিরমোনালিসাবিশ্বব্যাপী আলোচিত, আকর্ষণীয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো রহস্যময়হাসি ভিঞ্চি দৃষ্টিকোণ এবং ছায়ার কাজের মাধ্যমে এমন একটি অনন্য হাসি তৈরি করেন, যা এক ধরনের অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করে। দর্শক যখনই মোনালিসার চোখের দিকে তাকান, মুখ হাসির মতো দেখায়। কিন্তু যখন দর্শকের দৃষ্টি হাসির ওপর স্থির হয়, এটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার মোনালিসার হাসির দুরকমের ব্যাখ্যা আছে। কেউ মনে করেন এটি একটি সুখী হাসি। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন মোনালিসার হাসি দুঃখের। ৫০০ বছর ধরে এই অমীমাংসিত বিতর্ক চলছে। জো বাইডেনের চিঠিও যেন তেমনি। এই চিঠির বার্তা এবং উদ্দেশ্য এক রহস্য তৈরি করেছে। এই চিঠির মর্মার্থ কী ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক চলবে বহুদিন। অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তো বটেই।

প্রথমেই আমার মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বুদবুদ করে উঠল, তা হলো এই যুগে চিঠি কেন? স্বাধীনতা দিবসে জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করতে পারতেন। বাইডেনের পক্ষ থেকেহোয়াইট হাউসবাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারত। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউস সচরাচর এরকম বিবৃতি দিয়ে থাকে। কদিন আগেই বাংলাদেশের বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাসংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার রাষ্ট্রপ্রধানরা ধরনের উৎসবে শুভেচ্ছা কার্ড বা স্মারকও প্রেরণ করেন। কিন্তু তা না করে বাইডেন সরাসরি চিঠি লিখলেন কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানেপ্রামাণ্যকরণবাডকুমেন্টেশনবলে একটি শব্দ বহুল প্রচলিত। ডকুমেন্টেড করে রাখা বা ভবিষ্যতের জন্য রেকর্ড রাখা একটি রাজনৈতিক কৌশল। হোয়াইট হাউস কি এটি ভবিষ্যতের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চায়? জন্য তাদের ইচ্ছার কথা লিখিত চিঠির আকারে পাঠানো হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে বা যার পক্ষেই এই চিঠি লেখা হোক যুক্তরাষ্ট্র এটিকে প্রামাণ্যকরণ করতে চেয়েছে। এই চিঠিকে ঘিরে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রটোকল সংক্রান্ত। প্রেসিডেন্ট সাধারণ শুভেচ্ছা, শোকবার্তা বা অন্য কোনো বার্তা পাঠাবেন তার কাউন্টার পার্টকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে যদি নিখাদ শুভেচ্ছা বার্তাই পাঠানো হয়, সেটি তো পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতিকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। এক্ষেত্রে যুক্তি অবশ্য আছে। যেহেতু মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেদেশে প্রধান নির্বাহী আবার বাংলাদেশে নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের প্রধান নির্বাহীকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বার্তা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই এই চিঠি নিছক, নির্ভেজাল শুভেচ্ছা নয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। জন্যই বাইডেন মহাশয়, রাষ্ট্রপতিকে না দিয়ে চিঠিটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।

চিঠিসংক্রান্ত আমার আরও এক বিভ্রম আছে। ২১ মার্চ বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। শুভেচ্ছা বার্তাটি পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সাধারণত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালে বা টেলিফোন করলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা প্রকাশ করে, প্রচার করে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফোনের কথা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই প্রকাশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন, শুভেচ্ছা বাণী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। আবার জাতিসংঘ মহাসচিবের শুভেচ্ছা বাণী কিংবা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২১ মার্চে জো বাইডেনের চিঠির কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কেউ। না প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি মনে করেছে, এটি গুরুত্বহীন বিষয়, তাই গণমাধ্যমে এটা জানানোর প্রয়োজন নেই। অথবা এই চিঠি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বস্তি রয়েছে। তারা এর প্রচার চায়নি। ধারণা করা যায়, মার্কিন দূতাবাস ২৭ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। বাইডেনের চিঠিটি যেহেতু ২৬ মার্চ উপলক্ষে। তাই উপলক্ষ লগ্ন শেষ হওয়ার পর মার্কিন দূতাবাস আর বিলম্ব করেনি। তারা পুরো চিঠিটা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ এই চিঠিটি সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেতাদুরস্ত কর্মকর্তাদের কাছে গুরুত্বহীন হলেও বারিধারায় মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠির মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই বার্তাটি জনগণের কাছেও পৌঁছে দিতে চেয়েছে। জন্য চিঠিটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে মার্কিন দূতাবাস।

এই চিঠি নিয়ে আমার আরেকটি জিজ্ঞাসা হলো, চিঠিটি কেন ২১ মার্চে পাঠান হলো? কেন ২৬ মার্চ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। বলা হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতেই এই চিঠি। তাহলে পাঁচ দিন আগে কেন শুভেচ্ছা বার্তাসংবলিত চিঠি। এর একটি কারণ আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। ২০ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরদিনই বাইডেন এই চিঠি পাঠান। মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরঞ্জন করা হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এবং যুক্তিহীনভাবে বেশ কিছু বিষয়ে দোষারোপ করা হয়েছে সরকারকে। ওই রিপোর্টে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠি। এটি কি সম্পূরক? স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা আসলে স্রেফউসিলা আসলে মানবাধিকার রিপোর্টের আলোকে মার্কিন প্রত্যাশা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন জো বাইডেন। সে জন্যই এই চিঠি। এরকম ধারণার পক্ষে আরও যুক্তি আছে। ২১ মার্চ এই চিঠির পরদিন ২২ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। স্যুট কোট পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছয় নেতা মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হন। সেখানেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন। নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় সে প্রত্যাশা মার্কিন আকাক্সক্ষার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তাহলে জো বাইডেনের চিঠি কি এক ধরনের চাপ? আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় আনুষ্ঠানিক জানিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা দিবসকে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া বা অভিমত জানানোর জন্য একটি দিবস হিসেবে কেবল বেছে নেওয়া হয়েছে?

এবার এই চিঠির মর্মার্থ বা ভাবার্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। চিঠির তাৎপর্য এবং এর উদ্দেশ খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক চিঠিতে কী আছে। জো বাইডেনের লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা স্বাধীনতার মূল্য গভীরভাবে বোঝে। কারণ তারা ১৯৭১ সালে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে এবং নিজেদের ভাষায় কথা বলার অধিকার পেতে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল।চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ উভয়ই গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখায় এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন সময় দাঁড়িয়ে দুই দেশের জনগণের গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।বাইডেনের চিঠিতে, শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রদর্শিত অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রী পর্যায়ে গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানের যৌথ আয়োজনের জন্য আমরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তা বৈশ্বিক মহামারি নির্মূলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নীত করেছে।চিঠিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে। চিঠির শেষাংশে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘আমাদের ৫০ বছরের বেশি সময়জুড়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুই দেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া, জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক প্রতিক্রিয়ায় অংশীদারিত্ব সমৃদ্ধ, নিরাপদ, গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকার। উদযাপনের এই দিনটিতে আপনার বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক শুভ কামনা। জয় বাংলা।মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির তিনটি ভাগ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ, মানবাধিকার গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হয়, সেই প্রত্যাশা মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠিতে খোলামেলাভাবে বলা হয়েছে। তবে এটি প্রত্যাশা না আদেশ তা মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যময়।

দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং সাফল্য চিঠিতে খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নেতৃত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে চিঠিতে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে চিঠির দুটো বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একটি হলো, ‘অবাধ সুষ্ঠু আগামী নির্বাচন।আর চিঠির শেষেজয় বাংলা বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের বিশ্বাস, এবার নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সিরিয়াস। তারা যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক অবাধ, সুষ্ঠু দেখতে চায়। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। বিএনপি নেতা-কর্মীদের এরকম বক্তব্যের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। দুই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাগাতারভাবে নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন অবস্থান এখন স্পষ্ট। সর্বশেষ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে এই নির্বাচনে ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ইচ্ছার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটালেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একাধিক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ভোটের এই লড়াই পরিচালনা করে বা রেফারির দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন। তাই সব পক্ষের ক্রিয়াশীল এবং দায়িত্বশীল আচরণের ওপর নির্ভর করে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই দাবিতে অনড় থেকে তারা যদি আগামী নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, তাহলে সেটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একটি রাজনৈতিক দল এরকম সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি এবং কয়েকটি দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে না? আবার একইভাবে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী দলগুলো যদি ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তাহলে এই অচলাবস্থায় নির্বাচন কীভাবে হবে? আওয়ামী লীগ বা বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না, তাই দেশের জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে দূরে রাখা কি গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হবে? নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক দলগুলোকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন যদি অবাধ সুষ্ঠু হয়। জনগণ যদি শান্তিপূর্ণভাবে এবং বাধাহীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেয় তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে না? প্রশ্নগুলোর উত্তর পরিষ্কার হওয়া জরুরি। ব্যাপারে মার্কিন ব্যাখ্যা জানাটাও প্রয়োজন। তা না হলে গণতন্ত্রকে যে কেউ জিম্মি করতেই পারে। যে চেষ্টা এখন দৃশ্যমান। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বাংলাদেশে ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্যই বিএনপি। তাই বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে নির্বাচনের আমেজ এবং আকর্ষণ অনেক কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরে অনেক ভোটার ভোট দিতে উৎসাহ হারাবেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সহজ। আর এই সহজ কৌশলেই ভরসা রেখেছে ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। বিএনপি মনে করছে, আগামী নির্বাচন যদি তারা বয়কট করে তাহলেই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি নির্বাচনের আগেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। তাহলে আগামী নির্বাচন যেন না হয় সে জন্য কি একটি মহল সক্রিয়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে? জন্যই কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিঠি দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন যে, সব দল অংশ না নিলে সেই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না। এখন বিএনপি হাত-পা গুটিয়ে থাকলেই অনির্বাচিত সরকার এবং অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের উচিত বিএনপির সঙ্গে নিয়ে কথা বলা। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় তাহলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বর্তমান সংবিধান এবং নির্বাচনসংক্রান্ত আইনে কী ধরনের ব্যবস্থা আছে। কোথায় কোথায় নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা আছে। কীভাবে নির্বাচনে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা দরকার। নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র কথা বলতে পারে। কিন্তু সেসব কিছুই না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব একা ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে আমি মনে করি।  বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু করতে হবে, এরকম বক্তব্যের আড়ালে আসলে নির্বাচন বানচাল করে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাঁকডাকের আসল উদ্দেশ কি নির্বাচন বানচাল করা? নাকি এই অঞ্চলে হারানো আধিপত্য পুনরুদ্ধার। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনের আওয়াজ তুলে যুক্তরাষ্ট্র আবার বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গুরুত্ব অব্যাহত রাখতেই স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তাতেও নির্বাচন প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। আর চিঠির শেষেজয় বাংলালিখে মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যের আবহ তৈরি করা হয়েছে।  যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ না, আওয়ামী লীগকে হটাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামেনি। তাদের বাংলাদেশে কোনো এজেন্ডা নেই। এটি প্রমাণের জন্যইজয় বাংলা আবেগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চিঠি আসলে মার্কিন প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষার প্রকাশ।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

দূতাবাসপল্লিতে রাজনীতিকদের ভিড় কেন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৭ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

প্যারিসে এক ধরনের পেশা আছে। এ পেশাকে বলা হয় ‘পিকচার গাইড’। যে কোনো ছবি দেখে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই গাইডরা বাতলে দেন। যে কোনো ছবির ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে এরকম বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক নেই। থাকলে নির্ঘাৎ আমার মতো অনেকেই এসব গাইডের কাছে যেতেন দুটি ছবির ব্যাখ্যার জন্য। একটি ছবি গত ২২ মার্চ বুধবারের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছয় আওয়ামী লীগ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশন। এ ছবিতে আওয়ামী লীগের সব নেতাই কেতাদুরস্ত পোশাক। স্যুট-কোট পরিহিত। মুজিব কোটে কেউ নেই (পোশাকে কী আসে যায়)। তাদের চেহারার মধ্যে একটা বিজয় বিজয় ভাব। যেন মস্ত কিছু অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় ছবিটা ১৬ মার্চ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বিএনপির পাঁচ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এ ছবিতে বিএনপি নেতাদের হাসিটা বেশ চওড়া। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারত জয়ের পর যেমন প্রশস্ত হাসি দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতাদের হাসিটা অনেকটা সেই আদলের। বিএনপি নেতারা কি তাহলে ভারত জয় করলেন? ওইদিন ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল? কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য। বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।’ কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’ নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা কি ভারত জয় করলেন, নাকি ভারতের ‘পুতুল’ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব কি আবার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্য কি দূতাবাস পল্লিতেই নির্ধারিত হবে? কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তো এরকম ছিল না। স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতারা মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফরে এলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে আমলারা বললেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে মন্ত্রীরই যাওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদায় মন্ত্রীর অনেক নিচে। একজন যুগ্ম সচিবকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ম্যাকনামারাকে রিসিভ করার জন্য। ৭ জুন ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কারও এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’

সত্যিই বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারেনি। নাক গলাতে না পারলেও তারা ষড়যন্ত্র করেছে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আন্তর্জাতিক মদদ এবং ষড়যন্ত্রের কথা এখন সবাই জানে। মার্কিন দলিলপত্রেই তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার বুস্টারের ভূমিকার কথা জানা যায়। ৭৫-এর পর থেকেই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো ক্ষমতাবান হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা মোড়ল মুরুব্বি বনে যান। বাংলাদেশের ক্ষমতাবদলের লাটাই চলে যায় দূতাবাসপাড়ায়। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকরা মনে করে, জনগণ নয়, রাষ্ট্রদূতরাই ক্ষমতার উৎস। বিদেশি প্রভুদের খুশি রাখলেই ক্ষমতার মসনদ ঠিকঠাক থাকবে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় জনভিত্তিহীন শাসকদের মধ্যে। শুরু হয় বিদেশি প্রভুদের পদলেহনের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খুশি না করতে পারলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না এমন একটি চিন্তা রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য অর্থনৈতিক কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৭৫-এর পর বাংলাদেশের অর্থনীতি পরনির্ভরতার পথে যাত্রা শুরু করে। বাজেট, উন্নয়ন সবকিছুই দাতাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভিক্ষা নিলে তো প্রভুদের কথা শুনতেই হবে। শর্তের জালে বন্দি হয় আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং উন্নয়ন ভাবনা। সাহায্য বা ঋণের চেয়ে শর্তের ফর্দ লম্বা হতে থাকে। কিন্তু এখান থেকেই বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর তার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করেন। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য বিশ্বব্যাংক চাপ দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ গ্রহণ করেননি সদ্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা, সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যকে কূটনীতিতে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। এরই ফলে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজেই একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গ্যাস বিক্রি করতে তিনি রাজি হননি। এ জন্যই ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। আমার বিবেচনায় ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে, বিএনপির ‘নতুন নেতা’ তারেক জিয়া ‘বিদেশি প্রভু’দের তুষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন যে যা চেয়েছে, সবকিছুতেই সায় দিয়েছিলেন তারেক জিয়া। ক্ষমতায় গেলে তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরামর্শ মেনে চলার মুচলেকা দিয়েই বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া এক কথা আর তার বাস্তবায়ন অন্য কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টো করা শুরু হয়। যেমন ভারতের কথাই ধারা যাক। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে ভারতের প্রধান চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যেন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু ৭৫-এর পর থেকে ২০০৮ সালের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের এ অনুরোধ রাখেনি। নানাভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ চারণভূমিতে পরিণত হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান তার বড় প্রমাণ। শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বিএনপির ওয়াদা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। আর এরকম পরিস্থিতি ২০০৬ সাল থেকেই কূটনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নতুন তৎপরতা। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেউ না, তৃতীয়পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে সবুজ সংকেত দেয় প্রভাবশালী দেশগুলো। এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আনতে বাংলাদেশের অবস্থিত কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের ভূমিকা, এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। আবার সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত এক-এগারো সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোই বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ দেয়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি খোলামেলাভাবে এই প্রসঙ্গটি এনেছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে গেল প্রণব মুখার্জি তাকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারে ‘সুশীল’রা কথাবার্তায় যতই পটু হোক না কেন, দেশ পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থ। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের আসল শক্তি ছিল বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলো। জনগণনির্ভর না থাকায়, এক-এগারো সরকার আসলে দূতাবাসগুলোর কথায় চলত। তাদের নির্দেশেই তারা নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। এ সময় শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান এবং অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রভাব কমতে থাকে। আওয়ামী লীগ দূতাবাসগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও রাজনৈতিক বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার নীতি শুরু করে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করে, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন।

ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক, সংবিধান সংশোধন করে তা ৭২-এর আদলে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইত্যাদি ইস্যুতে কূটনৈতিকপাড়াকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। উপরন্তু ২০১৪ ও ’১৫ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কেউ পছন্দ করেনি। কূটনৈতিক অঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর ঝোঁক দূতাবাসগুলোতে বিএনপিকে অনাহূত করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা হিসেবে ভাড়া করে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দূতাবাস পল্লিতে আবার তৎপরতার সুযোগ পায় বিএনপি। ড. কামালের সঙ্গে ঐক্য বিএনপির চোখ খুলে দেয়। জনগণ না ‘বিদেশি প্রভু’দের স্বপক্ষে আনাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়। এরপর থেকে ঘরে-বাইরে কূটনৈতিক তৎপরতাই বিএনপির প্রধান কাজ। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে বিষিয়ে তুলতে তারা যেমন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের কূটনৈতিকপাড়ায় তাদের দৌড়ঝাঁপ ফটোসেশন বেড়েছে। অনেকেই মনে করে ভারত বিএনপিকে পছন্দ করে না। বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, ভারত চাইলেই আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। এ জন্য ২০১৮ সালেও ভারতের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। ভারত এখনো বিএনপিকে আস্থায় নেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতে দলটির নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে নিজেদের ধন্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে দিনে একবার অন্তত কথা বলেছেন বিএনপি কোনো না কোনো নেতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি কী প্রমাণ করতে চায়? জনগণ নয়, দূতাবাস তাদের ক্ষমতায় আনবে? এটা দেখে সম্ভবত আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ভয় পেয়েছেন। তারা ভাবছেন, কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কুপোকাত করে দেয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে নাজেহাল করে ফেলবে। চাপে জর্জরিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কী না পারে। এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ইদানীং শোনা যায়। এ জন্য স্যুট কোট পরে মার্কিন দূতাবাসে আওয়ামী লীগের ধরনা মনে হচ্ছে, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একমাত্র বাধা যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি ব্যস্ত ‘ভারত’কে খুশি করাতে, আওয়ামী লীগ ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাগ ভাঙাতে। তাই, ডিনার, লাঞ্চ আর ককটেলের উৎসব চলছে দূতাবাস পল্লিতে। দুই প্রধান দল কি আবার জনগণের বদলে দূতাবাসগুলোকে ক্ষমতা বদলের নিয়ন্তা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে? তাহলে জনগণ কী করবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com

 



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

জামায়াত কি তাহলে নির্বাচনে যাবে?

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলাম। জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক নিবন্ধন নাই। দলীয় প্রতীক নিয়ে দলটি নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু এবার মার্কিন প্রতিবেদনে জামায়াতের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে বসে যে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার এবং লবিং করছেন, কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন, তার ফল ভোগ করতে শুরু করেছে জামায়াত। যে জামায়াতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দাবি করত, বিশেষ করে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সে জামায়াতকে রাজনীতি করার অধিকার না দেওয়ার সমালোচনা করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে। একই সাথে জামায়াত যে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারে না, সে প্রসঙ্গটিও উত্থাপন করা হয়েছে।

এটির পেছনে একটি বড় কারণ রয়েছে। বড় কারণ নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক লবিং এবং জামায়াতের কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ। কিন্তু আরেকটি কারণ রয়েছে, জামায়াতকে লাইম লাইটে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মেরুকরণ সৃষ্টির চেষ্টা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা কি হবে- তা নিয়ে একটি প্রশ্ন ক্রমশ সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়তো বিএনপিকে বাদ দিয়ে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারে। ইতিমধ্যে জামায়াত ৩শ’ নির্বাচনী এলাকায় প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় তাদের প্রার্থী চূড়ান্তকরণে কাজ করছে। 

জামায়াতের একাধিক সূত্র বলছে, অন্তত একশটি নির্বাচনী এলাকায় তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এই চূড়ান্ত প্রার্থীরা ইতিমধ্যে মাঠে বিভিন্ন রকমভাবে প্রচারণা করছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জামায়াতকে কি সরকার ছাড় দিবে? এমন একটি প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোরপাক খাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, কৌশলগত কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা নির্বাচন বর্জন করেছিল। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত নিজস্ব প্রতীক পায়নি। বরং তারা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিল এবং ২০টি আসনেই তাদের প্রার্থী জামানত হারিয়েছিল। এরপর থেকেই জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে ওঠেছে। 

২০১০ সালের পর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার কারণে রাজনীতির মাঠে জামায়াতকে প্রতিহত করার ডাক আসে। আর এর মধ্যেও জামায়াতের একমাত্র অস্তিত্ব ছিল বিএনপি। বিএনপির ছায়ায় জামায়াত ২০ দলীয় জোট হিসেবে কোনো রকমে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮-এর পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে এ রকম কথা আসতে থাকে যে, বিএনপি যুদ্ধাপরাধী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য গড়েছে। এটিই প্রমাণ করে যে, বিএনপি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাস করে না, আর আন্তর্জাতিক চাপে বিশ্বাস করে। ভারতের নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আস্তে আস্তে বিএনপি জামায়াত থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করে। 

একটা পর্যায়ে বিএনপি ২০ দলকে অকার্যকর করে দেয় এবং জামায়াত ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে চলতে শুরু করে। এরপর জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আর দুই দলের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পরও সরকার জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়নি, বরং যেখানেই জামায়াতে ইসলামীর কোনো বৈঠক বা  দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে, সেখানেই সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই জামায়াত মনে করছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সরকার একটু চাপের মধ্যে থাকবে। আর এ রকম পরিস্থিতিতে, জামায়াত যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে সরকার হয়তো তাদেরকে নির্বাচনের মাঠে নামার একটা সুযোগ দিবে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সংগঠনকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা এবং নতুন করে সংগঠিত করার একটি সুযোগ পাবে জামায়াতে ইসলামী। আর এই পরিকল্পনা থেকেই জামায়াত হয়তো আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সবাইকে একটি চমক দেখাতে চায়।

জামায়াত   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগ কি ভুল পথে?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ২৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক বছরের কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে ‌'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে এবং প্রধান টার্গেট বিএনপিকে করেছে তা ভুল রাজনৈতিক কৌশল বলে অনেকেই মনে করছে। আওয়ামী লীগের মিত্রহীন হয়ে যাওয়া বিশেষ করে সুশীল সমাজের সাথে সম্পর্কের অবনতি আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত বলে কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপথে পাঁচটি ভুল চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এই ভুলগুলো হলো;

মিত্রহীন: আওয়ামী লীগ ২০১৮ নির্বাচনের পর থেকে 'একলা চলো' নীতি অনুসরণ করছে। সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মহাজোট বা ১৪ দলীয় জোটের কাউকে রাখেনি। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের 'একলা চলো' নীতি অব্যাহত রয়েছে। এটি মহাজোট এবং জোটের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে এবং এই প্রতিক্রিয়া এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ তার আদর্শিক জোট ১৪ দলকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। যার ফলে ১৪ দলের নেতারা এখন আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সমালোচনা করছে। সামনে আওয়ামী লীগের যখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা করব তখন এই সমস্ত জোট এবং দলগুলো কতটুকু সহযোগিতা করবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন বলে অনেকেই মনে করছে।

আমলা নির্ভরতা: আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের পর থেকেই আমলাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং আমলাদের নির্ভরতা হতে যেয়ে এক শ্রেণির আমলা সরকারের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস যোগ্যতা এবং অতীত নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেকেই মনে করেন, যারা সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ অনুসরণ করে তারাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বরং সুবিধাবাদী, চাটুকার আমলারা এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেছেন। এরা কঠিন সময় আওয়ামী লীগকে ধোঁকা দেবে বলেই মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ যখন তাদের সহযোগিতা চাইবে তখন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বুদ্ধিজীবী এবং সুশীলদের সাথে সম্পর্কের অবনতি: আওয়ামী লীগের সঙ্গে দীর্ঘদিন সুশীল, বুদ্ধিজীবীদের একটি সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একান্ত ভাবে কাজ করেছিল সুশীল সমাজের একটি বড় অংশই। সেই সুশীল সমাজের অধিকাংশই এখন আওয়ামী লীগের ওপর নানা কারণে অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ  এবং তারা নানা করণেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত বটে। আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্তবুদ্ধির চিন্তার মানুষের দূরত্ব তৈরি করেছেন। যার ফলে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যারা জড়িত তারা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ভুল বলে অনেকেই মনে করছেন। 

বিএনপিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া: বিএনপির কর্মসূচি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আরেকটি রাজনৈতিক ভুল করেছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার কারণেই বিএনপি পূর্ণ:উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্ধুহীনতা: রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও আওয়ামী লীগ অনেকটা 'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটেছে। আর এক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

তবে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আওয়ামী লীগের একজন শেখ হাসিনা আছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে তিনি দলকে একাধিকবার উদ্ধার করেছেন, ভবিষ্যতে করবেন বলে অনেকেই মনে করেন।


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

২৫ মার্চের কালরাত। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর চালাল বর্বর গণহত্যা। এটাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পৈশাচিকতা। জাতিগত নিধনের এ নৃশংসতা গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করেছিল। সায়মন ড্রিং-এর মাধ্যমে বিশ্ব জেনেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর তান্ডবের কিছুটা। আজও বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বীভৎসতার কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে।  হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন কী করেনি পাকিস্তানিরা সেদিন।  এ ভয়ংকর নিধন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি জাতির পিতার নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে’। ’৭১-এর গণহত্যা এবং বর্বরতার নিন্দা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল মানবতার পক্ষে। কেনেডির মতো অনেক মানবিক মার্কিন রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। গণহত্যার পক্ষে। পাকিস্তানি বর্বরতায় ছিল তার সরাসরি সমর্থন। তার বিশ্বস্ত হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত করতে পারে না তা প্রমাণিত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালে ঠুনকো অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ করে। সংকটে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। জাসদ, গণবাহিনী, সর্বহারা দিয়ে দেশে সৃষ্টি করা হয় অস্থিরতা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে দিয়ে চলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে রচিত হয় আরেকটি নৃশংসতার কালো অধ্যায়। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত দলিলপত্রগুলো উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৭৫-এর বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছিল। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং মদদ দিয়েছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে খুনি মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। খুনিদের বাঁচাতে খুনি মোশতাক এবং জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন বানিয়েছিল। এ আইনকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মানবাধিকার হরণকারী আইন বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কোনো দলিলে এরকম জঘন্য একটি আইনের নিন্দা করেনি। এসব কথা মনে পড়ল গত ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট ২০২২-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত ৬১ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পড়ে। মনের অজান্তেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিটি ঠোঁটে এসে গেল- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’ যে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এ পাকিস্তানি গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেনি। ’৭৪-এ বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ’৭৫-এ জাতির পিতার হত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে- তারাই আজ বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিচারক হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিক্তিতে মাপার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। সত্যি কী বিচিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টের তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এ রিপোর্ট গতানুগতিক গৎবাঁধা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো রিপোর্ট হুবহু কপি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রিপোর্টের কিছু বিষয় ইঙ্গিতবাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিছু মন্তব্য, আকাক্সক্ষা রিপোর্টে লেখা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয়ত, তথ্যের উৎসের ব্যাপারে পক্ষপাত। বিতর্কিত এবং অসত্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে রিপোর্টে বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই হয়নি।

এ রিপোর্টের কিছু কিছু বিষয় গতানুগতিক এবং পুরনো রিপোর্টগুলোর অনুরূপ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নতুন কোনো কথা নেই। বেশ কিছু স্থানে গত বছরের রিপোর্টই যেন পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। একইভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে, সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গেও মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে নতুন কিছু নেই। মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২২ এর কিছু কিছু মন্তব্য এবং সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। ৬১ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংক্রান্ত মানবাধিকার রিপোর্ট শুরুই হয়েছে ২০১৮-এর নির্বাচন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। রিপোর্টের শুরুতে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন না। এ নির্বাচনে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের হুমকিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।’ মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট মূলত বছরওয়ারি মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। ২০২২ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার ওপরই এ রিপোর্ট সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন। কিন্তু ২০২২ সালের রিপোর্টে কেন ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো? মজার ব্যাপার হলো, ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রায় হুবহু মন্তব্য করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ২০১৮-এর মানবাধিকার প্রতিবেদনে। তাহলে চার বছর আগের প্রসঙ্গ নতুন করে উপস্থাপনের কারণ কী? ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। গত চার বছরে দুই ডজনের বেশি মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। অর্থাৎ ২০১৮-এর নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে এখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কী? নির্বাচনের আগে সরকারকে চাপে ফেলা? আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তো ১৯৯১ সালেই সংবিধান সংশোধনীতে বৃদ্ধি করা হয়। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন কেন? বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত প্রস্তাবকে সমর্থনের জন্য?

রিপোর্টে একাধিক জায়গায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। পুরো রিপোর্টে ‘অধিকার’ ‘মায়ের ডাকে’র মতো বিএনপি নিয়ন্ত্রিত সংগঠনগুলোর বক্তব্যকেই গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৪ পৃষ্ঠায় গুম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৬ জনের গুমের দাবি করেছে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো দাবি করেছে জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী।’ স্পষ্টতই এটি মায়ের ডাক পরিবেশিত তথ্য। যে ১৬ জনের কথা দাবি করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকেই ফিরে এসেছেন। এদের কেউ বিএনপি নেতা নন, এমনকি কর্মীও নন। ফিরে আসা অন্তত চারজন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত দুজন সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত কর্মকর্তা। যাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত। এরা তাদের নিজস্ব বয়ানে সেটি স্বীকারও করেছেন। মায়ের ডাকের তালিকায় একজনের নাম ছিল যিনি নিজেই পরে স্বীকার করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পালিয়ে গেছেন। এরকম একটি অসম্পূর্ণ এবং একপেশে প্রতিবেদন কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় তা এক বিস্ময় বটে। ‘অধিকার’ সংগঠনটির প্রধান আদিলুর রহমান খান, বিএনপিপন্থি আইনজীবী। সাবেক জাসদ নেতা আদিলুর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের ঢাকা তা-বের পর একটি অসত্য, বিকৃত প্রতিবেদনের জন্য তার সংগঠন সমালোচিত। ওই সময়ে হেফাজতের একাধিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার গুজব প্রচার করে ‘অধিকার’। পরে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মনগড়া। দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অধিকার এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এহেন গুজব সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট গুরুত্ব পেয়েছে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে। ‘মায়ের ডাক’ আরেকটি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন একজন বিএনপি নেতার বোন। ‘মায়ের ডাক’ গুম নিয়ে যতগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার আধিকাংশই পরবর্তীতে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বিএনপির প্রতি পক্ষপাত উথলে উঠছে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিএনপির প্রতি প্রায় প্রকাশ্য সমর্থন জানানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএনপি নেতারা মাঠে যে ভাষায় কথা বলেন, সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। রিপোর্টের ১৩ পৃষ্ঠায় বেগম জিয়ার দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘২০১৮ সালে দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের কারাদন্ড হয়। এ মামলাটি ২০০৮ সালে দায়ের করা। আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে খালেদা জিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন নিষ্পত্তিতে আদালত ধীরগতির নীতি নিয়ে চলছে।’ অথচ বাস্তবতা হলো- বেগম জিয়ার আইনজীবীরাই স্বীকার করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার ব্যাপারে তারা ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণ করেছেন। এতিমখানা দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আপিল বিভাগে হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা অনাগ্রহী। বিএনপি যখন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করছে তখন তার দায় সরকারের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য কী? বেগম জিয়া যে দুটি মামলায় দন্ডিত হয়েছেন সে দুটোর রায় হয় দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। তার আইনজীবীরা বারবার উচ্চ আদালতে গেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও যদি এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ হয় তাহলে ন্যায়বিচার কী?

মার্কিন প্রতিবেদনের ২১ পৃষ্ঠায় পড়লে মনে হতেই পারে এটি বোধহয় বিএনপির কোনো লিফলেট। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিএনপির কর্মসূচি পালনে নিয়মিতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয় না অথবা বাধা দেওয়া হয়।’ তাহলে সব বিভাগীয় শহরে বিএনপি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশ করল কীভাবে? এখনো প্রতি শনিবার বিএনপি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগে পালাক্রমে সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে কেমন করে? প্রতিবেদনের ৩১ পৃষ্ঠায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনের ঘটনা উঠে এসেছে খন্ডিতভাবে। ১০ ডিসেম্বরে বিএনপিকে যে স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে সমাবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ৭ তারিখে নয়াপল্টনে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করে বিএনপি। বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় ১৬ বস্তা চাল, ডাল। ব্যস্ত রাস্তায় অবস্থান নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়া কি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে? অথচ এ বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। একই পৃষ্ঠায় বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা এখনো অমীমাংসিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ ৮৬টি মামলার ৬১টির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রাখা হয়েছে, সেই তথ্যটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এ রিপোর্টে।

এ রিপোর্টে একটি ভয়ংকর দিক হলো আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টির ওপর আঘাতের চেষ্টা। প্রতিটি দেশেই নিজস্ব রীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ রয়েছে। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন হাজার বছরের পুরনো। পরিবার, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, বিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে গভীর করেছে। প্রাচ্যের পরিবার প্রথা, রক্ষণশীল প্রেম বিয়ে, রোমান্টিকতা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মূল্যবোধকে এখন পশ্চিমা বিশ্ব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঐতিহ্যগতভাবেই এখানে সমকামিতা, সমলিঙ্গের বিয়ে ইত্যাদি বিষয়কে বিকৃতি মনে করা হয়। আমাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি এসবকে লালন করে না। সমকামিতা বা সমলিঙ্গের সম্পর্ককে এ দেশের প্রায় সব মানুষ বিকৃতি মনে করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়েও এটি আমাদের রুচি এবং সংস্কৃতির চেতনার সঙ্গে প্রোথিত। অথচ ৬১ পৃষ্ঠার মানবাধিকার প্রতিবেদনে অন্তত এক ডজনবার এসব পাশ্চাত্য বিকৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইন্ধন আছে। আমাদের চিরায়ত, সহজাত সামাজিক সম্পর্কের ভিতর এসব পশ্চিমা হতাশাজনিত কারণে সৃষ্ট অনৈতিক এবং রুচিহীন সম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। এমনকি এ প্রতিবেদনে নাস্তিকতাকে সমর্থন এবং তাদের অধিকারের প্রতিও এক ধরনের সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যক্তি উগ্র মৌলবাদীদের মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য হতাশা, বিকৃতি এবং কুরুচি অনুপ্রবেশের এক ধরনের প্ররোচনা আছে এ প্রতিবেদনে। অন্যদিকে আবার যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় মার্কিন প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টটি তাদের দ্বৈত ও স্ববিরোধী নীতির এক প্রকাশ।

এ প্রতিবেদনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো জামায়াতপ্রীতি। এ সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের বড় পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১, ২০০২ এবং ২০০৪ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে জামায়াতকে একটি উগ্র দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এবার প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে একেবারে ইউটার্ন নিয়েছে। প্রতিবেদনের ১৩ পৃষ্ঠায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিরোধী দলের সদস্যদেরই বিচারে দন্ডিত করা হয়েছে। ’৭১-এ গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে জন্যই কি তাদের এ আর্তনাদ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কোনো মানদন্ডে আন্তর্জাতিক মানের। ন্যায়বিচারের প্রতিটি ধাপ যথাযথ অনুসরণ করেই এ বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ’৭১-এর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনকে আবারও সমর্থন দিল? তারা কি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব? এ জন্যই এত আক্রোশ?

মার্কিন প্রতিবেদনের ৩০ ও ৩১ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি যেন মাত্রা ছাড়া। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিরোধী কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত। সর্ববৃহৎ মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সংবিধানে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ রিপোর্টে ভুলভাবে বলা হয়েছে সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত নামে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াও এখন বন্ধ। অথচ পুরো ব্যাপারটি হয়েছে সর্বোচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। এ জামায়াতকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ‘শত্রু’ মনে করত। আগের একাধিক রিপোর্টে এদের তালেবানদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত জামায়াত নারী স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। তাদের অধিকারের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ কেন? এটা কি আফগানিস্তান নাটকের পুনরাবৃত্তি? ‘কমিউনিজম’ ঠেকাতে আফগানিস্তানে তালেবানদের পেলে-পুষে বড় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তান তুলে দিয়ে তারা পালিয়েছে। এখন বাংলাদেশে কি একই নিরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় বিশ্ব মোড়ল? ’৭১-এ যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, সেই দেশটি আজ বিশ্বের বিস্ময়। উন্নয়নের রোল মডেল। এ কারণেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এত রাগ, ক্ষোভ। এ উন্নয়নও তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরেক পরাজয়। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়? পুরো প্রতিবেদনটি নির্মোহভাবে পড়লে মনে হতেই পারে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা আছে। নির্বাচনকে ঘিরে একটি অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত আছে মার্কিন প্রতিবেদনে। তাহলে নির্বাচন বানচাল করে কোন ‘হামিদ কারজাই’কে ক্ষমতায় বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার অনিবার্য পরিণতি হবে মৌলবাদীদের উত্থান। মার্কিন প্রতিবেদন কি তারই সংকেত?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন