এডিটর’স মাইন্ড

আত্মঘাতী আওয়ামী লীগ

প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ নভেম্বর, ২০২১


Thumbnail

ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম দুই ধাপের নির্বাচন ছিল সহিংস, সন্ত্রাসে ভরপুর। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ১৯৮ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন ৪০ জনের বেশি। আহত হয়েছেন ৫ হাজারের ওপর। ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে অতীতেও সহিংসতা হয়েছে। তবে এ সহিংসতা ও মৃত্যু কাম্য নয়।’ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এবার নির্বাচনী সহিংসতা একটু ভিন্ন ধরনের। আগে নির্বাচনে সন্ত্রাস হতো দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহিংসতায় রূপ নিত। কিন্তু এবার নির্বাচনী সহিংসতার প্রায় পুরোটাই আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগকে খুন করছে, জখম করছে। যারা একসঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন তারা এখন একে অন্যের ঘাতক। আওয়ামী লীগই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। নিজেরাই নিজেদের সব অর্জন ধ্বংস করছে। আত্মহননের এক ভয়ংকর খেলা চলছে আওয়ামী লীগেই। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৭২ বছরের পুরনো। এখনো আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল। তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনটি বিস্তৃত। এ দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শের ধারক দল আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য এ দলের নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের চেয়ে জুলুম-নির্যাতন আর কোনো রাজনৈতিক দল সহ্য করেনি। ৭২ বছরে আওয়ামী লীগকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ৫০ বছরের বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাইরের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে কখনো পরাজিত করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ যতবার হেরেছে প্রতিবার ঘরের শত্রুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আত্মঘাতী গোল আওয়ামী লীগকে বিপর্যস্ত করেছে। মুসলিম লীগ, আইয়ুব খান, মোনায়েম খান আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেননি। বরং এদের নিষ্পেষণে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু থেকে হয়েছেন জাতির পিতা। জাতির পিতাকে স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদ সর্বহারা, পরাস্ত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আওয়ামী লীগের ভিতরে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা প্রায় সবাই ’৭৫-এর পর অবৈধ সরকারের অংশ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়েই তারা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন শপথ নিতে। আওয়ামী লীগের মোশতাক চক্ররা যদি সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে আগস্ট ট্র্যাজেডি ঘটত কি না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যতবার হোঁচট খেয়েছে, সংকটে পড়েছে প্রতিবার আওয়ামী লীগের একাংশের আত্মঘাতী তৎপরতার জন্য। আওয়ামী লীগ এ অন্তর্ঘাত অস্বীকারও করেনি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও নীতিনির্ধারণী সভাগুলোয় আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার আদ্যোপান্ত পাওয়া যায়। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল হয় ৩ মার্চ ১৯৭৮। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ওই সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বলা হয়েছিল- ‘জনাব মিজান চৌধুরীদের সংগঠনের বিরুদ্ধে এহেন অপতৎপরতা এই প্রথম নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর আমলে অকাজ-কুকাজের জন্য বহিষ্কৃত জনাব মিজান চৌধুরী ও জনাব মতিউর রহমানের মতো লোকেরা সংগঠনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত এবং কবজাভূত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। রচনা, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা নূহ উল আলম লেনিন, পৃষ্ঠা ৪৪৭)। আওয়ামী লীগের বিভক্তি এবং হতচ্ছাড়া অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি উপায়ই ছিল তা হলো বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দলের নেতৃত্বে আনা। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের চাপে তা-ই হয়েছিল। দল বাঁচাতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে। ১৯৮১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হন এবং ১৭ মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকেও দলের ভিতরের আত্মঘাতী তৎপরতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে শুরুতে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা হয়েছে দলের মধ্যে থেকেই। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সেই আত্মঘাতী তৎপরতার বিবরণও পাওয়া যায়। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রিপোর্ট পেশ করেন বেগম সাজেদা চৌধুরী। ওই রিপোর্টে তিনি বলেন, ‘কতিপয় ব্যক্তি দলীয় সংকট মোচনের পথে অগ্রসর না হয়ে সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলতে সচেষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগের জন্মের পর হতেই বহুবার বহু নেতা-কর্মীর স্বীয় স্বার্থে ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার মানসে এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও অশুভ শক্তির প্ররোচনায় কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সংগঠনকে “ডানপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত অতিবিপ্লবী বাম রাজনীতির ও প্রগতির ধ্বজাধারীর পরিচয় দিয়ে, আবার কেউ কেউ একই অভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সংগঠন “বামপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত ওয়েস্টার্ন ডেমোক্র্যাসি, ফ্রি ইকোনমি ও ইসলামের অকৃত্রিম খাদেম পরিচয় দিয়ে দল ত্যাগ করেছেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। পৃষ্ঠা ৪৯৯)।

১৯৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ সঠিক না ভুল ছিল তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অমীমাংসিত। এরশাদের নজিরবিহীন কারচুপি ও ‘মিডিয়া ক্যু’ ওই নির্বাচনের ফল পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে আবদুর রাজ্জাকদের আত্মঘাতী তৎপরতা না হলে ভোটবিপ্লব হতো বাংলাদেশে। একইভাবে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপের আত্মঘাতী হয়ে ওঠা ছিল আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। বিদ্রোহী প্রার্থী, অন্তঃকলহ ’৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করেছে সফলভাবে। কিন্তু একসময় দলের ভিতরে কারও কারও অপতৎপরতা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের কারণ উঠে আসে ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলের সভানেত্রীর ভাষণে। ওই কাউন্সিলে প্রদত্ত ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দলের ভিতরে কোথাও কোথাও কোন্দল ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ার ঘটনাটিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় কিছুসংখ্যক নিশ্চিত বিজয়ের আসন আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।’

২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও আওয়ামী লীগে দেখা যায় আত্মঘাতী তৎপরতা। দলে গণতন্ত্রের জিকির তুলে আওয়ামী লীগ ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্র হয়েছিল দলের ভিতরেই।
আওয়ামী লীগ বারবার সংকটে পড়েছে দলের ভিতরের সমস্যার কারণেই। তার পরও দলটি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী সংগঠন এজন্য যে এ ‘আত্মঘাতী’ তৎপরতা প্রতিহত করেছেন কর্মীরা, তৃণমূল। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। এরাই ৭২ বছরেও আওয়ামী লীগকে সজীব ও সতেজ রেখেছেন। এদের ঐক্য, স্বার্থহীন ত্যাগ ও নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের ফলেই আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থায়। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের সেই নিঃস্বার্থ, ত্যাগী তৃণমূলই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। এটাই হলো ভয়ের কারণ।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছে চেয়ারম্যান পদে। শুরু থেকেই এ মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক। তৃণমূলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রতিক্রিয়া বেশ স্বচ্ছ। জেলা ও উপজেলা নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রে নাম পাঠান। দলের সভানেত্রীর নেতৃত্বে আছে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড। এ বোর্ড স্থানীয় পর্যায় থেকে পাঠানো একাধিক নামের প্রস্তাব থেকে একজনকে মনোনয়ন দেয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে মনোনয়ন নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকে। এখানে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক পরিচয় বড় করে দেখা হয়। তাই এসব নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে ভালো হতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যদি দলীয়ভাবে না করা হতো। যে-যার মতো নির্বাচন করত। তা সম্ভব হয়নি। আর সে কারণেই এ নির্বাচনে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত অনেক সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের একটি বিদ্রোহ হয়েছে। এ বিদ্রোহ মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের বিদ্রোহীরা দাবি করেছেন, স্থানীয় নেতা, এমপি এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত। একজন তৃণমূলের নেতা বলেছিলেন, ‘একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত।’ সবাই না হলেও এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্য হয়েছে তা ওপেন সিক্রেট। আওয়ামী লীগের মধ্যেই আলোচনা হয়, চেয়ারম্যান পদে এমপিরা মনোনয়ন বিক্রি করেছেন। সব এমপি যে মনোনয়ন বিক্রি করেছেন তা নয়। অনেক নব্য আওয়ামী লীগার এমপি হয়ে এলাকায় তার ভিত শক্ত করার মিশনে নেমেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের ওএসডি করেছেন। নতুন আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন। এদের ‘এমপি লীগ’ও বলা যায়। এমপি লীগে রাজনীতিবিদ নেই। আছেন ঠিকাদার, গ্রাম্য টাউট, সুবিধাবাদী, মৌলবাদী, ধর্ষক, সন্ত্রাসীরা। এমপি সাহেব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে এদের মধ্যেই তো কাউকে বাছাই করবেন। এরপর কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। কারও কাজ হয়েছে, কারও হয়নি। যার হয়েছে তিনি তার নতুন আওয়ামী লীগের একান্ত চামচাকে ‘নৌকা’ প্রতীক উপহার দিয়েছেন। তৃণমূলের ত্যাগী প্রার্থীরা হতবাক হয়েছেন। ২০০১-এর পর বিএনপি-জামায়াত তাণ্ডবে এই ব্যক্তি কোথায় ছিলেন? ২০০৭-এর ওয়ান-ইলেভেনে কোথায় ছিলেন? তৃণমূল এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। নিজেরা চাঁদা তুলে প্রার্থীর জন্য খরচ করেছেন। নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা ও প্রশাসনের অন্যায় আচরণ হজম করেছেন। (সত্যিকারের আওয়ামী লীগ তো এসবে অভ্যস্ত)। তারপর তারা নৌকা প্রতীক পাওয়া নব্য আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়েছেন। কদিন আগে বিজয়ী এক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এমপি সাহেব যে ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মুক্তি পরিষদের অন্যতম নেতা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যারা আক্রমণ করেছিল তাদের একজন ছিলেন নৌকা প্রতীক পাওয়া ওই প্রার্থী। তার মনোনয়ন স্থানীয় তৃণমূল মেনে নিতে পারেনি। তাই সম্মিলিতভাবে তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন একজন প্রবীণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ রকম ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। এরা নির্বাচনে দ্বিতীয়, তৃতীয়ও হতে পারেননি। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রতিহত করেছে। মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এটি ছিল দৃশ্যমান প্রতিবাদ। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তৃণমূলের প্রকাশ্য বিদ্রোহ।

আবার বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক স্থানে এমপিরা চেষ্টা-তদবির করেও তার পছন্দের প্রার্থীর মনোনয়ন আদায় করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত মনোনয়ন বোর্ড দলের পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু এমপি সাহেব তা মানবেন কেন? এটা যদি তিনি মানেন তাহলে তার এমপি লীগের কী হবে? দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনি তার ‘একান্ত অনুগত’ ব্যক্তিকে বিদ্রোহী প্রার্থীরূপে দাঁড় করালেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ম্যানেজ করলেন। তারপর নৌকার প্রার্থীকে দৌড়ের ওপর রাখলেন। টাকা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগকেও বিভক্ত করলেন। অবশেষে এমপির পছন্দের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হলেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হেরে গেলেন। ফলে ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটেছে। প্রথম দফায় কম থাকলেও দ্বিতীয় দফায় শতকরা ৪২ ভাগ ইউনিয়নে বিদ্রোহী বা আওয়ামীবিরোধীরা জয়ী হয়েছেন। সামনে এ প্রবণতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।

অতীতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ছিল ঐক্যের প্রতীক। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে, দলের নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তখন তৃণমূলের ঐক্যই তা প্রতিহত করেছে। তৃণমূলের ঐক্যের ফলেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা জাতীয় গণদাবি হয়েছে। তৃণমূলের সংগ্রামেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির পিতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তৃণমূলের ত্যাগের জন্যই ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। তৃণমূলের ভালোবাসায় ওয়ান-ইলেভেনের অপশক্তি আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে পারেনি। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে উদ্বোধনী ভাষণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের এ শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের ভয়ভীতি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেদিন যেভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে বাঙালি জাতি আবারও উপলব্ধি করতে পেরেছে, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারে তাদের আশা-আকাঙ্খা ধারণ করতে।... আওয়ামী লীগের যে কোনো সংকটে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই বারবার দলকে টিকিয়ে রেখেছেন।

এবার যেন সেই তৃণমূলকেই আত্মঘাতী বানানো হচ্ছে। তৃণমূল বিভক্ত মানেই আওয়ামী লীগ বিভক্ত। তৃণমূলে হানাহানি মানে আওয়ামী লীগে সংকট। তৃণমূলকে বিভক্ত করে কি আওয়ামী লীগের বারোটা বাজানো হচ্ছে? আওয়ামী লীগই হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের হন্তারক। আওয়ামী লীগের কাছেই হেরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে যে আত্মঘাতী তৎপরতা তা আওয়ামী লীগকে আরেকটি সংকটের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। আওয়ামী লীগে যেসব স্থানীয় নেতা, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন-বাণিজ্য করছেন তারা কি জানেন আওয়ামী লীগ দুর্বল হলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। আওয়ামী লীগে যারা দলের বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন, উসকে দিয়েছেন তারা কি জানেন এ বিভক্তি আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়, এটা দেশেরও ক্ষতি। কারণ আওয়ামী লীগ যখন জয়ী হয় তখন একাই জয়ী হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখন গোটা বাংলাদেশ হারে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

দূতাবাসপল্লিতে রাজনীতিকদের ভিড় কেন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৭ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

প্যারিসে এক ধরনের পেশা আছে। এ পেশাকে বলা হয় ‘পিকচার গাইড’। যে কোনো ছবি দেখে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এই গাইডরা বাতলে দেন। যে কোনো ছবির ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিতে তাদের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে এরকম বিশেষজ্ঞ বা বিশ্লেষক নেই। থাকলে নির্ঘাৎ আমার মতো অনেকেই এসব গাইডের কাছে যেতেন দুটি ছবির ব্যাখ্যার জন্য। একটি ছবি গত ২২ মার্চ বুধবারের। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে ছয় আওয়ামী লীগ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ফটোসেশন। এ ছবিতে আওয়ামী লীগের সব নেতাই কেতাদুরস্ত পোশাক। স্যুট-কোট পরিহিত। মুজিব কোটে কেউ নেই (পোশাকে কী আসে যায়)। তাদের চেহারার মধ্যে একটা বিজয় বিজয় ভাব। যেন মস্ত কিছু অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় ছবিটা ১৬ মার্চ ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে বিএনপির পাঁচ নেতার হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এ ছবিতে বিএনপি নেতাদের হাসিটা বেশ চওড়া। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারত জয়ের পর যেমন প্রশস্ত হাসি দিয়েছিলেন। বিএনপি নেতাদের হাসিটা অনেকটা সেই আদলের। বিএনপি নেতারা কি তাহলে ভারত জয় করলেন? ওইদিন ভারতীয় দূতাবাসে নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিবসহ পাঁচ নেতা। বেশ কিছুদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। সর্বশেষ গত ২০ মার্চ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে রীতিমতো তুলোধোনা করা হয়েছে। এর মাত্র দুদিন পর আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় মধ্যাহ্নভোজ কী বার্তা দিল? কে কাকে বশে আনল? আবার বলা হয়, বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে পারছে না ভারতের জন্য। বিএনপি নেতারাও একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন—‘ভারতই এ সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে।’ কোনো কোনো নেতা তো আওয়ামী লীগ সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার বলতেও দ্বিধা করেননি। এমন ভারতবিদ্বেষী বিএনপির ‘দেশপ্রেমিক’ নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে কী পেলেন? তারা কি ভারত জয় করলেন, নাকি ভারতের ‘পুতুল’ হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব এবং প্রভুত্ব কি আবার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? বাংলাদেশের রাজনীতির ভাগ্য কি দূতাবাস পল্লিতেই নির্ধারিত হবে? কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তো এরকম ছিল না। স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নেতারা মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফরে এলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে আমলারা বললেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে মন্ত্রীরই যাওয়া উচিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট পদমর্যাদায় মন্ত্রীর অনেক নিচে। একজন যুগ্ম সচিবকে তিনি পাঠিয়েছিলেন ম্যাকনামারাকে রিসিভ করার জন্য। ৭ জুন ১৯৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কারও এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’

সত্যিই বঙ্গবন্ধু যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ নাক গলাতে পারেনি। নাক গলাতে না পারলেও তারা ষড়যন্ত্র করেছে। ৭৫-এর ১৫ আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞে আন্তর্জাতিক মদদ এবং ষড়যন্ত্রের কথা এখন সবাই জানে। মার্কিন দলিলপত্রেই তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিস্টার বুস্টারের ভূমিকার কথা জানা যায়। ৭৫-এর পর থেকেই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো ক্ষমতাবান হতে শুরু করে। আস্তে আস্তে তারা মোড়ল মুরুব্বি বনে যান। বাংলাদেশের ক্ষমতাবদলের লাটাই চলে যায় দূতাবাসপাড়ায়। অনির্বাচিত স্বৈরশাসকরা মনে করে, জনগণ নয়, রাষ্ট্রদূতরাই ক্ষমতার উৎস। বিদেশি প্রভুদের খুশি রাখলেই ক্ষমতার মসনদ ঠিকঠাক থাকবে এরকম একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায় জনভিত্তিহীন শাসকদের মধ্যে। শুরু হয় বিদেশি প্রভুদের পদলেহনের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খুশি না করতে পারলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না এমন একটি চিন্তা রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায়। এর পেছনে অবশ্য অর্থনৈতিক কারণও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ৭৫-এর পর বাংলাদেশের অর্থনীতি পরনির্ভরতার পথে যাত্রা শুরু করে। বাজেট, উন্নয়ন সবকিছুই দাতাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ভিক্ষা নিলে তো প্রভুদের কথা শুনতেই হবে। শর্তের জালে বন্দি হয় আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং উন্নয়ন ভাবনা। সাহায্য বা ঋণের চেয়ে শর্তের ফর্দ লম্বা হতে থাকে। কিন্তু এখান থেকেই বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর তার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করেন। কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য বিশ্বব্যাংক চাপ দেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ গ্রহণ করেননি সদ্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা, সম্মান এবং স্বাতন্ত্র্যকে কূটনীতিতে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেন। এরই ফলে গঙ্গার পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তির মতো স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজেই একাধিক বক্তৃতায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে গ্যাস বিক্রি করতে তিনি রাজি হননি। এ জন্যই ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি। আমার বিবেচনায় ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার নির্বাচন। ওই নির্বাচনের আগে, বিএনপির ‘নতুন নেতা’ তারেক জিয়া ‘বিদেশি প্রভু’দের তুষ্টিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন যে যা চেয়েছে, সবকিছুতেই সায় দিয়েছিলেন তারেক জিয়া। ক্ষমতায় গেলে তাদের প্রেসক্রিপশন এবং পরামর্শ মেনে চলার মুচলেকা দিয়েই বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া এক কথা আর তার বাস্তবায়ন অন্য কথা। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতকে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার উল্টো করা শুরু হয়। যেমন ভারতের কথাই ধারা যাক। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে ভারতের প্রধান চাওয়া হলো, বাংলাদেশ যেন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়। কিন্তু ৭৫-এর পর থেকে ২০০৮ সালের আগপর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকারই ভারতের এ অনুরোধ রাখেনি। নানাভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলগুলো ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য নিরাপদ চারণভূমিতে পরিণত হয়। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান তার বড় প্রমাণ। শুধু ভারতের সঙ্গে নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বিএনপির ওয়াদা ভঙ্গের ঘটনা ঘটে। আর এরকম পরিস্থিতি ২০০৬ সাল থেকেই কূটনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় নতুন তৎপরতা। আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেউ না, তৃতীয়পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে সবুজ সংকেত দেয় প্রভাবশালী দেশগুলো। এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আনতে বাংলাদেশের অবস্থিত কয়েকটি বিদেশি দূতাবাসের ভূমিকা, এখন কোনো গোপন বিষয় নয়। আবার সুশীলদের নিয়ন্ত্রিত এক-এগারো সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, অযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোই বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের তাগিদ দেয়। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি খোলামেলাভাবে এই প্রসঙ্গটি এনেছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে গেল প্রণব মুখার্জি তাকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেন। যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারে ‘সুশীল’রা কথাবার্তায় যতই পটু হোক না কেন, দেশ পরিচালনায় সীমাহীন ব্যর্থ। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত এক-এগারো সরকারের আসল শক্তি ছিল বিদেশি প্রভাবশালী দেশগুলো। জনগণনির্ভর না থাকায়, এক-এগারো সরকার আসলে দূতাবাসগুলোর কথায় চলত। তাদের নির্দেশেই তারা নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। এ সময় শেখ হাসিনার দৃঢ় অবস্থান এবং অর্থনীতিতে বিস্ময়কর অগ্রগতির কারণে বিদেশি দূতাবাসগুলোর প্রভাব কমতে থাকে। আওয়ামী লীগ দূতাবাসগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও রাজনৈতিক বিষয়ে এড়িয়ে যাওয়ার নীতি শুরু করে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করেন। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেন কেউ হস্তক্ষেপ না করে, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেন।

ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক, সংবিধান সংশোধন করে তা ৭২-এর আদলে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ইত্যাদি ইস্যুতে কূটনৈতিকপাড়াকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেয়নি আওয়ামী লীগ সরকার। উপরন্তু ২০১৪ ও ’১৫ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের নামে বিএনপির জ্বালাও-পোড়াও কেউ পছন্দ করেনি। কূটনৈতিক অঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিএনপির সঙ্গে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সম্পর্ক, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদে বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মীর ঝোঁক দূতাবাসগুলোতে বিএনপিকে অনাহূত করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রায় একঘরে বিএনপি ড. কামাল হোসেনকে নেতা হিসেবে ভাড়া করে। ২০১৮ সালে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দূতাবাস পল্লিতে আবার তৎপরতার সুযোগ পায় বিএনপি। ড. কামালের সঙ্গে ঐক্য বিএনপির চোখ খুলে দেয়। জনগণ না ‘বিদেশি প্রভু’দের স্বপক্ষে আনাটাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডায় পরিণত হয়। এরপর থেকে ঘরে-বাইরে কূটনৈতিক তৎপরতাই বিএনপির প্রধান কাজ। সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশকে বিষিয়ে তুলতে তারা যেমন লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তেমনি বাংলাদেশের কূটনৈতিকপাড়ায় তাদের দৌড়ঝাঁপ ফটোসেশন বেড়েছে। অনেকেই মনে করে ভারত বিএনপিকে পছন্দ করে না। বিএনপির অনেক নেতাই মনে করেন, ভারত চাইলেই আওয়ামী লীগকে হটিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। এ জন্য ২০১৮ সালেও ভারতের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন বিএনপি নেতারা। ভারত এখনো বিএনপিকে আস্থায় নেয় না, এটা ভুল প্রমাণ করতে দলটির নেতারা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নৈশভোজে আমন্ত্রিত হয়ে নিজেদের ধন্য করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে দিনে একবার অন্তত কথা বলেছেন বিএনপি কোনো না কোনো নেতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি কী প্রমাণ করতে চায়? জনগণ নয়, দূতাবাস তাদের ক্ষমতায় আনবে? এটা দেখে সম্ভবত আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা ভয় পেয়েছেন। তারা ভাবছেন, কূটনৈতিক তৎপরতায় বিএনপি যদি আওয়ামী লীগকে কুপোকাত করে দেয়। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে নাজেহাল করে ফেলবে। চাপে জর্জরিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র চাইলে কী না পারে। এমন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেই ইদানীং শোনা যায়। এ জন্য স্যুট কোট পরে মার্কিন দূতাবাসে আওয়ামী লীগের ধরনা মনে হচ্ছে, টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একমাত্র বাধা যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপি ব্যস্ত ‘ভারত’কে খুশি করাতে, আওয়ামী লীগ ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাগ ভাঙাতে। তাই, ডিনার, লাঞ্চ আর ককটেলের উৎসব চলছে দূতাবাস পল্লিতে। দুই প্রধান দল কি আবার জনগণের বদলে দূতাবাসগুলোকে ক্ষমতা বদলের নিয়ন্তা বানানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে? তাহলে জনগণ কী করবে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখবে?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

poriprekkhit@yahoo.com

 



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

জামায়াত কি তাহলে নির্বাচনে যাবে?

প্রকাশ: ১০:০০ পিএম, ২৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলাম। জামায়াতে ইসলামের রাজনৈতিক নিবন্ধন নাই। দলীয় প্রতীক নিয়ে দলটি নির্বাচন করতে পারে না। কিন্তু এবার মার্কিন প্রতিবেদনে জামায়াতের প্রতি এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেখা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে বসে যে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচার এবং লবিং করছেন, কোটি কোটি ডলার খরচ করছেন, তার ফল ভোগ করতে শুরু করেছে জামায়াত। যে জামায়াতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দাবি করত, বিশেষ করে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সে জামায়াতকে রাজনীতি করার অধিকার না দেওয়ার সমালোচনা করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে। একই সাথে জামায়াত যে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারে না, সে প্রসঙ্গটিও উত্থাপন করা হয়েছে।

এটির পেছনে একটি বড় কারণ রয়েছে। বড় কারণ নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক লবিং এবং জামায়াতের কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ। কিন্তু আরেকটি কারণ রয়েছে, জামায়াতকে লাইম লাইটে নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি মেরুকরণ সৃষ্টির চেষ্টা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভূমিকা কি হবে- তা নিয়ে একটি প্রশ্ন ক্রমশ সামনে চলে আসছে। বিশেষ করে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হয়তো বিএনপিকে বাদ দিয়ে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারে। ইতিমধ্যে জামায়াত ৩শ’ নির্বাচনী এলাকায় প্রস্তুতি শুরু করেছে এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় তাদের প্রার্থী চূড়ান্তকরণে কাজ করছে। 

জামায়াতের একাধিক সূত্র বলছে, অন্তত একশটি নির্বাচনী এলাকায় তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এই চূড়ান্ত প্রার্থীরা ইতিমধ্যে মাঠে বিভিন্ন রকমভাবে প্রচারণা করছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জামায়াতকে কি সরকার ছাড় দিবে? এমন একটি প্রশ্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘোরপাক খাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যে, কৌশলগত কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে তারা নির্বাচন বর্জন করেছিল। আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত নিজস্ব প্রতীক পায়নি। বরং তারা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে ২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছিল এবং ২০টি আসনেই তাদের প্রার্থী জামানত হারিয়েছিল। এরপর থেকেই জামায়াতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে ওঠেছে। 

২০১০ সালের পর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকার কারণে রাজনীতির মাঠে জামায়াতকে প্রতিহত করার ডাক আসে। আর এর মধ্যেও জামায়াতের একমাত্র অস্তিত্ব ছিল বিএনপি। বিএনপির ছায়ায় জামায়াত ২০ দলীয় জোট হিসেবে কোনো রকমে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮-এর পর জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে এ রকম কথা আসতে থাকে যে, বিএনপি যুদ্ধাপরাধী এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে এবং তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য গড়েছে। এটিই প্রমাণ করে যে, বিএনপি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাস করে না, আর আন্তর্জাতিক চাপে বিশ্বাস করে। ভারতের নেতিবাচক মনোভাবের কারণেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আস্তে আস্তে বিএনপি জামায়াত থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করে। 

একটা পর্যায়ে বিএনপি ২০ দলকে অকার্যকর করে দেয় এবং জামায়াত ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে চলতে শুরু করে। এরপর জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আর দুই দলের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের পরও সরকার জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়নি, বরং যেখানেই জামায়াতে ইসলামীর কোনো বৈঠক বা  দূরভিসন্ধিমূলক তৎপরতার খবর পাওয়া গেছে, সেখানেই সরকার তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর এ কারণেই জামায়াত মনে করছে যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সরকার একটু চাপের মধ্যে থাকবে। আর এ রকম পরিস্থিতিতে, জামায়াত যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে সরকার হয়তো তাদেরকে নির্বাচনের মাঠে নামার একটা সুযোগ দিবে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে সংগঠনকে নতুন করে পুনর্বিন্যাস করা এবং নতুন করে সংগঠিত করার একটি সুযোগ পাবে জামায়াতে ইসলামী। আর এই পরিকল্পনা থেকেই জামায়াত হয়তো আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সবাইকে একটি চমক দেখাতে চায়।

জামায়াত   মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র   নির্বাচন  


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আওয়ামী লীগ কি ভুল পথে?

প্রকাশ: ০৭:০০ পিএম, ২৬ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক বছরের কম সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ যে ‌'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে এবং প্রধান টার্গেট বিএনপিকে করেছে তা ভুল রাজনৈতিক কৌশল বলে অনেকেই মনে করছে। আওয়ামী লীগের মিত্রহীন হয়ে যাওয়া বিশেষ করে সুশীল সমাজের সাথে সম্পর্কের অবনতি আওয়ামী লীগের ভুল সিদ্ধান্ত বলে কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক গতিপথে পাঁচটি ভুল চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এই ভুলগুলো হলো;

মিত্রহীন: আওয়ামী লীগ ২০১৮ নির্বাচনের পর থেকে 'একলা চলো' নীতি অনুসরণ করছে। সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মহাজোট বা ১৪ দলীয় জোটের কাউকে রাখেনি। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের 'একলা চলো' নীতি অব্যাহত রয়েছে। এটি মহাজোট এবং জোটের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে এবং এই প্রতিক্রিয়া এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ তার আদর্শিক জোট ১৪ দলকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছে। যার ফলে ১৪ দলের নেতারা এখন আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য সমালোচনা করছে। সামনে আওয়ামী লীগের যখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা করব তখন এই সমস্ত জোট এবং দলগুলো কতটুকু সহযোগিতা করবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন বলে অনেকেই মনে করছে।

আমলা নির্ভরতা: আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের পর থেকেই আমলাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এবং আমলাদের নির্ভরতা হতে যেয়ে এক শ্রেণির আমলা সরকারের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস যোগ্যতা এবং অতীত নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। আওয়ামী লীগের অনেকেই মনে করেন, যারা সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করে এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ অনুসরণ করে তারাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বরং সুবিধাবাদী, চাটুকার আমলারা এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেছেন। এরা কঠিন সময় আওয়ামী লীগকে ধোঁকা দেবে বলেই মনে করছেন অনেকে। বিশেষ করে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগ যখন তাদের সহযোগিতা চাইবে তখন তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

বুদ্ধিজীবী এবং সুশীলদের সাথে সম্পর্কের অবনতি: আওয়ামী লীগের সঙ্গে দীর্ঘদিন সুশীল, বুদ্ধিজীবীদের একটি সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একান্ত ভাবে কাজ করেছিল সুশীল সমাজের একটি বড় অংশই। সেই সুশীল সমাজের অধিকাংশই এখন আওয়ামী লীগের ওপর নানা কারণে অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্ধ  এবং তারা নানা করণেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বিরক্ত বটে। আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি গোষ্ঠী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্তবুদ্ধির চিন্তার মানুষের দূরত্ব তৈরি করেছেন। যার ফলে বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে যারা জড়িত তারা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে গেছেন। এটি আওয়ামী লীগের জন্য একটি বড় ভুল বলে অনেকেই মনে করছেন। 

বিএনপিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া: বিএনপির কর্মসূচি এবং অন্যান্য বিষয়গুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আরেকটি রাজনৈতিক ভুল করেছে। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়ার কারণেই বিএনপি পূর্ণ:উদ্ভাসিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বন্ধুহীনতা: রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও আওয়ামী লীগ অনেকটা 'একলা চলো' নীতি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটেছে। আর এক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে মাশুল দিতে হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।

তবে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো আওয়ামী লীগের একজন শেখ হাসিনা আছেন। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে তিনি দলকে একাধিকবার উদ্ধার করেছেন, ভবিষ্যতে করবেন বলে অনেকেই মনে করেন।


মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

যুক্তরাষ্ট্র কি বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৫ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

২৫ মার্চের কালরাত। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর চালাল বর্বর গণহত্যা। এটাকে বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পৈশাচিকতা। জাতিগত নিধনের এ নৃশংসতা গোটা বিশ্বকে স্তব্ধ করেছিল। সায়মন ড্রিং-এর মাধ্যমে বিশ্ব জেনেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ংকর তান্ডবের কিছুটা। আজও বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বীভৎসতার কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে।  হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন কী করেনি পাকিস্তানিরা সেদিন।  এ ভয়ংকর নিধন কর্মসূচির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নিরস্ত্র বাঙালি জাতি জাতির পিতার নির্দেশে ‘যার যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করে’। ’৭১-এর গণহত্যা এবং বর্বরতার নিন্দা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ছিল মানবতার পক্ষে। কেনেডির মতো অনেক মানবিক মার্কিন রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ছিলেন পাকিস্তানিদের পক্ষে। গণহত্যার পক্ষে। পাকিস্তানি বর্বরতায় ছিল তার সরাসরি সমর্থন। তার বিশ্বস্ত হেনরি কিসিঞ্জার জাতিসংঘে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এটি ভুল প্রচারণা।’ মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র সেদিন মানবাধিকার হরণকারী, লুণ্ঠনকারী দখলদারদের সমর্থন দিয়েছিল। সহযোগিতা করেছিল। দীর্ঘ ৯ মাস নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ঠেকাতে কী করেননি? কিন্তু মার্কিন সহযোগিতার পরও বীর বাঙালির কাছে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার অদম্য স্পৃহাকে যে কেউ পরাজিত করতে পারে না তা প্রমাণিত হয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। প্রবল মার্কিন বিরোধিতার পরও আমরা পাই রক্তে ভেজা পবিত্র পতাকা। আমাদের স্বাধীনতা। কিন্তু ’৭১-এর বিজয়ের পরও বাংলাদেশকে মেনে নেয়নি পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ যেন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়, স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন টিকতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। ১৯৭৪ সালে ঠুনকো অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ করে। সংকটে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। জাসদ, গণবাহিনী, সর্বহারা দিয়ে দেশে সৃষ্টি করা হয় অস্থিরতা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে দিয়ে চলে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে রচিত হয় আরেকটি নৃশংসতার কালো অধ্যায়। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এখন যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত দলিলপত্রগুলো উন্মুক্ত করা হয়েছে। এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ’৭৫-এর বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্রের সায় ছিল। তারা ষড়যন্ত্রকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং মদদ দিয়েছিল। সংবিধান লঙ্ঘন করে খুনি মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। খুনিদের বাঁচাতে খুনি মোশতাক এবং জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মতো কালো আইন বানিয়েছিল। এ আইনকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মানবাধিকার হরণকারী আইন বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কোনো দলিলে এরকম জঘন্য একটি আইনের নিন্দা করেনি। এসব কথা মনে পড়ল গত ২০ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্ট ২০২২-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত ৬১ পৃষ্ঠার রিপোর্টটি পড়ে। মনের অজান্তেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তিটি ঠোঁটে এসে গেল- ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।’ যে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এ পাকিস্তানি গণহত্যাকে সমর্থন করেছে। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেনি। ’৭৪-এ বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ’৭৫-এ জাতির পিতার হত্যাকারীদের সমর্থন দিয়েছে- তারাই আজ বাংলাদেশের মানবাধিকারের বিচারক হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি নিক্তিতে মাপার মহান দায়িত্ব স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। সত্যি কী বিচিত্র। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টের তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, এ রিপোর্ট গতানুগতিক গৎবাঁধা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনো রিপোর্ট হুবহু কপি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, রিপোর্টের কিছু বিষয় ইঙ্গিতবাহী এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কিছু মন্তব্য, আকাক্সক্ষা রিপোর্টে লেখা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। তৃতীয়ত, তথ্যের উৎসের ব্যাপারে পক্ষপাত। বিতর্কিত এবং অসত্য তথ্যের ওপর নির্ভর করে রিপোর্টে বেশ কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই হয়নি।

এ রিপোর্টের কিছু কিছু বিষয় গতানুগতিক এবং পুরনো রিপোর্টগুলোর অনুরূপ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রসঙ্গে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে নতুন কোনো কথা নেই। বেশ কিছু স্থানে গত বছরের রিপোর্টই যেন পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। একইভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে, সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গেও মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টে নতুন কিছু নেই। মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২২ এর কিছু কিছু মন্তব্য এবং সিদ্ধান্ত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। ৬১ পৃষ্ঠার বাংলাদেশ সংক্রান্ত মানবাধিকার রিপোর্ট শুরুই হয়েছে ২০১৮-এর নির্বাচন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। রিপোর্টের শুরুতে বলা হয়েছে- ‘বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কাছে বেশি ক্ষমতা ন্যস্ত। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়। পর্যবেক্ষকরা এ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু বলে মনে করেন না। এ নির্বাচনে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিরোধী পক্ষের পোলিং এজেন্ট এবং ভোটারদের হুমকিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়।’ মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট মূলত বছরওয়ারি মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ। ২০২২ সালে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তার ওপরই এ রিপোর্ট সীমাবদ্ধ থাকা সমীচীন। কিন্তু ২০২২ সালের রিপোর্টে কেন ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলো? মজার ব্যাপার হলো, ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে প্রায় হুবহু মন্তব্য করা হয়েছিল ২০১৯ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত ২০১৮-এর মানবাধিকার প্রতিবেদনে। তাহলে চার বছর আগের প্রসঙ্গ নতুন করে উপস্থাপনের কারণ কী? ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্র নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন। গত চার বছরে দুই ডজনের বেশি মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। অর্থাৎ ২০১৮-এর নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে এখন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কী? নির্বাচনের আগে সরকারকে চাপে ফেলা? আর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা তো ১৯৯১ সালেই সংবিধান সংশোধনীতে বৃদ্ধি করা হয়। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন কেন? বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত প্রস্তাবকে সমর্থনের জন্য?

রিপোর্টে একাধিক জায়গায় বিএনপিসহ বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রচ্ছন্নভাবে সমর্থন জানানো হয়েছে। পুরো রিপোর্টে ‘অধিকার’ ‘মায়ের ডাকে’র মতো বিএনপি নিয়ন্ত্রিত সংগঠনগুলোর বক্তব্যকেই গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের ৪ পৃষ্ঠায় গুম প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১৬ জনের গুমের দাবি করেছে স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন। সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো দাবি করেছে জোরপূর্বক নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত বিরোধী দলের নেতা-কর্মী এবং ভিন্ন মতাবলম্বী।’ স্পষ্টতই এটি মায়ের ডাক পরিবেশিত তথ্য। যে ১৬ জনের কথা দাবি করা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকেই ফিরে এসেছেন। এদের কেউ বিএনপি নেতা নন, এমনকি কর্মীও নন। ফিরে আসা অন্তত চারজন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত দুজন সেনাবাহিনীর বহিষ্কৃত কর্মকর্তা। যাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ প্রমাণিত। এরা তাদের নিজস্ব বয়ানে সেটি স্বীকারও করেছেন। মায়ের ডাকের তালিকায় একজনের নাম ছিল যিনি নিজেই পরে স্বীকার করেছেন, বন্ধুদের সঙ্গে তিনি পালিয়ে গেছেন। এরকম একটি অসম্পূর্ণ এবং একপেশে প্রতিবেদন কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় তা এক বিস্ময় বটে। ‘অধিকার’ সংগঠনটির প্রধান আদিলুর রহমান খান, বিএনপিপন্থি আইনজীবী। সাবেক জাসদ নেতা আদিলুর ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালের মে মাসে হেফাজতের ঢাকা তা-বের পর একটি অসত্য, বিকৃত প্রতিবেদনের জন্য তার সংগঠন সমালোচিত। ওই সময়ে হেফাজতের একাধিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার গুজব প্রচার করে ‘অধিকার’। পরে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মনগড়া। দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই অধিকার এ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এহেন গুজব সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট গুরুত্ব পেয়েছে মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে। ‘মায়ের ডাক’ আরেকটি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন একজন বিএনপি নেতার বোন। ‘মায়ের ডাক’ গুম নিয়ে যতগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার আধিকাংশই পরবর্তীতে অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিন প্রতিবেদনে বিএনপির প্রতি পক্ষপাত উথলে উঠছে। কোনো রাখঢাক ছাড়াই বিএনপির প্রতি প্রায় প্রকাশ্য সমর্থন জানানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বিএনপি নেতারা মাঠে যে ভাষায় কথা বলেন, সেই একই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। রিপোর্টের ১৩ পৃষ্ঠায় বেগম জিয়ার দন্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘২০১৮ সালে দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার ১০ বছরের কারাদন্ড হয়। এ মামলাটি ২০০৮ সালে দায়ের করা। আন্তর্জাতিক এবং স্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে খালেদা জিয়াকে দূরে সরিয়ে রাখতেই এ রায় দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞরা বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন নিষ্পত্তিতে আদালত ধীরগতির নীতি নিয়ে চলছে।’ অথচ বাস্তবতা হলো- বেগম জিয়ার আইনজীবীরাই স্বীকার করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের মামলার ব্যাপারে তারা ‘ধীরে চলো নীতি’ গ্রহণ করেছেন। এতিমখানা দুর্নীতি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আপিল বিভাগে হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে শুনানিতে বিএনপির আইনজীবীরা অনাগ্রহী। বিএনপি যখন বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করছে তখন তার দায় সরকারের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য কী? বেগম জিয়া যে দুটি মামলায় দন্ডিত হয়েছেন সে দুটোর রায় হয় দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। তার আইনজীবীরা বারবার উচ্চ আদালতে গেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থনের সব সুযোগ পেয়েছেন। তারপরও যদি এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ হয় তাহলে ন্যায়বিচার কী?

মার্কিন প্রতিবেদনের ২১ পৃষ্ঠায় পড়লে মনে হতেই পারে এটি বোধহয় বিএনপির কোনো লিফলেট। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিএনপির কর্মসূচি পালনে নিয়মিতভাবেই অনুমতি দেওয়া হয় না অথবা বাধা দেওয়া হয়।’ তাহলে সব বিভাগীয় শহরে বিএনপি জাঁকজমকপূর্ণ সমাবেশ করল কীভাবে? এখনো প্রতি শনিবার বিএনপি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগে পালাক্রমে সমাবেশ, বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে কেমন করে? প্রতিবেদনের ৩১ পৃষ্ঠায় ৭ ডিসেম্বর বিএনপি কার্যালয়ের সামনের ঘটনা উঠে এসেছে খন্ডিতভাবে। ১০ ডিসেম্বরে বিএনপিকে যে স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সেখানে সমাবেশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ৭ তারিখে নয়াপল্টনে অবস্থান গ্রহণের চেষ্টা করে বিএনপি। বিএনপি কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় ১৬ বস্তা চাল, ডাল। ব্যস্ত রাস্তায় অবস্থান নিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়া কি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি হতে পারে? অথচ এ বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। একই পৃষ্ঠায় বিএনপি মহাসচিবের বিরুদ্ধে ৮৬টি মামলা এখনো অমীমাংসিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এ ৮৬টি মামলার ৬১টির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রাখা হয়েছে, সেই তথ্যটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে এ রিপোর্টে।

এ রিপোর্টে একটি ভয়ংকর দিক হলো আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টির ওপর আঘাতের চেষ্টা। প্রতিটি দেশেই নিজস্ব রীতি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধ রয়েছে। বাংলাদেশে পারিবারিক বন্ধন হাজার বছরের পুরনো। পরিবার, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, বিয়ে আমাদের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টিকে গভীর করেছে। প্রাচ্যের পরিবার প্রথা, রক্ষণশীল প্রেম বিয়ে, রোমান্টিকতা, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মূল্যবোধকে এখন পশ্চিমা বিশ্ব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ঐতিহ্যগতভাবেই এখানে সমকামিতা, সমলিঙ্গের বিয়ে ইত্যাদি বিষয়কে বিকৃতি মনে করা হয়। আমাদের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি এসবকে লালন করে না। সমকামিতা বা সমলিঙ্গের সম্পর্ককে এ দেশের প্রায় সব মানুষ বিকৃতি মনে করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়েও এটি আমাদের রুচি এবং সংস্কৃতির চেতনার সঙ্গে প্রোথিত। অথচ ৬১ পৃষ্ঠার মানবাধিকার প্রতিবেদনে অন্তত এক ডজনবার এসব পাশ্চাত্য বিকৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ইন্ধন আছে। আমাদের চিরায়ত, সহজাত সামাজিক সম্পর্কের ভিতর এসব পশ্চিমা হতাশাজনিত কারণে সৃষ্ট অনৈতিক এবং রুচিহীন সম্পর্ক চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে মার্কিন প্রতিবেদনে। এমনকি এ প্রতিবেদনে নাস্তিকতাকে সমর্থন এবং তাদের অধিকারের প্রতিও এক ধরনের সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায়। এসব ব্যক্তি উগ্র মৌলবাদীদের মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে থাকে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। অর্থাৎ পাশ্চাত্য হতাশা, বিকৃতি এবং কুরুচি অনুপ্রবেশের এক ধরনের প্ররোচনা আছে এ প্রতিবেদনে। অন্যদিকে আবার যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি লক্ষ্য করা যায় মার্কিন প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টটি তাদের দ্বৈত ও স্ববিরোধী নীতির এক প্রকাশ।

এ প্রতিবেদনের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো জামায়াতপ্রীতি। এ সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের বড় পরিবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০১, ২০০২ এবং ২০০৪ সালের মানবাধিকার রিপোর্টে জামায়াতকে একটি উগ্র দক্ষিণপন্থি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এবার প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে একেবারে ইউটার্ন নিয়েছে। প্রতিবেদনের ১৩ পৃষ্ঠায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- ‘পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিরোধী দলের সদস্যদেরই বিচারে দন্ডিত করা হয়েছে। ’৭১-এ গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। সে জন্যই কি তাদের এ আর্তনাদ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কোনো মানদন্ডে আন্তর্জাতিক মানের। ন্যায়বিচারের প্রতিটি ধাপ যথাযথ অনুসরণ করেই এ বিচারকাজ পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এ বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্র কি তাহলে ’৭১-এর গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনকে আবারও সমর্থন দিল? তারা কি ’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব? এ জন্যই এত আক্রোশ?

মার্কিন প্রতিবেদনের ৩০ ও ৩১ পৃষ্ঠায় স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন জামায়াতের প্রতি সহানুভূতি যেন মাত্রা ছাড়া। এখানে বলা হয়েছে- ‘বিরোধী কর্মীরা ফৌজদারি অভিযোগে অভিযুক্ত। সর্ববৃহৎ মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতের নেতা-কর্মীরা সংবিধানে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ রিপোর্টে ভুলভাবে বলা হয়েছে সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। জামায়াত নামে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়াও এখন বন্ধ। অথচ পুরো ব্যাপারটি হয়েছে সর্বোচ্চ আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। এ জামায়াতকে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য ‘শত্রু’ মনে করত। আগের একাধিক রিপোর্টে এদের তালেবানদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত জামায়াত নারী স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতার পথে অন্তরায়। তাদের অধিকারের জন্য এখন যুক্তরাষ্ট্রের এত আগ্রহ কেন? এটা কি আফগানিস্তান নাটকের পুনরাবৃত্তি? ‘কমিউনিজম’ ঠেকাতে আফগানিস্তানে তালেবানদের পেলে-পুষে বড় করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই তালেবানদের হাতেই আফগানিস্তান তুলে দিয়ে তারা পালিয়েছে। এখন বাংলাদেশে কি একই নিরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করতে চায় বিশ্ব মোড়ল? ’৭১-এ যে দেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার, সেই দেশটি আজ বিশ্বের বিস্ময়। উন্নয়নের রোল মডেল। এ কারণেই কি যুক্তরাষ্ট্রের এত রাগ, ক্ষোভ। এ উন্নয়নও তো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরেক পরাজয়। এ পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই কি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়? পুরো প্রতিবেদনটি নির্মোহভাবে পড়লে মনে হতেই পারে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা আছে। নির্বাচনকে ঘিরে একটি অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত আছে মার্কিন প্রতিবেদনে। তাহলে নির্বাচন বানচাল করে কোন ‘হামিদ কারজাই’কে ক্ষমতায় বসাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। যার অনিবার্য পরিণতি হবে মৌলবাদীদের উত্থান। মার্কিন প্রতিবেদন কি তারই সংকেত?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
poriprekkhit@yahoo.com



মন্তব্য করুন


এডিটর’স মাইন্ড

আরেকটি এক-এগারোর মঞ্চ প্রস্তুত করছে কারা?

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২০ মার্চ, ২০২৩


Thumbnail

২৬ নভেম্বর ২০০৬। একই সাথে রাষ্ট্রপতি এবং তত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন ড: ইয়াজউদ্দিন আহমেদ। সংবিধানের সব বিকল্প শেষ না করেই রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হলো হাইকোর্টে। একই সাথে উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই রাষ্ট্র পরিচালনার বৈধতা এবং চুড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের আগে নির্বাচনী তফসীল ঘোষনা না করার সিদ্ধান্ত চেয়ে তিনটি রীট মামলা দায়ের করা হলো হাইকোর্টে। তিনটি রীট আবেদনের শুনানী চললো তিনদিন ধরে। শুনানী শেষে ৩০ নভেম্বর তিনটি রীটের উপর আদেশ দেয়ার কথা। এসময় বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আর্শীবাদ পুষ্ট তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এক নজীর বিহীন কান্ড করে বসলেন। তিনি তিনটি রীটের শুনানীর কার্যক্রম স্থগিত করে, মামলার সব নথি তলব করলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিচার বিভাগের উপর সরাসরি হস্তক্ষেপের এটি ছিলো বিএনপি-জামাতের আরেকটি বাজে দৃষ্টান্ত। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল এই ‘ভয়ংকর’ কান্ড সম্পর্কে বলেছিলেন ‘আমার ২০ বছরের ওকালতি এবং ২০ বছরের বিচারক জীবনে যে মামলার শুনানী হয়ে গেছে এবং কেবল আদেশের অপেক্ষায় আছে সেখানে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ দেখিনি।” এটি প্রথম এবং একমাত্র বিচার বিভাগের কার্যক্রমে বিএনপির হস্তক্ষেপ ছিলোনা। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে ‘বিএনপির ভাবমূর্তি’ রক্ষার জন্য অন্তত ১২ বার বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল।

প্রধান বিচারপতির ঐ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির এজলাসে গিয়ে প্রতিবাদ জানান। কিন্তু সেই সময় বিএনপি এবং জামাতপন্থী আইনজীবীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। তারা শুরু করেন ভাঙ্গচুর। চড়াও হন আইনজীবীদের উপর। বাইরে থেকে ভাড়া করা লোক এনে সন্ত্রাস চালালো সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। ভাঙ্গচুর এবং অগ্নি সংযোগ করা হয় গাড়ী এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সুপ্রীম কোর্টের এই নারকীয় তান্ডব বাংলাদেশে এক-এগারোর অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঠিক ১৭ বছর পর আবার সুপ্রীম কোর্টকে কলংকিত করলো বিএনপি-জামাত। সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে ঘিরে আবার তান্ডব হলো সুপ্রীম কোর্টে। ১৫ ও ১৬ মার্চ ছিলো সুপ্রীম কোর্টের নির্বাচন। ১৪ মার্চ, নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সাবেক বিচারপতি সৈয়দ মনসুর চৌধুরী প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর রাত আটটার দিকে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সমিতির কনফারেন্স কক্ষে যান বিএনপি জামাতপন্থী শতাধিক আইনজীবী। তারা ভাঙ্গচুর এবং ব্যালট পেপার ছিনতাই করে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এই আশংকায় নির্বাচনের দিন ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গনে। এর মধ্যেই ১৫ মার্চ সকালে বিএনপি-জামাত পন্থী আইনজীবীরা নির্বাচন বানচালের জন্য শুরু করেন আক্রমনাত্মক আচরন। তারা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন। বিকেল ৩টার দিকে শুরু হয় সহিংসতা। গত ১৫ মার্চ আইনজীবী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনা ২০০৬ সালের নভেম্বরের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিলো। তাহলে কি আবার একটি এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্যই সুপ্রীম কোর্ট আক্রান্ত হলো?

শুধু সুপ্রীম কোর্ট কেন? এক-এগারোর কুশীলবরা ২০০৬ এবং ২০০৭ সালের শুরুতে যা যা ঘটিয়েছিল, এখন বাংলাদেশে তার পূনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা করছে। এই প্রক্রিয়া এখন দৃশ্যমান। এক-এগারোর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা ছিলো চোখে পড়ার মতো। তারা বৈঠকের পর বৈঠক করতেন। রাজনৈতিক সমঝোতার আড়ালে দুপক্ষের বিরোধকে উস্্কে দিতেন। সুশীল সমাজের সাথে নিয়মিত পরামর্শ করতেন। এখন সেই একই প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কদিন আগেই বিএনপির নেতারা দল বেঁধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তাদের কাছে গিয়ে নালিশের সুরে বললেন ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি যাবে না।’ তাদের নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী পূণ:ব্যক্ত করলেন। কূটনীতিকরা নির্বাচন কমিশনেও নিয়মিত ধর্না দিচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে হিতোপদেশ দিচ্ছেন প্রায় নিয়মিত। একথা সঠিক যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক এটা সব নাগরিকের প্রত্যাশা। তারা এক উৎসব মূখর পরিবেশে ভোট দিতে চান। কিন্তু একটি দল যদি নির্বাচনে আসতে না চায় তাহলে জনগন আশাহত হওয়া ছাড়া আর কি বা করতে পারে। নির্বাচন কমিশন কি কাউকে টেনে হিঁচড়ে বা হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে আনতে পারে? নাকি ক্ষমতাসীন দলই বিরোধী দলকে আদর আপ্যায়ন করে ক্ষমতায় বসাতে পারে? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি দলের নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সেই দলের একান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে ভোট বর্জন করেছিল। আবার ২০১৮ সালে দলীয় সরকারের অধীনে কোন শর্ত ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। কাজেই বিএনপি তাদের তত্বাবধায়ক সরকারের দাবী ২০১৮ সালেই পরিত্যাগ করেছে। এখন তারা কেন নতুন করে এই দাবী উত্থাপন করছে? বিএনপি কি নির্বাচন করার জন্য এই দাবী করছে, নাকি নির্বাচন বন্ধ করতে? দেশে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার রাজনৈতিক পটভূমি সৃষ্টির জন্যই কি বিএনপির আন্দোলন? বর্তমান সময়ে এই প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

২০০৭ সালে এক-এগারো আনার আগে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন ড: ইউনূস এবং সুশীল সমাজ। ২০০৬ সালে ড: মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরুস্কার পান। এর পরপরই তিনি শুরু করেন রাজনৈতিক দলগঠনের প্রক্রিয়া। কিন্তু এই উদ্যোগ অংকুরেই বিনষ্ট হয়। কিন্তু ড: ইউনূস এতে থেমে থাকেননি। তিনি ‘নাগরিক সংলাপে’র আড়ালে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য মাঠে নামেন। ‘যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন’ শিরোনামে এক সুশীল প্রেসক্রিপশন দেন ড: মুহম্মদ ইউনূস। মূলত: ড: ইউনূসের নেতৃত্বে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার প্রক্রিয়াই ছিলো এক-এগারোর প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু শেষ মুহুুর্তে ড: ইউনূস তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হননি। তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের লিখিত গ্রন্থ ‘শান্তির স্বপ্নে, সময়ের স্মৃতি চারন’ থেকে জানা যায়; ড: মুহম্মদ ইউনূসকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি স্বল্প সময়ের জন্য নয় বরং ১০ বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। এজন্যই তার পছন্দের ব্যক্তি ড: ফখরুদ্দিন আহমেদকে তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান করা হয়েছিল। এখন আবার আলোচনায় ড: ইউনূস। তার পক্ষে ৪০ জন বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বিবৃতির পর এটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে, ড: ইউনূস হাত পা গুটিয়ে নেই। আগামী নির্বাচনে তিনি একটা ফ্যাক্টর। অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি যে চেষ্টা তদ্বির শুরু করেছেন, সেটি আর গোপন নেই। এক-এগারোর সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ছিলেন খুবই তৎপর। তাদের কথা-বার্তা, আর্তনাদ, আকুতি বলেই দিচ্ছিল যে, তারা তৃষ্ণার্ত। ক্ষমতায় আসতে চান। কিন্তু ভোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা তাদের ছিলো না। তাই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তারা। এখনও সুশীলদের তৎপরতা ২০০৬-০৭ সালের মতোই। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে তাদের বেদনা যেন অন্তহীন। এখন যে সব সুশীরা গণতন্ত্র এবং সুশাসন নিয়ে কথা বলেন, এদের কেউ কেউ এক-এগারো সরকারের উপদেষ্টা, স্থায়ী প্রতিনিধি কিংবা নীতি নির্ধারক ছিলেন। তখন তারা কি করেছিলেন, যদি একটু স্মৃতির ঝাপসা হয়ে যাওয়া আয়নাটা পরিস্কার করে দেখতেন। তখন কোথায় ছিলো মানবাধিকার, সুশাসন, ন্যায় বিচার, আইনে শাসন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা? এখন সেই সুশীলদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তারা দায়িত্ব না নিলে শিগ্্গীরই দেশটা রসাতলে চলে যাবে।

এক-এগারো আনতে যারা সক্রিয় ছিলেন সে সময় তারা আবারও তৎপর। একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টার অংশ হিসেবেই কি আবার সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। গত ১৩ মার্চ কাতার সফরের উপর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, দৃঢ়। তিনি চাপে আছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন ‘কোন চাপ নেই যা শেখ হাসিনাকে দেয়া যায়’। দেশের মানুষ জানে, কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করার মানুষ শেখ হাসিনা নন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঐ সংবাদ সম্মেলনে এটাও বলেছেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ সেই ষড়যন্ত্রের আলামত দেখা যাচ্ছে। সুপ্রীম কোর্টের ঘটনা বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকান্ড, পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা, সুশীলদের দৌড়ঝাপ সব একই সূত্রে গাঁথা। সম্মিলিত শক্তি চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করতে। তাহলেই অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পথ তৈরী হবে। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান। বাংলাদেশে এখন যে গণতন্ত্র আছে তাতে অনেক দূর্বলতা দেখা যায়। অনেক সমস্যা, ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। কিন্তু এটা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সবচেয়ে খারাপ গণতন্ত্রও অনির্বাচিত এবং অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে ভালো। তাই গণতন্ত্রকে বোতল বন্দী করার নীলনক্সা রুখতে হবে। যারা এক-এগারোর মঞ্চ বানানোর কাজে আদা জল খেয়ে নেমেছেন, তাদের থামাতেই হবে। অবশ্য এক-এগারোর কুশীলব দের জন্য কাল মাক্সের একটি বাণী প্রযোজ্য। মার্ক্স বলেছিলেন ‘ইতিহাসে একই ঘটনার পূনরাবৃত্তি কখনো হয় না।’ তাই মাক্সীয় সূত্র অনুযায়ী বাংলাদেশে আরেকটি এক-এগারো হবে না। অন্তত: যতোক্ষন রাজনীতির মাঠে অতন্ত্র প্রহরীর মতো জেগে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন