মাহাথির মোহাম্মদ।
আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি। ১৯৮১ সাল থেকে টানা ২২ বছর মালয়েশিয়ার সরকারপ্রধান ছিলেন।
তাঁর নেতৃত্বে মালয়েশিয়া বদলে গেছে। ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাহাথিরের নেতৃত্ব
এক উদাহরণ। মাহাথির মোহাম্মদ যখন তাঁর দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের
নজর পড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধাবমান মালয়েশিয়ার প্রতি। এর কারণ ছিল মালয়েশিয়ার
গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ব নেতা হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের উত্থান। তিনি মুসলিম নিপীড়নের বিরুদ্ধে
সোচ্চার ছিলেন। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাতেন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে
টুইন টাওয়ার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মাহাথির
মার্কিন এ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ইরাক আগ্রাসনের পর জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে মাহাথির
মোহাম্মদ যুক্তরাষ্ট্রকে আগ্রাসনবাদী এবং যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। মাহাথিরের
বক্তব্য সাড়া বিশ্বে তোলপাড় ফেলেছিল। পাল্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী
শাসন, বিরোধী মত দমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ইস্যু
সামনে এনেছিল। মাহাথিরকে চাপে রাখতে সেখানে উগ্র মৌলবাদীদের উসকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মাহাথিরকে থামাতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে গোপনে নানা সহায়তা
দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। যাতে তারা মাহাথিরের বিরুদ্ধে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
মালয়েশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী মত দমন নিয়ে সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন
প্রশাসন মালয়েশিয়ার সরকার পরিবর্তন করতে পারেনি। মাহাথির ২০০৩ সালে শান্তিপূর্ণভাবে
ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। যুক্তরাষ্ট্র মালয়েশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেও
অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করেনি। দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েই গেছে।
কারণ, অর্থনৈতিক কারণে মালয়েশিয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার ক্রমবর্ধমান
অগ্রগতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মালয়েশিয়ারও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন ছিল। দুই দেশের বিশ্ব
রাজনীতি নিয়ে ভিন্ন অবস্থানের পর কূটনৈতিক সম্পর্ক অটুট ছিল। এ সময় মাহাথির মোহাম্মদ
এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি শত্রু হয় তাহলে
বিপজ্জনক আর যদি বন্ধু হয় তাহলে তা মারাত্মক।’ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেশাদারিত্বের
এক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। বন্ধু বা শত্রু হননি। যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতে এতটুকু
ভয় পাননি। আবার তাদের ভালো কাজের প্রশংসাও করেছেন।
ঠিক কুড়ি বছর
পর মাহাথিরের মতো একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিশ্বনেতা দেখল বিশ্ব। সেই নেতার নাম শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনার একটি বড় গুণ হলো- স্পষ্টবাদিতা। তিনি যা বিশ্বাস করেন তা সরাসরি বলেন।
কোনো রাখঢাক ছাড়াই। অপ্রিয় সত্য বলতে তিনি পিছপা হন না। সত্য সরাসরি স্পষ্ট করে বলার
বিপদ জেনেই তিনি অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেন। রাজনীতিতে এ জন্য যেমন তাঁকে অনেক কঠিন
পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তেমনি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা তিনি এ জন্য অর্জন করেছেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে
না বঞ্চনা।’ এ কবিতার পঙ্ক্তি যেন শেখ হাসিনার পথচলার দিশারী। তিনি জানেন, অনেকে অসন্তুষ্ট
হবে, বিব্রত হবে তবুও তিনি ৭৫ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেছেন,
‘এত নেতা, এত বড় দল তারা কোথায় ছিল।’ ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কীভাবে হারানো
হয়েছে তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন অকপটে। বলেছেন, ‘গ্যাস বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র
২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি।’ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে
জেতাতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর ভূমিকা নিয়েও আওয়ামী লীগ সভাপতি একাধিক বক্তৃতায়
স্পষ্ট, খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। এসব বক্তব্যের পার্শ¦প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে,
কোনো প্রভাবশালী দেশ অসন্তুষ্ট হবে কি না ইত্যাদি ভাবনা তাঁকে সত্য উচ্চারণে পিছপা
করেনি। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে জনগণকে পর্দার আড়ালের ষড়যন্ত্রের কথা খোলামেলাভাবে জানিয়ে
দিয়েছেন। লাভ-ক্ষতির নিক্তিতে সত্যকে মাপেননি। এটাই শেখ হাসিনা। সাহসী উচ্চারণই শেখ
হাসিনার শক্তি। এ কথাটি আজ সবাই জানে। তবে ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে দেওয়া
বক্তব্য অতীতের সব বক্তব্যকে ছাপিয়ে গেছে। জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে
তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, স্পষ্টভাষী, আক্রমণাত্মক এবং সাহসী। প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো
রাজনৈতিক বক্তব্যে একটি দার্শনিক মর্মার্থ থাকে। শেখ হাসিনার বক্তব্যের তাৎপর্য অত্যন্ত
গভীর। শুধু দেশের প্রেক্ষাপটে নয়, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার বক্তৃতা গভীর তাৎপর্যময়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ বক্তৃতায় তিনি গণতন্ত্রের সব শত্রুকে একসঙ্গে চিহ্নিত
করেছেন, সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি তাঁর বক্তৃতায় মুসলিম বিশ্বের সংকটও উঠে এসেছে।
এ বক্তৃতায় তিনি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছেন আবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার
কথাও স্মরণ করেছেন। আমি মনে করি তিনটি কারণে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য আলাদা গুরুত্ব
রাখে। প্রথমত. সময়। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সময়টি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জাতীয়
সংসদ নির্বাচন নিয়ে যখন নানামুখী মেরুকরণ ঠিক তখন সংসদ নেতার এ বক্তব্য। প্রধানমন্ত্রী
যখন এ বক্তব্য রাখছিলেন তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন ওয়াশিংটনে অবস্থান
করেছিলেন। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পরই ড. মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। নানা কারণে বিশেষ করে আগামী জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের আগে মোমেন-ব্লিঙ্কেন বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বৈঠকের আগে
সংসদ নেতা কি ইচ্ছাকৃতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথাগুলো
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে সাহস পান না সেই কথাগুলো বলে প্রধানমন্ত্রী কি বাংলাদেশের
বার্তাটি পৌঁছে দিলেন। বৈঠকের আগে নিশ্চয়ই মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে মি. ব্লিঙ্কেন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য জেনেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক
বৈঠকে হয়তো এর দৃশ্যমান প্রভাব চোখে পড়বে না। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা নিশ্চয়ই
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তাদের কৌশল পুনর্বিন্যাস করবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও প্রধানমন্ত্রীর
বক্তব্যের সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। যখন চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব-ইরান বৈরিতার ইতি ঘটতে
শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। তখন ‘মুসলিম দেশগুলো
কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’ বলে শেখ হাসিনা মূলত প্রগতিশীল, উদার মুসলিমপ্রধান
দেশগুলোর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন। যেমনটি হয়েছিলেন মাহাথির।
প্রধানমন্ত্রীর
বক্তব্যের দ্বিতীয় তাৎপর্য হলো সব ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর জাতীয়
সংসদের ভাষণে গণতন্ত্রের পাঁচ প্রতিপক্ষকে একসঙ্গে চিহ্নিত করেছেন। শেখ হাসিনা সংসদের
ভাষণে যাদের সমালোচনা করেছেন তারা হলেন বিএনপি এবং তাদের নেতৃবৃন্দ। প্রথম আলো এবং
ডেইলি স্টার গোষ্ঠী। সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সর্বশেষ মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালে ষড়যন্ত্র করছে এ পঞ্চভূত। বিএনপি
তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে নির্বাচনে যাবে না- এ দাবিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং উত্তেজনা
সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাতাস দিচ্ছে সুশীলরা। সুশীলদের এ তৎপরতাকে
ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রথম আলো গোষ্ঠী। সুশীলরা এবং প্রথম আলো মিলে দেশে আবারও এক-এগারোর মতো
একটি অনির্বাচিত সরকার আনতে চায়। এ জন্যই তারা বিএনপির আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী
সুশীল নিয়ন্ত্রিত প্রথম আলো এক-এগারোর সময় কী ভূমিকা পালন করেছিল তা-ও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এ পুরো গণতন্ত্রবিনাশী তৎপরতায় পৃষ্ঠপোষকতা
করছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রাসী ভূমিকার কারণ তাদের স্বার্থ এবং ড. ইউনূসের
তৎপরতা। প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক সভামঞ্চে বা সরকারি কোনো অনুষ্ঠানে এ ষড়যন্ত্রের
মুখোশ উন্মোচন না করে কেন সংসদে করলেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আমার মনে হয় তিনি ইচ্ছা করেই
এ বক্তব্যটি জাতীয় সংসদে রেকর্ড করে রাখলেন। জাতীয় সংসদে সংসদ নেতা হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে
একটি বার্তা দিলেন। যাদের সঙ্গে মিলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার ‘ওলটপালট’ করতে চাইছে তাদের
দোষত্রুটি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিলেন ষড়যন্ত্রকারীরা অযোগ্য। ভালো বিকল্প নয়।
সংসদ নেতার ভাষণের তৃতীয় তাৎপর্য হলো- ক্ষমতাকে তুচ্ছজ্ঞান করা। আমার বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীর
ভাষণের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা ছিল এরকম- “হ্যাঁ তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যে কোনো দেশে
ক্ষমতা উল্টাতে পারে, পাল্টাতে পারে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে আরও কঠিন অবস্থার
মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।” প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল।
তারপরও তিনি সত্য উচ্চারণে দ্বিধাহীন। এখান থেকেই বোঝা যায় শেখ হাসিনা এখনো ক্ষমতার
মোহে দিকভ্রান্ত হননি। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতালোভীরা কত কিছু করে। যুক্তরাষ্ট্রের
মর্জি মতো চলার সব চেষ্টা করে। মার্কিন ভয়ে স্বাধীন ও স্বকীয় সত্তা বিসর্জন দেয়। কিন্তু
শেখ হাসিনা দেশের ও জনগণের স্বার্থের বাইরে কিছুই করেন না। এমনকি ক্ষমতা হারানোর ভয়েও
তিনি আদর্শ বিচ্যুত হন না। ক্ষমতার লোভে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কারও অন্যায্য প্রস্তাব
যে শেখ হাসিনা মানবেন না, এ বক্তব্য তাঁর এক দলিল।
প্রশ্ন হলো,
যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যি বাংলাদেশের ক্ষমতার ওলটপালট করতে চায়? এ জন্যই কি নির্বাচন ইস্যুকে
তারা সামনে এনেছে। একথা ঠিক বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ এখন রীতিমতো
বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেই দিয়েছে আগামী নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক
অর্থাৎ বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এ নির্বাচনে নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র
বলেছে, নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। এর কোনো ব্যত্যয় হলে তারা যে সেই
নির্বাচন মানবে না। এখন বিএনপি বুঝে গেছে তাদের ছাড়া নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে
গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই তারা আরও গো ধরে বসে আছে। এর ফলে গণতন্ত্র সংকটে পড়ার শঙ্কায়।
যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আগ্রহী হতো তাহলে
দুটি কাজ করত। প্রথমত. তারা নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে তা দেখত। কারা অংশগ্রহণ করছে না
করছে তা তাদের দেখার বিষয় নয়। কারণ একটি দেশে অনেক রাজনৈতিক দল থাকে। সব দল সব নির্বাচনে
অংশ নেয় না। ব্যক্তিগত কারণে, দলগত কারণে অথবা কৌশলগত কারণে কোনো নির্বাচন থেকে একটি
রাজনৈতিক দল দূরে সরে যেতেই পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে বিদ্যমান দলগুলোর মধ্যে যে
নির্বাচন হচ্ছে তা পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ এবং অবাধ হচ্ছে কি না সেটি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত.
যুক্তরাষ্ট্র সত্যি আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্ভব নয়। তাহলে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে আনার উদ্যোগ নিত। একটি রাজনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা
করত। যুক্তরাষ্ট্রের এখনকার অবস্থান দেখে মনে হতেই পারে তারা রাজনৈতিক সমঝোতা নয় বরং
বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে চায়। অর্থাৎ নির্বাচন একটি উপলক্ষ মাত্র। বাংলাদেশ নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের বহুমাত্রিক আগ্রহ আছে। বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের বাড়াবাড়ি রকমের উত্থান
যুক্তরাষ্ট্রের এ আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত নয়। নিষেধাজ্ঞা
উপেক্ষা করে ভারত চুটিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করছে। ভারতের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড়
গণতান্ত্রিক দেশকে চাপ দেওয়ার অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তাই চীনবিরোধী অবস্থানের
পরও বিশ্ব মেরুকরণে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত অনুগত নয়। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের
হাতছাড়া হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে থাকা পাকিস্তান এখন খরকুটোর মতো চীনকে আঁকড়ে
ধরে বাঁচার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র পালিয়েছে। এক সময় বিশ্ব
রাজনীতি এবং সামরিক কৌশলে এ উপমহাদেশ ছিল মার্কিন করতলগত। কিন্তু সেখানে এখন পতাকা
উড়িয়েছে চীন। চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের ‘গিনিপিগ’ হিসেবে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্যে হাত বাড়িয়েছে।
আরব বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারত। কিন্তু সেখানে মার্কিন সূর্য
এখন অস্তমিত প্রায়। নয়া অর্থনৈতিক আধিপত্যবাদে বিচলিত রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ। এ উপমহাদেশে
বাংলাদেশই একমাত্র স্বাতন্ত্র্য কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে টিকে আছে। ‘কারও প্রতি বৈরিতা
নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’- এ অবস্থানের জন্যই বাংলাদেশ যেমন চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক
সম্পর্ক বাড়িয়েছে, তেমনি ভারতের সঙ্গে বিশ্বস্ত বন্ধুত্বকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়।
’৭১ এর আরেক পরীক্ষিত বন্ধু রাশিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক অটুট রেখেছে বাংলাদেশ। গত ১৪ বছরে
অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব উন্নয়নে বাংলাদেশ এখন পরাশক্তিদের জন্য অত্যন্ত লোভনীয় এক ভূখ।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে এটি একটি আকর্ষণীয় বাজার। আর বঙ্গোপসাগরের কারণে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে
গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামরিক উত্তেজনার কারণে ‘বাংলাদেশে’ এখন যুক্তরাষ্ট্রের
মনোযোগ অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আর এ কারণেই ইদানীং এ ছোট্ট ভূখন্ডের গণতন্ত্রের
জন্য মার্কিন নীতিনির্ধারকদের নিদ্রাহীন রাত। তারা এখানে একান্ত অনুগত কাউকে বসিয়ে
নিশ্চিত থাকতে চায়। তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের কিছু সিদ্ধান্তে।
যেমন ৪ এপ্রিল জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি
প্রস্তাব পাস হয়। ইউরোপের কয়েকটি দেশ এ প্রস্তাব আনে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে
ভোট দেয়। যুক্তরাষ্ট্র কেন বাংলাদেশেই অনেকে এ সিদ্ধান্তে হতবাক হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া
এ প্রস্তাবের বিপক্ষে যারা ভোট দেয় তারা হলো- চীন, বলিভিয়া, কিউবা, পাকিস্তান ইত্যাদি।
তাহলে কি বাংলাদেশ তার বহুল প্রশংসিত পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসেছে? বাংলাদেশ কি নতুন
বিশ্ব মেরুকরণে চীন-রাশিয়ামুখী? চার বছর ধরে সেগুনবাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরকম
অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা বাংলাদেশ সহজেই এড়িয়ে যেতে পারত। এসব সিদ্ধান্ত পশ্চিমা বিশ্বকে
অস্বস্তিতে ফেলেছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে অতিরিক্ত আবেগময় করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
কারও কারও আগ্রহ সন্দেহজনক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক কূটনীতির
ফলে কোণঠাসা যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু ভাবতে
পারছে না। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো- যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির
অব্যাহত লবিং এবং প্রচারণা। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মহলে এরা সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত
মিথ্যাচার করছে। এর ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা ভালোই বিভ্রান্ত হয়েছেন। আবার সরকারের
ভিতরের কিছু ব্যক্তির দায়িত্বহীন কর্মকান্ড দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।
এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কৌশলগত এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর জাতীয়
সংসদের ভাষণে। তিনি বুঝিয়ে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি মর্যাদার সম্পর্ক চান।
নতজানু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হতে চান না। তিনি এটাও বুঝালেন অযোগ্য অনুগতের চেয়ে
যোগ্য সমালোচক ভালো।
যুক্তরাষ্ট্র
কি বাংলাদেশের সঙ্গে কিউবা, ভেনেজুয়েলা কিংবা সিরিয়ার মতো আচরণ করবে? নাকি মালয়েশিয়া,
তুরস্কের মতো আচরণ করবে? ৭১-এ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল।
সে সময় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়নে
বিভক্ত ছিল বিশ্ব। এখন সেই যুক্তরাষ্ট্রও নেই, বাংলাদেশও সে রকম পরনির্ভর অবস্থানে
নেই। বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশ একে অপরের
ওপর নানাভাবে নির্ভরশীল। তাই বাংলাদেশ চট করেই মার্কিনবিরোধী অবস্থানে যাবে না। এটা
যাওয়াও অনুচিত হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রকেও বুঝতে হবে ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে
‘গৃহপালিত’ রাখা এখন আর সম্ভব নয়। সেই বার্তাটি প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দিয়েছেন।
বিশ্ব নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ অংশীদার হতে পারে, ক্রীতদাস
নয়। কিন্তু সমস্যা হলো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কিছু চাটুকার
ফিদেল ক্যাস্ত্রোর চেয়েও বড় মার্কিনবিরোধী হয়ে গেছেন। তারা এমন সব বেসামাল কথাবার্তা
বলছেন যা দুই দেশের সম্পর্কে বহুমাত্রিক অবনতি ঘটাতে পারে। প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করতে
এ ধরনের উন্মাদনা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের যেমন বাংলাদেশকে দরকার, তার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের দরকার যুক্তরাষ্ট্রকে। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘে শান্তি মিশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনীয়। প্রধানমন্ত্রী মার্কিন চাপের বিপরীতে পাল্টা চাপ দিলেন। বিশ্বে ¯œায়ুযুদ্ধের পর নতুন মেরুকরণ হচ্ছে আবার। এ অবস্থায় বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে দর কষাকষি করতে পারে। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারে। কিন্তু সম্পর্ক শেষ করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরিতা নয়, মর্যাদার সম্পর্ক দরকার। মালয়েশিয়ার মাহাথির পেরেছিলেন। শেখ হাসিনাও পারবেন নিশ্চয়ই।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।