গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। কিন্তু এ নির্বাচনে হেরেও জিতেছে ক্ষমতাসীন দলটি। এ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আওয়ামী লীগ একদিকে যেমন উৎসব করতে পারে, ঠিক তেমনি এ নির্বাচন আগামী নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে সতর্কবার্তা দিল। গত ২৫ মে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে দলটি। এ আন্দোলনের কৌশল হিসেবে সব নির্বাচন থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখছে বিএনপি। আগে বিএনপির জনপ্রিয় নেতারা স্থানীয় প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার স্বার্থে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থী হতেন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সে ব্যাপারেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বিএনপি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদেরও আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল খুবই সোজাসাপ্টা। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, বিএনপি ভোট বর্জন করলেই নির্বাচন নিরুত্তাপ হবে। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। ফলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপির কৌশল কাজে লেগেছে। চট্টগ্রামের একটি উপনির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৪ শতাংশের মতো। বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়—এটি প্রমাণের জন্যই বিএনপি ভোট থেকে দূরে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বলছে, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। যুক্তরাষ্ট্র ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তারা বিএনপির ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের দাবিকে সমর্থন জানায়নি। কিন্তু আকারে ইঙ্গিতে তারা বুঝিয়ে দিয়েছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্তপূরণের জন্য প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ জরুরি। বিএনপি কূটনীতিকদের বোঝাতে চাইছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় উত্তাপহীন, জনগণ সেই নির্বাচনে অংশ নেয় না, প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দল মিলে নির্বাচনের নামে প্রহসন করে। জাতীয় নির্বাচনের আগে এরকম উত্তেজনাহীন নির্বাচন যত হবে, তত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জোরালো হবে। কিন্তু গাজীপুরে বিএনপির কৌশল ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ, উৎসবমুখর, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যে করা যায়, গাজীপুর তার প্রমাণ। এটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তির। এর ফলে বিএনপি ছাড়াই আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পথে এগোতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি গত এক বছর ধরেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বারবার বলছেন, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। যুক্তরাজ্যের মতো নির্বাচন হবে বাংলাদেশে—এমন বক্তব্য তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন। শেখ হাসিনা এটিও বলেছেন, জনগণ ভোট দিলে সরকার গঠন করব। আর ভোট না দিলে ক্ষমতা ছেড়ে দেব। এটি যে কথার কথা নয়, গাজীপুর সিটি নির্বাচন তার প্রমাণ। এ নির্বাচনে পর্দার আড়ালে অনেক নাটক হয়েছে। অতি উৎসাহীরা নানাভাবে প্রশাসন দিয়ে নির্বাচন প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। কেউ কেউ জোর করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জিতিয়ে দেওয়ার ফর্মুলা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা অর্বাচীনদের এ প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো নেতাকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সতর্ক করে দিয়েছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কারচুপির চেষ্টা করলে তিনি কাউকে ছাড়বেন না। ফলে গাজীপুর নির্বাচনে কোনো কেলেঙ্কারি হয়নি। শেখ হাসিনা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ দেননি। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ধারায় যদি বাকি চারটি নির্বাচন হয়, তাহলে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি মুখ থুবড়ে পড়বে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব বলা যৌক্তিক হবে। গাজীপুর নির্বাচন প্রমাণ করেছে, একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের একমাত্র ফ্যাক্টর বিএনপির অংশগ্রহণ নয়। বিএনপি ছাড়াও যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব, গাজীপুর তার বিজ্ঞাপন। জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য বিশাল স্বস্তির। এ নির্বাচনের আগের দিনই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় সৃষ্টিকারীদের যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়। এরকম সতর্কবার্তার পর প্রথম পরীক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকার খুব ভালোমতোই পাস করেছে। নির্বাচন নিয়ে চাপ বিএনপির কাঁধে তুলে দিতে গাজীপুর নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাই প্রার্থীর জয়-পরাজয়ের চেয়ে এ নির্বাচন সরকারের জন্য একটি বড় বিজয়। গাজীপুর হেরেও জিতেছে আওয়ামী লীগ।
গাজীপুরের নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা বাড়াবে। কিন্তু নানা কারণে এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তির। এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সতর্কবার্তা। গাজীপুর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অন্তর্কলহ এবং বিভক্তির ভয়ংকর রূপ প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী লীগই যে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ, তা প্রমাণ হয়েছে গাজীপুরে। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ এবার মনোনয়ন দেয় দলের প্রবীণ নেতা আজমত উল্লাকে। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর গাজীপুরে জনপ্রিয়। আওয়ামী লীগের তরুণরা তাকে পছন্দ করে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ জনগণের মধ্যে জাহাঙ্গীরের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। মনোনয়নের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মনোনয়ন বোর্ডের সভায় এ বাস্তবতাগুলো উঠে আসেনি। জনমতের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলমকে ‘কোণঠাসা’ করতে গিয়ে প্রভাবশালী নেতারা আওয়ামী লীগকে ঝুঁকিতে ফেলেছেন। আজমত উল্লাকে মনোনয়ন আরও সুন্দর এবং শালীনভাবে দেওয়া যেত। যেমনটি করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে। সেখানে আওয়ামী লীগের দুই প্রতিপক্ষ নেতাকে গণভবনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুজনের সঙ্গে কথা বলে একটি সমঝোতা করে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। গাজীপুরে তেমনটি করা হলো না কেন? ২০১৪ সাল থেকে আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে অহংকার এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে গেছে। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ মনে করেন, দল যাকে ইচ্ছা মনোনয়ন দেবে। প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে প্রভাব খাটিয়ে জিতিয়ে আনবে। গাজীপুরেও সেই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। রাজনীতি হুমকি, ধমকের বিষয় নয়। একটি সমঝোতার কৌশল। এ চিরন্তন সত্যটা আওয়ামী লীগ ভুলেই গিয়েছিল। জাহাঙ্গীর এবং তার মা যখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন, তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ‘দমন নীতি’ কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। ভয় দেখিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে রাজনীতিতে জয়ী হওয়া যায় না। জাহাঙ্গীরের (এবং তার মা) বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ভুল কৌশল প্রয়োগ করেছেন। ভোটের আগে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা, দুদকে তলব, তার কর্মীদের ওপর পেশিশক্তি প্রয়োগ—সবই জনগণের মধ্যে জায়েদা খাতুনের পক্ষে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের তরুণ কর্মীরা এটা পছন্দ করেননি। ভোটের দিন দেখা গেছে, নৌকার কার্ড গলায় ঝুলিয়ে তারা ঘড়ি মার্কায় ভোট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে সব নেতাই প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং তার পরামর্শকরা গাজীপুরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তার ফলও ভালো হয়নি। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা কারও ক্রীতদাস নয়। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর তার মাকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গেছেন। কান্নাকাটি করেছেন। ভোটারদের সহানুভূতি আদায় করেছেন। যেটি আওয়ামী লীগের আদি নির্বাচন কৌশল। ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য আজমত উল্লা ভোটার নয়, নানা শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরের সমর্থদের গ্রেপ্তার, কাউকে কাউকে হুমকি দিতেও শোনা গেছে। জাহাঙ্গীরের সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে যেতে দেওয়া হবে না। এমন পরিকল্পনার নিপুণ বাস্তবায়নে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন ঢাকা থেকে আসা কিছু নেতা। তারা বিশ্বাসও করেননি, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন এরকম অভাবনীয় নিরপেক্ষ হবে। ভোটের স্বাভাবিক সহজ কৌশলকে আওয়ামী লীগ পাত্তা দেয়নি। অন্যদিকে জাহাঙ্গীর বুঝিয়ে দিয়েছেন, নির্বাচনের অঙ্ক তিনি ভালোই বোঝেন। জাহাঙ্গীর তার মায়ের পক্ষে আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটকে একাট্টা করেছেন। নীরব সমর্থদের সংগঠিত করেছেন। নিরপেক্ষ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পেরেছেন। গাজীপুরের নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল। নির্বাচন কমিশন অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু উজাড় করে কাজ করেছে। ফলে গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপর্যয় হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গাজীপুর থেকে আওয়ামী লীগ কি শিক্ষা নেবে? ২৫ মের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো প্রার্থী বাছাই। প্রার্থী যদি যথাযথ না হয়, জনপ্রিয় না হয়, তাহলে ভরাডুবি অনিবার্য। জাতীয় নির্বাচনের বাকি ছয় মাস। এখনো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে সময় আছে। এখন যারা জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্য, দলের বাইরে সাধারণ জনগণের সঙ্গে যারা সম্পর্কহীন, তাদের বাদ দেওয়ার এখনই সময়। গাজীপুর শেখাল, জনবিচ্ছিন্ন, বিতর্কিত প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। এ নির্বাচনের দ্বিতীয় শিক্ষা হলো—তৃণমূলের শক্তিতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলটিকে প্রশাসননির্ভরতা কমাতে হবে। আগামী ভোটে প্রশাসন আর পুলিশ দিয়ে পার করা যাবে না। জনগণের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে যেতে হবে। ভোটাররাই রাজনৈতিক দলের আসল শক্তি। নতুন মার্কিন নীতিমালার পর অতি আওয়ামী লীগার হয়ে ওঠা প্রশাসনের লোকজন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে কোনো ঝুঁকি নেবেন না, তার অনুধাবন করতে হবে দলের প্রার্থীদের। এ উপলব্ধি যত দ্রুত হয়, ততই তাদের জন্য মঙ্গল।
২০০৮-এর নির্বাচনের পর বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটার হয়েছেন। এমন প্রার্থী দিতে হবে যাতে তরুণরা আকৃষ্ট হন। ভোট একটি রাজনৈতিক বিজ্ঞান। এখানে গণিত গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের হিসাব ঠিকঠাক মতো করেই প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে আওয়ামী লীগকে।
আগামী নির্বাচন হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর শেষ নির্বাচন। একটি অসাধারণ, অনবদ্য এবং অনন্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে তিনি কোনো আপস করবেন না। একবিন্দুও ছাড় দেবেন না। গাজীপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি সেটি ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা চাটুকার, সুবিধাভোগী, মতলববাজরা কি সেই বার্তাটা পেয়েছেন? না পেয়ে থাকলে সামনে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মন্তব্য করুন
তৃণমূল বিএনপি নির্বাচন বিএনপি বিএনপি থেকে বহিস্কৃত সরকার শওকত মাহমুদ
মন্তব্য করুন
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ দেখতে চায় বিএনপি। আর এ লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং এক রকমের প্রচ্ছন্ন চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো চাপ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংহত থাকুক, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকশিত হোক। কারণ গণতন্ত্র হলো উন্নয়ন এবং উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি অর্থবহ ও অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।
কিন্তু এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রধান বাধা হলো- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, দুটি রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিরোধী অবস্থান। বিএনপি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই দাবিতে তারা এক দফা আন্দোলন করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নাই। সংবিধান সম্মতভাবেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি মনে করছে,দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে ভোট অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ হবে না। এখন এরকম একটি অচল অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর এই সংকট কাটিয়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন মহলের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দুইটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কাজ করছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেবে না এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাও গ্রহণ করবে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সংলাপ এবং সমঝোতাকে সমর্থন করে। তবে মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক না কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন মহলের সঙ্গে একটি অর্থবহ নির্বাচন কিভাবে করা যায়- তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। আর এই সমস্ত আলাপ-আলোচনায় বেশ কিছু সম্ভাব্য প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক নিয়েও তারা কথাবার্তা বলছেন।
সুশীল সমাজের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কূটনৈতিকরা একাধিক বৈঠক করেছেন। সংবিধান কাঠামোর মধ্যে কিভাবে একটি অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়- সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। বিএনপির সঙ্গেও তারা রাজনৈতিক সমঝোতার পথ নিয়ে কথা বলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ‘আওমীলীগ কতটুকু পর্যন্ত ছাড় দেবে’-তা নিয়েও কথা বলছে। এই সবকিছু মিলিয়ে তারা একটি অর্থবহ নির্বাচনের পথ খুঁজছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন শেখ হাসিনা- এই দাবি থেকে তারা সরে আসবে না। অন্যদিকে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক বা যেটাই হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করলেও কোনো আপত্তি নেই। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করা যায় কিনা, সেই সম্ভব্যতা যাচাই করছেন- এ নিয়ে সুশীল সমাজের অন্তত দুইজন প্রতিনিধি মার্কিন দূতাবাসের সাথে কথাও বলেছেন বলে জানা গেছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি দশ সদস্যের নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলীর কথা বলেছেন, যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে একদম নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা থাকবেন; যারা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেবেন এবং এই পরামর্শের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন পরিচালনা করবেন।
তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে। উপদেষ্টারা কার্যত প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারবে না। তাই এই প্রস্তাবে তারা রাজি নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সুশীল সমাজের কয়েকজন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায় কিনা, তার সাংবিধানিক বিধি-বিধানগুলো খুঁজে দেখছে। তবে বিএনপির এটিতেও সায় নাই। বিএনপি মনে করে, বর্তমান রাষ্ট্রপতিও নিরপেক্ষ নয়।
আর এরকম পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে বলছে, তারা (পশ্চিমা দেশগুলো) নির্বাচনের পুরো বিষয়টি তদারকি করবে এবং নির্বাচনে কোনো রকম কারচুপি, জালিয়াতি ইত্যাদি হলে সেটি তারা প্রতিহত করবে। আর এরকম ঘটনা ঘটলে নির্বাচনকেও স্বীকৃতি দেবে না।
এরকম একটি প্রস্তাবনা নিয়ে তারা (পশ্চিমা দেশগুলো) বিএনপিকে নির্বাচনে রাজি করানোর চেষ্টা করছে। এখন দেখার বিষয়, এই প্রস্তাবে বিএনপি সায় দেয় কিনা।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
মির্জা
আজম। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। ছয়বারের এমপি। জীবনে কোনো সংসদ নির্বাচনে
পরাজিত হননি। ১৯৯১ ও ২০০১
সালে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও
তিনি জয়ী হয়েছেন। জামালপুরে
দলমত নির্বিশেষে তিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন
করেছেন। সেই জামালপুরে গত
১১ সেপ্টেম্বর ঘটল এক কাণ্ড।
সেখানকার জেলা প্রশাসক (ডিসি)
মো. ইমরান আহমেদ, প্রশাসনের মাঠ কর্মকর্তা থেকে
আওয়ামী লীগের নেতা বনে গেলেন।
আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনার
জন্য তিনি জনগণের কাছে
উদাত্ত আহ্বান জানালেন। জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভায় নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি
এ চাঞ্চল্যকর বক্তব্য রাখেন। ডিসি শুধু এ
সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনার
অঙ্গীকারই করেননি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগামী সরকারও গঠন করে ফেলেছেন।
ওই সরকারে মির্জা আজমকে মন্ত্রীও বানিয়ে ফেলেছেন। মো. ইমরান বলেছেন,
‘আমি আশা করি, সামনের
নির্বাচনের পর আমাদের সম্মানিত
প্রধান অতিথি (মির্জা আজম) অবশ্যই একজন
মন্ত্রী হিসেবে এ জেলায় আরও
ব্যাপক উন্নয়ন করবেন। এটা আমি আশা
করি এবং বিশ্বাস করি,
এটা হবে ইনশাআল্লাহ।’ মির্জা
আজমকে জেতানোর জন্য কোনো আমলার
দরকার নেই। কোনো কারসাজি
করারও প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের
নির্বাচনের আগেও আমলাদের এমন
চেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে দেশে
যে-কটি আসনে ভোটাররা
দিনভর ভোট দিয়েছে, তার
মধ্যে মির্জা আজমের আসন একটি। তাহলে
এবার কেন? এ জনপ্রিয়
নেতাকে বিতর্কিত করার জন্যই কি
এ আয়োজন। জামালপুরের এ জেলা প্রশাসকই
এরকম কদর্য চাটুকারিতায় ভরপুর বক্তব্য রাখেননি। কিছুদিন ধরেই মাঠ প্রশাসনে
এবং পুলিশে এ ব্যাধিটি ছড়িয়ে
পড়েছে। কদিন আগে অর্থমন্ত্রীর
নির্বাচনী এলাকা, লাঙ্গলকোটের ওসি ফারুক হোসেন
আগামী নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম
মুস্তফা কামালকে ‘আবার নির্বাচিত করার
জন্য মিনতি করেন’। অথচ
অসুস্থ অর্থমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না, তারই
ঠিক নেই। গত ১৫
আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই
অনুষ্ঠানে দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি
শ্যামল চন্দ্র ধর বর্তমান সরকারকে
ফের নির্বাচিত করতে ভোট চান।
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে,
ততই ডিসি, এসপি, ওসি, ইউএনওদের নির্বাচন
নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য আলগা প্রেম
বাড়ছে। শুধু মাঠ প্রশাসন
নয়, বড় আমলারাও আওয়ামী
লীগের জন্য গদগদ হয়ে
উঠছেন। কোনো কোনো অতিউৎসাহী
আমলা এখন শেখ হাসিনার
চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার
হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও এসব সরকারি কর্মকর্তা
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতানোর ফর্মুলা আবিষ্কারে ব্যস্ত। এসব সরকারি কর্মকর্তা
এবং কর্মচারী কি আসলে আওয়ামী
লীগের উপকার করছেন না ক্ষতি করছেন?
নির্বাচনে জয়ী হতে কি
আওয়ামী লীগের আমলাদের দরকার? নাকি এসব আমলা
মতলববাজ। নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য তারা আওয়ামী
লীগকে বিতর্কিত করছে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি
করছে। এসব ঘটনার ফলে,
আওয়ামী লীগের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।
অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে
হবে তা নিয়ে জাতীয়
এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলছে নানা বিতর্ক।
বিএনপি বলছে, এ সরকারের অধীনে
অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্ভব নয়। বিএনপি মহাসচিব
একাধিক বক্তৃতায় অভিযোগ করেছেন, সরকার তার পক্ষের লোকজন
দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে। সুশীল সমাজ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা
হচ্ছে, নির্বাচনে যদি প্রশাসন হস্তক্ষেপ
করে তাহলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য
হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আগামী
নির্বাচন সামনে রেখে ভিসা নিষেধাজ্ঞার
হুমকি দিয়ে রেখেছে। এর
বিপরীতে সরকার বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ
থাকবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশ-বিদেশে
সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। আগামী নির্বাচন কেমন হয় সেদিকে
চোখ সবার। এরকম পরিস্থিতিতে এসব
অতিউৎসাহীদের বাচালতা গোটা নির্বাচনকেই অনিশ্চিত
করে তুলবে। সরকার যতই বলুক, নিরপেক্ষ
নির্বাচন হবে, এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন
কর্মকর্তাদের কারণে তা কারও কাছেই
বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। যারা এসব
চাটুকারিতা করছে, তারা গণতন্ত্রকেই আসলে
সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমি মনে করি প্রশাসনে
অতি রাজনীতিকরণ এবং দলীয়করণের কারণেই
বড় আমলা থেকে শুরু
করে মাঠ প্রশাসন তাদের
নিরপেক্ষতা এবং যোগ্যতা হারাচ্ছে।
এ প্রবণতা দীর্ঘদিনের। এখন প্রশাসনের দলীয়করণের
বিষয়টি ‘জায়েজ’ হয়ে গেছে। এখন
প্রশাসনে পদোন্নতি কিংবা পদায়ন করা হয় রাজনৈতিক
পরিচয় দেখে। মেধা এবং যোগ্যতার
ভিত্তিতে পদোন্নতির চর্চা নেই বললেই চলে।
একজন উপসচিব জানেন, তিনি ‘আওয়ামী লীগ’ এ পরিচয়
সামনে এলে তার পদোন্নতি
হবে। যুগ্ম সচিব মনে করছেন
যত চাটুকারিতা করবেন, সরকারের স্তুতি করবেন, তত দ্রুত তার
পদোন্নতির দরজা খুলে যাবে।
সচিব হতে গেলে এখন
দক্ষতা লাগে না, তার
কাজের মান কিংবা নেতৃত্বের
যোগ্যতা যাচাই করা হয় না।
দেখা হয় তিনি সরকারের
কতটা আপনজন। তাই প্রশাসনের সব
পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ার এক বীভৎস প্রতিযোগিতা
শুরু হয়েছে। রাজাকার পরিবারের সন্তানও এখন নিজেকে ছাত্রলীগের
কর্মী পরিচয় দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে
ছাত্রদল কিংবা শিবির করে এখন আওয়ামী
লীগে রূপান্তরিত হওয়া আমলার সংখ্যা
কম নয়। যে যেভাবে
পারছে নিজেকে অতি বড় আওয়ামী
লীগার প্রমাণে ব্যস্ত। কেউ কবিতা লিখছেন,
কেউ আওয়ামী নেতাদের চেয়েও জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। যারা প্রশাসনে সত্যিকারের
আওয়ামী পরিবার থেকে এসেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, তারাই এখন এসব নব্য
আওয়ামী লীগের দাপটে কোণঠাসা। এসব নব্য আওয়ামী
লীগার প্রশাসনে একটি সিন্ডিকেট করেছে।
এ সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ সচিব হয়
না, কারও ভালো পোস্টিং
হয় না। তাদের ভাবসাব,
কথাবার্তায় মনে হয়, শেখ
হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, তারাই আবার
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে নির্লজ্জ চাটুকারদের প্রভাব পড়েছে মাঠপর্যায়ে। আরেকবার ক্ষমতায় এলেই আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রক্ষমতা
দখলে ষোলোকলা পূর্ণ হবে। ২০১৮ সালের
নির্বাচনে এ আমলারাই পরিকল্পিত
ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ
করে। এর মাধ্যমে তারা
ক্ষমতাকেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অধিকাংশ
মন্ত্রণালয়ে সচিবরা মন্ত্রীদের পাত্তাই দেন না। মাঠে
ডিসি, ইউএনওরা জনপ্রতিনিধিদের কথাই শোনেন না।
কদিন আগে আওয়ামী লীগের
একজন নেতা বলছিলেন, ‘মাঠে
এখন আওয়ামী লীগ নেই। আমলা
লীগ আছে।’ কিছু কিছু আমলা
মুখে আওয়ামী লীগের কথা বলে আসলে
আওয়ামী লীগকেই বিকলাঙ্গ করছে। এরা শুধু সরকারের
জন্য নয়, আওয়ামী লীগের
জন্যও বিপজ্জনক। এরা এখন আওয়ামী
লীগকে জয়ী করার কথা
বলছে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য।
আগামী নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত
আওয়ামী লীগ জয়ী হয়
তাহলে তারা বলবে ‘আহ,
কী ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগের
প্রার্থীকে জেতালাম। আমি না থাকলে
তো এবার আওয়ামী লীগের
প্রার্থীর ভরাডুবি নিশ্চিত।’ ব্যস, দ্রুত গতিতে তার পদোন্নতির অভিযাত্রা
শুরু হবে। লাগামহীন দুর্নীতির
লাইসেন্স পাবে। ওই আমলার ভাগ্যের
চাকা খুলে যাবে। সাধারণ
জনগণ বলবে, এমপির কোনো দাম নেই।
সব ক্ষমতার মালিক আমলাই। আর যদি কোনো
কারণে ভোটে আওয়ামী লীগের
প্রার্থীর বিপর্যয় হয়, প্রার্থী হেরে
যায়, তখন ওই মাঠ
কর্মকর্তা দুরকম অবস্থান গ্রহণ করবেন। প্রথম অবস্থান, যদি আওয়ামী লীগ
জয়ী হয় এবং ওই
প্রার্থী হেরে যায়। তখন
মাঠ আমলা বলবে, কী
যে পরিশ্রম করলাম। আমি চেষ্টা করেছি
বলেই এ ভোট পেয়েছে।
না হলে তো জামানত
বাজেয়াপ্ত হতো। আর ওই
প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ
উভয়ই হারে, তখন গিরগিটির মতো
মুহূর্তে তিনি রূপ বদল
করবেন। বলবেন, আসলে আমিই তো
আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়েছি। গোপনে গোপনে আমি তার সর্বনাশ
করেছি। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তার
লাভ এবং লাভ। নির্বাচনের
তপশিল ঘোষণার আগেই যেসব সরকারি
কর্মকর্তা ভোট চেয়ে চাটুকারিতার
অরুচিকর প্রদর্শনী করলেন, সরকারকে বিব্রত করলেন, তাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু
নেই। তাদের শুধু প্রত্যাহার করা
হয়েছে। জামালপুরের ডিসি প্রবাসী কল্যাণ
মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। ওসিদেরও
শাস্তি হলো প্রত্যাহার। তারা
অচিরেই ‘নির্যাতিত’ পরিচয়ে ভূষিত হবেন। আওয়ামী লীগের জন্য তাদের জীবন
উৎসর্গের কাহিনি তারা বলে বেড়াবেন
প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে। কদিন পর আবার
তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং
হবে। আওয়ামী লীগের সৈনিক হিসেবে তারা বুক ফুলিয়ে
ঘুরে বেড়াবেন। এ অবস্থা বন্ধ
করা দরকার এখনই। যোগ্য এবং পেশাদার কর্মকর্তারাই
আসলে সরকার এবং দেশের জন্য
মঙ্গলকর। অযোগ্য চাটুকাররা শুধু নিজেদের স্বার্থ
খোঁজে। সরকার এবং দেশের কোনো
কাজে তারা যাবে না।
সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন
সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারেন না। এটা শাস্তিযোগ্য
অপরাধ। তাই নির্মোহভাবে তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যাহার
কোনো শাস্তি নয়। সরকারকে মনে
রাখতে হবে, আমলারা কোনোদিন
কারও হয় না। বঙ্গবন্ধুর
পায়ের কাছে বসে থাকা
আমলা খুনি মোশতাকের শপথ
পাঠ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। জিয়াকে খুশি করতে যে
আমলা স্যুট-প্যান্ট ছেড়ে সাফারি এবং
সানগ্লাস পরা শুরু করেন,
এটাই জাতীয় পোশাক হওয়া উচিত বলে
বক্তৃতা দেন, সেই আমলাই
এরশাদের রাজকবি সভাই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য
হয়েছিলেন। এরশাদের সঙ্গে আমৃত্যু থাকার অঙ্গীকার করা আমলা স্বৈরাচারের
পতনের পর বিএনপির টিকিটে
এমপি হতে সময় নেননি।
এখন যারা আমলাতন্ত্রে আওয়ামী
সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, দুঃসময়ে
তারা হয় পালাবেন অথবা
ভোল পাল্টাবেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে অনেক কঠিন কাজ
করা যায়। আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব
প্রতিষ্ঠার কাজটি কঠিন, কিন্তু জরুরি। আওয়ামী লীগই পারে যোগ্যতা
এবং মেধার ভিত্তিতে আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। এতে সিংহভাগ সরকারি
কর্মচারী খুশি হবেন। সরকার
গুটিকয়েক সুবিধাবাদী চাটুকার আমলাদের হাতে জিম্মি থাকবে
না। মেধাবী, স্মার্ট আমলাতন্ত্র গড়তে—এ সিদ্ধান্ত
নিতে হবে এখনই। তার
জন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে চাকরি শৃঙ্খলা
বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আমলাদের আওয়ামী লীগে রূপান্তর বন্ধ
করা।
লেখক
: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল :
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
আমি জ্যোতিষী নই। ভবিষ্যৎ গণনা আমার কাজ না। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে কি ঘটতে পারে কোন জ্যোতিষীর পক্ষেও এখন বলা সম্ভব কিনা আমার সন্দেহ । হয়তো তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আগামী দিনের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের একটি ধারণা পাওয়া যেতেই পারে। ১০০ দিনের মধ্যে দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এ ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন আগামী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু দেশে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, তা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে কি বিএনপি অংশ নেবে? বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করা কি আদৌ সম্ভব হবে? সেরকম একটি নির্বাচন কি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পাবে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে। অফিসে, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে, চায়ের আড্ডায়, হাটে-বাজারে এসব নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। অজানা এক গন্তব্যে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের ব্যাপারে পাঁচটি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনোরকম সমঝোতায় পৌঁছতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন। সেখানে তারা বিভিন্ন মার্কিন কূটনৈতিক কর্মকর্তার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলেট এর সাথে গত মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়াও পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সাথেও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বৈঠক করেছেন। উজরা জেয়ার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি থেকে একঝাঁক নেতা তৃণমূল বিএনপিতে যাচ্ছে—এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপির ভিতর। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতারা নন, বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী নেতারা এমনকি বিভাগীয় জেলা পর্যায়ের নেতারাও তৃণমূল বিএনপিতে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির মধ্যে যে সমস্ত নেতারা এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন তাদের একটি বিরাট অংশ তৃণমূল বিএনপিতে যেতে পারেন বলে অনেকে ধারণা করছেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ দেখতে চায় বিএনপি। আর এ লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং এক রকমের প্রচ্ছন্ন চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো চাপ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংহত থাকুক, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকশিত হোক। কারণ গণতন্ত্র হলো উন্নয়ন এবং উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি অর্থবহ ও অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।