১৫ জুন ২০১৩। রাজশাহী,
খুলনা, বরিশাল, সিলেট- এই চার সিটি
করপোরেশন নির্বাচন একযোগে অনুষ্ঠিত হলো। নির্বাচনে সব
সিটি করপোরেশনেই পরাজিত হলেন আওয়ামী লীগ
মনোনীত প্রার্থীরা। এর কদিন পরই
(৬ জুলাই) অনুষ্ঠিত হলো গাজীপুর সিটি
নির্বাচন। সেখানেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী
হেরে গেলেন। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন পেয়েছিলেন ৮৩
হাজারের কিছু বেশি ভোট।
আর বিএনপি প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল পান প্রায় ১
লাখ ৩২ হাজার ভোট।
খুলনায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার
আবদুল খালেক পেয়েছিলেন ১ লাখ ২০
হাজারের কিছু বেশি ভোট।
অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি তার চেয়ে
প্রায় ৬০ হাজার বেশি
ভোট পান। বরিশালে আওয়ামী
লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ,
তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আহসান হাবিব কামালের চেয়ে প্রায় ২৫
হাজার ভোট কম পেয়ে
পরাজিত হন। সিলেটে আওয়ামী
লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরান, বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে
৩০ হাজারের বেশি ভোটে হেরে
যান। আর ৬ জুলাই
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত
উল্লা ১ লাখেরও বেশি
ভোটে পরাজিত হন বিএনপির এম
এ মান্নানের কাছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে
এই পাঁচ সিটির নির্বাচন
আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করেছিল। বিএনপি ক্ষমতার সুবাস পাচ্ছিল। এ সময় যদি
এই বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ
নিত, তাহলে আওয়ামী লীগ যে বড়
ধরনের চাপে পড়ত এ
নিয়ে কোনো সংশয়ই নেই।
কিন্তু পাঁচ সিটি নির্বাচনে
বিপুল বিজয়ের ফসল ঘরে তুলতে
পারেনি বিএনপি। পাঁচ সিটিতে জয়ের
পর বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অনড় অবস্থান গ্রহণ
করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন
হতে দেওয়া হবে না বলেও
ঘোষণা দেয়। শুরু হয়
সহিংস আন্দোলন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে একের পর
এক সমঝোতা প্রস্তাব দেন। প্রথমে তিনি
নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এ প্রস্তাবে শেখ
হাসিনা জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সরকার
গঠনের প্রস্তাব দেন। ওই সরকারে
বিএনপিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সব মন্ত্রণালয় দিতে
রাজি হন। কিন্তু বিএনপি
চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া
ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর শেখ হাসিনা
বিএনপি চেয়ারপারসনকে গণভবনে চায়ের আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রী হরতাল, জ্বালাও- পোড়াও ছেড়ে আলাপ-আলোচনার
মাধ্যমে সংকট সমাধানের আহ্বান
জানান। বেগম জিয়াকে টেলিফোন
করেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বেগম জিয়া টেলিফোনে
ছিলেন আক্রমণাত্মক। তার কিছু বক্তব্য
ছিল রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। কুরুচিপূর্ণ। একজন রাজনৈতিক নেতা
এমন অশ্লীল ভাষায় কথা বলতে পারেন!
এটি সাধারণ মানুষকে বেগম জিয়ার ব্যাপারে
নেতিবাচক ধারণা দেয়। এ সময়
সব দলের অংশগ্রহণে একটি
নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগও
নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি।
অবশেষে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই ২০১৪ সালের ৫
জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হয়। বিএনপির পুরোপুরি নির্বাচন বর্জন, জাতীয় পার্টির আংশিক বর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই নির্বাচন ছিল
উত্তেজনাহীন। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বাকি আসনেও
ভোট হয় নামমাত্র। অনেকেই
এটি ১৯৯৬ সালের ১৫
ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের মতো মনে করেছিলেন।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই ধরেই নিয়েছিল
খুব শিগগিরই দেশে আরেকটি নির্বাচন
হবে। কিন্তু ২০১৪-এর ৫
জানুয়ারির নির্বাচনের পর গঠিত জাতীয়
সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে। জনগণ বিএনপির
জেদকে, সহিংস রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে। বিনা ভোটে
অর্ধেক এমপি হওয়ার পরও
সাধারণ মানুষ ওই সরকারকে সমর্থন
দেয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের
বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বেগম জিয়া সারা
দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবরোধের ডাক
দিয়েছিলেন। ওই সময় পেট্রলবোমা,
অগ্নিসংযোগ, বাসে গানপাউডার দিয়ে
মানুষ হত্যার এক নারকীয় তান্ডব
শুরু হয়। মানুষ এসব
সন্ত্রাস এবং নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে
স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ করে। অকার্যকর হয়ে
যায় বিএনপির আন্দোলন। জনগণ বিএনপির ওপর
রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শেষ
পর্যন্ত বিএনপির ওই আন্দোলন ব্যর্থতায়
পর্যবসিত হয়। বিএনপির রাজনৈতিক
ভুলের তালিকা করা হলে ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন
প্রথম দিকে থাকবে। ওই
নির্বাচন যদি বিএনপি বর্জন
না করত তাহলে হয়তো
তাদের পরিণতি আজকের মতো হতো না।
২০১৩ সালের জুন-জুলাইয়ে পাঁচ
সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির পক্ষে একটি জোয়ার সৃষ্টি
হয়েছিল। কিন্তু ভুল কৌশলের কারণে
সেই জোয়ারকে কাজে লাগাতে পারেনি
দলটি। উপরন্তু জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে
বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভুল
রাজনীতি এবং ভুল কৌশল
একটি রাজনৈতিক দলকে যে কতটা
বিপর্যস্ত করতে পারে ২০১৩
এবং ২০১৪-এর ঘটনা
প্রবাহ তার বড় প্রমাণ।
২০১৩
সাল থেকে ২০২৩। ঠিক
১০ বছর পর প্রায়
একই রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতির
সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে পাঁচ সিটি করপোরেশন
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ২৫ মে অনুষ্ঠিত
হবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন।
১২ জুন বরিশাল এবং
খুলনা সিটিতে হবে ভোটযুদ্ধ। আর
২১ জুন ভোট হবে
রাজশাহী এবং সিলেটে। ২০১৩
সালে যেমন বিএনপি নির্দলীয়
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে ছিল। ১০ বছর
পর একই দাবিতে বিএনপি
রাজপথে। তখন যেমন বিএনপি
বলেছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া তারা জাতীয়
নির্বাচন করবে না। এখনো
সেই দাবিই বিএনপি নেতাদের কণ্ঠে। তবে ২০১৩ সালে
বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছিল। এখন আরও অনড়
অবস্থান গ্রহণ করেছে দলটি। ঘোষণা করেছে, এই সরকার এবং
এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে
যাবে না। স্থানীয় সরকার
নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে এখন দলীয় প্রতীকে
স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ফলে একটি
দলের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের ভালো উপায় এসব
নির্বাচন। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই
বিএনপি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আনুষ্ঠানিকভাবে বয়কট করছে। যদিও
ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এমনকি বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও
বিএনপির নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা স্বতন্ত্র পরিচয়ে অংশ নিচ্ছেন। এটি
দলের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি
এবং বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। শেষের দিকে এসে এসব
স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিএনপি কঠোর হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ
সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে স্বতন্ত্র
প্রার্থী হয়েছিলেন বিএনপি নেতা তৈমূর আলম
খন্দকার। নির্বাচনের পর দীর্ঘদিনের ত্যাগী
এই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার
করা হয়। একই পরিণতি
বরণ করেন কুমিল্লায় মনিরুল
ইসলাম সাক্কু। কিন্তু ওইসব নির্বাচনের চেয়ে
সামনের পাঁচ সিটি নির্বাচনের
প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এই নির্বাচন এমন
এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে
যখন জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। বিএনপি
বলছে, এই সরকারের অধীনে
কোনো অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না।
কিন্তু এটি তাত্ত্বিক কথা।
বাস্তবতা হলো ২০১৮-এর
নির্বাচনের পর দেশে অনেক
স্থানীয় এবং জাতীয় নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচনে ভোটারদের
উপস্থিতি নিয়ে হতাশা আছে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক উৎসবের ঘাটতি দৃশ্যমান। নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক এবং অংশগ্রহণমূলক হয়নি
এমন অপ্রাপ্তি আছে। বিরোধী প্রার্থীদের
ছলে-বলে বসিয়ে দিয়ে
বিনা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার
অগ্রহণযোগ্য প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু নির্বাচনে
কারচুপির বড় অভিযোগ নেই।
কয়েকটি নির্বাচনকে মডেল নির্বাচন হিসেবে
চিহ্নিত করা যায়। যেমন
নারায়ণগঞ্জ এবং রংপুর সিটি
নির্বাচন। এর মধ্যে রংপুর
সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জামানত হারান। নির্বাচন কমিশন পাঁচ সিটি নির্বাচনের
আগে বিএনপিকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গত
মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) বিএনপিকে
অন্তত একটি নির্বাচনে অংশ
নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাজের পরীক্ষা নিতে আহ্বান জানান।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেখা যাচ্ছে
বিএনপির অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চান। কর্মী
এবং ভোটারদের জন্যই তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণে
আগ্রহী। যেমন সিলেটের মেয়র
আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সবুজ সংকেত পেতে
লন্ডন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দল
অনুমতি না দিলেও তিনি
হয়তো নির্বাচনে দাঁড়াবেন। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করলে দুদিক থেকেই বিএনপি লাভবান হতে পারত। যদি
নির্বাচনে দলগতভাবে অংশগ্রহণ করত এবং দুই-তিনটিতে বিজয়ী হতো, তাহলে বিএনপি
বলতে পারত এই সরকারের
জনপ্রিয়তা কমেছে। কর্মীরা উৎসাহিত হতো, অনুপ্রাণিত হতো।
এই শহরগুলোকে ঘিরে বিএনপি সংগঠিত
হতে পারত। দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে সব
সিটিতে মেয়র পদে হারলেও
বিএনপির লাভ হতো। তারা
বলতে পারত, আগেই বলেছিলাম এই
সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্ভব নয়। এটি প্রমাণিত
হলো। নির্বাচনের সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জোরালো করত। কিন্তু বিএনপি
এই নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে
রেখেছে। অবশ্য নির্বাচন থেকে বিএনপি সম্পূর্ণ
দূরে সরে আছে এরকম
বলাটা ভুল হবে। বিএনপি
এই নির্বাচনকে রাজনৈতিক কৌশলের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। বিএনপি
মনে করছে, সিটি নির্বাচন বর্জন
করলে ভোটের আকর্ষণ নষ্ট হবে। ভোট
উৎসব হবে বিবর্ণ। ফলে
‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো
হবে। বিএনপি অংশগ্রহণ না করলে যে
ভোটের জৌলুস থাকে না, সেটি
প্রমাণ করতেই বিএনপি সিটি নির্বাচন বর্জন
করছে। প্রতিযোগিতাহীন ভোট মানেই সেখানে
জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয় না। তিন
বছর ধরে আন্তর্জাতিক মহলে
বিএনপি এ কথাটি বারবার
বলছে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ
পশ্চিমা দেশগুলো এখন ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের’
ওপর জোর দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র
নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানাচ্ছে না বটে। কিন্তু
তারা সুস্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন হতে হবে অবাধ,
সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। যুক্তরাষ্ট্র
এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের কথাবার্তায় একটা ইঙ্গিত পাওয়া
যায়। সেটি হলো, বিএনপি
অংশগ্রহণ না করলে, সেই
নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। এ
জন্যই বিএনপি নেতাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতুষ্টি
লক্ষ্য করা যায়। বিএনপি
নেতারা বলছেন, ২০১৪-এর মতো
নির্বাচন এবার হবে না।
এবার যদি তারা ঘরেও
চুপচাপ বসে থাকে, তাহলেও
আওয়ামী লীগের জন্য একতরফা নির্বাচন
দুরূহ হবে, এমন ধারণা
বিএনপির। তাই সিটি নির্বাচনকে
পানসে করে বিএনপি নিজেদের
গুরুত্বপূর্ণ করতে চায়। এই
নির্বাচনের পর তাদের নির্বাচনে
আনার চাপ বাড়বে এমন
বিশ্বাস বিএনপির। তবে পাঁচ সিটিতে
বিএনপির আরেকটি কৌশলও লক্ষণীয়। সেটি হলো, আওয়ামী
লীগ প্রার্থীকে পর্যুদস্ত করা। এখন পর্যন্ত
প্রতিটি সিটি করপোরেশনেই বিএনপির
নানা ধরনের প্রার্থীর তৎপরতা লক্ষণীয়। সিলেটে বর্তমান মেয়র আরিফ প্রার্থী
হতে পারেন, এমন গুঞ্জন রয়েছে।
বরিশালে সাবেক মেয়র এবং বিএনপি
নেতা প্রয়াত আহসান হাবিব কামালের পুত্র কামরুল হাসান রূপন প্রার্থী হবেন
বলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। গাজীপুরে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম
সরকারের ছেলে শাহ নূর
ইসলাম রনি প্রার্থী হয়েছেন।
খুলনা এবং রাজশাহীতেও বিএনপির
‘ছদ্মবেশী’ প্রার্থী থাকবেন, এটা নিশ্চিত। এরা
স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও এদের পেছনে রয়েছে
স্থানীয় বিএনপির একটি বড় অংশ।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা স্বতন্ত্রভাবে
প্রার্থী হলেও নির্বাচনে একটি
উত্তেজনা সৃষ্টি হবে। কে আওয়ামী
লীগ আর কে বিএনপি
এটা ভোটারদের কাছে কোনো গোপন
বিষয় নয়। তাই বিএনপি
স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিলেও নির্বাচন
হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যেমনটি হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লায়। তাই
বিএনপির দ্বিমুখী কৌশল স্ববিরোধী। একদিকে
দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন না করে তারা
নির্বাচনকে গুরুত্বহীন করতে চাইছে। অন্যদিকে
আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমেছে এটা প্রমাণ করতে
গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে তারা নির্বাচনকে
আকর্ষণীয় এবং উৎসবমুখর করছে।
কাজেই বিএনপির এই কৌশল শেষ
পর্যন্ত তাদের জন্য বুমেরাং হয়
কি না, সেটি দেখার
বিষয়। কারণ বিএনপির স্বতন্ত্র
প্রার্থিতার কারণে ইতোমধ্যে সিটি নির্বাচনে উত্তাপ
ছড়িয়ে পড়েছে। বিএনপির দলগত অংশগ্রহণ ছাড়া
যদি পাঁচ সিটির নির্বাচন
অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়,
তাহলে তা বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের দাবিকে দুর্বল এবং অর্থহীন করবে।
এখানেই সিটি নির্বাচন নিয়ে
আওয়ামী লীগের কৌশল পরিকল্পনা। জয়-পরাজয়ের চেয়ে এই নির্বাচন
আওয়ামী লীগের জন্য প্রমাণ করার
নির্বাচন। দলীয় সরকারের অধীনে
যে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্ভব, তা প্রমাণের শেষ
সুুযোগ এই পাঁচটি স্থানীয়
সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনগুলো যদি
সুষ্ঠু, অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
হয়, তাহলে বিএনপিকে বাদ দিয়েই আরেকটি
জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে পারবে আওয়ামী
লীগ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বিভিন্ন
বক্তৃতায় বারবার বলছেন, ‘আগামী নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু
এবং নিরপেক্ষ। কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করল, কে করল না,
সেটি দেখার বিষয় নয়। কাউকে
হাতেপায়ে ধরে নির্বাচনে আনার
দায়িত্ব না সরকারের, না
নির্বাচন কমিশনের।’ সিটি নির্বাচন সফল
হলে, উৎসবমুখর হলে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য
শক্ত ভিত্তি পাবে। ক্ষমতাসীন দল বিএনপির ওপর
পাল্টা চাপ দিতে পারবে।
আওয়ামী
লীগ যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে
এই নির্বাচনকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে। বলতে
পারবে, বিএনপি ছাড়া ভালো নির্বাচন
হয় না, এরকম ধারণা
সঠিক নয়। এটি সংবিধান
অনুসরণ করে জাতীয় নির্বাচন
করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বলাই বাহুল্য,
২০১৪ সালের মতো সেই নির্বাচন
হবে না। আওয়ামী লীগ,
জাতীয় পার্টি, ইসলামী দলসমূহ, ১৪ দলের শরিকরা
যদি আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করে, সেক্ষেত্রে নির্বাচন
একেবারে ঠান্ডা থাকবে না। কাজেই আগামী
নির্বাচনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত করতে এই নির্বাচন
ক্ষমতাসীনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে
আওয়ামী লীগ যদি সব
সিটিতেও পরাজিত হয় তাহলেও তাদের
ক্ষতি নেই। এই বোধ
আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহীদের মধ্যে
সঞ্চালিত হতে হবে। নির্বাচনে
যে কোনো উপায়ে জয়ী
হওয়ার এক অযৌক্তিক মানসিকতা
আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে
ইদানীং প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। এটা
আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করছে। ভবিষ্যতে আরও করবে। ২০১৩-তে সব সিটিতে
হেরেই আওয়ামী লীগ জিতেছিল। এবারও
আওয়ামী লীগকে সেই পরীক্ষাই দিতে
হবে। একদিকে ভালো ভোট, অন্যদিকে
জয়। এটা আওয়ামী লীগের
জন্য দ্বিমুখী সংকট। জনপ্রিয়তা প্রমাণ করতে গিয়ে যদি
নির্বাচনে অতি উৎসাহী আওয়ামী
লীগাররা কারচুপি করে, প্রশাসনকে ব্যবহার
করে কিংবা অনিয়ম ও আধিপত্য বিস্তার
করে, সেটি ক্ষমতাসীনদের জন্য
হবে আত্মঘাতী। এর ফলে বিরোধী
পক্ষের দাবিকে জোরালো করবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত এবং আন্তর্জাতিক
চাপ তৈরি হবে। তাই
পাঁচ সিটি নির্বাচন আওয়ামী
লীগের জন্য অনেকটা ‘জলে
কুমির, ডাঙায় বাঘের মতোই।’ আওয়ামী লীগ কী করবে?
প্রশ্ন
হলো, গত ১৪ বছরে
আওয়ামী লীগের এত উন্নয়ন, এত
অর্জন, তারপরও স্থানীয় নির্বাচনে জয় নিয়ে আওয়ামী
লীগের প্রার্থীদের এত সংশয় কেন?
এত অনিশ্চয়তা কেন? কেন কারচুপি
করে জিততে চায়? নির্বাচনে জয়ী
হতে কেন পুলিশ লাগে?
প্রশাসন প্রয়োজন হয়? এর কারণ
আওয়ামী লীগ নিজেই। পাঁচ
সিটিতে প্রার্থী ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের
গৃহদাহের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গাজীপুরে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী
নেতা আজমত উল্লা। কিন্তু
সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর তার
পক্ষে নেই। তিনি নির্বাচন
করবেন, এমন কথা গাজীপুরে
কান পাতলেই শোনা যায়। শেষ
পর্যন্ত যদি আজমত-জাহাঙ্গীর
এক না হতে পারেন,
তাহলে ‘দ্বিতীয় গোপালগঞ্জ’ খ্যাত গাজীপুরে আওয়ামী লীগের জন্য অপ্রত্যাশিত ফলাফল
আসতে পারে। সিলেটে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন লন্ডন প্রবাসী আনোয়ার। সিলেট মহানগরের একটি বড় অংশ
তার বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করছেন, এমন
খবর কে না জানে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই গত সিটি নির্বাচনে
বদরউদ্দিন কামরানের মতো জনপ্রিয় প্রার্থী
হেরেছিলেন। এখন সেই কোন্দল
কমেনি, বরং বেড়েছে। বরিশালে
মনোনয়নে আওয়ামী লীগ সাহসী সিদ্ধান্ত
নিয়েছে। বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহকে
মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। জাতীয় নির্বাচনের আগে এটি শেখ
হাসিনার একটি বার্তা। যারা
জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুর্নাম কুড়াবেন। ক্ষমতার দাপট দেখাবেন। অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা করবেন। তাদের আগামীতে সাদিক আবদুল্লাহর মতোই পরিণতি বরণ
করতে হবে- এ বার্তাটি
শেখ হাসিনা দিয়েছেন। কিন্তু বরিশালে কি আওয়ামী লীগ
ঐক্যবদ্ধ? সাদিক আবদুল্লাহপন্থিরা কি আওয়ামী লীগের
সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন? খোকন
সেরনিয়াবাতকে হারাতে কি বিএনপির চেয়েও
ভয়ংকর হবে না আওয়ামী
লীগের একাংশ? কোন্দলে জর্জরিত, বিভক্ত আওয়ামী লীগই এখন আওয়ামী
লীগের সবচেয়ে বড় শত্রু। এই
কোন্দল সহজ জয়কেও কঠিন
করে তোলে। জয়ী হতে নির্বাচন
ব্যবস্থাকেই কলুষিত ও কলঙ্কিত করে।
তাই সিটি নির্বাচন আওয়ামী
লীগের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। নিজেদের
অন্তর্কলহ পাশ কাটিয়ে ক্ষমতাসীনরা
কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন করে তা দেখবেন
দেশবাসী এবং বিশ্ব।
আগামী
প্রায় দুই মাস সিটি
নির্বাচন, তাই শুধু ভোটের
লড়াই হবে না, হবে
রাজনৈতিক কৌশলের লড়াই। দেখার বিষয় এই কৌশলের
লড়াইয়ে কে জেতে, আওয়ামী
লীগ না বিএনপি?
লেখক
: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।