‘তথ্য প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা কারও চরিত্র হননের লাইসেন্স দেয় না। ব্যক্তি আক্রমণ, মিথ্যা অপপ্রচার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নয়।’ গত সোমবার (২২ মে) দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি সচিন দত্ত এ মন্তব্য করেন। ‘ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোশ্চেন’ শিরোনামে বিতর্কিত প্রামাণ্যচিত্র ইস্যুতে এক মামলায় বিচারপতি দত্তের এ উক্তি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এক আদেশে বিবিসিকে হাই কোর্টে তলব করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসি ওই প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে গত ১৭ জানুয়ারি। প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল গুজরাট সহিংসতা নিয়ে। প্রামাণ্যচিত্রে সরাসরি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হয়। তথ্যচিত্রটি ছিল অনেকটাই একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট। ভারত সরকার বিবিসিকে কোনো প্রতিবাদ পাঠায়নি। কঠোর ভাষায় ওই বিতর্কিত প্রামাণ্যটি সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ‘আপত্তিকর’ ভিডিওটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নামিয়ে ফেলার নোটিস দেওয়া হয়। ফেসবুক, ইউটিউব বাধ্য ছেলের মতো বিতর্কিত এ প্রামাণ্যচিত্রটি সরিয়ে ফেলে। এটুকু করেই ভারত সরকার সন্তুষ্টির ঢেকুর তোলেনি। আয়কর বিভাগ এক মাসের মধ্যে (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিবিসির দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের ভারতীয় কার্যালয়ে অভিযান চালায়। সর্বশেষ ২২ মে দিল্লি হাই কোর্ট এ ধরনের ‘ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক’ প্রামাণ্যচিত্র প্রচারের অভিযোগে বিবিসির সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সমন জারি করলেন। এ মামলা তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর লাগাম টেনে ধরার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক।
ঠিক দুই বছর আগে প্রায় একই রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশকে ঘিরেও। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি মনগড়া, প্রতিহিংসামূলক এবং অসত্য প্রামাণ্যচিত্র প্রকাশ করে আলজাজিরা। ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার মেন’ শিরোনামে ওই প্রামাণ্যচিত্রটিতে জোর করে অসংলগ্নভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জড়ানো হয়। প্রামাণ্যচিত্রটি প্রকাশের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভুলেভরা এক প্রতিবাদপত্র পাঠিয়েছিল আলজাজিরায়। কাতারভিত্তিক এ টেলিভিশন চ্যানেলটি ওই প্রতিবাদলিপিকে পাত্তা দেয়নি। এটি প্রকাশের পর বিভিন্ন মহল প্রামাণ্যচিত্রটিকে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এখন অবধি। ফেসবুক, ইউটিউবে এর নানা খন্ডিত অংশ এবং পুরোটা প্রচার হচ্ছে। বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এ বিদ্বেষমূলক, হিংসাত্মক প্রামাণ্যচিত্রটি নামিয়ে ফেলার কোনো উদ্যোগ পর্যন্ত নেয়নি। ভারত দেশের স্বার্থরক্ষায় ‘প্রধানমন্ত্রী’ প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। ভারত পেরেছে, বাংলাদেশ পারেনি কেন? সরকারের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা মিচকে ষড়যন্ত্রকারীরা মিনমিন করে বলে ‘ভারত অনেক বড় দেশ। অনেক জনসংখ্যা, তাদের সঙ্গে কি আমরা পারি।’ তাদের এ কথা শুনে মনে হয় তারা বোধহয় দূর গ্রহে বাস করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেদের দেশের আত্মমর্যাদার ব্যাপারে কতটা সচেতন তা তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যেই দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ক্ষমতার ‘ওলটপালট’ করতে পারে জেনেও প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করছেন। এ সমালোচনা একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, বরং দেশের স্বার্থে, মর্যাদার জন্য। সরকারে বিভিন্ন পদে যেসব ব্যক্তি বসে আছেন তারা কি এ থেকে এতটুকু সাহসী, দৃঢ় হতে পারেন না? তারা পারছেন না এ কারণে যে, তারা ষড়যন্ত্রকারী।
ভারত যখন মতপ্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম টেনে ধরেছে। বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রভাবশালী মিডিয়াকে তলব করেছে, তখন বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হাঁটু গেড়ে ফেসবুককে কুর্নিশ করছে। গত ১১ মে ফেসবুকের চাকর-বাকরদের সঙ্গে বৈঠক করেন একদা জাসদের বিভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক বিপ্লবী ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। ফেসবুকের লোকজনকে তিনি জামাই আদর করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপত্তিকর, ঘৃণাসূচক, চরিত্র হননের কনটেন্টগুলো বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেননি। প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ফেসবুক বাংলাদেশে অফিস করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ফেসবুক এটাও বলেছে, কনটেন্ট মনিটরিং সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ফেসবুকের এসব আপত্তিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী খুশিতে বাকবাকুম। তিনি বলেছেন, ‘ফেসবুক বর্তমানে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত অনুরোধ রাখছে।’
বাংলাদেশ এখন যে গুজবের ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে তা মূলত ফেসবুক এবং ইউটিউবের কারণে। শুধু গুজব নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাষ্ট্র এবং সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর প্রধান বাহনে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকার প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। বাংলাদেশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে বিকৃতি এবং কুৎসার বীভৎস উৎসব। লন্ডনে পলাতক বিএনপি নেতা তারেক জিয়ার অর্থে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স থেকে কিছু সাইবার সন্ত্রাসীর ভয়ংকর তথ্যসন্ত্রাস এবং কদর্য আক্রমণের শিকার আজ বাংলাদেশ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এগুলো বোধহয় সরকারবিরোধী অপপ্রচার। কিন্তু যেভাবে একযোগে এসব নোংরা আবর্জনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে গোটা বাংলাদেশই দূষিত এবং দুর্গন্ধময় হয়ে উঠছে। অথচ অবিরত এসব অশ্রাব্য প্রচারণা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কোনো উদ্যোগ নেই। নেই কোনো মাথাব্যথা। তাহলে কি সাইবার-সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্টদের গোপন যোগাযোগ রয়েছে? এ প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে, সাইবার-সন্ত্রাসীদের আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যারা কাজ করছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজ নেই বিদেশে বসে মিথ্যাচার প্রচারকারীদের। কদিন আগে দেখলাম এক প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট আসছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। কিন্তু তারপর আর রিপোর্ট নেই। সংশ্লিষ্ট বমি উগলানোর ইউটিউব চ্যানেল কার্ডটি পর্যন্ত নামিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ আমলে একাধিক ব্যাংকের মালিক বনে যাওয়া এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে রিপোর্ট আসছে বলে ঘোষণা চলল কয়েক দিন। কিন্তু রিপোর্ট আর আসে না। সরকারের সঙ্গে হঠাৎ করে ঘনিষ্ঠ হওয়া কিছু ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা লক্ষ্য করলাম। কেন? একটু খোঁজখবর নিলেই দেখা যায় এর পেছনে রয়েছে ভয়ংকর সর্বনাশা ষড়যন্ত্র। ১৪ বছর আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্বে। এ সময় অনেক ব্যবসায়ী ফুলেফেঁপে উঠেছেন। নাম-পরিচয়হীন ব্যক্তিরাও হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মুদির দোকানদার ব্যাংক থেকে শতকোটি টাকা লোপাট করেছেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে যাদের টিকিটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি তারাই এখন ক্ষমতার চারপাশে ফেভিকলের মতো সেঁটে আছেন। এসব অনুপ্রবেশকারী, হঠাৎ বনে যাওয়া আওয়ামী লীগার একদিকে যেমন সীমাহীন দুর্নীতি করছেন, বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচার করছেন, তেমনি ভবিষ্যতে তাদের লুণ্ঠিত সম্পদকে নিরাপদ করতে লন্ডনে যোগাযোগ করছেন। সাইবার-সন্ত্রাসীরা তাদের ব্ল্যাকমেল করছে। এদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হবে ঘোষণা দেওয়ার পরপরই এরা বিদেশে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। লুণ্ঠিত সম্পদের ছিটেফোঁটা দিয়ে ওইসব সংবাদ বন্ধ করছেন। শুধু যে অর্থ দিচ্ছেন তা-ই নয়, সরকারের অনেক স্পর্শকাতর গোপন তথ্যও তারা তুলে দিচ্ছেন সাইবার-সন্ত্রাসীদের হাতে। অন্যদিকে যেসব ব্যবসায়ী তিল তিল করে ত্যাগে, শ্রমে মেধায় দেশের উন্নয়নের অংশীদার হয়েছেন তারা সাইবার-সন্ত্রাসীদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন না। এসব কুৎসিত মিথ্যাচারের কাছে নতিস্বীকার করছেন না দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তাই তাদেরও এখন টার্গেট করা হয়েছে। এখন অবিরাম কুৎসিত প্রচারণা চলছে। বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাজ যেন শুধু তামাশা দেখা। গণকণ্ঠে যারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন সেই বিপ্লবীরাই এখন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেখভালের দায়িত্ব তাদেরই। তখন তারা নিজেরাই বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার করতেন গণকণ্ঠে। আর এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেখ হাসিনা ও তাঁর বিশ্বস্তদের বিরুদ্ধে কুৎসিত অপপ্রচারের পথ করে দেন। এরা ষড়যন্ত্রকারী। প্রধানমন্ত্রীর জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর ছিল কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক অর্বাচীন প্রতিমন্ত্রী বিমানে আরও কজন মন্ত্রী এবং সফরসঙ্গীকে নিয়ে এক সেলফি তুললেন। মনে হচ্ছে পিকনিকে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনিই ছবিটা ছেড়ে দিলেন। তিনি কি ইচ্ছা করেই সাইবার-সন্ত্রাসীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিলেন? তার এ ছবি তোলা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেওয়া যেমন আপত্তিকর, অনুচিত, তার চেয়েও গর্হিত হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়ার পর এটি নিজের আইডি থেকে অপসারণ করা। শুধু এ প্রতিমন্ত্রী কেন? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে এমন অনেকে যাচ্ছেন তারা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এরা সাইবার-সন্ত্রাসীদের তথ্যের অন্যতম উৎস। এদের পাঠানো ছবি, তথ্যকে রংচং দিয়ে বিদেশ থেকে ফেসবুক আর ইউটিউবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সত্যিকারের বিশ্বস্তদের বিরুদ্ধে যে মাত্রায় নোংরামি চলছে তা যে কোনো দেশের মানদন্ডে ঘৃণিত, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশে বসে কেউ যদি এর একাংশও করে তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তা অপরাধ। কিন্তু বিদেশে বসে করলে? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একাধিকবার এ ধরনের কনটেন্ট বন্ধ করতে বলেছেন। কিন্তু বিটিআরসি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলেছে, ফেসবুক এবং ইউটিউবের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমার মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা আসলে কার প্রতিনিধিত্ব করছেন? সরকারের না সাইবার-সন্ত্রাসীদের? বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী তারেক জিয়া একজন দন্ডিত ফেরারি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির এ পলাতক নেতা দন্ডিত। হাই কোর্ট এক আদেশে ওই ফেরারি ব্যক্তির কোনো বক্তব্য বাংলাদেশে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন এ পলাতক ব্যক্তি লাইভে এসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছেন। কর্মিসভা করছেন, মিটিং করছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসিত মিথ্যাচার করছেন। এসব প্রচারণা বন্ধে যারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তারা তো আদালত অবমাননা করছেন। পচা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী মন্ত্রীর বদৌলতে, বিটিআরসির পৃষ্ঠপোষকতায় এবং আশীর্বাদে বিএনপি-জামায়াত এখন সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে নিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোও সাইবার-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। আজ পর্যন্ত শুনিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স কিংবা কানাডায় বাংলাদেশের দূতাবাস এদের অপতৎপরতা সম্পর্কে ব্যবস্থা নিতে সে দেশের সরকারকে অনুরোধ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা তো দূরের কথা, নোংরামির প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি দূতাবাসগুলো। কদিন আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরকম ২২ জনের নামের তালিকা পাঠিয়েছে বিভিন্ন দূতাবাসে। তালিকা পাওয়ার পর কোনো দূতাবাসের তৎপরতা নেই। সরকারের ঘরেই এভাবে সর্বনাশ বসবাস করছে। বাংলাদেশে ফেসবুকের গ্রাহক ৫ কোটির বেশি। ফেসবুক, ইউটিউবের জন্য বাংলাদেশ এক বিরাট বাজার। তাদের আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত সহজ। বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে ঠিক একই অবস্থা হয়েছিল ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। বর্ণবাদ, হিংসাত্মক প্রচারণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে দেশে দেশে অভিযুক্ত হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে ফেসবুকের বিরুদ্ধে সহস্রাধিক মামলা হয়েছে। প্রায় সব মামলাতেই ফেসবুক আত্মসমর্পণ করেছে। ফেসবুক মার্কিন প্রতিষ্ঠান। মার্কিন আইন অনুযায়ী মানহানিকর কোনো তথ্য প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলায় হেরে গেলে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ। মামলার ক্ষতিপূরণ কে দেবে, এ নিয়েও বিতর্ক হয়েছিল। কিন্তু নিউইয়র্কের এক ক্ষতিপূরণ মামলায় আদালত জানিয়ে দেন ফেসবুক তার দায় এড়াতে পারে না। ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ফেসবুককেই। প্রতিষ্ঠানটি ঘোষিত হিসেবে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রেই ক্ষতিপূরণ দিয়েছে ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। যে দেশ ফেসবুকে ভুয়া তথ্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ, বর্ণবাদ, হেইট ক্রাইমের বিরুদ্ধে যত সোচ্চার হয়েছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের কাছেই নমনীয় হয়েছে। ফেসবুক পৃথিবীর কোনো দেশেই স্বেচ্ছায় অফিস করেনি। স্বপ্রণোদিত হয়ে করও দেয়নি। যেসব দেশ তাদের আইন, রীতির ব্যাপারে দৃঢ় ছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ব্রাজিলে একজন গর্ভবতী নারীর ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করেন তার এক প্রতিবেশী। ওই নারী তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণেœœর অভিযোগে মামলা করেন। ব্রাজিলের আদালত ফেসবুককে ওই ছবি অপসারণের নির্দেশ দেন। কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় অস্বীকার করে। আদালত সরকারকে নির্দেশ দেন, ফেসবুক যদি আদালতের নির্দেশ না মানে তাহলে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে এক মাসের মধ্যে ব্রাজিলে নিজস্ব অফিস করতে বলে। ২১ দিনের মাথায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্রাজিলে অফিস করে। ওই ছবিও অপসারণ করে। মেক্সিকোর একজন মন্ত্রীকে মাদক ব্যবসায়ী বলে মন্তব্য করেন মার্কিন এক সিনেটর। তার এ বক্তব্য দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী এক মেক্সিকান নাগরিক। মন্ত্রী মামলা করেন। মেক্সিকো সরকার এ নিয়ে শক্ত অবস্থান নেয়। অবশেষে মাথানত করে মেক্সিকোতে অফিস করে ফেসবুক। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকককে যৌন ব্যবসার স্বর্গ বলে মন্তব্য করা হয়েছিল। থাইল্যান্ড সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুক নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দুই দিনের মধ্যে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চায়। ওই কনটেন্টটি অপসারণ করে এবং তিন মাসের মধ্যে থাইল্যান্ডে নিজস্ব অফিস করার অঙ্গীকার করে। এরকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। ফেসবুক কিংবা ইউটিউব যখন একটি দেশে অফিস করে তখন তাকে সে দেশের আইনকানুন মানতে হয়। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা জবাবদিহিতার আওতায় না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফেসবুক তো একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা উপার্জন করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগে তারা ভ্যাট, করও দিত না। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টার উদ্যোগে এবং এনবিআরের সঠিক পদক্ষেপের কারণে এখন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে কিছু ভ্যাট ও কর দিচ্ছে বটে। কিন্তু এখনো অনেক টাকার কর ফাঁকির অভিযোগও আছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে হইচই চলছে। এ আইনটি বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরোর মতো। এটি দিয়ে কেবল প্রতিপক্ষকে হয়রানি করা যায়, সাইবার-সন্ত্রাসীদের দমন করা যায় না। সাইবার- সন্ত্রাসীদের দমন করতে দরকার ডাটা প্রটেকশন আইন। সব উন্নত দেশে এটি আছে। সম্প্রতি ‘গাইডলাইন অ্যান্ড ডিজিটাল মিডিয়া ইথিকস কোড’কে আইনে পরিণত করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত। দেশটির তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশংকর প্রসাদ বলেছেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়াকে আরও দায়িত্বশীল এবং জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্যই এ নীতিমালা।’ এ নীতিমালা অনুযায়ী সাইবার নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগ তদন্তে ফেসবুক, ইউটিউব বা টুইটার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ প্রাপ্তির ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সহযোগিতা করতে হবে। এ ধরনের আপত্তিকর কনটেন্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করতে হবে। ভারত সরকারের এ নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়েছেন ভারতে ফেসবুকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অজিত মোহন। তিনি ভারতের আইনের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলেছেন, ‘এটি নিয়ে দর কষাকষির সুযোগ নেই।’ ভারতে যখন মার্কিন টেক জায়ান্ট একান্ত অনুগত তখন বাংলাদেশে তার রূপ অন্যরকম। তার চেয়েও নির্লিপ্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। ডাটা প্রটেকশন আইন নিয়ে আইসিটি মন্ত্রণালয় কাজ করছে, এমনটি শুনছি বহুদিন। কিন্তু এটি হচ্ছে না। আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর মনোযোগ লাভজনক প্রকল্পে। আইন করে তার কী লাভ? সম্প্রতি সরকার ওটিটি গাইডলাইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। ‘রেগুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফরমস ২০২১’ শিরোনামে এ নীতিমালার ব্যাপারে অংশীজনের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এখানে ফেসবুকও তাদের মতামত দিয়েছে। বিটিআরসি খসড়া নীতিমালার ব্যাপারে ৪৫টি মতামত পর্যালোচনা করছে। এর মধ্যে ৩৩টি মতামতই হলো মেটা বা ফেসবুকের। বাংলাদেশে যাদের অফিস নেই, যারা এ দেশের আইনের ঊর্ধ্বে, ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের মতামত দেওয়ার অধিকার আছে? বিটিআরসি তাদের মতামত নেয় কেন? ফেসবুক, ইউটিউবকে আইনের আওতায় আনতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এবং কর্তৃপক্ষের এত অনীহা কেন? সরকার ও রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারের স্বার্থেই কি তাদের এ উদারতা। বিরোধী আন্দোলন নয়, বরং সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। সরকারকে বিব্রত করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু পিশাচের চিৎকার চেঁচামেচিতে দেশের জনগণ অস্থির। শেখ হাসিনা যদি স্যাংশন দেওয়া দেশের কাছ থেকে কিছু কিনবেন না বলে দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা দিতে পারেন, তাহলে ৫ কোটি গ্রাহকের দেশের মন্ত্রী কেন সাহস করে বলতে পারেন না বাংলাদেশে অফিস না করলে ফেসবুক, ইউটিউব কাউকেই ব্যবসা করতে দেব না। ফেসবুক, গুগলকে এমন সতর্কবার্তা দিতে মন্ত্রীরা কেন শরম পান? নাকি তাদের অন্য মতলব আছে?
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে
যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি।
কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন।
সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ
অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
(বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত ছবি প্রকাশ না
হওয়া পর্যন্ত এ ঘটনা মেজর (অব.) হাফিজ বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। মেজর হাফিজ এখন যা বলছেন,
বিষয়টি যদি তেমনি সাদামাটাই হতো, তাহলে সাকিব নাটক তিনি এতদিন গোপন করতেন না। তিনি
যদি তখন এটাকে ‘সরকারের চক্রান্ত’ মনে করতেন, তাহলে তখনই তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে
দিতেন সরকার তাকে কেনার চেষ্টা করছে। সরকারকে বেইজ্জত করার এমন সুযোগ তিনি হাতছাড়া
করবেন কেন? এ নিয়ে হৈচৈ করে তিনি বিএনপিতে তার অবস্থান পোক্ত করতেন। তারেক রহমানের
ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বিএনএম কেলেঙ্কারি, সাকিবের সঙ্গে
ফটোসেশনের ঘটনা গোপন কুঠিরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
এখন যখন দুষ্ট লোকেরা তার এসব গোপন
প্রণয়ের দুর্লভ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে তখন মেজর (অব.) হাফিজ এসবকে
চক্রান্ত বলছেন। এখন কেন? যখন এসব খেলা চলছিল তখন কেন হাফিজ মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন?
হাফিজ উদ্দিন যখন বিদেশ থেকে এসে স্বল্পমেয়াদে কারাবরণ করে ‘পবিত্র’ হলেন, তখন বিএনপি
নেতাদের উল্লাস চাপা থাকেনি। বিএনপির নেতারা মনে করলেন বিএনপিতে আরেক খাঁটি সোনা পাওয়া
গেল। নবরূপে আত্মপ্রকাশের পর নব্য জ্যোতিষীর মতো তিনি ঘোষণা করলেন, বিএনপি নাকি খুব
শিগগির ক্ষমতায় আসছে। অল্পদিনের মধ্যে সরকার পতনের বিষয়টিও তার জ্যোতিষী বিদ্যায় ধরা
পড়ল। বিএনপির আধমরা নেতাকর্মীরা খানিকটা হলেও উদ্ভাসিত হলেন। আবার কিছু একটা হবে, এই
স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন বিএনপির হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা। নির্বাচনের আগে হাফিজ উদ্দিন
কী বলেছিলেন, তা ভুলে গেলেন অনেকে।
আসুন একটু পেছনে ফিরে যাই। ৭ জানুয়ারির
নির্বাচনের আগে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি
বিএনপির আন্দোলনের কৌশলের সমালোচনা করেন। বিএনপির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তও সঠিক
নয় বলে মন্তব্য করেন। মেজর (অব.) হাফিজের ইউটার্ন যে দেনা-পাওনার হিসাব না মেলাজনিত,
এটা বুঝতে সাকিবের সঙ্গে বিএনপি এই নেতার ছবি ভাইরাল হওয়া পর্যন্ত বিএনপির কর্মীদের
অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওই ছবি প্রকাশের পর বিএনপি নেতাকর্মীরা অনুধাবন করতে পারলেন যে,
তারা মেজর (অব.) হাফিজের কাছে ধোঁকা খেয়েছেন। ধোঁকা যে শুধু বিএনপি খেয়েছে এমন নয়।
মেজর (অব.) হাফিজও ‘ডাবল’ ধোঁকা খেয়েছেন। প্রথম ধোঁকা হলো, যে প্রলোভনে তাকে কিংস পার্টিতে
ভেড়ানোর কথা ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই উপঢৌকন তাকে দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় ধোঁকা, বিএনপিতে
আবার যখন তিনি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করলেন, তখনই গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে তাকে বেইজ্জত
করা হলো। বিএনপির জন্য এ ঘটনা ছোট ধোঁকা। গত কুড়ি বছর ধোঁকায় ধোঁকায় জর্জরিত বিএনপি।
বারবার ধোঁকা খেতে খেতে দলটি রীতিমতো গর্তে পড়েছে। ভুল লোককে বিশ্বাস করে বিএনপি ধোঁকা
খেয়েছে। ভুল বন্ধুকে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাস রেখে বিএনপি
বিপর্যস্ত হয়েছে।
২০০১ সালের অক্টোবরে জামায়াতকে সঙ্গে
নিয়ে ভূমিধস বিজয় লাভ করে বিএনপি। এ সময় বিএনপির নেতারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী ৪২
বছর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। আওয়ামী লীগ অচিরেই মুসলিম লীগে পরিণত হবে।
ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিএনপি নানামুখী পদক্ষেপ নেয়। প্রধান বিচারপতির চাকরির বয়সসীমা
বাড়াতে সংবিধানে সংশোধন করে। ভোটার তালিকায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটারের নাম সংযোজন করে।
ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে বিএনপি চেয়ারপারসন তার পুত্রের পরামর্শে সাতজনকে ডিঙিয়ে
মঈন ইউ আহমেদকে সেনাপ্রধান করেন। মঈন ইউ আহমেদ বিএনপিকে চিরস্থায়ী ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য
করবে, এমন ভাবনা থেকেই তাকে সেনাপ্রধান করা হয়। কিন্তু এই জেনারেল বিএনপিকে এমন ধোঁকা
দেয় যে, দলটির কোমরই ভেঙে যায়।
এখনো ক্ষমতার বাইরে দীর্ঘ ১৭ বছর থাকা
দলটি সেই ভাঙা কোমর আর সোজা করতে পারেনি। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা
চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু এরকম ব্যক্তিত্ববান রাষ্ট্রপতি বিএনপির
পছন্দ নয়। বিএনপি বেছে নিল পদলেহী একান্ত অনুগত ব্যক্তিত্বহীন ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের
মতো রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক বদরুদ্দোজাকে সরিয়ে ইয়াজউদ্দিনের মতো জি হুজুর মার্কা রাষ্ট্রপতি
বানিয়ে বিএনপি খুশিতে আত্মহারা। এরকম একান্ত বাধ্যগত রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান
করে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান ক্ষমতার সুবাস পেতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়াজউদ্দিন
তাদের ধোঁকা দিলেন। বড় ধোঁকা। এই ধোঁকায় বিএনপির সাজানো বাগান তছনছ হয়ে গেল। বিএনপি
আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইয়াজউদ্দিনের মতো ব্যক্তিত্বহীনরা যে কঠিন সময়ে কোনো সাহায্য
করতে পারে না, এটা বুঝতে বিএনপি অনেক দেরি করে ফেলেছিল। বিএনপির ‘ধোঁকা’ গল্পের এখানেই
শেষ নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি
নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছিল উচ্ছ্বসিত। এ সময় ব্যাকফুটে থাকা আওয়ামী
লীগ, নির্বাচনকালীন সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দেওয়ার
প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের
দাবিতে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। সিটি নির্বাচনে বিপুল সাফল্যের পর বিএনপি কেন জাতীয়
সংসদ নির্বাচন বর্জন করল? সেই ‘ধোঁকা’। বিএনপিকে কেউ কেউ বুঝিয়েছিল, কোনোভাবেই নির্বাচনে
যাওয়া যাবে না। নির্বাচনে না গেলেই সরকারের পতন ঘটবে। একতরফা নির্বাচন দেশে-বিদেশে
গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যস। নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখে, বিএনপি আন্দোলন
শুরু করল। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুর, গান পাউডার দিয়ে গণপরিবহনে আগুন দিয়ে একটা ত্রাসের
রাজত্ব সৃষ্টি করল। জাতীয় পার্টিও মনে করল, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হবে না। এরশাদও নির্বাচন
থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। রওশন এরশাদ থাকলেন নির্বাচনের পক্ষে। ১৫৩ আসনে বিনা ভোটে
নির্বাচিত হলেন সংসদ সদস্যরা। কিন্তু সরকারের পতন হলো না। আওয়ামী লীগ দিব্যি পাঁচ বছর
দেশ পরিচালনা করল।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক
বছর পর আবার ধোঁকা খেল বিএনপি। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবরোধের ডাক দিলেন
খালেদা জিয়া। তিনি নিজেও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অবস্থান
করে তিনি ধমক দিলেন, গাড়ি পোড়ালেন, বোমাবাজি আর আগুন সন্ত্রাস করে জনজীবন বিপর্যস্ত
করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু জনগণ প্রত্যাখ্যান করল এই সহিংস রাজনীতি। একপর্যায়ে বিএনপির
সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল সাধারণ জনগণ।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতি
মামলার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল এক-এগারো সরকারের সময়। ড. ফখরুদ্দিনের সরকার ২০০৭ সালে
এই মামলা করে। বিএনপির আইনজীবীরা এই মামলা নিয়ে খালেদা জিয়াকে ধোঁকা দিলেন। বারবার
মামলার তারিখ নেন, কথায় কথায় হাইকোর্টে যান। মামলাটি বিএনপির আইনজীবীরা এমন নাজুক জায়গায়
নিয়ে যান যে, খালেদা জিয়ার শাস্তি পাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। ২০১৮ সালে মামলার
রায়ের আগে তিনি লন্ডনে গেলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে পরামর্শ
দিলেন মামলার রায় পর্যন্ত তিনি (খালেদা জিয়া) যেন লন্ডনেই অবস্থান করেন। রায়ে দণ্ড
হলে একটা সমঝোতা করে দেশে ফেরার পরামর্শ দিলেন তারা। কিন্তু ধোঁকাবাজরা খালেদা জিয়াকে
দিলেন ভুল পরামর্শ। তারা বললেন, দেশেই ফিরতে হবে। সরকার খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টাও জেলে
রাখতে পারবে না। এর মধ্যেই সরকারের পতন ঘটবে। খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করলেই নাকি জনবিস্ফোরণ
ঘটবে। খালেদা জিয়া শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথা শুনলেন না, শুনলেন ধোঁকাবাজদের কথা। দেশে ফিরলেন।
মামলার রায়ে দণ্ডিত হলেন। তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হলো টানা দুই বছর। বিএনপি
একটা টুঁ শব্দ করতে পারল না। আইনি লড়াইয়েও খালেদা জিয়া হেরে গেলেন। ধোঁকাবাজদের খপ্পরে
পরে খালেদা জিয়ার রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গেছে। এখন খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য আবেদন-নিবেদন
হচ্ছে। তার ভাই সরকারের কাছে অনুকম্পা ভিক্ষা করছেন। বিএনপির আন্দোলন বা আইনি লড়াইয়ে
নয়, সরকারের করুণায় খালেদা জিয়া এখন তার সব রাজনৈতিক অর্জন বিসর্জন দিয়ে ফিরোজায় থাকছেন।
এই ধোঁকা বিএনপিকে কোমায় নিয়ে গেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে ধোঁকা
খেয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৮ সালে ধোঁকা খায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে
অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি কোনো শর্ত ছাড়াই। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিও
বিএনপি নেতারা উচ্চারণ করেননি সরকারের সঙ্গে সংলাপে। ওই নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে লাথি দিয়ে বিদায় করে সারা
জীবন ‘বঙ্গবন্ধু’র আদর্শে বিশ্বাসী ড. কামাল হোসেনকে নেতা মানে বিএনপি। ড. কামাল হোসেনের
নেতৃত্বে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে। ওই নির্বাচনে মাত্র ছয় আসন পেয়ে লজ্জায়
ডুবে যায় দলটি। বিএনপি নেতারাই বলেন, এটা ছিল স্রেফ ধোঁকা। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায়
আনতে সাজানো নাটকে বিএনপিকে বলির পাঁঠা করা হয়েছিল, এমন কথা বিএনপি নেতারাই প্রকাশ্যে
বলেন। ড. কামাল হোসেন বিএনপিকে কীভাবে ধোঁকা দিল এ গল্প করে বিএনপি নেতারাই লজ্জায়
মুখ লুকান।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর বিএনপি ‘তওবা’ করে। দলীয় সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২০২১ সালের শেষ থেকে শুরু করে আবার আন্দোলন। এবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির প্রতি সহানুভূতি দেখায়। আস্তে আস্তে পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক গাঢ় হয়। বিএনপি নেতারা সকাল-সন্ধ্যা কূটনীতিকপাড়ায় ঘোরাঘুরি করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রাতরাশ সারেন, নৈশভোজে যান ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোনো দূতের বাসায়। বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে না। একতরফা নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবে না ইত্যাদি নানা আতঙ্ক বাণী চারদিকে উচ্চারিত হতে থাকে। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা, স্যাংশন ইত্যাদি নিয়ে চলে তুলকালাম তর্কবিতর্ক। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। অতি আত্মবিশ্বাসে ২৮ অক্টোবর সহিংস হয়ে ওঠে তারা। তারপর নির্বাচন। আবার ধোঁকা খায় বিএনপি। বিএনপি মনে করেছিল, একতরফা নির্বাচন করলেই মার্কিন অ্যাকশন শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞা আসবে। কিন্তু কোথায় নিষেধাজ্ঞা। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশ অভিনন্দন বাণীতে ভরিয়ে তুলল নতুন সরকারকে। একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ জানাল বিশ্বের প্রায় সব প্রভাবশালী দেশ। বিএনপি ধোঁকা খেল আবারও। এবার ধোঁকায় একেবারে গর্তে পড়ে গেছে দলটি। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বারবার কেন ধোঁকা খায় বিএনপি? এর কারণ একটাই, আদর্শহীন রাজনীতি এবং যে কোনো ধরনের ক্ষমতায় যাওয়ার উদগ্র বাসনা। বিএনপিতে যদি ন্যূনতম আদর্শ চর্চা থাকত, তাহলে এভাবে বারবার প্রতারিত হতো না। ভুল মানুষের হাত ধরে ভুল পথে পা বাড়াত না। আদর্শহীন রাজনীতির পরিণতির উদাহরণ বিএনপি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রম আদালত হাইকোর্ট
মন্তব্য করুন
বিএনপি নেতা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনকে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছিল, তখন কে জানত তার বিএনএম কাহিনি। কে জানত তিনি বিএনপি ছেড়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হতে যাচ্ছিলেন। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট তারকাকেও তিনি বিএনএমে ভিড়িয়েছিলেন। এখন মেজর (অব.) হাফিজ অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর পরও একটি কথা সত্যি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) তার যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া হয়েছিল। এই প্রক্রিয়া বহু দূরে এগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠার পর এখন সবচেয়ে সুসময় কাটাচ্ছে। টানা ১৫ বছরের বেশী সময় ক্ষমতায়। বাঁধাহীন ভাবে চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি। মাঠে আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার মতো কোন রাজনৈতিক শক্তি নেই। সংসদেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ। কোথাও আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কেউ নেই। আওয়ামী লীগের কোন চাপ নেই, নেই উৎকণ্ঠা। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দলটি আরো নির্ভার। কিন্তু এই সুসময়ে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে একটু ভয়ও হয়। এই আওয়ামী লীগ কি সেই আওয়ামী লীগ?
আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের সাথী তারা। ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। কঠিন সময়ে লড়াকু ভূমিকা পালন করেছেন। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কখনও পিছপা হতে দেখা যায়নি। আদর্শের প্রশ্নে তারা কখনও আপস করেননি। কিন্তু তারপরেও আওয়ামী লীগে অনাহূত। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তারা জায়গা পান না, এমপি হতে পারেন না। মন্ত্রিসভা তো অনেক দূরের কথা। অথচ তাদের চেয়ে কম উজ্জ্বল নেতারা এখন মন্ত্রী হয়েছেন, এমপি হয়েছেন। দলে এবং সরকারে প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাদের কি অপরাধ কেউ জানে না। অথচ কর্মীদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে। আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়েই তারা থাকতে চান এবং আওয়ামী লীগের পরিচয় নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন। হৃদয়ে ক্ষোভ হতাশা থাকলেও মুখে তাদের হাসি থাকে। তারা তাদের দুঃখ হতাশার কথা কাউকে বলেন না।