ইনসাইড আর্টিকেল

শেখ হাসিনার বিপন্ন দিনগুলি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:০৫ এএম, ১২ অগাস্ট, ২০১৮


Thumbnail

শোকের মাস আগস্ট। এই মাসেই জাতি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্বাধীন দেশের মাটিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে। শোকের মাসে বাঙালি জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে জাতির পিতা ও অন্যান্য শহীদদের।

এই শোকাবহ মাসে বাংলা ইনসাইডার পাঠকদের জন্য নিয়েছে বিশেষ আয়োজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কিছু স্মরণীয় লেখা তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আজ থাকছে এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া এর ‘শেখ হাসিনার বিপন্ন দিনগুলি’ শিরোনামে একটি লেখা। লেখাটি নেওয়া হয়েছে রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট

শেখ হাসিনার বিপন্ন দিনগুলি

এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া

১৫ আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানির বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দেই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নিচে দোতলায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা হেট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখেও তিনি কোনো কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, “আজ ভোরে বাংলাদেশ ‘ক্যু-দে-তা’ হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুণি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন।’

প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে এ কথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এর বেশি আপাতত আমি আর কিছুই জানি না।’ এ কথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বলেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌঁছাতেই হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কী বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদের প্যারিস যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে সেদিনই বনে ফিরে যেতে বলেছেন। এ কথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রেহানা ও হাসিনা দু’জনই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে, নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে যা আমি তাদের বলতে চাই না। তারা আরো বলেন যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ তাদের পরিষ্কারভাবে না বলা পর্যন্ত তারা ওই বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। অতএব, বাধ্য হয়েই আমি তাদের বলি যে, বাংলাদেশে কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। এ কথা শুনে তারা দু’বোন কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙে যায়। ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌঁছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়কমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাংকফুর্টে যাত্রাবিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হুমুয়ান রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের উপর তলায় নিয়ে যান। তখন ড্রইংরুমে ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকণ্ঠিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাঁকে আমি হুমায়ুন রশীদ রৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোনো কিছু জানতে দেবো না, এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, ‘বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই।’ এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে তাঁর কাছ থেকে এ কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়।’ পরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য ড. কামাল হোসেন বনস্থ বিমানবন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানানো হয়। ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গাড়িতে উঠে বসি।

বিমান বন্দরে ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দুজনে একত্রে গোপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহর্তে ড. কামাল হোসেন সাহেবের হাত ধরে তাকে বললাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার ওয়াদা করুন যে, আপনি কোনো অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে তাঁর মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না। আমার এই প্রশ্নের জবাবে ড. কামান হোসেন আমাকে বললেন, ড. ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে ব্যাপারে আপোস করে আমি দেশে ফিরতে পারি না। এই কথাগুলো বলেই তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যান। বিমান বন্দর থেকে হুমায়ন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ফিরে হাসিনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইতোপূর্বে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মোমিনুল হক খোকা (কাকা) ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমাদেরকে লন্ডনে তার কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছোট ভাই কায়সার রশীদ চৌধুরী তাঁকে ফোন করেন। এই পরিস্থিতিতে খন্দকার মোশতাক আহমদের বিরুদ্ধে কোনোকিছু না করার জন্য কায়সার চৌধুরী তাঁকে হুশিয়ার করে দেন। কায়সার রশীদ চৌধুরী রেহানা ও হাসিনার সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে সান্ত্বনা দেন। অতঃপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, রেহানা, হাসিনা ও আমাকে বলেন যে, লন্ডনে চলে যাওয়া সাব্যস্ত করলে আমরা সেখানে তার বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। তবে তিনি আমাদেরকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, সেখানে মাত্র একটি সমস্যা আছে। ঐ বাসার নিচতলায় কায়সার রশীদ চৌধুরী বসবাস করে এবং সে ভুট্টোর অন্ধ ভক্ত। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে ১৫ আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো খন্দকার মোশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন তার সঙ্গে ব্যাপারে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য। যাহোক, ঐদিনই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কার্লসরুয়ে পাঠালেন সেখান থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য ভারি জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।

আমি সেদিন কার্লসরুয়ে গিয়ে বনে ফিরে আসি রাত সাড়ে দশটার দিকে। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কোনো বইপত্র বা অন্য কোনো জিনিসপত্র সঙ্গে আনতে পারি নি। রাত এগারোটার দিকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার স্ত্রী ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাইরে যান। পথে তিনি বলেন যে, একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসে তার পরিচিত একজন অফিসিয়াল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আমাকে তাদের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাহোক, উক্ত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর ভারতীয় সেই কালের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তাঁর কাছে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহর্তে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব পরামর্শ দেন যে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে রওনা হওয়ার ‘আমি যেন তাকে ফোনে অবহিত করি। অতঃপর ভারতীয় ঐ অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন যান জার্নালিস্ট। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শোনার পর তিনি আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে কী চাই। অতঃপর তিনি সাদা কাগজ ও একটি কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা। শংকায় আমার হাত কাপছিল । যাহোক, অতিকষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেখপূর্বক সকলের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম, শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশুরা ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা। করি রাজনৈতিক আশ্রয়।

১৭ আগস্ট রোববার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারাক্ষণ বাসায় ছিলেন। ঐদিন লন্ডন থেকে আরও কয়েক জন আওয়ামী লীগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় রেহানা ও হাসিনাকে ফোন করেন। এক সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পত্নী আমাদেরকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইতিপূর্বে কথা বলেছেন এবং তিনি আশ্বাস দেন যে, আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। রাতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কিনা। আমি তাকে জানাই যে, হাসিনারা প্রত্যেকে মাত্র পঁচিশ ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কার্লসরুয়ে গেস্ট হাউসে আমি রেহানার জন্য একটি পৃথক কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। অতঃপর আমি তাকে হাসিনার সঙ্গে ঐ বিষয়ে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দিই। তখন হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানাই যে, মাত্র হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই আমরা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারব।

১৬ আগস্ট ড. কামাল হোসেন লন্ডন চলে যাওয়ার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দেশের কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আমলার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গোপন ও চাঞ্চল্যকর কাহিনী আমাকে শোনান। তিনি বলেন যে, তাঁর ছোট ভাই, কায়সার রশীদ চৌধুরী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর একান্ত সচিব ছিলেন, যখন তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রিপরিষদের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ঐ সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনেক অপকর্ম ও কুকর্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল কায়সার রশীদ চৌধুরীর।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে তার ভুমিকা সচ্ছ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে অনেক কাহিনী শোনান। তিনি তখন পাকিস্তানি দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন ও তা ঘোষণার পূর্বে তাঁকে দাফতরিক কাজে করাচি হয়ে ইসলামাবাদ যেতে হত কয়েকবার। তখন পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন তার গতিবিধির কড়া নজর রাখতো। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে দিল্লী থেকে পাকিস্তান ইসলামাবাদ সফর শেষে ফেরার পথে করাচি বিমান বন্দরে তাঁকে গ্রেফতার করারও নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য ইসলামাবাদ থেকে তদুদ্দেশে প্রেরিত টেলেক্স বার্তাটি করাচিস্থ সংশিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় তিনি সেবার ভাগ্যক্রমে রেহাই পান। অতঃপর দিল্লি পেীছেই তিনি পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ কর তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি তার সমর্থন ও আনুগত্য ঘোষণা করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে আরও জানান যে, ১৯৭১-এ কলকাতায় খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে তঙ্কালীন আওয়ামী লীগের জহিরুল কাউইম, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব মাহবুবুল। আলম চাষী ও কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান হোসেন আলীসহ কতিপয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জোর গোপন তৎপরতা চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত ও নস্যাৎ করার জন্য।

১৯৭৫-এ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর রাজধানী লিমায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু ইতোপূর্বে ড. কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের যথাক্রমে দলপতি ও সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। যে কারণে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিউইয়র্কে ও লিমায় হোটেলও রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্টের ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করায় তার লিমা সম্মেলনে যোগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস যে, খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাকে কোনো অবস্থাতেই লিমা সম্মেলনে যেতে দেবেন না। | কিন্তু তখন স্বল্প সময়ের মধ্যে নিউইয়র্ক ও লিমাস্থ হোটেলসমূহে তার পূর্ব নির্ধারিত রিজার্ভেশন বাতিল করা সহজ হবে যদি তিনি লন্ডন যান। সেই মোতাবেক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৮ আগস্ট তারিখে সপত্নীক লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

১৮ আগস্ট সোমবার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরেন দুপুর বারোটার দিকে।  আমাদেরকে কার্লসরুয়ে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। এর এক ফাকে তাঁর সাহায্য ও প্রতীকস্বরূপ তিনি হাসিনাকে এক হাজার জার্মান মুদ্রা প্রদান করেন এবং ভবিষ্যতেও আমাদের তার সাধ্যমত টাকা-পয়সাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। অতঃপর কার্লসরুয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার মুহূর্তে ঘরের বাইরে এসে দেখি যে, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তার সরকারি রাষ্ট্রদূতের গাড়িটি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আমাকে এও বলেন যে, ভয়ে আমাদের জরুরি কাজগুলো সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন ঐ কে সেখানে রেখে দেই। তার এই সহমর্মিতায় ও মহানুভবতায় আমি এতই অভিভূত হয়ে যাই যে, তখন আমার দু`চোখ অশ্রুতে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর জন্য তাকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য কোনো ভাষা খুঁজে না পেয়ে আমি হুমায়ন রশীদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।

২৯ আগস্ট বন থেকে ৩৫০ কিলোমিটার ভ্রমণ করে আমরা নিরাপদে কার্লসরুয়ে পৌছাই সন্ধে সাতটার দিকে। আমাদের কার্লসরুয়ে পৌছার সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে আসে কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য তখন গবেষণারত শহীদ হোসেন এবং কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত আমার কনিষ্ঠ সহকমী আমিরুল ইসলাম। অতঃপর হাসিনাদের গেস্ট হাউসে রেখে আমি শহীদ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কার্লসরুয়েতে উপস্থিতির কথা রিপোর্ট করার জন্য যাই সেখানকার বিশেষ নিরাপত্তাবিষয়ক দফতরে। ১৯ আগস্ট আমি কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসি এবং অন্যান্য জরুরি কাজকর্ম সম্পন্ন করি উক্ত গাড়িটি ব্যবহার করে । ২০ আগস্ট তারিখে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের ঐ গাড়িটি ফেরত পাঠিয়ে দিই। শোক ও শঙ্কায় তখন আমরা এত মুহ্যমান হয়ে পড়ি যে, আমাদের দেখাশুনার ভার নিতে হয় শহীদ হোসেন ও আমিরুল ইসলামকে। গেস্ট হাউসে আমাদের কক্ষ দুটির পাশের কক্ষটি ভাড়া নেয়া হয় শহীদ হোসেন ও আমিরুল ইসলামের জন্য। ২২ আগস্ট বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে ফোন করে ওদের (ভারতীয় দূতাবাসের) কেউ আমার সঙ্গে কার্লসরুয়েতে যোগাযোগ করেছেন কি না সে সম্পর্কে জেনে নেন। ২৩ আগস্ট সকালে বনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোনে জানান যে, সেদিনই তার অফিসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি কার্লসরুয়েতে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিকেল ২টায় ঐ কমকর্তা ঐ গেস্ট হাউসে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি আমাকে এও জানান যে, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৪ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আমাদের ফ্রাংকফুর্ট বিমান বন্দরে নিয়ে যাবেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ভদ্রলোক উক্ত গেস্ট হাউসে পৌছান। অতঃপর মালপত্রসহ দুটো ট্যাক্সিতে হাতে কালসরুয়ে রেলওয়ে স্টেশনে যাই ফ্রাংকফুট শহরে যাওয়ার জন্য। নিজেকে নিরাপত্তার জন্য আমি শহীদ হোসেনকেও সঙ্গে নেই। বিমান বন্দরে বহির্গমন হলে প্রবেশ করার মুহর্তে শহীদ হোসেনের নিকট হতে বিদায় নেয়ার সময় তাকে শুধু আকার-ইঙ্গিতে জানাই যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি । উল্লেখ্য, ভারতীয় ৯ কর্মকর্তা আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উক্ত ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গোপন রাখার জন্য। শহীদ হোসেনও তখন মুখে কিছু বললেন না। তিনি আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলো। তখন আমাদের জন্য সহমর্মিতা ও সমবেদনায় তার দু`চোখ ছিল অশ্রুতে ভরা। আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি জাম্বো বিমানে (পশ্চিম) জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট থেকে দিল্লিস্থ পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করি ২৫ আগস্ট সকাল আটটার দিকে। `আগমন হলে’ কাউকেও দেখলাম না আমাদের খোঁজ করতে। দেখতে দেখতে ঐ বিমানে আগত প্রায় সব যাত্রীই চলে যান। মেরামত ও নবরূপায়ন কাজের জন্য উক্ত হলটির শীতলীকরণ সিস্টেম বন্ধ ছিল। নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা এবং আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে তখন আমার শরীর থেকে অঝোরে ঘাম ঝরছিলো। যাহোক, সেখানের এক কর্মকর্তার অফিস থেকে ফোনে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম প্রায় পৌনে একঘণ্টা ধরে। কিন্তু কাউকে পেলাম না। ফলে, আমার দুশ্চিন্তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় উক্ত অফিস থেকে হল ঘরে এসে হাসিনাদের সেখানে দেখতে না পেয়ে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। যাহোক, এর একটু পরেই একজন শিখ কর্মকর্তা পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আরও কাছ থেকে জানতে চান যে, আমি উক্ত দুই মহিলার সহযাত্রী কি না। আমি তাদের সফরসঙ্গী জেনে কর্মকর্তাটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঐ যুবতী মহিলাদ্বয়কে ঐ দুই বাচ্চাসহ ভিআইপি হিসেবে এই বিমান বন্দর হয়ে যেতে দেখেছিলাম । ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, আজকে তাদের কি নিদারুণ করুণ অবস্থা। এটা একেবারেই একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য।

প্রায় আধঘণ্টা পর ঐ শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে জানান যে, কতিপয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতি শিগগির সেখানে পৌছবেন আমাদের ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। এরও প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট পর দুইজন কর্মকর্তা এলেন আমাদের খোজে। তাঁদের একজন নিজেকে ভারত সরকারের মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলে পরিচয় দিলেন। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। অতঃপর এ দুই কর্মকর্তা আমাদেরকে দুটো ট্যাক্সিতে বিমানবন্দর থেকে নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায় নিয়ে যান। তখন ভারতীয় সময় দুপুর ১টা। সুদীর্ঘ চার ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা, দিল্লির প্রচণ্ড আবহাওয়া, পারিবারিক শোকক, নিজেদের নিরাপত্তা এবং নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কার তখন শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে দারুণভাবে বিপর্যস্ত।

ডিফেন্স কলোনির বাড়িটির নিচতলার ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুম এবং প্রত্যেকটি কে বাথরুমসহ দুটো শয়নকক্ষ। এর ছাদে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি শয়নকক্ষ যা তখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হত। দুপুরের খাবার ও বিকেলের চা-নাস্তা খাওয়ার পর ঐ দুই কর্মকর্তা চলে যান। ঐ বাড়ির জানালায় কোনো গ্রীল ছিলো না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই, রাতে রেহানাসহ সবাই মিলে একই শয়নকক্ষে থাকার। পরদিন অর্থাৎ ২৬ আগস্ট উক্ত কর্মকর্তাদ্বয় ঐ বাসায় আসেন আমাদের খবরাখবর জানার জন্য তারা আমাকে পরামর্শ দেন। সবকিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখপূর্বক জার্মানির আমার ঐ স্কলারশিপটি কয়েক মাসের জন্য সংরক্ষিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে। অতঃপর ২৭ আগস্ট তারিখে আমি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্ম কর্তাকে ঐ মর্মে পত্র পাঠাই।

ঐ বাড়ির চত্বরের বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারোও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া কিংবা দিলুরি কারোও সঙ্গে যোগাযোগ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল আমাদের সকলকে। অতএব নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঐ বাড়ির অতি ক্ষুদ্র চত্বরের মধ্যে আবদ্ধ থাকি আমরা সকলেই। আমি রাতে শুয়ে সারাক্ষণ জেগে থাকতাম এক রকম নিরাপত্তা প্রহরীর মতো। মাঝে মাঝে জানালার পর্দার ফাক দিয়ে বাইরের গেটের দিকে তাকাতাম। রাতে কয়েক ঘণ্টা পর পর গেটে প্রহরারত দারোয়ানের সঙ্গে বাইরের লোকের ফিসফিস কথা বলা সন্দেহের উদ্রেক করত। এরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে, মাঝে মধ্যে হাসিনাকে সজাগ করতাম । সারা ভারতে তখন জরুরি অবস্থা আইন বলবৎ ছিল । সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কোনো সংবাদ প্রকাশিত হত না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে আমরা থাকি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এভাবেই অতিবাহিত হয় সপ্তাহ দুয়েক। ইতোমধ্যে রেহানাসহ বাচ্চারা চক্ষুপীড়ায় (কনজাংটিভাইটিসে আক্রান্ত হয়। এমন সময়ে একদিন ভারত সরকারের উক্ত যুগ্ম সচিব হাসিনা ও আমাকে জানান যে, ঐ রাতে আটটায় আমাদের দু`জনকে অন্য এক বাসায় নেয়া হবে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য। সে রাতে সেই বাসায় যাওয়ার পথে অপর একটি গাড়িতে আমাদের সঙ্গে যান একজন অতি উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা। সেখান থেকে মিনিট পনের জার্নি করার পর আমরা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে পৌছাই। অতঃপর অতি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ঐ কর্মকর্তা আমাদের দুজনকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের একটি মাঝারি ধরনের বৈঠকখানায় নিয়ে যান। একটি লম্বা সোফায় হাসিনাকে বসানো হয় আর আমাকে আর একটি লম্বা সোফায়। এর প্রায় মিনিট দশেক পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে হাসিনার পাশে বসেন। সামান্য কুশলাদি বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধী আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমরা ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত রয়েছি কি না। এর জবাবে আমাদের জার্মানির বনে থাকাকালীন সময়ে ১০ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে `রয়টার’ পরিবেশিত এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত যে দুটো ভাষ্যের কথা বলেছিলেন আমি তার পুনরুল্লেখ করি। অতঃপর ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত ঐ কর্মকর্তাকে ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য জানতে বলেন। তখন উক্ত কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত মনে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই সংবাদে হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধী তখন হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টায় বলেন, তুমি যা হারিয়েছ তা আর কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে আছে। তখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা ও মেয়েকে মা হিসেবে ভাবতে হবে। এছাড়াও তোমার ছোট বোন ও তোমার স্বামী রয়েছে তোমার সঙ্গে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব এখন তোমার কোনো অবস্থাতেই ভেঙে পড়লে চলবে না। উল্লেখ্য, ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এটাই ছিল আমাদের একমাত্র সাক্ষাৎকার।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঐ সাক্ষাৎকারে তিন-চার দিন পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে নয়াদিল্লীস্থ ভারতের স্বাধীনতায় যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘ইন্ডিয়া-গেট’ এর নিকটবর্তী পাণ্ডারা রোডস্থ প্রতি তলায় দু`টি ফ্লাটের একটি সরকারি দোতলা বাড়ির উপর তলার একটি ফ্ল্যাট আমাদের জন্য নির্ধারিত করা হয়। ফ্লাটগুলোতে দু’টো করে শয়নকক্ষ। এ ফ্লাটটিতে তখন কোনো আসবাবপত্র ছিল না। যাহোক, আস্তে আস্তে বাজার থেকে ভাড়ায় কিছু আসবাবপত্র সংগ্রহ করে আমাদের জন্য বন্দোবস্ত করা হয়। অতঃপর ১ অক্টোবর সাময়িক ও দৈনিক ভিত্তিতে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশন থেকে আমার জন্য একটি পেস্ট-ডক্টরাল ফেলোশীপের বন্দোবস্ত করা হয়। ঐ ফেলোশিপের শর্তানুসারে বাসা ও অফিসে যাতায়াতের সুবিধাদির অতিরিক্ত আমাকে দৈনিক প্রদান করা হতো বাষট্টি রূপী (ভারতীয় মুদ্রা) পঞ্চাশ পয়সা মাত্র। ঐ বাসাতেও আমাদেরকে একই নিয়ম পালন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাইরের কারও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া, কারও সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ না করা এবং নিরাপত্তা প্রহরী ব্যতিরেকে বাইরে না যাওয়া আমাদের পালনীয় দায়িত্ব বলে আমাদের সকলকে স্মরণ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। সময় কাটানো ও নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্য আমাদের বাসায় সরবরাহ করা বতীয় ‘শাদাকালো` টেলিভিশন। এছাড়া আমার একটি নিজস্ব ট্রানজিস্টারও ছিল। ঐ বাসায় কোনো টেলিফোন সরবরাহ করা হয় নি। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে খবরাখবর রাখার আমাদের একমাত্র উপায় ছিলো আমার ঐ ব্যক্তিগত ট্রানজিস্টার।

 [রহীম শাহ সম্পাদিত ‘পঁচাত্তরের সেই দিন’ বই থেকে নেওয়া। (পৃষ্ঠা- ১০২ থেকে ১১১)]

বাংলা ইনসাইডার/এসএইচ/জেডএ



মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

'এপ্রিল ফুল' এর ট্র্যাজেডিতে কি জড়িয়ে আছে?

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০১ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি পশ্চিমা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এদিনে একে অপরকে চমকে দিয়ে 'বোকা বানাতে' চায়। যদিও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এই প্রচলন খুব একটা দেখা যায় না।

পহেলা এপ্রিল পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকে কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে। অন্যথায় কারো না কারো কাছে তাকে বোকা হিসেবে পরিচিত হতে হবে এবং এটি নিয়ে হাস্যরস তৈরি হতে পারে।

এ দিনটিকে তাই বলা হয় অল ফুলস ডে, বাংলায় বোকা বানানোর দিনও বলতে পারেন। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফলাও করে ভুয়া ও ভুল সংবাদ ছাপায়। পরদিন অবশ্য সেটার সংশোধনী দিয়ে জানিয়ে দেয় খবরটা আসলে এপ্রিল ফুল ছিল।

একই সাথে এদিন পরিবারের ছোটরা সাধারণত বড়দের সাথে নানাভাবে মজা করে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। আবার বন্ধু বা কলিগরাও একে অন্যের সাথে মজা করে। তবে যাকে বোকা বানানো হয়, তাকে শেষে সবাই মিলে চিৎকার করে জানিয়ে দেয় 'এপ্রিল ফুল'।

ধারণা করা হয়, ইউরোপে এপ্রিল ফুলের প্রসার ফ্রেঞ্চ জাতির মধ্যে। ফ্রেঞ্চরা ১৫০৮ সাল, ডাচরা ১৫৩৯ সাল থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম দিনকে কৌতুকের দিন হিসেবে পালন শুরু করে। ফ্রান্সই প্রথম দেশ হিসেবে সরকারিভাবে নবম চার্লস ১৫৬৪ সালে এক ফরমানের মাধ্যমে ১ জানুয়ারিকে নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন । অর্থাৎ তিনি এটি করেন ১৫৮২ সালে ইতালীয়ান পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী প্রবর্তিত গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার হিসেবে প্রচলন হওয়ারও আগে। পাশাপাশি ১ এপ্রিল বন্ধুদের উপহার আদানপ্রদানের প্রথা বদলে যায় ১ জানুয়ারি। কারণ তখন বিভিন্ন দেশে জুলিয়ীও ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিউইয়ার পালিত হত ১ এপ্রিলে। অনেকেই এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে না পেরে এদিনই তাদের পুরনো প্রথাসমূহ চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ১ জানুয়ারির পক্ষের লোকজন এদেরকে ফাঁকি দিতে ১ এপ্রিলে ভুয়া উপহার পাঠানোর প্রথা চালু করে।

ফ্রান্সে কাউকে বোকা বানালে বলা হত এপ্রিল মাছ (April fish), ফ্রেঞ্চ ভাষায় poisson d’avril. এই্ নামকরণের কারণ, রাশিচক্র অনুযায়ী স্বর্গের কাল্পিক রেখা অতিক্রম করলে এপ্রিলে সূর্যকে মাছের মত দেখায়। এইদিনে তারা ছুটি কাটাত এবং মরা মাছ এনে তাদের বন্ধুদের পেছনে সেটে দিয়ে মজা করত।

ডাচদের আরও কারণ রয়েছে। স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ১৫৭২ সালে নেদারল্যান্ড শাসন করতেন। যারা তার শাসন অমান্য করেছিল তারা নিজেদেরকে গুইযেন বা ভিখারী বলে পরিচয় দিত । ১৫৭২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখে গুইযেন বা বিদ্রোহীরা উপকূলীয় ছোট শহর ডেন ব্রিয়েল করায়ত্ব করে ফেলে। তাদের এই সফলতায় বিদ্রোহের দাবানল দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। শেষমেষ স্প্যানিশ সেনাপ্রধান বা দ্যা ডিউক অব অ্যালবা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। সেই থেকে দিনের প্রচলন।

মুসলমানদের জন্য ট্র্যাজেডির?

বাংলাদেশে একটা প্রচলিত ধারণা এপ্রিল ফুলের সঙ্গে আসলে মুসলমানদের বোকা বানানোর ইতিহাস জড়িয়ে আছে।

অনেকেই মনে করেন ১৫শতকের শেষ দিকে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটান রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলা। তারা স্পেনের মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাডায় হামলা করেন এবং পরাজিত অসংখ্য মুসলিম নারী, পুরুষ ও শিশুকে মসজিদে আটকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারেন। আর সেদিনটি ছিল পহেলা এপ্রিল।

কিন্তু এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।

"এটি আমরাও শুনেছি এবং এটি একরকম আমাদের বিশ্বাসের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে যখন স্পেনের ইতিহাস পড়েছি, দেখেছি যে সেসময় গ্রানাডার শাসক ছিলেন দ্বাদশ মোহাম্মদ। তার কাছ থেকেই ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা গ্রানাডা দখল করে নেন। আর এ ঘটনাটি ঘটেছিল জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে। কোন কোন সূত্র বলে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ। এবং এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠনিক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হয়েছিল।"

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলছেন, সেসময় ফার্দিনান্ড ও ইসাবেলা মুসলমানদের উপর নির্যাতন করেছে, ইহুদিদের উপরও করেছে, কিন্তু এপ্রিল ফুলের যে ট্র্যাজেডির কথা বলা হয় সেটার সাথে তার কোন সত্যতা পাওয়া যায় না।

"ইতিহাসে আমরা যে বইগুলো পড়েছি সেখানে কোথাও ঐ বর্ণনা পাইনি। আমাদের কাছে মনে হয় এই ঘটনা নিয়ে একটা মিথ তৈরী করা হয়েছে, যার সাথে কোন ঐতিহাসিক সংযোগ নেই।"

মি. ছিদ্দিক বলেন অন্যদিকে গূরুত্ব দিয়ে অবশ্য মুসলমানরা এটি উদযাপন নাও করতে পারে। কারণ ইসলাম ধর্ম মিথ্যা বলা, প্রতারিত করা বা কাউকে বোকা বানানো সমর্থন করে না।

মজা আনন্দের জন্য তো কোনো বিশেষ দিন আমাদের না হলেও চলে। সেখানে কোনো ছক কষে কাউকে ঘাবড়ে, কোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়ে আনন্দ নেওয়াটা সুস্থ মানসিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতেই পারে।

মজা করে কাউকে বোকা বানাতে চাইলে সেটা বিশেষ কোনোদিনেই করতে হবে এমনটা তো নয়। মজা করুন, তবে সেটা বোকা বানিয়ে নিজের বিমলানন্দ নেওয়ার মাধ্যমে নয়। কারণ আপনি যাকে বোকা বানাতে চান, সে যে আপনাকে কখনো বোকা বানানোর চেষ্টা করতে না, এটা ভাববেন না। আর এই বোকা বানাতে গিয়ে আপনার স্বভাব, সম্পর্কগুলো যে নষ্টের দিকে যেতে পারে, সেটাও তো আপনাকে ভাবতে হবে। 


এপ্রিল ফুল   পহেলা এপ্রিল  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

রাতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে রাজধানীবাসী

প্রকাশ: ০৯:১৪ এএম, ৩১ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

ঋতু বদলে শীত শেষে বসন্ত, আসছে গ্রীস্ম। ঋতু পরির্বতনের সাথে সাথে মশার প্রবল উপদ্রবে অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী। মশা নিধনে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেও মিলছেনা স্বস্তি। কয়েল, স্প্রেসহ কোন কিছুতেই কমছে না মশার উৎপাত। যিদিও ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনই মশা নিধনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে তা কার্যক্রম করছে। তবুও নিধন কমছে না মশার। রাজধানীবাসীর জন্য আতংক হিসেবে যোগ হয়েছে মশার যন্ত্রণা। ঢাকার জলাশয় ও নালা নর্দমাগুলোয় জমে থাকা পানিতে মশার প্রজনন বেড়েছে কয়েকগুন। মশা নেই এমন জায়গা খুঁজে পাওয়া দুস্কর।

গবেষণা অনুযায়ী, গত চার মাসে রাজধানীতে কিউলেক্স মশার ঘনত্ব বেড়েছে। এ গবেষণার জন্য পাতা ফাঁদে জানুয়ারিতে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ টিরও বেশি পূর্ণবয়স্ক মশা ধরা পড়েছে। যার মধ্যে ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা এবং বাকি ১ শতাংশ এডিস, অ্যানোফিলিস, আর্মিজেরিস ও ম্যানসোনিয়া।

মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের মধ্যে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত রোগ হচ্ছে মাইক্রোসেফালি, যা মশাবাহিত জিকা ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই ভাইরাসের কারণে গর্ভের সন্তানের মস্তিষ্ক অপরিপক্ব থাকে এবং শিশুর মাথা স্বাভাবিকের চেয়ে আকারে ছোট হয়। এই রোগের জন্য ব্রাজিলে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি দেশে জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। তবে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা থেকে জনজীবনকে রক্ষা করতে হলে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন মশা নিধনের কার্যকরী আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ। মশার উপদ্রব ও জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করি।

অন্যদিকে, মাছির উপদ্রবে জরাজীর্ণ ঢাকার বসবাসরত কোটি মানুষের। সামনে আসছে বর্ষাকাল। প্রবল বৃষ্টি আর পানিতে টইটুম্বুর থাকবে বাড়ীর আঙ্গিনা রাস্তাঘাট কিংবা আশপাশের অনেক স্থান। বর্ষাকাল মানেই মশা-মাছির উপদ্রব। ছোঁয়াচে রোগের জাঁকিয়ে বসার আদর্শ সময় বর্ষাকাল। তাই এই সময় দরকার অতিরিক্ত একটু সতর্কতা, অতিরিক্ত কিছুটা সাবধানতা। খাবার খোলা রাখলে, বা বাড়িতে নোংরা আবর্জনা জমলে, বা খোলা ড্রেনে মাছির উপদ্রব বাড়ে। মাছি থেকে নানা রকম রোগও ছড়ায়। তাই বাড়ি থেকে মাছি তাড়াতে অবশ্যই করুন এই কাজগুলো।

বিজ্ঞান বলছে, মাছি আমরা যা জানি তার থেকেও অনেক বেশি রোগজীবাণু বহন করে। মাছির ডিএনএ বিশ্লেষণ করে।

আমেরিকান গবেষকরা বলছেন, ঘরের মাছি আর নীল মাছি মিলে ৬০০য়ের বেশি বিভিন্নধরনের রোগজীবাণু বহন করে। এর মধ্যে অনেক জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রমণের জন্য দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে পেটের অসুখের জন্য দায়ী জীবাণু, রক্তে বিষক্রিয়া ঘটায় এমন জীবাণু এবং নিউমোনিয়ার জীবাণু।

পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাছি এসব জীবাণু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়ায় তাদের পা আর ডানার মাধ্যমে। গবেষকরা বলছেন, মাছি তার প্রত্যেকটি পদচারণায় লাইভ জীবাণু ছড়াতে সক্ষম।

মাছির মাধ্যমে নানা রোগের সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। কারণ এটি নর্দমায় বসে, ক্ষতিকর জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়া বহণ করে। মাছি দূর করার জন্য বাজারে যেসব স্প্রে কিনতে পাওয়া যায়, সেগুলোতে রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর।

মাছির উপদ্রব কমানো সহজ কাজ নয়। তবে তা কমানোর চেষ্টা তো করতেই হবে। স্বাস্থ্যক্ষাত ও সিটি কর্পোরেশনের সঠিক উদ্যেগে মাছির উপদ্রব কমানোটা অনকে সহজ হতে পারে। এছাড়াও বাসা বাড়িতে বসবাসরত মানুষজন নিজেরে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাছির খাবারের উৎসগুলো ফেলে দেওয়া, পোষা প্রাণীর নোংরা দূর করা, মাছি ঢোকার পথ বন্ধ করু, বিশেষ কিছু গাছ রোপণ করুন, এমনকি প্রাকৃতিক ফাঁদ পেতেও মানুষ সতর্ক থাকতে পারে।


মশা. মাছি   রাজধানী   জনজীবন   সিটি কর্পোরেশন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

সুশিক্ষা প্রয়োগেই হতে পারে প্রজন্মের বিকাশ

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০৯ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের শিক্ষার সাথে সুশিক্ষিত কথাটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নৈতিক গুণাবলী না থাকলে যেমন সুশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় তেমনি শিক্ষা পরিণত হয় কুশিক্ষায়। প্রকৃত শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে আচরণগত পরিবর্তন, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করা কিংবা সুনাগরিকে পরিণীত হওয়া। যা চলামান জীবনের প্রতিফলন হয়ে দেশ ও জাতীর উন্নতিতে অবদান রাখবে। তাই শিক্ষিত হওয়ার চেয়ে  সুশিক্ষিত হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।

সুশিক্ষিত একজন মানুষের মধ্যে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকবে। মনকে সুন্দর করবে। মানসিকতাকে পরিপূর্ণ করবে মানবিকতায়। অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসবে। এক কথায় প্রজন্মকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। আর তাই শিক্ষাকে পর্যবসিত করতে হবে সুশিক্ষায়।

 সুশিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার এমন এক অবস্থা, যে শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলে। একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠে সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে।

শিক্ষিত সমাজে অনেক ব্যক্তিই প্রতিনিয়ত হাজারও জঘন্য ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। আর নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবি করছে একদল স্বার্থপর শিক্ষিত মানুষ। যাদের কাছে জিম্মি দেশের নানান শ্রেণী পেশার মানুষ,বৃদ্ধ,শিশু কিংবা নারীরা।

শিক্ষিতের ব্যানার প্রয়োগ করে হাসিল করছে তাদের নিজস্ব স্বার্থ। যা কিনা দেশ জাতীর সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব নামধারী শিক্ষিত মানুষদের যেন দেখার কেউ নেই।

দেশের বর্তমান ঘটনাবহুল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, আবার তাকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে, শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। আবার ছাত্র শিক্ষককে ধর্ষণ করছে তাহলে, শিক্ষিত সমাজে শিক্ষিত ব্যক্তির মানসিকতা কোথায় গিয়ে দাড়িয়েছে। যেখানে বর্তমান সমাজে বাবার কাছেই তার মেয়ে নিরাপদে থাকে না। এটাই কি তাহলে শিক্ষা?

যেখানে বাবা মায়ের কলিজার টুকরা শিক্ষিত সন্তান তার পিতা-মাতাকে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে।

শিক্ষা নামক শব্দকে ব্যবহার করে শিক্ষিত নামক লোগো লাগিয়ে ঘুরছে কিছু শিক্ষিত মহল। আর এর মারাত্মক ফলাফল হচ্ছে এসব ঘটনাগুলো। সমাজে সন্তানকে বাবা-মা বড় করছেন। শিক্ষার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু সন্তান তার বাবা-মাকে ভরণপোষণ দিচ্ছেন না। তাহলে এখানে আমাদের শিক্ষার আলো কোথায় গেল?

যদি শিক্ষার বদলে মানুষ সুশিক্ষা অর্জন করত, তাহলে হয়তো নারীরা লাঞ্ছিত হতনা, হতনা বিবাহ বিচ্ছেদ, পরকীয়া, শিশু ধর্ষণ, কিংবা পরম মমতাময়ী মা কে থাকতে হত না বৃদ্ধাশ্রমে।

তবে, দেশের বড় বড় দায়িত্বতে থাকা শিক্ষিত ও সুশিক্ষিত দায়িত্ববান ব্যক্তিরা, কিংবা রাজনীতি, সমাজ কিংবা কোন নাম করা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাদের সুশিক্ষিত মনোভাবে যদি দেশের তরুন প্রজন্মকে শিক্ষিত নয়, বরং সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য ভূমিকা রাখেন তাহলে হয়ত বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতে নিয়ে যাবে।


সুশিক্ষা   প্রজন্ম   বিকাশ   তরুণ তরুণী   শিক্ষা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

নারীর প্রতি এক পৃথিবী সম্মান থাকুক প্রতিটি পুরুষের

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ০৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

পুরুষের কাছে নারী মানে মহীয়সী, নারী মানে আত্মবিশ্বাসী, নারী মানে সম্মান, নারী মানেই মাতৃত্ব, নারী মানে ঠিক যেন তাজা পবিত্র ফুল। যে ফুলকে আগলে রাখতে হয় পরম মমতায় ভালোবাসায় যত্নে। নারী নামক এই ফুলকেই সাজিয়ে রাখতে হয় ফুলদানিতে। যেন সম্মান ছড়ায় এক পৃথিবী সমপরিমাণ।

পুরুষের কাছে নারী হয় ভালোবাসার ফুল, আবার সেই নারীর জন্যই কোন পুরুষ হারায় তার কূল। কেননা পৃথিবীতে নারী স্থান যতটাই অপ্রত্যাশিত থাকে না কেন, একটি সংসার, পরিবার, সমাজ কিংবা জাতি পরিপূর্ণই হয় এই নারীর কারণেই।

পুরুষবিহীন যেমন পৃথিবী অসম্পূর্ণ তেমনি নারীবিহীন এই জগতসংসার পরিপূর্ণ নয়। কেননা, মাতৃগর্ভের প্রবল নিরাপত্তা ডিঙ্গিয়ে ধূলোর এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় ঠিক নারীর গর্ভ থেকেই।

পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরুষের ন্যায় নারীদের জীবনেও উচ্চ মানসম্পন্ন এবং মূল্যবান ব্যক্তিত্বের অবস্থা থাকা জরুরী। এটি নারীদের অধিকার, স্বাধীনতা, সমর্থন, এবং সমানুভূতির মাধ্যমে তাদের সম্প্রদায়ে এবং সমাজে প্রতিরোধশীল ও উন্নত করতে সাহায্য  হয়ে থাকে। এটি একটি ব্যক্তির যোগাযোগে, সাধারণ জীবনে, শিক্ষা, কাজে, এবং সমাজে প্রভাবিত হওয়ার একটি উপায়ও হতে পারে।

যুগের বিবর্তনে প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষের পরিবর্তন হওয়াটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি সেই পরিবর্তনের ফলে যুগের মহিমায় পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত দিক থেকে পুরুষদের মতে নারীদেরও ভূমিকা চোখে পড়ার মতো। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুরুষরা নারীদেরকে কর্মস্থলে তাদের সমান অবস্থানে রাখা জরুরী। এতে তৈরি হবে কর্মবন্ধন, সম্পূর্ণ হবে প্রযুক্তির উদ্দেশ্যের সফলতা আর পরিপূর্ণ হবে পৃথিবীর চলমান প্রথা।

এছাড়াও ধর্মীয় জায়গা থেকে দেখা যায়,  একটা সময় যেখানে গোটা দুনিয়া যেখানে নারীকে একটি অকল্যাণকর তথা সভ্যতার অপ্রয়োজনীয় উপাদান মনে করতো সেখানে ইসলাম নারীকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। যেসব দোষ নারীকে দেওয়া হতো আল্লাহ তা’আলা কুরআন-উল-কারিমে আয়াত নাজিল করে নারীকে সেসব দোষ অপনোদন থেমে মুক্তি দিয়েছে। তাই নারীদের তার নিজ প্রেক্ষাপটে নিজের স্ব স্ব সঠিক দায়িত্বটা অবগত হয়ে তা পালনে মনযোগী হলে সঠিক পুরুষের কাছে নীতিগত নারী ঠিক সঠিক মূল্যয়ন ই পাবে।

তবে, এক শ্রেনির পুরুষ নামক কিছু অপ্রত্যাশিত মানুষের কাছে নারীর মর্যাদা নেই বল্লেই চলে, এদের মধ্যে কিছু পুরুষের মস্তিস্কহীন, কিছু পুরুষ মনুষ্যত্বহীন আর কিছু পুরুষ অমানুষের গণনায় অবস্থিত। কেননা পৃথিবীতে নারীদের যে পুরুষ সম্মান ভালোবাসা আর মমতায় আগলে রাখতে পারেনা বা জানেনা, সেই পুরুষ কখনোই সঠিক পুরুষের মধ্যে পড়েনা। এতে করে ওইসব নারীদের কাছে পুরুষদের অবমানা হয় যে সব নারী সঠিক পুরুষদেরকে দায়িত্ববান মনে করেন।

তবে, পুরুষ সর্বদা নারীদেরকে তার মনুষ্যেতর স্থান থেকে পৃথিবীর সেরা সম্মানটা দেওয়া উচিত। কেননা সঠিক পুরুষ আর সঠিক ব্যক্তিত্বের অধিকারি হতে এই নারীদের ভূমিকাই অপরিসীম। অবস্থান, আস্থা আর বিশ্বাষের দিক থেকে নারী পুরুষ উভয়েই সমান্তরাল হয়ে জীবন পরিচালনা করা উচিত। এতে করে তৈরি হবে সঠিক বন্ধন। হোক সেটা সামাজিক, পারিবারিক কিংবা জাতীগত। চলে যাবে অবমাননা, চরিত্রহীনতা কিংবা নারীর মূল্যহীনতা। থেকে যাবে হৃদয়ের বন্ধন ভালোবাসা সম্মান আর চলমান জীবন পরিচালনার সুশিল সমাজের পারিবারিক বন্ধন। তৈরি হবে নারী পুরুষের সঠিক বন্ধন আর ভবিষ্যত প্রজন্মের সঠিক নির্দেশনা।


নারীর প্রতি সম্মান   পুরুষের ভালোবাসা   নারী দিবস  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড আর্টিকেল

অধিকার আদায়ের স্মারক নারী দিবস

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ০৮ মার্চ, ২০২৪


Thumbnail

“পৃথিবীতে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের চোখে নারী এভাবেই ধরা পড়েছে। তবে সবসময় নারীদের এমন মহান দৃষ্টিতে দেখা হতো না। এর জন্য করতে হয়েছে নানা আন্দোলন। নারীর সংগ্রামের ইতিহাস পৃথিবীতে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

১৮৫৭ সালের ৮ই মার্চ নারীদের জন্য একটি স্মরণীয় দিন বলে বিবেচিত। এ দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের একটি সূচ তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। কারখানার মানবেতর পরিবেশ, ১২ ঘণ্টার কর্মসময়, অপর্যাপ্ত বেতন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের বিরুদ্ধে তাদের এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। কিন্তু পুলিশ এই শান্তিপূর্ণ মিছিলে মহিলা শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালায়। বহু শ্রমিককে আটক করা হয়। এই ঘটনার স্মরণে ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ মহিলা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে নিউইয়র্ক সূচ শ্রমিকেরা। এভাবেই সংঘবদ্ধ হতে থাকে মহিলা শ্রমিকদের আন্দোলন। এক সময় তা কারখানা ও ইউনিয়নের গন্ডি অতিক্রম করে।

১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতন্ত্রী নারী নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। এই সম্মেলনে নারীদের ন্যায্য মজুরী, কর্মঘণ্টা এবং ভোটাধিকারের দাবী উত্থাপিত হয়। ১৯১০ সালের ২য় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ডেনমার্কের কোপেনহেগে। এতে ১৭টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়। এ সম্মেলনেই ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১১ সালে প্রথম ৮ মার্চ দিবসটি পালিত হয়। ১৯১৪ সাল থেকে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে দিবসটি বেশ গুরুত্বের সাথে পালিত হতে থাকে। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করতে থাকে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ সময় জাতিসংঘ দিবসটির গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দিবসটি পালনের আহবান জানায়। এর ফলে অধিকার বঞ্চিত নারী সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ সুগম হয়। নারীর অধিকার রক্ষা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এটি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। নারী দিবসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বাংলাদেশের সংবিধানে নারী দিবসের শিক্ষাসমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। কেবল নারী হওয়ার কারণে যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয় তার আইনগত সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন আইনে নারীর সুরক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে এবং নারীর নিরাপত্তায় বিশেষ বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক শিল্প, যার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা এবং ন্যায্য মজুরী পাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। যে নারী শ্রমিকদের মধ্য থেকেই দিবসটির উৎপত্তি হয়েছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে সেরূপ নারী শ্রমিক রয়েছে কয়েক লক্ষ। নিউইয়র্কের সেদিনকার সূচ কারখানার নারী শ্রমিক ও বাংলাদেশের পোশাক তৈরি কারখানার নারী শ্রমিক যেন একই পথের অনুসারী। বাংলাদেশ প্রতি বছর। যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে থাকে। কিন্তু এখানকার নারী পোশাক শ্রমিকেরা কতটা সুরক্ষিত তার প্রশ্ন থেকেই যায়।

বাংলাদেশে নারীদের জন্য অনেক আইন ও বিধি বিধান থাকলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এখনও নারীরা উপেক্ষিত। নারীদের গৃহস্থালী কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই, মাতৃত্বকালীন ছুটির অভাব, নিরাপত্তার অভাব ইত্যাদি লক্ষ্যণীয়। তবে এখন এর এ সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমেছে। বাংলাদেশের নারী শ্রমিকেরা যে সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে এর পেছনে নারী দিবসের কিছুটা হলেও ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।

 

বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিকেরা আজও নানা ভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের রানা প্লাজা ও তাজরিন ফ্যাশনস এর দুর্ঘটনার পর দেখা গেছে, এতে হতাহতদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও মজুরী অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশেই নিশ্চিত হয়নি বলে মনে করা হয়। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন কোনো উপকারে এসেছে বলে মনে হয় না। অনেকের মতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস বর্তমানে কেবল একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে, যার বাস্তব কোনো সফলতা নেই।

বর্তমান যুগকে বলা হয় গণতান্ত্রিক যুগ, সমতার যুগ। কিন্তু এ সময়েও নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীরা এখন কাজের জন্য ঘরের বাইরে যাচ্ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গবেষণা, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই নারীর পদচারণা লক্ষণীয়। কিন্তু তারপরও নারীরা এখনও বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। নারী উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান বাধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সব সময় পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। এটিও নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়। নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয় তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। এরূপ অবস্থা নারীকে দুর্বল করে দেয়।  নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকাও উন্নয়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।

নারী উন্নয়ন করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। নারী উন্নয়নে সমাজ ও রাষ্ট্রকে একসাথে কাজ করতে হবে। নারীর প্রধান শক্তি  শিক্ষা, এ শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। নারীশিক্ষার বিস্তার ঘটলে নারীর কর্মসংস্থান হবে, আয় বাড়বে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে। নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা। এর জন্য নারীর নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী স্বার্থের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সহ নারীর উন্নয়নে সহায়ক সেবা প্রদান করতে হবে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ট পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। যদি বর্তমানে আমরা। নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তবেই দিবসটির উদ্যাপন সার্থক হবে।

নারী উন্নয়নের প্রথম এবং প্রধান বাধা হলো পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সব সময় পুরুষের অধীন এবং ছোট করে দেখা হয়। সামাজিক কুসংস্কার নারীর অগ্রগতিকে মেনে নিতে পারে না। এটিও নারী উন্নয়নের পথে এক বড় অন্তরায়। নারী যদি শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয় তবে সে সচেতন হয় না। তার আয় বাড়ে না। ফলে সে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়। এরূপ অবস্থা নারীকে দুর্বল করে দেয়। নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকাও উন্নয়নের পথে বাঁধার সৃষ্টি করে।

নারী দিবস নিয়ে কিছু শিক্ষার্থী, ডাক্তার ও কর্পোরেট সেক্টরে নিয়োজিত কর্মজীবী নারীদের মতামত জানতে চাইলে তারা জানায়, মানুষ এখন নারীদের অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছে। নারীরা নিজেরাও তাদের মতামত নিয়ে বেশ সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ) জানায়, মেয়েদের নিজের প্রতি আত্নবিশ্বাসী হতে হবে, কখনো দমে যাওয়া যাবেনা। একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রতিবছর নারী দিবস উদযাপন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক আয়োজন করে থাকে। আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৪ এর প্রতিপাদ্য - নারীর সম অধিকার, সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের এক স্মারক দিবস। নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্যের প্রতিবাদে এক বলিষ্ট পদক্ষেপ ছিল এই দিনটির আন্দোলন। যদি বর্তমানে আমরা নারীর ন্যায্য অধিকার ও চাহিদা পূরণ করতে পারি, তবেই দিবসটির উদযাপন সার্থক হবে।


অধিকার   স্মারক   নারী দিবস  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন