এডিটর’স মাইন্ড

একজন আত্মস্বীকৃত খুনি এবং মার্কিন ভিসানীতি

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ০৩ জুন, ২০২৩


Thumbnail

রাশেদ চৌধুরী। আত্মস্বীকৃত খুনি। বীভৎস হত্যাকারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে কিছু ঘৃণ্য ব্যক্তি।

ইতিহাসের এ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ছিল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। আর এ নিকৃষ্টতম কাণ্ডটি যারা সরাসরি ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম রাশেদ চৌধুরী। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাক হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়েছিল। মোশতাকের অবৈধ সরকার জারি করেছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ।

সেনা অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলার মুখে ’৭৫ -এর ৩ নভেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হয় মোশতাক। ক্যু এবং পাল্টা ক্যু-এর ধারায় ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। জিয়া ছিলেন ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুশীলব। তাই ক্ষমতা দখল করে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বহাল রাখেন।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের বিশেষ বিমানে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। ক্ষমতায় থিতু হয়ে জিয়া খুনিদের কূটনৈতিক চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন। এটি ইতিহাসের আরেক ভয়াবহ অধ্যায়। জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন এরশাদ। তিনিও জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনিদের দুধে-ভাতে রাখেন।

যারা কূটনৈতিক চাকরি করত তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এরশাদের পতনের পরও খুনিদের গায়ে আঁচড় লাগেনি। ’৯১-এ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দেশে প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি জয়ী হয় সেই নির্বাচনে। ’৯১-এর সংসদে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একমত হয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে বিএনপি রাজি হয় না। ’৭৫-এর ঘাতকদের বিচারের পথ রুদ্ধই থেকে যায়। বেগম জিয়া খুনিদের আরেক দফা পদোন্নতি দেন। এ সময় খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ব্রাজিলে বদলি করা হয়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। রাশেদ চৌধুরী এ সময় ব্রাজিল থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয় যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পাহারাদার। তাদের হাতেই যেন দায়িত্ব বিশ্ব মানবাধিকার রক্ষার। বিশ্বে কোনো দেশে গণতন্ত্রের ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে দেখে দেশটি। গণতন্ত্র মেরামত না করলে কানমলা দিয়ে দেয় অথবা কঠোর শিক্ষকের মতো ক্লাস থেকে বের করে দেয়। মানবাধিকারের একটু বিচ্যুতিও মার্কিন কর্তাদের নজর এড়ায় না। নানা স্যাংশন দিয়ে শাস্তি দেয়। মাঝেমধ্যে ভাবি, আহা। যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে কী হতো বিশ্বের গণতন্ত্রের, কী হতো মানবাধিকারের। এরকম মানবাধিকার রক্ষকের দেশে ঢুকে পড়ল পৃথিবীর ইতিহাসের নিকৃষ্টতম খুনি। যে কি না নিজেই তার পৈশাচিকতার কথা বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ায়। অনেকেই আহলাদে আটখানা হয়ে গেল। পালাবি কোথায়? যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কী না পরিশ্রম করে। কত না ডলার ব্যয় করে। তাদের দেশে গেছে এরকম নৃশংসতম আত্মস্বীকৃত খুনি! ব্যাটার তো আর বাঁচার পথ নেই। আমরা নিশ্চিত হলাম রাশেদ চৌধুরীর আর রক্ষা নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলাম, কখন খবর পাব তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাশেদকে গুয়ানতানামো বে কারাগারে পাঠানো হয়েছে নাকি অন্য কোথাও। কিন্তু কী আশ্চর্য আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পেল। বহাল তবিয়তে যুক্তরাষ্ট্রের এখানে-সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়ায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন বিল ক্লিনটন। যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আত্মস্বীকৃত খুনিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করেন। ক্লিনটন বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে না করে শেখ হাসিনা প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেন। চলে দীর্ঘ আইনি লড়াই। এ সময় কয়েকজন খুনিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়। কিন্তু রশীদ, ডালিম, নূর চৌধুরীসহ কয়েকজন পলাতক। এদের মধ্যে মানবাধিকারের ঠিকাদার রাষ্ট্রের কোলে বসেছিল খুনি রাশেদ চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া চলে দীর্ঘদিন। অন্যদিকে চলে বিদেশে পলাতক আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কূটনৈতিক উদ্যোগ। সে সময় আবুল হাসান চৌধুরী ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনিও মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। পরবর্তীতে একটি দৈনিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে আছে ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘তারা (অভিযুক্তরা) এ দেশে থাকুক তা আমি দেখতে চাই না। ’ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সিরাজুল হক ছিলেন আশাবাদী মানুষ। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রচলিত আইনে বিচার হলে বিদেশে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না। খুনিদের ফেরত আনা সহজ হবে। ’ কিন্তু ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত রাশেদ চৌধুরী বহাল তবিয়তেই ছিল মার্কিন মুল্লুকে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ হন আইনমন্ত্রী। তিনি তার নিজের লেখা গ্রন্থেই (কারাগারে কেমন ছিলাম, পৃষ্ঠা-১৪১) স্বীকার করেছেন, তার সরকার সর্বোচ্চ আদালতে এ বিচার প্রক্রিয়াকে আটকে দিয়েছিল। বিএনপি চেয়ারপারসন একদিকে এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করেন, অন্যদিকে পলাতক খুনিদের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এদিকে ‘মানবাধিকার’ রক্ষক যুক্তরাষ্ট্রও ২০০৪ সালে আত্মস্বীকৃত খুনিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০৬ সালে দেয় নাগরিকত্ব। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। দ্রুত বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় সরকার। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দণ্ড কার্যকর না হওয়ার দুঃখ নিয়েই ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর পরপারে চলে যান সিরাজুল হক। পিতার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নেন আনিসুল হক। আপিল বিভাগের রায়ের পর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনার যুক্তি আরও দৃঢ় হয়। এ সময় রাশেদ চৌধুরীসহ খুনিদের ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। যারা গ্রেফতার ছিল তাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়। আমি আশা করেছিলাম দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র অন্তত দ্রুত রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেবে। কিন্তু বহুবার রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিখিত আবেদন করেছে বাংলাদেশ। হায় মানবাধিকার! এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নির্বিকার। যুক্তরাষ্ট্র কোনো অভিবাসীকে নাগরিকত্ব দেয় ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী। গত ২৪ মে থেকে বাংলাদেশে এ আইনটি নিয়ে বেশ মাতামাতি চলছে। এ আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। কীভাবে একজন অভিবাসী মার্কিন নাগরিক হতে পারেন তার বিস্তারিত শর্ত আছে এ আইনে। একটি নির্দিষ্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেই চলবে না, তাকে অন্তত ২০টি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো- কোনো ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি (তা যে দেশেরই হোক না কেন), মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, হত্যাকারী, নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। শুধু তাই নয়, কোনো অভিবাসী যদি এ ধরনের কোনো তথ্য গোপন করে নাগরিকত্ব পান তবুও ভবিষ্যতে যদি প্রমাণ হয় যে তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বা তথ্য গোপন করে নাগরিকত্ব পেয়েছেন তাহলে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে বহিষ্কার করা হবে। সাফ কথা। আইনে এরকম নির্দেশনার মধ্যে কোনো তবে, যদি, কিন্তু নেই। মানবাধিকারে চ্যাম্পিয়ন দেশে তো এমনই আইন হওয়া চাই। কিন্তু রাশেদ চৌধুরীর বেলায় এ আইন কি প্রযোজ্য হয়েছে? না হয়নি। ২০১৮ এবং ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুবার চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। ট্রাম্প বিষয়টি অ্যাটর্নি অফিসকে দেখতে বলেন। কিন্তু জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সবকিছু থমকে গেছে। এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বলে বিষয়টি তাদের না, অ্যাটর্নি অফিসের। আইনমন্ত্রী নিজে মার্কিন অ্যাটর্নি অফিসে যোগাযোগ করেছেন। সময় চেয়েছেন। কিন্তু গত দেড় বছরে মার্কিন অ্যাটর্নি অফিস এ নিয়ে টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করেনি। ব্যস, এভাবেই চলছে। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রই যখন একজন আত্মস্বীকৃত, সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিতকে ফেরত দেয় না, তখন কানাডাও খুনি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠায় না। কানাডার যুক্তি হলো- সে দেশে যেহেতু মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ তাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে তারা ফেরত দেবে না। রশীদ, ডালিমসহ অন্য পলাতক খুনিদেরও বিভিন্ন দেশ রাখছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে। পাঠক একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রেসিডেন্টকে খুন করে কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে আশ্রয় নিল, তাকে কতক্ষণ বাংলাদেশ রাখতে পারত? তাকে বাংলাদেশ নাগরিকত্ব দিলে কী কেলেঙ্কারি হতো? কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সব পারে। তারা যা করবে সেটিই সঠিক। তারা যা বলবে এ বিশ্বে সেটিই আইন।

এখন যখন মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের উচ্ছ্বাসের বন্যা, তখন খুনি রাশেদ চৌধুরীর ঘটনাটি আমার মনে পড়ল। এ কারণেই দীর্ঘ ইতিহাস এক ঝলক স্মরণ করলাম। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের ঘোষণার পর প্রধান দুই দলের নেতারা এটি তাদের ‘বিজয়’ বলে চিৎকার, চেঁচামেচি করছেন। আওয়ামী লীগের নেতা ওবায়দুল কাদের আবিষ্কার করেছেন ‘ফখরুলের ঘুম হারাম হয়েছে। ’ মির্জা ফখরুলও কম যান না। তিনি গবেষণা করে পেয়েছেন ‘আওয়ামী লীগের সুর নরম হয়ে গেছে। ’ নতুন ভিসানীতি ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়ে ধন্য হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছিল তা ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর একনিষ্ঠ আনুগত্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব। বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর প্রভুত্ব। এক ভিসানীতি নিয়ে রাজনীতিতে যে মাতম শুরু হয়েছে তাতে মনে হতেই পারে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ বোধহয় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে আছে। মার্কিন ভিসা না পেলে বাংলাদেশে যেন লঙ্কাকাণ্ড ঘটে যাবে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও অভয় দিচ্ছেন। গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে তাদের জন্য ভিসানীতি উদ্বেগের নয়। ’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে খুব জানতে ইচ্ছা করে যে, রিকশাচালক দিনমান রোদে পুড়ে রিকশা চালান, তিনি তো সুষ্ঠু ভোট চান। ওই রিকশাচালক কি মার্কিন ভিসা পাবেন? কিংবা গ্রামের তরুণ মেধাবী অনেক কষ্টে লেখাপড়া করছে অথবা গ্রামের খেতমজুর কিংবা ড. ইউনূসের ঋণে নিঃস্ব হওয়া বিধবা নারী? তারা তো সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে। তারা কি মার্কিন ভিসা পাবে? এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যারা ভিসা আবেদন করেন তাদের অনেকেই প্রত্যাখ্যাত হন। যাদের যুক্তরাষ্ট্র নানা কারণে ভিসা দেয় না তাদের নামের তালিকা কি ফলাও করে প্রকাশ করে? কিন্তু এক্ষেত্রে করা হবে। তাদের প্রকাশ্যে অপমানিত করা এ ভিসানীতির একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইটে কোন দেশে বছরে কতজনকে ভিসা (নন-ইমিগ্র্যান্ট) দেওয়া হয় তার সংখ্যা পাওয়া যায়। ওই তালিকায় দেখা যায়- ২০১৩ সালে ২৮ হাজার ৮০ জন বাংলাদেশের নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিয়েছিল। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার ২৫ জনকে ভিসা দেওয়া হয়। গত বছর বাংলাদেশ থেকে মার্কিন ভিসা পেয়েছেন ২৯ হাজার ২০২ জন। গত ১০ বছরে আনুমানিক প্রায় ২ লাখ বাংলাদেশি মার্কিন ভিসা পেয়েছেন। প্রায় সমান সংখ্যক আবেদনকারী প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অর্থাৎ ভিসা নীতিমালা সাধারণ নাগরিকদের কোনো মাথাব্যথার বিষয় নয়। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা গুরুত্বপূর্ণ, হোমরাচোমরা তাদের জন্য এ ভিসানীতি অস্থিরতা তৈরি করেছে। প্রশাসনের যে বড় কর্তা যুক্তরাষ্ট্রে সন্তানদের পড়ান, সেখানে স্ত্রী থাকেন। কর্তা ঢাকায় এক ব্যাচেলর জীবনযাপন করেন। সব টাকা সেখানে পাঠিয়ে ‘সততা’র চাদরে নিজেদের ঢেকে রাখেন। এ ভিসানীতি তাদের উতালা করেছে। যেসব রাজনীতিবিদ কানাডায় সেকেন্ড হোম বানিয়ে, বেগমপাড়ায় রাজবাড়ী বানিয়েছেন। সন্তান-স্ত্রীকে সেখানে রেখেছেন। দেশের কিছু একটা হলেই উড়াল দেবেন। মার্কিন ভিসানীতি তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। যে ব্যবসায়ী হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ হয়েছেন। ব্যাংক ফোকলা বানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় টাকা পাচার করে নব্য মুজিব সৈনিক হয়েছেন; মার্কিন ভিসানীতি তার জন্য দম বন্ধ করার মতো খবর। যুক্তরাষ্ট্র জেনে-বুঝেই এ ভিসানীতি করেছে। গণতন্ত্র, ভোট, মানবাধিকার দেশের আপামর জনগণ নষ্ট করে না। এসব ধ্বংস করে মুষ্টিমেয় কিছু মতলববাজ, লুটেরা, সুবিধাবাদী। এরা সব দলে আছে। সব সরকারের সময়েই প্রশাসনে এরা খবরদারি করে। এরাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। মার্কিন ভিসানীতি এদের লক্ষ্য করেই করা হয়েছে। এ কারণে এ ভিসানীতি ধন্যবাদ পেতেই পারে। এরা যদি গণতন্ত্র, নির্বাচন নিয়ে জল ঘোলা না করে তাহলে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের এ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সমস্যা তো অন্য জায়গায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় মার্কিন নীতি এবং আইন অনেকটা জলের মতো। মার্কিন প্রশাসন একে যখন যে পাত্রে রাখে সেই আকার ধারণ করে। যেমন ভিসানীতি যে আইনের দ্বারা ঘোষণা করা হয়েছে সেই আইন অনুযায়ী খুনি রাশেদ চৌধুরীর নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা নয়। অথচ ঘৃণ্য ঘাতক বহাল তবিয়তেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছে। ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত একজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিপোর্ট করার কথা। তিনি তো বেশ আছেন। একজন সামরিক কর্মকর্তা, তিনি র‌্যাবে থাকার সময় ‘ক্রসফায়ারের’ জন্য আলোচিত ছিলেন। এক-এগারোর সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন কোন নীতিমালায়? নিঃশর্ত মার্কিন অনুগতদের জন্য এ বিশ্বে সাতখুন মাফ। অনুগত হয়ে হামিদ কারজাইয়ের সীমাহীন দুর্নীতি কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু মার্কিন বশ্যতা স্বীকার না করায় চিলির আলেন্দেকে প্রাণ দিতে হয়। তাই প্রশ্ন, এ আইন ও নীতি কি বাংলাদেশে সমভাবে সবার জন্য প্রয়োগ হবে? মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে যারা সুশীল সেজে বসে আছেন, যারা এক-এগারোর মতো আবার একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে চান, বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে দীর্ঘস্থায়ী একটি অগণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে চান- এরা গণতন্ত্রের শত্রু, সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান বাধা। তারা কি এ নীতির আওতায় আসবেন? সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে কারা তা কে নির্ধারণ করবে? এ দেশে অনুগত মার্কিন ভৃত্যগণ? এসব প্রশ্নের কারণ হলো- অতীত অভিজ্ঞতা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থে পক্ষপাতপূর্ণভাবে আইন ও নীতিমালা প্রয়োগ করেছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদেরই অবমুক্ত করা দলিলে। এসব দলিল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পিএল ৪৮০ এর ১০৩ (ঘ) (৩) ধারা প্রয়োগ করে বাংলাদেশে ৭৪-এ গম পাঠায়নি যুক্তরাষ্ট্র। কিউবায় চটের বস্তা রপ্তানি করা হয়েছে অভিযোগে সে সময় পিএল ৪৮০ এর ওই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছিল। অবমুক্ত দলিলে পাওয়া যায় হেনরি কিসিঞ্জার এবং তৎকালীন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট টম অ্যাডামের কথোপকথন। যাতে বাংলাদেশ এবং ইন্দোনেশিয়া উভয়েই কিউবায় পণ্য রপ্তানি করলেও কিসিঞ্জার ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে ৭৩ হাজার টন গম পাঠানো বন্ধ করেন।

মার্কিন অবমুক্ত দলিলে পাওয়া যায় ’৭৫-এর খুনিরা ১৯৭৩ থেকেই মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিল। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই মেজর রশীদ মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে জিয়াউর রহমানের পক্ষ থেকে সমরাস্ত্র কেনার ব্যাপারে কথা বলে। মার্কিন দূতাবাসের তৎকালীন কর্মকর্তা নিউবেরির নিশ্চয়ই জানার কথা, একজন মধ্যস্তরের সেনা কর্মকর্তা এভাবে অস্ত্র কেনার প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারে না। ১৯৭৪ সালে খুনি ফারুক বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনার কথা মার্কিন দূতাবাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ওয়াশিংটনে ২১৫৮ নম্বর তারবার্তার মাধ্যমে এ তথ্য জানান। মার্কিন দলিলেই প্রকাশ করা হয়েছে ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির আগে খুনি ফারুক একাধিকবার মার্কিন দূতাবাসে গেছে। অথচ মার্কিন ঘোষিত নীতি হলো- তারা কোনো রাষ্ট্রে অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল এবং সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করে না। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে উৎখাত, তাঁকে সপরিবারে হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সম্মতি ছিল। শুধু বাংলাদেশ কেন, বহু রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে তাদের পছন্দের পুতুল সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ইস্যুতে র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার প্রতিবাদ করেনি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল চায়নি। খুনিদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- একটি দেশ নিয়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত আগ্রহী হয়, যখন একটি দেশ নিয়ে নীতিমালা করে, সে দেশে তখনই বড় বিপর্যয় হয়। ক্ষমতা বদল হয়। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা হয়। অবশ্য যেসব দেশে দৃঢ়ভাবে তাদের আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়ায়, যে দেশের নেতারা জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ এবং ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন, তারা মার্কিন ইচ্ছার বিপরীতে অবস্থান নিতে পারেন। যেমন ছিল মাহাথিরের মালয়েশিয়া, এখন যেমন তুরস্ক। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের নির্বাচনে এরদোগানকে হারাতে সব চেষ্টাই করেছিল। কিন্তু রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের দৃঢ় নেতৃত্ব এবং জনপ্রিয়তা তা প্রতিরোধ করেছে। মার্কিন অভিপ্রায়ের কথা আরেক দৃঢ়চেতা নেতা শেখ হাসিনা ভালো করেই জানেন। এ জন্যই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর উচ্চারণ করেছিলেন। কিন্তু ভিসানীতির পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতার আত্মতুষ্টি আনন্দ আমাকে বিচলিত করেছে। আওয়ামী লীগের অতি মার্কিন ভক্তরা কি তা ’৭৫-এ বাংলাদেশ দেখেছে। শঙ্কা হয় বাংলাদেশ কি তাহলে আরেকটি আগস্ট ট্র্যাজেডির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আগামী ১০০ দিন বাংলাদেশে কি ঘটতে পারে?

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

আমি জ্যোতিষী নই। ভবিষ্যৎ গণনা আমার কাজ না। বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের আগে কি ঘটতে পারে কোন জ্যোতিষীর পক্ষেও এখন বলা সম্ভব কিনা আমার সন্দেহ । হয়তো তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আগামী দিনের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের একটি ধারণা পাওয়া যেতেই পারে। ১০০ দিনের মধ্যে দেশে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। এ ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন আগামী জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে চায়। কিন্তু দেশে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন হবে কিনা, তা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে কি বিএনপি অংশ নেবে? বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন করা কি আদৌ সম্ভব হবে? সেরকম একটি নির্বাচন কি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পাবে? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এখন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে। অফিসে, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে, চায়ের আড্ডায়, হাটে-বাজারে এসব নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। অজানা এক গন্তব্যে বাংলাদেশ।

নির্বাচন হবে কিনা, তা যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। তেমনি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আগামী ১০০ দিন কতগুলো ‘এক্স ফ্যাক্টর’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দু’দলই রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চাইছে। মাঠের দখলের লড়াই এখন দৃশ্যমান। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত এখন শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপির শক্তি এবং নেতৃত্বের দক্ষতার উপর নির্ভরশীল নয়। পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই দেশের নির্বাচন এবং রাজনৈতিক গতি প্রবাহের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। এই যেমন ধরা যাক, বেগম জিয়ার অসুস্থতা। কাগজে কলমে এখনও বেগম জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসন। যদিও তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে আছেন গত পাঁচ বছর ধরে। সাম্প্রতিক সময়ে ৭৮ বছর বয়সী এই প্রবীন মানুষটি নানা রোগ শোকে আক্রান্ত। হাসপাতালে আছেন বেশ কিছুদিন ধরে। দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে আছেন তিনি এবং তার দল। দুটি দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত হয়ে কারান্তরীণ ছিলেন দুই বছরের বেশি সময়। সরকারের বিশেষ বিবেচনায় তিনি কারাগার থেকে ‘ফিরোজায়’ গেছেন বটে। কিন্তু নানা শারীরিক সমস্যা তাকে রীতিমতো গ্রাস করে ফেলেছে। বিএনপি নেতারা মাঝে মধ্যেই বলেন ‘বেগম জিয়া জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।’ তার উন্নত চিকিৎসার দাবী বেশ পুরনো। বেগম জিয়ার পরিবারের সদস্যরা এনিয়ে সরকারের কাছেও দেন দরবার করছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এব্যাপারে সরকার সায় দেয়নি। অনেকেই বেগম জিয়ার শেষ পরিণতির অপেক্ষায়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলের মধ্যেই বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা চলছে। বেগম জিয়ার কিছু হলে দেশে কি হবে? আগামী ১০০ দিনের মধ্যে কি বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটবে? জীবন-মৃত্যু সৃষ্টিকর্তার হাতে। কিন্তু নির্বাচনের আগে যদি এরকম কোন ঘটনা ঘটে তাহলে দেশের পরিস্থিতি কি হতে পারে? অনেকেই মনে করেন এরকম অবস্থায় বিএনপির কর্মীরা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারেন। বিক্ষুদ্ধ কর্মীরা ভাঙ্গচুর, জ্বালাও পোড়াও ঘটিয়ে দেশে সৃষ্টি করতে পারে এক অশান্ত পরিবেশ। ঘেরাও, সন্ত্রাসী তান্ডব করে দেশে তৈরী হতে পারে এক অরাজক পরিস্থিতি। সরকার সেরকম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কিনা তা নিয়েও অনেকে শংকিত। নির্বাচনের আগে এরকম একটি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা দেশে সাংবিধানিক ধারা ব্যাহত করতে পারে। নির্বাচনও বাধাগ্রস্থ করতে পারে। একটা সংকটময় পরিস্থিতিতে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ পেতে পারে বলে অনেকের ধারনা। তবে আশাবাদী মানুষরা এনিয়ে শঙ্কিত নয় নানা কারণে। বেগম জিয়াকে যখন সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্টের বাসা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল, তখনও অনেকে শংকিত ছিলেন। অনেকেই মনে করেছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে। তেমন কিছুই শেষ পর্যন্ত হয়নি। ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আদালতের রায়ে বেগম জিয়া দোষী সাব্যস্ত হন। দন্ড কার্যকর করার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তখন বিএনপির অচল করে দেয়ার হুমকি কাজে দেয়নি। বেগম জিয়ার অনাকাঙ্খিত কিছু হলে, এবারও বিএনপির নেতা-কর্মীরা কতদূর কি করতে পারে তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। কেউ কেউ মনে করেন চার/পাঁচদিন বড়জোড় এক সপ্তাহের একটা ঝড় তুলবে। তারপর সব কিছু ঠিকঠাক হবে। ঠিক হোক না হোক বাংলাদেশের আগামী ১০০ দিনের অনিশ্চয়তার যাত্রায় বেগম জিয়া একটা বড় ‘এক্স ফ্যাক্টর’। 

বেগম জিয়ার মতোই ড. ইউনূস ইস্যুও আগামী ১০০ দিনের অভিযাত্রার গতিপথ পাল্টে দিতে পারে যে কোন সময়ে। যেভাবে শ্রম আদালতে মামলা এগুচ্ছে তাতে ড. ইউনূসের রায় যে নির্বাচনের আগেই হবে তা  মোটামুটি নিশ্চিত। শ্রমিকদের এই মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে শান্তিতে নোবেল জয়ী এই অর্থনীতিবীদকে কারাগারে যেতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেগম জিয়ার মতো জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা নন। তার বিরাট দল, বিশাল কর্মী বাহিনীও নেই। কিন্তু বেগম জিয়ার চেয়েও ড. ইউনূস অনেক বেশি প্রভাবশালী। ড. ইউনূস ইস্যুতে ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট অবস্থান নিয়েছে। শতাধিক নোবেল জয়ী ড. ইউনূসের মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। হিলারী ক্লিনটন এবং বারাক ওবামার মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ড. ইউনূস ইস্যুকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। এমনিতেই গত দুবছর ধরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট সম্পর্ক নানা অস্বস্তি এবং টানাপোড়েন চলছে। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান স্পষ্ট করেছে। ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আমেরিকা কি কি করবে তার তালিকা প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞা, সহায়তা কমানোর হুমকি, সামরিক সহায়তা হ্রাস সহ নানা হুমকি আর ধমকের মধ্যে আছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এক বাঁচাল পররাষ্ট্র মন্ত্রী একাই বেসামাল কথা বলে কূটনীতির মাঠকে কর্দমাক্ত করে ফেলছেন। এই অবস্থায় ড. ইউনূস ইস্যু কি যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ নিয়ে যাবে? কিছুদিন ধরেই সরকার প্রধান বলছিলেন ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাকে হয়তো ক্ষমতায় দেয়তে চায় না।’ প্রধানমন্ত্রী এটাও বলেছেন ‘এখানে কেউ কেউ তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।’ যুক্তরাষ্ট্র যে তার স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে এটা প্রমাণিত সত্য। বাংলাদেশে যেমন আমেরিকার অনেক স্বার্থ আছে, তেমনি ড. ইউনূসের ব্যাপারে তাদের আছে আলাদা আবেগ এবং পক্ষপাত। বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পরিকল্পনায় কি ঘি ঢালবে ড. ইউনূস ইস্যু? বাংলাদেশে আগামী ১০০ দিনের ঘটনা প্রভাব কোন দিকে মোড় নেবে তা অনেকটা নির্ভর করে ড. ইউনূসের মামলার রায়ের উপর। 

১০০ দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়? এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে সম্পূরক প্রশ্নও জুড়ে দেয়া যায় যুক্তরাষ্ট্র যা চায় সব সময় কি পায়? আগামী ১০০ দিনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানাপোড়েনের পরিণতিও বোঝা যাবে। 

দেশের দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিম, পিয়াজ আলুর মূল্য নির্ধারণ করে আরেকটা অযোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে। ঐ দামে কোথাও এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কর্তারা নির্লজ্জের মতো দায়িত্ব জ্ঞানহীন কথাবার্তা বলছে। মানুষ ফুঁসে উঠছে। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচন, বিরোধী দল নয় সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। গত ১৫ বছর মানুষ খুব বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। ক্ষমতার পালা বদল, কিংবা বিরোধী দলের দাবী দাওয়া বিষয়ে তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল। প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে স্বপ্ন দেখতো। ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতো। কিন্তু পঁচা শামুকে পা কাটার মতো, ডেঙ্গু, দ্রব্যমূল্য, দূর্নীতি সরকারের উপর জনগনের আস্থা নষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক হলো এসব সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা কেবল অযোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন না। অসত্য বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। সংকটকে পাত্তা দিচ্ছেন না। অশান্ত, ক্ষুদ্ধ জনগণ কি করতে পারে, তা বাংলাদেশ বহুবার দেখেছে। নির্বাচনের আগে জনগণকে তাঁতিয়ে তুলতে অনেকেই চাইবে। সরকারের ভেতর কিছু অর্থব, দায়িত্ব জ্ঞানহীনরা সেই অস্ত্রই যেন তুলে দিচ্ছে বিরোধী পক্ষের হাতে। দেশে স্যালাইনের হাহাকার, দেখার কেউ নেই। মশা নিয়ন্ত্রণের নামে নজিরবিহীন জালিয়াতি এবং লুণ্ঠনের পরও কেউ কেউ দাঁত কেলিয়ে হাসেন। বাজারে আগুন নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রী এবং সচিবের বক্তব্য মানুষকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এসব ঘটনা বিস্ফোরণ সৃষ্টি করতে পারে। আগামী ১০০ দিনে এসব প্রতিকূলতার দূর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে সরকারকে। বিএনপি এখন এক দফা দাবীতে আন্দোলন করছে। আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দলটির টানা কর্মসূচী রয়েছে। বিএনপি নেতারা অক্টোবরের মধ্যে আন্দোলনকে একটা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু একা বা নাম সর্বস্ব কিছু সঙ্গী সাথীকে নিয়ে আন্দোলন করে বিএনপি এক দফা আদায় করতে পারবে, এটা বিএনপির নেতারাও বিশ্বাস করেন না। বিএনপি তাদের আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এসব এক্স ফ্যাক্টরের উপরই নির্ভরশীল। বেগম জিয়ার কিছু হলে সারাদেশে আগুন জ্বলবে, বিএনপির একদফা আদায় সহজ হবে। কিংবা ড. ইউনূস ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর চূড়ান্ত নাখোশ হবে। বাংলাদেশের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা দেবে। শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বন্ধ করবে। ব্যস। এক দফা আদায়ের পথ সুগম হবে। এরকম সব যদি, তবে, কিন্তুর উপর ভর করে বিএনপি আন্দোলন করছে। তাই জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সেলফি থেকে বিএনপির কর্মীরা হতাশ হন। আবার পররাষ্ট্র মন্ত্রী যখন গ্রামের চাওয়ালার মতো শিষ্টাচার বহির্ভূত ভাষায় সেলফির গল্প শোনান, তখন তারা উজ্জীবিত হন। তাই ১০০ দিনে দেশের বা বিএনপির গন্তব্য নির্ধারণে ক্ষমতা বিএনপির নেই। এটি পুরোপুরি নির্ভর করে চারপাশের ঘটনা প্রবাহের উপর। বিএনপি না পারলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিন্তু ঠিকই পারে ১০০ দিনের ঘটানা প্রবাহের গতিপথ নির্ধারণ করতে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা। সংবিধান সম্মুন্নত রাখা। সংবিধান অনুযায়ী এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে একটি নির্বাচন। আগামী ১০০ দিনে এই লক্ষ্যে অবিচল থেকে দূর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে দলটিকে। এজন্য প্রথম এবং প্রধান কাজ জনগণের আস্থা অর্জন। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যক্তি। কিন্তু তার মন্ত্রী সভা এবং চারপাশে কিছু ব্যক্তির চেহারা দেখলেই সাধারন মানুষ ইদানিং ক্ষুদ্ধ হয়ে যায়। আগামী  ১০০ দিনের জন্য এসব অনাকাঙ্খিত ভাঁড় এবং দূর্বৃত্তদের ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। সরকারের ভেতর থেকে বা সরকারের সুবিধাভোগী ১০০ জনকে বাদ দিলেই সরকারের চেহারাটা আবার চমৎকার হবে। এসব অযোগ্য চাটুকার লুটেরাদের ভার এখন আর কোন ভাবেই সরকারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হবে না। 

দলেও একটা শুদ্ধি অভিযান করতে হবে। হাইব্রিড, উদ্বাস্তু, শেকড়হীনদের সরিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসাতে হবে জাহাঙ্গীর কবির নানক, বাহাউদ্দিন নাসিম, মির্জা আযমের জনপ্রিয় নেতাদের। প্রকৃচি থেকে আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা হঠাৎ বনে যাওয়া নাদুস নুদস জনবিচ্ছিন্ন নব্য নেতাদের ঘরবন্দী করতে হবে। ত্যাগী পরিক্ষীত দিতে হবে রাজপথের দায়িত্ব। জনগণের কাছে যেতে হবে পরিচ্ছন্ন নেতাদের। টিন চোর, কাবিখা চোর, নিয়োগ বাণিজ্য করা, টেন্ডারবাজ, মুখোশধারী রাজাকারদের বাদ দিয়ে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দিতে হবে পরিচ্ছন্ন, বিতর্কহীন, কলুষমুক্ত প্রার্থীদের। তাহলেই মানুষ আশাবাদী হবে। ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ভোট উৎসবে যোগ দেবে। আসলে ১০০ দিন পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের উপরই। আওয়ামী লীগ কি পারবে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা, সিন্ডিকেট, দূর্নীতিবাজ, অযোগ্য, অর্থব চাটুকার, মুখোশধারী রাজাকারদের হাত থেকে দল এবং সরকারকে মুক্ত করতে। তাহলেই বন্দরে নিরাপদে নৌকা ভিড়বে। 


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

পাঁচ বিষয়ে অনড় যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বাংলাদেশের ব্যাপারে পাঁচটি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনোরকম সমঝোতায় পৌঁছতে চাচ্ছে না। এ নিয়ে তাদের অনড় অবস্থানের এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে এম আবদুল মোমেন। সেখানে তারা বিভিন্ন মার্কিন কূটনৈতিক কর্মকর্তার সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সিলর ডেরেক এইচ শোলেট এর সাথে গত মঙ্গলবার বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব। এছাড়াও পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সাথেও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বৈঠক করেছেন। উজরা জেয়ার সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক কূটনৈতিকদের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এই সমস্ত কোন বৈঠকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে একমত হচ্ছে না। তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করছে না। যে সমস্ত বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনড় রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে;

১. নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো নির্বাচনে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানো। এই জন্য রাজনৈতিক সংলাপ দরকার। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের রাজনৈতিক সংলাপে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে না। সংলাপ প্রক্রিয়ার জন্য মধ্যস্থতার ভূমিকাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবতীর্ণ হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারা রাজনৈতিক সমঝোতাকে স্বাগত জানায় এবং রাজনৈতিক সংলাপের প্রতিও তাদের আগ্রহ রয়েছে। 

২. ড. ইউনূস ইস্যু: ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারী মামলার কার্যক্রম গুলোর স্থগিত চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি উজয়া জেয়া সরাসরি ভাবে পররাষ্ট্র সচিবকে জানিয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার এমন একটি মন্তব্য করা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের পক্ষ থেকে। আর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর সেই বক্তব্যকে সমর্থন করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ড. ইউনূস ইস্যুতে অনড় অবস্থানে রয়েছে। 

৩. মানবাধিকার ইস্যু: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আদিলুর রহমান খান এবং অধিকার সহ অন্যান্য মানবাধিকার ইস্যুতে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করেনি। বরং মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারকে আরও দায়িত্বশীল সংবেদনশীল এবং যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে এবং এই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন ছাড় দেবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিয়েছে। 

৪. নিখোঁজ ৭০ জনের ব্যাপারে তদন্ত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ৭০ জন নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো গ্রহণযোগ্য সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। এই ৭০ জনের ব্যাপারে সঠিক তথ্য তারা নির্বাচনের আগে নিশ্চিত করতে চায়। আর এ ব্যাপারেও তারা কোন ছাড় দিতে আগ্রহী নয় বলে জানা গেছে। 

৫. সাইবার সিকিউরিটি আইন: সাইবার সিকিউরিটি আইনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার পরিপন্থী। এই আইনের বিষয়েও তারা কোনো ছাড় দিতে রাজি না। তারা মনে করে, এ ধরনের আইন  সরকারের বাতিল করাই উচিত। 

এইসব বিষয়গুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যে মতদৈত্যতা সেই মতদৈত্যতার জায়গা থেকে ২ দেশ এখনও একটা সম্মানজনক সমঝোতার জায়গায় আসতে পারেনি।

বাংলাদেশের নির্বাচন   প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   নিউইয়র্ক   পররাষ্ট্রমন্ত্রী  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আরও যারা যাচ্ছে তৃণমূল বিএনপিতে

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বিএনপি থেকে একঝাঁক নেতা তৃণমূল বিএনপিতে যাচ্ছে—এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে বিএনপির ভিতর। শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতারা নন, বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী নেতারা এমনকি বিভাগীয় জেলা পর্যায়ের নেতারাও তৃণমূল বিএনপিতে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির মধ্যে যে সমস্ত নেতারা এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন তাদের একটি বিরাট অংশ তৃণমূল বিএনপিতে যেতে পারেন বলে অনেকে ধারণা করছেন। 

সংশ্লিষ্ট গুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি থেকে বহিস্কৃত সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন—এমন গুঞ্জন রয়েছে। বিএনপির ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল সময় পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারেন—এমন কোথাও শোনা যাচ্ছে। খুলনার বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুও তৃণমূলে যোগ দিতে পারেন এমন দাবি করছেন তৃণমূল বিএনপির নেতারা। এছাড়াও বিএনপির আবদুল্লাহ আল নোমান সহ বেশ কয়েকজন নেতার তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপির মধ্যে যে সমস্ত নেতারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চান এবং এলাকায় যাদের জনপ্রিয়তা আছে তাদের সঙ্গে তৃণমূল বিএনপির যোগাযোগ করা হচ্ছে। এই সংখ্যা দুইশো ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করছেন।

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে দেখা গেছে, তারাও স্বীকার করেছেন যে তাদের সাথে এখন যোগাযোগ বাড়ছে। হঠাৎ করেই তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক কেন বেড়ে গেল—এই নিয়ে বিএনপির মধ্যে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যাচ্ছে। বিএনপির একটি অংশ বলছে যে, বিএনপিতে যারা নির্বাচন করতে চায় এমন নেতারা মনে করছেন যে আগামী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির কোনো অবস্থাতেই অংশগ্রহণ করবে না। আর এ কারণেই তারা তৃণমূল বিএনপিতে যেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটাকেই নিরাপদ মনে করছেন। এই নির্বাচনে তারা ভালো ফলাফল করবেন এমনটি প্রত্যাশা করছেন। 

অন্যদিকে যে সমস্ত বিএনপির নেতারা বেশি আত্মবিশ্বাসী তারা বলছেন যে, এটা আসলে সরকারের পাতানো ফাঁদ। সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিকে ছাড়াই করতে চায়। বিভিন্ন মহলের কাছে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে চায়। আর এ কারণেই তৃণমূল বিএনপিকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শুধুমাত্র বিএনপি থেকেই নয় বরং এরকমও গুঞ্জন রয়েছে যে বিকল্প ধারা তৃণমূল বিএনপিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এমনকি কর্নেল অলি আহমেদের নেতৃত্বে এলডিপি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিতে পারে—এমন গুঞ্জনও রয়েছে। তবে যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে তারা কেউই তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের কথা স্বীকার করেননি। 

তারা বলেছেন, এটা নোংরা অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার। এই মুহূর্তে বিএনপি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো অভিপ্রায় নেই। কিন্তু বিএনপির বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, দলের নিষ্ক্রিয় নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ বেড়েছে এবং এই যোগাযোগের প্রধান কারণ হলো তাদেরকে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করা। তৃণমূল বিএনপি শক্তিশালী হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের একটি পথ পরিষ্কার হয়ে যায় এবং নির্বাচনে যারা বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ বিরোধী অবস্থানে আছে তাদের অংশগ্রহণের পথ সুগম হয়—এমন ভাবনা থেকেই তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক বাড়বে বলেই মনে করছেন বিভিন্ন মহল। এমনকি গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির টিকিটে যে কয়েকজন নির্বাচিত হয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্তত একজন তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করবেন—এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এখন দেখা যাক শেষ পর্যন্ত বিএনপি থেকে তৃণমূল বিএনপিতে কতজন, কিভাবে যোগদান করেন।


তৃণমূল বিএনপি   নির্বাচন   বিএনপি   বিএনপি থেকে বহিস্কৃত   সরকার   শওকত মাহমুদ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশ: ০৮:০১ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ দেখতে চায় বিএনপি। আর এ লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং এক রকমের প্রচ্ছন্ন চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোনো চাপ নয়, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সংহত থাকুক, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকশিত হোক। কারণ গণতন্ত্র হলো উন্নয়ন এবং উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্ত। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশে একটি অর্থবহ ও অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দেখতে চায়।

কিন্তু এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রধান বাধা হলো- আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, দুটি রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিরোধী অবস্থান। বিএনপি নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এই দাবিতে তারা এক দফা আন্দোলন করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নাই। সংবিধান সম্মতভাবেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে। বিএনপি মনে করছে,দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলে ভোট অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ হবে না। এখন এরকম একটি অচল অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। আর এই সংকট কাটিয়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিভিন্ন মহলের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দুইটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো কাজ করছে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো উদ্যোগ নেবে না এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ করার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকাও গ্রহণ করবে না। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের সংলাপ এবং সমঝোতাকে সমর্থন করে। তবে মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যাই বলুক না কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন মহলের সঙ্গে একটি অর্থবহ নির্বাচন কিভাবে করা যায়- তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। আর এই সমস্ত আলাপ-আলোচনায় বেশ কিছু সম্ভাব্য প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক নিয়েও তারা কথাবার্তা বলছেন। 

সুশীল সমাজের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কূটনৈতিকরা একাধিক বৈঠক করেছেন। সংবিধান কাঠামোর মধ্যে কিভাবে একটি অবাধ, সুষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা যায়- সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। বিএনপির সঙ্গেও তারা রাজনৈতিক সমঝোতার পথ নিয়ে কথা বলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ‘আওমীলীগ কতটুকু পর্যন্ত ছাড় দেবে’-তা নিয়েও কথা বলছে। এই সবকিছু মিলিয়ে তারা একটি অর্থবহ নির্বাচনের পথ খুঁজছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগের প্রধান দাবি হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন শেখ হাসিনা- এই দাবি থেকে তারা সরে আসবে না। অন্যদিকে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক বা যেটাই হোক না কেন, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকতে পারবেন না। অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করলেও কোনো আপত্তি নেই। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করা যায় কিনা, সেই সম্ভব্যতা যাচাই করছেন- এ নিয়ে সুশীল সমাজের অন্তত দুইজন প্রতিনিধি মার্কিন দূতাবাসের সাথে কথাও বলেছেন বলে জানা গেছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি দশ সদস্যের নিরপেক্ষ উপদেষ্টামণ্ডলীর কথা বলেছেন, যে উপদেষ্টামণ্ডলীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপির বাইরে একদম নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা থাকবেন; যারা প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেবেন এবং এই পরামর্শের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন পরিচালনা করবেন। 

তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রয়েছে। উপদেষ্টারা কার্যত প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারবে না। তাই এই প্রস্তাবে তারা রাজি নয়। 

সাম্প্রতিক সময়ে সুশীল সমাজের কয়েকজন রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায় কিনা, তার সাংবিধানিক বিধি-বিধানগুলো খুঁজে দেখছে। তবে বিএনপির এটিতেও সায় নাই। বিএনপি মনে করে, বর্তমান রাষ্ট্রপতিও নিরপেক্ষ নয়। 

আর এরকম পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে বলছে, তারা (পশ্চিমা দেশগুলো) নির্বাচনের পুরো বিষয়টি তদারকি করবে এবং নির্বাচনে কোনো রকম কারচুপি, জালিয়াতি ইত্যাদি হলে সেটি তারা প্রতিহত করবে। আর এরকম ঘটনা ঘটলে নির্বাচনকেও স্বীকৃতি দেবে না। 

এরকম একটি প্রস্তাবনা নিয়ে তারা (পশ্চিমা দেশগুলো) বিএনপিকে নির্বাচনে রাজি করানোর চেষ্টা করছে। এখন দেখার বিষয়, এই প্রস্তাবে বিএনপি সায় দেয় কিনা।


অংশগ্রহণমূলক   নির্বাচন   যুক্তরাষ্ট্র  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আমলাদের আওয়ামী লীগে রূপান্তরের নেপথ্যে

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

মির্জা আজম। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। ছয়বারের এমপি। জীবনে কোনো সংসদ নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ ২০০১ সালে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি জয়ী হয়েছেন। জামালপুরে দলমত নির্বিশেষে তিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। সেই জামালপুরে গত ১১ সেপ্টেম্বর ঘটল এক কাণ্ড। সেখানকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. ইমরান আহমেদ, প্রশাসনের মাঠ কর্মকর্তা থেকে আওয়ামী লীগের নেতা বনে গেলেন। আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনার জন্য তিনি জনগণের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানালেন। জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভায় নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি চাঞ্চল্যকর বক্তব্য রাখেন। ডিসি শুধু সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনার অঙ্গীকারই করেননি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগামী সরকারও গঠন করে ফেলেছেন। ওই সরকারে মির্জা আজমকে মন্ত্রীও বানিয়ে ফেলেছেন। মো. ইমরান বলেছেন, ‘আমি আশা করি, সামনের নির্বাচনের পর আমাদের সম্মানিত প্রধান অতিথি (মির্জা আজম) অবশ্যই একজন মন্ত্রী হিসেবে জেলায় আরও ব্যাপক উন্নয়ন করবেন। এটা আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি, এটা হবে ইনশাআল্লাহ।মির্জা আজমকে জেতানোর জন্য কোনো আমলার দরকার নেই। কোনো কারসাজি করারও প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও আমলাদের এমন চেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে দেশে যে-কটি আসনে ভোটাররা দিনভর ভোট দিয়েছে, তার মধ্যে মির্জা আজমের আসন একটি। তাহলে এবার কেন? জনপ্রিয় নেতাকে বিতর্কিত করার জন্যই কি আয়োজন। জামালপুরের জেলা প্রশাসকই এরকম কদর্য চাটুকারিতায় ভরপুর বক্তব্য রাখেননি। কিছুদিন ধরেই মাঠ প্রশাসনে এবং পুলিশে ব্যাধিটি ছড়িয়ে পড়েছে। কদিন আগে অর্থমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা, লাঙ্গলকোটের ওসি ফারুক হোসেন আগামী নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালকেআবার নির্বাচিত করার জন্য মিনতি করেন অথচ অসুস্থ অর্থমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না, তারই ঠিক নেই। গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি শ্যামল চন্দ্র ধর বর্তমান সরকারকে ফের নির্বাচিত করতে ভোট চান। নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে, ততই ডিসি, এসপি, ওসি, ইউএনওদের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য আলগা প্রেম বাড়ছে। শুধু মাঠ প্রশাসন নয়, বড় আমলারাও আওয়ামী লীগের জন্য গদগদ হয়ে উঠছেন। কোনো কোনো অতিউৎসাহী আমলা এখন শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও এসব সরকারি কর্মকর্তা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতানোর ফর্মুলা আবিষ্কারে ব্যস্ত। এসব সরকারি কর্মকর্তা এবং কর্মচারী কি আসলে আওয়ামী লীগের উপকার করছেন না ক্ষতি করছেন? নির্বাচনে জয়ী হতে কি আওয়ামী লীগের আমলাদের দরকার? নাকি এসব আমলা মতলববাজ। নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য তারা আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করছে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করছে। এসব ঘটনার ফলে, আওয়ামী লীগের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলছে নানা বিতর্ক। বিএনপি বলছে, সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপি মহাসচিব একাধিক বক্তৃতায় অভিযোগ করেছেন, সরকার তার পক্ষের লোকজন দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে। সুশীল সমাজ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচনে যদি প্রশাসন হস্তক্ষেপ করে তাহলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছে। এর বিপরীতে সরকার বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশ-বিদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। আগামী নির্বাচন কেমন হয় সেদিকে চোখ সবার। এরকম পরিস্থিতিতে এসব অতিউৎসাহীদের বাচালতা গোটা নির্বাচনকেই অনিশ্চিত করে তুলবে। সরকার যতই বলুক, নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকর্তাদের কারণে তা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। যারা এসব চাটুকারিতা করছে, তারা গণতন্ত্রকেই আসলে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমি মনে করি প্রশাসনে অতি রাজনীতিকরণ এবং দলীয়করণের কারণেই বড় আমলা থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসন তাদের নিরপেক্ষতা এবং যোগ্যতা হারাচ্ছে। প্রবণতা দীর্ঘদিনের। এখন প্রশাসনের দলীয়করণের বিষয়টিজায়েজহয়ে গেছে। এখন প্রশাসনে পদোন্নতি কিংবা পদায়ন করা হয় রাজনৈতিক পরিচয় দেখে। মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির চর্চা নেই বললেই চলে। একজন উপসচিব জানেন, তিনিআওয়ামী লীগ পরিচয় সামনে এলে তার পদোন্নতি হবে। যুগ্ম সচিব মনে করছেন যত চাটুকারিতা করবেন, সরকারের স্তুতি করবেন, তত দ্রুত তার পদোন্নতির দরজা খুলে যাবে। সচিব হতে গেলে এখন দক্ষতা লাগে না, তার কাজের মান কিংবা নেতৃত্বের যোগ্যতা যাচাই করা হয় না। দেখা হয় তিনি সরকারের কতটা আপনজন। তাই প্রশাসনের সব পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ার এক বীভৎস প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। রাজাকার পরিবারের সন্তানও এখন নিজেকে ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয় দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রদল কিংবা শিবির করে এখন আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত হওয়া আমলার সংখ্যা কম নয়। যে যেভাবে পারছে নিজেকে অতি বড় আওয়ামী লীগার প্রমাণে ব্যস্ত। কেউ কবিতা লিখছেন, কেউ আওয়ামী নেতাদের চেয়েও জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। যারা প্রশাসনে সত্যিকারের আওয়ামী পরিবার থেকে এসেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, তারাই এখন এসব নব্য আওয়ামী লীগের দাপটে কোণঠাসা। এসব নব্য আওয়ামী লীগার প্রশাসনে একটি সিন্ডিকেট করেছে। সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ সচিব হয় না, কারও ভালো পোস্টিং হয় না। তাদের ভাবসাব, কথাবার্তায় মনে হয়, শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, তারাই আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে নির্লজ্জ চাটুকারদের প্রভাব পড়েছে মাঠপর্যায়ে। আরেকবার ক্ষমতায় এলেই আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে ষোলোকলা পূর্ণ হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমলারাই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করে। এর মাধ্যমে তারা ক্ষমতাকেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে সচিবরা মন্ত্রীদের পাত্তাই দেন না। মাঠে ডিসি, ইউএনওরা জনপ্রতিনিধিদের কথাই শোনেন না। কদিন আগে আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলছিলেন, ‘মাঠে এখন আওয়ামী লীগ নেই। আমলা লীগ আছে।কিছু কিছু আমলা মুখে আওয়ামী লীগের কথা বলে আসলে আওয়ামী লীগকেই বিকলাঙ্গ করছে। এরা শুধু সরকারের জন্য নয়, আওয়ামী লীগের জন্যও বিপজ্জনক। এরা এখন আওয়ামী লীগকে জয়ী করার কথা বলছে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। আগামী নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ জয়ী হয় তাহলে তারা বলবেআহ, কী ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতালাম। আমি না থাকলে তো এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরাডুবি নিশ্চিত।ব্যস, দ্রুত গতিতে তার পদোন্নতির অভিযাত্রা শুরু হবে। লাগামহীন দুর্নীতির লাইসেন্স পাবে। ওই আমলার ভাগ্যের চাকা খুলে যাবে। সাধারণ জনগণ বলবে, এমপির কোনো দাম নেই। সব ক্ষমতার মালিক আমলাই। আর যদি কোনো কারণে ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপর্যয় হয়, প্রার্থী হেরে যায়, তখন ওই মাঠ কর্মকর্তা দুরকম অবস্থান গ্রহণ করবেন। প্রথম অবস্থান, যদি আওয়ামী লীগ জয়ী হয় এবং ওই প্রার্থী হেরে যায়। তখন মাঠ আমলা বলবে, কী যে পরিশ্রম করলাম। আমি চেষ্টা করেছি বলেই ভোট পেয়েছে। না হলে তো জামানত বাজেয়াপ্ত হতো। আর ওই প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ উভয়ই হারে, তখন গিরগিটির মতো মুহূর্তে তিনি রূপ বদল করবেন। বলবেন, আসলে আমিই তো আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়েছি। গোপনে গোপনে আমি তার সর্বনাশ করেছি। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তার লাভ এবং লাভ। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই যেসব সরকারি কর্মকর্তা ভোট চেয়ে চাটুকারিতার অরুচিকর প্রদর্শনী করলেন, সরকারকে বিব্রত করলেন, তাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তাদের শুধু প্রত্যাহার করা হয়েছে। জামালপুরের ডিসি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। ওসিদেরও শাস্তি হলো প্রত্যাহার। তারা অচিরেইনির্যাতিতপরিচয়ে ভূষিত হবেন। আওয়ামী লীগের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গের কাহিনি তারা বলে বেড়াবেন প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে। কদিন পর আবার তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং হবে। আওয়ামী লীগের সৈনিক হিসেবে তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াবেন। অবস্থা বন্ধ করা দরকার এখনই। যোগ্য এবং পেশাদার কর্মকর্তারাই আসলে সরকার এবং দেশের জন্য মঙ্গলকর। অযোগ্য চাটুকাররা শুধু নিজেদের স্বার্থ খোঁজে। সরকার এবং দেশের কোনো কাজে তারা যাবে না। সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারেন না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই নির্মোহভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যাহার কোনো শাস্তি নয়। সরকারকে মনে রাখতে হবে, আমলারা কোনোদিন কারও হয় না। বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে থাকা আমলা খুনি মোশতাকের শপথ পাঠ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। জিয়াকে খুশি করতে যে আমলা স্যুট-প্যান্ট ছেড়ে সাফারি এবং সানগ্লাস পরা শুরু করেন, এটাই জাতীয় পোশাক হওয়া উচিত বলে বক্তৃতা দেন, সেই আমলাই এরশাদের রাজকবি সভাই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েছিলেন। এরশাদের সঙ্গে আমৃত্যু থাকার অঙ্গীকার করা আমলা স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপির টিকিটে এমপি হতে সময় নেননি। এখন যারা আমলাতন্ত্রে আওয়ামী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, দুঃসময়ে তারা হয় পালাবেন অথবা ভোল পাল্টাবেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে অনেক কঠিন কাজ করা যায়। আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব প্রতিষ্ঠার কাজটি কঠিন, কিন্তু জরুরি। আওয়ামী লীগই পারে যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। এতে সিংহভাগ সরকারি কর্মচারী খুশি হবেন। সরকার গুটিকয়েক সুবিধাবাদী চাটুকার আমলাদের হাতে জিম্মি থাকবে না। মেধাবী, স্মার্ট আমলাতন্ত্র গড়তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই। তার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে চাকরি শৃঙ্খলা বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আমলাদের আওয়ামী লীগে রূপান্তর বন্ধ করা।

 

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

-মেইল : poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন