তখন জিওগ্রাফিতে অনার্সে পড়ি, মনমনসিংহে অবস্থিত আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র। ময়মনসিংহের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বেশ জানা-শোনা, যাওয়া-আসা। আবৃত্তি নিকেতন কিংবা শব্দ ও আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রে নিয়মিত অনুশীলন করি। টুকটাক দু’চারটা কবিতা লিখেই বন্ধু-পরিজন মহলে কবি হিসেবে সম্বোধন পেতে শুরু করি। ভালোই লাগে, উৎসাহ পাই, আরও লিখি। দু’চারটা গানও করি নিজের লেখা, জাতীয় পর্যায়ে প্রকাশিত বা প্রচারিতও হয়। অনুপ্রেরণার উৎসগুলো দিন দিন প্রসার ও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। কেউ কেউ আবার বলে, কবি দুই লাইন কবিতা লিখে জীবনটা নষ্ট করে দে.... একজন আরেকজনকে নিয়ে লিখতে বলে। বন্ধুদের কেউ কেউ আবার কবিতা লেখা ডায়েরির পাতা সমানভাবে স্টিলের স্কেল দিয়ে কেটে চুরি করে নিয়ে যায়, প্রেমিকাকে উপহার দেয়- বলে, তার নিজের লেখা কবিতা তাকে (বন্ধুর প্রেমিকা) নিয়ে, তাদের প্রেম আরও ঘনিষ্ঠ হয়। ভালোই লাগে, মনে মনে আনন্দ পাই।
এরই মধ্যে বাজারে এলো নতুন কবিতার বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। লাল-কালো মলাটের বইটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কবিতাপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আমিও তার ব্যতিক্রম ছিলাম না। কবি হেলাল হাফিজের লেখা ‘অশ্লীল সভ্যতা’ শিরোনামের কবিতার দুইটি লাইন- ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না!’। প্রশ্ন ওঠেছিল আসলে কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল কবিতাটি বা কাদের উদ্দেশ্য করে এই প্রশ্ন কবি হেলার হাফিজের। পরে কোনো এক বিজ্ঞ কবি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, কোনো এক নারী বা কবি তার প্রেমিকা- কোনো এক নারীকে উদ্দেশ্য করে কবিতাটি লিখেছিলেন। বাস্তবিক অর্থে ঘটনাটি সত্য না হলেও কবির কবিতার যে শিরোনাম ‘অশ্লীল সভ্যতা’, সে অশ্লীল সভ্যতার যুগে আমরা পা রেখেছি। কেননা নিছকই একটি ক্ষুদ্র ঘটনা নিয়ে খুদ জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩টি দেশের রাষ্ট্রদূত বিবৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনে একটু আধটু মারামারি, দৌড়ঝাপ- এটি যুগ যুগ ধরেই দেখে আসছি আমরা। শুধু বাংলাদেশে নয়, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই এ ধরনের ঘটনা চোখে পড়ে অহরহ। নির্বাচনের মৌসুমে পত্রিকার পাতা খুললেই এ ধরনের অনেক খবর দেখা যায়। পাল্টাপাল্টি দলগুলোর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারামারি। আসলে ক্ষমতায় কে না থাকতে চায়? খুদ আমেরিকাও চায় বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে অন্যের উপর মাতব্বরি ফলাতে। আর জাতিসংঘ, সেওতো ওই আমেরিকারই তলপিবাহক। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ কৌতুহল। যে কারণেই নানা ধরনের বিবৃতি, নানা ধরনের তৎপরতা, ভিসা নীতি, স্যাংশন আরও কি যে হতে পারে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই কিংবা ক্ষমতা দখলের লড়াই।
বলছিলাম কবি হেলাল হাফিজের ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতার দুটি লাইন ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না!’। ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের প্রাক্কালে সাততলা বস্তিতে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে স্থানীয় নারীদের প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। সাততলা বস্তির নারীরা বলতে থাকেন, ‘তুই টিকটকার, তুই টিকটক করবি, তুই ক্যান নির্বাচন করবি?’ আসলে সাততলা বস্তির নারীরাও বুঝে গিয়েছিলেন, কার কি যোগ্যতা, কার কোথায় থাকা উচিৎ। কবি হেলাল হাফিজের ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতার দুটি লাইন ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না!’- বিজ্ঞ বয়জেষ্ঠ্য কবির বিশ্লেষণ মোতাবেক যদি নারীদের উদ্দেশ্য করে লেখা হয়ে থাকে, তবে ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত সাততলা বস্তির নারীদের ক্ষেত্রে কবি হেলাল হাফিজের সে উক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বলেই আমি মনে করি। কেননা সাততলা বস্তির নারীরা মানুষ বুঝেছিলেন। বস্তুত সাততলা বস্তির নারীরা অধিকাংশই অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত পোশাক শ্রমিক। অথচ তারা ঠিকই বুঝেছিলেন টিকটকার বা ইউটিউবার আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের অবস্থা এবং অবস্থান। কিন্তু অতি উচ্চ শিক্ষিত কূটনীতিক রাষ্ট্রদূতরা বুঝলেন না, বুঝলেন না জাতিসংঘের বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইস। হিরো আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত মঙ্গলবার এক টুইটে নিন্দা জানান গোয়েন লুইস। তিনি লিখেছেন, ‘সহিংসতামুক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ সবার মৌলিক অধিকার এবং সেটিকে রক্ষা করা উচিত।’
জাতিসংঘের প্রতিনিধি বা রাষ্ট্রদূতরা দলবেধে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিশ্বের অতি উচ্চশিক্ষিত কূটনীতিক মানুষদের, তাহলে কি বোঝার ভুল ছিল? নাকি অন্য কোনো মতলব? অতি উচ্চ শিক্ষিত মানুষরা কি মতলববাজ হয়? নাকি তারা হিরো আলমের অবস্থা এবং অবস্থান বুঝতে অক্ষম? বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে আজ এসব প্রশ্ন দানা বেধে উঠেছে। জনসাধারণ জানতে চায়, একজন টিকটকারকে নিয়ে রাষ্ট্রদূতদের বিবৃতি কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি বা জাতিসংঘের বিবৃতি কেন? তবে কি তারা অতি উচ্চশিক্ষিত কূটনীতিক ব্যক্তি হয়েও হিরো আলমের অবস্থা, অবস্থান বুঝতে অক্ষম? তাই হেলাল হাফিজের সেই ‘অশ্লীল সভ্যতা’ শিরোনামের কবিতাটি আজ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না!’
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ জুলাই (সোমবার)। নির্বাচন দিবসের শেষ বিকেলে কয়েকজন যুবক হিরো আলমকে ধাওয়া দেয়, মারধর করে। ধাওয়ার আগে, তারাও বলে একই কথা, ‘তুই টিকটকার, তুই টিকটক করবি, তুই ক্যান পার্লামেন্টে যাবি?’ সেদিন হিরো আলমের উদ্দেশ্যে উত্তেজিত যুবকদের আরও বলতে শোনা যায়, ‘সে করে টিকটক, সে হলো জোকার, সে কেন গুলশান-বনানীর এমপি হতে চায়? এমপির মানে সে জানে?’ কেউ কেউ আবার বলছিলেন, ‘তারে খালি দৌড়ানি দে, মারধর করা লাগব না।’
তবে হিরো আলমকে মারা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ- সবাই গরম। কিন্তু হিরো আলমকে মারলো কারা? এবং কেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে, সাততলা বস্তিতে হিরো আলমকে যারা প্রতিরোধ করেছে তারা স্থানীয় কাউন্সিলর কালা নাসিরের অনুসারী। এক সময়ে বিএনপি নেতা কালা নাসির এখন আওয়ামী লীগের তাবেদার। আর বনানীতে হিরো আলমকে যারা মেরেছে তাদের একজন মহানগর যুবদলের নেতা। হিরো আলমের ওপর আওয়ামী লীগ-বিএনপির আক্রোশের কারণ কী? এর জবাব আক্রমণকারীরা দিয়েছে- ‘তুই টিকটকার, তুই টিকটক করবি। তুই কেন নির্বাচনে যাবি?’
নির্বাচনে যাওয়াটাই হিরো আলমের কাল হয়েছে। হিরো আলম এবং বিএনপি বার বার নির্বাচনের বিরোধিতা করছে। আবার এই সরকারের আমলেই হিরো আলম ৬ বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। হিরো আলম নিজেই বলেছে, ‘নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে শুধু বার বার মারই খাচ্ছি। এই সরকারের আধীনে আর নির্বাচন করবো না।’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হিরো আলমের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটা কি সরকারকে বিব্রত, বিতর্কিত করার জন্যই নয়?
নির্বাচন দিবসের বিকেলে কয়েকজন যুবক হিরো আলমকে মারধর করেছেন, ধাওয়া দিয়েছেন- যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা নিয়ে সে সময়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেন। চায়ের দোকান থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন, সবখানেই আলোচনায় ওঠে এসেছে হিরো আলমকে মারধরের ঘটনা। কেউ হিরো আলমের প্রতি দয়া দেখিয়ে বলেছেন, এই কাজটি করা আওয়ামী লীগের লোকদের ঠিক হয়নি। আবার কেউ বলেছেন, বগুড়াতে নির্বাচন করাটাই হিরো আলমের জন্য ভালো ছিল, গুলশানে নির্বাচনে আসাটা তার ঠিক হয়নি। কিন্তু এ ঘটনায় যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হচ্ছে- হিরো আলমকে মারলো কারা? এই প্রশ্নের উত্তরও ইতিমধ্যে জানা গেছে। জানা গেছে, বনানীতে হিরো আলমকে যারা মেরেছে তাদের একজন মহানগর যুবদলের নেতা। কিন্তু বিএনপির লোকেরা হিরো আলমকে মারবে কেন?
হিরো আলমের সাথে বিএনপির পুরনো বিরোধ। ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে মির্জা ফখরুলের সাথে একই আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন হিরো আলম। সেই নির্বাচনে মির্জা ফখরুলের সমর্থকরা হিরো আলমকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল। কিন্তু তখন জাতিসংঘ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রদূতদের কোনো ধরনের বিবৃতি দিতে দেখা যায়নি। আবার আওয়ামী লীগও চায় না হিরো আলম নির্বাচনে যাক। হিরো আলম নির্বাচনে গেলে আওয়ামী লীগে রুচির দুর্ভিক্ষ লেগে যায়। সামান্য এক কৌতুক অভিনেতা বার বার আওয়ামী লীগ-বিএনপির আতে ঘাঁ দিচ্ছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় সহজ টার্গেট হিরো আলমের ওপর আক্রমণ। কিন্তু যে বিষয়টি প্রকাশ্যে এসেছে- তা হচ্ছে হিরো আলমের উপর আক্রমণ করার ঘটনাটির সাথে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী জড়িত নয়, তবে সেখানে গোপালগঞ্জের বেশ কয়েকজন লোক হামলার সাথে জড়িত বলে গণমাধ্যম সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।
হিরো আলম একজন কৌতুক অভিনেতা, সে কেন নির্বাচন করবে? তাঁর কৌতুকও আবার ‘মার্জিত রুচি’র বা বাইবেলধোয়া কিংবা সমাজ সচেতন নয়। উপরন্তু অনেক কৌতুক নারীবিদ্বেষী। এই রুচি নিয়ে কেন তাঁর নির্বাচন করার খায়েশ? ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি একজন কৌতুক অভিনেতা। তাঁর সব কৌতুক কি মার্জিত রুচির? একটু অন্তর্জালে ঢুঁ মারলেই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। এরপরও কি এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদ জেলেনস্কি নন? আমাদের এই উপমহাদেশে কৌতুক অভিনেতারা কেউ নির্বাচন করেননি? ভারতের লোকসভা বা বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৌতুক অভিনেতাদের নির্বাচন করার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। সর্বশেষ ঢাকা-১৭ আসনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক, যিনি একজন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে বিখ্যাত। তাহলে?
হিরো আলমের পেশা কৌতুক অভিনয় হলেও সে কিন্তু অভিনেতা পরিচয়ে রাজনীতিতে আসেনি। ২০১৬ সালে আলোচিত হওয়ার আগেই দুইবার স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে হিরো আলম। এর মধ্যে একবার মাত্র ৭০ ভোটে পরাজিত হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বগুড়া-৪ আসনে মাত্র ৮৩৪ ভোটে হেরে যায় হিরো আলম। অর্থাৎ অভিনয়ে পরিচিতি পাওয়ার অনেক আগে থেকেই রাজনীতির অঙ্গনে তাঁর এক ধরনের জনপ্রিয়তা ছিল। অভিনয়ের ব্যাপ্তি তাঁর জনপ্রিয়তার মাত্রাকে বাড়িয়েছে। একই সাথে যারা তাকে পছন্দ করেন না, তাদের মধ্যে সমালোচনাও বেড়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিনেও সাততলা বস্তিতে যান হিরো আলম। সেখানে তিনি বলেন, ‘হিরো আলম সব সময় গরীবের পক্ষে। গরীবের ভোটে আমি গরীবের নেতা হতে চাই।’ কিন্তু সাততলা বস্তির লোকেরা কি তাকে ভোট দিয়েছিলেন? ভোটের রাজনীতিতে হিরো আলম পরাস্ত। তবে কি কবি হেলাল হাফিজের কবিতা- ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না!’- এখানেও মিথ্যা প্রমাণিত যে, সাততলা বস্তির মানুষেরা মানুষ বুঝেছিল?
নির্বাচনী রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে গত ১৪ বছরে ৬ বার নির্বাচন করেছে হিরো আলম। ঘটনার পরিক্রমায় মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সে অংশ নেবে। কে জানে- নির্বাচিত হয়ে সংসদেও বসতে পারে হিরো আলম!