ইনসাইড আর্টিকেল

সেই দুঃসহ স্মৃতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:০৯ এএম, ০৬ অগাস্ট, ২০১৮


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে রহীম শাহ সম্পাদিত শেখ ফজলুল করিম সেলিম এর ‘সেই দুঃসহ স্মৃতি’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।

সেই দুঃসহ স্মৃতি

শেখ ফজলুল করিম সেলিম

পনেরই আগস্ট। ৭৫- এর এ দিনটিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের। সেই কালোরাত্রিতে আরও হত্যা করা হয়েছিল বাংলা বাণীর প্রতিষ্ঠাতা, অগ্রজ শেখ ফজলুল  হক মনি ও আমার অন্তঃস্বত্ত্বা ভাবী শামসুন্নাহার আরজুকে। মনি ভাই ও ভাবীকে যখন হত্যা করা হয়, তখন আমিও তাঁদের পাশে ছিলাম। ঘাতকদের ব্রাশ ফায়ারের বুলেটে বিদ্ধ মনি ভাই ও ভাবীর দেহ মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। আমিও তাঁদের সঙ্গে লুটিয়ে পড়ি। তাঁদের রক্তধারার উপর আমার লুটিয়ে পড়ায় দেহের জমাকাপড় ভিজে যায়। স্বজন হননের সেই হৃদয়বিদারক মর্মন্তুদ মূহূর্তে নৃশংস ঘটনার সময় আমি প্রাণে বেঁচে গেলেও সেই দুঃসহ স্মৃতি আজ এত বছর পরও চোখের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে।

ঐ কালো অধ্যায় আজ কালের চাকায় বহু বছর পিছনে। কিন্তু স্মৃতির মিনারে ইতিহাসের সেই করুণ অধ্যায়টির চাক্ষুস অবলোকন এখনও আবছা হয়ে যায়নি। বরং যতই দিন যাচ্ছে, মাস যাচ্ছে, আর বছর ঘুরে পনেরই আগস্ট আসছে, ততই স্বজন হারানোর পাথরচাপা শোক শুধু অশ্রুতে নয়, স্মুতির মিনারে অক্ষয় চিরঞ্জীব মানুষগুলোর মহান মৃত্যুর রক্তধারার উষ্ণ স্রোতের স্পর্শের অনুভবে সেই শোক এখন শক্তির উৎস। কী করে, কীভাবে চোখের সামনে মনি ভাই ও ভাবীকে হত্যা করা হলো, তার স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মনে পড়ছে, নিজেরও বাঁচার কথা ছিল না। কিন্তু সবচেয়ে বড় সত্য, সকল নির্মম ঘটনা ও কালো অধ্যায়ের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হয়তো ইতিহাসের প্রযোজনেই অলৌকিকভাবে বেঁচে যায়। সৌভাগ্য বলুন বা দুর্ভাগ্য বলুন, আল্লাহ তা’ আলারই ইচ্ছায় মনি ভাই ও ভাবীর রক্তধারা গায়ে মেখে ঐদিনের প্রত্যক্ষ বিবরণের জন্য আমিও বেঁচে আছি।

দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আগস্টের সেই কালো রাতে মনি ভাই ও ভাবীকে হত্যার একটি চাক্ষুস বিবরণ জাতির কাছে পেশ করার জন্য ঐতিহাসিক দায়েই আজ আমি কলম ধরেছি। এই বিবরণ চোখে যা দেখেছি, তা-ই লিপিবদ্ধ করলাম।

১৩ নম্বর সড়কস্থ ধানমন্ডির একটি বাড়ি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মনি ভাই এই বাড়িতেই ছিলেন। দোতলা বাড়ির সামনে এই চিলতে উঠোন। পনেরই আগস্টের আগের দিন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকেই বাড়ি লোকে লোকারণ্য। বিভিন্ন জেলার নেতৃবৃন্দ জড়ো হয়েছিল মনি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মনি ভাই তখন বাকশাল সেক্রেটারি। আমি এইদিন বিভিন্ন কাজকর্ম শেষ করে রাত এগারটার দিকে বাড়িতে ফিরি। তখন মনি ভাই ছিলেন না। তাঁর জন্য অপেক্ষমান দূরদূরান্ত থেকে আগত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছিলাম। মনি ভাই তখন অফিসেও ছিলেন না।

রাত সাড়ে এগারটায় মনি ভাইয়ের গাড়ি এল। কিন্তু উনি এলেন না। ড্রাইভার রহমান বলল, ‘মনি ভাই ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে গেছেন, নিজে গাড়ি পাঠিয়ে। উনি তখনও ফেরেননি।

রাত সাড়ে বারোটা। মাকে নিয়ে মনি ভাই এলেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাঁর বেডরুমে দু’জনে অনেকক্ষণ একসঙ্গে ছিলেন। তখন ওখানে অন্য কেউ ছিলেন না। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে বলে এবং মা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছেন বলে মামী (বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী) ডাইনিং রুমে গেলেন। বঙ্গবন্ধু মনি ভাইকে বললেন, ‘মনি, বুজিকে নিয়ে আমার সঙ্গে চারটে খেয়ে যাও।’

বাড়ি ফিরতে দেরি হবে বলে মা ও মনি ভাই না খেয়েই চলে গেলেন।

আজ ব্যথায় বুক মোচড় দেয়, মনি ভাইকে চারটে ভাত একসঙ্গে খেয়ে যাবার আমন্ত্রণেই ছিল দু’জনার মধ্যে শেষ কথা।

মনি ভাই মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন আমি লনে। গাড়ি থেকে নেমে মা দোতলায় আর মনি ভাই ড্রয়িং রুমে চলে গেলেন। মনি ভাই তখন সারাদিন পরিশ্রমে ক্লান্ত ও অবসন্ন। কিন্তু চোখে আত্মপ্রত্যয়ের দৃষ্টি। সমবেত ব্যক্তিবর্গের উদ্দেশে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আগামীকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। ওখানে আমাকেও যেতে হবে।’

এরপর সকলেই চলে গেলেন। পৌনে একটার দিকে মনি ভাই খেতে বসলেন মা ও ভাবীকে নিয়ে। খাওয়া-দাওয়ার পর আত্মজ পরশ-তাপসের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বেডরুমে ঘুমাতে গেলাম। মনি ভাই মিনিট তিনেক বাদে বেডরুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরি রুমে ঢুকে বইপত্র ঘাঁটলেন। ঘুমোতে যাবার আগে বই পড়া আর খুব সকালে উঠে জাতীয় দৈনিকগুলো পাঠ করা মনি ভাইয়ের নিত্যদিনের রুটিন। লাইব্রেরি রুম থেকে একটি বই বেছে নিয়ে বেগরুমে এলেন। বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর লেখা একটি বিখ্যাত দলিল। নাম- লাস্ট ব্যাটল। বুকের উপর বই মেলে ধরে শুয়ে শুয়ে তিনি এটা পড়ছিলেন। মনি ভাই একা জেগে বিখ্যাত বইটি যখন পড়ে যাচ্ছিলেন, তখন বাড়ির সকলেই ঘুমে নিমগ্ন। রাত্রির শেষ প্রহরে ঢাকা মহানগরীও ঘুমন্ত।  

ভোর প্রায় ৫য়াটা। ঘুম থেকে উঠে পড়লেন মনি ভাই। পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। নিয়ে নেমে এলেন দৈনিকগুলোর উপর চোখ বুলানোর জন্য। হঠাৎ চোখ পড়ল বাইরের দিকে। গেইট থেকে ২০/২৫ গজ দূরে আর্মির ল্যান্সার ফোর্সের এই দলটিকে দেখামাত্রই মনি ভাই আবার ত্বড়িৎ গতিতে উপরে উঠে এলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় চিন্তিত তাঁর মুখাবয়ব। কিন্তু একেবারে বিচলিত হলেন না তিনি। ওই সময়ে আমার স্ত্রী ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য যায়। মনি ভাইয়ের চিন্তিত মুখাবয়ব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মনি ভাই, কী হয়েছে?’

 

মনি ভাই কোনো কথা বললেন না। তার চোয়াল শক্ত হলো। বেডরুমে ঢুকে ফোন করলেন। আকাঙ্ক্ষিত নম্বরে ডায়াল করে এনগেইজড টোন পেলেন। খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধুকেই ফোন করেছিলেন। এরপর ফের টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর নেই। এই সময় ফোন বেজে উঠল। মনি ভাই ধরলেন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল, সেরনিয়াবত সাহেবের বাড়ি আক্রান্ত। ‘ফোন রাখো, আমি দেখছি’- মনি ভাই ফোন ছেড়ে দিলেন। ঠিক এ সময়ে সেনাবাহিনীর ৬/৭ জন লোক ভারী বুটের শব্দ সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠতে উঠতে চিৎকার শুরু করল, ‘মনি সাহেব কোথায়, উনি আছেন?’

মনি ভাই দ্রুত বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে সামনের ছোট স্পেসে আগন্তুকদের মুখোমুখি হয়ে বললেন, ‘আমি; কী হয়েছে?” তেজী ও ভারী কণ্ঠের আওয়াজে আগান্তুকরা ইতস্তত। মনি ভাই আবার বললেন , ‘কী হয়েছে বলুন?’

ওদের ভিতর থেকে একজন বললেন, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’

তখনি মনি ভাই বললেন, ‘হোয়াই, কী অন্যায় করেছি আমি?’

ক্ষিপ্ত একজন ঘাতক সঙ্গিন উঁচিয়ে মনি ভাই-এর মাথায় আঘাত করল, চুলের ঝুটি জাপটে ধরল। দৃশ্য দেখে ছুটে গিয়ে আমার স্ত্রী আমাকে ডাকল। বলল, ‘কী সাহস, কারা যেন মনি ভাইকে মারছে।’

চুলের ঝুটি ধরা হাতটা ঝাপটা দিয়ে ছাড়ালেন। ভাবীও তখন বেড রুম থেকে এসে মনি ভাই এর ডান পাশে দাঁড়াল। আমি মনি ভাই-এর পাশে, আমার পাশে আমার স্ত্রী। পরশ-তাপস দরজার সোজাসুজি ঘরে বিছানায় শায়িত। অনুজ মারুফ তখন নিচে গান-পয়েন্টের মুখে। মনি ভাইয়ের চুল, ছাড়িয়ে নেওয়ার পর ওদের একজন আবার বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে, এগেইন রিপিট ইট, ইউ আর নাউ আন্ডার অ্যারেস্ট।’

মনি ভাই বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’-এ কথা বলে একটু ঘুরে ঠিক যে মুহূর্তে তিনি জামাকাপড় পাল্টানোর জন্য তার রুমের দিকে উদ্যত হয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই দুইগজ দূর থেকে শুরু হলো ব্রাশ ফায়ার। সামনের আড়াই বাই তিন ফুট স্পেসের উপর আমরা সবাই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ি। মনি ভাই ও ভাবীর গায়ে বুলেট বিদ্ধ হয়ে রক্তধারায় মেঝে লাল হয়ে যায়। আমার ও আমার স্ত্রীর গায়ে গুলি লাগে নি। মনি ভাই ও ভাবীর রক্তধারায় আমর জামা কাপড় রঞ্জিত হলো, ওরা আবার ফায়ার শুরু করল। এবারও গায়ে লাগল না। আমার স্ত্রী দরজার আড়ালে ছিল। এরপর তাড়াহুড়ো করে আগন্তুক খুনিরা নিচে নেমে যায়। গুলির শব্দে পরশ-তাপস চিৎকার করে ওঠে। আমার স্ত্রী দৌড়ে ওদের কাছে ছুটে যায়। ওদের জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, চিৎকার করোনা, লক্ষ্মীটি চিৎকার করো না।’

 

ওরাও তখন কিছু বলল না। চাচির বুকের উপর পড়ে ডুকরে চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। একই সঙ্গে মাও চিৎকার করে তার রুম থকে বেরিয়ে আসেন। এরপর মা অজ্ঞান হয়ে ঐ রক্তধারার উপর লুটিয়ে পড়েন। এই চিৎকার শুনে খুনিরা আবার ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। এই গুলি কারো গায়ে লাগে নি। ঘাতকরা চলে যাবার সময় বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ছিল। আমরা তখন মৃত্যর মুখোমুখি হয়ে পরম করুণাময় আল্লাহতালার কাছে এই অবিচারের আরজি পেশ করলাম। ওদের গুলির ঝাঁঝে সারা বাড়ি মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসযজ্ঞের পরিণত হয়। খুনিরা অতঃপর চলে গেল।

মা’র সঙ্গে সঙ্গে আমার বৃদ্ধ পিতা শেখ নূরুল হক ঘর থকে বের হয়ে এসে এই করুণ অবস্থা দেখতে পেয়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ তিনি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে থাকেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেশ করলেন, ’মনিকে কারা মারল?’

আমি বললাম, ‘আর্মি।’

একথা শুনে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’

আমি বললাম, ‘জানি না।’

এরপর তিনি নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে মনি ভাইয়ের লুটিয়ে পড়া দেহের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

এরপর রক্তাপ্লুত দেহ দিয়ে মেঝেতে উঠে মনি ভাই-এর দিকে ঝুঁকে তাকালাম। মনি ভাই নিথর, নিস্পন্দ। ভাবীর দিকে চোখ ফেরালাম। তাঁর ঠোট নড়ছে। যন্ত্রণার আর্তিতে বলে উঠলেন, ‘আমার পেট ছিড়ে-ফুড়ে গেছে। কোমরে শাড়ির বাধনটি একটু হালকা করে দিন।’

আমার স্ত্রী কোমরের বাধন হালকা করে দেওয়ার পর ভাবীর মুখ মেঝেতে এলিয়ে পড়ল। তিনি বললেন, ‘আমাকে বাঁচান। আমার দুটো বাচ্চা আছে।’

পরশ-তাপস তখন তাদের চাচির বুক থেকে মা-বাবার রক্তাপ্লুত দেহের কাছে ছুটে এল। ওরা করুণ আর্তিতে মা-বাবার মুখের কাছে মুখ রেখে ভেঙে পড়ল, ‘মা, কথা বলো, বাবা, কথা বলো।’

নিচে থেকে ছোট ভাই মারুফ উঠে এল। তার চোখ পাথরের মতো অনড়। আমি তাড়াতাড়ি ৩২ নম্বরে ফোন করলাম। কিন্তু লাইন পেলাম না। মারুফ চেষ্টা করে ফোনে শেখ জামালকে পেল। ওরা দু`জনে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। মারুফ জামালকে জানাল, মনি ভাইকে মেরে ফেলেছে, ভাবী আহত। শোনার পরই জামালের উদ্ভ্রান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘দোস্ত রাখ। আমাদের বাড়িতেও গুলি হচ্ছে।’

এরপর মারুফ ফোন রেখে দেয়। তখনো বুঝতে পারছি না কী ঘটছে? আমি, মারুফ ও শাহাবুদ্দিন মনি ভাই ও ভাবীকে নিয়ে পিজিতে ছুটলাম। আমার গাড়িতে ছিল ভাবী। মারুফের গাড়িতে মনি ভাই। পথে মোস্তফা মহসীন মন্টুর দেখা পেলে মারুফ তাকে গাড়িতে নেয়। পিজির সামনেই দেখলাম, আর্মি পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশ বেতারের সামনেও আর্মি। ওদিকে যাওয়াই মুশকিল। গাড়ি ঘুরিয়ে মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে আসার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে হর্নের শব্দ শুনলাম। ঐ গাড়িতে ছিল আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের লাশ। ঐ গাড়িতেই ছিল রমনা থানার ওসি মি. আনোয়ার। তিনিও জানতেন না কী ঘটছে।

মনি ভাইকে সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দেওয়া হলো, ভাবীকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য ওয়ার্ডে। ইমারজেন্সি বারান্দায় সেরনিয়াবাত সাহেবের ১১ বছরের গুলিবিদ্ধ কন্যা বেবী একটু একটু নড়ছে। ডাক্তারকে বলল, ‘একটু দেখুন।’

কিছু সময় পর সে আর বাঁচে নি। এই কিশোরীটিও আমার চোখের সামনে বলি হলো। মনি ভাইয়ার কাছে তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম। ডাক্তার বললেন, ‘উনি আপনার কে হন?’

‘আমার ভাই।’

‘দুঃখিত। অনেক চেষ্টা করেছি। বাঁচাতে পারলাম না।’

মনি ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনে কয়েক মিনিট পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আবার ছুটে গেলাম । ভাবীর কী অবস্থা দেখতে। ধারণা ছিল ভাবী হয়তো বেঁচে যাবেন। কিন্তু তিনিও এই সুন্দর পৃথিবীতে অসুন্দরের হাতে বলি হয়ে পরপারে চলে গেলেন।

মনি ভাইয়ের বুকে, লাংসে ও থুতনিতে তিনটি গুলির চিহ্ন ছিল। আর ভাবীর পেট ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তখনই বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে মেডিকেল কলেজে বুলিটবিদ্ধ কয়েক জন আহত লোক এল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসার কাজের লোক আলতাফ ছিল। সে মারুফকে বলল, ‘ভাই সাহেবকে, কামাল ভাইকে, সবাইকে মেরে ফেলেছে।’

এ খবর মারুফ আমাকে বলার পর তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারি। এর কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতাল আর্মি ঘেরাও করল। আমি বাসায় ফোন করে বললাম, ‘তোমরা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ো। পাশের বাসায় চলে যাও।’

ফোন করেই আমি, মারুফ ও শাহাবুদ্দিন হাসপাতালের তিন তলায় চলে গেলাম। তখন বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। এদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় কোনো চেনামুখ দেখা গেল না। ওরা চিৎকার করে বলেছেন, ‘লাশ দিন, আমরা মিছিল করব।’

পরে অবশ্য অস্ত্রের দাপটে মুহূর্তের মধ্যে এলাকাটি জনশূন্য হয়ে যায়। এরপর হাসপাতালে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমাদের গায়ের জামাকাপড়ে মনি ভাই ও ভাবীর রক্তের চিহ্ন। এভাবে বের হওয়া মুশকিল বিধায় চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এস. এম. মনিরুল হক ও আরও কয়েকজন ডাক্তার খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের বের করে দেন। রক্তাক্ত জামা-কাপড়গুলো খুলে ফেলে ওদের জামাকাপড় পরেই বের হয়েছিলাম।

বাড়িতে ফিরে দেখি বাড়ির লোকজন কেউ সরে যায়নি। আমরা তখন আরও উদ্বিগ্ন। আমাদের দেখেই পরশ ও তাপস কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওরা বললো, ‘চাচা, আমাদের মা-বাবা কোথায়? মা-বাবার কাছে আমাদের নিয়ে যাও।, মা-বাবাকে আমাদের কাছে এনে দাও।’

পরশের বয়স তখন পাঁচ। তাপসের বয়স সাড়ে তিন। এই অবোধ শিশু দুটির প্রশ্নের জবাব সেদিন দিতে পারিনি। বুক থেকে একটি ভারি বাতাস কণ্ঠ অবধি এসে আটকা পড়েছিল।

আবার শুনলাম, সেই একই চিৎকার- ‘মনি নাহেব আছেন?’

সামরিক উর্দিপরা একদল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। আমি জবাব দিলাম, ‘উনি নেই, হাসপাতালে।’

পুনরায় জিজ্ঞেস করল, ‘মারুফ আছে?’

বললাম, ‘বাইরে।’

ওরা বলল, ‘ছোটাছুটি করবেন না। আমরা দেখছি।’

আমরা সেই বাড়িটি ত্যাগ করে পাশের একটি বাড়িতে চলে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, আরেকটি সামরিক গাড়ি। কিন্তু আর্মি বাড়িতে ঢুকে কী যেন তল্লাশি করল এবং লুটপাট করতেও আর বাকি রাখলো না।

মনি ভাইয়ের সেই মৃত্যুকালীন জিজ্ঞাসা- ‘কী অন্যায় করেছি আমি?’- এখনো আমার কানে বাজে। কানে বাজে ভাবীর সেই শেষ আর্তনাদ- ‘আমাকে বাঁচান। আমার দুটো বাচ্চা আছে।’  

 [রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ২৯ থেকে ৩৪)]

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ

 



মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

'এপ্রিল ফুল' এর ট্র্যাজেডিতে কি জড়িয়ে আছে?

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০১ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এদিনে একে অপরকে চমকে দিয়ে 'বোকা বানাতে' চায়। যদিও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এই প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না।

পহেলা এপ্রিল পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকে কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। অন্যথায় কারো না কারো কাছে তাকে বোকা হিসেবে পরিচিত হতে হবে এবং এটি নিয়ে হাস্যরস তৈরি হতে পারে।

এ দিনটিকে তাই বলা হয় অল ফুলস ডে, বাংলায় বোকা বানানোর দিনও বলতে পারেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফলাও করে ভুয়া ও ভুল সংবাদ ছাপায়। পরদিন অবশ্য সেটার সংশোধনী দিয়ে জানিয়ে দেয় খবরটা আসলে এপ্রিল ফুল ছিল।

একই সাথে এদিন পরিবারের ছোটরা সাধারণত বড়দের সাথে নানাভাবে মজা করে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আবার বন্ধু বা কলিগরাও একে অন্যের সাথে মজা করে। তবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে শেষে সবাই মিলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় 'এপ্রিল ফুল'।

ধারণা করা হয়, ইউরোপে এপ্রিল ফুলের প্রসার ফ্রেঞ্চ জাতির মধ্যে। ফ্রেঞ্চরা ১৫০৮ সাল, ডাচরা ১৫৩৯ সাল থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে কৌতুকের দিন হিসেবে পালন শুরু করে। ফ্রান্সই প্রথম দেশ হিসেবে সরকারিভাবে নবম চার্লস ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন । অর্থাৎ তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালীয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী প্রবর্তিত গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। পাশাপাশি ১ এপ্রিল বন্ধুদের উপহার আদানপ্রদানের প্রথা বদলে যায় ১ জানুয়ারি। কারণ তখন বিভিন্ন দেশে জুলিয়ীও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউইয়ার পালিত হত ১ এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই তাদের পুরনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ১ জানুয়ারির পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাঁকি দিতে ১ এপ্রিলে ভুয়া উপহার পাঠানোর প্রথা চালু করে।

ফ্রান্সে কাউকে বোকা বানালে বলা হত এপ্রিল মাছ (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় poisson d’avril. এই্ নামকরণের কারণ, রাশিচক্র অনুযায়ী স্বর্গের কাল্পিক রেখা অতিক্রম করলে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত।

ডাচদের আরও কারণ রয়েছে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিল তারা নিজেদেরকে গুইযেন বা ভিখারী বলে পরিচয় দিত । ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোট শহর ডেন ব্রিয়েল করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেষ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান বা দ্যা ডিউক অব অ্যালবা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। সেই থেকে দিনের প্রচলন।

মুসলমানদের জন্য ট্র্যাজেডির?

বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ধারণা এপ্রিল ফুলের সঙ্গে আসলে মুসলমানদের বোকা বানানোর ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

অনেকেই মনে করেন ১৫শতকের শেষ দিকে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটান রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা। তারা স্পেনের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডায় হামলা করেন এবং পরাজিত অসংখ্য মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে মসজিদে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন। আর সেদিনটি ছিল পহেলা এপ্রিল।

কিন্তু এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।

"এটি আমরাও শুনেছি এবং এটি একরকম আমাদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন স্পেনের ইতিহাস পড়েছি, দেখেছি যে সেসময় গ্রানাডার শাসক ছিলেন দ্বাদশ মোহাম্মদ। তার কাছ থেকেই ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে। কোন কোন সূত্র বলে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এবং এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠনিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়েছিল।"

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলছেন, সেসময় ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করেছে, ইহুদিদের উপরও করেছে, কিন্তু এপ্রিল ফুলের যে ট্র্যাজেডির কথা বলা হয় সেটার সাথে তার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না।

"ইতিহাসে আমরা যে বইগুলো পড়েছি সেখানে কোথাও ঐ বর্ণনা পাইনি। আমাদের কাছে মনে হয় এই ঘটনা নিয়ে একটা মিথ তৈরী করা হয়েছে, যার সাথে কোন ঐতিহাসিক সংযোগ নেই।"

মি. ছিদ্দিক বলেন অন্যদিকে গূরুত্ব দিয়ে অবশ্য মুসলমানরা এটি উদযাপন নাও করতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্ম মিথ্যা বলা, প্রতারিত করা বা কাউকে বোকা বানানো সমর্থন করে না।

মজা আনন্দের জন্য তো কোনো বিশেষ দিন আমাদের না হলেও চলে। সেখানে কোনো ছক কষে কাউকে ঘাবড়ে, কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়ে আনন্দ নেওয়াটা সুস্থ মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতেই পারে।

মজা করে কাউকে বোকা বানাতে চাইলে সেটা বিশেষ কোনোদিনেই করতে হবে এমনটা তো নয়। মজা করুন, তবে সেটা বোকা বানিয়ে নিজের বিমলানন্দ নেওয়ার মাধ্যমে নয়। কারণ আপনি যাকে বোকা বানাতে চান, সে যে আপনাকে কখনো বোকা বানানোর চেষ্টা করতে না, এটা ভাববেন না। আর এই বোকা বানাতে গিয়ে আপনার স্বভাব, সম্পর্কগুলো যে নষ্টের দিকে যেতে পারে, সেটাও তো আপনাকে ভাবতে হবে। 


এপ্রিল ফুল   পহেলা এপ্রিল  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে রাজধানীবাসী

প্রকাশ: ০৯:১৪ এএম, ৩১ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

ঋতু বদলে শীত শেষে বসন্ত, আসছে গ্রীস্ম। ঋতু পরির্বতনের সাথে সাথে মশার প্রবল উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। মশা নিধনে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেও মিলছেনা স্বস্তি। কয়েল, স্প্রেসহ কোন কিছুতেই কমছে না মশার উৎপাত। যিদিও ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনই মশা নিধনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে তা কার্যক্রম করছে। তবুও নিধন কমছে না মশার। রাজধানীবাসীর জন্য আতংক হিসেবে যোগ হয়েছে মশার যন্ত্রণা। ঢাকার জলাশয় ও নালা নর্দমাগুলোয় জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন বেড়েছে কয়েকগুন। মশা নেই এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

গবেষণা অনুযায়ী, গত চার মাসে রাজধানীতে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। এ গবেষণার জন্য পাতা ফাঁদে জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টিরও বেশি পূর্ণবয়স্ক মশা ধরা পড়েছে। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা এবং বাকি ১ শতাংশ এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া।

মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের মধ্যে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত রোগ হচ্ছে মাইক্রোসেফালি, যা মশাবাহিত জিকা ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ভাইরাসের কারণে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক অপরিপক্ব থাকে এবং শিশুর মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে ছোট হয়। এই রোগের জন্য ব্রাজিলে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি দেশে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তবে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা থেকে জনজীবনকে রক্ষা করতে হলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন মশা নিধনের কার্যকরী আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। মশার উপদ্রব ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করি।

অন্যদিকে, মাছির উপদ্রবে জরাজীর্ণ ঢাকার বসবাসরত কোটি মানুষের। সামনে আসছে বর্ষাকাল। প্রবল বৃষ্টি আর পানিতে টইটুম্বুর থাকবে বাড়ীর আঙ্গিনা রাস্তাঘাট কিংবা আশপাশের অনেক স্থান। বর্ষাকাল মানেই মশা-মাছির উপদ্রব। ছোঁয়াচে রোগের জাঁকিয়ে বসার আদর্শ সময় বর্ষাকাল। তাই এই সময় দরকার অতিরিক্ত একটু সতর্কতা, অতিরিক্ত কিছুটা সাবধানতা। খাবার খোলা রাখলে, বা বাড়িতে নোংরা আবর্জনা জমলে, বা খোলা ড্রেনে মাছির উপদ্রব বাড়ে। মাছি থেকে নানা রকম রোগও ছড়ায়। তাই বাড়ি থেকে মাছি তাড়াতে অবশ্যই করুন এই কাজগুলো।

বিজ্ঞান বলছে, মাছি আমরা যা জানি তার থেকেও অনেক বেশি রোগজীবাণু বহন করে। মাছির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে।

আমেরিকান গবেষকরা বলছেন, ঘরের মাছি আর নীল মাছি মিলে ৬০০য়ের বেশি বিভিন্নধরনের রোগজীবাণু বহন করে। এর মধ্যে অনেক জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রমণের জন্য দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে পেটের অসুখের জন্য দায়ী জীবাণু, রক্তে বিষক্রিয়া ঘটায় এমন জীবাণু এবং নিউমোনিয়ার জীবাণু।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাছি এসব জীবাণু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়ায় তাদের পা আর ডানার মাধ্যমে। গবেষকরা বলছেন, মাছি তার প্রত্যেকটি পদচারণায় লাইভ জীবাণু ছড়াতে সক্ষম।

মাছির মাধ্যমে নানা রোগের সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। কারণ এটি নর্দমায় বসে, ক্ষতিকর জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া বহণ করে। মাছি দূর করার জন্য বাজারে যেসব স্প্রে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলোতে রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর।

মাছির উপদ্রব কমানো সহজ কাজ নয়। তবে তা কমানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। স্বাস্থ্যক্ষাত ও সিটি কর্পোরেশনের সঠিক উদ্যেগে মাছির উপদ্রব কমানোটা অনকে সহজ হতে পারে। এছাড়াও বাসা বাড়িতে বসবাসরত মানুষজন নিজেরে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাছির খাবারের উৎসগুলো ফেলে দেওয়া, পোষা প্রাণীর নোংরা দূর করা, মাছি ঢোকার পথ বন্ধ করু, বিশেষ কিছু গাছ রোপণ করুন, এমনকি প্রাকৃতিক ফাঁদ পেতেও মানুষ সতর্ক থাকতে পারে।


মশা. মাছি   রাজধানী   জনজীবন   সিটি কর্পোরেশন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

সুশিক্ষা প্রয়োগেই হতে পারে প্রজন্মের বিকাশ

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০৯ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের শিক্ষার সাথে সুশিক্ষিত কথাটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নৈতিক গুণাবলী না থাকলে যেমন সুশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় তেমনি শিক্ষা পরিণত হয় কুশিক্ষায়। প্রকৃত শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করা কিংবা সুনাগরিকে পরিণীত হওয়া। যা চলামান জীবনের প্রতিফলন হয়ে দেশ ও জাতীর উন্নতিতে অবদান রাখবে। তাই শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে  সুশিক্ষিত হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।

সুশিক্ষিত একজন মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকবে। মনকে সুন্দর করবে। মানসিকতাকে পরিপূর্ণ করবে মানবিকতায়। অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে। এক কথায় প্রজন্মকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। আর তাই শিক্ষাকে পর্যবসিত করতে হবে সুশিক্ষায়।

 সুশিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার এমন এক অবস্থা, যে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।

শিক্ষিত সমাজে অনেক ব্যক্তিই প্রতিনিয়ত হাজারও জঘন্য ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আর নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করছে একদল স্বার্থপর শিক্ষিত মানুষ। যাদের কাছে জিম্মি দেশের নানান শ্রেণী পেশার মানুষ,বৃদ্ধ,শিশু কিংবা নারীরা।

শিক্ষিতের ব্যানার প্রয়োগ করে হাসিল করছে তাদের নিজস্ব স্বার্থ। যা কিনা দেশ জাতীর সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব নামধারী শিক্ষিত মানুষদের যেন দেখার কেউ নেই।

দেশের বর্তমান ঘটনাবহুল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, আবার তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে, শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। আবার ছাত্র শিক্ষককে ধর্ষণ করছে তাহলে, শিক্ষিত সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তির মানসিকতা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে। যেখানে বর্তমান সমাজে বাবার কাছেই তার মেয়ে নিরাপদে থাকে না। এটাই কি তাহলে শিক্ষা?

যেখানে বাবা মায়ের কলিজার টুকরা শিক্ষিত সন্তান তার পিতা-মাতাকে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে।

শিক্ষা নামক শব্দকে ব্যবহার করে শিক্ষিত নামক লোগো লাগিয়ে ঘুরছে কিছু শিক্ষিত মহল। আর এর মারাত্মক ফলাফল হচ্ছে এসব ঘটনাগুলো। সমাজে সন্তানকে বাবা-মা বড় করছেন। শিক্ষার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু সন্তান তার বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিচ্ছেন না। তাহলে এখানে আমাদের শিক্ষার আলো কোথায় গেল?

যদি শিক্ষার বদলে মানুষ সুশিক্ষা অর্জন করত, তাহলে হয়তো নারীরা লাঞ্ছিত হতনা, হতনা বিবাহ বিচ্ছেদ, পরকীয়া, শিশু ধর্ষণ, কিংবা পরম মমতাময়ী মা কে থাকতে হত না বৃদ্ধাশ্রমে।

তবে, দেশের বড় বড় দায়িত্বতে থাকা শিক্ষিত ও সুশিক্ষিত দায়িত্ববান ব্যক্তিরা, কিংবা রাজনীতি, সমাজ কিংবা কোন নাম করা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের সুশিক্ষিত মনোভাবে যদি দেশের তরুন প্রজন্মকে শিক্ষিত নয়, বরং সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ভূমিকা রাখেন তাহলে হয়ত বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতে নিয়ে যাবে।


সুশিক্ষা   প্রজন্ম   বিকাশ   তরুণ তরুণী   শিক্ষা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

নারীর প্রতি এক পৃথিবী সম্মান থাকুক প্রতিটি পুরুষের

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ০৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

পুরুষের কাছে নারী মানে মহীয়সী, নারী মানে আত্মবিশ্বাসী, নারী মানে সম্মান, নারী মানেই মাতৃত্ব, নারী মানে ঠিক যেন তাজা পবিত্র ফুল। যে ফুলকে আগলে রাখতে হয় পরম মমতায় ভালোবাসায় যত্নে। নারী নামক এই ফুলকেই সাজিয়ে রাখতে হয় ফুলদানিতে। যেন সম্মান ছড়ায় এক পৃথিবী সমপরিমাণ।

পুরুষের কাছে নারী হয় ভালোবাসার ফুল, আবার সেই নারীর জন্যই কোন পুরুষ হারায় তার কূল। কেননা পৃথিবীতে নারী স্থান যতটাই অপ্রত্যাশিত থাকে না কেন, একটি সংসার, পরিবার, সমাজ কিংবা জাতি পরিপূর্ণই হয় এই নারীর কারণেই।

পুরুষবিহীন যেমন পৃথিবী অসম্পূর্ণ তেমনি নারীবিহীন এই জগতসংসার পরিপূর্ণ নয়। কেননা, মাতৃগর্ভের প্রবল নিরাপত্তা ডিঙ্গিয়ে ধূলোর এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় ঠিক নারীর গর্ভ থেকেই।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরুষের ন্যায় নারীদের জীবনেও উচ্চ মানসম্পন্ন এবং মূল্যবান ব্যক্তিত্বের অবস্থা থাকা জরুরী। এটি নারীদের অধিকার, স্বাধীনতা, সমর্থন, এবং সমানুভূতির মাধ্যমে তাদের সম্প্রদায়ে এবং সমাজে প্রতিরোধশীল ও উন্নত করতে সাহায্য  হয়ে থাকে। এটি একটি ব্যক্তির যোগাযোগে, সাধারণ জীবনে, শিক্ষা, কাজে, এবং সমাজে প্রভাবিত হওয়ার একটি উপায়ও হতে পারে।

যুগের বিবর্তনে প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের পরিবর্তন হওয়াটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি সেই পরিবর্তনের ফলে যুগের মহিমায় পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পুরুষদের মতে নারীদেরও ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরুষরা নারীদেরকে কর্মস্থলে তাদের সমান অবস্থানে রাখা জরুরী। এতে তৈরি হবে কর্মবন্ধন, সম্পূর্ণ হবে প্রযুক্তির উদ্দেশ্যের সফলতা আর পরিপূর্ণ হবে পৃথিবীর চলমান প্রথা।

এছাড়াও ধর্মীয় জায়গা থেকে দেখা যায়,  একটা সময় যেখানে গোটা দুনিয়া যেখানে নারীকে একটি অকল্যাণকর তথা সভ্যতার অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করতো সেখানে ইসলাম নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। যেসব দোষ নারীকে দেওয়া হতো আল্লাহ তা’আলা কুরআন-উল-কারিমে আয়াত নাজিল করে নারীকে সেসব দোষ অপনোদন থেমে মুক্তি দিয়েছে। তাই নারীদের তার নিজ প্রেক্ষাপটে নিজের স্ব স্ব সঠিক দায়িত্বটা অবগত হয়ে তা পালনে মনযোগী হলে সঠিক পুরুষের কাছে নীতিগত নারী ঠিক সঠিক মূল্যয়ন ই পাবে।

তবে, এক শ্রেনির পুরুষ নামক কিছু অপ্রত্যাশিত মানুষের কাছে নারীর মর্যাদা নেই বল্লেই চলে, এদের মধ্যে কিছু পুরুষের মস্তিস্কহীন, কিছু পুরুষ মনুষ্যত্বহীন আর কিছু পুরুষ অমানুষের গণনায় অবস্থিত। কেননা পৃথিবীতে নারীদের যে পুরুষ সম্মান ভালোবাসা আর মমতায় আগলে রাখতে পারেনা বা জানেনা, সেই পুরুষ কখনোই সঠিক পুরুষের মধ্যে পড়েনা। এতে করে ওইসব নারীদের কাছে পুরুষদের অবমানা হয় যে সব নারী সঠিক পুরুষদেরকে দায়িত্ববান মনে করেন।

তবে, পুরুষ সর্বদা নারীদেরকে তার মনুষ্যেতর স্থান থেকে পৃথিবীর সেরা সম্মানটা দেওয়া উচিত। কেননা সঠিক পুরুষ আর সঠিক ব্যক্তিত্বের অধিকারি হতে এই নারীদের ভূমিকাই অপরিসীম। অবস্থান, আস্থা আর বিশ্বাষের দিক থেকে নারী পুরুষ উভয়েই সমান্তরাল হয়ে জীবন পরিচালনা করা উচিত। এতে করে তৈরি হবে সঠিক বন্ধন। হোক সেটা সামাজিক, পারিবারিক কিংবা জাতীগত। চলে যাবে অবমাননা, চরিত্রহীনতা কিংবা নারীর মূল্যহীনতা। থেকে যাবে হৃদয়ের বন্ধন ভালোবাসা সম্মান আর চলমান জীবন পরিচালনার সুশিল সমাজের পারিবারিক বন্ধন। তৈরি হবে নারী পুরুষের সঠিক বন্ধন আর ভবিষ্যত প্রজন্মের সঠিক নির্দেশনা।


নারীর প্রতি সম্মান   পুরুষের ভালোবাসা   নারী দিবস  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

অধিকার আদায়ের স্মারক নারী দিবস

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

“পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চোখে নারী এভাবেই ধরা পড়েছে। তবে সবসময় নারীদের এমন মহান দৃষ্টিতে দেখা হতো না। এর জন্য করতে হয়েছে নানা আন্দোলন। নারীর সংগ্রামের ইতিহাস পৃথিবীতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ নারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন বলে বিবেচিত। এ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। কারখানার মানবেতর পরিবেশ, ১২ ঘণ্টার কর্মসময়, অপর্যাপ্ত বেতন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিন্তু পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলে মহিলা শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায়। বহু শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিউইয়র্ক সূচ শ্রমিকেরা। এভাবেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন। এক সময় তা কারখানা ও ইউনিয়নের গন্ডি অতিক্রম করে।

১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। এই সম্মেলনে নারীদের ন্যায্য মজুরী, কর্মঘণ্টা এবং ভোটাধিকারের দাবী উত্থাপিত হয়। ১৯১০ সালের ২য় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ডেনমার্কের কোপেনহেগে। এতে ১৭টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়। এ সম্মেলনেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ সালে প্রথম ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৪ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দিবসটি বেশ গুরুত্বের সাথে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করতে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ সময় জাতিসংঘ দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহবান জানায়। এর ফলে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়। নারীর অধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। নারী দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাংলাদেশের সংবিধানে নারী দিবসের শিক্ষাসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কেবল নারী হওয়ার কারণে যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয় তার আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে নারীর সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এবং নারীর নিরাপত্তায় বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প, যার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা এবং ন্যায্য মজুরী পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। যে নারী শ্রমিকদের মধ্য থেকেই দিবসটির উৎপত্তি হয়েছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে সেরূপ নারী শ্রমিক রয়েছে কয়েক লক্ষ। নিউইয়র্কের সেদিনকার সূচ কারখানার নারী শ্রমিক ও বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানার নারী শ্রমিক যেন একই পথের অনুসারী। বাংলাদেশ প্রতি বছর। যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু এখানকার নারী পোশাক শ্রমিকেরা কতটা সুরক্ষিত তার প্রশ্ন থেকেই যায়।

বাংলাদেশে নারীদের জন্য অনেক আইন ও বিধি বিধান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এখনও নারীরা উপেক্ষিত। নারীদের গৃহস্থালী কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই, মাতৃত্বকালীন ছুটির অভাব, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি লক্ষ্যণীয়। তবে এখন এর এ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা যে সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে এর পেছনে নারী দিবসের কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।

 

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকেরা আজও নানা ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনস এর দুর্ঘটনার পর দেখা গেছে, এতে হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও মজুরী অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন কোনো উপকারে এসেছে বলে মনে হয় না। অনেকের মতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বর্তমানে কেবল একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে, যার বাস্তব কোনো সফলতা নেই।

বর্তমান যুগকে বলা হয় গণতান্ত্রিক যুগ, সমতার যুগ। কিন্তু এ সময়েও নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীরা এখন কাজের জন্য ঘরের বাইরে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নারীর পদচারণা লক্ষণীয়। কিন্তু তারপরও নারীরা এখনও বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান বাধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সব সময় পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। এটিও নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়। নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয় তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। এরূপ অবস্থা নারীকে দুর্বল করে দেয়।  নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকাও উন্নয়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।

নারী উন্নয়ন করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। নারী উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। নারীর প্রধান শক্তি  শিক্ষা, এ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা। এর জন্য নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী স্বার্থের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সহ নারীর উন্নয়নে সহায়ক সেবা প্রদান করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ট পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। যদি বর্তমানে আমরা। নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তবেই দিবসটির উদ্যাপন সার্থক হবে।

নারী উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান বাধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সব সময় পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। এটিও নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়। নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয় তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। এরূপ অবস্থা নারীকে দুর্বল করে দেয়। নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকাও উন্নয়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।

নারী দিবস নিয়ে কিছু শিক্ষার্থী, ডাক্তার ও কর্পোরেট সেক্টরে নিয়োজিত কর্মজীবী নারীদের মতামত জানতে চাইলে তারা জানায়, মানুষ এখন নারীদের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছে। নারীরা নিজেরাও তাদের মতামত নিয়ে বেশ সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ) জানায়, মেয়েদের নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাসী হতে হবে, কখনো দমে যাওয়া যাবেনা। একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রতিবছর নারী দিবস উদযাপন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক আয়োজন করে থাকে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য - নারীর সম অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ট পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। যদি বর্তমানে আমরা নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তবেই দিবসটির উদযাপন সার্থক হবে।


অধিকার   স্মারক   নারী দিবস  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন