লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পোদ্দার বাজারের হাঁস মুরগী ব্যবসায়ী জহির। তিনি জানান, নভেম্বর মাসের ২য় সপ্তাহ থেকে প্রতি হাটের দিন প্রায় ৫শ হাঁস ক্রয় বিক্রয় হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে শীত মৌসুমে বাজারে প্রায় ১০ হাজার হাঁস বিক্রি হবে বলে তার ধারণা। যেগুলোর বাজার মূল্য দাঁড়াবে কমপক্ষে ৪০ লাখ টাকা। এদিন বাজারে প্রতি জোড়া হাঁস ৮শ থেকে ১৮শ টাকা বিক্রি হচ্ছিল।
বাজার ইজারাদাররা দাবি করে বলেন, মৌসুমে জেলার বাজারগুলোতে প্রায় ২০ কোটি টাকার হাঁস ক্রয় বিক্রয় হয়।
স্থানীয় ভাবে জানা যায়, জেলা জুড়ে হাঁসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও মূলত হাঁস উৎপাদন হয় জেলার উপকূলীয় রামগতি, কমলনগর এবং রায়পুর উপজেলায়। এসকল উপজেলার চরাঞ্চলের প্রতি বাড়িতে গৃহিণীরা হাঁস পালন করে শীতে বিক্রি করে থাকে। বাজারে পুরুষ হাঁস একজোড়া ১৬শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। অন্যদিকে খামারের হাঁস প্রতি জোড়া ৮শ থেকে ১২শ দামে বিক্রি হয়। বাজারে পুরুষ হাঁসের চাহিদা বেশি থাকে।
জেলা পশু সম্পদ কার্যালয় থেকে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের ২শ থেকে ৩ হাজার হাঁস পালন করে এমন খামার রয়েছে ১৭০টি। এছাড়া প্রায় বাড়িতে নারীরা হাঁস পালন করে থাকে।
হাঁসের চাহিদা ও বাজার নিয়ে কথা হয়, উপকূলীয় কমলনগর উপজেলার ফজু মিয়ার হাট এলাকার বাসিন্দা সফি উল্ল্যাহ সাথে। তিনি জানান, ওই বাজারে মৌসুম জুড়ে প্রায় ২০ হাজার হাঁস বিক্রি হয়। যেগুলোর বাজার মূল্য কমপক্ষে ৮০ লাখ টাকা। শীত মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে হাঁস ক্রয় বিক্রয়ের চিত্র এখন এমনই।
প্রতিদিন স্থানীয় বিভিন্ন হাটবাজারে হাঁসের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ছে। ব্যবসায়ী, খামারি এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে শীত মৌসুমে হাঁস খাওয়ার নানা আয়োজন চলে। ঐতিহ্যগতভাবে লক্ষ্মীপুরের মানুষ শীতে হাঁসের মাংস খায়। অন্যদিকে মাংসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে এ জেলায় শীত মৌসুমের ২-৩ মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার হাঁস ক্রয় বিক্রয় হয়। হাঁসের ব্যাপক চাহিদার কারণে, পাশের জেলা চাঁদপুর এবং নোয়াখালী থেকেও খামারের হাঁস লক্ষ্মীপুর নিয়ে এসে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। তীব্র শীতে হাঁসের মাংস খাওয়া লক্ষ্মীপুরের একটি ব্যতিক্রমী ও ঐতিহ্যবাহী ভোজন বিলাসী আয়োজন।
সদর উপজেলার চররুহিতা এলাকার কামরুল হোসেন জানান, এ জেলার বয়স্ক ব্যক্তিরা আগেকার দিনে শীতে হাঁসের মাংস খেতো। কিন্তু গত প্রায় দশ বছর যাবত এমন রীতি ছড়িয়ে পড়েছে তরুণ ও যুবকদের মাঝে। বর্তমানে এটা অনেকটা উৎসবের মতো হয়ে গেছে। শীত বাড়ার সাথে সাথে লক্ষ্মীপুরের গ্রামগঞ্জ আর শহরে ধূমপড়ে হাঁসপার্টির। হাঁসপার্টি ছাড়াও বিভিন্ন পরিবারে হাঁসের মাংস খাওয়ার আয়োজন হয়।
স্থানীয়রা আরো জানায়, হাঁসপার্টির সবগুলো আয়োজনই হয় রাতে। শীত বাড়ার সাথে সাথে হাঁসপার্টির আয়োজনও তত বাড়তে থাকে।
কিভাবে হাঁসপার্টি তরুণদের নিকট উৎসবের মতো হয়ে গেল, এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথা হয়। রাজা (৫৮) নামের এক ব্যক্তি জানান, তিনি দেখেছেন তার বাবা এবং তার গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা অতীতে শীতের ঠাণ্ডা ও বাত রোগ থেকে সুরক্ষা পেতে বিশেষ প্রক্রিয়া ও মসলা ব্যবহার করে হাঁস রান্না করে খেতো।
তবে শীতের জন্য তারা পুরুষ (আঁড়িয়া) বা হাঁসা হাঁস খেতো। অনেকে দেহের পুরুষালী শক্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যেও শীতে একটা হাঁস একবেলায় খেতো। মজার বিষয় হচ্ছে কোন মহিলারা কিন্তু এ রকম হাঁস খেতো না বলেও জানান তিনি।
আবদুস সহিদ আরো জানান, আগেকার দিনের বৃদ্ধ মানুষের হাঁস খাওয়ার রীতি বর্তমানে যুবকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে গেছে। কিন্তু যুবকরা সেই মসলা ব্যবহার, রান্না পদ্ধতি এবং একজনে একটা হাঁস খেতে পারে না। শীত মৌসুমে দল ভিত্তিক হাঁস খাওয়া এখন জেলাব্যাপী একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। লক্ষ্মীপুর ছেড়ে এ রীতি ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের জেলাতেও।
শীতকালে লক্ষ্মীপুর জেলার সবখানের সামাজিক অনুষ্ঠানে হাঁসের গোশত থাকবেই। ইদানীং জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রতি শীতে হাঁসপার্টির আয়োজন করে। এসময় জেলার জামাইদের জন্যও শ্বশুর শ্বাশুড়ীরা হাঁসপার্টির আয়োজন করতেও ভুল করে না।
এখন হাঁসপার্টির সাথে রাজনীতি এবং ওয়াজ মাহফিলও যোগ হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জুনিয়র নেতারা বিভিন্ন পদ-পদবী ও তদবিরের জন্য সিনিয়র নেতাদের সৌজন্যে হাঁসপার্টির আয়োজন করে থাকে। মাহফিলে আসা মেহমানদের জন্য আয়োজকরা অন্যান্য খাবারের সাথে হাঁসের মাংসও রাখছেন।
লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজের ছাত্র শাহ আলম জানান, লক্ষ্মীপুর জেলার এমন কোন তরুণ খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি এ শীতে কোন একটি হাঁস পার্টিতে অংশগ্রহণ করেনি বা করবে না। কমপক্ষে একটি আয়োজনে অংশগ্রহণ করে এখানকার প্রত্যেক তরুণ।
অন্যদিকে শীতের হাঁসের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শীতের হাঁসের মাংস রান্নার সময় অন্যান্য মসলার সাথে হোরা বা একাঙ্গী, জায়ফল, জয়ত্রী এবং গোল মরিচ নামক চারটি বিশেষ মসলা ব্যবহার করে রান্না করা হয় এ মাংস। পরে খাওয়া হয় আটার রুটি বা পরোটা দিয়ে।
কমলনগর উপজেলার চর পাগলা গ্রামের যুবক মাসুদ আলম জানান, তিনি একটি হাঁসের খামার দিয়েছিলেন ডিম উৎপাদনের জন্য। কিন্তু গত বছর ডিমের ১২শ হাঁস যুবকদের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন খাওয়ার জন্য। গত বছর হাঁস বিক্রি থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা আয় করে ওই যুবক।
কমলনগর উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান জানান, লক্ষ্মীপুর জেলায় বহু হাটবাজার থাকলেও হাঁস ক্রয় বিক্রয় হয় জেলায় এমন বাজার রয়েছে প্রায় ৫০টি । ওই সকল বাজারে হাটের দিন গড়ে প্রায় ৩শ-৪শ হাঁস বিক্রি হয়। শীত এলেই হাঁসের মাংসের ব্যাপক চাহিদার কারণে দিন দিন প্রায় প্রতি বাড়িতে হাঁস পালন বৃদ্ধির সাথে সাথে খামারি সংখ্যাও বাড়ছে। এতে করে কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী এ রীতি এখন উৎসবমুখর হয়ে গেছে। এতে করে হাঁসপালন, ক্রয় বিক্রয় এবং উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।