এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচন বনাম অনির্বাচিত সরকার

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ১৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

গত ১৫ নভেম্বর বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন। এবার জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করা হলো এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে। তফসিলের দিন বিএনপি অবরোধ ডেকেছিল। তফসিল ঘোষণার পরদিন ১৬ নভেম্বর কয়েকটি বাম দল হরতাল ডাকে। যদিও এসব অবরোধ এবং হরতাল এখন আর কেউ মানে না, কিন্তু জনমনে কিছুটা হলেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। বিএনপি নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখান করেছে। বিএনপির সাথে সুর মিলিয়ে কিছু সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলও এই নির্বাচনী তফসিলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে তফসিল ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনন্দ মিছিল করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনী তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছেন। 

গত ২৮ অক্টোবর থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সহিংস আন্দোলন করেছে বিএনপি। ২৮ অক্টোবর থেকেই পুরনো রূপে ফিরে গেছে দীর্ঘ ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে হত্যা করা, হাসপাতাল হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা কোন রাজনৈতিক দলের কাজ নয়। কিন্তু বিএনপি এরকম সন্ত্রাসী তৎপরতাই বেছে নিয়েছে দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু এপথে যে দাবি আদায় বা সরকারের পতন হবে না এটি বোঝার জন্য পন্ডিত হবার দরকার নেই। শুরুতেই বিএনপির আন্দোলন মুখ থুবড়ে পরেছে। বলা হচ্ছিল তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে বিএনপি চমক দেখাবে। সারাদেশ অচল করে দেবে। কোন কোন গণমাধ্যমে বিএনপি অসহযোগ আন্দোলনের যেতে পারে বলেও খবর দিচ্ছিল। কিন্তু জনগণ সমর্থন না দিলে কঠোর আন্দোলন যে নির্মম কৌতুকে পরিণত হয়, বিএনপির এবারের আন্দোলন তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। বিএনপি অবশ্য নিজেদের শক্তিতে কিংবা জনগণের সমর্থনে সরকার পতনের খোয়াব দেখেনি। বরং তারা মনে করতো কোন ম্যাজিক হবে। সাত-সমুদ্দুরের ওপার থেকে কোন দেবদূত আওয়ামী লীগের কল্লা ছিঁড়ে খাবে। গত দুবছর ধরেই এমন আলামত দেখা যাচ্ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উপর নাখোশ এমন একটি মনোভাব গত দুবছর ধরেই গুঞ্জারিত হচ্ছিল আকাশে-বাতাসে। 

গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। র‌্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘোষণা করেছে ভিসানীতি। গত সেপ্টেম্বরে এই ভিসানীতি কার্যকর হয়েছে বলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়। এই সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে ঢাকায় এসেছেন একাধিক মার্কিন প্রতিনিধি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহে আওয়ামী লীগ উৎকণ্ঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি সহ একাধিক নেতা বিরক্তি প্রকাশ করতেও কার্পণ্য করেননি। অনেকেই মনে করেন, এবার যুক্তরাষ্ট্র দেখে নেবে। ২০১৪ কিংবা ২০১৮’র মতো কোন নির্বাচন যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কত প্রকার ও কি কি নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে তার তালিকা বুক পকেটে নিয়ে অনেকে টকশোতে তোলপাড় করেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ কেউ বাংলাদেশে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চায়। এই যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা তখন তাদের একান্ত অনুগত সুশীল এবং বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। তারা তো আরেকটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসছে এই খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিলেন। সুশীলদের কেউ কেউ নতুন স্যুট টাই পর্যন্ত কিনে ফেলেছিলেন। কিন্তু এতো আয়োজন, এতো মহড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে কিংবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে শেখ হাসিনাকে টলাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সংবিধান সম্মত ভাবে নির্বাচনের প্রশ্নে অটল থেকেছে। নানা প্রলোভন হুমকি উপেক্ষা করেছে। শেখ হাসিনা যদি এরকম দৃঢ় এবং আত্মপ্রত্যয়ী না থাকতেন, তাহলে হয়তো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাই হতো না। দেশ এক অনিশ্চয়তার অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করতো। বিশেষ করে নির্বাচন তফসিল ঘোষণার আগে পিটার হাসের তৎপরতায় অনেকে শঙ্কিত হয়েছিলেন। ডোনাল্ড লু এর চিঠি নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তফসিল ঘোষণার দিন সকালেও গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অফিসে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছিল সংলাপ না তফসিল কোনটা আগে। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা সুখের নয়। নির্বাচনের তফসিল পেছানো, তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন না হওয়া বাংলাদেশে নতুন নয়। 

২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিও একটি জাতীয় নির্বাচন হবার কথা ছিলো। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন আগে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে। নির্বাচন পিছিয়ে যায় দুই বছর। কাজেই তফসিল ঘোষণা মানেই নির্বাচন হয়ে যাবে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আগামী ৫০ দিন বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। খেলা শেষ হয়ে গেছে বলে যদি কেউ মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আসলে খেলা শুরু হলো। আগামী ৫০ দিন এদেশে অনেক কিছুই ঘটতে পারে। বিএনপির হরতাল অবরোধ কেউ মানছে না, তাই তারা হাল ছেড়ে দেবে— এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। ইতোমধ্যেই তারা আন্দোলনকে সন্ত্রাসের চোরাগলিতে নিয়ে গেছে। সামনে তারা চোরাগুপ্তা হামলা, টার্গেট কিলিং বাড়াবে, এটা নিশ্চিত। তাদের অনেক ক্যাডাররাই ঘাপটি মেরে বসে আছে বলে খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে, দীর্ঘ ৫ বছর পর বিএনপি-জামায়াতের প্রকাশ্য প্রেম নতুন শঙ্কা তৈরী করেছে। জামায়াত একটি সশস্ত্র ক্যাডার ভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক গুলো জঙ্গি সংগঠনের জন্ম হয়েছে। এরা যে মাঠে নামবে না, তা কে নিশ্চিত করে বলতে পারে। নির্বাচনের আগে বড় ধরনের নাশকতা করে বিএনপি-জামায়াত যে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করতে পারে, এই আশঙ্কা অমূলক নয়। জনগণের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করা হবে। ভয়ে এবং অনাগ্রহে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে যাবে না। নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ। তখনই পশ্চিমারা হৈ চৈ শুরু করবে। নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেবে না। সৃষ্টি হবে গ্রহণযোগ্যতার সংকট। এমন পরিকল্পনার কথাও কান পাতলেই শোনা যায়। জাতীয় পার্টি যদি নির্বাচন প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত বিভক্ত হয়, তাহলে ভোট উৎসব আরো বিবর্ণ হবে। যারা বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, তাদের টার্গেট ভোটকে তামাশা বানানো। এই নির্বাচনে এরকম এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা হবে। এরকম ঘটনা ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে তারা হস্তক্ষেপে প্ররোচিত করবে তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কি এতো সহজে হাল ছেড়ে দেবে? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নির্বাচন হবে আর যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে? যুক্তরাষ্ট্র চুপ-চাপ থাকাও অনেক সময় বিপদজ্জনক। 

গত ১০ নভেম্বর দিল্লীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠক হয়েছে। সেখানে দুই প্রভাবশালী দেশ একমত হয়নি। তাই তফসিল ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতার ভয়ঙ্কর অর্থও থাকতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কি করবে, তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আগামী নির্বাচন শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে হওয়া না হওয়া অনেকটাই নির্ভর করবে মার্কিন মনোভাবের উপর। বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন কৌশলের উপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রাম এখন আমাদের একার নয়। ৭১ এর বন্ধুরাও আছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এই লড়াইয়ে কে জেতে তা জানার জন্য অপেক্ষা কতে হবে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত। এখন যুদ্ধটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগকে সতর্ক থাকতে হবে। অতি উৎসাহীরা যেন ভোট কারচুপি বা বিনা ভোটে এমপি হবার আত্মঘাতী চেষ্টা না করেন, সেজন্য সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন নিয়ে দেশ দুই ভাগে বিভক্ত। একপক্ষ চায় অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে। আবার অসাংবিধানিক যুগে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে। এজন্য তারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে। অন্যপক্ষ চায়, গণতন্ত্র এবং সংবিধান সুরক্ষা করতে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এখন আর কোন দলের জয় পরাজয়ের বিষয় নয়। গণতন্ত্র থাকা না থাকার নির্বাচন।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

মান্না কেন বড়শিতে বিঁধলেন না

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

প্রায় দু সপ্তাহ নীরব থাকার পর মাহমুদুর রহমান মান্না আবার সরব হয়েছেন। আবার রাস্তায় এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত দু সপ্তাহ তিনি কোথায় ছিলেন? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, এ সময় মান্না সরকারের সাথে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দেন দরবার করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেন দরবারের রফা হয়নি। সেই কারণেই মান্না এখন আবার সরব হয়েছেন। আবার বিরোধী দলের লড়াকু সৈনিক হিসেবে মাঠে নেমেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না যা চেয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। 

তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, একদিকে যেমন মান্না সরকারের সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন, অন্যদিকে লন্ডনে পলাতক তারেক জিয়ার সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। তারেক জিয়ার যে টোপ সেটি বেশি মাত্রায় লোভনীয় হওয়ার কারণে তিনি সরকারের টোপ গেলেননি। আর এ কারণেই মাহমুদুর রহমান মান্না আবার আগের অবস্থানে ফিরে গেছেন। 

২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডব, নাশকতার পর বিএনপি ব্যাকফুটে চলে যায় এবং এই ব্যাকফুটে যাওয়ার পর থেকেই বিএনপির কোনো কোনো নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করে। বিএনপির শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে গেলে সামনে চলে আসেন মাহমুদুর রহমান মান্না। মাহমুদুর রহমান মান্না নিজে থেকেই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এবং নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চান এমনটাই বলেছিলেন। এরপর সরকারের সঙ্গে তার কয়েক দফা বৈঠক হয়, যেসব বৈঠকে মান্না নির্বাচনকালীন সরকারে তার মন্ত্রিত্ব, বগুড়ার একটি আসনে তার নিশ্চিত বিজয় সহ আরও বেশ কিছু দাবিদাওয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার থেকে তাকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় যে, নির্বাচনকালীন সরকারে অনির্বাচিত কোন মন্ত্রীদের রাখার সুযোগ নেই। 

দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে বগুড়া আসন থেকে তিনি জিতবেন কি জিতবেন না এটি সম্পূর্ণ ভাবে নির্ভর করে ভোটারদের অভিপ্রায়ের ওপর। ভোটাররা যদি ভোট না দেন তাহলে সরকার কাউকে জিতিয়ে আনতে পারে না। অন্যদিকে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে হাতছাড়া করতে চাননি লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া। আর এ কারণেই মান্না যেন শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে থাকেন এই জন্য তাকে লোভনীয় অফার দেওয়া হয় এবং ভবিষ্যতে তার জন্য অনেকগুলো সুখবর আছে এমন আশ্বাসও দেওয়া হয়। সবকিছু হিসাব নিকাশ মিলিয়ে মান্না শেষ পর্যন্ত তারেক জিয়ার বড়শিতে বিদ্ধ হচ্ছেন এমন কথা রয়েছে। 

মান্না অবশ্য সরকারের বড়শিতে বিদ্ধ না হওয়ার একটি বড় কারণ ছিল যে তিনি যেভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন বা বিএনপি নির্বাচনে আসবেন বলে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। কারণ বিএনপির মধ্যে একটি বড় অংশ আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত দেখা এবং নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করার নীতিতে বিশ্বাসী। দলছুট হয়ে কেউই ঝুঁকি নিতে চাননি এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত হতে চাননি। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা দেখেছেন, যারা বিএনপি ছেড়ে চলে গেছেন তারাই রাজনীতিতে এতিম এবং পরিত্যক্ত হয়েছে। এ কারণেই বিএনপির মধ্যে যারা নির্বাচন করতে আগ্রহী, তারাও ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পাননি। আর এ কারণেই শেষ পর্যন্ত মান্নার মিশনও ব্যর্থ হয়েছে। মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি আবার বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু মান্নারা সব সময় সুযোগসন্ধানী। সুযোগের রাজনীতি তাদের কাছে শুধু মাত্র কিছু পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। যখন তার পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মেলেনি, তখন তিনি আর সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় যাননি। নিশ্চয়ই সরকারের কাছ থেকে তিনি যা পেতেন তার চেয়ে বেশি পেয়েছেন লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে।

মাহমুদুর রহমান মান্না  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

নির্বাচনের মাঠে ‘কোরবানির হাট’

প্রকাশ: ০৯:৫৪ এএম, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’

সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।

বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।

এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।


সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com


কল্যাণ পার্টি   নির্বাচন   আওয়ামী লীগ  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

রাজনীতিকে দূষণমুক্ত করার এখনই সময়

প্রকাশ: ১১:০০ পিএম, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনামুক্ত এবং দূষণমুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। 

৭৫ এর আগস্ট ট্রাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুটি ধারায় বিভক্ত করেছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ধারা, অন্যটি স্বাধীনতাবিরোধী ধারা। পৃথিবীর কোন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে বিভক্ত থাকে না। একটি দেশের অস্তিত্ব, অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের আদর্শগত বিরোধ আছে, থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে তারা একমত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিক যারাই ক্ষমতায় থাকুক, দেশটির ইসরায়েল নীতির পরিবর্তন হয় না। ভারতে কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে মতপার্থক্য অনেক। কিন্তু, কানাডা প্রশ্নে তারা অভিন্ন। কাশ্মীর ইস্যুতেও তাদের মৌলিক বিরোধ নেই। বিজেপি-কংগ্রেস উভয় দলই পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি ভয়ংকরভাবে বিভক্ত। এই দেশের রাজনীতি এমন যে, একটি বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে অস্বীকার করে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টকে উৎসবের দিন বানিয়ে কুৎসিত উৎসব করে। এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দুইভাবে ব্যাখ্যা করে। ৭১-এ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, সেই রাজাকার, আল-বদর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করে একটি দল। স্বাধীনতাবিরোধী ধারাকে বিকশিত করাই যেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য। মৌলিক প্রশ্নে এই বিভক্তি রাজনীতিকে যেমন জটিল করেছে, তেমনি দেশকেও করেছে বিভক্ত। 

বাংলাদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে। আদর্শের পার্থক্য থাকবে, মতভেদ থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে সবাই থাকবে একমত। জাতির পিতাকে নিয়ে কেউ বিতর্ক করবে না। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নেবে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। এই মৌলিক প্রশ্নে একমত থেকে নানা মত ও পথের রাজনীতি দেশের গণতন্ত্রকে বিকশিত করবে। এটাই আমাদের ঐক্যের সূত্র। কিন্তু ৭৫ এর পর জিয়ার বিভাজনের রাজনীতি, স্বাধীনতাবিরোধীদের কেবল পুনর্বাসিত করেনি, শক্তিশালীও করেছে। এই ধারার মূল দল বিএনপি। 

বিএনপি নামের সংগঠনটি যতদিন থাকবে, ততদিন ‘বাংলাদেশ’ এক হতে পারবে না। দেশের মৌলিক প্রশ্নে ঐক্যমত ছাড়া একটি জাতি কখনো তার অভীষ্ট অর্জন করতে পারে না। ২০০৮ এর নির্বাচনে এদেশের জনগণ ঐক্যের পক্ষে রায় দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিল। ঐ নির্বাচনের পর থেকে আস্তে আস্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে হাটছে বাংলাদেশ। বিভাজনের দেয়াল উপড়ে ফেলছে জনগণ। যুদ্ধপরাধীদের বিচার হয়েছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে এখন আর কেক কেটে ভুয়া জন্মদিন পালনের বিভৎস উৎসব হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বিএনপি’ নামের বিষফোঁড়া যতদিন থাকবে ততদিন ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারবো না। গত ১৫ বছর ভুল রাজনীতির চোরাগলিতে গিয়ে বিএনপি এখন মুমূর্ষু। ২৮ অক্টোবর আত্মঘাতি আন্দোলন দলটিকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। এখন অবরোধ-হরতালের মতো গণবিরোধী কর্মসূচির কারণে বিএনপি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। কিছু অবুঝ বিভ্রান্ত কর্মী-সমর্থকদের কারণে দলটি এখন লাইফ সাপোর্টে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে গেছে। নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেরাই পড়েছে। বিএনপি ভেবেছিল, তারা নির্বাচন না করলেই বোধ হয় একতরফা নির্বাচন হবে। ২০১৪’র নির্বাচনের মতো ঘটনা ঘটবে। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। বিএনপিকে ছাড়াই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, যুক্তফ্রন্টসহ নানা দল এখন নির্বাচনী মাঠে। শরিকরাও এখন বিএনপিকে গুড বাই জানিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এর ফলে দেশের রাজনীতির বিষাক্ত ধারাকে উপড়ে ফেলার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিভক্তির দেয়াল ভেঙে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এবার এখন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের মধ্যে চমৎকার একটি মিল লক্ষণীয়। সবাই অন্তত মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে। বিএনপি এই নির্বাচনে না আসায় বাংলাদেশের একটা বড় লাভ হলো। এর ফলে মূলধারা থেকে ছিটকে গেল বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা পাপমুক্ত হলো। এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির ধারা। দেশের মৌলিক প্রশ্নে অভিন্ন মতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এদেশকে নিয়ে যাবে নতুন উচ্চতায়। 

তবে, রাজনীতি কুলুষমুক্ত হবে তখনই, যখন আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সুন্দর হওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। এই নির্বাচনও যদি ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে তা হবে এদেশের রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে আবার স্বাধীনতাবিরোধী ধারা শক্তিশালী হবে। পুনর্জন্ম হবে বিএনপির। রাজনীতির শেষ আশার প্রদীপ টুকুও নিভে যাবে। জয়-পরাজয়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর হওয়া জরুরী। একটি ভালো নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তির শেকড় উপড়ে ফেলতে পারে। বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে পারে। 

আরেকটি ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ অক্টোবরের পর মুখ থুবড়ে পড়ে বিএনপির রাজনীতি। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যাবে। এখন সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী উত্তেজনা। এবারের নির্বাচনে শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি আবহ সৃষ্টি হয়েছে। নৌকার পক্ষে একটি জোয়ার উঠেছে। যে সব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তারা সবাই দ্বিতীয় হতে চায়। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সবাই প্রধান বিরোধীদল হতে চায়। আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে, এমনটি স্বপ্নেও ভাবে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তাই রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে। ৭৫ এর পর রাজনীতিতে যে দূষণ তাতে আক্রান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগও। অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য ভোটে জয়ী হতে আওয়ামী লীগকে অনেক আপোষ করতে হয়েছে। আদর্শের বাইরে লোকজনকে মনোনয়ন দিতে হয়েছে। দূর্বৃত্ত, লুটেরারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে হয়েছেন মন্ত্রী, এমপি। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের ভেতর বানের পানির মতো প্রবেশ করেছে হাইব্রিড, চাটুকার, মতলববাজরা। ভাড়াটে রাজনীতিবিদদের অত্যাচারে আওয়ামী লীগ অতিষ্ঠ। গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়নের পরও আওয়ামী লীগের যা বদনাম তা এসব ব্যাংক লুটেরা, অর্থপাচারকারী দূর্বৃত্তদের কারণেই। গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা সত্যিকারের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের সামনে টেনে আনার চেষ্টা করেছেন। এদেরকে বিভিন্ন উপনির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এবারের মনোনয়নে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি মহেন্দ্রক্ষণ। আওয়ামী লীগ যদি এসব অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন না দেয় তাহলে দেশ বাঁচবে, রাজনীতি রক্ষা পাবে। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়। আওয়ামী লীগ কি পারবে?

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তিন কৌশল

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বাংলাদেশ নিয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সরব ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং তারা বাংলাদেশে নির্বাচন সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন, হুমকিও দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে এবং সেই ভিসা নীতি গত সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলেও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর বিএনপি সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং তাণ্ডব করল, সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে যেতে শুরু করে। এরপর অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস নির্বাচন কমিশন সহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন, বৈঠক করেছেন। মার্কিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়েছিলেন, তারা যেন শর্তহীন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।

কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত আর সংলাপ হয়নি। এককভাবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের তফসিলের পর পরই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উড়ে চলে যান। প্রথমে কলম্বো, সেখান থেকে ওয়াশিংটনে। এখন পর্যন্ত তিনি দেশে ফেরেননি। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় এরকম একটি রুটিন বক্তব্য প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছে। আসলে বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল কি এটি নিয়ে কূটনীতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে চলছে নানা রকম আলোচনা। 

কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিনটি কৌশলে এগোচ্ছে। প্রথমত, তারা এখনও গোপনে গোপনে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং এ নিয়ে তারা তাদের মিত্র দেশগুলো অর্থাৎ ইউরোপের দেশগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করছে । ইউরোপের দেশগুলো গত কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এসব বৈঠকের মাধ্যমে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে নিয়ে আসার জন্য একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া হলো যে, বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচন হোক যেখানে সবগুলো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক। অর্থাৎ সোজাসাপটা হলো বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে সেই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক বিবেচিত হবে না বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে বলেছিল। কিন্তু এখন যেহেতু বিএনপি নির্বাচন থেকে নিজেদেরকে সরে রেখেছে নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়েছে, সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন নিয়ে একটি মৌন ব্রত অবলম্বন করছে। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল অব্যাহত রাখবে বলে মনে করছেন কোন কোন কূটনীতিকরা। 

দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রতি আস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে চীনের আধিপত্য বন্ধ দেখতে চায়। বাংলাদেশের বাজার চায়, বঙ্গোপসাগরে হিস্যা  চায়। এই বিষয়গুলোর জন্যই বাংলাদেশে নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে তারা চাপ সৃষ্টি করছিল বলে কোন কোন কূটনীতিক মনে করেন। আর এই বিষয়টি নিয়ে এখন ভারত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মধ্যস্থতা করছে এবং ভারত সর্বশেষ গত ১০ নভেম্বর টু প্লাস টু সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের অবস্থানের কথা সোজাসাপ্টা ভাবে জানিয়ে দিয়েছে। ভারতের এই অবস্থানের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসলে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু করার নেই এমনটা মনে করছেন কূটনীতিকরা। কারণ ভারতের অবাধ্য হয়ে বাংলাদেশে কিছু করলে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ বয়ে আনবে না। আর তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো তা ভারতকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত তাদেরকে আশ্বস্ত করেছে যে নির্বাচনের পর বিষয়গুলো দেখা হবে। এরকম একটি কৌশল থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনটাই মনে করছেন কোন কোন মহল। 

তৃতীয়ত, অনেকে মনে করছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যে বিরাজনীতিকরণ এবং তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টা করছিল তা এখনও অব্যাহত রয়েছে। তারা আসলে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করছে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভুল করবেই, অতি উৎসাহীরা কারচুপি করবেই—এরকম ভুলের অপেক্ষায় আছে যুক্তরাষ্ট্র। এ রকম ভুল হলেই ভিসা নীতি সহ নানা রকম সাঁড়াশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে যে ব্যবস্থাগুলো আওয়ামী লীগকে বিপর্যস্ত করবে এবং হয়তো শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হবে। এই তিন কৌশলের যে কোন একটি বা একাধিক কৌশল নিয়ে বাংলাদেশে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনটাই মনে করেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশের নির্বাচন   ভারত   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

ভারতের ইচ্ছা কেন মেনে নিলো যুক্তরাষ্ট্র?

প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ২১ নভেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত মুখোমুখি অবস্থানে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতের ইচ্ছারই জয় হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অভিপ্রায় মেনে নিল। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এতদিনের যে আগ্রহ ছিল তা গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন সেদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তারা চায়, বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়িত হোক। এটুকু প্রত্যাশা সকল দেশের, সকল বন্ধুরাষ্ট্রের এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে তাদেরও। আর তাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সহনীয় এবং সহনশীল অবস্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তনের হাওয়া সূচনা করেছে। 

প্রশ্ন হলো যে, ভারতে অভিপ্রায় যুক্তরাষ্ট্র কেন মেনে নিল? বিভিন্ন কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে টলটলয়মান জো বাইডেন প্রশাসন যদি ভারতে সঙ্গে বাংলাদেশের মতো ইস্যু নিয়ে একটি দূরত্ব তৈরি করে তাহলে তা পুরো বিশ্ব কূটনীতিতে রেখাপাত করতো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি কূটনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়তো। এ কারণেই তাদের সামনে যে বিকল্প ছিল সে বিকল্পের মধ্যে তারা ভারতের সহাবস্থানের নীতি বেছে নিয়েছে। 

যেসব কারণে ভারতের জয় হলো বাংলাদেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের নীতি মেনে নিলো। তার মধ্যে রয়েছে- 

১. মধ্যপ্রাচ্য ইস্যু: মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একলা হয়ে গেছে। এমনকি ইউরোপের দেশগুলো পর্যন্ত ইসরায়েলের আগ্রাসন এবং সামরিক তৎপরতাকে পছন্দ করছে না। এই পরিস্থিতির মধ্যে একমাত্র ভারতই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে এবং ইসরায়েলের ব্যাপারে সহানুভুতি দেখাচ্ছে। গাজা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান অনেকটাই নমনীয়। আর এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখন একমাত্র শক্তি। আর তাই ভারত যেখানে বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনরকম ছাড় দিতে রাজি নয়, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ নিয়ে নাক গলানোর নীতি থেকে সরে আসতে এক প্রকার বাধ্যই হলো। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির অনেকখানি নির্ভর করে। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায়নি একলা হয়ে যেতে। তাই তারা ভারতে সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে চেয়েছে।

২. চীনের আধিপত্য: শেষ পর্যন্ত যদি উপমহাদেশে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্য বিরোধে জড়াতো তাহলে এই অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হতো চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা ও অন্যান্য বিধি-ব্যবস্থা কায়েম করতো, সেক্ষেত্রে লাভবান হতো চীন। কারণ, এর ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য আরও চীনের দিকে ঝুকে পড়তো। ফলে ভারতের সঙ্গে সহমত পোষণ করা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আর কোন বিকল্প ছিল না।

৩. বাংলাদেশের বাজার: শেষ পর্যন্ত যদি ভারতে সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ এই নির্বাচন করে ফেলতো তাহলে বাংলাদেশের কূটনীতি হতো রাশিয়া, চীন এবং ভারতকেন্দ্রীক। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মতো একটি বড় বাজার হারাতো। বাংলাদেশ একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। এই বাজার যুক্তরাষ্ট্র কখনোই হারাতে চায়নি। 

৪. বিএনপির অপতৎপরতা: বিএনপির রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ দিকে কিছুটা বিরক্তই হয়েছে। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তারা যে ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে সেই ঘটনা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পথ এটি নয়। আর এই কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, বিএনপি তাদের সঙ্গে কথা রাখেনি। এই কারণেই তারা নির্বাচনের ব্যাপারে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে। 

৫. বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা: বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে সেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কোনভাবেই এ দেশের জনগণ ইতিবাচকভাবে নেয়নি। এটিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুভব করেছে। আর, এ কারণেই তারা শেষ পর্যন্ত ভারতের পরামর্শ শুনে বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে একটি নিরাপদ দূরত্বের অবস্থানে নিজেদেরকে প্রতিস্থাপিত করেছে। পাশাপাশি একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ, গত এক বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত যে কূটনীতি করেছে, সে কূটনীতির একটি বিজয় অর্জিত হলো বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে।

বাংলাদেশের নির্বাচন   ভারত   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন