ভাষা মূলত একটি মাধ্যম। যে শব্দগুলোর বিনিময়ে
একে অপরকে কাছে টানে, বুঝতে পারে, জানতে পারে। এই শব্দ মাধ্যমগুলোর
সমষ্টিই হচ্ছে ভাষা। সৃষ্টির আদিতে মানুষ ভাষার ব্যবহার করতে জানতো না। বিভিন্ন গোত্র, উপ-গোত্র বা
সম্প্রদায় ইশারা-ইঙ্গিতে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করতো। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ ভাষার ব্যবহার করতে শিখে, এর পর শুরু
হয় অক্ষর বিন্যাস অর্থাৎ লেখার চর্চা।
মূলত মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ভাষা ব্যবহারের প্রচলণ করেছিল। একেকটি অঞ্চলের একেকটি সম্প্রদায়ের ভাষা একেক রকম হয়ে থাকে। উচ্চারণগত ভিন্নতার কারণেও বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাভাষি বিভিন্ন মানুষের ভাষাগত ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। ইতিহাসবিদ এবং ভাষাবিদদের মতে, বাংলা ভাষা একটি আদি ভাষা। এর রয়েছে প্রায় ১৪শ’ বছরের ঐতিহ্য। বাংলা গদ্য সাহিত্য কিংবা দৈনিক পত্রিকাতেও পাকিস্তান আমলে সাধু ভাষার প্রচলণ লক্ষ্য করা গেছে। এটিও বাংলা ভাষা, লেখ্য বা সাধু ভাষা এবং আবার এর রয়েছে কথ্য বা চলিত ভাষা। বাংলাতে এমন ভাষার ব্যবহার খুব বেশি দিন আগের নয়। দিনে দিনে পরিমার্জন, পরিশোধন এবং পরিচর্যার কারণে সমসাময়িক সময়ে বাংলা ভাষার একটি প্রমিত রূপ ধারণ করেছে বলেই মনে করছেন ভাষাবিদরা।
ভাষাবিদরা বলছেন, এর মূলে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অবদান। বাংলা সহিত্যের কথা সাহিত্যিকেরা তাদের রচিত বিভিন্ন বইয়ে শুদ্ধ বাংলা ভাষা বা প্রমিত বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটিয়ে আজকের বাংলা ভাষার রূপ সৃষ্টি করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির আগে বাংলা ভাষারও অন্য একটি ভিন্ন রূপ ছিল। ব্যাকরণগত দিক থেকে যাকে বলা হতো সাধু ভাষা, তবে সে সময় কথ্য বা চলিত ভাষার ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের এক অধিবেশনেও এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে তখন পর্যন্ত এ সমস্যাটি তত প্রকট হয়নি। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিলে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। তৎকালীন বাংলা সরকারের সময়ও ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মৃদুভাবে দেখা দেয়।
কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে পাল্টা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উর্দু ভাষাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে খুব ক্ষুদ্র হলেও বাংলার পক্ষে দাবি ওঠে। তবে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ভাষা বিতর্ক নতুন রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মাসে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন।
এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র-পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এ সময় পূর্ববঙ্গে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ এর জুলাই মাসেই কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘গণআজাদী লীগ' নামে একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠন স্পষ্টভাবে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে। পরের মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা বিতর্ক আরো প্রকাশ্য রূপ লাভ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিস’ সভা-সমিতি ও লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। এই সংগঠনের উদ্যোগে ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ যার আহ্বায়ক মনোনীত হন নূরুল হক ভূঁইয়া। পরবর্তীকালে এ উদ্দেশে কয়েকটি কমিটি গঠিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিসের গঠিত প্রথম সংগ্রাম পরিষদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা ও স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
তবে পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি ও আশা-আকাঙ্খাকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারি কোন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলনের প্রসার ঘটে। ঢাকায় ৬ ডিসেম্বর প্রতিবাদ মিছিল শেষে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। যদিও এ পর্যায়ে সরকার যড়যন্ত্রের পাশাপশি উর্দুভাষী মোহাজেরদের বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ১২ ডিসেম্বর এমনি একটি বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষে বেশ কযেকজন বাঙালি ছাত্র আহত হন।
ভাষা সৈনিক নূরুল হক ভূঁইয়া এ ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “বাঙালিদের ওপর অবাঙালিদের এটা যে অন্যায় হামলা ছিল- তা সবার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়। বাঙালির মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব, জাতীয় সত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে ভাষা আন্দোলন দ্রুত জনসমর্থন লাভ করে।”
এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করে। সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং ১৫ দিনের জন্য সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই ভাষা প্রশ্নে বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত অংশ বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার হয়। ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের সকল সদস্যের ভোটে তা অগ্রাহ্য হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রতিবাদ করে প্রথমে ছাত্র সমাজ।
২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। নব গঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। ওইদিন হরতালকালে পুলিশের লাঠি চার্জে অনেকে আহত হন। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল আলম সহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শুধু ঢাকা নয় ঢাকার বাইরে সর্বত্র ১১ মার্চ হরতাল ও অন্যান্য দিনের কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার প্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ও ব্যবস্থাপক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপনে রাজি হন।
তড়িঘড়ি করে তাঁর চুক্তি সম্পাদনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর যেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। ১৯ মার্চ জিন্নাহও ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্সে নাগরিক সংবর্ধনা, ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মতামত দেন। জিন্নাহর ২৪ মার্চ বক্তৃতার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশনে নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ মার্চের চুক্তি ভঙ্গ করে উর্দুকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করেন। পরিষদে বিরোধী দল এর প্রতিবাদ করলেও নাজিমুদ্দিন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন নি। যদিও শেষ পর্যন্ত পরিষদে উত্থাপিত এই প্রস্তাবটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
১৯৪৮ সাল জিন্নাহর মৃত্যুর পর বিশেষত মার্চ মাসের পর হতে ভাষা আন্দোলন কিছু দিনের জন্য স্থিমিত থাকলেও বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয়। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে ৮ এপ্রিল থেকে ১৮ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের ধর্মঘট, মেডিকেল ছাত্রদের ধর্মঘট, জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই পুলিশ ধর্মঘট হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে গুলি চলাকালে ২ জন পুলিশ নিহত হয়।
এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান আলী ঢাকা এলে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায়। লিয়াকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায় সুকৌশলে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রদের মধ্য থেকে আবারও ‘না’ ‘না’ ধ্বনিত প্রতিবাদ মুখরিত হয়ে ওঠে।
ভাষা আন্দোলন ভাষা বিতর্ক উৎপত্তি ইতিহাস
মন্তব্য করুন
মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও অনুকম্পার মাস এই রমজান। তাই এই রমজান মাসে অত্যধিক নেক আমল ও জিকির-আজকার করা উচিত। রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজান। পবিত্র এই রমজান মাসে মুসলিম উম্মাহর সঠিকভাবে রোজা পালন করা উচিৎ। এতে বিপুল পরিমাণে সওয়াব লাভ হবে। সেই সঙ্গে সঠিকভাবে ইসলামিক বিধান মোতাবেক রোজা পালন করতে যে সকল বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে- তাই আজকের আলোচনা বিষয়বস্তু।
আমরা অনেকেই জানি না যে, কী কী কারণে রোজা ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। তাই যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় বা নষ্ট হয়, সেসব কারণগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
১. ইচ্ছাকৃত বমি করা বা মুখে বমি চলে আসার পর- তা পরিমাণে অল্প হলেও ইচ্ছা করে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। (সূত্র: সহীহ মুসলিম এবং মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)।
২. কোনো কারণে নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে মুখে চলে আসলে রোজা ভেঙে যাবে। ( সূত্র: ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া)।
৩. মুখে পান বা অন্য কোনো খাবার রেখে ঘুমিয়ে পড়ার পর জেগে ওঠে কেউ যদি দেখে যে, সুবহে সাদেক হয়ে গেছে আর সেই পান বা খাবারের কিছু অংশ পেটে চলে যায়; তবে তার রোজা হবে না। পরে কাজা রোজা করতে হবে। তবে এ কারণে রোজা ভেঙে যাওয়ায় কাফফারা দিতে হবে না। (সূত্র: ফতোয়ায়ে শামী -যাকারিয়া)।
৪. ওজু করার সময় বা যে কোনো কারণে কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে পানি গলা দিয়ে পেটে চলে যায়, ওই ব্যক্তির রোজা হবে না। এ রোজা পরে কাজা করতে হবে। আর কুলি করার সময় যদি রোজার কথা স্মরণই না থাকে এবং পানি মুখে নিয়ে খেয়ে ফেলে তবে রোজা ভাঙবে না।' (সূত্র: ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া)।
৫. নাক ও কানে তেল দেওয়ার দ্বারাও রোজা ভেঙে যাবে। তবে কাফফারা ওয়াজিব হবে না।' (সূত্র: ফতোয়ায়ে হেদায়া)।
৬. যদি কোনো ব্যক্তি কারো ধমকের (ভয়ে) কারণে কিংবা রোজা রাখার কথা ভুলে গিয়ে কোনো কিছু খেয়ে ফেলার পর (না জানার কারণে) রোজা ভেঙে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত খাবার খেলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। পরে এ রোজা কাজা করা জরুরি। (সূত্র:মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)।
৭. পাথরের কণা, মাটি, ঘাস, কাগজ ইত্যাদি অর্থাৎ সাধারণত যা আহারযোগ্য নয় কিংবা যেসব খাবার মানুষের কোনো উপকারে আসে না তা খেলেও রোজা ভেঙে যাবে। আর এ রোজা পরে কাজা করতে হবে। (সূত্র: ফতোয়ায়ে বাযযাযিয়া)।
৮. দিনের বেলায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে; এ সহবাসে বীর্যপাত হোক আর নাই হোক স্বামী-স্ত্রী উভয়ের রোজা ভেঙে যাবে। এই অবস্থায় রোজা ভঙ্গের ৫ পরিণাম কবিরা গুনাহ হবে; ফলে তাদের তাওবা করতে হবে;
রোজা বাতিল হয়ে যাবে; তাদের উভয়কে ওই দিনের অবশিষ্ট অংশ খাবার ও পাণীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে; ওই দিনের রোজা (রমজানের পরে) কাজা করতে হবে; কাফ্ফারা আদায় করতে হবে। আর কাফ্ফারা হলো- একাধারে দুই মাস রোজা রাখা অথবা একজন গোলাম আজাদ করা কিংবা ৬০ জন মিসকিনকে একবেলা খাবার খাওয়ানো।
৯. সহবাস ছাড়া অন্য পন্থায় যৌনস্বাদ নেওয়ার জন্য বীর্যপাত ঘটালেও রোজা ভেঙে যাবে। এমনকি যদি কোনো রোজাদার যৌনস্বাদ নেওয়ার জন্য স্পর্শকাতর কোনো যুবতী যৌবনা নারী সংস্পর্শে আসে; তাকে চুম্বন করে; জড়িয়ে ধরে অথবা হস্তমৈথুন করে ইত্যাদির মাধ্যমে বীর্যপাত ঘটায় তবে তার রোজা ভেঙে যাবে।
(সবার জানা উচিত যে, এই কর্মগুলি যেমনিভাবে রোজার মাসে হারাম তেমনিভাবে অন্য সময়গুলোতেও হারাম।)
১০. উপকারি কিংবা অপকারি, কম কিংবা বেশি, হালাল কিংবা হারাম খাবার; যা-ই হোক তা দিনের বেলায় নাক-মুখ দিয়ে গ্রহণ করলেও রোজা ভেঙে যাবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর পানাহার কর; যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিস্কারভাবে দেখা যায়।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)।
১১. রোজাদার যদি খাবারের বিকল্প উপায় হিসেবে- রক্ত গ্রহণ; শক্তিবর্ধক স্যালাইন গ্রহণ; এমন ইঞ্জেকশন যা আহারের কাজ করে অর্থাৎ গ্লুকোজ ইনজেকশন ইত্যাদি গ্রহণ করে তবে রোজা ভেঙে যাবে।
১২. অসুস্থতার কারণে ইনহেলার (Inhelar) ব্যবহার করলেও রোজা ভেঙে যায়। (সূত্র: ফতোয়ায়ে শামী -যাকারিয়া)।
১৩. কোনো রোজাদার নারীর যদি ইফতারের আগ মুহূর্তেও হায়েজ (মাসিক) ও নেফাস (প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ) হয়, তবে রোজা ভেঙে যাবে।
১৪. রোজাদার ব্যক্তির শরীর বা দেহ থেকে দুষিত রক্ত বের করলে রোজা নষ্ট হবে কি হবে না- তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে; তবে মূল কথা হলো- দিনের বেলায় রোজা থাকা অবস্থায় কোনো রোজাদারের জন্যই এ কাজ না করা উত্তম।
১৫. কোনো রোজাদার যদি তার কোনো কথা, কাজের কারণে মুরতাদ বা ইসলাম থেকে বের হয়ে যায় (কাফের হয়ে যায়), তবে ওলামায়ে কেরামের সর্বসম্মতিক্রমে তার রোজা বাতিল হয়ে যাবে। অতঃপর সে যদি তাওবা করে পুনরায় মুসলিম হয়, তাহলে এ রোজা রমজানের পরে কাজা করতে হবে।
১৬. কোনো রোজাদার যদি ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বেহুশ থাকে, তবে তার রোজা শুদ্ধ হবে না। বরং তাকে ওই দিনের রোজা পরে কাজা করতে হবে।
১৭. রোজার নিয়তে গরমিল হলেও রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। নিয়ত প্রত্যেক ইবাদত তথা রোজার অন্যতম রোকন। আর সারাদিন সে নিয়ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে মনে জাগ্রত রাখতে হবে যে, আমি রোজাদার। যাতে রোজাদারের নিয়তে রাখা না রাখার বা রোজা বাতিল করার কোনো দৃঢ় সংকল্প না করে বসে।
১৮. রোজা না রাখার নিয়ত করলে এবং নিয়ত বাতিল করে দিয়ে সারাদিন খাবার না খেয়ে উপবাস করলেও রোজা বাতিল বলে গণ্য হবে। সুতরাং রোজা রাখার জন্য নিয়ত আবশ্যক।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বিত্র কোরআনে নির্দেশ করেছেন, ‘আর এ বিষয়ে তোমরা কোন ভুল করলে তোমাদের কোন পাপ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (পাপ হবে)। আর আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৫)।
পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজা যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। কোরআন ও সুন্নাহর ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। রোজা ভঙের বা নষ্টের কারণগুলো থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন
রোজার পূর্ণ সওয়াব অর্জন এবং মহান প্রভুর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য পেতে হলে শুধু পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকা যথেষ্ট নয়। বরং মিথ্যা, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, ঝগড়া-বিবাদসহ যাবতীয় অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং চোখ, কান, জিহ্বা ও হাত-পাসহ সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুনাহ মুক্ত রাখতে হবে। হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্যগ্রন্থ সহীহ মুসলিমে উল্লেখ আছে, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখবে সে যেন অশ্লীল আচরণ ও ঝগড়া বিবাদ থেকে বিরত থাকে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার প্রতি মারমুখী হয়, তবে সে যেন বলে ‘আমি রোজাদার’।
প্রিয়নবী (সা.) আরো বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, অশ্লীল কর্মকাণ্ড ও জাহেলি আচরণ পরিত্যাগ করতে পারে না, তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী) বিনা ওজরে রমজানের রোজা ভঙ্গ করা কবিরাহ গুনাহ এবং এর পরিণতি জাহান্নাম। রমজানুল মোবারকের একটি রোজা ভঙ্গ করে তার বিনিময়ে সারাজীবন রোজা রাখলেও ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোজা রাখলেও ঐ রোজার ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, সহীহ বুখারী)
ইসলামী স্কলার মুফতি হেলাল উদ্দীন হাবিবীর দেওয়া তথ্যমতে পবিত্র রমজানুল মোবারকের রোজা পালনের সুবিধার্থে কিছু জরুরি ও আধুনিক চিকিৎসা সংক্রান্ত মাসআলা উপস্থাপন করা হলো:-
১. রোজা অবস্থায় মুখে কোনো ঔষধ ব্যবহার করে তা গিলে ফেললে রোজা ভেঙ্গে যাবে। যদিও তা কম হয়।
২. সালবুটামল বা ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে রোগী যদি অতি অসুস্থ হয়ে পড়ে; সে ক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহারের মাধ্যমে রোজা ভাঙ্গতে পারবে এবং পরাবর্তীতে কাজা রোজা করতে হবে। তবে কাফ্ফারা লাগবে না।
৩. রোজা অবস্থায় এন্ডোস্কপি করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে কোনো নল বা পাইপের মাধ্যমে পেটের ভেতর ঔষধ প্রবেশ করালে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
৪. নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহার করে গিলে না ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৫. কানে ড্রপ, ঔষধ, পানি বা তেল ইত্যাদি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৬. চোখে ড্রপ বা মলম ব্যবহার করলে রোজা ভঙ্গ হবে না। এটা হাদীস দ্বারা প্রমানিত; যদিও তার স্বাদ গলায় উপলব্ধি হয়।
৭. নাকে অক্সিজেন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৮. নাকে ড্রপ বা পানি দিয়ে ভেতরে টেনে নিলে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
৯. রোজা অবস্থায় রক্ত দিলে বা নিলে কোনো অবস্থাতেই রোজা ভঙ্গ হবে না।
১০. এনজিওগ্রাম করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১১. ইনসুলিন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১২. ইনজেকশন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১৩. রগে স্যালাইন নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১৪. সাপেজিটরি-ভোল্টালিন মলদ্বারে প্রবেশ করালে রোজা ভেঙ্গে যাবে।
১৫. যোনিদ্বার বা প্রস্রাবের রাস্তায় ঔষধ প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১৬. বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের টিকা নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
মন্তব্য করুন
সমসাময়িক
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইফতার পার্টির নামে গরীব-দুঃখী অসহায় জনসাধারণকে একবেলা খাবারের
ব্যবস্থা করে রাজনৈতিক দলে ভেড়ানোর চেষ্টা আমরা হরহামেশাই অবলোকন করে থাকি। কিন্তু
প্রশ্ন হচ্ছে পবিত্র মাহে রমজানে এসব ইফতার পার্টির নামে রাজনীতি ইসলামে কতটুকু শোভন?
সংযমের মাস মাহে রমজান। বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসকে গুরুত্ব দিয়েছেন স্বয়ং
সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা। ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে, গরীব-দুঃখী মানুষকে
রাজনৈতিক দলে ভেড়ানোর চেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায়শই চোখে পড়ে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড
আসলে কতটুকু সঠিক?- তাই বলছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।
ইসলামী চিন্তাবিদরা
বলছেন, রমজান মাসে আলোচনা সভা ও ইফতার ‘পার্টির’ নামে এখন বিকৃত ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের সুমহান ধর্মীয়
ঐতিহ্যকে বিতর্কিত করে চলেছে। কারণ, লৌকিকতা, জৌলুসে ভরা বে-হিসেবী তথা অবৈধ উৎসের
অর্থে কেনা বা সংগৃহীত খাবার মুমিনদের ইফতারের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। তাই এখনই
সতর্ক হয়ে সে সকল পথ পরিহার করা আমাদের আশু করণীয়।
রমজানে সারাদিন
রোজা রাখার পর ইফতার করে একজন রোজাদার তার দেহ-মনের পবিত্রতা ও প্রফুল্লতা লাভ করে
থাকেন। শুধু খাদ্য সামগ্রী দিয়ে রোজা ভঙ্গ করাই নয়, ইফতারির সময় দোয়া কবুলেরও সময়।
এ সময় খাঁটি রোজাদাররা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে দোয়া করে পানাহ চেয়ে থাকেন। এতে
রোজারদের দেহ-মনে স্বর্গীয় প্রশান্তি আসে।
আমদের দেশে
পবিত্র রমজানের রোজাকে সামনে রেখে আলোচনা সভা ও ইফতার একসঙ্গে করার হিড়িক পড়ে যায়।
অনেক রাজনৈতিক দলকে ইফতার পার্টির নামে সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়। একবেলা খাবারের লোভে
অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ এসব ইফতার পার্টিতে ভিড় জামান। এরকম কোনো কোনো আয়োজনে দীর্ঘ
সময়ব্যাপী নানা ধরনের পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, এমনকি গালাগালি,
বিষোদগার, ঝগড়াঝাটি করতেও দেখা যায়। পরে এসব
শেষে ইফতার করা হয়। অনেক সময় হাস্যকর বিষয়েও ইফতারে হট্টগোল বাঁধতে দেখা যায়।
এতে ইফতারের মতো একটি মহান ধর্মীয় বিষয়ের মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য ও স্বর্গীয় আমেজ-অনুভূতি
নষ্ট হয়ে পড়ে।
অনেকে আজকাল
ইফতারকে নিছক পার্টির আবরণে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ইফতার তো কোনো বিয়ে-জন্মদিন
বা রাজনৈতিক-ব্যবসাপাতির কোনো বিষয় নয়। রোজাদারগণ ভুলেই বসেন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ
অথবা কোনটা গিবত, কোনটা রিয়া আর কোনটা শিরক্, কোনটা তাকওয়া ! তাই রিয়া, বেদআত, ও তাক্ওয়া
বিষয়গুলো বোঝাটা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে বলেও মনে করছেন ইসলামী চিন্তাবিদরা।
পবিত্র কোরআন
এবং হাদিসের আলোকে তারা বলছেন, রিয়া হলো অহেতুক লোক দেখানো বিষয়। ইসলাম অহেতুক জৌলুস
করে লোক দেখানো বিষয় সমর্থন করে না। রোজা একটি সাধনার ব্যাপার ও সর্বোপরি এটা আত্মিক
ইবাদত। এখানে লৌকিকতার কোনো স্থান নেই। রোজা আল্লাহর প্রদত্ত বিধান। মানুষের অধ্যাত্মিক
শিক্ষা ও প্রগতির জন্য রোজা হচ্ছে একটি উপায়। রোজা মানুষকে অশালীন প্রবৃত্তিরোধ করে
শৃংখলাবদ্ধ হতে সক্ষম করে। এটা ধনী-গরীব সব মানুষকে একই ক্ষুৎ-পিপাসার অভিজ্ঞতা প্রদান
করে থাকে। তাই একজন খাঁটি মুসলমান শুধু মিডিয়ায় প্রচারের জন্য স্বার্থপরের মত ভোগবিলাসী
বড়লোকী খানাপিনায় মত্ত হবার মতো ইফতার করতে পারেন না।
আর বেদআত
হলো যেটা মূল বিষয় থেকে বিকৃত করে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। ধর্মকাজে নতুনত্ব সৃষ্টি
করা বা পরিবর্তন করাকে বেদআত বলে (ওয়াজ ও খুতবা ১০৯, ২৬০)। শরীয়তের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি
বা সংমিশ্রণ করে মনগড়া ও বিকৃত জিনিস হলো বেদআত। এর ফলে শয়তানের ধোঁকার মধ্যে পড়ে গুমরাহির
পথ প্রশস্থ হয়।
তাক্ওয়া হলো-
খোদাভীরু হওয়া, মুত্তাক্কী হওয়া। সবসময় আল্লাহর কথা স্মরণ করা ও তাঁর ভয়ে ভীত থাকা।
আল্লাহতায়ালা সবসময় বিরাজমান, সঙ্গে আছেন, সব কাজ দেখছেন-মানুষের অন্তরে এমন বিশ্বাস
হওয়াটাই তাক্ওয়া । রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে মুত্তাকীর ভাব চলে আসে। তাই সে খারাপ কাজ
করতে চায় না।
ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, বলা হয়ে থাকে আমরা বাংলাদেশিরা
সংকর বাঙালি। এ জাতির ভাবনা চিন্তাও সংকর ও কিছুটা মিশ্র। আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায়
সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষতার একটি মুলনীতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে
ধর্মহীনতা নয়। তাই সব ধর্মের মানুষ এদেশে সমান ধর্মীয় সুবিধা ও অধিকারের সুযোগ পেয়ে
থাকেন।
আজকাল এসব
ইফতার ‘পার্টিতে’
রঙ-রেজিনী দিয়ে সুদৃশ্য গেট সাজানো হয়, রঙীন আলো দিয়ে মঞ্চ তৈরি হয়। দেশের হোমড়া-চোমড়া
মানুষরাই এখানে দাওয়াত পেয়ে থাকেন। জৌলুসে ভরা, লোক দেখানো এসকল ইফতার পার্টিতে আদৌ
কোনো ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য থাকে না। পাক-নাপাক, পর্দা-বেপর্দার সমন্বয়ে আজকাল ব্যবসা
অথবা রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে ইফতারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। আজ অমুকের সম্মানে
ইফতার-তা হবে কেন? এসব ইফতার ‘পার্টিতে’
দামী রেস্টুরেন্ট বা পাঁচতারকা হোটেলের বহু পদের বাহারী খাবার আনানো হয়। ইফতার ‘পার্টি’র সুস্বাদু বহুপদের স্বাদ নিতে গিয়ে
মাগরিবের নামাজের কথা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। অনেকে অশালীনভাবে সেজেগুজে ইফতার করতে
বসেন। প্রতিদিন টিভিতে এসব দেখানোও হয়ে থাকে। এগুলো রোজার সংযম, আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টা
নয়। বরং এগুলো দ্বারা রমজান মাস, রোজা ও ইফতারের মর্যাদাকে প্রহসনে রুপান্তরিত করা
হয় মাত্র। লৌকিক, ভোগবাদী এ সকল ইফতার ‘পার্টি’র বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বর্তমানে আমরা আসল ধর্মীয় মূল্যবোধ
থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি।
আবার কেউ
লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে প্যান্ডেল টাঙ্গিয়ে উচ্চস্বরে মাইক বজিয়ে শতপদের ইফতারীর পসরা
নিয়ে বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে উল্লাস করে ইফতার করবেন-আর প্যান্ডেলের পাশের অভাবী মানুষের
খোঁজ নেবেন না অথবা কেউ একটু ছোলা-মুড়ি পাবার আশায় থালা হাতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াবে-
এটা রোজার শিক্ষা নয়। পাশাপাশি আলোচনা সভার নামে ইফতার করতে এসে ‘পার্টি’তে বসে রোজার আহকাম-আরকান ভুলে গিয়ে
আমরা কোনটা গিবত, কোনটা রিয়া আর কোনটা বেদআত গুলিয়ে ফেলছি।
ইসলামী চিন্তাবিদরা আরও বলছেন, এ সকল ইফতার ‘পার্টি’র আয়োজন ধর্মীয় কাজের মোড়কে আমাদের
ধর্মে নব্য অপচয় সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। আজকাল মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে, ভাই-বোন নিয়ে পরিবারের
সঙ্গে বসার ফুরসৎ হয় না। সবাই একত্রে ইফতার করার সময় যেন একবারেই উধাও হয়ে গেছে। এতে
চিরায়ত পারবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে। মা-বাবারা তাদের উঠতি বয়সের সন্তানদের সাথে ভালো
করে কথা বলার সময় পান না। একটি ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে থাকলে নৈতিকতা শাণিত হয়। সাথে
বাবা মায়ের স্নেহের বচন, উপদেশ পরামর্শ ইত্যাদি থেকে সুসন্তান তৈরি হয়। এভাবে একটি
ইতিবাচক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়ে থাকে। নব্য ইফতার পার্টি সংস্কৃতির আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে
রাজনৈতিক নেতাদের একে অপরের মুখের বিষোদ্গার শুনে নবীনরা নেতিবাচক মানসিকতা অর্জন করছে।
ইসলামে মানুষ
মানুষে ভেদাভেদের কোন স্থান নেই। সকল মানুষের সম-সুযোগের ভিত্তিতে সামাজিক সহ-অবস্থান
নিশ্চিত করতে না পারলে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হবে। সামাজিক বৈষম্য প্রকট হলে সামাজিক
বঞ্চনা থেকে নানামুখি সংকট তৈরি হতে থাকবে। সামাজিক এসব সংকট আজকাল অপরাধ বৃদ্ধি করে
চলেছে। বর্তমানে সুবিধাভোগী রং সাইডে চলা পাতি নেতারা এবং তাদেরকে অবৈধ মদদদাতা একশ্রেণির
নৈতিকতা বিবর্জিত কর্মকর্তা ও সংগঠকরা চরম অনৈতিক কাজে ভীষণভাবে সক্রিয়। এসব লুটেরা
এখন দেশের নিম্ন ও মধ্যমশ্রেণির কর্মজীবি, সৎ, ধর্মভীরু মানুষের ঝুলি ও হাঁড়ির ওপর
নজর দিয়েছে।
আসুন আমরা সবাই পবিত্র রমজানের সুযোগকে কাজ লাগিয়ে সংযমী হই, কল্যাণ, ক্ষমা, মুক্তি তথা মাগফেরাত ও নাজাতের এই ভরা মৌসুমকে কাজে লাগিয়ে নেতিবাচক ইফতার সংস্কৃতি পরিহার করে খাঁটি রোজাদার ও পূণ্যবান হয়ে উভয় জগতের সাফল্য খোঁজার চেষ্টা করি।
মন্তব্য করুন
পবিত্র মাহে রমজান মুমিন মুসলমানের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই মাসে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। এই মাসে কিছু গুণাবলি অর্জনের দীক্ষা নেন মুমিন। যে শিক্ষাগুলো ধারণ করলে জীবন হয় আলোকিত। আল্লাহ তাআলা বরকতময় রমজান মাসকে মুসলিম উম্মাহর জন্য রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের উসিলা বানিয়েছেন। রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কিছু বিশেষ গুণের অধিকারী হয়ে থাকেন- যা পরবর্তী সময়ে তার যাপিত জীবনে একটি উত্তম চরিত্রের মানুষ হিসেবে মর্যাদা দান করে।
মুসলিস উম্মাহর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) ওপর কোরআন নাজিলের পবিত্র মাস রমজান। এ মাসেই মানুষের জন্য জীবন বিধান হিসেবে কোরআন নাজিল করা হয়েছে। পবিত্র রমজানে একজন রোজাদার যেসব গুনগুলো অর্জন করবেন তাই আজকের আলোচনা বিষয়বস্তু।
তাকওয়া অর্জন
রোজার প্রধান শিক্ষা তাকওয়া অবলম্বন করা। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা ও ভয় করা। পরিভাষায়- মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলে। আর দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বান্দাকে তাকওয়া অবলম্বন করার যোগ্যতা তৈরি করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত- ১৮৩)
মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার মাস রমজান
রমজানে মসজিদের সঙ্গে রোজাদারের সম্পর্ক স্থায়ী হয়। কোনো মুমিন মুসলমানের জন্য এমনটি হওয়া উচিত নয় যে, সে শুধু রমজানেই নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। বরং বছরজুড়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার সম্পর্ক এই রমসজানে তৈরি হবে। যেন মুমিনের জন্য দুনিয়াতেই মসজিদ হবে জান্নাতের সর্বোত্তম নমুনা।
বিশুদ্ধ কোরআন শিক্ষার মাস রমজান
বরকতময় রমজান কোরআন নাজিলের মাস। মাসটি কোরআন শেখার জন্য বিশেষ সহায়ক। রমজানে কোরআনের সঙ্গে তৈরি হোক স্থায়ী সম্পর্ক। কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক যেন রমজান কেন্দ্রিক না হয়। রমজানে কোনো ইসলামিক স্কলার কিংবা কোনো ব্যক্তির উপদেশ যেন এমন না হয় যে,- ‘কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে বা না জানলে ‘কুল হুওয়াল্লাহ’ সুরা বা ‘সুরা ইখলাস’ কিংবা কোনো দোয়া-জিকিরের অজিফা দুই শত বার কিংবা চার শত বার পড়ুন!’
বরঞ্চ তাদের বক্তব্য যেন হয় এমন যে, রমজান মাস হলো কোরআন শেখার সর্বোত্তম মাস। কোরআন পড়তে না জানলে ২/৪/৬ কিবাং হাজার বার কোনো সুরা, দোয়া পড়ার তালিম নয়; বরং আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ থেকে শুরু করে এক আয়াত, দুই আয়াত, একটি সুরা, দুই সুরা, এক পারা, দুই পারা- এভাবে কোরআন শেখানো বা শেখার উপদেশই সর্বোত্তম। কোরআন নাজিলের মাস রমজানেই মুমিন মুসলমানের জন্য তেলাওয়াত শেখার সর্বোত্তম সুযোগ।
নবীজী হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেন, কোরআন ও রোজা আল্লাহ তাআলার কাছে সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, ‘আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও মনের খায়েশ মিটানো থেকে বিরত রেখেছিলাম।’ কোরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিলাম। অতএব আমাদের সুপারিশ কবুল করুন।’ তখন আল্লাহ তাআলা সুপারিশ কবুল করে নিবেন (মুসনাদে আহমদ)।
সহিহ মুসলিমে আবু উমামা আল বাহিলি (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, নবীজি (সা:) বলেন, ‘তোমরা কোরআন পড়ো, কেননা তেলাওয়াতকারীদের জন্য কোরআন সুপারিশকারী হিসেবে আসবে’ (সহিহ মুসলিম: ৮০৪)।
সহমর্মিতা
মহানবী (সা:) রমজান মাসকে ‘সহমর্মিতার মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। দীর্ঘদিন রোজা রাখার কারণে রোজাদারের মধ্যে দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সহমর্মিতাবোধ জাগ্রত হয়। সহমর্মিতা জ্ঞাপন করার জন্য মহানবী (সা:) রমজান মাসে অধিক পরিমাণে দান করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা:) ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল। রমজান মাসে তিনি আরও অধিক দানশীল হয়ে ওঠতেন...’ (সহি বুখারী: ৬)।
ধৈর্যধারণ
হাদিসে রমজান মাসকে ‘ধৈর্যের মাস’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। রোজাদারের সামনে সুস্বাদু খাবার থাকলেও তিনি আহার করেন না, রূপসী স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সহবাস করেন না। এমনকি আচার-আচরণেও ধৈর্যধারণ করেন।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজাদার’ (বুখারি: ১৯০৪)।
ইখলাস
রোজা এমন একটি ইবাদত, যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে পানাহার ও যৌনাচার করার সুযোগ পরিহার করেই রোজা রাখেন একজন রোজাদার। এজন্যই হাদিসে কুদসিতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার নিজের জন্য। কিন্তু রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান দেব।’ (সহি বুখারী: ১৯০৪)।
ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব
রমজানে ধনী-গরীব, সাদা-কালো একসঙ্গে তারাবির নামাজ, একই দস্তরখানে সম্মিলিতভাবে ইফতার করা এবং জাকাত ও সদকাতুল ফিতর প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। এই ভ্রাতৃত্ববোধ মুসলমানদের প্রতি সৃষ্টিকর্তার একান্ত অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে, ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শন সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎ পথ লাভ করতে পারো।’ (সুরা আল ইমরান: ১০৩)।
নাজাত পাওয়ার মাস রমজান
রমজান মাসে দেখে দেখে পুরো কোরআন পড়ার যোগ্যতা অর্জন করার মাধ্যমে রমজানের রহমত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার চেষ্টা করা। তাই রমজানের শুরু থেকেই কোরআন শেখার মেহনত করা জরুরি। প্রয়োজনে আরবি ২৯ হরফ শেখার মাধ্যমে তা শুরু করা যেতে পারে।
কোরআন শেখার হুকুম হচ্ছে ফরজ। বিশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শেখা সবার উপর ফরজ। কোরআন শেখার জন্য কোনো অজুহাত-ওজরের প্রয়োজন নেই। আর কোনো ওজর দিয়ে পার পাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। কোরআন শেখার মাধ্যমে রমজান মাসে আল্লাহর কাছে নাজাত পাওয়ার চেষ্টা করাই হবে সর্বোত্তম নেক আমল ও ইবাদত।
কোরআন শেখার কাজে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ সবার জন্য সমান গুরুত্ব বহন করে। তাই সবার জন্য পুরো কোরআন তথা সুরা ফাতেহা থেকে নাস পর্যন্ত দেখে দেখে বিশুদ্ধভাবে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। আর রমজানই হোক সবার জন্য কোরআন শেখার সর্বোত্তম সময়।
তবে কোনো লোক নিজে মিথ্যাবাদী। কথা ও কাজে মিথ্যা ত্যাগ করে না। কিন্তু সে কোরআন তেলাওয়াত করছে। তার কোরআন তেলওয়াত আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করবেন না। মিথ্যাবাদীদের উপর আল্লাহর লানত বা অভিশাপ। আবার কোনো লোক নিজে অন্যের উপর অত্যাচারী। মানুষের উপর জুলুম করছে। হয়ত সেও কোরআন পড়ছে। তার কোরআন তেলওয়াতও আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করবেন না। অত্যাচারীদের উপর আল্লাহর লানত। এভাবে কোরআন তেলাওয়াতকারী নিজেই নিজের ধ্বংসের জন্য আল্লাহর কাছে কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ধ্বংস প্রার্থনা করে। তাই কোরআন তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি।
মুমিন মুসলমানের উচিত, রমজানে মসজিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়া, কোরআন তেলাওয়াত শেখা, নাজাত পাওয়া এবং কোরআনের লানত থেকে নিজেদের মুক্ত রাখা। নিজেদের মিথ্যা ও অত্যাচার থেকে মুক্ত থাকাও জরুরি। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজায় মসজিদমুখী হওয়ার অভ্যাস গঠন করার তাওফিক দান করুন। বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াত শেখার সুযোগ দান করুন। কোরআনের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকতে বদগুণগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দান করুন। রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মন্তব্য করুন
রমজান বছরের শ্রেষ্ঠ মাস। মুসলিম উম্মাহর প্রতি আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও অনুকম্পার মাস
এই রমজান। তাই এই রমজান মাসে
প্রতিটি মুসলিম উম্মাহর অত্যধিক নেক আমল ও জিকির-আজকার
করা উচিত। এবারের রমজান মাসে বিশ্বের ১০০ কোটিরও বেশি মুসলিম রোজা রাখবেন।
ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাস প্রায় ১০ দিন করে
এগিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশে তীব্র গরমে রোজা শুরু হয় এবং শেষ
দিকে অনেকটা শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সাধারণত, গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড় হয় এবং
শীতকালের দিকে যত এগোয়, দিনের
ব্যপ্তি তত কমতে থাকে।
যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোজার বিধান মোতাবেক সেহেরি থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার যে রীতি তা সময়ানুপাতে কম
বা বেশি হয়ে থাকে।
যে দেশগুলোতে সবচেয়ে
কম সময় রোজা
এবারের রমজানে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলিতে রোজা রাখার সময় হবে সবচেয়ে কম। চিলির মুসলিমরা গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ১১ ঘণ্টা রোজা
রাখবেন অর্থাৎ পানাহার থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া বিশ্ব মানচিত্রের দক্ষিণের দেশগুলো, যেমন- নিউজিল্যান্ড,
আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকাতেও
রোজার সময় কম। দেশগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ১১ থেকে ১২
ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে।
যেসব দেশে রোজার সময় সবচেয়ে দীর্ঘ
নরডিক দেশ আইসল্যান্ডে এবার সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রোজা থাকবেন রোজাদাররা। দেশটিতে গড়ে প্রায় ১৬ ঘণ্টা ৫০
মিনিট রোজা রাখতে হবে তাদের। তিউনিসিয়ার মুসলিমরা রোজা রাখবেন প্রায় ১৫ ঘণ্টা। এছাড়া
মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ১৩ থেকে ১৪
ঘণ্টা রোজা রাখতে হবে।
যেসব দেশে রাতই হয় না, তারা
কীভাবে রোজা রাখেন?
পৃথিবীর কিছু দেশের দিন ২০ ঘণ্টারও বেশি
সময় হয়ে থাকে। তবে ২০ ঘণ্টারও বেশি
সময় ধরে তো রোজা রাখা
সম্ভব না। তাহলে এক্ষেত্রে কী করেন তারা? ফতোয়ার
মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যেসব দেশে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের ব্যবধান ৩ ঘণ্টার চেয়ে
কম, তারা অন্য কোনও শহরের ইফতার ও সেহেরির সময়
অনুসরণ করতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মক্কা শহরের সময়সূচী অনুসরণ করে রোজা পালন করে থাকেন। এমন দেশের একটি হলো গ্রিনল্যান্ড। এখানকার মুসলিমরা সৌদি আরবের মক্কার সময় অনুসরণ করে সেহেরি ও ইফতার করেন।
রোজার সময়ের কিছু ব্যতিক্রম
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবস্থা আরও অদ্ভুত হয়ে থাকে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মহাকাশচারী সুলতান আল নেয়াদি রমজান
মাসে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে থাকবেন। এমতাবস্থায় তারা ২৪ ঘণ্টায় প্রায়
১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখতে
পাবেন। এ বিষয়ে আল
নেয়াদি বলেন, ‘আমাকে পরিব্রাজক হিসেবে গণ্য করা হবে। রোজা রাখা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়।’
বাধ্যতামূলক না হলেও মক্কার
সময় অনুসরণ করে কয়েকটি রোজা রাখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সাধারণত, আইসল্যান্ড এবং গ্রীনল্যান্ডের মুসলমানরা প্রায় ২১ ঘন্টা রোজা রাখেন। নরওয়েতে ১৯ ঘন্টা এবং ব্রিটেনে ১৮ ঘন্টা রোজার সময়। কানাডার মুসলিমরা প্রায় ১৭ ঘন্টা পানাহার থেকে বিরত থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে এবং পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলে রোজার সময় ১১ ঘন্টা ৩৫ মিনিট।
এছাড়াও, ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়াতে রোজার সময় ১২ ঘন্টা থেকে ১৩ ঘন্টা। জিম্বাবুয়ের হারারেতে ১২ থেকে ১৩ ঘন্টা। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ এবং কেপ টাউন-এ ১১ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ার্স-এ ১২ ঘন্টা রোজার সময়। নিউজিল্যাণ্ডের ক্রাইস্টচার্চ- এ ১২ ঘন্টা, প্যারাগুয়ে এবং উরুগুয়েতে ১১ ঘন্টা থেকে ১২ ঘন্টা রোজার সময়।
(সূত্র: ট্র্যাভেল ব্লগ ওয়েগো, আল আরাবিয়া নিউজ, দ্য ন্যাশনাল)।
রোজা রমজান বিশ্ব রোজার সময় কম বেশি
মন্তব্য করুন
প্রিয়নবী (সা.) আরো বলেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, অশ্লীল কর্মকাণ্ড ও জাহেলি আচরণ পরিত্যাগ করতে পারে না, তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই। (সহীহ বুখারী) বিনা ওজরে রমজানের রোজা ভঙ্গ করা কবিরাহ গুনাহ এবং এর পরিণতি জাহান্নাম। রমজানুল মোবারকের একটি রোজা ভঙ্গ করে তার বিনিময়ে সারাজীবন রোজা রাখলেও ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি অসুস্থতা ও সফর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে রমজানের একটি রোজা ভঙ্গ করে, সে আজীবন রোজা রাখলেও ঐ রোজার ক্ষতিপূরণ আদায় হবে না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, সহীহ বুখারী)
মদের দেশে পবিত্র রমজানের রোজাকে সামনে রেখে আলোচনা সভা ও ইফতার একসঙ্গে করার হিড়িক পড়ে যায়। অনেক রাজনৈতিক দলকে ইফতার পার্টির নামে সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায়। একবেলা খাবারের লোভে অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষ এসব ইফতার পার্টিতে ভিড় জামান। এরকম কোনো কোনো আয়োজনে দীর্ঘ সময়ব্যাপী নানা ধরনের পার্থিব বিষয় নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক, এমনকি গালাগালি, বিষোদগার, ঝগড়াঝাটি করতেও দেখা যায়। পরে এসব শেষে ইফতার করা হয়। অনেক সময় হাস্যকর বিষয়েও ইফতারে হট্টগোল বাঁধতে দেখা যায়। এতে ইফতারের মতো একটি মহান ধর্মীয় বিষয়ের মাহাত্ম্য, সৌন্দর্য ও স্বর্গীয় আমেজ-অনুভূতি নষ্ট হয়ে পড়ে।
রোজার প্রধান শিক্ষা তাকওয়া অবলম্বন করা। তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা ও ভয় করা। পরিভাষায়- মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অনাচার ও পাপাচার হতে বিরত থাকাকে তাকওয়া বলে। আর দীর্ঘ এক মাস প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বান্দাকে তাকওয়া অবলম্বন করার যোগ্যতা তৈরি করেন মহান আল্লাহ তায়ালা। সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সুরা বাকারা: আয়াত- ১৮৩)
ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাস প্রায় ১০ দিন করে এগিয়ে আসে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি অংশে তীব্র গরমে রোজা শুরু হয় এবং শেষ দিকে অনেকটা শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে। সাধারণত, গ্রীষ্মকালে দিন অনেক বড় হয় এবং শীতকালের দিকে যত এগোয়, দিনের ব্যপ্তি তত কমতে থাকে। যে কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রোজার বিধান মোতাবেক সেহেরি থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার যে রীতি তা সময়ানুপাতে কম বা বেশি হয়ে থাকে।