মির্জা
আজম। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা। ছয়বারের এমপি। জীবনে কোনো সংসদ নির্বাচনে
পরাজিত হননি। ১৯৯১ ও ২০০১
সালে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও
তিনি জয়ী হয়েছেন। জামালপুরে
দলমত নির্বিশেষে তিনি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন
করেছেন। সেই জামালপুরে গত
১১ সেপ্টেম্বর ঘটল এক কাণ্ড।
সেখানকার জেলা প্রশাসক (ডিসি)
মো. ইমরান আহমেদ, প্রশাসনের মাঠ কর্মকর্তা থেকে
আওয়ামী লীগের নেতা বনে গেলেন।
আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় আনার
জন্য তিনি জনগণের কাছে
উদাত্ত আহ্বান জানালেন। জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভায় নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে তিনি
এ চাঞ্চল্যকর বক্তব্য রাখেন। ডিসি শুধু এ
সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনার
অঙ্গীকারই করেননি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগামী সরকারও গঠন করে ফেলেছেন।
ওই সরকারে মির্জা আজমকে মন্ত্রীও বানিয়ে ফেলেছেন। মো. ইমরান বলেছেন,
‘আমি আশা করি, সামনের
নির্বাচনের পর আমাদের সম্মানিত
প্রধান অতিথি (মির্জা আজম) অবশ্যই একজন
মন্ত্রী হিসেবে এ জেলায় আরও
ব্যাপক উন্নয়ন করবেন। এটা আমি আশা
করি এবং বিশ্বাস করি,
এটা হবে ইনশাআল্লাহ।’ মির্জা
আজমকে জেতানোর জন্য কোনো আমলার
দরকার নেই। কোনো কারসাজি
করারও প্রয়োজন নেই। ২০১৮ সালের
নির্বাচনের আগেও আমলাদের এমন
চেষ্টাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি। ওই নির্বাচনে দেশে
যে-কটি আসনে ভোটাররা
দিনভর ভোট দিয়েছে, তার
মধ্যে মির্জা আজমের আসন একটি। তাহলে
এবার কেন? এ জনপ্রিয়
নেতাকে বিতর্কিত করার জন্যই কি
এ আয়োজন। জামালপুরের এ জেলা প্রশাসকই
এরকম কদর্য চাটুকারিতায় ভরপুর বক্তব্য রাখেননি। কিছুদিন ধরেই মাঠ প্রশাসনে
এবং পুলিশে এ ব্যাধিটি ছড়িয়ে
পড়েছে। কদিন আগে অর্থমন্ত্রীর
নির্বাচনী এলাকা, লাঙ্গলকোটের ওসি ফারুক হোসেন
আগামী নির্বাচনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম
মুস্তফা কামালকে ‘আবার নির্বাচিত করার
জন্য মিনতি করেন’। অথচ
অসুস্থ অর্থমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন কি না, তারই
ঠিক নেই। গত ১৫
আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভায় আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ওই
অনুষ্ঠানে দেওয়ানগঞ্জ মডেল থানার ওসি
শ্যামল চন্দ্র ধর বর্তমান সরকারকে
ফের নির্বাচিত করতে ভোট চান।
নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে,
ততই ডিসি, এসপি, ওসি, ইউএনওদের নির্বাচন
নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য আলগা প্রেম
বাড়ছে। শুধু মাঠ প্রশাসন
নয়, বড় আমলারাও আওয়ামী
লীগের জন্য গদগদ হয়ে
উঠছেন। কোনো কোনো অতিউৎসাহী
আমলা এখন শেখ হাসিনার
চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার
হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও এসব সরকারি কর্মকর্তা
আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জেতানোর ফর্মুলা আবিষ্কারে ব্যস্ত। এসব সরকারি কর্মকর্তা
এবং কর্মচারী কি আসলে আওয়ামী
লীগের উপকার করছেন না ক্ষতি করছেন?
নির্বাচনে জয়ী হতে কি
আওয়ামী লীগের আমলাদের দরকার? নাকি এসব আমলা
মতলববাজ। নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য তারা আওয়ামী
লীগকে বিতর্কিত করছে। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি
করছে। এসব ঘটনার ফলে,
আওয়ামী লীগের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে।
অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
নিয়ে সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে
হবে তা নিয়ে জাতীয়
এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলছে নানা বিতর্ক।
বিএনপি বলছে, এ সরকারের অধীনে
অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্ভব নয়। বিএনপি মহাসচিব
একাধিক বক্তৃতায় অভিযোগ করেছেন, সরকার তার পক্ষের লোকজন
দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছে। সুশীল সমাজ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা
নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা
হচ্ছে, নির্বাচনে যদি প্রশাসন হস্তক্ষেপ
করে তাহলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য
হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আগামী
নির্বাচন সামনে রেখে ভিসা নিষেধাজ্ঞার
হুমকি দিয়ে রেখেছে। এর
বিপরীতে সরকার বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। প্রশাসন নিরপেক্ষ
থাকবে। প্রধানমন্ত্রী নিজে দেশ-বিদেশে
সুষ্ঠু নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। আগামী নির্বাচন কেমন হয় সেদিকে
চোখ সবার। এরকম পরিস্থিতিতে এসব
অতিউৎসাহীদের বাচালতা গোটা নির্বাচনকেই অনিশ্চিত
করে তুলবে। সরকার যতই বলুক, নিরপেক্ষ
নির্বাচন হবে, এসব দায়িত্বজ্ঞানহীন
কর্মকর্তাদের কারণে তা কারও কাছেই
বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। যারা এসব
চাটুকারিতা করছে, তারা গণতন্ত্রকেই আসলে
সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
আমি মনে করি প্রশাসনে
অতি রাজনীতিকরণ এবং দলীয়করণের কারণেই
বড় আমলা থেকে শুরু
করে মাঠ প্রশাসন তাদের
নিরপেক্ষতা এবং যোগ্যতা হারাচ্ছে।
এ প্রবণতা দীর্ঘদিনের। এখন প্রশাসনের দলীয়করণের
বিষয়টি ‘জায়েজ’ হয়ে গেছে। এখন
প্রশাসনে পদোন্নতি কিংবা পদায়ন করা হয় রাজনৈতিক
পরিচয় দেখে। মেধা এবং যোগ্যতার
ভিত্তিতে পদোন্নতির চর্চা নেই বললেই চলে।
একজন উপসচিব জানেন, তিনি ‘আওয়ামী লীগ’ এ পরিচয়
সামনে এলে তার পদোন্নতি
হবে। যুগ্ম সচিব মনে করছেন
যত চাটুকারিতা করবেন, সরকারের স্তুতি করবেন, তত দ্রুত তার
পদোন্নতির দরজা খুলে যাবে।
সচিব হতে গেলে এখন
দক্ষতা লাগে না, তার
কাজের মান কিংবা নেতৃত্বের
যোগ্যতা যাচাই করা হয় না।
দেখা হয় তিনি সরকারের
কতটা আপনজন। তাই প্রশাসনের সব
পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ার এক বীভৎস প্রতিযোগিতা
শুরু হয়েছে। রাজাকার পরিবারের সন্তানও এখন নিজেকে ছাত্রলীগের
কর্মী পরিচয় দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে
ছাত্রদল কিংবা শিবির করে এখন আওয়ামী
লীগে রূপান্তরিত হওয়া আমলার সংখ্যা
কম নয়। যে যেভাবে
পারছে নিজেকে অতি বড় আওয়ামী
লীগার প্রমাণে ব্যস্ত। কেউ কবিতা লিখছেন,
কেউ আওয়ামী নেতাদের চেয়েও জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। যারা প্রশাসনে সত্যিকারের
আওয়ামী পরিবার থেকে এসেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, তারাই এখন এসব নব্য
আওয়ামী লীগের দাপটে কোণঠাসা। এসব নব্য আওয়ামী
লীগার প্রশাসনে একটি সিন্ডিকেট করেছে।
এ সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ সচিব হয়
না, কারও ভালো পোস্টিং
হয় না। তাদের ভাবসাব,
কথাবার্তায় মনে হয়, শেখ
হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নয়, তারাই আবার
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে নির্লজ্জ চাটুকারদের প্রভাব পড়েছে মাঠপর্যায়ে। আরেকবার ক্ষমতায় এলেই আমলাতন্ত্রের রাষ্ট্রক্ষমতা
দখলে ষোলোকলা পূর্ণ হবে। ২০১৮ সালের
নির্বাচনে এ আমলারাই পরিকল্পিত
ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ
করে। এর মাধ্যমে তারা
ক্ষমতাকেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অধিকাংশ
মন্ত্রণালয়ে সচিবরা মন্ত্রীদের পাত্তাই দেন না। মাঠে
ডিসি, ইউএনওরা জনপ্রতিনিধিদের কথাই শোনেন না।
কদিন আগে আওয়ামী লীগের
একজন নেতা বলছিলেন, ‘মাঠে
এখন আওয়ামী লীগ নেই। আমলা
লীগ আছে।’ কিছু কিছু আমলা
মুখে আওয়ামী লীগের কথা বলে আসলে
আওয়ামী লীগকেই বিকলাঙ্গ করছে। এরা শুধু সরকারের
জন্য নয়, আওয়ামী লীগের
জন্যও বিপজ্জনক। এরা এখন আওয়ামী
লীগকে জয়ী করার কথা
বলছে নিজেদের আখের গোছানোর জন্য।
আগামী নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত
আওয়ামী লীগ জয়ী হয়
তাহলে তারা বলবে ‘আহ,
কী ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগের
প্রার্থীকে জেতালাম। আমি না থাকলে
তো এবার আওয়ামী লীগের
প্রার্থীর ভরাডুবি নিশ্চিত।’ ব্যস, দ্রুত গতিতে তার পদোন্নতির অভিযাত্রা
শুরু হবে। লাগামহীন দুর্নীতির
লাইসেন্স পাবে। ওই আমলার ভাগ্যের
চাকা খুলে যাবে। সাধারণ
জনগণ বলবে, এমপির কোনো দাম নেই।
সব ক্ষমতার মালিক আমলাই। আর যদি কোনো
কারণে ভোটে আওয়ামী লীগের
প্রার্থীর বিপর্যয় হয়, প্রার্থী হেরে
যায়, তখন ওই মাঠ
কর্মকর্তা দুরকম অবস্থান গ্রহণ করবেন। প্রথম অবস্থান, যদি আওয়ামী লীগ
জয়ী হয় এবং ওই
প্রার্থী হেরে যায়। তখন
মাঠ আমলা বলবে, কী
যে পরিশ্রম করলাম। আমি চেষ্টা করেছি
বলেই এ ভোট পেয়েছে।
না হলে তো জামানত
বাজেয়াপ্ত হতো। আর ওই
প্রার্থী এবং আওয়ামী লীগ
উভয়ই হারে, তখন গিরগিটির মতো
মুহূর্তে তিনি রূপ বদল
করবেন। বলবেন, আসলে আমিই তো
আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে হারিয়েছি। গোপনে গোপনে আমি তার সর্বনাশ
করেছি। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, তার
লাভ এবং লাভ। নির্বাচনের
তপশিল ঘোষণার আগেই যেসব সরকারি
কর্মকর্তা ভোট চেয়ে চাটুকারিতার
অরুচিকর প্রদর্শনী করলেন, সরকারকে বিব্রত করলেন, তাদেরও হতাশ হওয়ার কিছু
নেই। তাদের শুধু প্রত্যাহার করা
হয়েছে। জামালপুরের ডিসি প্রবাসী কল্যাণ
মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন। ওসিদেরও
শাস্তি হলো প্রত্যাহার। তারা
অচিরেই ‘নির্যাতিত’ পরিচয়ে ভূষিত হবেন। আওয়ামী লীগের জন্য তাদের জীবন
উৎসর্গের কাহিনি তারা বলে বেড়াবেন
প্রশাসনের দুয়ারে দুয়ারে। কদিন পর আবার
তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং
হবে। আওয়ামী লীগের সৈনিক হিসেবে তারা বুক ফুলিয়ে
ঘুরে বেড়াবেন। এ অবস্থা বন্ধ
করা দরকার এখনই। যোগ্য এবং পেশাদার কর্মকর্তারাই
আসলে সরকার এবং দেশের জন্য
মঙ্গলকর। অযোগ্য চাটুকাররা শুধু নিজেদের স্বার্থ
খোঁজে। সরকার এবং দেশের কোনো
কাজে তারা যাবে না।
সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী একজন
সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারেন না। এটা শাস্তিযোগ্য
অপরাধ। তাই নির্মোহভাবে তাদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যাহার
কোনো শাস্তি নয়। সরকারকে মনে
রাখতে হবে, আমলারা কোনোদিন
কারও হয় না। বঙ্গবন্ধুর
পায়ের কাছে বসে থাকা
আমলা খুনি মোশতাকের শপথ
পাঠ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। জিয়াকে খুশি করতে যে
আমলা স্যুট-প্যান্ট ছেড়ে সাফারি এবং
সানগ্লাস পরা শুরু করেন,
এটাই জাতীয় পোশাক হওয়া উচিত বলে
বক্তৃতা দেন, সেই আমলাই
এরশাদের রাজকবি সভাই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য
হয়েছিলেন। এরশাদের সঙ্গে আমৃত্যু থাকার অঙ্গীকার করা আমলা স্বৈরাচারের
পতনের পর বিএনপির টিকিটে
এমপি হতে সময় নেননি।
এখন যারা আমলাতন্ত্রে আওয়ামী
সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন, দুঃসময়ে
তারা হয় পালাবেন অথবা
ভোল পাল্টাবেন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে অনেক কঠিন কাজ
করা যায়। আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব
প্রতিষ্ঠার কাজটি কঠিন, কিন্তু জরুরি। আওয়ামী লীগই পারে যোগ্যতা
এবং মেধার ভিত্তিতে আমলাতন্ত্রের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। এতে সিংহভাগ সরকারি
কর্মচারী খুশি হবেন। সরকার
গুটিকয়েক সুবিধাবাদী চাটুকার আমলাদের হাতে জিম্মি থাকবে
না। মেধাবী, স্মার্ট আমলাতন্ত্র গড়তে—এ সিদ্ধান্ত
নিতে হবে এখনই। তার
জন্য প্রথম পদক্ষেপ হবে চাকরি শৃঙ্খলা
বিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। আমলাদের আওয়ামী লীগে রূপান্তর বন্ধ
করা।
লেখক
: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল :
poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার রিপোর্ট বাংলাদেশ ভারত বাংলাদেশের নির্বাচন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
শেখ হাসিনা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্বতন্ত্র প্রার্থী
মন্তব্য করুন
৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন। শেষদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমরের
‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা। কারাগার থেকে বেরিয়েই এ বিএনপি নেতা যেভাবে ঝালকাঠিতে
আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন, তা বিস্ময়কর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত,
রওশন এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, রেকর্ড পরিমাণ স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগে
চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়া ইত্যাদি সবই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী
কৌশল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে চায়। ভোট
উৎসব করতে চায়। সেজন্যই এতসব আয়োজন। বিএনপি এবং তার মিত্রদের বাদ দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু
ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার রাজনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত কি আওয়ামী লীগ সফল হবে? নাকি
এ কৌশল তাদের জন্য হবে বুমেরাং? এ কৌশলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?
বিএনপি-জামায়াত অংশ না নিলেও এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএমসহ অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল। দল এবং স্বতন্ত্র মিলিয়ে ৩০০ আসনে প্রার্থী হয়েছে ২ হাজার ৭৪১ জন। প্রায় ৮০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীই ৪০০-এর ওপর। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো হচ্ছে না। ওই নির্বাচনে বিনা ভোটে এমপি হওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের তাণ্ডব, নাশকতার কারণে শেষ পর্যন্ত জনগণ এবং বহির্বিশ্ব এ নির্বাচন মন্দের ভালো হিসেবে মেনে নেয়। ওই সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করে। এবার দেশি-বিদেশি সবাই ২০১৪-এর মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সেজন্য ক্ষমতাসীনদের সতর্ক করেছিল। আওয়ামী লীগ সভাপতিও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের গণভবনে ডেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিনা ভোটে এমপি হওয়া যাবে না। প্রত্যেক আসনে ‘ডামি প্রার্থী’ দেওয়ার কৌশলের কথাও তিনি দলের নেতাকর্মীদের জানিয়েছিলেন। ব্যস, আওয়ামী লীগের এমপি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর সবাই এটাকে সবুজ সংকেত হিসেবে মনে করেন। দলীয় মনোনয়ন যারা পাননি তারা ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হওয়াটাকে পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর বাম্পার ফলন হয়েছে এই নির্বাচনে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও বুঝতে পেরেছেন এভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিস্ফোরণ দলের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এরপর থেকে বারবার বলছেন, যথেচ্ছভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া যাবে না। দল ঠিক করে দেবে কে স্বতন্ত্র প্রার্থী হবে। দলের সিদ্ধান্ত না মানলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সারা দেশে আওয়ামী লীগের ‘চেইন অব কমান্ড’ রীতিমতো ভেঙে পড়েছে। নির্বাচন হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগ ‘এ’ টিম আর আওয়ামী লীগ ‘বি’ টিমের লড়াই। কোথাও কোথাও ‘সি’ টিম, ‘ডি’ টিমও আছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার পর্যন্ত সময় আছে। এর মধ্যে যদি ক্ষমতাসীনরা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে না পারে, তাহলে সমূহ বিপদ। এর ফলে বহু আসনে নৌকা প্রার্থীর বদলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের বিজয়ী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ অবশ্য মনে করতেই পারে যেই জিতুক, এমপি তো শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের। কিন্তু এর সুদূর প্রসারী তাৎপর্য হবে ভয়াবহ। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকাতেই আওয়ামী লীগ হয়ে পড়বে বিভক্ত। একপক্ষ অন্যপক্ষের সঙ্গে মারামারি, খুনোখুনি করবে। একে অন্যের চরিত্র হনন করবে। সারা দেশে সংগঠনে সৃষ্টি হবে বিশৃঙ্খলা। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমপি হবেন, তখন তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো হবে কঠিন। কেউ মন্ত্রী হতে চাইবেন, কেউ বিক্রি হবেন। কেনাবেচার বাজারে তারা আওয়ামী লীগের ওপরই যে চাপ সৃষ্টি করবেন না, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে?
এবার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোটগত ঐক্য নিয়ে
এখন পর্যন্ত একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে। একমাত্র হাসানুল হক ইনু ছাড়া ১৪ দলের আর কোনো
নেতার আসন সংরক্ষিত নয়। ২০০৮-এর নির্বাচন থেকে গত তিনটি নির্বাচনী আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে
করেছে। মহাজোট এবং ১৪ দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোটের অংশ। জাতীয় পার্টি ছাড়া মহাজোটের
শরিক অন্য সব দলই নৌকা প্রতীকে গত তিনটি নির্বাচন করেছে। এবার কী হবে? যদিও আওয়ামী
লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৪ দলের শরিকদের জন্য তারা আসন ছেড়ে দেবে। মনোনয়ন প্রত্যাহার
পর্যন্ত সময় আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে কটি আসন দেবে, তা কি ১৪ দলের শরিকরা মানবে?
এ নিয়ে মনোমালিন্য, মান-অভিমান, তিক্ততার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। ১৪ দলের শরিক বাংলাদেশের
ওয়ার্কার্স পার্টির কথাই ধরা যাক। দলটির প্রধান নেতা রাশেদ খান মেননের আসনে আওয়ামী
লীগ মনোনয়ন দিয়েছে দলের জনপ্রিয় নেতা বাহাউদ্দিন নাছিমকে। আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই মেননকে
বরিশালের একটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তাব দেবে। ওই আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী
আছেন। আছেন বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার
করবেন, কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কেন দলীয় সিদ্ধান্ত মানবে? আওয়ামী লীগের
স্থানীয় সংগঠন কি মেননের জন্য কাজ করবে, না বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য কাজ করবে? রাজশাহীতে
ওয়ার্কার্স পার্টির আরেক নেতা ফজলে হোসেন বাদশার আসনেও হবে একই নাটক। এ লেজে-গোবরে
অবস্থায় যদি আওয়ামী লীগের শরিকরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়, তাহলে আমি অবাক হব না।
সেটা হবে এ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার আরেক সংকট। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের নেতারা
ভালো করেই জানেন ভোটের বাজারে তারা মূল্যহীন। আওয়ামী লীগের প্রতীক এবং কর্মী-সমর্থকরাই
তাদের ভরসা। সেই ভরসাতেও অপমান, উপেক্ষা সহ্য করে তারা অনেকটাই চাকরবাকরের মতো জোটে
আছেন। কিন্তু এবার সত্যি তাদের একটা অপমানজনক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ
সভাপতি বড় উদারতা না দেখালে জোট নিয়ে এক অস্বস্তিতে পড়বে আওয়ামী লীগ। আলাদা আলাদা নির্বাচনের
যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা তাকে বন্ধুহীন করতে পারে।
জাতীয় পার্টির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল, ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের আচরণ, কথাবার্তা সবই ছিল সন্দেহজনক। গত দুই বছর ধরেই তিনি কখনো বিএনপির চেয়ে বড় বিরোধী দল, কখনো সুশীলদের চেয়েও বড় বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতেন। এ কারণেই সরকার ‘রওশন এরশাদ’কে একান্ত আপনজন করে রাখত। নির্বাচনের তপসিল ঘোষণার পর জাতীয় পার্টি যখন নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কালক্ষেপণ করছিলেন, তখন রওশন এরশাদই ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন। তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জি এম কাদেরকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন। নির্বাচনমুখী নেতাদের সামলাতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এতে নিশ্চয়ই সরকার খুশি হয়েছে। জি এম কাদেরের সঙ্গে সরকারের বোঝাপড়া এবং সমঝোতার কারণেই রওশন এরশাদ জাপায় মাইনাস হয়ে গেলেন বলে আমি মনে করি। কিন্তু জি এম কাদেরের প্রতি আওয়ামী লীগের আস্থা কি ঝুঁকিপূর্ণ নয়? জি এম কাদেরকে আস্থায় আনতে যেভাবে রওশন এরশাদকে টিস্যু পেপার বানানো হলো, তার ফল খারাপও হতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কী করেছিলেন, তা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ ভুলে যায়নি। ওই নির্বাচনে রওশন এরশাদই শেষ রক্ষা করেছিলেন। এবার জি এম কাদের যে এরশাদের পথে হাঁটবেন না, তা কে বলবে। সেরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হলে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী মাঠে কে ধরে রাখবে? জাতীয় পার্টি নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশল কি ঝুঁকিপূর্ণ হলো না?
এবার নির্বাচনের আগে দুটি ‘কিংস পার্টি’ বেশ সরব হয়েছিল। একটি তৃণমূল বিএনপি, অন্যটি বিএনএম। দুটি দলেরই প্রধান টার্গেট ছিল বিএনপি থেকে লোক ভাঙানো। দুটি দলই ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো দলই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। বিএনপি থেকেও বড় কোনো নেতা এসব দলে যোগ দেননি। এখন এই দুটি দল আওয়ামী লীগের দায়ে পরিণত হয়েছে। এরা ভোটে নয়, সমঝোতায় এমপি হতে চায়। সরকার তাদের ভোটে জিতিয়ে সংসদে আনবে এমন প্রত্যাশায় এরা নির্বাচনে এসেছে। এসব দলের যে সাংগঠনিক অবস্থা এবং প্রার্থীদের যোগ্যতা তাতে দুয়েকজন ছাড়া আর কেউ ভোটের মাঠে জামানত রাখতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ। এদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে সরকারকে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’ করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ভালো করেই জানে, এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করাটা কতটা জরুরি। ছোটখাটো অনিয়মও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করবে। গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক মহল নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। কাজেই এত বড় ঝুঁকি সরকার বা আওয়ামী লীগ কি নেবে? আবার ভালো নির্বাচনে এরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে, আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করবে।
আওয়ামী লীগ কেন শাহজাহান ওমরকে দলে ভেড়াল? এ থেকে আওয়ামী লীগ কী পেল? আদর্শহীন ব্যক্তিকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে ক্ষমতাসীনরা কি প্রমাণ করল না, তারাও ভাঙাগড়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের এরকম প্রক্রিয়ার যুক্ত হওয়া কি শোভন। এই কৌশলে কি লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হলো না?
নির্বাচন প্রসঙ্গ এলেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে। সব দল অংশগ্রহণ করার পরও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে ওই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রধান কারণ ছিল প্রার্থী এবং প্রশাসনের যোগসাজশ। অতি উৎসাহীদের দায়িত্বহীন কাণ্ড। এবার নির্বাচন অনেকটাই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ লড়াই। বিরোধীরা এ নির্বাচনে তৃতীয়পক্ষ। তাই এ নির্বাচনে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষ থাকার বিরাট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাউকে জেতাতে বা হারানোর দায় নেই কারও। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র, যারা প্রার্থী তারা সবাই প্রভাবশালী। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রার্থীরা নানাভাবে ঘনিষ্ঠ। ক্ষমতার শক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা কি শেষ পর্যন্ত জনগণের মতামতের ওপর নির্ভর করবে, না জয়ী হতে সব অপকৌশল প্রয়োগ করবে?
আগামী কয়েকটা দিন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তপসিল ঘোষিত হয়েছে, মনোনয়নপত্র দাখিলও হয়েছে, কিন্তু নির্বাচন এখনো অনেক দূরের পথ। এ পথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি আছে, তা সামাল দিতে পারবে আওয়ামী লীগ? আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল কি পারবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ঠিকানায় দেশকে নিয়ে যেতে?
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা নির্বাচন
মন্তব্য করুন
জি এম কাদের জাতীয় পার্টি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তৃণমূল বিএনপি বিএনএম শাহ্ জাফর
মন্তব্য করুন
আগামী ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে কি হতে পারে বাংলাদেশের ওপর তা নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলাপ আলোচনা। যদিও সরকার প্রকাশ্যে বলছে, ১০ ডিসেম্বর কিছুই হবে না। নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন নিষেধাজ্ঞা বা অন্য কিছু আরোপ করবে না। কিন্তু কূটনীতিকপাড়ায় এ নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে সমস্ত এমপিরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা তাদের এলাকা সাজিয়ে ছিলেন নিজেদের মতো করে। থানাগুলোর ওসি দিয়েছিলেন নিজের পছন্দের, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিয়েছিলেন একান্ত বিশ্বস্ত ও অনুগত। এমনকি ডিসি, এসপি পর্যন্ত নিজেদের বশীভূত রাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তারা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন এই সমস্ত এমপিদের নির্বাচনী সাজানো বাগান তছনছ করে দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন এই সমস্ত এমপিরা।
এবার নির্বাচনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। প্রায় ৮০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। তাতে কি! যারা বাতিল হয়েছে তারাও আপিল করেছেন আর যে ৭০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের জন্য প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন তারা এবার নির্বাচনে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
৩০ নভেম্বর ছিল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষদিন। শেষদিনের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বিএনপি নেতা শাহজাহান ওমরের ‘নৌকা’ প্রতীকে নির্বাচন করার ঘোষণা। কারাগার থেকে বেরিয়েই এ বিএনপি নেতা যেভাবে ঝালকাঠিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেন, তা বিস্ময়কর। শাহজাহান ওমরের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত, রওশন এরশাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়া, রেকর্ড পরিমাণ স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগে চার শতাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দেওয়া ইত্যাদি সবই ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী কৌশল। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি আগামী নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে চায়। ভোট উৎসব করতে চায়। সেজন্যই এতসব আয়োজন। বিএনপি এবং তার মিত্রদের বাদ দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার রাজনৈতিক কৌশলে শেষ পর্যন্ত কি আওয়ামী লীগ সফল হবে? নাকি এ কৌশল তাদের জন্য হবে বুমেরাং? এ কৌশলে আওয়ামী লীগের লাভ হলো না ক্ষতি?
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি একটি ভিন্ন ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে কারা বিজয়ী হবে তা নিয়ে কারোরই কোন সন্দেহ নেই। বিএনপি-জামায়াত জোট যখন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না তখন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ে একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আওয়ামী লীগ যে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে এবং সরকার গঠন করতে যাচ্ছে, এটি নিয়ে কারও কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে মজার যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হল কারা প্রধান বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় সংসদের দায়িত্ব পালন করবে। শেষ পর্যন্ত যদি ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হয় তাহলে এই নির্বাচনী লড়াইয়ের প্রধান আকর্ষণ হবে কে হতে যাচ্ছে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল?