মানুষ ভবিষ্যৎ নিয়ে যা কল্পনা করে, তা সবসময় সঠিক হয় না। এই যেমন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের কথাই ধরা যাক। আমি ভেবেছিলাম, বুধবার (১৫ নভেম্বর) জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর তার ব্যস্ততা বাড়বে। তিনি ছুটে যাবেন নির্বাচন কমিশনে। মার্কিন দূতাবাসে ডেকে নেবেন রাজনৈতিক নেতাদের। ব্যস্ত সময় কাটাবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, পিটার হাস গেলেন ছুটিতে। কতদিনের ছুটি, কবে ফিরবেন কেউ ঠিকঠাকমতো বলতে পারে না। অনুমান করা যায়, ২৩ নভেম্বর থ্যাঙ্কসগিভিং ডে পালন করে তিনি দেশে ফিরবেন। ততদিনে পদ্মা মেঘনায় অনেক জল গড়াবে। অথচ তপশিল ঘোষণার আগপর্যন্ত তিনি ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। তপশিল ঘোষণার দিন সকালবেলাই তিনি সচিবালয়ে ছুটে যান। ডোনাল্ড লুর চিঠি পৌঁছে দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের হাতে। ওই চিঠিতে শর্তহীন সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর দুদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেখা করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে। ওই সাক্ষাতের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
২৮ অক্টোবর বিএনপির তাণ্ডবের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত শর্তহীন সংলাপ ইস্যু সামনে এনেছিলেন। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকের পর গণমাধ্যমের কাছে সংলাপের ট্রিজার অবমুক্ত করেন পিটার হাস। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের মরচেধরা নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গেও পরীবাগে গিয়ে বৈঠক করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বিরামহীনভাবে নাক গলানো এ রাষ্ট্রদূতের তৎপরতায় জনগণের দৃষ্টি ছিল। বিএনপির নেতারাও ছিলেন আহ্লাদে আটখানা। পিটার হাসের ‘ম্যাজিক’ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন আমাদের সুশীল সমাজ। বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ তো কিছুদিন আগে থেকেই মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ‘অবতার’ মানছিলেন। কারাবন্দি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাখঢাক ছাড়াই বলেছিলেন, ‘বিদেশিদের তৎপরতা আমাদের সাহস জোগায়।’ বিএনপি নেতারা তো প্রকাশ্যেই বলতেন, পিটার ডি হাস যখন আছেন তখন আমাদের চিন্তা নেই। তাই নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণা করবে আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত তা চুপচাপ বসে দেখবেন, এটা তো হতেই পারে না। তপশিলের পরেই দেখা যাবে অবতারের অগ্নিরূপ। নিষেধাজ্ঞা আসবে, অর্থনৈতিক অবরোধ আসবে, মার্কিন হুংকারে সবকিছু তছনছ হয়ে যাবে। বিএনপি সবসময় বলেছে, ২০১৪-এর মতো নির্বাচন এবার আর যুক্তরাষ্ট্র মেনে নেবে না। ডোনাল্ড লুর দরকার নেই, হাস মহাশয়ই আওয়ামী লীগের ঘাড় মটকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ আশায় বিএনপি দফায় দফায় অবরোধ ডাকছিল। অবরোধ ডেকে টোকাই আর ছিঁচকে মাস্তানদের পেট্রোল বোমা মারার ঠিকাদারি দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। কাউকে কিছু করতে হবে না, যা করার করবেন ‘অবতার’। নির্বাচন কমিশন যখন তপশিল ঘোষণা করলেন, তখন বিএনপি নেতারা নিজেদের অজান্তেই মুচকি হেসেছেন। ভাবখানা এমন, এবার দেখবে অবতারের কারিশমা। কিন্তু কীসের কী, অবতার গেলেন ছুটিতে। ছুটি নিয়েও চলছে লুকোচুরি। এ নিয়ে লুকোচুরির কিছু নেই। একজন ব্যক্তি কিংবা একজন রাষ্ট্রদূত ছুটিতে যেতেই পারেন। তারও বিশ্রাম প্রয়োজন, দরকার একটু বিনোদন। কিন্তু তাই বলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ছুটি?
নির্বাচন একটি দেশের স্বাভাবিক সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। সংবিধান এবং আইনের বিধিবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচন প্রতিবার রীতিমতো যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এবারের ‘যুদ্ধ’ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে, গত বছর ১৫ মার্চের পর থেকে। আরও সহজভাবে বললে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে পিটার ডি হাসের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্র। তাই সব দেশেই মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিশেষ মর্যাদা পান। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের পথে হাঁটা দেশগুলো নানাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। তাই এ দেশে যারাই মার্কিন রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছেন, তারাই পেয়েছেন বিশেষ সম্মান ও সমীহ। তাদের অভিপ্রায়কেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাদের অনেকেই এ গুরুত্ব ও সম্মানকে মর্যাদা দিয়েছেন। তারা বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে মুগ্ধ হয়েছেন। দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে কাজ করেছেন। তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। তাদের মধ্যে ২০১৫ থেকে ’১৮ সালে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্নিকাটের কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। বার্নিকাট রিকশায় চড়েছেন, ফুচকা খেয়েছেন, শাড়ি পরে বাঙালি সংস্কৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। তাই বলে এমন নয় তিনি নির্বাচন নিয়ে কথা বলেননি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার তার এজেন্ডা থেকে বাদ গেছে। বার্নিকাটের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল ২০১৬ সালে। আমার প্রতিষ্ঠান মার্কিন দূতাবাসের জন্য একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিল। মার্কিন ভিসা পেতে অনেকে দালাল ধরে, তথ্য জালিয়াতি করে, এটা বন্ধের জন্য একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন দূতাবাস। বার্নিকাট নিজে বিজ্ঞাপন নির্মাণের তদারকি করেছিলেন। এ সময় তার সাংস্কৃতিক জ্ঞানে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের বানানো বিজ্ঞাপন ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। ২০১৬ সালে নির্মিত ওই বিজ্ঞাপনটি এখনো দূতাবাসের ওয়েবসাইটে দেখে গর্বিত হই বৈকি। বিজ্ঞাপন নির্মাণের পর তিনি এ কাজে জড়িত আমাদের পুরো টিমকে আমেরিকান ক্লাবে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি তাকে আড়ংয়ের ছোট্ট একটা রিকশা আর ‘এক তারা’ দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতি, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি নিয়ে তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘এ দেশে আমি মুগ্ধ। আমি এ দেশ থেকে অনেক কিছু শিখতে এসেছি।’ বার্নিকাট ছিলেন বিনয়ী, স্নিগ্ধ। যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন শাড়ি পরে।
আরেকজন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সখ্য হয়েছিল, তিনি হলেন ড্যান মজিনা। তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০১১ সালের নভেম্বরের শেষদিকে। সে সময় আমরা পরিপ্রেক্ষিতের উদ্যোগে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের নিয়ে একটা নিরীক্ষামূলক প্রকল্প করেছিলাম। তাদের নিজস্ব কৃষ্টির স্মারক চিহ্নগুলোকে আমরা মূলধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নিই। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ধানমন্ডিতেই পরিপ্রেক্ষিত কার্যালয়ে আমরা পাহাড়ি জনপদের মানুষদের তৈরি পণ্যের প্রদর্শনী করি। একবারেই ঘরোয়া উদ্যোগ। অপ্রত্যাশিতভাবে প্রদর্শনী দেখতে আসেন জাপানি রাষ্ট্রদূত। তিনি অনুরোধ করেন, তার বাসভবনে এরকম একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করতে। ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধনী দিনে এসেছিলেন ড্যান মজিনা। আন্তরিক আর স্বতঃস্ফূর্ত মানুষ। ওইদিন তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আমি তাকে সমুচা ও শিঙাড়ার পার্থক্য বোঝাতে গলদগর্ম হয়েছিলাম। সে কথা মনে হলে এখনো হাসি পায়। বার্নিকাট কিংবা ড্যান মজিনাও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিছু বিতর্কেরও হয়তো জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু কেউই কূটনীতিক সীমার বাইরে যাননি। তাদের বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তৎপরতা কোনোভাবেই পিটার হাসের আগ্রাসী দৌড়ঝাঁপের ধারেকাছেও নয়। ২০০৯-এর পর যারাই বাংলাদেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এসেছেন, তারা সবাই কমবেশি বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পিটার হাস এসেই যেন ভিন্ন বার্তা দিতে শুরু করেন। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তিনি যেভাবে মাথা ঘামিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। তার কিছু আচরণ অনেকেই পক্ষপাতদুষ্ট মনে করে। যেমন ‘মায়ের ডাক’ বলে বিতর্কিত একটি সংগঠনের নেতার বাসায় যাওয়া। কিংবা গুম নিয়ে একটি বিতর্কিত প্রামাণ্যচিত্র দূতাবাসের অফিসিয়াল ফেসবুকে স্থান দেওয়া কতটা যৌক্তিক ছিল, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। গত বছর ৭ ডিসেম্বর বিএনপি অফিসের সামনের ঘটনার পর তার চটজলদি প্রতিক্রিয়া আদৌ জরুরি ছিল কি না, তা নিশ্চয়ই একদিন তিনিই মূল্যায়ন করবেন। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে গিয়ে গণমাধ্যম সম্পর্কে তার বক্তব্য হুমকি কি না, তা নিশ্চয়ই মিস্টার হাস বিবেচনা করবেন। কিন্তু এসব তাকে যে বিতর্কিত করেছে, তা বলাইবাহুল্য। যে কোনো দেশে একজন রাষ্ট্রদূতের কিছু নির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকে। কিছু লক্ষ্য বাস্তবায়নের তাগিদ থাকে। নিশ্চয়ই পিটার হাসেরও তেমন কোনো এজেন্ডা আছে। কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গত দেড় বছরে তার লক্ষ্য অর্জনের কৌশল ছিল আক্রমণাত্মক ও বিতর্কিত। বন্ধুত্ব নয়, তিনি যেন প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। পিটার ডি হাসের তৎপরতা অনেকের কাছেই ১৯৭৫ সালে দায়িত্ব পালন করা মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজেন বুস্টারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মিস্টার হাস বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতি সম্পর্কে পড়াশোনা করেই এসেছেন। কিন্তু তিনি বোধহয় এ দেশের সংস্কৃতি, মানুষের মন-মানসিকতা কিংবা আবেগ সম্পর্কে ভালো হোমওয়ার্ক করেননি। বাংলাদেশ জোয়ার-ভাটার দেশ। এ দেশের মানুষ খুবই আবেগী। ভালোবেসে কিছু চাইলে বাঙালি নিজের জীবন দিয়ে হলেও অতিথির আবদার পূরণ করে। কিন্তু কেউ প্রভুত্ব করতে চাইলে, জীবন দিয়ে হলেও প্রতিরোধ করে। এই সহজ, সরল উপলব্ধিটি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের হয়েছিল কি না, আমি জানি না। কিন্তু আমি মনে করি, এরকম একজন মেধাবী উচ্চশিক্ষিত কূটনীতিক সবকিছু আরও শালীন ও শিষ্টাচার সম্মতভাবে করতে পারতেন। সবাইকে আস্থায় নিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের বার্তা বাহক হতে পারতেন পিটার হাস। তবে তিনি একটি কাজ করেছেন। তার তৎপরতার কারণে বিএনপির প্রত্যাশার বেলুন ফুলে উঠেছিল। বিএনপি তাকে দেবদূত ভাবতে শুরু করেছিল। নির্বাচনের তপশিলের পরদিন ছুটিতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিএনপিকে দুটি শিক্ষা দিলেন। প্রথমত, অন্যের ভরসায় কোনো লক্ষ্য অর্জন করা যায় না। বিএনপি ভেবেছিল, তারা নির্বাচনে যাব না বলে বসে থাকলেই সরকারের পতন হবে। তাদের কিছুই করতে হবে না, যা করার যুক্তরাষ্ট্র করবে। অনেকটা এমন, পরীক্ষায় পড়াশোনা না করলেও চলবে। ভগবানের কৃপায় আপনাআপনি সাফল্য আসবে। কিংবা ঈশ্বর অন্ন জোগানদাতা, আমরা ঘুমিয়ে থাকব, ঈশ্বর আমাদের মুখে খাবার তুলে দেবেন। এ ভাবনাতেই বিএনপিকে আচ্ছন্ন করেছিলেন পিটার হাস। আসলে এভাবে সাফল্য আসে না। অন্যের ওপর নির্ভর করে আন্দোলন করলে নিজেদেরই অস্তিত্বের সংকট হয়। সেটা তপশিল ঘোষণার পর বিএনপির হয়েছে।
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো, ব্যর্থ হলে বিশ্রামে যেতে হয়। ছুটি নিতে হয়। দেহ ও মনের ক্লান্তি দূর করে ঠান্ডা মাথায় নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হয়। যেমন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছুটি কাটিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে নিশ্চয়ই নতুন পরিকল্পনা সাজাবেন। বিএনপি যদি সত্যি সত্যি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তাদের প্রভু মানেন, তাহলে নিশ্চয়ই তার কাছ থেকে শিক্ষা নেবে। আন্দোলন ছুটিতে পাঠাবে। কারণ এসব অবরোধ, হরতাল এখন জংধরা অস্ত্র। এসব দিয়ে কোনো কাজ হয় না। মানুষ ভয়কে জয় করে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়েছে। অবরোধে রাস্তাঘাটে রীতিমতো যানজট। এ ধরনের কর্মসূচি বিএনপিকে একটি হাস্যকর, খেলো রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে। এভাবে ৪৮ দিন কর্মসূচি দিলে তা নিশ্চিত ২০১৫ সালে অবরোধের মতোই হবে। তার চেয়ে বিএনপির উচিত আন্দোলন থেকে কয়েক দিনের ছুটি নেওয়া। আর টিকে থাকতে চাইলে কৌশল পরিবর্তন করে জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। পিটার হাসের কাছ থেকে এ শিক্ষাটা কিন্তু বিএনপি দিব্যি নিতে পারে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল : poriprekkhit@yahoo.com
বিএনপি পিটার হাস মার্কিন দূতাবাস
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
সৈয়দ ইবরাহিম চৌকস সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কোরআন এবং ইসলামী ব্যাখ্যায় তিনি অনবদ্য। মুসলিম যুদ্ধের কৌশল নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থের লেখক এই মেধাবী মানুষটি। সহজ সরল সদালাপী। নির্বাচনে যাওয়ার যে ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন, তাতে যথেষ্ট যুক্তি আছে। আছে সহজ-সরল স্বীকারোক্তি। কিন্তু তার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি শরিকরা। নির্বাচনী এলাকায় তিনি এখন বিএনপি কর্তৃক অবাঞ্ছিত। ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর সৈয়দ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। নুর বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদরা কোরবানির গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন।’ শুধু নুর নয়, একই রকম বক্তব্য রেখেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গত শুক্রবার এলডিপির নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেছেন, ‘এ বয়সে এসে গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হতে চাই না।’ সৈয়দ ইবরাহিম গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। বরং নিজের বুদ্ধি বিবেচনার দ্বারাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে আমার ধারণা। কোরবানির হাটে নিজেকে বিক্রির অভিপ্রায় থাকলে তিনি নিশ্চয়ই তৃণমূল বিএনপি, কিংবা বিএনএমে যোগ দিতেন। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গেও যোগাযোগ করতেন। সৈয়দ ইবরাহিম তা করেননি। এটি তার নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। তবে নির্বাচনের মাঠে এখন কেনাবেচার খেলা জমে উঠেছে। সন্দেহের তালিকায় থাকা অনেক নেতাই বলছেন, ‘আমি গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হব না।’ রাজনীতিতে এ কেনাবেচার ইতিহাস অনেক পুরোনো। নানা সময়ে রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়েছেন। নিজেদের আদর্শকে কোরবানি দিয়েছেন।
বিএনপির এখন পর্যন্ত অবস্থান নির্বাচনে না যাওয়ার। এখনো দলটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, অন্তত কাগজে-কলমে। অবরোধের ঘোষণা দিয়ে চুপচাপ বসে নদীর ঢেউ গুনছেন নেতারা। বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধেছিল ৩৪টি দল। এদের মধ্যে বেশ কিছু দল এখন নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সামনে আরও চমক অপেক্ষা করছে।’ বিএনপির এখন অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো, নির্বাচন বর্জনের পক্ষে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়ানো। এজন্য রাজনীতিতে কেনাবেচার খেলা চলছে। জাতীয় পার্টির একজন নেতা স্বীকার করেছেন, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচনে না যায় সেজন্য ‘বড় অফার’ দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। কান পাতলে নানা কথা শোনা যায়। এখনো জাতীয় পার্টি নাকি নিলামে আছে। দর-কষাকষি এখনো চলছে। শেষ মুহূর্তে ভালো দর পেলে, ২০১৪ সালের মতো, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে পারে দলটি, এমন গুঞ্জনও শোনা যায়। বিএনপির শরিকদের মোটা অঙ্কের উপঢৌকনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা নির্বাচনে না যায়। আদর্শ বা নীতি নয়, টাকার লোভে নির্বাচন থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তও এক ধরনের কেনাবেচা। গরু-ছাগলের মতো কোন কোন রাজনীতিবিদের কত দাম ওঠে তা জানার অপেক্ষায় আমরা। বিএনপির প্রধান লক্ষ্য নির্বাচনে না যাওয়াদের পাল্লা ভারী করা। নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পড়ে। পশ্চিমা বিশ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর বলে—‘এটা পাতানো খেলা। আবার নির্বাচন করতে হবে।’ সে আশায় রাজনীতির হাটে এখন লন্ডনি পাউন্ডের আনাগোনা লক্ষ করা যায়। শুধু জোট নয়, ঘরেই অবিশ্বাস-সন্দেহের দোলাচলে বিএনপি। দলটির বেশ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে তারা গোপন আঁতাত করছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্য তারা ‘গরু-ছাগলের’ মতো বিক্রি হয়েছেন। এজন্য ঘর সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর আগে সিলেট সিটি নির্বাচনে দলের নেতাকে ধরে রাখতে ‘নজরানা’ দিয়েছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। নির্বাচনে না দাঁড়ানোর বিনিময়ে তিনি কী কী পেয়েছেন, তা গোপনই রয়ে গেছে। তবে দলীয় পদ প্রাপ্তিও যে এক ধরনের উৎকোচ, তা নিশ্চয়ই জনগণ উপলব্ধি করে। এবার বিএনপি আরও মরিয়া। জনপ্রিয় এবং নির্বাচনে যেতে আগ্রহীদের তা থেকে দূরে রাখতে নানা টোপ দেওয়া হচ্ছে। পদ-পদবির সঙ্গে আছে নগদ প্রলোভন। আন্দোলন নয়, বিএনপিতে চলছে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’র রাজনীতি। আদর্শহীন রাজনীতিতে টাকা-পয়সা ও পদ-পদবির লোভই শেষ অস্ত্র।
এটা স্পষ্ট, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচন চায়। এমন একটি নির্বাচন যেখানে ভোটারদের উৎসাহ-উদ্দীপনা থাকবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। দৃশ্যত নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা তো নির্বাচন উৎসবমুখর করতে পারবে না। এজন্যই বাজারে এসেছে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, ইসলামী জোট, যুক্তফ্রন্টসহ নানা জাতের-রঙের বাহারি রাজনৈতিক দল। জাতীয় পার্টিসহ এসব নতুন রং করা পুরোনো গাড়ি নির্বাচনী মহাসড়কে চলাচল শুরু করতেই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। জনগণ ধীরে ধীরে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহী হতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা গোটা দেশকে আচ্ছন্ন করেছিল, এখনকার পরিস্থিতি তার ধারেকাছেও নয়, বরং দেশ স্বাভাবিক। বিএনপি রাজনীতির মূলধারা থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছে ক্রমাগত। নির্বাচনের মহাসড়কে এত গাড়ি নামাতে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ কসরত করেছে। বিনিয়োগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি গল্প বলতে চাই। এক ব্যবসায়ী তার ম্যানেজারকে নির্দেশ দিলেন, একজন কর্মকর্তাকে ‘ম্যানেজ’ করে একটা কাজ বাগাতে হবে। ম্যানেজার ওই কর্মকর্তা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। এসে মালিককে বললেন, ‘উনি (ঘুষ) খান না।’ ব্যবসায়ী হেসে বললেন, ‘কত খান না?’ পরে ব্যবসায়ী নিজেই ওই কর্মকর্তার সঙ্গে দফারফা করলেন। এখন আমরা এমন এক আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বসবাস করি, যেখানে আদর্শ মূল্যহীন, নীতি অর্থহীন। সবকিছুই কেনাবেচা হয়। রাজনীতিতে কেনাবেচা এখন ‘হালাল’। তাই কে ‘নগদে’, কে ‘আশ্বাসে’ নির্বাচনে এলো; তার হিসাব খুঁজে লাভ নেই। নির্বাচনী মাঠ এখন কোরবানির গরু-ছাগলের হাট। তবে এখানে ক্ষমতাসীনরা একাই ক্রেতা নয়। বিরোধীরাও নিলামে শক্তিশালী পক্ষ। বাংলাদেশে কেনাবেচার রাজনীতি নতুন নয়। সৈয়দ ইবরাহিমই প্রথম রাজনীতিতে ‘ডিগবাজি’ দিয়েছেন এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ’৭৫-এর পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গরু-ছাগলের হাট প্রথা চালু হয়। সহজভাবে বলা যায়, বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগলের মতো কেনাবেচার জনক জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক গোয়েন্দাদের দিয়ে বিএনপি গঠন করেছিলেন। বিভিন্ন লোককে বিএনপিতে যোগদানের জন্য নগদ অর্থ, ব্যবসা, টেন্ডার, ব্যাংক ঋণ দেওয়ার প্রথা চালু হয় জিয়ার হাত ধরেই। তিনি একদিকে যেমন স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ, মশিউর রহমানকে (যাদু মিয়া) দলে ভেড়ান, তেমনি চৈনিক বাম, গলাকাটা পার্টির তরিকুল ইসলাম, মান্নান ভূঁইয়াদেরও কাছে টানেন। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী কে এম ওবায়দুল রহমানের মতো নেতাদের বিএনপিতে নিয়ে জিয়া আওয়ামীবিরোধী ‘ককটেল’ সৃষ্টি করেন, যার নাম বিএনপি। জিয়া রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিকে সত্যিই ডিফিকাল্ট করেছিলেন। তার নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রবেশ করে কালো টাকার মালিক, মাস্তান, দুর্বৃত্তরা। তবে রাজনীতিতে গরু-ছাগলে হাটকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এরশাদ কবি ছিলেন, তাই রাজনীতিবিদদের গরু-ছাগল বানিয়েছিলেন তিনি কাব্যিক ঢঙে। বিকেলে জনসভায় এরশাদকে তুলোধোনা করেছিলেন ব্যারিস্টার কোরবান আলী। সন্ধ্যায় গোটা জাতি অবাক বিস্ময়ে দেখল স্বৈরাচারের মন্ত্রী হয়ে নিজেকে কোরবানি দিলেন মুজিব সৈনিক। কাজী জাফর আহমেদ, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কিংবা মিজান চৌধুরীর জাতীয় পার্টিতে যোগদান ছিল একেকটি প্রতারণা এবং বিশ্বাসঘাতকতার অনুপম কাব্য। তাদের ডিগবাজি এত বিস্ময়কর যে, অলিম্পিকে এরকম কোনো খেলা থাকলে অবলীলায় তারা স্বর্ণপদক পেতেন। রাজনীতিকে এরশাদ রীতিমতো গরু-ছাগলের হাট বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই হাটেই এরশাদ নিঃস্ব রাখালে পরিণত হন ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে। এরশাদের পতনের পর গরু-ছাগলদের রশি আর রাখালের হাতে থাকেনি। যারা এরশাদের জন্য জান কোরবার করার প্রতিযোগিতা করতেন, তাদের প্রায় সবাই যোগ দেন বিএনপিতে। স্বৈরাচারের দোসররাই যখন এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দেয়, তখন লজ্জায় মুখ লুকানো ছাড়া উপায় কি? এখানেও কেনাবেচার রাজনীতি। এরশাদের চাটুকার গোষ্ঠীর ব্যারিস্টার মওদুদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বহুজনকে সস্তায় কিনে নেয় বিএনপি। ভাবখানা এমন বুড়ো গরুর দাম কম! স্বৈরাচারের উপ-রাষ্ট্রপতি ২০০১ সালে বিএনপির আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বিএনপির দ্বিতীয় অধ্যায়ে ডিগবাজির রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ বিরোধী দল ভাঙার জন্য, বিরোধী নেতাদের ভাগিয়ে আনার যে ‘অস্ত্র’ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি আবিষ্কার করেছিল, আজ সেই অস্ত্রেই তারা ঘায়েল হচ্ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনের জন্য এরশাদ আ স ম আবদুর রবকে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের সম্মানে ভূষিত করেছিলেন। ’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করতে বিএনপি মৃতপ্রায় খুনিদের দল ‘ফ্রিডম পার্টি’কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। ক্ষমতায় থাকার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনীতিতে যারা ‘গরু-ছাগলের হাট’-এর প্রবর্তন করেছিলেন, তারাই এখন কোরবানির হাটের পণ্য। ’৭৫-এর পর রাজনীতির যে কেনাবেচার অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, সেই অধ্যায় আজ ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব’ হয়ে উঠেছে। বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তাতেই ক্ষতবিক্ষত। শুধু রাজনীতিবিদরা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হচ্ছেন না। রাজনীতিই এখন হয়ে উঠেছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। সবচেয়ে বড় বাণিজ্য।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ইমেইল: poriprekkhit@yahoo.com
কল্যাণ পার্টি নির্বাচন আওয়ামী লীগ
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের নির্বাচন ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মন্তব্য করুন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে গত ২৬ নভেম্বর। এবারের নির্বাচন বড়ই অদ্ভুত নির্বাচন। এই নির্বাচনে একটিই ফলাফল হতে পারে। সেটি হলো আওয়ামী লীগের বিজয়। বিএনপি এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সহ যে সব রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তাদের একটাই লক্ষ্য, ‘বিরোধী দল’ হওয়া। তবে নির্বাচন টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জের। পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই চায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন।
প্রায় দু সপ্তাহ নীরব থাকার পর মাহমুদুর রহমান মান্না আবার সরব হয়েছেন। আবার রাস্তায় এসে সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। কিন্তু গত দু সপ্তাহ তিনি কোথায় ছিলেন? বিভিন্ন সূত্রগুলো বলছে যে, এ সময় মান্না সরকারের সাথে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে দেন দরবার করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেন দরবারের রফা হয়নি। সেই কারণেই মান্না এখন আবার সরব হয়েছেন। আবার বিরোধী দলের লড়াকু সৈনিক হিসেবে মাঠে নেমেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না যা চেয়েছিল তা দেওয়া সম্ভব হয়নি।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কল্যাণ পার্টির নেতা লে. জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেই সত্যটি আরেকবার প্রমাণিত হলো। ২৭ অক্টোবর, বিএনপির মহাসমাবেশের আগের দিন এই সেনা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া আর জাহান্নামের আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা।’
যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনামুক্ত এবং দূষণমুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশ নিয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সরব ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একের পর এক কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করেছেন এবং তারা বাংলাদেশে নির্বাচন সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা রকম পরামর্শ দিয়েছেন, হুমকিও দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তা নিশ্চিত করার জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করে এবং সেই ভিসা নীতি গত সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে বলেও আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর বিএনপি সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং তাণ্ডব করল, সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বদলে যেতে শুরু করে। এরপর অবশ্য ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস নির্বাচন কমিশন সহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছিলেন, বৈঠক করেছেন। মার্কিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলকে চিঠি দিয়েছিলেন, তারা যেন শর্তহীন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।