ইনসাইড থট

আজ কালের আমাদের গর্বের বাংলাদেশ

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ০৪ মার্চ, ২০২২


Thumbnail আজ কালের আমাদের গর্বের বাংলাদেশ

১৯৭২ সাল, আমি তখন ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমি এক জায়গায় বসে বা দাডিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ শান্তভাবে লোকেদের পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসি- তারা কি কাপড় বা কি রংয়ের কাপড় পরিধান করে, চলার পথে বা চলার সময় তারা কী করছে, তাদের অভিব্যক্তি কী এবং কীভাবে তারা একে অপরের সাথে এবং পার্শ্ববর্তী পরিবেশে প্রতিক্রিয়া করছে তা নিরবে উপলব্ধ করি। ঢাকায় পড়ার সময়, কলেজের সময় শেষে লোকে ভর্তি বাসে করে পুরান ঢাকা বিমানবন্দরে যেতাম। এয়ারপোর্টের দর্শকদের বারান্দা থেকে আমি দেখতাম প্লেনে নামা ও উঠা লোকজনকে। কাজের জন্য আমাকে প্রতি নিয়ত আমেরিকায় যেত হত। অনেক সময়, আমি নিউইয়র্ক সিটির ৫তম অ্যাভিনিউর রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে লোকদের চলাচল দেখতাম - সেখানে সারা বিশ্বের সমস্ত ধরণের লোকের চলাচলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ১৯৭২ সালের সময় বাংলাদেশের বেশিরভাগ ফকার ফ্রেন্ডশিপ-৫০ প্লেন ছিল এবং খুব কম আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স ঢাকায় আসতো। তখন রাস্তায় দেখা যেত অর্ধ উলঙ্গ শিশু, কারও স্যান্ডেল জুতা পরা যেন একটা বিরাট বিলাসতা ছিল। লাখো মানুষের বলিদান দিয়েই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সব হারানো বাংলাদেশে তখন আনেক গরিব মানুষ ছিল, জাতির পিতা সব ধ্বংসযজ্ঞ কাটিয়ে উঠতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছিলেন। পশ্চিমা দেশ গুলো আমাদের বলতো একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ। বাংলাদেশকে এমন দেশ হিসেবে দেখা হতো যেখানে মানুষ ক্ষুধার্ত, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যায় মারা যায়।

১৯৭৩ সালে শুরু হয় আমার মেডিকেলের ছাত্রজীবন। ১৯৭৫ সালে সম্পূর্ণ আতঙ্ক এবং দুঃখের সাথে আমরা শুনলাম আমাদের জাতির পিতা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। নীরবে চোখের জল ফেলছি, আমরা কিছুই করতে পারিনি। তারপর প্রহসনমূলক তথাকথিত হ্যাঁ না ভোট দিয়ে খুনি জিয়া ক্ষমতা দখল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কলুষিত করতে শুরু করে, রাজাকার ও শান্তিবাহিনীর খুনিদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। বাংলাদেশ বেতার আবারও বাংলাদেশ রেডিও হয়ে গেল। ১৯৭৯ সালে আমি ডাক্তার হলাম, এক বৎসর ইন্টারনশীপ শেষে একটি প্রত্যন্ত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আমার পোস্টিং হল। আমি বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সেখানের দুর্নীতির গল্প আগেই বলেছি। সেখানে এক বৎসর কাজের পর আমার কাছে দুটি বিকল্প ছিল - হয় দুর্নীতির অংশ হওয়া অথবা দেশ ছেড়ে যাওয়া। আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করি। জিয়া, কালো রে ব্যান সানগ্লাস এবং একটি লাঠি হাতে লোক দেখানো খাল খনন করতে দেশে ভ্রমণ করতেন - খাল খনন ছাড়া (আমি দেখেছি যা এখন পরিত্যক্ত এবং অকেজো), বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য তিনি আর কী করেছেন? এরপর এলেন আরেক স্বৈরাচারী এরশাদ ও তারপর বেগম জিয়া, সেনানিবাসে তৈরি দুই দল। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও পাকিস্তান প্রেমিকদের ক্ষমতায়ন ছাড়া তাদের শাসন আমলে বাংলাদেশের জন মানুষের জীবন-জীবিকার আর কী উন্নতি ঘটেছে? আরপর এলেন সাহশী দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা এবং দেখুন গত দশকে বাংলাদেশ কিভাবে সব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু চিত্তাকর্ষক এবং গর্ব করার মত কিছু।

দেশ ছেড়ে যাবার পরের সাল থেকে দেশে যা হচ্ছে বা ঘটছে তার সাথে যোগাযোগ রেখেছি। আমি বাংলাদেশে প্রতি দুই বছরে অন্তত একবার আর ২০১৭ সালে WHO থেকে অবসর নেওয়ার পর, আমি এবং আমার পরিবার বছরে অন্তত একবার বাংলাদেশ সফর করি। আমি যতবার সেখানে যাই, আমি ঢাকার বাইরে, গ্রামীণ জেলায় যাওয়ার চেষ্টা করি। কয়েক বছর আগে আমি আমাদের প্রিয় জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে টঙ্গীপাড়ায় গিয়েছিলাম (আমার ইচ্ছা, অনেক দেশের মতো, এই জায়গাটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হক এবং তাদের দ্বারা পরিচালনা করা যেতে পারে এবং তারা প্রতিদিন গার্ড পরিবর্তনের অনুষ্ঠান করতে পারে। অনেক দেশে তাই দেখেছি। ঢাকায় যেখানে বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, আমি সেখানেও গিয়েছিলাম। আশ্চর্য কেন এটি সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত হয় না এবং বছরে শুধু মাএ একদিনের সম্মানের স্থান হয়!!)। বাংলাদেশ প্রতিদিন যে অগ্রগতি করছে তা দেখে আমি বিস্মিত, আবেগপ্রবণ এবং গর্বিত হই। কোনো দেশ আর বলতে পারবে না বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ। আজ তাঁরাই বাংলাদেশেকে উন্নয়নের সমান অংশীদার হিসেবে সম্মান করে। বাংলাদেশের অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কের দিকে তাকিয়ে আছে এবং অবকাঠামো উন্নয়নে তাদের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করছে। ভূ-রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ অনেক শক্তিধর দেশের স্বার্থের দেশ হয়ে উঠছে।

কোন দেশের তার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং কিছু মৌলিক নীতি ও অবকাঠামো। উন্নত সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগ, টেলিফোন এবং ইন্টারনেট সংযোগ। আমার মনে আছে, স্বাধীনতার আগে আমি যখন ছোট, আমার বাবা যশোর জেলায় চাকরি করতেন। তখন নানা আর দাদার বাড়ীতে যাবার জন্য আমাদের চাঁদপুর এলাকায় যেতে হত। যশোর থেকে আমদের প্রথমে ট্রেনে গোয়ালন্দোতে গিয়ে স্টিমার (যাকে রকেট বলা হত) ধরতে হত। স্টিমার ঘাটে ফিরার সাথে সাথে একজন ভাড়া করা কুলি একটা বড় বিছানার চাদর নিয়ে ছুটত এবং উপরের ডেকে আমাদের জায়গা রিজার্ভ করত। চাঁদপুর পৌছাতে এটা ছিল সারা রাতের যাত্রা। চাঁদপুর আমাদের নানা বাড়ী। ফরিদগঞ্জ এলাকার কাউনিয়া গ্রামে আমার দাদার বাড়িতে যেতে হলে বর্ষাকালে নৌকায় যেতে হতো। আজ সেখানে যেতে কত সময় লাগবে? কয়েক বছর আগে, ঢাকা থেকে চাঁদপুরে লঞ্চে পৌছে পাকা রাস্তা ব্যবহার করে ভারা করা গাডীতে খুব কম সময়ে কাউনিয়া গ্রামে গিয়ে খুব অবাক ও খুশি হয়েছিলাম। চাঁদপুরকে চিনতে পারছিলাম না, সব কিছু বদলে গেছে, উন্নতির ছোয়া সব যায়গায়। মানুষ আজ সড়কপথে চাঁদপুর যেতে পারে এবং একই দিনে ঢাকায় ফিরে আসতে পারে। বাংলাদেশ একটি ব-দ্বীপ দেশ, সবখানে নদী, তাই একের পর এক নজরকাড়া সেতু তৈরি হচ্ছে, সড়ক পথে বরিশাল যাওয়া ছিল স্বপ্ন, আজ তা সম্ভব। পদ্মা সেতু হলে যাতায়াত আরও সহজ হবে। বিশ্বব্যাংকের হুমকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তা করছে বাংলাদেশ। কুরনোফুলী টানেল আমরা ভাবতেই পারিনি, আজ তা প্রায় শেষের দিকে। মেট্রো রেল এবং ভূগর্ভস্থ রেল এবং হাইওয়ে সিস্টেম যেন কিছুই আজ অসম্ভব না। ঢাকার তৃতীয় বিমানবন্দর টার্মিনাল, চট্টগ্রাম, সিলেট আর নতুন কক্সবাজার বিমানবন্দরের উন্নতির পাশাপাশি বাংলাদেশ বিমান চলাচলেও উন্নতি করছে। অভ্যন্তরীণ বিমান পরিষেবা এবং এর ব্যবহার বাড়ছে, যা অনেকেরই ধারণা ছিল না। আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে আধুনিক বিমান রয়েছে। রেল পরিষেবারও উন্নতি হচ্ছে। বৈদ্যুতিক মেট্রো রেলের পর বাংলাদেশ হাই স্পিড রেলওয়ে ব্যবস্থার পরিকল্পনা করছে। আগে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দরের ওপর নির্ভর করতে হতো। সেসব সক্ষমতা বাড়ানোর সাথে সাথে নতুন সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে। দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আজ সহজেই সড়ক বা রেলপথে চট্টগ্রাম বা মংলা সমুদ্রবন্দরে পণ্য সহজেই আনা যায়। বাংলাদেশের আজ নিজস্ব স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। দেশ এখন 5G সিস্টেম শুরু করছে। ব্রডব্যান্ড সুবিধা সর্বত্র আছে। বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হচ্ছে।

আরও উন্নয়নের জন্য আজ একটি দেশে টেলিফোন, মোবাইল এবং ওয়েব ভিত্তিক ইন্টারনেট সংযোগ প্রয়োজন। বাংলাদেশের কোনায় কোনায় মোবাইল নেট কাজের অনুপ্রবেশ এবং ব্যবহার চিত্তাকর্ষক। আজ প্রত্যন্ত গ্রামের একজন কৃষক তাদের মোবাইলের মাধ্যমে আবহাওয়া সম্পর্কে তথ্য পেতে পারেন। কৃষকরা শহরগুলিতে তাদের পণ্যের দাম খুঁজে পেতে পারে এবং মধ্যম ব্যক্তির দ্বারা প্রতারণা বন্ধ করতে পারে। কয়েক বৎসর আগে যশোর জেলার একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, পাকা রাস্তা, কোন ভাঙ্গা ঘর নেই, প্রায় সবাই তাদের টিনের শেডের ঘরকে কংক্রিটের ঘরে প্রতিস্থাপন করছে। মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ, টিভি, ফ্রিজ আছে। মানুষ খুশি এবং সন্তুষ্ট। বিদ্যুৎ পরিকাঠামো উন্নতির আরেকটি মাপকাঠী। আমার এখনো মনে আছে বিএনপি ও এরশাদের সময়ে বাংলাদেশে যাওয়ার কথা, দীর্ঘ সময়ের লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। আজকে আমরা লোডশেডিং দেখি না। বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের দেশ। শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা এবং চাকরির সম্ভাবনা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সময়ে শুধু বড় শহরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আমাদের মাত্র কয়েকটি সরকারি মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছিল। আজ অনেক বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মেয়েদের ভর্তি ও লেখাপড়া বেড়েছে এবং তারা ছেলেদের তুলনায় ভালো করছে। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক তরুণ চাকরির বাজারে আসছে। গার্মেন্টস এবং অন্যান্য শিল্প সুবিধা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, মেগাপ্রজেক্ট এর মধ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন ভারী এবং ইলেকট্রনিক শিল্প আসছে, বাংলাদেশ অটোমোবাইল উত্পাদন করছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম আজকাল কৃষকরা তাদের ফসল কাটার জন্য শ্রমিকের অভাব বোধ করছে। আমার একজন ভাতিজি, যে ম্যানেজারিয়াল, উচ্চ বেতনের চাকরিতে করতো, কিছুদিন আগে সে সময় নিতে এবং তার ছেলের দেখাশোনা করার জন্য পদত্যাগ করেছে। সে আমাকে বলে, “চাচা দুই বছর পর সহজেই আরেকটি চাকরি পাবো”। আমরাদের সময় বাংলাদেশে তা কল্পনাও করা যেত না। উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা প্রতিটি সেক্টরে ভালো চাকরি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে যাচ্ছে। আমাদের ভাল ক্রয় ক্ষমতা সহ একটি ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছ। অনেক বাংলাদেশি যেমন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে অনেক বিদেশিও কাজের জন্য বাংলাদেশে আসছে।

বাড়ি ও সম্পত্তির বাজারও উন্নত হচ্ছে। অল্পবয়সী দম্পতিদের হয় আজকাল বাড়ি ভাড়া নেওয়ার এবং কেনার ক্ষমতা রয়েছে। একজন অত্যন্ত উচ্চ পুলিশ অফিসার হওয়া সত্তেও আমার বাবার অবসর নেওয়ার বহু বছর পরে ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধ করে আমরা আমাদের বাড়ীতে উঠতে পেরেছি। দুর্ভাগ্য আমার বাবা কখনো তার নিজের বাড়িতে থাকার সুযোগ পাননি। তিনি একটি ভাড়া বাড়িতে অবসরের পর অল্প বয়সে মারা যান। আজ সরকার উদ্যোগী হয়ে দরিদ্র মানুষের জন্য ঘর তৈরি করেছে।

স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে বাড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও সুযোগ-সুবিধা। বাংলাদেশের ওষুধ তৈরির সক্ষমতা গর্বের বিষয়। বাংলাদেশ জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য বজায় রেখে দক্ষতার সাথে কোভিড-১৯ মহামারী পরিচালনা করতে পেরেছে। ১৪০০০ কমিউনিটি হেলথ সেন্টার তার ক্যাচমেন্ট এলাকার লোকের দ্বারে দ্বারে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্যসেবার মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করা দরকার। যাতে আমাদের বা বিদেশীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সিঙ্গাপুর, ভারত বা থাইল্যান্ডে ছুটতে না হয়। পানি ও স্যানিটেশনের উন্নতি হয়েছে। এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও স্যানিটেশনের উদ্দেশ্যে আজ ঝোপঝাড়ে যেতে হয় না। গ্রামে দাদার রাডীতে আমিও স্যানিটেশনের উদ্দেশ্যে ঝোপঝাড়ে গিয়েছি। আজ সেখানে পাকা পায়খানা আছে। মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং তার বিকাশ যেমন আয়, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি এবং স্যানিটেশন আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার বিরল পণ্য নয়। দেশে খাদ্য নিরাপত্তা এখন প্রশ্ন নয়, মানুষ আর ক্ষুধার্ত থাকে না। এই সেদিন বাংলাদেশ শুধু চাল নয়, শ্রীলঙ্কাকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ধার দিয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও আপনি আর কোনো অর্ধ-উলঙ্গ বা পাদুকা বিহিন কাউকে দেখতে পাবেন না। মানুষ সাধারণত খুশি। আজ কৃষকের বা ছোট দোকানদার বা রিকশাচালকের ছেলে বা মেয়েও বিসিএস অফিসার হচ্ছে। কোন কিছুই কারো নাগালের বাইরে নয়। এটাই আজকের বাংলাদেশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রবল প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের নিরাপত্তার উন্নতি হয়েছে। আজ বাংলাদেশে সন্ত্রাসী বা ধর্মান্ধদের কোনো স্থান নেই। তবুও, আমাদের এখনও পুরানো, এমনকি ব্রিটিশ আমলের আনেক আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং নীতি রয়েছে, যা আমাদের অগ্রগতিকে আরও বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের সেসব নীতি ও পদ্ধতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। দুর্নীতি আমাদের দেশে একটি ক্যান্সার। এটি কমাতে বা দুর করতে র্যাডিকাল সার্জারি (radical surgery) প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশে প্রতিটি সেক্টরে ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের (Human Resources for management and leadership) মানবিক ক্ষমতারও অভাব রয়েছে। বিভিন্ন প্রাইভেট সেক্টরে বিদেশীদের দ্বারা উচ্চ বেতনের ব্যবস্থাপক এবং নেতৃত্বের পদের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাহিরে প্রেরণ করা হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে এই মানবসম্পদ এলাকাকে শক্তিশালী করতে হবে। গবেষণা এবং পেটেন্ট উন্নয়নের জন্য বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। পলিসি, অ্যামিনিটিস এবং কম বেতনের কারণে আমরা অত্যন্ত দক্ষ মানবসম্পদও হারাচ্ছি। আমাদের আরও দ্রুত অগ্রগতির জন্য একটি সহায়ক নীতি এবং আইনী কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

যদিও অভ্যন্তরীণ পর্যটন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিদেশী পর্যটকদের স্বাগত জানাতে এবং আকৃষ্ট করতে আমাদের পর্যটন খাতকে আরও উন্নত করতে হবে। তাদের বিনোদন ও উপভোগের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে কারণ আমাদের এই সেক্টরে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বিদেশী পর্যটকরা তাদের অর্থের জন্য সেরা আনন্দ আর সেভা কিনতে চান। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম ছুটিতে সফর যাওয়া সপ্নের বাহিরে ছিল। আজ নতুন নতুন পর্যটন রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে, আর বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ সেসব রিসোর্টে ছুটিতে অবস্থান করছে। কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার আগে আমরা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে যেতাম। আজ তরুণরা ফুল নিচ্ছে। ভ্যালেন্টাইন বা বাংলা নববর্ষ দিবসে লাখো মানুষ একে অপরকে ফুল দিচ্ছেন। আমি যখন দেখি মানুষ ফুল কিনছে, আমি খুব আবেগপ্রবণ হই। এটি বাংলাদেশের মানুষের একটি দারুন ক্রয় ক্ষমতা এবং উন্নয়নের চিহ্ন। আমাদের নবী বলেছেন “তোমার এক পয়সা থাকলে খাদ্য কিনবে, আর দুই পয়সা থাকলে ফুলও কিনবে”।

যখন অনেক দেশ আমাদের অগ্রগতি সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠছে এবং বাণিজ্য ও উন্নয়নে আমাদের সমান অংশীদার হতে চায়, আমাদের কে সম্মান করে আমাদের সাফল্যকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে, তখনও বাংলাদেশে কিছু সংখ্যক লোক, বিশেষ করে যারা শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল করতে এবং রাতারাতি ধনী হতে আগ্রহী, দুর্নীতি এবং আবার হাউয়া ভবনের চর্চা করতে চায় এবং যারা আমাদের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে না বা বিশ্বাস করে না তারা এখনও অভিযোগ করছে। আমাদের অগ্রগতি বন্ধ করতে নাশকতার সব উপায় চেষ্টা করছে। আমরা কোথায় ছিলাম এবং এখন কোথায় আছি তা তারা দেখতে পায় না বা দেখতে চায় না। আমাদের অগ্রগতির অংশ হতে তারা যোগ দিতে চায় না। তারা দেখেন গ্লাস সবসময় অর্ধেক খালি আছে। আমি বিশ্বাস করি যদি আমরা অগ্রগতি ও নেতৃত্বের গতি আরও এক দশক ধরে রাখতে পারি তাহলে কেউ বা কোনো দলই আমাদের পিছে ঠেলে দিতে পারবে না। সাধারণ মানুষ আজ প্রগতি দেখেছে এবং অনুভব করছে। তারা শান্তি ও অগ্রগতি চায়, তারা আর হরতাল, মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে, রাস্তা অবরোধের রাজনীতি চায় না। তারা শান্তি ও সমৃদ্ধি চায়, তাদের পরিবার নিয়ে সুখে থাকতে চায়।

২০১৯ সালে পাকিস্তানে কাজের সফরের সময় একজন মন্ত্রী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন আমি মনে করি বাংলাদেশ এত অল্প সময়ে, বিশেষ করে গত ১০-১২ বছরে এত কিছু অর্জন করতে পেরেছে। আমার উত্তর ছিল, “আমাদের অদম্য, দূরদর্শী, নিবেদিত যিনি তার পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন, সেই নেত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই এটা ঘটছে।” আমাদের এখনও শেখ হাসিনার অন্য বিকল্প নেই। বাংলাদেশ তাকে পেয়ে ভাগ্যবান এবং আগামী বছর গুলোতেও তার প্রয়োজন হবে। তার চলমান নেতৃত্ব বাংলাদেশকে স্থিতিস্থাপক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবে এবং বিশ্বে আরো সম্মানিত করবে। যার ফলে আমরা অনেক সম্মান ও গর্বের সাথে বাঁচতে পারবো।

বাংলাদেশ   ঢাকা কলেজ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে বিএনপির রাজনীতি


Thumbnail

বিএনপির রাজনীতি এখন ভুলের চোরাগলিতে আটকে গেছে। রাজনীতিতে একের পর এক ভুল করার কারণে তারা এখন হতাশায় নিমজ্জিত। কোন কী বলতে হবে সেটার খেই হারিয়ে ফেলেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। 

বিএনপি এখন দাবি করছে যে, তাদের ৬০ লাখ নেতাকর্মী জেলে আছেন। এখানে দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হল যদি ৬০ লাখ কর্মী তাদের থাকত তাহলে এতদিনে তারা কেন আন্দোলনে ব্যর্থ হল? যদি এত সংখ্যক নেতাকর্মী থাকত তাহলে তো অনেক আগেই সরকারের পতন ঘটে যেত। কারণ সরকারের পতন ঘটানোর জন্য এক লাখ নেতাকর্মী হলেই যথেষ্ট। কিন্তু এত সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়েও তারা ব্যর্থ কেন! এত বড় সংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে তারা তাদের নেত্রীকে জেল থেকে মুক্ত করতে পারেনি। কোন আন্দোলনই তারা করতে পারল না! বরং তাদের নেত্রীকে সরকারের অনুকম্পায় ফিরোজায় থাকতে হচ্ছে। ফলে স্বভাবতই বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যা কত সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আর এত নেতাকর্মী থাকা সত্বেও তাদের নেতাকে লন্ডনে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে! 

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হল বিএনপির ৬০ লাখ নেতাকর্মী যদি জেলে থাকেন তাহলে দেশের জেলখানা গুলোর ধারণ ক্ষমতা কত। এবং সেখানে যদি বিএনপির নেতাকর্মীর সংখ্যাই হয় ৬০ লাখ তাহলে এর মধ্যে সাধারণ কয়েদি কোথায় আছেন। তাদেরকেই বা কোথায় রাখা হয়েছে।

কথায় আছে, পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পথ ফিরে পাওয়া যায়! বিএনপির অবস্থায় এখন তাই। তারা রাজনীতির পথের মাঝে রাজনীতির পথ হারিয়ে ফেলেছেন। কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনীতি নয় সেটাও বিএনপির নেতাকর্মীরা বোধহয় ভুলে গেছেন কিংবা বুঝতে পারছেন না। অন্য আরেকটি কথায় আছে যে, স্বপ্নে যখন কেউ কিছু খাবে তখন পান্তা খাবে কেন? পোলাও কোরমা খাওয়াই ভালো। বিরিয়ানিও খাওয়া যেতে পারে। সুতরাং ৬০ লাখ না বলে তাদের বলা উচিত ছিল বাংলাদেশে তো প্রায় ১৮ কোটি লোক আছে এর মধ্যে ৬ কোটি লোকই বিএনপির নেতাকর্মী। তাহলে অত্যন্ত লোকে আরও ভালো ভাবে বুঝত যে, বিএনপি আসলেই অনেক বড় একটি শক্তিশালী দল এবং তাদের আন্তর্জাতিক মুরব্বিরা বুঝতে পারত যে, বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা অত্যন্ত ভালো। 

তবে বাস্তবতা হল বিএনপি ৬০ লাখ নেতাকর্মী দাবি করলেও আসলে তাদের কোন জনসমর্থনই নাই। যদি তাই থাকত তাহলে তারা নির্বাচন বিষয়টিকে এত ভয় পেত না। নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নিত না। শুধু তাই নয়, বিদেশিও তাদের কোন বন্ধু নাই। যারা আছে সেই বন্ধুদের কথায় দলটি বরং এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যাচ্ছে। দেশিয় বিএনপির যে সমস্ত বন্ধুরা ছিলেন, বিভিন্ন সময় বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে কিছু লেখালেখি করতেন, তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতার স্বপ্ন দেখাতেন তারাও এখন হারিয়ে গেছেন। সব কিছু মিলিয়ে দলটি এখন অনেকেটা এতিম হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়ত সামনে দলটির নাম নিশানাও থাকবে না। যারা নিজের দলের নেতাকর্মীর সঠিক সংখ্যা জানেন না তাহলে বুঝতে হবে সেই দলটি এখন কোন পর্যায় গেছে। কতটা দেউলিয়া হলে একটি দলের নেতাকর্মীর সংখ্যা নিয়ে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত হন। সুতরাং দলটি যে অচিরেই হারিয়ে যেতে বসছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বৈশাখে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ১৪ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে। 

১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের নববর্ষ। টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’, দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। তাপদাহে এই এপ্রিলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে এই এপ্রিল আমাদের বৈশাখি/বৈসাবি/বিজু উৎসবের মাস- খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস হলেও। বৈশাখকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন ‘মোহন ভীষণ বেশে’, দেখেছিলেন ‘অতলের বাণী খুঁজে পাওয়া মৌনী তাপসরূপে’। অন্য কবি লিখেছেন- ‘রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল/আম কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল/ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে মাঠে কভু খেল লয়ে অশনি।’ বৈশাখে এই ‘অশনি’র খেলা নিশ্চয় কারো কাছে প্রত্যাশিত নয়।

বিশ্ব পরিস্থিতির সংকট আমাদের বৈশাখি আয়োজনের মধ্যে গরল উগড়ে দিলেও অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন এবারও। এখন আমরা প্রাণিত, আমাদের চিত্ত আনন্দিত এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। অতীতের মতো এবারও সকালে হালখাতা খুলে দোকানে বসবে ব্যবসায়ী, বৈশাখি মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাবে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে সারাদেশে মঙ্গলশোভা যাত্রা অনুষ্ঠিত হতো তাও এবার হবে। রমনার বটমূলের প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান এবারও হচ্ছে।আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানও শুরু হয়েছে।‘পাচন’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সকল প্রথা অনুসৃত হচ্ছে।একসময় ভারতবর্ষে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ফলনের খাজনা আদায় করা হতো। ফলে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল কৃষিকাজে ফসল না থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিতে বাধ্য হতো কৃষকরা। খাজনা আদায়ের সময়টিকে কৃষকদের জন্য সহনীয় করতে প্রবর্তিত হয় ‘ফসলি’ সন। আসলে হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন সনের নিয়ম প্রচলন করা হয়েছিল। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনার শুরু। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। ক্রমান্বয়ে ফসলি সন বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত লাভ করে। 

বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি সূচনা হয় সূর্যোদয়ের প্রত্যুষে। কাজেই সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখের উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০২৩ অবধি ছায়ানটের রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজন হয়ে এসেছে। অন্যদিকে নব্বই দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখ সকালে মঙ্গলশোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণের সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের উৎসাহে ২০১৩ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির দিন পালিত হয় চড়কপূজা অর্থাৎ শিবের উপাসনা। একইসঙ্গে ওইদিন গ্রামবাংলায় আয়োজিত হয় চড়ক মেলা।

নববর্ষের সকল আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করেও আমরা আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, সংকটে আক্রান্ত বিশ্বে আমাদের কাছে এখন বেঁচে থাকার গৌরব অত্যন্ত বেশি। নিকট আত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক, আমরা এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে  চাই। সংকট এলে কী করি, কীভাবে অগ্রসর হই, কোথায় যাই, কোথায় সেবা করে আত্মবিসর্জন করতে হবে, এটাই শান্তচিত্তে আমরা খুঁজছি। ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া নতুন বছরের আগে ছিল কাজ, অকাজ, অকারণ কাজ, যে উপায়েই হোক, জীবনের শেষ নিমেষপাত পর্যন্ত ছুটাছুটি করে, মাতামাতি করে বেঁচে থাকা। ওই কর্ম-নাগরদোলার ঘূর্ণিনেশা আমাদের পেয়ে বসেছে বলেই পৃথিবী হয়েছে শান্তিতে পূর্ণ। অবশ্য দুর্গম হিমালয়শিখরের নিরুদ্বিগ্ন প্রাণিদের জীবন বিপন্ন; জনশূন্য তুষারমরুর বিশ্বস্তচিত্ত সীল এবং পেঙ্গুইনদের নির্বিরোধে প্রাণধারণ করার সুখটুকু বিলীন এখন। বাণিজ্যপুঁজি ও শিল্পপুঁজির দাপটে আফ্রিকা আর দক্ষিণ-আমেরিকার প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলেও আধুনিকতার নামে মৃত্তিকাসংলগ্ন সভ্যতার তিরোধান ঘটেছে। বিচিত্র কর্মের পিছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক। এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো আমাদের ব্যস্ত থাকার কথা নয়। এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনে আমাদের জীবন মুখরিত হয়।

আজকের দিনের বহু আড়ম্বর, আস্ফালন, করতালি, মিথ্যাবাক্য, যা আমাদের স্বরচিত, যাকে বাংলাদেশের মধ্যে আমরা একমাত্র সত্য, একমাত্র বৃহৎ বলে মনে করছি, সেই কর্পোরেট কালচারের ঢেউ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কারণ নববর্ষ সকলকে একই কাতারে নিয়ে আসে। সেখানে শ্রমজীবী আর বুদ্ধিজীবী একসঙ্গে চলেন, প্রত্যেকে নিজকে এবং জগৎকে ঠিকভাবে দেখতে পান, উৎসবের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মিলনলাভ সম্ভব হয়। উৎসবের আয়োজনে ব্যক্তিগত ভোগের নিবিড়তা নেই বরং বৈশাখি আনন্দ আত্মীয়-স্বজন-প্রতিবেশীর মধ্যে ব্যাপ্ত করে দিয়েছে মহত্ত্ব। নববর্ষের আনন্দ আমাদের ঘরকে, মনকে, সমাজকে কলুষের ঘনবাষ্প থেকে অনেকটা পরিমাণে নির্মল করে রাখে, দূষিত বায়ুকে বদ্ধ করে রাখে না এবং মলিনতার আবর্জনাকে একেবারে গায়ের পাশে জমতে দেয় না। পরস্পরের কাড়াকাড়িতে ঘেঁষাঘেঁষিতে যে রিপুর দাবানল জ্বলে উঠে উৎসবে তা প্রশমিত থাকে; কর্মের সঙ্গে শান্তিকে জড়িত করে রেখে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করে। উৎসব আমাদের শিখিয়েছে মানুষ বড়ো, পদ বড়ো নয়; দারিদ্র্য লজ্জাকর নয়, সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলে রাখা যায়। আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকুর মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর ধনি হওয়ার প্রচেষ্টা অন্যকে ছোটো করে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে দেয় না। এজন্য নববর্ষের উৎসব সর্বজনীন।

এসেছে পহেলা বৈশাখ, ৩০ চৈত্রে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ বিদায় নিয়েছে। এজন্য- ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/বিপুল নিঃশ্বাসে।’ রবীন্দ্রনাথ ‘নববর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘পুরাতনই চিরনবীনতার অক্ষয় ভাণ্ডার।...নূতনত্বের মধ্যে চিরপুরাতনকে অনুভব করিলে তবেই অমেয় যৌবনসমুদ্রে আমাদের জীর্ণ জীবন স্নান করিতে পায়।’ এই ‘চিরপুরাতন’ হলো আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। আজকের এই নববর্ষের মধ্যে বাঙালির বহুসহস্র পুরাতন বর্ষকে উপলব্ধি করতে হবে। কারণ সেখানে রয়েছে সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিহাস, সেখানে আছে গ্রামীণ বাংলার হালখাতা আর বৈশাখি মেলার আয়োজন, আছে বাঙালি জমিদারদের পুণ্যাহের উৎসব। ফসলের ঘ্রাণে গড়ে ওঠা আমার নববর্ষ শাশ্বত ও গৌরবের। নববর্ষে বৈশাখের খররৌদ্রে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। ‘হে নূতন, এসো তুমি সম্পূর্ণ গগন পূর্ণ করি/পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে-/ ব্যাপ্ত করি, লুপ্ত করি, স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে/ ঘনঘোরস্তূপে।’ ‘ঘনঘোরস্তূপে’ নতুনের এই আহ্বান প্রকৃতপক্ষে সংকট কবলিত বাঙালির জীবনে প্রত্যাশার অভিব্যক্তি। এ মুহূর্তে আমরা পৃথিবীতে যতটুকু কাজ করি তা যেন সত্যসত্যই দায়িত্ব পালনের জন্য করি, ভান না করি। কারণ অক্ষমরা বৃহৎ কাজ করতে পারে না বরং বৃহৎ ভানকে শ্রেয়স্কর জ্ঞান করে। জানে না যে মনুষ্যত্বলাভের পক্ষে বড়ো মিথ্যার চেয়ে ছোটো সত্য ঢের বেশি মূল্যবান। এই সত্য পথে হেঁটে আমরা নববর্ষের চেতনায় সংকট জয় করব। আর এই বৈশাখেই মানবজীবনকে অশান্তি মুক্ত করার শপথ নিতে হবে। কারণ- বৈশাখে ‘মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে’।

লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘সংখ্যায় আধিক্য মানে অবনমন’


Thumbnail

সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।

সময়ের সাথে সাথে এভাবে পৃথিবীতে প্রায় সবকিছুর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়লেও গুণগত মান এবং কার্যকারিতা নিম্নমুখী হচ্ছে। সবকিছুতেই যেন ভেজাল বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে তবে শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে দিন দিন। শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক এবং সৃজনশীল হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থীদের মননশীলতা এবং সৃজনশীলতার বিকাশ আশানুরূপ হচ্ছে না। চিন্তাশীলতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা অতিশয় প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে।

এক সময় সমাজে হাজীর সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। তবে সমাজে তাদের অনেক সম্মান ছিল। মানুষ তাদেরকে খুব ইজ্জত করতেন। তাদের চলাফেরা এবং আচার-আচরণ সমাজের আর দশজন মানুষ থেকে আলাদা ছিল যা দেখে তাদের খুব সহজেই চেনা যেত। তাদেরকে মানুষ অনুকরণ করতেন। এখন হজ্জব্রত পালন করা মানুষের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, তবে তাদের ঈমানী শক্তিতে আর আগের সেই ধার নেই। হজ্জ করে আসা ব্যাবসায়ী হজ্জ করে এসে আগের চেয়ে অধিক মুনাফা করছে, ভেজাল পণ্য বিক্রি করছে। সিন্ডিকেট করে দ্রব্যমূল্য রাতারাতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। হজ্জ করে আসা একজন চাকরিজীবী পবিত্র ঘর তাওয়াফ করে এসে আবার আগের মতই ঘুষ, দূর্নীতিতে জড়াচ্ছে। একজন হাজী'র কোনো চারিত্রিক এবং নৈতিক গুণাবলি তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে হাজীদেরকে এখন আর দেখে চেনা যায় না। সমাজে হাজীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও সমাজের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক গুণাবলি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে; মানুষের মনুষ্যত্ববোধ দিন দিন লোপ পাচ্ছে। 

ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষ দিন দিন আকৃষ্ট হচ্ছে। দেশে বিগত কয়েক বছরে মাদ্রাসা এবং মাদ্রাসায় পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তবে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত এসব শিক্ষার্থী সমাজের মানুষের  ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে পারেনি। বরং এরা নিজেরাই অনেকে উগ্র, সাম্প্রদায়িক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষী। ইসলাম যেখানে সহনশীলতা, সাম্য, শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধের বার্তা দেয়, ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত এসব আলেমদের আচরণ ঠিক তার উল্টো! 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) তার চলার পথে কাঁটা পুঁতে রাখা বুড়ী অসুস্থ হলে তার সেবাশুশ্রূষা করে তাকে সারিয়ে তুলেছেন। যাদের অত্যাচার, নির্যাতন এবং হিংস্রতার কারণে তিনি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত বাধ্য হয়েছিলেন- মক্কা বিজয়ের পর তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। অথচ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া আলেম নামধারী কিছু সাম্প্রদায়িক মানুষ ঈদ এর পরিবর্তে কেউ ইদ লিখলেই তাকে কাফির, নাস্তিক, মুরতাদ আখ্যা দিয়ে তাদের কল্লা কাটার ঘোষণা দেয়! চুন থেকে পান খসলেই এরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষোদগার করে, অশালীন ভাষায় মন্তব্য করে। যাকে তাকে যখন তখন ইসলাম বিরোধী, নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। এরা আসলে কতটা কুরআন এবং রাসূলের অনুসারী! সমাজ, রাষ্ট্রে এমন আলেমের সংখ্যাই বেশি। প্রকৃত আলেমের সংখ্যা খুবই কম। 

সমাজে কেবল এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম নয়, সুশীল নামধারী নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করা অনেক শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক মানুষ আছে। এরা দাঁড়ি, টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই তাদেরকে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মান্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে পছন্দ করে। এরা দাঁড়ি, টুপীওয়ালা মানুষদের জঙ্গি এবং মৌলবাদী আখ্যায়িত করতে পারলেই নিজেদেরকে প্রগতিশীল ভাবে। দাঁড়ি, টুপি এবং মাদ্রাসার প্রতি এদের এলার্জি সাংঘাতিক রকমের। এরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক মনে করলেও আসলে এরা নিজেরাও চরম সাম্প্রদায়িক। এরুপ প্রগতিশীলের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। সমাজে দিন দিন এরুপ সাম্প্রদায়িক আলেম এবং প্রগতিশীলতার ভান করা চরম সাম্প্রদায়িক শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এরা উভয়ই সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপস্বরুপ।

আগে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার সংখ্যা ছিল কম। যা ছিল তাও বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোল পাতার ছাউনি ঘেরা নিতান্তই এক একটা কুঁড়ে ঘর। এসি তো দূরের কথা লাইট, ফ্যান ও ছিল না। মানুষের গায়ে তখন দামি পোশাক ছিল না, দামি গাড়ি, আলিশান বাড়ি ছিল না অথচ তখন সমাজে অনেক আদর্শবান মানুষ ছিলেন। যাদের দেশপ্রেম, সততা এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল অনুকরণীয়। আজকে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, মাদ্রাসা, গীর্জার কোনো কমতি নেই। বাঁশ, কাঠের বেড়া আর তালপাতা, গোলপাতার ছাউনির পরিবর্তে এগুলো এখন একেকটা আলিশান ভবন। টাইলস কিংবা দামি মার্বেল পাথর বাঁধানো এসব ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র ( এসি ) এর ছড়াছড়ি। আজকাল এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় মানুষের শরীরকে শীতল করলেও মনকে পরিশীলিত, নরম এবং পরিশুদ্ধ করতে পারছে না। মানুষ এখন দামি পোশাক, অভিজাত গাড়ি, প্রাসাদতুুল্য বাড়ির মালিক। তাদের এখন সব আছে। নেই কেবল সততা, দেশপ্রেম, নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ।

লেখক- মোঃ নজরুল ইসলাম, তরুণ কলামিস্ট, খুলনা।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বাংলাদেশের নির্বাচন: ব্যাপক বয়কট নাকি সর্বজন গৃহীত?

প্রকাশ: ০১:৫৭ পিএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।  

তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।

অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?

দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।

নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।

তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।

তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।  

নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।

বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।

তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।

উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।

বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।

দায়বদ্ধতা

এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।

১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।

নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।


বাংলাদেশের নির্বাচন   ব্যাপক   বয়কট   সর্বজন গৃহীত  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অবিনাশী বাক্যাবলি

প্রকাশ: ১১:০১ এএম, ১০ এপ্রিল, ২০২৪


Thumbnail

১০ই এপ্রিল  ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ (প্রোক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) -এর ৫৩ বছর পূর্তি।আজ থেকে পাঁচ দশক আগে এই দিন ঢাকা শহর থেকে দূরে নিভৃত এক গ্রামের আম্রকাননে উদ্ভাসিত হয়েছিল এর অবিনাশী বাক্যগুলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী  নৃশংস পৈশাচিকতায় বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সে রাতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পৃথিবীর বুকে যুদ্ধরত বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। অন্যদিকে মাত্র ১৫ দিনের মাথায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৭ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয় এই সরকার।এই সরকারের নেতৃত্বেই ৯ মাসের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের সারেন্ডারের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

একাধিক গবেষণাগ্রন্থ ও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সূত্র মতে, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের আলাদা দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই প্রথমে তাজউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য ৩০ মার্চ ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। সেখান থেকে মেহেরপুর মহকুমার প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসা পর্যন্ত পুরো সময়টাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল। কারণ তাজউদ্দিন সেটা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে শুরু থেকেই দৃঢ় অবস্থানের মাধ্যমে। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে তাজউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে একটি প্রশাসনিক কাঠামো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন প্রতিনিধি হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য আলোচনা করেন। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে পূর্ব পরিকল্পনা এবং ভারতের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবে তাজউদ্দিনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশের কারণে তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি না দিলেও ভারত বাংলাদেশের এই নতুন সরকারকে মুক্তিফৌজের আশ্রয়-ট্রেনিং-অস্ত্র থেকে শুরু করে সকল রকম সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় এবং সবধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।

ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে এই বৈঠকের সূত্র ধরেই তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (M.N.A) এবং এমপিএ (M.P.A)-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রীপরিষদ এবং এমএনএ এবং এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন- ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ তিনটি ঘটনা একসূত্রে গাঁথা।’ তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ১০ এপ্রিলের ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে স্বদেশ ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য প্রথম সরকার গঠন করা হয়।’ সেসময় যিনি এই ঘোষণাপত্রটি রচনা করেছিলেন তাঁর স্মৃতিতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র; যা ৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে পেনসিলভানিয়া প্রাদেশিক আইনসভায় অনুষ্ঠিত ২য় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধরত তেরটি মার্কিন উপনিবেশ নিজেদের ব্রিটিশ শাসনের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র নামে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় জুলাইয়ের ৪ তারিখ, যে তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়েছিল সেই তারিখেই। ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কারণ ঘোষণাপত্রে লেখা হয়েছে- ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।’

        ঘোষণাপত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিহিত করা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। বর্ণিত ঘটনা অনুসারে আমরা জানি, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের  ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা বন্ধ ঘোষণা করেন। উপরন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে গণহত্যা চালায়। উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ নামের এই দলিল যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল।ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ এরকম-

‘‘যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং

যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং

যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহ্বান করেন, এবং

যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনিভাবে নির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, এবং

যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং

যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, এবং

যেহেতু একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনও অনবরত করিয়া চলিতেছে, এবং

যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের জন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং

যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে।

সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকার জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং এতদ্দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম, এবং এতদ্দ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, কর আরোপণ ও অর্থ ব্যয়ন ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবিকরণ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, এবং  বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন।

আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোন কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাহার ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্দ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমাদের উপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।

আমরা আরও সিদ্ধান্ত করিতেছি যে, এই দলিল কার্যকর করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করিলাম।’’

উল্লেখ্য, এটি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মুজিবনগরে ঘোষিত ও জারিকৃত এবং ২৩ মে, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫০(১) অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হবে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ {সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ} একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অপরিবর্তনীয় বিধান। ৫৩ বছর আগে ঘোষিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। এজন্য একাত্তরে পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন না বলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বীকৃতি দান করা হয়।২৪ বছরের নিপীড়ন-অত্যাচারের পথ অতিক্রম করে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়েছিল বলেই আমাদের স্বাধীনতার লড়াই আইনসম্মত হয়ে উঠেছিল।আর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল সেই আইনগত বৈধতা অর্জনের অন্যতম স্তম্ভ, যার বাক্যাবলি আজও অবিনাশী।

 

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন