এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতিতে ‘এক-এগারো’ ঝড়ের পূর্বাভাস

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২০ মে, ২০২৩


Thumbnail

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মুখ ফসকে কিংবা নিজের অজান্তে সত্যটা বলে ফেলেন। এই যেমন গত শনিবার (১৩ মে) পল্টনের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ঝড় আসছে। সমুদ্র থেকে উত্তাল ঢেউ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। আজ শুধু প্রাকৃতিক ঝড় আসছে, সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। আজ রাজনৈতিক ঝড়ও আসছে।’  মির্জা ফখরুল যখন ‘ঝড় আসছে’ বলে উচ্ছ্বাস করছিলেন তখন দেশের মানুষ ছিল উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত, আতঙ্কিত। উপকূলবাসী প্রিয় আপন ঠিকানা ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছিল আশ্রয় কেন্দ্রে। আবহাওয়া অধিদফতর, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করেছিল। ঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো কোনো আনন্দের উপলক্ষ নয়। বিভীষিকা, মৃত্যু, আতঙ্ক, কান্না, আহাজারি। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব এই তান্ডবে পুলক অনুভব করেছিলেন। একটি সুস্থ, জনঅধিকারে বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক দল কখনো জনগণের দুর্দশা কামনা করতে পারে না। কিন্তু মির্জা ফখরুল রাজনৈতিক ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে মানুষের কষ্টের আগাম বার্তা দিলেন। এ দেশের জনগণের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, মোখা যেমন অপরিচিত নয়, তেমনি অপরিচিত নয় রাজনৈতিক ঝড়ের নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস, অসাংবিধানিক শাসন।

রাজনৈতিক ঝড় দুই রকমের। এক ধরনের ঝড় সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্য। যেমন ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের রাজনৈতিক টর্নেডো। এই দুর্যোগের আগুনে বাস পুড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু এই ঝড় বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। আরেক ধরনের রাজনৈতিক ঝড় দীর্ঘমেয়াদি। যেমন ২০০৭ সালের রাজনৈতিক ঝড়। ওই তান্ডবের নাম ছিল এক-এগারো। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জনগণকে ভুগিয়েছিল দুই বছর। তাহলে কি বিএনপি মহাসচিব আরেকটি এক-এগারো আনার ইঙ্গিত দিলেন। শুধু ইঙ্গিত বলি কী করে? বিএনপি কয়েক মাস ধরেই দেশে আরেকটি এক-এগারো আনার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছে। এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে চাইছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে আনার কিছু দৃশ্যমান আলামতও পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাজ্য সফরকালে বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিমকে তিনি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই বাংলাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্যে রূপ নিতে শুরু করেছে। তিন দেশ সফর শেষে গত সোমবার (১৫ মে) গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম না বলে তিনি ঘোষণা করেন, যেসব দেশ আমাদের স্যাংশন দেবে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না। স্পষ্টতই শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেই এ মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন সে সময়েই ঢাকার পুলিশ কমিশনার জানালেন, যে চারটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা অতিরিক্ত প্রটোকল বা নিরাপত্তা সুবিধা পেতেন তা আর পাবেন না। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় একই রকম ঘোষণা দেন। সিদ্ধান্ত ঘোষণার ধরন এবং প্রক্রিয়া ছিল বিভ্রান্তিকর। বুঝে না বুঝে এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। বিএনপি সরকারের এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিএনপির উথলে পড়া দরদের রহস্য বুঝতে গবেষক হওয়ার দরকার নেই। একদা বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের কেউ ছিলেন মস্কোপন্থি। কেউ ছিলেন চীনপন্থি। সে সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কৌতুক প্রচলিত ছিল। কৌতুকটি ছিল এরকম-‘মস্কোতে বৃষ্টি হলে কমিউনিস্টরা বাংলাদেশে ছাতা ধরে।’ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে খালকাটা শুরু করলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতকে এতে আমন্ত্রণ জানানো হতো। সৌজন্যতার খাতিরে কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত খালকাটা কর্মসূচিতে যোগ দিতেন। এরকম একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত। ব্যস। আর যায় কই, পরদিন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা কোমর কষে কোদাল নিয়ে খাল কাটতে নেমে পড়লেন। রাজনীতিতে এ নিয়ে শুরু হলো হাস্যরস। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও হতবাক। পরে নেতারা ইনিয়ে-বিনিয়ে জানালেন, কৌশলগত কারণে তারা খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্যই তাদের এই কৌশল। প্রটোকল বা এসকট প্রত্যাহার নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া সেরকম একটি একান্ত অন্ধ অনুগত রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। ওয়াশিংটনে বৃষ্টি হলে কি একদা চৈনিক বিএনপি নেতা ছাতা মেলে ধরেন? আসলে ঘটনা কী? বাংলাদেশে বহু দেশের দূতাবাস আছে। সব দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতরা একই রকম নিরাপত্তা সুবিধা পান না। এখানে কিছু দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ‘রাজা’দের মতো সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তারা যেন প্রভু। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা যখন এখানে ওখানে যেতেন তখন তাদের নিরাপত্তার নামে রীতিমতো বাড়াবাড়ি হতো। বাংলাদেশের সচিবরা তো নয়ই, মন্ত্রীরাও এমন প্রটোকল পান না। সরকার এখন এরকম কয়েকটি দেশের অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়া বন্ধ করেছে। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূত বা একটি দূতাবাসের নিরাপত্তা বিধানের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তার সবই নেওয়া হয়েছে। শুধু তাদের বাড়তি খাতির বন্ধ করা হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক এবং সাধারণ একটি পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারের একজন মন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনার যেভাবে আয়োজন করে সিদ্ধান্ত জানালেন মনে হলো ভয়ংকর এক কান্ড ঘটেছে। সরকারের এই ঘোষণা লুফে নিল বিএনপি। বাড়তি বা অতিরিক্ত কথাটি বাদ দিয়ে তারা এ নিয়ে এমনভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছে যেন যুক্তরাষ্ট্রসহ রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য টানাপোড়েন তখন বিএনপি কি মার্কিন দূতাবাসের আস্থা অর্জনে মরিয়া? কারণ বাংলাদেশে সব অসাংবিধানিক ক্ষমতা বদলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। অথচ বিএনপি ভুলে গেছে; তাদের শাসনামলে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে কী ভয়ংকর হামলা চালানো হয়েছিল। বিএনপির মধ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার রোগ এখন প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তারা শুধু বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তাদানের ব্যর্থতার কথাই ভুলে যায়নি, নিজেদের তাবৎ ব্যর্থতার কথাও ভুলে গেছে। লোডশেডিং, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, বাংলাভাইদের মতো সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের উত্থান। ১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা : ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, বাজারে সিন্ডিকেট সবকিছু বিএনপি নেতাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। অথবা তারা ইচ্ছা করেই এসব ভুলে গেছেন। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি যা করেছে; তা একবার যদি স্মরণ করত তাহলে বিএনপির কোনো নেতা এভাবে বুক চিতিয়ে কথা বলতে পারতেন না। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেন না। বিএনপি নেতাদের ভুলে যাওয়ার তালিকায় আছে এক-এগারোর ঘটনাবলিও। এ জন্য তারা আবার সে রকম একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে। বিএনপি নেতারা হয়তো মনে করছেন; এরকম একটি সরকার এলে আওয়ামী লীগকে প্যাদানি দেবে আর বিএনপি আরাম আয়েশে ঘুরবে। বিষয়টি তেমন নয়। অনির্বাচিত সরকার রাজনীতির প্রতিপক্ষ; অর্থনীতির বাধা; সাধারণ জনগণের শত্রু। আসুন একটু ‘ঝাপসা’ স্মৃতি পরিষ্কার করে নিই। ২০০৭ সালের ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই আক্রমণ করে রাজনীতির ওপর। ঢালাওভাবে গ্রেফতার শুরু হয় রাজনীতিবিদদের। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ প্রমাণের এক নোংরা খেলা শুরু হয়। প্রভাবশালী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন চলে। বিনা অভিযোগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’ কিংবা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘কারাগারে লেখা অনুস্মৃতি, যে কথা বলা হয়নি।’ এ দুটি গ্রন্থ পড়লেই যে কারও গা শিউরে ওঠে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করে টর্চার সেলে নেওয়া হতো। চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। বিএনপি তখন ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায়ী দল। আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল। কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ছাড়েনি। বরং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বেগম জিয়ার আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কাজেই, বিএনপি যদি মনে করে একটি সুশীল সরকার এসে তাদের জামাই আদর করবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে বাংলাদেশ থেকে রাজনীতি নির্বাসিত হবে। গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেই ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বসে থাকেনি। তারা রাজনীতিতে কিছু মেরুদন্ডহীন চাকর-বাকরের সন্ধানে নেমেছিল। এই ভৃত্যদের দিয়ে প্রধান দুই দুটি রাজনৈতিক দলে ভাঙন ধরানোর নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল এক-এগারো সরকার। মাইনাস ফর্মুলা করে জনপ্রিয় দুই নেত্রীকে অসাংবিধানিকভাবে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে চেয়েছিল সুশীলরা। যেন তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় যারা ওই সেনাসমর্থিত সরকারের পদলেহন করত, সে সময় যারা সংস্কারপন্থি হিসেবে ঘৃণিত হয়েছিল, তখন যারা রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল- তারাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সবচেয়ে সোচ্চার। বিএনপিতে এক-এগারোর সময় যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, তারা এখন অনেকেই কোণঠাসা। সংস্কারপন্থিরা এখন বিএনপির ড্রাইভিং সিটে। এক-এগারোর সময় যেসব লোভী নেতা সেনা গোয়েন্দাদের পায়ের কাছে বসে থাকতেন, তারাই এখন সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি চিৎকার করেন। তাহলে কি এক-এগারোর অসমাপ্ত এজেন্ডা সমাপ্ত করার মিশনে তারা? এক-এগারো আসলে কী? আমার বিবেচনায় বাংলাদেশকে পরনির্ভর এবং পঙ্গু বানিয়ে পশ্চিমাদের পুতুল রাষ্ট্র বানানোই এক-এগারোর মূল ধারণা। শুধু ক্ষমতা লিপ্সা থেকে সে সময় ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি। ড. ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল সে সময়। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে সেই সময় শুরু হয়েছিল কুৎসিত খেলা। শুরুতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তাকে। তথাকথিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকা ছিল মানহানিকর আপত্তিকর এবং আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা। এই তালিকা দিয়েই শুরু হয় নির্বিচারে চাঁদাবাজি। দেশের আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানা দেওয়া শুরু হয়। নানা অজুহাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া, মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করার আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। অনেকে মানসম্মানের ভয়ে সারা জীবনের অর্জিত টাকা তুলে দেন রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজদের হাতে। কেউ দেশের বাইরে চলে গিয়ে দূর থেকে সর্বনাশের নির্মমতায় ডুকরে কেঁদেছেন। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে ভোরের অপেক্ষায় ছিলেন। এক-এগারোর সময় দেশে বেসরকারি খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই অর্থ আদায়কে অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই অর্থ ফেরত পাননি ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা। বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় স্তম্ভ হলো কৃষি খাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঝড়ে ল-ভ- হয়েছিল আমাদের কৃষিও। সারের উচ্চমূল্য ও সংকট, বিদ্যুতের অভাবে সেচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে দিশাহারা হয়ে যান আমাদের কৃষক। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় উৎপাদিত আলু ফেলে প্রতিবাদ করেন তারা। কৃষক যখন অস্তিত্বের সংকটে তখন পাঁচতারকা হোটেলে আলু উৎসব করে এক নিষ্ঠুর তামাশা করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় কারাগারে। শিক্ষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে গোটা জাতিকে অপমানিত করা হয়। সাধারণ মানুষ এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। নির্বিচারে ধরপাকড় গোটা দেশকে আতঙ্কপুরীতে পরিণত করে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি তারবার্তা যায় ওয়াশিংটনে। তাতে বলা হয়, ‘নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর হাতে ৪৩ হাজার মানুষ গ্রেফতার হয়েছে।’ (তথ্যসূত্র : এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮, পৃষ্ঠা : ১৯৭)। নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল সেনাসমর্থিত সরকার দ্বারা। এমনকি উচ্চ আদালত জামিন দিলেও ড. কামাল হোসেনের মতো মানবাধিকারের ঠিকাদার তার প্রতিবাদ করেন। আজ যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে হাহাকার করেন, সেদিন তারা এর প্রতিবাদ করেননি। বরং মানবাধিকারের এই চরম লঙ্ঘনকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বরং বলেছে বেশ বেশ। কিছু তাঁবেদার পরগাছা রাজনীতিবিদ, ভ- লোভী বুদ্ধিজীবী ছাড়া কেউ সেনাসমর্থিত ওই সরকারকে সমর্থন করেনি। তাহলে বিএনপি কি দেশে আবার সেরকম একটি পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে চায়?

ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন আঘাত হানার আগে কিছু লক্ষণ জানান দেয়। তেমনি রাজনৈতিক ঝড়েরও আগমনী পূর্বাভাস কিছু ঘটনাবলিতে বোঝা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এখন আরেকটি রাজনৈতিক ঝড়ের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্যোগের প্রথম আলামত রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে এক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি রাজনীতিতে একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি যদি সামনে জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় তাহলে তা দুর্যোগকে ত্বরান্বিত করবে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ক্ষমতাসীন দলেরও ব্যর্থতা থাকে। তাদের ভিতরও কিছু গোষ্ঠী গোপনে এ ধরনের দুর্যোগকে স্বাগত জানায়। আওয়ামী লীগ টানা ১৪ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। কিন্তু এ সময়ে সব দায়িত্ব একাই পালন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্য কারও যেন কোনো কাজ নেই। মন্ত্রীদের একটি বড় অংশ অযোগ্য। কেউ কেউ দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। একজন প্রতিমন্ত্রী কদিন আগে বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কয়েকটি গণমাধ্যমে। সেখানে তিনি মন্ত্রীদের সিন্ডিকেট, দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। সরকারের ভিতর অস্থিরতা প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। সরকারের ভিতর সুবিধাবাদী, চাটুকারদের প্রচ- ভিড়। এরা সরকারপ্রধানকে সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী সুযোগসন্ধানীরা আস্তে আস্তে প্রকাশ্য হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। শেখ হাসিনা তাদের আবার ক্ষমতায় আনবেন এমন একটি ভাবনায় বুঁদ আওয়ামী লীগ। দলের অবস্থা হতশ্রী। বিভক্তি কোন্দল কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা গাজীপুর আর বরিশাল সিটি করপোরেশনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এসব অনির্বাচিত সরকার আসার পূর্ব লক্ষণ। অনির্বাচিত সরকারের মাস্টারমাইন্ড হলো সুশীল সমাজ। এরা আসলে পশ্চিমা প্রভুদের এজেন্ট, পোষা প্রাণী। প্রভুদের কথায় এরা সবকিছু করে। এখন কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই এরা মাঠে নেমেছে। সরকারকে নাস্তানাবুদ করার জন্য সবকিছু করছেন ক্ষমতালিপ্সু সুশীলরা। সুশীলদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। যাদের এখন বাংলাদেশ নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি ইসু্যুতে তারা কোণঠাসা করতে চাইছে সরকারকে। সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক কূটনৈতিক লড়াই এখন প্রকাশ্যে। এটাও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিত। এক-এগারো আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন এই কূটনীতিকরাই।

তবে, এক-এগারো আঘাত হানতে গেলে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করতে হয়। অতীতে দেশে যতবার অগণতান্ত্রিক শাসন এসেছে প্রত্যেকবারই সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী বিভ্রান্ত অংশের ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার, বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছে। এ ধরনের বিভ্রান্তির প্রলোভনে গত ১৪ বছর তারা পা দেয়নি। এ কারণেই দুর্যোগ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আঘাত হানবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। আশার আরেকটি কারণ হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এ ধরনের দুর্যোগ সামাল দেওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দরকার শেখ হাসিনার তা ভালোমতোই আছে। তার কারণেই এক-এগারোর তান্ডব থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পায়।  তার জন্য ২০১৪ এবং ২০১৫-এর রাজনৈতিক সাইক্লোন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কালবৈশাখীর আগে যেমন প্রকৃতি থমথম হয়ে যায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন তেমন। শেখ হাসিনা কি পারবেন? শেষ পর্যন্ত মোখা বাংলাদেশে আঘাত হানেনি।  সেন্টমার্টিনের একটি অংশের ওপর দিয়ে আঘাত হানে মিয়ানমারে। বাংলাদেশ রক্ষা পায় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে। রাজনৈতিক ঝড়ও কি এভাবে ঠিকানা বদল করবে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।

আকর্ষণহীন, উত্তেজনাহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এখন শুরু হয়েছে উপজেলা নির্বাচনের প্রক্রিয়া। যথারীতি উপজেলা নির্বাচনেও বিরোধী দল নেই। শেষ মুহুর্তে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিএনপি কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্বতন্ত্রভাবেও উপজেলা নির্বাচনে কেউ অংশ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে তিন ধাপে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপের মনোনয়ন পত্র জমা দেয়ার শেষ দিনে দেখা গেল বিএনপির বেশ কিছু স্থানীয় পর্যায়ের নেতা উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু এর পর পরই এলো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন, তাদের বেশীর ভাগই মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেবেন বলেই ধারণা করা যায়।। উপজেলা নির্বাচন এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের স্ত্রী, সন্তান, ভাই-ভাতিজা, শালা-মামাদের নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। আবারও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই। মানুষের সামনে বিকল্প নেই। সাধারণ ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে কেন যাবে? বিএনপির এই ‘ভোট বর্জন’ কৌশল কি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ারই অংশ? 

৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচন বর্জন, অসহযোগ আন্দোলনও সফল হয়নি। শুধুমাত্র ভোটাররা নির্বাচনে আগ্রহ হারিয়েছেন। যে নির্বাচনের ফলাফল পূর্ব নির্ধারিত, সেখানে ভোট দিয়ে কি হবে-এরকম একটি মানসিকতা পল্লবিত হয় ভোটারদের মধ্যে। নির্বাচনের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের আগ্রহ নষ্ট হতে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকেই। ঐ নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করেছিল। সে সময় ১৫৩ টি আসনে জনগণ ভোটই দিতে পারেনি। বিএনপির বর্জন দেশের নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ২০১৮’র নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এবারও অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী ভোট দিতে যাননি। জনগণের সামনে কোন বিকল্প ছিলো না। অথচ ঐতিহ্যগত ভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ নির্বাচন পাগল। ভোটকে তারা উৎসব মনে করে। সেই উৎসব এখন ভাঙ্গা হটের মতো। দেশের অর্ধেকের বেশী নাগরিক জীবনে ভোটই দেননি। একটি ভোট যে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগের হাতিয়ার, এটিই এদেশের মানুষ এখন ভুলতে বসেছে। এটি বিরাজনীতিকরণের সবচেয়ে বড় উপসর্গ। তাবৎ পন্ডিতরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। বিএনপি তো প্রতিদিন মুখস্থ বুলীর মতো, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার নিয়ে আওয়ামী লীগকে গালাগালি করছে। কিন্তু গণতন্ত্র রক্ষা, ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিএনপির কি কোন দায়িত্ব নেই? বিএনপি কি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? নাকি তৃতীয় পক্ষের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার মিশনে বিএনপি একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে এখন যেতে চাই না। 
এবছরের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি কি পেল? এবার অবাধ, সুষ্টু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উপর প্রচন্ড চাপ ছিলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ, হুশিয়ারির প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীনদের অবাধ, সুষ্টু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করতেই হতো। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর জনগণের কাছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিলো। পশ্চিমা দেশ গুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীর মনোযোগ দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিল। সব কিছু মিলিয়ে এবার ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করা ছিলো অসম্ভব, অলীক কল্পনা। কিন্তু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলো। জনগণ ভোটের মাঠে নানা চিন্তা, মত ও পথের প্রার্থী পেলেন না। বিএনপি বলতেই পারে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না- এটা নিশ্চিত হয়েই তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির এই অনুমান কে মানবে? বিএনপির নির্বাচন বর্জনে দলটির ক্ষতি হয়েছে। জনগণের ক্ষতি হয়েছে। লাভ হয়েছে সুশীল সমাজের। এই নির্বাচন জনগণের মধ্যে রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পর্কে অনীহা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের পটভূমি তৈরীর কাজ হয়েছে আরো ত্বরান্বিত। ২০০৭ সালে এরকম রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেই সুশীলরা ক্ষমতা দখল করেছিল। 

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে। তারপর থেকেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে সুশীল সমাজ। এজন্য বিএনপির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও চেষ্টা করছেন সম্মানিত কিছু সুশীল। কিন্তু বিএনপি যদি রাজনীতির পথেই থাকতো, তাহলে নির্বাচনে যেতো। তাদের অভিযোগ জনগণের সামনে তুলে ধরতো। ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনেও বিরোধী দল বিজেপির বিরুদ্ধে দমন পীড়ন, নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করেছে। আম-আদমী পার্টির প্রধান নেতা কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে পার্লামেন্ট থেকে। কংগ্রেস অভিযোগ করছে, বিজেপি নির্বাচনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাই বলে কংগ্রেস, আম-আদমী পার্টি কিংবা তৃণমূল কি নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছে? না, বরং তারা এই অভিযোগ গুলোকেই নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেছে, জনগণের কাছে। বিএনপির জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর যে হতাশা এবং অস্থিরতা তা দেখে আমার মতো অনেকেই মনে করছিল, দলটির ভুল ভাঙ্গবে, আত্ম উপলব্ধি হবে বিএনপির। ভুল শোধরানোর জন্য হলেও উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপিকে অংশগ্রহণের জন্য অনবদ্য এক সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করবে না। ফলে বিএনপিও এই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়া অংশগ্রহণ করলে ভোটে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরী হতো। বিএনপি এবং তার গোপন এবং প্রকাশ্য মিত্ররা নির্বাচনে অংশ নিলে গণতন্ত্রের রক্তশূন্য শরীরে রাজনীতির রক্ত সঞ্চালিত হতো। উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ‘রাজনীতি’ কে আরো দুর্বল এবং মুমূর্ষু করলো। বিএনপি দেশে গণতন্ত্র চায় না। জনগণের অধিকারও চায়না। তারা শুধুমাত্র চায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে। এটা যেমন সত্য, তেমনি এর বিপরীতে প্রশ্ন উঠতেই পারে আওয়ামী লীগ কি মুক্ত, সুস্থ রাজনীতি চায়? আওয়ামী লীগ কি গণতন্ত্রের বিকাশ চায়? রাজনীতি হত্যার উৎসবে কি আওয়ামী লীগও সামিল নয়? 

টানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কৌশল যেভাবে রপ্ত করেছে, ঠিক সেভাবে কি সংগঠনকে নীতি ও আদর্শের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে? আওয়ামী লীগের ভেতরে কি কোন রাজনীতি আছে? আদর্শ চর্চা আছে? প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই কি নিজেকে হত্যা করছে না? সারা দেশে এখন আওয়ামী লীগ কয়েক ভাগে বিভক্ত। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন দলটি কোন্দল বিভক্তিকে সাংগঠনিক স্বীকৃতি দেয়। দেশে এখন কোন বিরোধী দল নেই। কোথাও সরকারের সমালোচনা নেই। সবাই সরকারকে ‘সাধু সাধু’ করে। আওয়ামী লীগ এখন একাধিক টীম হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে খেলছে। কোন্দলকে দেয়া হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি। জেলায় জেলায় আওয়ামী লীগ একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। বিএনপি-জামায়াতের দরকার নেই, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারাই একে অন্যের চরিত্র হনন করছে, রক্ত ঝরাচ্ছে, খুন করছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। তারা এসব কোন্দলকে পাত্তা দিতেই রাজি নন। আওয়ামী লীগ নেতারা এখন আত্ম তুষ্টির সর্বোচ্চ চূড়ায়। কোন বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। তাদের মতে, বিরোধী দল নেই, তাই একাধিক গ্রুপ থাকলে দল শক্তিশালী হবে। কর্মী বাড়বে। দলে ভারসাম্য থাকবে। একজন এমপি বলছিলেন, সবাই তো শেখ হাসিনার। যে জিতবে, সেই আপন। যে হারবে, সে জয়ীকে চাপে রাখবে। এরকম ‘চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স’ কৌশল চলছে আওয়ামী লীগ। এটাই নাকি ভালো। কিন্তু এটি যে কি ভয়ংকর দর্শন তা বুঝতে আওয়ামী লীগকে আরেকটি দুঃসময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এর ফলে বিশ্বস্ত, ত্যাগী, দল ও নেতার জন্য সব কিছু উৎসর্গ করার মতো নেতা-কর্মী শূন্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ। নেতা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, নেতার জন্য জীবন দেবো-এই মনোভাব আওয়ামী লীগ থেকে উঠে গেছে বহু আগেই। আওয়ামী লীগে এখন ‘নব্য মোশতাক’ তৈরী হচ্ছে মাশরুমের মতো। নেতার সামনে স্তুতি, আড়ালে সমালোচনা-এটাই এখন আওয়ামী সংস্কৃতি। সব নেতা, পাতি নেতা জানেন, মূল নেতা তার বিকল্প রেখেছেন। তিনি দলে অপরিহার্য নন। কাল নেতার হাত সরে গেলেই সে ‘জিরো’। মূল নেতার তিনি একান্ত আপন নন। এই উপলব্ধি তাকে লোভী করে। দুর্নীতিবাজ করে। আদর্শহীন এক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদে পরিণত করে। এই উপলব্ধির কারণেই সে সংগঠন ভালোবাসেনা, দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে না। আওয়ামী লীগের ক’জন নেতা এখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন? কাজের চেয়ে মূল নেতার নেক নজরে থাকাটাই তাদের জন্য লাভজনক। এজন্য আওয়ামী লীগে চলছে আখের গোছানোর উৎসব। যে যেভাবে পারছে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দলের ত্যাগী, পরীক্ষিতরা হয় বৈষয়িক হয়ে উঠেছেন। টাকা-কড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্য মনোযোগী হচ্ছেন, অথবা দূরে, নিভৃতে চলে যাচ্ছেন অবহেলায়, হতাশায়। দল করো, পদ দখল করো, নির্বাচন করো, টাকা বানাও-আওয়ামী লীগের এই অধ্যায় সমাপ্ত প্রায়। এরপর শুরু হয়েছে, ছেলে, বউ, শালা, মামা, ভাগিনাদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা। যার এক ঝলক দেখা যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নেতাদের একটা বড় অংশ এখন সাধারণ মানুষকে ‘মানুষ’ মনে করে না। তাদের পাত্তাও দেয় না। নেতারা চার পাশে রাখেন স্তাবকদের। কিছু একটা বলেই চাটুকারদের দিকে তাকান। তারা অনুগত ভৃত্যের মতো মাথা নাড়েন এবং হাসেন। 

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও আজ বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীদের মতো। এরা জনসম্পৃক্তহীন, উদ্বাস্তু। জনবিচ্ছিন্নতার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে স্বৈরাচারের গর্ভে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টি। এই সুযোগে রাজনীতির মরা লাশ কুড়ে কুড়ে খাওয়ার অপেক্ষায় মৌলবাদী শকুন। তরুণদের মধ্যে রাজনীতির আগ্রহ নেই। আরো সোজা সাপটা বললে, তরুণরা রাজনীতিকে রীতিমতো ঘৃণা করে। একারণেই ‘রাজনীতি মুক্ত’ ক্যাম্পাসের দাবী এখন জনপ্রিয় হচ্ছে। যারা ছাত্র রাজনীতি করেন, তাদের মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্র নেতাদের ভয় পান বটে, কিন্তু সম্মান করেন না। রাজনীতি এখন সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। এভাবেই সর্বত্র রাজনীতিকে কলংকিত করার উৎসব চলছে। রাজনীতি মানেই খারাপ-এটা প্রমাণের এক ভয়ংকর খেলা শুরু হয়েছে। যার মূল লক্ষ্য হলো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো। আবার অগণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা। কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে ক্ষমতার চাবি তুলে দেয়া। তেমন পরিস্থিতির দিকেই কি ছুটছে বাংলাদেশ?     

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

পদ হারানোর ঝুঁকিতে আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য

প্রকাশ: ০২:০০ পিএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন। 

আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদকের টেলিআলাপের পরপরই ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডির ৩ নম্বর কার্যালয়ে যান এবং সেখানে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই বৈঠকে তিনি যারা যারা নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করার জন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেন। 

একই সাথে তিনি এটাও জানান যে, যদি কেউ দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী করে তাহলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরকম একটি বক্তব্যের পরপরই আওয়ামী লীগের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। 

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক গণমাধ্যমে শুধু বিষয়টি অবহিত করেননি, তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তত তিনজন আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং কথা বলে তাদের নিকট আত্মীয় স্বজনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ড. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই  হারুন অর রশীদ হীরা টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলা থেকে এবার নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তার এই প্রার্থীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক। তারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 

ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতির সাথেও টেলিফোনে কথা হয়েছে বলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বাংলা ইনসাইডারকে নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়াও আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান এমপির ছেলে আসিবুর রহমান খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। তার সাথেও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কথা বলেন এবং তাকেও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য পরামর্শ দেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গেও আলাপ করেছেন বলে জানা গেছে। তার ছেলে আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচরে প্রার্থী হয়েছেন। 

এই সমস্ত স্বজনরা যদি শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করে সে ক্ষেত্রে কী করা হবে? এ রকম প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং এদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলেও জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা প্রেসিডিয়াম এবং এই প্রেসিডিয়ামের দুজন সদস্য যখন দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদের নিজেদের আত্মীয় স্বজনকে প্রার্থী করেছেন তখন অন্যরা সেটা মানবে কীভাবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে সামনে এসেছেন। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান গ্রহণ করতে চায় বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেক হাসিনা বলেছেন, যারাই এ সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উল্লেখ্য, এর আগেও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদেরকে দল থেকে পদ হারানো বা বহিষ্কারের নজির রয়েছে। আওয়ামী লীগের এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতা আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী যখন দল থেকে বহিষ্কৃত হন তখন তিনি প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। কাজেই শেষ পর্যন্ত যদি এই উপজেলা নির্বাচনে স্বজনদের অবস্থান নিয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না নেয়া হয় তাহলে এই দুই নেতা বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন বলে অনেকে মনে করছেন।

আওয়ামী লীগ   উপজেলা নির্বাচন   ড. আব্দুর রাজ্জাক   শাহজাহান খান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু: শেখ হাসিনাই হতে পারেন শান্তির দূত

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা। 

উল্লেখ্য, ২০১২ সালে শেখ হাসিনার বিশ্বশান্তির দর্শন জাতিসংঘ অনুমোদিত হয়েছে। এই বিশ্বশান্তি দর্শনের আলোকেই ইসরায়েল ইস্যুতে একটি রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে। 

বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে কঠোর এবং যৌক্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ গাজায় নিরীহ মানুষের ওপর অবিচার, হত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সবসময় নিন্দা জানাচ্ছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার ঈদের শুভেচ্ছা ভাষণেও মধ্যপ্রাচ্যের মানবিক বিপর্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'মাদার অব হিউম্যানিটি' হিসেবে পরিচিত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার কণ্ঠস্বর হয়েছেন। আর এ কারণেই বিশ্বে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। উদার মুসলিম দেশের নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে তিনি আলাদা একটি অবস্থানে রয়েছেন। বাংলাদেশ একদিকে যেমন ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা করে, অন্যদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদ এবং ধর্মের নামে উগ্র সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। আর এটি বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ করেছে। শেখ হাসিনা এই মুহূর্তে বিশ্বের এমন একজন নেতা যিনি মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সংকট সমাধানের আলোকবর্তিকা হয়ে সামনে দাঁড়াতে পারেন। তার শান্তির মডেলকে সামনে রেখে যদি বিবদমান পক্ষগুলো আলোচনার টেবিলে বসে তাহলে ইসরায়েল ইস্যুতে শান্তি অসম্ভব নয়।

বিশ্বে যারা নেতৃবৃন্দ আছেন তারা প্রায় অনেকেই বিতর্কিত এবং পক্ষপাতে দুষ্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্ব নেতার অবস্থানে থাকতে পারছেন না। চীন এই বিষয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভাবে পক্ষ করতে চায় না। তাছাড়া বিভাজিত বিশ্বে চীনের নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ মেনে নেবে না এটা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি রাশিয়া এখন নিজের ঘর সামলাতে ব্যস্ত। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে সমঝোতায় নেতৃত্ব দেওয়া পুতিনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমঝোতার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এরদোয়ান ব্যাপারে ইসরায়েল সহ অন্যান্য দেশগুলোর একটি অবস্থান রয়েছে। তাছাড়া তুরস্ক এই বিতর্কে কতটুকু সহনীয় অবস্থায় থাকতে পারবে তা নিয়ে ব্যস্ত।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। এই অবস্থায় বিশ্বকে যুদ্ধাবস্থা থেকে সামাল দিতে পারেন একমাত্র শেখ হাসিনাই। তার শান্তির বার্তা যদি বিবাদমান পক্ষগুলো অনুধাবন করে তাহলে এই জটিল কঠিন পরিস্থিতিতে বিশ্ব শান্তি অসম্ভব নয়। আর এই শান্তির জন্য শেখ হাসিনাই হতে পারেন বিশ্ব নেতা। তার শান্তির দর্শন এবং তার শান্তির উদ্যোগের মাধ্যমে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তি হতে পারে বিশ্ব।

ইরান-ইসরায়েল   শেখ হাসিনা   শান্তির দূত   জো বাইডেন   ইরান  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন যারা

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ১৩ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

আওয়ামী লীগে নীরবে নিভৃতে পালাবদল ঘটছে। এক সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মানে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ সেলিম, মতিয়া চৌধুরী। এখন তাদের অধ্যায় আস্তে আস্তে যবনিকা ঘটেছে। শারীরিক ভাবে তারা অনেকেই অসুস্থ। অনেকে এখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। বরং একটি নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সামনে নিয়ে আসছেন। তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে জায়গা করে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের এই পালাবদলটি শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনীতির একটি অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। 

পুরনোদেরকে অসম্মান না করে নতুনদের জন্য জায়গা করে দেওয়ার যে কৌশল সেটি রাজনীতিতে একটি শিক্ষণীয়। কিছু দিন আগেও যারা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তাদের বদলে এখন আস্তে আস্তে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বেশ কিছু নেতা। যারা আওয়ামী লীগে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে ১১ জানুয়ারি টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠিত হওয়ার পর যাদেরকে বেশি পাদপ্রদীপে দেখা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন;

১. ড. হাছান মাহমুদ: ড. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি ঘটেছে। এর আগে তিনি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী। এবার তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। স্পষ্টতই আওয়ামী লীগ সভাপতি তাকে পাদপ্রদীপে নিয়ে আসছেন। তিনি আওয়ামী লীগের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও বটে। কোন কারণে সাধারণ সম্পাদকের পদ খালি হলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও ড. হাছান মাহমুদের সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলেই অনেকে মনে করছেন। আর এই সমস্ত বিবেচনা থেকেই আওয়ামী লীগে এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে সামনে আসছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। 

২. জাহাঙ্গীর কবির নানক: জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন নিজ যোগ্যতায়। মাঠের নেতা হিসেবে তার দীর্ঘদিনের সুনাম ছিল। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি তৃণমূলের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। রাজনীতিতে চড়াই উতরাই এর মধ্য দিয়েই তিনি এগিয়ে গেছেন তার আদর্শের কারণে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়ার পর তিনি ভেঙে পড়েননি। বরং সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে গেছেন। তার পুরস্কার তিনি পেয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে উন্নীত হন। এবার নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের এই নেতা এখন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি এখন আওয়ামী লীগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারক হয়ে উঠেছেন। 
৩. আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম: আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক কর্মী বান্ধব হওয়ার কারণে তার অবস্থান আস্তে আস্তে দৃঢ় হচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতাদের অন্যতম বাহাউদ্দিন নাছিম কর্মীদের কাছে আওয়ামী লীগ সংগঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থাভাজন, বিশ্বস্ত এবং সংগঠনের প্রশ্নে অকুতোভয় এবং একনিষ্ঠ এই নেতা মন্ত্রী না হয়েও আওয়ামী লীগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নীতি নির্ধারক হয়ে উঠছেন নিজ যোগ্যতায়। 

৪. আব্দুর রহমান: আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীর কবির নানক এর মতোই তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। কিন্তু তারপরও তিনি ভেঙে পড়েননি। সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। এবার নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন এবং আওয়ামী লীগ সভাপতির আস্থার প্রতিদান তিনি ভালো ভাবেই দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের একটি পালা বদল ঘটছে। তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু কিংবা শেখ ফজলুল করিমের জায়গা আস্তে আস্তে এই সমস্ত নেতারা জায়গা করে নিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের একটা পাইপলাইন তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। যেখানে পর্যায়ক্রমে নেতারা অপেক্ষমান অবস্থায় আছেন। নেতৃত্বের শূন্যতা আওয়ামী লীগে যেন না হয় সেজন্য একটি দূরদর্শী রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

আব্দুর রহমান   জাহাঙ্গীর কবির নানক   ড. হাছান মাহমুদ   আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অন্ধকার ছয়দিন

প্রকাশ: ১০:৩০ পিএম, ১২ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের লোডশেডিং চলছে। গত বুধবার থেকে সংবাদপত্র বের হচ্ছে না। টানা ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধের বিশ্ব রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। না কোন প্রতিবাদে নয়, দাবী আদায়ের জন্য নয়। ছুটির ফাঁদে সংবাদপত্র বন্ধ আছে। সংবাদপত্রকে বলা হয় জরুরী সেবা। চিকিৎসক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা যেমন জরুরী সেবা দেন, তেমনি সংবাদকর্মীদের কাজও হলো দেশের মানুষকে সার্বক্ষণিকভাবে সঠিক, বস্তুনিষ্ঠ তথ্য দেয়া। বিশেষ করে ছুটির সময় এটার প্রয়োজন আরো বেশী। এবার দেশে একটা দীর্ঘ ছুটি। এসময় সংবাদপত্র অনেক জরুরী। আচ্ছা ভাবুন তো, ছয়দিন যদি হাসপাতালে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হতো, কিংবা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি বলতো ছয়দিন তারা দায়িত্ব পালন করবে না। তাহলে কি হতো? আমিতো মনে করি, সংবাদপত্র বন্ধ রাখার বিষয়টিও তেমনি আঁতকে ওঠার মতো। কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকদের এনিয়ে বিকার নেই।  

এবার বাংলাদেশ দু’টি বড় উৎসব কাছাকাছি সময় উদ্যাপন করছে। ঈদ-উল-ফিতর উদযাপন করতে না করতেই, আগামীকাল (রোববার) ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ। বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব। এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। তবে বাংলাদেশে ঈদ-উল-ফিতর কেবল মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব নয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও এই উৎসবে আনন্দ করে। সম্প্রীতির বাংলাদেশে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’-এই রীতি চলে এসেছে দীর্ঘদিন। ইদানিংকার মতো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন ধর্মীয় উৎসবকেই দেখা হতো না। ঈদের দিন অন্য ধর্মের বন্ধুরাও বাসায় আসতো সেমাই মিষ্টি এক সাথে খাওয়া হতো। আবার হিন্দুদের পূজাতেও আমরা যেতাম। অনেক মজা হতো। যতো দিন যাচ্ছে আমাদের ধর্মীয় উদার নৈতিক চেতনাকে গ্রাস করে ফেলছে ধর্মান্ধ সংকীর্ণতা। এখন ঈদ উৎসব যেন অনেকটাই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে শৃঙ্খলিত। রমজান মাস জুড়ে এক ধরনের কঠোর বিধি নিষেধ থাকে যা স্বতঃস্ফূর্ত না। আরোপিত এবং লোক দেখানো। এই আরোপিত বিধি নিষেধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন কিছু ‘বক ধার্মিক’। এদের কারণে গত তিন ঈদে পহেলা বৈশাখ নির্বাসিত ছিলো। পবিত্র রমজানের সাথে পহেলা বৈশাখের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু তারপরও অতি উৎসাহী কট্টরবাদীদের দাপটে শৃঙ্খলিত হয় পহেলা বৈশাখ। অথচ বাঙালী হিসেবে পহেলা বৈশাখীই আমাদের প্রথম এবং প্রধান সর্বজনীন উৎসব। বাংলা বর্ষ বরণ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। এই উৎসব অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বেশ কয়েক বছর পর এবার পহেলা বৈশাখ উদ্যাপিত হবে বাঁধাহীন ভাবে। বাঙালী জাতি বর্ষবরণ করবে মুক্ত ভাবে। এটা আমাদের জন্য বড় আনন্দের উপলক্ষ্য তো বটেই। কিন্তু এত বড় উৎসব হবে সংবাদপত্রহীন! কি অদ্ভুত! সংবাদপত্র কি দায়িত্বহীন মালিকানার শিকার?

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করে। সম্প্রীতির বন্ধনে অটুট। কিছু মানুষ যতোই কট্টর মৌলবাদী হোক না কেন, সাধারণ মানুষ এখনও উগ্র পন্থাকে সমর্থন করে না। এজন্য একই সময়ে একাধিক ধর্মাবলম্বীদের উৎসব এদেশে নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়। এবার রমজানের কথায় ধরা যাক না কেন। এবার রমজানের মধ্যেই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ‘ইস্টার সানডে’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোজার মধ্যেই দোল উৎসবে হিন্দু সম্প্রদায় রং উৎসবে মেতেছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা বলেননি যে, রোজার জন্য ইস্টার সানডে করা যাবে না কিংবা দোল উৎসব বন্ধ রাখতে হবে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায় কিছু উপরের তলার মানুষ। যারা ধর্ম প্রতিপালনের চেয়ে লোক দেখানোতে বেশী আগ্রহী। এদের হাতে ধর্ম এবং সংস্কৃতি কোনটাই নয়। এবার ঈদের পরপরই পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হচ্ছে-এজন্য আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের মানুষের সামনে এটি এক অনন্য সুযোগ। এর মাধ্যমে প্রমাণ হতে পারে আমরা বাঙালী, আমরা অসাম্প্রদায়িক, আমরা উদার। এদেশের মানুষ যেমন ঈদ উৎসব করলো তেমনি বাংলা নববর্ষকেও বরণ করবে। এই বর্ষ বরণের উৎসব যেন ঢেকে দিচ্ছে সংবাদপত্রে ছুটি। এবার ঈদের ছুটিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছে বাংলাদেশ সংবাদপত্র মালিকরা। ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ মিলিয়ে মোট ৬ দিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার এক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সংবাদপত্র মালিকরা। পহেলা বৈশাখে কেন সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে? কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ‘ঈদ সংখ্যা’ সাময়িকী প্রকাশ করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে এই সব সাময়িকী গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি আশা করেছিলাম এবার যেহেতু কাছাকাছি সময়ে ঈদ এবং বর্ষবরণ তাই সংবাদপত্রগুলো পহেলা বৈশাখে একটা ছোট সাময়িকী করবে। আলাদা আলাদা সাময়িকী না করুক ঈদ সংখ্যা এবং নববর্ষ সংখ্যা মিলিতভাবে করবে। কিন্তু কোথায় কি, এবার পহেলা বৈশাখে কোন সংবাদপত্রই বেরুচ্ছে না। শুধু পহেলা বৈশাখ কেন? বাংলাদেশে এখন চলছে অন্ধকার সময়। ১০ এপ্রিল থেকে ১৫ এপ্রিল দেশে কোন সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে না। এটি নজীর বিহীন। 

অবশ্য কেউ বলতে পারেন, এ যুগে সংবাদপত্র ৬ দিন না ৬ মাস বন্ধ থাকলো কার কি? এখন সংবাদের জন্য কে আর দৈনিক পত্রিকার অপেক্ষা করে? অনলাইন, টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়ার এই যুগে কেউ আর খবরের জন্য সকালের সংবাদপত্রের অপেক্ষা করে না। সকাল বেলা এক কাপ চায়ের সাথে একটি সংবাদপত্র এখন উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ নয়। এসব ঘটনা প্রিন্ট মিডিয়ার অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠারই ইঙ্গিত। কিন্তু তারপরও প্রিন্ট মিডিয়া এখনও বিশ্বস্ততা এবং আস্থার প্রতীক। একজন পাঠক টেলিভিশনে বা অনলাইনে যতো সংবাদই দেখুক বা পড়ুক না কেন, দিনের শেষে তার নির্ভরতা ছাপা কাগজ। অনলাইনে কোন সংবাদ পাঠ করার পর তার সত্যতা যাচাই করে ছাপা কাগজে। তাই এখনও সংবাদ, সঠিক তথ্যের জন্য প্রধান নির্ভরতার জায়গা হলো সংবাদপত্র। তথ্যের এই বিশ্বস্ত উৎস বন্ধ আছে। টানা ছয়দিনের জন্য দেশের মানুষ সংবাদপত্র পাবে না। এই ছয়দিনকে বলা যায় অন্ধকার সময়। সংবাদপত্র বিহীন একটা দিন মানে অন্ধকার দিন-রাত্রি। গত ১০ এপ্রিল থেকে অন্ধকার ছয়দিন শুরু হয়েছে। আমরা যারা সেকেলে মানুষ। ঘুম থেকে উঠেই পত্রিকা খুঁজি তাদের জন্য এই ছয়দিন দূর্বিসহ, অবর্ননীয়। 

প্রশ্ন হলো সংবাদপত্রের মালিকরা কেন এরকম সিদ্ধান্ত নিলো? এই সিদ্ধান্ত দেশের সংবাদপত্র শিল্পকে আরো সংকটে ফেলবে। বাংলাদেশে এখন সংবাদপত্রের মালিকানা শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের দখলে। প্রধান সব সংবাদপত্রই কোন না কোন শিল্প গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। বড় শিল্পপতিদের কাছে সংবাদপত্র হলো মর্যাদার প্রতীক। মুক্ত সাংবাদিকতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পাঠকের কাছে দায় বদ্ধতা ইত্যাদি ব্যবসায়ীদের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। সংবাদপত্র এখনকার মালিকদের কাছে ‘ক্ষমতা’ এবং ‘অস্ত্র’। এই ক্ষমতা দেখিয়ে তারা তাদের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করে। সুদৃঢ় করে। সরকার সংবাদপত্র মালিকদের ভয় পায়। ব্যাংক তো তটস্থ থাকে। তাই পত্রিকা থাকা মানে ব্যবসায়ীদের সব মুশকিল আসান। কর্পোরেট হাউসে এখন সাংবাদিকতা নেই, এক ঝাঁক ক্রীতদাস আছে। যাদের একমাত্র কাজ মালিকদের মনোরঞ্জন করা। এদের মধ্যে যিনি সম্পাদক তিনি হলেন সবচেয়ে বড় ক্লাউন। মালিকদের খুশী করাই তার একমাত্র কাজ। পেশাগত উৎকর্ষতা চুলোয় যাক। যিনি মালিকের স্বার্থ যতো নিবিড়ভাবে সুরক্ষিত করেন তিনি ততো বড় সম্পাদক। এই অস্ত্র প্রয়োগ করে মালিকরা প্রতিপক্ষকে ভয় দেখায়। যারা তাদের কথা শোনে না তাদের এই অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করে। সংবাদপত্রের মালিকানা ব্যবসায়ীদের কাছে একধরনের বর্মের মতো। নিজেদের অপকর্ম, স্বেচ্ছাচারিতা জায়েজ করার জন্য সংবাদপত্রকে তারা ব্যবহার করে। সংবাদপত্রের মালিক হবার কারণে কেউ তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেনি। এভাবেই চলছে সংবাদপত্র শিল্প। সংবাদপত্র এখন কর্পোরেট ক্রীতদাস। তাই মালিকরা সংবাদপত্র দুই দিন বন্ধ থাকলো না ছয়দিন বন্ধ থাকলো তা নিয়ে ভাবেন না। তারা তাদের ব্যবসা সুরক্ষা পত্রিকা দিয়ে কতটা হলো তা নিয়েই ব্যস্ত। সংবাদপত্র মালিকরা পাঠকের কাছে জবাবদিহিতার বিশ্বাসী নন। তারা দেখেন এই সংবাদপত্র তাদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করতে পারছে। ছাপা কাগজ একদিন বের না হলে অনেক সংবাদপত্রের অনেক টাকা সাশ্রয়। এসব বিবেচনা করেই মালিকরা মনে করেছেন পত্রিকা যদি কয়েকটা দিন বন্ধই থাকে, কি এমন ক্ষতি। কিন্তু এই ছয়দিন সংবাদপত্র বন্ধ যে এক ভয়ংকর বার্তা দিলো তাকি মালিকরা অনুধাবন করেন? সংবাদপত্র ছাড়াও যে দেশ চলে, এমন এক ঘোষণাই কি দিলেন না মালিকরা। ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে হবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকেই। 

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন