মার্চ
মাস বাঙালির আবেগের মাস। স্বাধীনতার মাস। ৭ মার্চ জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তি ও
স্বাধীনতা বলতে জাতির পিতা রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলেছিলেন। ৭ মার্চ জাতির
পিতার দেখানো পথেই বাঙালি এগিয়ে যায়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে চালায় নির্মম, নৃশংসতম বর্বরতা। জ্বলে-পুড়ে ছারখার হওয়ার পরও মাথা নোয়ায়নি বীর বাঙালি। জাতির পিতার নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী
যুদ্ধের পর বাংলাদেশের অভ্যুদয়
ঘটে। আমরা পাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। রক্তে রঞ্জিত পতাকা, মানচিত্র। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতাই জাতির পিতার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ‘সোনার বাংলা’। অর্থনৈতিক মুক্তি।
একটি স্বনির্ভর স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। যেখানে সব মানুষ তার
মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারবে। বিশ্বে বাঁচবে সম্মানের সঙ্গে। মাথা উঁচু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সে পথেই গড়ার
সংগ্রাম শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ৭৫-এর ১৫
আগস্টের জঘন্যতম ঘটনা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। ঝাপসা হয়ে যায় অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। বাংলাদেশ একটা পর মুখাপেক্ষী, পরনির্ভর
রাষ্ট্র হিসেবেই চিহ্নিত হতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা বলেছিল,
‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’; কিংবা যেসব অর্থনীতিবিদ এ দেশ সম্পর্কে
বলেছিল, ‘বাংলাদেশ হবে দারিদ্র্যের মডেল’—তাদের ভবিষ্যদ্বাণী যেন সত্য প্রমাণিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ হারে না। বাঙালি বিজয়ী জাতি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। ১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেই শেখ হাসিনা শুরু করেন জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার সংগ্রাম। শুরু করেন অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর সোনার
বাংলা বিনির্মাণের দ্বিতীয় যুদ্ধ। ২০০৯ সাল থেকে এই যুদ্ধে দৃঢ়ভাবে
লড়াই করছে বাংলাদেশ। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এই যুদ্ধ একটু
অন্যরকম যুদ্ধ। শেখ হাসিনা এ যুদ্ধের সেনাপতি।
প্রবাসে থাকা রেমিট্যান্স পাঠানো কর্মী, গার্মেন্টসকর্মী, সোনার ফসল ফলানোর কৃষক, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তারা হলেন এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা।
যে ভাই বা বোনটি প্রবাসে
কঠিন পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন, তিনি এ যুদ্ধে সাহসী
সৈনিক। গার্মেন্টসে যে বোনের নিপুণ
বুননে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তিনি এই যুদ্ধের যোদ্ধা।
যাদের পরিশ্রমে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, আমরা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি, তারাই দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। আর এ যুদ্ধটা
অনেকটাই ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের
মতোই।
’৭১-এ যেমন রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের ক্রীতদাস রাখার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল এ দেশের রাজাকার, আলবদর এবং যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠী। এ যুদ্ধেও বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিপক্ষ আছে। এরাও ’৭১-এর মতো বর্তমান বাংলাদেশের মুক্তির প্রতিপক্ষ। এরা বাংলাদেশকে পরমুখাপেক্ষী রাখতে চায়। পরনির্ভর রাখতে চায়। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে পঙ্গু রাখতে চায়। গার্মেন্টসকর্মী, রেমিট্যান্সযোদ্ধা এবং দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীরা যদি একালের মুক্তিযোদ্ধা হন, তাহলে তখনকার রাজাকার, আলশামস, আলবদর আর যুদ্ধাপরাধী কারা?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের উন্নয়নের চিত্রটা একটু বিশদ বিশ্লেষণ করতে হবে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের বিপ্লব হয়েছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল—বাংলাদেশের উন্নয়নের একেকটি স্বারক চিহ্ন। শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন কেন? কমিউনিটি ক্লিনিক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের গড় মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, প্রবৃদ্ধির হার সবকিছুই ঈর্ষণীয়। কিন্তু বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যেতে পারত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে শঙ্কা, তা থেকেও আমরা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারতাম। তিনটি কারণে আমাদের অর্থনীতি এখন সংকটে। তিন ত্রুটির জন্য এখনো আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি বা জাতির পিতার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার দ্বিতীয় ধাপ অর্জন করতে পারিনি। এ তিন ব্যাধি হলো—দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও ঋণখেলাপি। এ তিনটি ব্যাধি থেকে মুক্ত হতে পারলেই আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব। দুর্নীতি যে আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম শত্রু তা চিহ্নিত করেন জাতির পিতা। ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে পিরোজপুর শহরের গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কোনো অফিস-আদালতে দুর্নীতি হলে এবং আপনাদের নিকট ঘুষ চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তিন পয়সার একটি পোস্ট কার্ডে লিখে আমাকে জানাবেন। আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যাতে দুর্নীতি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।’ দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ নীতি এবং আদর্শে অটল বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা এখনো সক্রিয়। দুর্নীতিবাজরা একালের রাজাকার। প্রশাসনে, রাজনীতির মধ্যে দুর্নীতিবাজরা শক্ত শেকড় দৃশ্যমান। এ শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা সম্ভব নয়।
একটা ব্যাপারে সবাই একমত যে, বাংলাদেশ থেকে যদি বিপুল অর্থ পাচার না হতো তাহলে আমরা অর্থনীতিতে আরও শক্তিশালী অবস্থানে থাকতাম। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ভয়াবহ তথ্য পাওয়া যায়। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সুইস ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ২০২১ সালের প্রতিবেদন বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের মোট অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে জমার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঙ্ক বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকেই পাচার হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য দেশে অর্থ পাচারের হিসাব যোগ করলে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। কারা বিদেশে অর্থ পাচার করে আমরা সবাই জানি। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপার কেলেঙ্কারিতে এরকম ৪৩ জন অর্থ পাচারকারীর নাম এসেছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। ডলার সংকটের মুখে সরকার অর্থ পাচারকারীদের বিশেষ ছাড় দেয়। পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা হলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করাও ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। অর্থ পাচারকারীরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এরা একালের যুদ্ধাপরাধী। কারণ, আমরা যতই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি, যতই উপার্জন করি না কেন, অর্থ যদি পাচার হয়ে যায়, তাহলে কিছুতেই আমরা আমাদের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে পারব না। আমরা স্বাবলম্বী হতে পারব না। অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ও ঝুঁকি থেকেই যাবে।
আমাদের মুক্তির সংগ্রামের তৃতীয় শত্রু হলো ঋণখেলাপি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সম্প্রতি এক ভাষণে ঋণখেলাপিদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ কেউ ইচ্ছে করেই ঋণখেলাপি হয়। ব্যাংক থেকে টাকা নেয় পরিশোধ না করার জন্য।’ তার এ বক্তব্য যে কতটা নির্মম বাস্তবতা, তা বোঝা যায় ব্যাংকের ঋণখেলাপির হিসাব থেকেই। গত বছর সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত তিন মাসে শুধু খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে কথাই হয়েছে শুধু। অর্থ উদ্ধারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। খেলাপি ঋণ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক ভয়ংকর রোগ। যারা ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার জন্যই ঋণ নেন, তারা একালের রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী। এদের জন্যই মুক্তির সংগ্রামে এখনো আমরা বিজয়ী হতে পারছি না।
মার্চ মাস আমাদের দ্রোহের মাস। সংকল্পের মাস। নতুন মুক্তিযুদ্ধে তাই এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতেই হবে। নব্য রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের পরাজিত না করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধে আমরা জয়ী হতে পারব না। স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ কিংবা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কোনোটাই অর্জন করা যাবে না।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
মন্তব্য করুন
২৭ মার্চ রাতে
বন্ধু সম্পাদকের ফোন। ফোনে তিনি জানালেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন। গত ২৬ মার্চ
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এ চিঠি। সম্পাদক
বললেন, ‘নানা কারণে এ সময়ে এ
চিঠি গুরুত্বপূর্ণ।’ ব্যস এটুকুই। আমি বিভিন্ন সংবাদপত্রের অনলাইনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির বিবরণ পড়লাম। চিঠিতে গুরুত্বপূর্ণ কী আছে তা
খুঁজে বের করার আগেই একজন বিএনপিপন্থি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীর ফোন।
তিনি বললেন, বাইডেনের চিঠি দেখেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার আলটিমেটাম দিয়েছে। এবার আর ২০১৪ এবং
২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হবে না। এ কথা বলতেই
তিনি বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ঘটালেন। পরদিন সকালে কেবল অফিসে কাজ শুরু করেছি। এরকম সময় আওয়ামী লীগের এক নেতার উচ্ছ্বসিত
ফোন। বাইডেনের চিঠি দেখছেন? শেষে দেখেন ‘জয় বাংলা’ বলছে।
আর নেত্রীর কী প্রশংসা। ভালো
করে পড়েন। এরপর হাসির ফোয়ারার সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর মিলে এক কলতান হলো।
বললেন, ‘এখন তো আমেরিকাও লাইনে।
বিএনপির কী হবে?’ বলেই
আবারও বেমক্কা হাসির দমকা হাওয়া। রমজান মাসে এত উচ্চৈঃস্বরে না
হাসাই ভালো-এমনটা আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফোন রাখলাম। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠি তো একটাই। এই
একই চিঠি আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই পক্ষকেই খুশি করেছে। দুই পক্ষই মনে করছে এ চিঠির বার্তা
তাদের পক্ষে। চিঠির কী ক্যারিশমা। আওয়ামী
লীগ এবং বিএনপি দুই দলই এ চিঠিকে তাদের
বিজয় মনে করছে। এ যেন ৫০০
বছর আগের মোনালিসার ছবির হাসির রহস্যের মতো। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ১৫০৩ ও ১৫০৪ সালে
এ বিখ্যাত ছবি আঁকা শুরু করেন। এক ধনী ফ্লোরেনটাইন
ব্যবসায়ীর অনুরোধে তিনি এ শিল্পকর্মটির কাজ
শুরু করেছিলেন। সে ব্যবসায়ী তার
স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনির একটি প্রতিকৃতি চেয়েছিলেন। নামকরণের সময় সেকালে ইতালিতে ‘মোনা’ অর্থাৎ ম্যাডোনা নারীর সম্বোধন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন যেমন মিস বা মিসেস ব্যবহার
করা হয়। মোনাকে লিসার সঙ্গে যুক্ত করেই ছবির নামকরণ ‘মোনালিসা’ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। লিওনার্দো ১০ বছরের বেশি
সময় ধরে চিত্রকল্পটি নির্মাণ করেন। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ‘মোনালিসা’ বিশ্বব্যাপী আলোচিত, আকর্ষণীয় হওয়ার অন্যতম কারণ হলো রহস্যময় ‘হাসি’। ভিঞ্চি দৃষ্টিকোণ
এবং ছায়ার কাজের মাধ্যমে এমন একটি অনন্য হাসি তৈরি করেন, যা এক ধরনের
অপটিক্যাল ইলিউশন তৈরি করে। দর্শক যখনই মোনালিসার চোখের দিকে তাকান, মুখ হাসির মতো দেখায়। কিন্তু যখন দর্শকের দৃষ্টি হাসির ওপর স্থির হয়, এটি অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার মোনালিসার হাসির দু’রকমের ব্যাখ্যা
আছে। কেউ মনে করেন এটি একটি সুখী হাসি। আবার অনেকে বিশ্বাস করেন মোনালিসার হাসি দুঃখের। ৫০০ বছর ধরে এই অমীমাংসিত বিতর্ক
চলছে। জো বাইডেনের চিঠিও
যেন তেমনি। এই চিঠির বার্তা
এবং উদ্দেশ্য এক রহস্য তৈরি
করেছে। এই চিঠির মর্মার্থ
কী ছিল, তা নিয়ে বিতর্ক
চলবে বহুদিন। অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত তো বটেই।
প্রথমেই আমার মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বুদবুদ করে উঠল, তা হলো এই যুগে চিঠি কেন? স্বাধীনতা দিবসে জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করতে পারতেন। বাইডেনের পক্ষ থেকে ‘হোয়াইট হাউস’ বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারত। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউস সচরাচর এরকম বিবৃতি দিয়ে থাকে। কদিন আগেই বাংলাদেশের বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাসংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ধরনের উৎসবে শুভেচ্ছা কার্ড বা স্মারকও প্রেরণ করেন। কিন্তু তা না করে বাইডেন সরাসরি চিঠি লিখলেন কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘প্রামাণ্যকরণ’ বা ‘ডকুমেন্টেশন’ বলে একটি শব্দ বহুল প্রচলিত। ডকুমেন্টেড করে রাখা বা ভবিষ্যতের জন্য রেকর্ড রাখা একটি রাজনৈতিক কৌশল। হোয়াইট হাউস কি এটি ভবিষ্যতের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চায়? এ জন্য তাদের ইচ্ছার কথা লিখিত চিঠির আকারে পাঠানো হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে বা যার পক্ষেই এই চিঠি লেখা হোক যুক্তরাষ্ট্র এটিকে প্রামাণ্যকরণ করতে চেয়েছে। এই চিঠিকে ঘিরে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রটোকল সংক্রান্ত। প্রেসিডেন্ট সাধারণ শুভেচ্ছা, শোকবার্তা বা অন্য কোনো বার্তা পাঠাবেন তার কাউন্টার পার্টকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে যদি নিখাদ শুভেচ্ছা বার্তাই পাঠানো হয়, সেটি তো পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতিকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। এক্ষেত্রে যুক্তি অবশ্য আছে। যেহেতু মার্কিন প্রেসিডেন্ট সেদেশে প্রধান নির্বাহী আবার বাংলাদেশে নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তাই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশের প্রধান নির্বাহীকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বার্তা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই এই চিঠি নিছক, নির্ভেজাল শুভেচ্ছা নয়। এটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। এ জন্যই বাইডেন মহাশয়, রাষ্ট্রপতিকে না দিয়ে চিঠিটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।
চিঠিসংক্রান্ত আমার আরও এক বিভ্রম আছে। ২১ মার্চ বাইডেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। শুভেচ্ছা বার্তাটি পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সাধারণত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠালে বা টেলিফোন করলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা প্রকাশ করে, প্রচার করে। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ফোনের কথা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই প্রকাশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর টেলিফোন, শুভেচ্ছা বাণী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। আবার জাতিসংঘ মহাসচিবের শুভেচ্ছা বাণী কিংবা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের যোগাযোগ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু ২১ মার্চে জো বাইডেনের চিঠির কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কেউ। না প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি মনে করেছে, এটি গুরুত্বহীন বিষয়, তাই গণমাধ্যমে এটা জানানোর প্রয়োজন নেই। অথবা এই চিঠি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অস্বস্তি রয়েছে। তারা এর প্রচার চায়নি। ধারণা করা যায়, মার্কিন দূতাবাস ২৭ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। বাইডেনের চিঠিটি যেহেতু ২৬ মার্চ উপলক্ষে। তাই উপলক্ষ লগ্ন শেষ হওয়ার পর মার্কিন দূতাবাস আর বিলম্ব করেনি। তারা পুরো চিঠিটা গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে। অর্থাৎ এই চিঠিটি সেগুনবাগিচায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেতাদুরস্ত কর্মকর্তাদের কাছে গুরুত্বহীন হলেও বারিধারায় মার্কিন কূটনীতিকদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, প্রধানমন্ত্রীকে চিঠির মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই বার্তাটি জনগণের কাছেও পৌঁছে দিতে চেয়েছে। এ জন্য চিঠিটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছে মার্কিন দূতাবাস।
এই চিঠি নিয়ে আমার আরেকটি জিজ্ঞাসা হলো, চিঠিটি কেন ২১ মার্চে পাঠান হলো? কেন ২৬ মার্চ নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ। বলা হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাতেই এই চিঠি। তাহলে পাঁচ দিন আগে কেন শুভেচ্ছা বার্তাসংবলিত চিঠি। এর একটি কারণ আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। ২০ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরদিনই বাইডেন এই চিঠি পাঠান। মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরঞ্জন করা হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত এবং যুক্তিহীনভাবে বেশ কিছু বিষয়ে দোষারোপ করা হয়েছে সরকারকে। ওই রিপোর্টে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠি। এটি কি সম্পূরক? স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা আসলে স্রেফ ‘উসিলা’। আসলে মানবাধিকার রিপোর্টের আলোকে মার্কিন প্রত্যাশা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন জো বাইডেন। সে জন্যই এই চিঠি। এরকম ধারণার পক্ষে আরও যুক্তি আছে। ২১ মার্চ এই চিঠির পরদিন ২২ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। স্যুট কোট পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে ছয় নেতা মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হন। সেখানেও মার্কিন রাষ্ট্রদূত আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন। নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হয় সে প্রত্যাশা ও মার্কিন আকাক্সক্ষার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। তাহলে জো বাইডেনের চিঠি কি এক ধরনের চাপ? আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় আনুষ্ঠানিক জানিয়ে দেওয়া। স্বাধীনতা দিবসকে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া বা অভিমত জানানোর জন্য একটি দিবস হিসেবে কেবল বেছে নেওয়া হয়েছে?
এবার এই চিঠির মর্মার্থ বা ভাবার্থ খুঁজে দেখার চেষ্টা করা যেতে পারে। চিঠির তাৎপর্য এবং এর উদ্দেশ খোঁজার আগে দেখে নেওয়া যাক চিঠিতে কী আছে। জো বাইডেনের লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাই। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার মূল্য গভীরভাবে বোঝে। কারণ তারা ১৯৭১ সালে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে এবং নিজেদের ভাষায় কথা বলার অধিকার পেতে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল।’ চিঠিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ উভয়ই গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখায় এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশ পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এমন সময় দাঁড়িয়ে দুই দেশের জনগণের গণতন্ত্র, সমতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি।’ বাইডেনের চিঠিতে, শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের প্রদর্শিত অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রী পর্যায়ে গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানের যৌথ আয়োজনের জন্য আমরা বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ তা বৈশ্বিক মহামারি নির্মূলে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নীত করেছে।’ চিঠিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে। চিঠির শেষাংশে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিখেছেন, ‘আমাদের ৫০ বছরের বেশি সময়জুড়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুই দেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে এগিয়ে নেওয়া, জনগণের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও জলবায়ু সমস্যা মোকাবিলা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক প্রতিক্রিয়ায় অংশীদারিত্ব ও সমৃদ্ধ, নিরাপদ, গণতান্ত্রিক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকার। উদযাপনের এই দিনটিতে আপনার ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আন্তরিক শুভ কামনা। জয় বাংলা।’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির তিনটি ভাগ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনগণ, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, সেই প্রত্যাশা মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠিতে খোলামেলাভাবে বলা হয়েছে। তবে এটি প্রত্যাশা না আদেশ তা মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যময়।
দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্ব এবং সাফল্য চিঠিতে খানিকটা তুলে ধরা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের নেতৃত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে চিঠিতে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে চিঠির দুটো বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। একটি হলো, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু আগামী নির্বাচন।’ আর চিঠির শেষে ‘জয় বাংলা’। বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকদের বিশ্বাস, এবার নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সিরিয়াস। তারা যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক অবাধ, সুষ্ঠু দেখতে চায়। বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া সেটি সম্ভব নয়। বিএনপি নেতা-কর্মীদের এরকম বক্তব্যের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। দুই বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লাগাতারভাবে নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলছে। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন অবস্থান এখন স্পষ্ট। সর্বশেষ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে এই নির্বাচনে ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন ইচ্ছার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটালেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় একাধিক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। ভোটের এই লড়াই পরিচালনা করে বা রেফারির দায়িত্ব পালন করে নির্বাচন কমিশন। তাই সব পক্ষের ক্রিয়াশীল এবং দায়িত্বশীল আচরণের ওপর নির্ভর করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই দাবিতে অনড় থেকে তারা যদি আগামী নির্বাচন থেকে দূরে থাকে, তাহলে সেটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। একটি রাজনৈতিক দল এরকম সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। প্রশ্ন হলো, বিএনপি এবং কয়েকটি দল যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে না? আবার একইভাবে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী দলগুলো যদি ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তাহলে এই অচলাবস্থায় নির্বাচন কীভাবে হবে? আওয়ামী লীগ বা বিএনপি অংশগ্রহণ করবে না, তাই দেশের জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে দূরে রাখা কি গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হবে? নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছুক দলগুলোকে বাদ দিয়ে যদি নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। জনগণ যদি শান্তিপূর্ণভাবে এবং বাধাহীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দেয় তাহলে সেই নির্বাচন কি গ্রহণযোগ্য হবে না? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পরিষ্কার হওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে মার্কিন ব্যাখ্যা জানাটাও প্রয়োজন। তা না হলে গণতন্ত্রকে যে কেউ জিম্মি করতেই পারে। যে চেষ্টা এখন দৃশ্যমান। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং অবাধ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। বাংলাদেশে ভোটের হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অবশ্যই বিএনপি। তাই বিএনপি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে নির্বাচনের আমেজ এবং আকর্ষণ অনেক কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। নির্বাচনের ফলাফল কী হতে যাচ্ছে, তা বুঝতে পেরে অনেক ভোটার ভোট দিতে উৎসাহ হারাবেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সহজ। আর এই সহজ কৌশলেই ভরসা রেখেছে ১৬ বছরের বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। বিএনপি মনে করছে, আগামী নির্বাচন যদি তারা বয়কট করে তাহলেই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি নির্বাচনের আগেই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। তাহলে আগামী নির্বাচন যেন না হয় সে জন্য কি একটি মহল সক্রিয়? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি তাদের পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে? এ জন্যই কি মার্কিন প্রেসিডেন্ট চিঠি দিয়ে ইঙ্গিত দিলেন যে, সব দল অংশ না নিলে সেই নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না। এখন বিএনপি হাত-পা গুটিয়ে থাকলেই অনির্বাচিত সরকার এবং অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পথ তৈরি হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশ সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে, তাদের উচিত বিএনপির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলা। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় তাহলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। বর্তমান সংবিধান এবং নির্বাচনসংক্রান্ত আইনে কী ধরনের ব্যবস্থা আছে। কোথায় কোথায় নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা আছে। কীভাবে নির্বাচনে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, তার উপায় খুঁজে বের করা দরকার। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্র কথা বলতে পারে। কিন্তু সেসব কিছুই না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের দায়িত্ব একা ক্ষমতাসীন দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু করতে হবে, এরকম বক্তব্যের আড়ালে আসলে নির্বাচন বানচাল করে অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার কোনো ষড়যন্ত্র চলছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার।
আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাঁকডাকের আসল উদ্দেশ কি নির্বাচন বানচাল করা? নাকি এই অঞ্চলে হারানো আধিপত্য পুনরুদ্ধার। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচনের আওয়াজ তুলে যুক্তরাষ্ট্র আবার বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গুরুত্ব অব্যাহত রাখতেই স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তাতেও নির্বাচন প্রসঙ্গ আনা হয়েছে। আর চিঠির শেষে ‘জয় বাংলা’ লিখে মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যের আবহ তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ না, আওয়ামী লীগকে হটাতে আদাজল খেয়ে মাঠে নামেনি। তাদের বাংলাদেশে কোনো এজেন্ডা নেই। এটি প্রমাণের জন্যই ‘জয় বাংলা’র আবেগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই চিঠি আসলে মার্কিন প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষার প্রকাশ।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
প্যারিসে এক ধরনের পেশা
আছে। এ পেশাকে বলা
হয় ‘পিকচার গাইড’। যে কোনো
ছবি দেখে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই গাইডরা বাতলে
দেন। যে কোনো ছবির
ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে এরকম বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক নেই।
থাকলে নির্ঘাৎ আমার মতো অনেকেই এসব গাইডের কাছে যেতেন দুটি ছবির ব্যাখ্যার জন্য। একটি ছবি গত ২২ মার্চ
বুধবারের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছয় আওয়ামী লীগ
নেতার হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশন। এ ছবিতে আওয়ামী
লীগের সব নেতাই কেতাদুরস্ত
পোশাক। স্যুট-কোট পরিহিত। মুজিব কোটে কেউ নেই (পোশাকে কী আসে যায়)। তাদের চেহারার
মধ্যে একটা বিজয় বিজয় ভাব। যেন মস্ত কিছু অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় ছবিটা ১৬ মার্চ ভারতীয়
রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বিএনপির পাঁচ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এ ছবিতে বিএনপি
নেতাদের হাসিটা বেশ চওড়া। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারত জয়ের পর যেমন প্রশস্ত
হাসি দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতাদের হাসিটা অনেকটা সেই আদলের। বিএনপি নেতারা কি তাহলে ভারত
জয় করলেন? ওইদিন ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের
টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন
পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল?
কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য।
বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে
রেখেছে।’
কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ
সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’
নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা
কি ভারত জয় করলেন, নাকি
ভারতের ‘পুতুল’
হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘বন্ধু’
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব কি আবার প্রতিষ্ঠিত
হতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্য কি দূতাবাস পল্লিতেই
নির্ধারিত হবে? কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তো এরকম ছিল
না। স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতারা মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফরে এলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে আমলারা বললেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে মন্ত্রীরই যাওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদায় মন্ত্রীর অনেক নিচে। একজন যুগ্ম সচিবকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ম্যাকনামারাকে রিসিভ করার জন্য। ৭ জুন ১৯৭২
সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কারও এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’
সত্যিই বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারেনি। নাক গলাতে না পারলেও তারা
ষড়যন্ত্র করেছে। ৭৫-এর ১৫
আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আন্তর্জাতিক মদদ এবং ষড়যন্ত্রের কথা এখন সবাই জানে। মার্কিন দলিলপত্রেই তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার বুস্টারের ভূমিকার কথা জানা যায়। ৭৫-এর পর
থেকেই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো ক্ষমতাবান হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা মোড়ল মুরুব্বি বনে যান। বাংলাদেশের ক্ষমতাবদলের লাটাই চলে যায় দূতাবাসপাড়ায়। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকরা মনে করে, জনগণ নয়, রাষ্ট্রদূতরাই ক্ষমতার উৎস। বিদেশি প্রভুদের খুশি রাখলেই ক্ষমতার মসনদ ঠিকঠাক থাকবে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় জনভিত্তিহীন শাসকদের মধ্যে। শুরু হয় বিদেশি প্রভুদের
পদলেহনের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খুশি না করতে পারলে
ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না এমন একটি
চিন্তা রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য
অর্থনৈতিক কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৭৫-এর পর
বাংলাদেশের অর্থনীতি পরনির্ভরতার পথে যাত্রা শুরু করে। বাজেট, উন্নয়ন সবকিছুই দাতাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভিক্ষা নিলে তো প্রভুদের কথা
শুনতেই হবে। শর্তের জালে বন্দি হয় আমাদের রাজনীতি,
অর্থনীতি এবং উন্নয়ন ভাবনা। সাহায্য বা ঋণের চেয়ে
শর্তের ফর্দ লম্বা হতে থাকে। কিন্তু এখান থেকেই বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর
তার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করেন। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য বিশ্বব্যাংক চাপ দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ গ্রহণ করেননি সদ্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি
বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা, সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যকে কূটনীতিতে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। এরই ফলে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজেই একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গ্যাস বিক্রি করতে তিনি রাজি হননি। এ জন্যই ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী
লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। আমার বিবেচনায় ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে,
বিএনপির ‘নতুন নেতা’
তারেক জিয়া ‘বিদেশি প্রভু’দের তুষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন যে যা চেয়েছে,
সবকিছুতেই সায় দিয়েছিলেন তারেক জিয়া। ক্ষমতায় গেলে তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরামর্শ মেনে চলার মুচলেকা দিয়েই বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া এক কথা আর
তার বাস্তবায়ন অন্য কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া
হয়েছিল, ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টো করা শুরু হয়। যেমন ভারতের কথাই ধারা যাক। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের
কাছে ভারতের প্রধান চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যেন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু
৭৫-এর পর থেকে
২০০৮ সালের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের এ অনুরোধ রাখেনি।
নানাভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ চারণভূমিতে পরিণত হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্রের
চালান তার বড় প্রমাণ। শুধু
ভারতের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বিএনপির ওয়াদা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। আর এরকম পরিস্থিতি
২০০৬ সাল থেকেই কূটনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নতুন তৎপরতা।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেউ না, তৃতীয়পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে সবুজ সংকেত দেয় প্রভাবশালী দেশগুলো। এক-এগারোর অনির্বাচিত
সরকার ক্ষমতায় আনতে বাংলাদেশের অবস্থিত কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের ভূমিকা, এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। আবার সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত এক-এগারো সরকারের
সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোই বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ দেয়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি খোলামেলাভাবে এই প্রসঙ্গটি এনেছেন।
তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত
সফরে গেল প্রণব মুখার্জি তাকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারে ‘সুশীল’রা কথাবার্তায় যতই
পটু হোক না কেন, দেশ
পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থ। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের
নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের
আসল শক্তি ছিল বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলো। জনগণনির্ভর না থাকায়, এক-এগারো সরকার আসলে দূতাবাসগুলোর কথায় চলত। তাদের নির্দেশেই তারা নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। এ সময় শেখ
হাসিনার দৃঢ় অবস্থান এবং অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রভাব কমতে থাকে। আওয়ামী লীগ দূতাবাসগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও রাজনৈতিক বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার নীতি শুরু করে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করে, তা
নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন।
ড. ইউনূস এবং
গ্রামীণ ব্যাংক, সংবিধান সংশোধন করে তা ৭২-এর
আদলে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইত্যাদি ইস্যুতে কূটনৈতিকপাড়াকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। উপরন্তু ২০১৪ ও ’১৫ সালে
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কেউ পছন্দ করেনি। কূটনৈতিক অঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব
পড়ে। বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর ঝোঁক দূতাবাসগুলোতে বিএনপিকে অনাহূত করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে
নেতা হিসেবে ভাড়া করে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দূতাবাস পল্লিতে আবার তৎপরতার সুযোগ পায় বিএনপি। ড. কামালের সঙ্গে
ঐক্য বিএনপির চোখ খুলে দেয়। জনগণ না ‘বিদেশি প্রভু’দের স্বপক্ষে আনাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়। এরপর থেকে ঘরে-বাইরে কূটনৈতিক তৎপরতাই বিএনপির প্রধান কাজ। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে বিষিয়ে তুলতে তারা যেমন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের কূটনৈতিকপাড়ায় তাদের দৌড়ঝাঁপ ফটোসেশন বেড়েছে। অনেকেই মনে করে ভারত বিএনপিকে পছন্দ করে না। বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, ভারত চাইলেই আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। এ জন্য ২০১৮
সালেও ভারতের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। ভারত এখনো বিএনপিকে আস্থায় নেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতে দলটির নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে নিজেদের ধন্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে দিনে একবার অন্তত কথা বলেছেন বিএনপি কোনো না কোনো নেতা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি কী প্রমাণ করতে
চায়? জনগণ নয়, দূতাবাস তাদের ক্ষমতায় আনবে? এটা দেখে সম্ভবত আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ভয় পেয়েছেন। তারা
ভাবছেন, কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কুপোকাত করে দেয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র
নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে নাজেহাল করে ফেলবে। চাপে জর্জরিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কী না পারে।
এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ইদানীং শোনা যায়। এ জন্য স্যুট
কোট পরে মার্কিন দূতাবাসে আওয়ামী লীগের ধরনা মনে হচ্ছে, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একমাত্র বাধা যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি ব্যস্ত ‘ভারত’কে খুশি করাতে,
আওয়ামী লীগ ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাগ ভাঙাতে। তাই, ডিনার, লাঞ্চ আর ককটেলের উৎসব
চলছে দূতাবাস পল্লিতে। দুই প্রধান দল কি আবার
জনগণের বদলে দূতাবাসগুলোকে ক্ষমতা বদলের নিয়ন্তা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে? তাহলে জনগণ কী করবে? দাঁড়িয়ে
দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
জামায়াত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
২৫ মার্চের কালরাত।
‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি
হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর চালাল বর্বর গণহত্যা। এটাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর সবচেয়ে বড় পৈশাচিকতা। জাতিগত
নিধনের এ নৃশংসতা গোটা
বিশ্বকে স্তব্ধ করেছিল। সায়মন ড্রিং-এর মাধ্যমে বিশ্ব
জেনেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর তান্ডবের কিছুটা। আজও বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বীভৎসতার কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে। হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন কী করেনি পাকিস্তানিরা
সেদিন। এ ভয়ংকর নিধন
কর্মসূচির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ৯ মাসের
রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি জাতির পিতার নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে,
তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে’। ’৭১-এর
গণহত্যা এবং বর্বরতার নিন্দা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সে দেশের বৃহত্তর
জনগোষ্ঠী ছিল মানবতার পক্ষে। কেনেডির মতো অনেক মানবিক মার্কিন রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। গণহত্যার পক্ষে। পাকিস্তানি বর্বরতায় ছিল তার সরাসরি সমর্থন। তার বিশ্বস্ত হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু
মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার
বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত
করতে পারে না তা প্রমাণিত
হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের
পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে
জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালে ঠুনকো অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ
করে। সংকটে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। জাসদ, গণবাহিনী, সর্বহারা দিয়ে দেশে সৃষ্টি করা হয় অস্থিরতা। স্বাধীনতাবিরোধী
অপশক্তিকে দিয়ে চলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে
অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ’৭৫-এর ১৫
আগস্ট বাংলাদেশে রচিত হয় আরেকটি নৃশংসতার
কালো অধ্যায়। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত দলিলপত্রগুলো
উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৭৫-এর বর্বরতায়
যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছিল। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং মদদ দিয়েছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে খুনি মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। খুনিদের বাঁচাতে খুনি মোশতাক এবং জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন বানিয়েছিল। এ আইনকে ইতিহাসের
নিকৃষ্টতম মানবাধিকার হরণকারী আইন বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কোনো
দলিলে এরকম জঘন্য একটি আইনের নিন্দা করেনি। এসব কথা মনে পড়ল গত ২০ মার্চ
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট ২০২২-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত
৬১ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পড়ে। মনের অজান্তেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিটি ঠোঁটে এসে গেল- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’
যে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এ পাকিস্তানি
গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেনি। ’৭৪-এ বাংলাদেশকে
দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ’৭৫-এ জাতির
পিতার হত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে- তারাই আজ বাংলাদেশের মানবাধিকারের
বিচারক হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিক্তিতে মাপার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। সত্যি কী বিচিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের
মানবাধিকার রিপোর্টের তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এ রিপোর্ট গতানুগতিক
গৎবাঁধা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো রিপোর্ট হুবহু কপি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রিপোর্টের কিছু বিষয় ইঙ্গিতবাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিছু মন্তব্য, আকাক্সক্ষা রিপোর্টে লেখা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয়ত, তথ্যের উৎসের ব্যাপারে পক্ষপাত। বিতর্কিত এবং অসত্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে রিপোর্টে বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই হয়নি।
এ রিপোর্টের কিছু কিছু বিষয় গতানুগতিক এবং পুরনো রিপোর্টগুলোর অনুরূপ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নতুন কোনো কথা নেই। বেশ কিছু স্থানে গত বছরের রিপোর্টই যেন পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। একইভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে, সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গেও মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে নতুন কিছু নেই। মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২২ এর কিছু কিছু মন্তব্য এবং সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। ৬১ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংক্রান্ত মানবাধিকার রিপোর্ট শুরুই হয়েছে ২০১৮-এর নির্বাচন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। রিপোর্টের শুরুতে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন না। এ নির্বাচনে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের হুমকিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।’ মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট মূলত বছরওয়ারি মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। ২০২২ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার ওপরই এ রিপোর্ট সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন। কিন্তু ২০২২ সালের রিপোর্টে কেন ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো? মজার ব্যাপার হলো, ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রায় হুবহু মন্তব্য করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ২০১৮-এর মানবাধিকার প্রতিবেদনে। তাহলে চার বছর আগের প্রসঙ্গ নতুন করে উপস্থাপনের কারণ কী? ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। গত চার বছরে দুই ডজনের বেশি মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। অর্থাৎ ২০১৮-এর নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে এখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কী? নির্বাচনের আগে সরকারকে চাপে ফেলা? আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তো ১৯৯১ সালেই সংবিধান সংশোধনীতে বৃদ্ধি করা হয়। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন কেন? বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত প্রস্তাবকে সমর্থনের জন্য?
রিপোর্টে একাধিক জায়গায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। পুরো রিপোর্টে ‘অধিকার’ ‘মায়ের ডাকে’র মতো বিএনপি নিয়ন্ত্রিত সংগঠনগুলোর বক্তব্যকেই গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৪ পৃষ্ঠায় গুম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৬ জনের গুমের দাবি করেছে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো দাবি করেছে জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী।’ স্পষ্টতই এটি মায়ের ডাক পরিবেশিত তথ্য। যে ১৬ জনের কথা দাবি করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকেই ফিরে এসেছেন। এদের কেউ বিএনপি নেতা নন, এমনকি কর্মীও নন। ফিরে আসা অন্তত চারজন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত দুজন সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত কর্মকর্তা। যাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত। এরা তাদের নিজস্ব বয়ানে সেটি স্বীকারও করেছেন। মায়ের ডাকের তালিকায় একজনের নাম ছিল যিনি নিজেই পরে স্বীকার করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পালিয়ে গেছেন। এরকম একটি অসম্পূর্ণ এবং একপেশে প্রতিবেদন কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় তা এক বিস্ময় বটে। ‘অধিকার’ সংগঠনটির প্রধান আদিলুর রহমান খান, বিএনপিপন্থি আইনজীবী। সাবেক জাসদ নেতা আদিলুর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের ঢাকা তা-বের পর একটি অসত্য, বিকৃত প্রতিবেদনের জন্য তার সংগঠন সমালোচিত। ওই সময়ে হেফাজতের একাধিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার গুজব প্রচার করে ‘অধিকার’। পরে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মনগড়া। দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অধিকার এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এহেন গুজব সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট গুরুত্ব পেয়েছে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে। ‘মায়ের ডাক’ আরেকটি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন একজন বিএনপি নেতার বোন। ‘মায়ের ডাক’ গুম নিয়ে যতগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার আধিকাংশই পরবর্তীতে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বিএনপির প্রতি পক্ষপাত উথলে উঠছে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিএনপির প্রতি প্রায় প্রকাশ্য সমর্থন জানানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএনপি নেতারা মাঠে যে ভাষায় কথা বলেন, সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। রিপোর্টের ১৩ পৃষ্ঠায় বেগম জিয়ার দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘২০১৮ সালে দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের কারাদন্ড হয়। এ মামলাটি ২০০৮ সালে দায়ের করা। আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে খালেদা জিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন নিষ্পত্তিতে আদালত ধীরগতির নীতি নিয়ে চলছে।’ অথচ বাস্তবতা হলো- বেগম জিয়ার আইনজীবীরাই স্বীকার করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার ব্যাপারে তারা ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণ করেছেন। এতিমখানা দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আপিল বিভাগে হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা অনাগ্রহী। বিএনপি যখন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করছে তখন তার দায় সরকারের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য কী? বেগম জিয়া যে দুটি মামলায় দন্ডিত হয়েছেন সে দুটোর রায় হয় দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। তার আইনজীবীরা বারবার উচ্চ আদালতে গেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও যদি এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ হয় তাহলে ন্যায়বিচার কী?
মার্কিন প্রতিবেদনের ২১ পৃষ্ঠায় পড়লে মনে হতেই পারে এটি বোধহয় বিএনপির কোনো লিফলেট। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিএনপির কর্মসূচি পালনে নিয়মিতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয় না অথবা বাধা দেওয়া হয়।’ তাহলে সব বিভাগীয় শহরে বিএনপি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশ করল কীভাবে? এখনো প্রতি শনিবার বিএনপি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগে পালাক্রমে সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে কেমন করে? প্রতিবেদনের ৩১ পৃষ্ঠায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনের ঘটনা উঠে এসেছে খন্ডিতভাবে। ১০ ডিসেম্বরে বিএনপিকে যে স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে সমাবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ৭ তারিখে নয়াপল্টনে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করে বিএনপি। বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় ১৬ বস্তা চাল, ডাল। ব্যস্ত রাস্তায় অবস্থান নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়া কি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে? অথচ এ বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। একই পৃষ্ঠায় বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা এখনো অমীমাংসিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ ৮৬টি মামলার ৬১টির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রাখা হয়েছে, সেই তথ্যটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এ রিপোর্টে।
এ রিপোর্টে একটি ভয়ংকর দিক হলো আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টির ওপর আঘাতের চেষ্টা। প্রতিটি দেশেই নিজস্ব রীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ রয়েছে। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন হাজার বছরের পুরনো। পরিবার, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, বিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে গভীর করেছে। প্রাচ্যের পরিবার প্রথা, রক্ষণশীল প্রেম বিয়ে, রোমান্টিকতা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মূল্যবোধকে এখন পশ্চিমা বিশ্ব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঐতিহ্যগতভাবেই এখানে সমকামিতা, সমলিঙ্গের বিয়ে ইত্যাদি বিষয়কে বিকৃতি মনে করা হয়। আমাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি এসবকে লালন করে না। সমকামিতা বা সমলিঙ্গের সম্পর্ককে এ দেশের প্রায় সব মানুষ বিকৃতি মনে করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়েও এটি আমাদের রুচি এবং সংস্কৃতির চেতনার সঙ্গে প্রোথিত। অথচ ৬১ পৃষ্ঠার মানবাধিকার প্রতিবেদনে অন্তত এক ডজনবার এসব পাশ্চাত্য বিকৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইন্ধন আছে। আমাদের চিরায়ত, সহজাত সামাজিক সম্পর্কের ভিতর এসব পশ্চিমা হতাশাজনিত কারণে সৃষ্ট অনৈতিক এবং রুচিহীন সম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। এমনকি এ প্রতিবেদনে নাস্তিকতাকে সমর্থন এবং তাদের অধিকারের প্রতিও এক ধরনের সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যক্তি উগ্র মৌলবাদীদের মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য হতাশা, বিকৃতি এবং কুরুচি অনুপ্রবেশের এক ধরনের প্ররোচনা আছে এ প্রতিবেদনে। অন্যদিকে আবার যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় মার্কিন প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টটি তাদের দ্বৈত ও স্ববিরোধী নীতির এক প্রকাশ।
এ প্রতিবেদনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো জামায়াতপ্রীতি। এ সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের বড় পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১, ২০০২ এবং ২০০৪ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে জামায়াতকে একটি উগ্র দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এবার প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে একেবারে ইউটার্ন নিয়েছে। প্রতিবেদনের ১৩ পৃষ্ঠায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিরোধী দলের সদস্যদেরই বিচারে দন্ডিত করা হয়েছে। ’৭১-এ গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে জন্যই কি তাদের এ আর্তনাদ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কোনো মানদন্ডে আন্তর্জাতিক মানের। ন্যায়বিচারের প্রতিটি ধাপ যথাযথ অনুসরণ করেই এ বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ’৭১-এর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনকে আবারও সমর্থন দিল? তারা কি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব? এ জন্যই এত আক্রোশ?
মার্কিন প্রতিবেদনের ৩০ ও ৩১ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি যেন মাত্রা ছাড়া। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিরোধী কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত। সর্ববৃহৎ মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সংবিধানে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ রিপোর্টে ভুলভাবে বলা হয়েছে সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত নামে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াও এখন বন্ধ। অথচ পুরো ব্যাপারটি হয়েছে সর্বোচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। এ জামায়াতকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ‘শত্রু’ মনে করত। আগের একাধিক রিপোর্টে এদের তালেবানদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত জামায়াত নারী স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। তাদের অধিকারের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ কেন? এটা কি আফগানিস্তান নাটকের পুনরাবৃত্তি? ‘কমিউনিজম’ ঠেকাতে আফগানিস্তানে তালেবানদের পেলে-পুষে বড় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তান তুলে দিয়ে তারা পালিয়েছে। এখন বাংলাদেশে কি একই নিরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় বিশ্ব মোড়ল? ’৭১-এ যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, সেই দেশটি আজ বিশ্বের বিস্ময়। উন্নয়নের রোল মডেল। এ কারণেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এত রাগ, ক্ষোভ। এ উন্নয়নও তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরেক পরাজয়। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়? পুরো প্রতিবেদনটি নির্মোহভাবে পড়লে মনে হতেই পারে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা আছে। নির্বাচনকে ঘিরে একটি অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত আছে মার্কিন প্রতিবেদনে। তাহলে নির্বাচন বানচাল করে কোন ‘হামিদ কারজাই’কে ক্ষমতায় বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার অনিবার্য পরিণতি হবে মৌলবাদীদের উত্থান। মার্কিন প্রতিবেদন কি তারই সংকেত?
মন্তব্য করুন
প্রথমেই আমার মধ্যে যে জিজ্ঞাসা বুদবুদ করে উঠল, তা হলো এই যুগে চিঠি কেন? স্বাধীনতা দিবসে জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করতে পারতেন। বাইডেনের পক্ষ থেকে ‘হোয়াইট হাউস’ বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবসে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিতে পারত। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পক্ষ থেকে হোয়াইট হাউস সচরাচর এরকম বিবৃতি দিয়ে থাকে। কদিন আগেই বাংলাদেশের বিজয় দিবসে (১৬ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাসংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ধরনের উৎসবে শুভেচ্ছা কার্ড বা স্মারকও প্রেরণ করেন। কিন্তু তা না করে বাইডেন সরাসরি চিঠি লিখলেন কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘প্রামাণ্যকরণ’ বা ‘ডকুমেন্টেশন’ বলে একটি শব্দ বহুল প্রচলিত। ডকুমেন্টেড করে রাখা বা ভবিষ্যতের জন্য রেকর্ড রাখা একটি রাজনৈতিক কৌশল। হোয়াইট হাউস কি এটি ভবিষ্যতের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে চায়? এ জন্য তাদের ইচ্ছার কথা লিখিত চিঠির আকারে পাঠানো হয়েছে। যে উদ্দেশ্যে বা যার পক্ষেই এই চিঠি লেখা হোক যুক্তরাষ্ট্র এটিকে প্রামাণ্যকরণ করতে চেয়েছে। এই চিঠিকে ঘিরে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন প্রটোকল সংক্রান্ত। প্রেসিডেন্ট সাধারণ শুভেচ্ছা, শোকবার্তা বা অন্য কোনো বার্তা পাঠাবেন তার কাউন্টার পার্টকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে যদি নিখাদ শুভেচ্ছা বার্তাই পাঠানো হয়, সেটি তো পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতিকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন চিঠি পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে।
ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল? কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য। বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।’ কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’ নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা কি ভারত জয় করলেন, নাকি ভারতের ‘পুতুল’ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?
স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলাম। জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক নিবন্ধন নাই। দলীয় প্রতীক নিয়ে দলটি নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু এবার মার্কিন প্রতিবেদনে জামায়াতের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে বসে যে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার এবং লবিং করছেন, কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন, তার ফল ভোগ করতে শুরু করেছে জামায়াত।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক বছরের কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে 'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে এবং প্রধান টার্গেট বিএনপিকে করেছে তা ভুল রাজনৈতিক কৌশল বলে অনেকেই মনে করছে। আওয়ামী লীগের মিত্রহীন হয়ে যাওয়া বিশেষ করে সুশীল সমাজের সাথে সম্পর্কের অবনতি আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত বলে কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপথে পাঁচটি ভুল চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এই ভুলগুলো হলো;
হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত করতে পারে না তা প্রমাণিত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে।