সংসদীয় গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর ব্রিটেন। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সম্পর্কে একটি কথা বহুল প্রচলিত। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সম্পর্কে বলা হয় ‘একমাত্র নারীকে পুরুষ এবং পুরুষকে নারীতে পরিবর্তন ছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সব পারে’।
সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সরকার পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু। সংসদের মধ্য দিয়েই প্রজাতন্ত্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্টকে দেশ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হয়। যুক্তরাজ্য, ভারতসহ সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলো এর উদাহরণ। বাংলাদেশেও
সংসদীয় গণতন্ত্র। নানা টানাপোড়েন এবং চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ গত ৭ এপ্রিল
৫০ বছর পূর্ণ করল। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এক বিশেষ অধিবেশন
আহ্বান করা হয়। রাষ্ট্রপতি এ অধিবেশনে বক্তব্য
রাখেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের সিনিয়র নেতারা ভাষণ দেন। কিন্তু সংসদের ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে
পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমরা কি বলতে পারি
আমাদের জাতীয় সংসদ ক্ষমতাবান? ব্রিটেন বা ভারতের মতো
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু? জাতির পিতা সারা জীবন ছিলেন জনগণের ক্ষমতায়নের পক্ষে। সংসদীয় গণতন্ত্রে তার আস্থা ছিল। এ কারণেই ১০
জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গণপরিষদে ৪ নভেম্বর ১৯৭২
সালে নতুন সংবিধান প্রণীত হয়। ৭২-এর সংবিধানে
সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এ সংবিধান গৃহীত
হওয়ার পর ১৫ ডিসেম্বর
গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৭৩-এর ৭ মার্চ
অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয়
সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনের পর
১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল জাতীয়
সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় সংসদের এই ৫০ বছরের যাত্রাপথ সহজ সরল স্বাভাবিক ছিল না। ৫০ বছরে ১১টি সংসদ গঠিত হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। এর মধ্যে ছয়টি সংসদই তার পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। প্রথম জাতীয় সংসদের মেয়াদ ছিল ২ বছর ৬ মাস। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর অবৈধ রাষ্ট্রপতি সংসদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় নৃশংসতার পর সংসদ এমনিতেই ছিল অকার্যকর। প্রথম জাতীয় সংসদেই সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে সরে আসে আওয়ামী লীগ। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল গঠন এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি প্রবর্তিত হওয়া রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা বহাল ছিল ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এ সময়কালে সংসদ তার সার্বভৌমত্ব হারায়। সংসদ ছিল নির্বাহী কর্তৃত্বের অধীনে। সংসদ এ সময় অবৈধ শাসকদের ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়। জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। সেনাশাসন জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন। বুটের তলায় পিষ্ট হয় গণতন্ত্র। সেনা পোশাকেই জিয়া অস্ত্রহাতে বঙ্গভবন যান। নামমাত্র রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মো. সায়েমকে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতাচ্যুত করেন। উর্দি পরেই স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি হন জিয়া। এ সময় জিয়া সংবিধান স্থগিত করেই ক্ষান্ত হননি। সাময়িক ফরমানের মাধ্যমে একের পর এক সংবিধান কাটাছেঁড়া করেন সামরিক একনায়ক জিয়া। ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের মতো রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে উপড়ে ফেলেন সংবিধান থেকে। রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হয় পবিত্র ৭২-এর সংবিধান। ক্ষমতায় বসেই জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসনের মধ্যেই আয়োজন করা হয় দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রহসনের এই নির্বাচনে একটি ফলাফলই নির্ধারিত ছিল। তা হলো, সামরিক শাসনের গর্ভে জন্ম নেওয়া জিয়ার দল বিএনপিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে আনা। পাতানো ওই নির্বাচনে সেটিই হয়। ২০৭টি আসন পায় জিয়ার দল বিএনপি। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে ২ এপ্রিল। প্রথম অধিবেশনের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র পাঁচ দিন। এ পাঁচ দিনেই জিয়ার সামরিক শাসন জারি থেকে অবৈধ ক্ষমতা দখল, সবকিছুর বৈধতা দেওয়া হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এক অভিশাপ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ওই সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয় সংসদের প্রধান কাজই ছিল জিয়ার অবৈধ শাসন বৈধতা দেওয়া। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতা দখল করেই তিনি জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেন। তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের মৃত্যু হয়। ক্ষমতা দখল করে এরশাদ জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। সংবিধানে কাটাছেঁড়া করা হয় সামরিক ফরমানে। এরশাদও ক্ষমতায় বসে দল গঠন করেন। তার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দিতে প্রয়োজন হয় নতুন সংসদ। ১৯৮৬ সালের ৭ মে বহুল বিতর্কিত, সমালোচিত, মিডিয়া ক্যু-এর মাধ্যমে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১০ জুলাই মাত্র আট দিনের জন্য বসে প্রথম অধিবেশন। প্রথম অধিবেশনেই সপ্তম সংশোধনী বিলের মাধ্যমে এরশাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয় সংসদ। বিরোধী দলের সরব উপস্থিতিতে এ সংসদ ছিল উত্তপ্ত। প্রাণবন্ত। কিন্তু রাজপথের আন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সংসদ বাতিল করেন। তৃতীয় জাতীয় সংসদও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।
এরশাদ সংসদ ভেঙে দিয়ে আন্দোলন দমন করেন। নতুন করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান প্রধান সব রাজনৈতিক দল বর্জন করে। এরশাদ আ স ম আবদুর রবের মতো ভাড়া করা অনুগত বিরোধী দল জোগাড় করেন। এই অনুগত, গৃহপালিত বিরোধী দলকে নিয়ে জাতীয় পার্টি চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ২৫ এপ্রিল ১৯৮৮ সালে বসে প্রথম অধিবেশন। কিন্তু এ সংসদও তার মেয়াদপূর্তি করতে পারেনি। ২ বছর ৭ মাসের মাথায় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হয়। এভাবেই স্বাধীনতার পর প্রথম বিশ বছর চারটি সংসদই ছিল অকার্যকর। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীদের বৈধতা দেওয়ার প্রতিষ্ঠান। রাবার স্ট্যাম্প। এ চারটি সংসদ একবারও তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ৭৫-এর পর দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল সামরিক স্বৈরাচারদের হাতে। সংসদ ছিল স্রেফ অলংকার। রাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো একনায়কতান্ত্রিক ভাবেই।
নব্বইয়ের গণআন্দোলনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তিনজোট এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় অঙ্গীকার করে যে, এরশাদের পতনের পর তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় ফিরে যাবে। ৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। সবাইকে অবাক করে ওই নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জামায়াতের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেন বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে ৯১-এর জাতীয় সংসদ ছিল অন্যতম প্রাণবন্ত এবং কার্যকর। ৯১-এর জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা অবসান ঘটে। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়। কিন্তু সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আসলে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থার বদলে প্রধানমন্ত্রীর শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়। রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে অর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি হয়ে যান ক্ষমতাহীন। ৯১-এর নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া। তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে অনভ্যস্ত, আড়ষ্ট ছিলেন। সংসদে আসতেন কম। কথা বলতেন আরও কম। সংসদের বাইরে মন্ত্রিসভা দিয়েই দেশ পরিচালনা করতেন। মন্ত্রীদের সংসদে জবাবদিহিতায় তীব্র অনীহা এবং আপত্তি ছিল লক্ষণীয়। কারণ ক্ষমতার গর্ভে জন্ম নেওয়া বিএনপি সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চায় অভ্যস্ত ছিল না। ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র শুধু কাগজে কলমেই থাকে। সংসদ জবাবদিহিতার কেন্দ্রবিন্দুও হয় না। বিএনপি ক্ষমতায় এসে ভোটচুরি ও কারচুপির একই ধারা শুরু করে। বিশেষ করে মাগুরা এবং মীরপুরের উপনির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বিএনপি সেই আন্দোলনের দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানায়। উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে পঞ্চম জাতীয় সংসদ মেয়াদপূর্তির মাত্র চার মাস আগে ভেঙে যায়। বিরোধী দল একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়াই ছিল একমাত্র বিকল্প। ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দল নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। বিরোধী আন্দোলন উপেক্ষা করে বিএনপি একতরফাভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালের নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই এ নির্বাচন হয়। বিএনপি ছাড়া ৭৫-এর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দল ওই নির্বাচনে অংশ নেয়। তীব্র গোলযোগ এবং সহিংসতার মুখে ভোট ছাড়াই নির্বাচন কমিশন ঘরে বসে ফলাফল বানায়। ২১ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকা হয়। মাত্র ১১ দিন স্থায়ী ছিল ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ। এ সংসদে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত সংবিধানের ১৩তম সংশোধনী পাস করা হয়। ৩০ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২১ বছর পর এ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সংসদীয় গণতন্ত্রকে অর্থবহ এবং কার্যকর করতে সংসদ নেতা এ সময় বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। সংসদীয় কমিটিগুলোর সভাপতি করা হয় মন্ত্রী নন এমন সংসদ সদস্যদের। যাতে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা করা যায়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করেন। কিন্তু সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে যে বিপুল নির্বাহী ক্ষমতা দিয়েছে তাতে সংসদ শুধু আলোচনা এবং বিতর্কের কেন্দ্র হতে পারে। জবাবদিহিতার মাধ্যমে ক্ষমতাবান হতে পারে না। তবে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি এবং কার্যকর সংসদীয় কমিটি যে সংসদকে ক্ষমতাবান করতে পারে পঞ্চম ও সপ্তম জাতীয় সংসদ তার প্রমাণ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সংসদ যেটি মেয়াদপূর্ণ করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। বেগম জিয়া যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রে স্বাচ্ছন্দ্য নন, তাই আবার সংসদ পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ সময় স্বীকৃত সরকারের চেয়ে হাওয়া ভবনে প্রতিষ্ঠিত ছায়া সরকারই অধিক ক্ষমতাবান হয়ে যায়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করে ফেলে। নানা বিতর্ক ও টানাপোড়েনের পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ হন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান। বিএনপির অনুগত ইয়াজউদ্দিন একটি প্রহসনের নির্বাচনের পথে হাঁটেন। যে কোনো মূল্যে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনাই ছিল তার লক্ষ্য। এরকম বাস্তবতায় সেনা সমর্থনে সুশীল নিয়ন্ত্রিত অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। দুই বছর গণতন্ত্র নির্বাসনে যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসে। সেই থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি টানা ১৪ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। সংসদে বিরোধী দল উত্তাপহীন। ২০০৯ সালের নবম সংসদে বিরোধী দল ছিল দুর্বল। সংখ্যায় খুবই কম। ২০১৪ সালে বিরোধী দল আর সরকারি দল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ২০১৮-এর নির্বাচন জাতীয় সংসদকে প্রায় বিরোধী দলশূন্য করে ফেলে। ফলে সংসদ উত্তাপহীন, আগ্রহহীন একটি রুটিন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রীরা সংসদে জবাবদিহিতা করেন না। কারণ বিরোধী দল শক্তিশালী নয়। সংসদ এখন আলোচনা এবং বক্তৃতার জায়গা। সিদ্ধান্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, মন্ত্রিসভায়। এমপিদের ভূমিকা এখন গৌণ। আমলারা ক্ষমতাবান। তবে একটা ইতিবাচক দিকে হলো, ১৯৯৬ সাল থেকে সংসদের অপমৃত্যু নেই। সব সংসদই মেয়াদপূর্ণ করছে। জাতীয় সংসদ গণতন্ত্রের পাহারাদার। রাষ্ট্রপরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণে জাতীয় সংসদ উপেক্ষিত এটা সত্যি। তবে এও সঠিক যে, জাতীয় সংসদ আছে বলেই এখনো গণতন্ত্র টিকে আছে। মনে রাখতে হবে, সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অনির্বাচিত স্বৈরশাসনের চেয়ে ভালো। জাতীয় সংসদ তার ৫০ বছর পূর্ণ করল। জাতীয় সংসদ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতিষ্ঠান। তাই একে কার্যকর করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। শক্তিশালী বিরোধী দল, সংসদ সদস্যদের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থিতি এবং প্রাণবন্ত বিতর্কই সংসদকে শক্তিশালী করতে পারে। সে জন্য প্রয়োজন একটি ভালো নির্বাচন।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।