ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম দুই ধাপের নির্বাচন ছিল সহিংস, সন্ত্রাসে ভরপুর। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ১৯৮ ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। এ নির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন ৪০ জনের বেশি। আহত হয়েছেন ৫ হাজারের ওপর। ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে অতীতেও সহিংসতা হয়েছে। তবে এ সহিংসতা ও মৃত্যু কাম্য নয়।’ একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, এবার নির্বাচনী সহিংসতা একটু ভিন্ন ধরনের। আগে নির্বাচনে সন্ত্রাস হতো দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সহিংসতায় রূপ নিত। কিন্তু এবার নির্বাচনী সহিংসতার প্রায় পুরোটাই আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যে। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগকে খুন করছে, জখম করছে। যারা একসঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছেন তারা এখন একে অন্যের ঘাতক। আওয়ামী লীগই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। নিজেরাই নিজেদের সব অর্জন ধ্বংস করছে। আত্মহননের এক ভয়ংকর খেলা চলছে আওয়ামী লীগেই। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের পেছনে ফিরে যেতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ৭২ বছরের পুরনো। এখনো আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল। তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনটি বিস্তৃত। এ দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতির পিতার আদর্শের ধারক দল আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য এ দলের নেতা-কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের চেয়ে জুলুম-নির্যাতন আর কোনো রাজনৈতিক দল সহ্য করেনি। ৭২ বছরে আওয়ামী লীগকে সংগ্রাম করতে হয়েছে ৫০ বছরের বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ইতিহাস একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাইরের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগকে কখনো পরাজিত করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ যতবার হেরেছে প্রতিবার ঘরের শত্রুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আত্মঘাতী গোল আওয়ামী লীগকে বিপর্যস্ত করেছে। মুসলিম লীগ, আইয়ুব খান, মোনায়েম খান আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেননি। বরং এদের নিষ্পেষণে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু থেকে হয়েছেন জাতির পিতা। জাতির পিতাকে স্বাধীন বাংলাদেশে জাসদ সর্বহারা, পরাস্ত করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আওয়ামী লীগের ভিতরে। খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা প্রায় সবাই ’৭৫-এর পর অবৈধ সরকারের অংশ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়েই তারা বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন শপথ নিতে। আওয়ামী লীগের মোশতাক চক্ররা যদি সেদিন বিশ্বাসঘাতকতা না করত তাহলে আগস্ট ট্র্যাজেডি ঘটত কি না তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগ যতবার হোঁচট খেয়েছে, সংকটে পড়েছে প্রতিবার আওয়ামী লীগের একাংশের আত্মঘাতী তৎপরতার জন্য। আওয়ামী লীগ এ অন্তর্ঘাত অস্বীকারও করেনি। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ও নীতিনির্ধারণী সভাগুলোয় আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার আদ্যোপান্ত পাওয়া যায়। ’৭৫-এর ট্র্যাজেডির পর আওয়ামী লীগের বিশেষ কাউন্সিল হয় ৩ মার্চ ১৯৭৮। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ওই সম্মেলনের আহ্বায়ক ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে আওয়ামী লীগের আত্মঘাতী তৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বলা হয়েছিল- ‘জনাব মিজান চৌধুরীদের সংগঠনের বিরুদ্ধে এহেন অপতৎপরতা এই প্রথম নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর আমলে অকাজ-কুকাজের জন্য বহিষ্কৃত জনাব মিজান চৌধুরী ও জনাব মতিউর রহমানের মতো লোকেরা সংগঠনের নেতৃত্ব কুক্ষিগত এবং কবজাভূত করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। রচনা, গ্রন্থনা ও সম্পাদনা নূহ উল আলম লেনিন, পৃষ্ঠা ৪৪৭)। আওয়ামী লীগের বিভক্তি এবং হতচ্ছাড়া অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি উপায়ই ছিল তা হলো বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দলের নেতৃত্বে আনা। আওয়ামী লীগের তৃণমূলের চাপে তা-ই হয়েছিল। দল বাঁচাতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনাকে। ১৯৮১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হন এবং ১৭ মে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকেও দলের ভিতরের আত্মঘাতী তৎপরতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে শুরুতে তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা হয়েছে দলের মধ্যে থেকেই। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সেই আত্মঘাতী তৎপরতার বিবরণও পাওয়া যায়। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই কাউন্সিলে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রিপোর্ট পেশ করেন বেগম সাজেদা চৌধুরী। ওই রিপোর্টে তিনি বলেন, ‘কতিপয় ব্যক্তি দলীয় সংকট মোচনের পথে অগ্রসর না হয়ে সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তুলতে সচেষ্ট হন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগের জন্মের পর হতেই বহুবার বহু নেতা-কর্মীর স্বীয় স্বার্থে ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার মানসে এবং বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও অশুভ শক্তির প্ররোচনায় কেউ কেউ আওয়ামী লীগ সংগঠনকে “ডানপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত অতিবিপ্লবী বাম রাজনীতির ও প্রগতির ধ্বজাধারীর পরিচয় দিয়ে, আবার কেউ কেউ একই অভিন্ন কারণে আওয়ামী লীগ সংগঠন “বামপন্থিদের সংগঠন” রূপে আখ্যায়িত করে নিজেদের তথাকথিত ওয়েস্টার্ন ডেমোক্র্যাসি, ফ্রি ইকোনমি ও ইসলামের অকৃত্রিম খাদেম পরিচয় দিয়ে দল ত্যাগ করেছেন।’ (সূত্র : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল। পৃষ্ঠা ৪৯৯)।
১৯৮৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ সঠিক না ভুল ছিল তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক অমীমাংসিত। এরশাদের নজিরবিহীন কারচুপি ও ‘মিডিয়া ক্যু’ ওই নির্বাচনের ফল পাল্টে দিয়েছিল। কিন্তু ওই নির্বাচনে আবদুর রাজ্জাকদের আত্মঘাতী তৎপরতা না হলে ভোটবিপ্লব হতো বাংলাদেশে। একইভাবে ১৯৯১-এর নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি গ্রুপের আত্মঘাতী হয়ে ওঠা ছিল আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। বিদ্রোহী প্রার্থী, অন্তঃকলহ ’৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করেছে সফলভাবে। কিন্তু একসময় দলের ভিতরে কারও কারও অপতৎপরতা আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। ২০০১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয়ের কারণ উঠে আসে ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দলের সভানেত্রীর ভাষণে। ওই কাউন্সিলে প্রদত্ত ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দলের ভিতরে কোথাও কোথাও কোন্দল ও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ার ঘটনাটিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় কিছুসংখ্যক নিশ্চিত বিজয়ের আসন আমাদের হাতছাড়া হয়েছে।’
২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও আওয়ামী লীগে দেখা যায় আত্মঘাতী তৎপরতা। দলে গণতন্ত্রের জিকির তুলে আওয়ামী লীগ ভাঙার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্র হয়েছিল দলের ভিতরেই।
আওয়ামী লীগ বারবার সংকটে পড়েছে দলের ভিতরের সমস্যার কারণেই। তার পরও দলটি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী সংগঠন এজন্য যে এ ‘আত্মঘাতী’ তৎপরতা প্রতিহত করেছেন কর্মীরা, তৃণমূল। এরাই আওয়ামী লীগের প্রাণ। এরাই ৭২ বছরেও আওয়ামী লীগকে সজীব ও সতেজ রেখেছেন। এদের ঐক্য, স্বার্থহীন ত্যাগ ও নেতৃত্বের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনের ফলেই আওয়ামী লীগ আজকের অবস্থায়। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগের সেই নিঃস্বার্থ, ত্যাগী তৃণমূলই যেন আত্মঘাতী হয়ে উঠেছে। এটাই হলো ভয়ের কারণ।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছে চেয়ারম্যান পদে। শুরু থেকেই এ মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক। তৃণমূলের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রতিক্রিয়া বেশ স্বচ্ছ। জেলা ও উপজেলা নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রে নাম পাঠান। দলের সভানেত্রীর নেতৃত্বে আছে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড। এ বোর্ড স্থানীয় পর্যায় থেকে পাঠানো একাধিক নামের প্রস্তাব থেকে একজনকে মনোনয়ন দেয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে মনোনয়ন নিয়ে সব সময় বিতর্ক থাকে। এখানে দলীয় পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তিগত, পারিবারিক পরিচয় বড় করে দেখা হয়। তাই এসব নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে ভালো হতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যদি দলীয়ভাবে না করা হতো। যে-যার মতো নির্বাচন করত। তা সম্ভব হয়নি। আর সে কারণেই এ নির্বাচনে মনোনয়নের সিদ্ধান্ত অনেক সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া প্রয়োজন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন এলাকায় কথা বলে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তৃণমূলের একটি বিদ্রোহ হয়েছে। এ বিদ্রোহ মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে। তৃণমূলের বিদ্রোহীরা দাবি করেছেন, স্থানীয় নেতা, এমপি এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত। একজন তৃণমূলের নেতা বলেছিলেন, ‘একমাত্র শেখ হাসিনা ছাড়া সবাই মনোনয়ন-বাণিজ্যে জড়িত।’ সবাই না হলেও এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে ব্যাপক মনোনয়ন-বাণিজ্য হয়েছে তা ওপেন সিক্রেট। আওয়ামী লীগের মধ্যেই আলোচনা হয়, চেয়ারম্যান পদে এমপিরা মনোনয়ন বিক্রি করেছেন। সব এমপি যে মনোনয়ন বিক্রি করেছেন তা নয়। অনেক নব্য আওয়ামী লীগার এমপি হয়ে এলাকায় তার ভিত শক্ত করার মিশনে নেমেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের নেতা-কর্মীদের ওএসডি করেছেন। নতুন আওয়ামী লীগ তৈরি করেছেন। এদের ‘এমপি লীগ’ও বলা যায়। এমপি লীগে রাজনীতিবিদ নেই। আছেন ঠিকাদার, গ্রাম্য টাউট, সুবিধাবাদী, মৌলবাদী, ধর্ষক, সন্ত্রাসীরা। এমপি সাহেব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে এদের মধ্যেই তো কাউকে বাছাই করবেন। এরপর কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিয়েছেন। কারও কাজ হয়েছে, কারও হয়নি। যার হয়েছে তিনি তার নতুন আওয়ামী লীগের একান্ত চামচাকে ‘নৌকা’ প্রতীক উপহার দিয়েছেন। তৃণমূলের ত্যাগী প্রার্থীরা হতবাক হয়েছেন। ২০০১-এর পর বিএনপি-জামায়াত তাণ্ডবে এই ব্যক্তি কোথায় ছিলেন? ২০০৭-এর ওয়ান-ইলেভেনে কোথায় ছিলেন? তৃণমূল এটা মেনে নিতে পারেনি। তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। নিজেরা চাঁদা তুলে প্রার্থীর জন্য খরচ করেছেন। নতুন করে সন্ত্রাসী হামলা ও প্রশাসনের অন্যায় আচরণ হজম করেছেন। (সত্যিকারের আওয়ামী লীগ তো এসবে অভ্যস্ত)। তারপর তারা নৌকা প্রতীক পাওয়া নব্য আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়েছেন। কদিন আগে বিজয়ী এক বিদ্রোহী প্রার্থী এবং কয়েকজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এমপি সাহেব যে ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিয়েছেন তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী সাঈদী মুক্তি পরিষদের অন্যতম নেতা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর যারা আক্রমণ করেছিল তাদের একজন ছিলেন নৌকা প্রতীক পাওয়া ওই প্রার্থী। তার মনোনয়ন স্থানীয় তৃণমূল মেনে নিতে পারেনি। তাই সম্মিলিতভাবে তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বেছে নেন একজন প্রবীণ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। ওই ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এ রকম ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা প্রতীকের ভরাডুবি হয়েছে। এরা নির্বাচনে দ্বিতীয়, তৃতীয়ও হতে পারেননি। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে প্রতিহত করেছে। মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের এটি ছিল দৃশ্যমান প্রতিবাদ। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ তৃণমূলের প্রকাশ্য বিদ্রোহ।
আবার বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক স্থানে এমপিরা চেষ্টা-তদবির করেও তার পছন্দের প্রার্থীর মনোনয়ন আদায় করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত মনোনয়ন বোর্ড দলের পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দিয়েছে। কিন্তু এমপি সাহেব তা মানবেন কেন? এটা যদি তিনি মানেন তাহলে তার এমপি লীগের কী হবে? দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে তিনি তার ‘একান্ত অনুগত’ ব্যক্তিকে বিদ্রোহী প্রার্থীরূপে দাঁড় করালেন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও ম্যানেজ করলেন। তারপর নৌকার প্রার্থীকে দৌড়ের ওপর রাখলেন। টাকা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগকেও বিভক্ত করলেন। অবশেষে এমপির পছন্দের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হলেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হেরে গেলেন। ফলে ইউনিয়ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপর্যয় ঘটেছে। প্রথম দফায় কম থাকলেও দ্বিতীয় দফায় শতকরা ৪২ ভাগ ইউনিয়নে বিদ্রোহী বা আওয়ামীবিরোধীরা জয়ী হয়েছেন। সামনে এ প্রবণতা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে।
অতীতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ছিল ঐক্যের প্রতীক। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন দলের স্বার্থের বিরুদ্ধে, দলের নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তখন তৃণমূলের ঐক্যই তা প্রতিহত করেছে। তৃণমূলের ঐক্যের ফলেই বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা জাতীয় গণদাবি হয়েছে। তৃণমূলের সংগ্রামেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে জাতির পিতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। তৃণমূলের ত্যাগের জন্যই ’৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। তৃণমূলের ভালোবাসায় ওয়ান-ইলেভেনের অপশক্তি আওয়ামী লীগের ক্ষতি করতে পারেনি। ২০০৯ সালের কাউন্সিলে উদ্বোধনী ভাষণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলের এ শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের ভয়ভীতি ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেদিন যেভাবে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন তাতে বাঙালি জাতি আবারও উপলব্ধি করতে পেরেছে, একমাত্র আওয়ামী লীগই পারে তাদের আশা-আকাঙ্খা ধারণ করতে।... আওয়ামী লীগের যে কোনো সংকটে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাই বারবার দলকে টিকিয়ে রেখেছেন।
এবার যেন সেই তৃণমূলকেই আত্মঘাতী বানানো হচ্ছে। তৃণমূল বিভক্ত মানেই আওয়ামী লীগ বিভক্ত। তৃণমূলে হানাহানি মানে আওয়ামী লীগে সংকট। তৃণমূলকে বিভক্ত করে কি আওয়ামী লীগের বারোটা বাজানো হচ্ছে? আওয়ামী লীগই হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের হন্তারক। আওয়ামী লীগের কাছেই হেরে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগে যে আত্মঘাতী তৎপরতা তা আওয়ামী লীগকে আরেকটি সংকটের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। আওয়ামী লীগে যেসব স্থানীয় নেতা, এমপি ও কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন-বাণিজ্য করছেন তারা কি জানেন আওয়ামী লীগ দুর্বল হলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না। আওয়ামী লীগে যারা দলের বিদ্রোহীদের মদদ দিয়েছেন, উসকে দিয়েছেন তারা কি জানেন এ বিভক্তি আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বড় ক্ষতি নয়, এটা দেশেরও ক্ষতি। কারণ আওয়ামী লীগ যখন জয়ী হয় তখন একাই জয়ী হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখন গোটা বাংলাদেশ হারে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা।
নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার।
শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন,
ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি
হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়,
দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
এজন্য দেখা যায়, অনেক সন্তান যোগ্যতা
ও মেধায় পূর্বসূরির চেয়েও খ্যাতি অর্জন করেন। আবার অনেক পূর্বসূরি সুনামের মর্যাদা
রাখতে পারেন না। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ছেলে রাজনীতিতে আলো ছড়াতে পারেননি। রাজনীতিতে
সুবিধা করতে পারেননি এ কে ফজলুল হকের সন্তানরাও। গাভাস্কারের ছেলে ক্রিকেটে বড় তারকা
হতে পারেননি। অমিতাভের সন্তান অভিষেক পিতার ছায়ার নিচেই জীবন কাটালেন। ইন্দিরা গান্ধী
বা রাজীব গান্ধীর মতো জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছাতে পারেননি রাহুল গান্ধী। এরকম উদাহরণ
অনেক দেওয়া যায়। উত্তরাধিকারের রাজনীতি এক বাস্তবতা। এতে দোষের কিছু নেই। বিশেষ করে
উপমহাদেশে রাজনীতি উত্তরাধিকার একটি অনুষঙ্গ। বিলাওয়াল ভুট্টো, রাহুল, প্রিয়াঙ্কার
যোগ্যতা এবং রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে তাই কেউ প্রশ্ন তোলে না। বাংলাদেশেও রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের
প্রচলন দীর্ঘদিন ধরেই। দেশের প্রধান দুই দলের জনপ্রিয়তার উৎস হলো উত্তরাধিকার। জাতির
পিতার রক্তের উত্তরাধিকার ছাড়া আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং অস্তিত্ব কেউ কল্পনাও করে না।
আবার বিএনপি টিকে থাকার সূত্র জিয়া পরিবার বলেই মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
দুটি দলেই উত্তরাধিকারের রাজনীতির স্বাভাবিক
প্রবাহ লক্ষ করা যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী রাজনীতিতে এসেছেন উত্তরাধিকার
সূত্রে। পিতা বা স্বজনদের আদর্শের পতাকা তারা বয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্পিকার শিরীন
শারমিন চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি,
শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী, অর্থ প্রতিমন্ত্রী, প্রাথমিক
ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী পারিবারিক পরিচয়ের সূত্রে দ্রুত রাজনীতিতে
এগিয়ে গেছেন। পিতৃপরিচয়ের কারণে এবার আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন এমন সংসদ সদস্যের
সংখ্যা একশর ওপর। এবার নির্বাচনে কয়েকজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সন্তানকে রাজনীতিতে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজেরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার
মোশাররফ হোসেন নিজে প্রার্থী হননি। তার ছেলে নির্বাচিত হয়ে এখন সংসদ সদস্য। রংপুরের
আশিকুর রহমানও ছেলের জন্য নির্বাচন করেননি। ছেলে রাশেক রহমান অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হতে
পারেননি। আওয়ামী লীগ বা বিএনপিতে পারিবারিক পরিচয় একটা বড় স্বীকৃতি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ’৭৫-এর পর ত্যাগ স্বীকার করেছেন, ১৯৮১ সালে কঠিন সময়ে দলের সভাপতির প্রতি
বিশ্বস্ত কিংবা দুঃসময়ে দলের জন্য লড়াই করেছেন, এমন ব্যক্তিদের সন্তানরা আওয়ামী লীগে
বাড়তি খাতির-যত্ন পান। আওয়ামী লীগ সভাপতি তাদের বারবার সুযোগ দেন। দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা
করেন। কেন্দ্রীয় নেতা সাঈদ খোকনের কথাই ধরা যাক। রাজনীতিতে নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হতে
না পারলেও তিনি প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের সন্তান, এ পরিচয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হয়েছিলেন।
এখন এমপি। পিতার পরিচয়ের জোরেই ডা. মুরাদ এমপি, প্রতিমন্ত্রী হন। কিন্তু নিজের অযোগ্যতার
জন্য পিতৃপরিচয়ে পাওয়া অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।
শুধু আওয়ামী লীগে নয়, বিএনপিতেও এ স্বজনপ্রীতি
স্বীকৃত। পৈতৃক পরিচয়েই শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানা কিংবা ইশরাক বিএনপিতে তরতর করে
ওপরে উঠছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে পারিবারিক বন্ধন বাড়তি যোগ্যতা বলেই বিবেচিত হয়।
এজন্য অনেক রাজনীতিবিদই তার সন্তানকে ভবিষ্যতের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
প্রধান দুই দলের রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়, এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ করে। কিন্তু এবার
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান
নিলেন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির ‘স্বজন’প্রীতির
বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের বার্তাটি ঘোষণা করেন। উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত।
৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর এবারও বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজেলা
নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবেও বিএনপির কেউ দাঁড়াতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলের
স্থায়ী কমিটি। যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করবে তাদের বহিষ্কার করা হবে
বলেও সতর্ক করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি সম্ভবত এরকম একটি পরিস্থিতির কথা আগেই অনুমান
করেছিলেন। এজন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার
সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ স্থানীয়
নির্বাচনে দলগতভাবে কাউকে মনোনয়ন না দিলে এবং নৌকা প্রতীক ব্যবহার না করলে অভ্যন্তরীণ
কোন্দল এবং বিরোধ বন্ধ হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
করতে টানা ক্ষমতায় থাকা দলটি ‘ডামি’ কৌশল গ্রহণ করেছিল। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের স্বতন্ত্রভাবে
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। এ সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় পর্যায়ের
বহু আওয়ামী লীগ নেতা ‘নৌকার বিরুদ্ধে’ প্রার্থী হন। ৫৮ জন বিজয়ীও হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যে উত্তেজনা
তা স্বতন্ত্রদের কারণেই। ৫৮ জন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত
করেন ওই নির্বাচনে। এর ফলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ নির্বাচন ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে
স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমা বিশ্ব ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য বিএনপির বর্জনকেও দায়ী করে।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগের ‘ডামি কৌশল’ সারা দেশে সংক্রামক ব্যাধির
মতো কোন্দল ছড়িয়ে দেয়। নির্বাচনের পরও চলতে থাকে মারামারি, হানাহানি, খুনোখুনি। উপজেলা
নির্বাচন উন্মুক্ত করার ফলে এ কোন্দল কমবে এমন আশা ছিল আওয়ামী লীগের। যদিও এ কৌশল এখন
ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। উন্মুক্ত উপজেলা নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিভক্তিকে দগদগে ক্ষতের
মতো উন্মোচিত করেছে।
উপজেলা নির্বাচন উন্মুক্ত করার দ্বিতীয়
কারণ ছিল ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। দলের মনোনয়ন না থাকলে স্বাধীনভাবে যে কেউ নির্বাচনে
দাঁড়াবে। বিএনপিও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ পাবে। ফলে উপজেলা নির্বাচন
হবে উৎসবমুখর। ভোটার উপস্থিতি বাড়বে—এমন একটি প্রত্যাশা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এর বাইরেও আওয়ামী লীগ সভাপতির আরেকটি প্রত্যাশা ছিল। তিনি সম্ভবত চেয়েছিলেন,
সব ধরনের প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন। এ কারণেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার
পরপরই শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
কেউ যেন উপজেলায় পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না দেয়, তাকে জেতানোর জন্য প্রভাব বিস্তার
না করে। সে ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ লিখিত নির্দেশ
দিয়ে বলেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা উপজেলা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করবেন না। প্রভাবমুক্ত একটা
স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। কিন্তু দলের প্রভাবশালীরা
শেখ হাসিনার নির্দেশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান।
উপজেলা নির্বাচনকে কিছু মন্ত্রী এবং
এমপি তাদের রাজত্ব কায়েম করার মোক্ষম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা শুরু করেন। নির্বাচনী এলাকায়
জমিদারি প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ‘মাই ম্যান’কে বসানোর মিশন শুরু করেন
কতিপয় মন্ত্রী-এমপি। ‘মাই ম্যান’ পছন্দ করতে অনেকে বাইরের লোকের ওপর ভরসা রাখতে পারেননি।
যে দলে ‘মোশতাক’দের জন্ম হয়, সেই দলের সুবিধাবাদী নেতারা অনাত্মীয়কে কীভাবে বিশ্বস্ত
ভাববে? মন্ত্রী-এমপিরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেছে নেন
স্ত্রী, সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামা, ভাগনেসহ আত্মীয়স্বজনদের। বগুড়া-১ আসনের
এমপি নির্বাচনী এলাকায় দুটি উপজেলার একটিতে তিনি ভাইকে অন্যটিতে ছেলেকে প্রার্থী হিসেবে
ঘোষণা করেন। টাঙ্গাইল-১ আসনের আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট নেতা এবং এমপি একটি উপজেলায় প্রার্থী
হিসেবে ঘোষণা করেছেন তার খালাতো ভাইয়ের নাম। নাটোরে এক প্রতিমন্ত্রী তার এলাকার রাজত্ব
নিশ্চিত করতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে তার শ্যালককে ‘একক’ প্রার্থী ঘোষণা করেন।
সুনামগঞ্জে সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান
সংসদ সদস্য উপজেলা নির্বাচনে তার ছেলেকে প্রার্থী করে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ
সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নিজ জেলা নোয়াখালীতেই দুজন এমপি দলের সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙুল
দেখিয়েছেন। উপজেলা নির্বাচনে এ দুই সংসদ সদস্য তাদের পুত্রদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা
করেছেন। তাদের একজন আবার ভোট না দিলে উন্নয়ন বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন। মাদারীপুরের এক
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তার পুত্রকে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নিয়েছেন উপজেলা
নির্বাচন। দলের নির্দেশ অমান্য করেই পুত্রের পক্ষে মাঠে নেমেছেন ওই নেতা। এরকম উদাহরণ
অনেক। স্বজনপ্রীতির তালিকা এত দীর্ঘ যে, তা লিখলে পুরো পত্রিকা দখল করতে হবে। সে প্রসঙ্গে
তাই আর যেতে চাই না। তবে মন্ত্রী-এমপিদের উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আগ্রাসী স্বজন তোষণের
প্রধান কারণ এলাকায় ‘পরিবারতন্ত্র’ কায়েম করা। নিজের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এসব নির্বাচনী এলাকার মধ্যে ২০০টিতেও যদি মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনরা উপজেলা চেয়ারম্যান
হন, তাহলে স্থানীয় পর্যায়ে ‘রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হবে। সাধারণ জনগণ তো বটেই, আওয়ামী
লীগ কর্মীরাই পরিণত হবেন প্রজা এবং ক্রীতদাসে। সংকটে থাকা গণতন্ত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করবে। কিছু গোষ্ঠী এবং পরিবারের কাছে জিম্মি হবে গোটা আওয়ামী লীগ।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র
তো আগেই ছিল। পারিবারিক পরিচয়ের কারণে অনেকে যোগ্যতার বাইরে পদ-পদবি পেয়েছেন। পিতার
নাম বিক্রি করে কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি হয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এক বৃহত্তর পরিবার।
তাই যদি হবে, তাহলে এখন স্বজনদের উপজেলার প্রার্থী হতে কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? এর উত্তর
ব্যাখ্যার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগে ত্যাগী, পরীক্ষিত এবং আদর্শবাদী নেতাদের স্বজনদের
পাদপ্রদীপে তুলে আনা হয়েছে একাধিক কারণে।
প্রথমত, এসব নেতা দুঃসময়ে দলের জন্য
জীবনবাজি রেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের সন্তানরাও সেই দুর্বিষহ জীবনের সহযাত্রী
ছিলেন। এটি তাদের জন্য একটি পুরস্কার। ত্যাগী নেতাদের অবদানের স্বীকৃতি। এজন্যই তাজউদ্দীন
আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, মনসুর আলীর সন্তানরা আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ
হয়ে ওঠেন। প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরী, মোহাম্মদ হানিফ, মোহাম্মদ নাসিমের ছেলে এমপি হন।
নির্বাচনে হারলেও ময়েজ উদ্দিনের কন্যাকে সংসদে আনা হয়। দ্বিতীয়ত, ওই সব ত্যাগী নেতার
সন্তানরা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের আদর্শচর্চা করেছে পরিবার থেকে সারা জীবন। আওয়ামী
লীগই তাদের পরিচয়। আওয়ামী লীগ তাদের কাছে এক অনুভূতির নাম। তৃতীয়ত, পরিবার থেকে তাদের
মন্ত্রী-এমপি বা নেতা বানানো হয়নি। তাদের পুরস্কার দিয়েছে দল বা আওয়ামী লীগ সভাপতি।
ডা. দীপু মনি বা শিরীন শারমিনকে তার পিতারা মন্ত্রী বা স্পিকার বানাননি। শেখ হাসিনা
বানিয়েছেন। দূরদর্শী নেতা হিসেবে তিনি তাদের মধ্যে মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চয়ই দেখেছেন।
এটা তার সিদ্ধান্ত। দলের প্রধান নেতা যে কাউকে টেনে তুলতে পারেন আবার ফেলেও দিতে পারেন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে পিতার বদলে যেসব সন্তানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তা দলের সিদ্ধান্ত,
পিতাদের নয়। কিন্তু উপজেলায় মন্ত্রী-এমপিরা নিজেরাই এলাকার ‘মালিক’ বনে গেছেন। তারাই
ঠিক করছেন কে হবেন এলাকায় আওয়ামী লীগের পরবর্তী ভাগ্য বিধাতা। এটা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল। দল যখন উপজেলা নির্বাচনে কাউকে মনোনয়ন দিচ্ছে
না, তখন এমপিরা মনোনয়ন দেয় কীভাবে? এটা সংগঠনবিরোধী, দলের স্বার্থের পরিপন্থি।
এ কারণেই আমি মনে করি আওয়ামী লীগ সভাপতির
সিদ্ধান্ত সঠিক, সাহসী এবং দূরদর্শী। আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী।
তিনি চাইলে শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিকী সবাইকে
মন্ত্রী-এমপি বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শেখ হাসিনার পরিবারের যে সংজ্ঞা
ও নাম জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেছিলেন, তাদের কেউই আওয়ামী লীগের নেতা নন, মন্ত্রী বা এমপি
নন। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে কোনো নেতার চেয়ে তার দেশ ও দলের জন্য বেশি অবদান রাখছেন।
শেখ হাসিনা যদি দল পরিচালনায় নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তার সত্যিকারের অনুসারীরা
কেন চর দখলের মতো এলাকা দখল করবেন? শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী। দলকে ব্যবহার
করে আওয়ামী লীগের যেসব পরিবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, এটা তাদের জন্য সতর্কবার্তা। দলের
ত্যাগী, পরীক্ষিতদের জন্য উপহার। কিন্তু আওয়ামী লীগ সভাপতির এ নির্দেশ ক্ষমতা লিপ্ত
নেতারা মানবেন কি? অতীতেও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার অনেক ভালো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে
দেয়নি দলের ভেতর স্বার্থান্বেষী কুচক্রীরা। এবারের নির্দেশনার পরিণতি কী হয়, তা দেখার
অপেক্ষায় রইলাম।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: poriprekkhit@yahoo.com
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন ড. আব্দুর রাজ্জাক শাহজাহান খান
মন্তব্য করুন
ইরান-ইসরায়েল শেখ হাসিনা শান্তির দূত জো বাইডেন ইরান
মন্তব্য করুন
আব্দুর রহমান জাহাঙ্গীর কবির নানক ড. হাছান মাহমুদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম
মন্তব্য করুন
রাজার ছেলে রাজপুত্র। ভবিষ্যতের রাজা। নাপিতের ছেলেই পিতার পরিচয় ধরে রাখবে। উকিলের সন্তানই পিতার সেরেস্তার উত্তরাধিকার। শিক্ষকের ছেলে শিক্ষক হলেই তো মানায়। নেতা বা রাজনীতিবিদের ছেলেমেয়ে রাজনীতিবিদ হবেন, ভবিষ্যতের নেতা হবেন—এটাই স্বাভাবিক। পেশার উত্তরাধিকার প্রত্যাশিত। দেশে দেশে এমনটি হয়েই থাকে। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে যিনি যে পেশাতেই আসুন না কেন, তাকে যোগ্য হতে হয়, দক্ষ হতে হয়। যোগ্যতা না থাকলে শুধু পিতৃপরিচয়ে উজ্জ্বল হওয়া যায় না।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের সহজ উপায় কি? এক কথায় এর উত্তর হলো রাজনীতি শূণ্য করা। গণতন্ত্রে রাজনীতি হলো রক্ত সঞ্চালনের মতো। একটি দেহে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহ বন্ধ হলে, মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি গণতন্ত্রের মৃত্যু হয় বিরাজনীতিকরণে। বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণে চেষ্টা চলছে বহুদিন থেকে। কিন্তু এখন সবাই মিলে আনুষ্ঠানিক ভাবে দেশকে রাজনীতিহীন করার উৎসবে মেতেছে। রাজনীতি হত্যার উৎসব চলছে দেশে। দেশে এখন কোন রাজনীতি নেই। রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জনগণের হৃদয় জয়ের চেষ্টা নেই। আছে শুধু ‘ব্লেইম গেম’। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পাল্টাপাল্টি গালাগালি। কুৎসিত, কদর্য কথার খিস্তি।
দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে শেষ পর্যন্ত যদি স্বজনদেরকে প্রার্থী করেন তাহলে দলের পদ হারাতে পারেন আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে এ রকম বার্তা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাথে দলে বিশৃঙ্খলা এবং ভাই, ভাতিজা, শ্যালক, মামাদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী করার তীব্র সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করেন।
ইরান-ইসরায়েল ইস্যু ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। তৈরি হয়েছে যুদ্ধ পরিস্থিতি। ইরান যে কোন সময় ইসরায়েল হামলা করতে পারে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সারা বিশ্ব উৎকণ্ঠিত। এক অস্থির যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানিয়েছে, ইরানের আক্রমণের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ভূখণ্ড তারা ব্যবহার করতে দেবে না। সব কিছু মিলিয়ে একটি বিভাজন এবং বৈরি পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হলো এই বৈরি পরিবেশে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন উদার নৈতিক নেতা নেই যিনি এই পরিস্থিতিতে সকল পক্ষকে আস্থায় নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আর এরকম শূন্যতার মধ্যে শেখ হাসিনাই হতে পারেন আলোকবর্তিকা।
আওয়ামী লীগে নীরবে নিভৃতে পালাবদল ঘটছে। এক সময় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মানে ছিলেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, শেখ সেলিম, মতিয়া চৌধুরী। এখন তাদের অধ্যায় আস্তে আস্তে যবনিকা ঘটেছে। শারীরিক ভাবে তারা অনেকেই অসুস্থ। অনেকে এখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। বরং একটি নতুন প্রজন্মকে আওয়ামী লীগ সভাপতি সামনে নিয়ে আসছেন। তাদেরকে নীতি নির্ধারক হিসেবে জায়গা করে দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের এই পালাবদলটি শেখ হাসিনার দূরদর্শী রাজনীতির একটি অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।