ইনসাইড থট

বঙ্গবন্ধুর কারা-সাহিত্য

প্রকাশ: ০১:০০ পিএম, ১৭ মার্চ, ২০২২


Thumbnail বঙ্গবন্ধুর কারা-সাহিত্য

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়া চীন (২০২০) তাঁর লেখকসত্তার অনন্য পরিচয়ে ভাস্বর। গ্রন্থ তিনটির বিষয়বস্তু পর্যালোচনায় দেখা যায় তাঁর সংগ্রাম, অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগের মহিমা বর্তমান প্রজন্মের জন্যও অভিনব। তবে ত্রয়ী গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর কষ্টে যাপিত জেলজীবনের প্রতিচ্ছবি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। কারাবন্দি জীবনের একাকিত্বের মুহূর্তগুলো ভরে তুলেছিলেন আত্মজীবনী লেখায় নিজেকে নিয়োজিত করে। যদিও তা সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। তিনি কারাগারে বসে রোজনামচাও লিখেছেন। তাঁর ত্রয়ী গ্রন্থ বাংলা কারাসাহিত্যের অন্যতম সংযোজন।

২.

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি অবস্থায় লিখে গেছেন তাঁর কারাজীবন, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং সর্বোপরি সর্বংসহা সহধর্মিণীর কথা, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে সহায়ক শক্তি হিসেবে সকল দুঃসময়ে পাশে  ছিলেন। একইসঙ্গে লেখকের চীন, ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণের বর্ণনাও বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। এছাড়া আছে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশ পরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশবিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ কালপর্বের কারাস্মৃতি স্থান পেয়েছে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কারাগারে তাঁর লেখা দুটি এক্সারসাইজ খাতা জব্দ করে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধারকৃত একটি খাতার গ্রন্থরূপ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কারাগারের রোজনামচা। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা উত্থাপনের পর বারবার গ্রেফতার হন। ওই সময়ের বন্দিজীবনের দিনলিপি উঠে এসেছে বইটিতে। বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ থাকাকালীন প্রতিদিন ডায়েরি লেখা শুরু করেন। এজন্য কারাগারের রোজনামচায় জেলজীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। অর্থাৎ জেলখানায় সংঘটিত বিভিন্ন কথা ও কাজের মধ্যদিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা সবিস্তারে উপস্থাপিত। কারা-জীবনে তিনি সীমাহীন নির্যাতন, কষ্ট, অপমান, অবহেলা সহ্য করেছিলেন। বন্দি থাকাকালীন তাঁর সংসার, সন্তান ও বেগম মুজিব কষ্ট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে দিন পার করেছেন। তবে তিনি দিনলিপি লেখার আগেই কারাগারের প্রচলিত শব্দগুলোর অর্থ ঘটনার মধ্যদিয়ে তুলে ধরেছেন। প্রতিটি দিনলিপির শেষে লেখকের নিঃসঙ্গতার নিদারুণ বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। জেল-জীবন, জেল-যন্ত্রণা, কয়েদিদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিল- সেসব বিষয় যেমন সন্নিবেশিত হয়েছে; ঠিক তেমনি তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ৬ দফার আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রকৃতিপ্রেম, পিতৃ-মাতৃভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না দরদ দিয়ে তুলে ধরেছেন। কারাগারের রোজনামচা দিনলিপি হলেও; তিনি বিবৃত করেছেন ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্যায়, কখনো বা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে ওঠা সেই মহৎ সংগ্রাম। বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার সংগ্রামে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার কথা। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার সংস্পর্শে এসে একজন কুখ্যাত চোর কীভাবে জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তন এনে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে, সে সত্যও বইটিতে অভিব্যক্ত। জেলখানায় কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয় তাঁকে। তবুও তাঁর লেখায় কৌতুকবোধের অভাব হয়নি। তাই রোজনামচায় বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের কষ্টের পাশাপাশি রসবোধের পরিচয়ও ব্যক্ত হয়েছে।

১৯৫২ সালের চীন ভ্রমণের কাহিনি আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু এটি রচনা করেছিলেন ১৯৫৪ সালে যখন কারাগারে। তাঁর লেখা খাতাটির ওপর গোয়েন্দা সংস্থার সেন্সর ও কারা-কর্তৃপক্ষের যে সিল দেয়া আছে তা থেকেই সময়কালটা জানা যায়। শেখ মুজিবের বয়স তখন ৩২ বছর। কারাগারে বসে লেখা বলে এটিও কারা-সাহিত্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত। গ্রন্থটির সূচনায় জেলে থাকার কথা লিখেছেন তিনি- ‘১৯৫২ সালে জেল হতে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, ‘যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।’ অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেওয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতো যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে! ৭৩ পৃষ্ঠায় তিনি চীনের সেলুনওয়ালার পরিচয় জিজ্ঞাসার উত্তরে মনে মনে বলেছেন- ‘... মনে মনে বলি, আমার আবার পরিচয়? পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বক্তৃতা করে বেড়াই। আর মাঝে মাঝে সরকারের দয়ায় জেলখানায় পড়ে খোদা ও রসুলের নাম নেবার সুযোগ পাই। এই তো আমার পরিচয়।’ প্রকাশিত গ্রন্থটির খাতা  পরিচিতি অংশে আছে- ‘তরুণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান এন্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন। সেই সময়ের স্মৃতিনির্ভর এ ভ্রমণকাহিনি ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে তিনি রচনা করেন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব-বাংলার শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তান সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে তিনি আরো একবার চীন সফর করেন। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর গভীর ধারণার পরিচয় পাওয়া যায় এ লেখায়। সদ্য বিপ্লবের পর গণচীনের শাসনব্যবস্থা ও মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে গভীর আগ্রহ ও ঔৎসুক্যের পরিচয় আছে এ লেখায়। মুক্ত মন ও তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখা ঘটনার প্রাঞ্জল বর্ণনায় এ রচনা খুবই আকর্ষণীয়। চীন, রাশিয়া বা আমেরিকার মূল্যায়নে তাঁর বোধের স্বচ্ছতা ও সত্যনিষ্ঠা আমাদের মুগ্ধ করে। তরুণ বয়সেই যে তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতায় রূপান্তরিত হচ্ছিলেন এ বই তাঁর উজ্জ্বল নিদর্শন। এ লেখার সঙ্গে প্রসঙ্গক্রমে নিজের দেশ ও মানুষের অবস্থার কথাও তিনি তীক্ষèভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি ও গভীর উপলব্ধি তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে।’

৩.

আমার দেখা নয়া চীনে জেলজীবনের প্রসঙ্গ আছে। জেল-জুলুমের পরও রাজনীতিতে নিজের আদর্শবাদিতা বজায় রেখেছিলেন সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অভিব্যক্তি-‘আমি ভাবলাম, লোকটা অন্ধ। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের লোভ মোহ দিয়া ভোলানো সোজা না। তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগওয়ালারা তা পারতো। মনে করে ভাবলাম, ‘জেলে দিয়া, মিথ্যা মামলার আসামি বানিয়ে, ইউনিভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত করে নানা প্রকার অত্যাচার করেও আমাদের মতের পরিবর্তন করা যায় নাই।’ দেখা যায়, হংকং-এ থেকে কম্যুনিস্ট বিরোধী হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ, চীনের অনেক বড় বড় লোক কম্যুনিস্ট জুজুর ভয়ে হংকং-এ আশ্রয় নিয়েছে। তবে আস্তে আস্তে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে। অনেকে আবার হুজুগে এসে বিপদে পড়েছে। এইভাবে, বহুলোক হংকংয়ে সামান্য জায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। যা হোক, ফেরার পথেও দুইদিন হংকংয়ে ছিলাম, তাই হংকং পর্ব শেষ করে নয়াচীনে ঢুকবো। (পৃ ২৭)

নিরাপত্তা আইনে নিজের জেল খাটার ঘটনা স্মরণ করেছেন চীনকে দেখার ঘটনা বর্ণনা করার সময়- ‘আর হতভাগাদের ছেলেমেয়েরা কিছুদিন মহাজনের বাড়ি কাজ করে, কিছুদিন ভিক্ষা করে জীবন রক্ষা করে, তারপর একদিন গ্রাম ছেড়ে পেটের তাগিদে অন্য কোথাও চলে যায়। আর ফিরে আসে না। এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হয়। বোধ হয়, প্রকৃতির কোলে চিরদিনের জন্য আশ্রয় নেয়। তাদের ছেলেমেয়েগুলি না খেয়ে থাকতে থাকতে একদিন ব্যারাম হয়ে মারা যায়। আমরা বলি অসুখ হয়ে মারা গেছে। কিন্তু না খেতে না খেতে যে ব্যারাম হয়, তারপর মারা যায়, একথা আমাদের দেশে বলে না। কারণ, সরকারের থেকে খবর নিলে জানা যায় যে, না খেয়ে মরে নাই, ব্যারাম হয়ে মারা গেছে। যদি কেউ না খেয়ে মরার খবর দেয় তবে তার কৈফিয়ত দিতে কাজ সারা হয়ে যায়। আর যদি কোনো খবরের কাগজে প্রকাশ পায়, তবে কাগজআলার কাগজটা দেশের নিরাপত্তার নামে বন্ধ করে দেওয়া হয়্ আর বেচারার আমার মতো নিরাপত্তা আইনে জেল খাটতে খাটতে জীবন শেষ হয়ে যায়।’ (পৃ ৯৩)

জেলে থাকার সময় সিপাহিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তার দৃষ্টান্ত রয়েছে এ গ্রন্থে- তাহলেই গরিব কর্মচারীরা কোনোমতে বাঁচতে পারে। তাদের ছেলেমেয়েদের ফ্রি শিক্ষার বন্দোবস্ত করা উচিত এবং সাথে সাথে তাদের জন্য অল্প খরচে বাড়ির বন্দোবস্ত করে দেওয়া উচিত- যাতে তাদের বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ি ঠিক করতে না হয়। আমি যখন জেলে ছিলাম এক সিপাহি আমাকে বলেছিল যে, ‘৬০ টাকা বেতন, তার মধ্যে বাসা ভাড়া দিতে হয় ১৮ টাকা। কারণ যে সামান্য কয়েকটা সরকারি বাড়ি আছে তাহা অন্য সিপাহিদের দেওয়া হয়েছে। আমাকে দেওয়া হয় নাই। কারণ আমি বড় কর্তাদের দালালি করতে পারি নাই।আমি বললাম, তাদের যদি না দেওয়া হতো তাহলে তো তাদেরও আপনার মতো দশা হতো। তাই একই কথা। এটা সত্য কথা যে একদিনে হয় না, কিন্তু সুষ্ঠু কর্মপন্থা থাকা দরকার।’(পৃ ১০৩)

কয়েক বছর রাজবন্দি থাকার পর জেলের অভ্যন্তরে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত মানুষদের দেখতে পেয়েছেন। আর পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের দুর্নীতির ভয়ঙ্কও অবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘১৪ বৎসরে রাজনীতিতে আমার শিখবার ও দেখবার যথেষ্ট সুযোগ হয়েছে। পূর্বে শুনতাম, দারোগা পুলিশের মতো ঘুষ কেউ খায় না। তারপর শুনতাম, সিভিল সাপ্লাইয়ের মতো ঘুষ কেউ খায় না, তারপর শুনতাম কাস্টমস অফিসারদের মতো ঘুষ কেউ খায় না। আমি কয়েক বৎসর রাজবন্দি হিসেবে জেল খেটেছি, তাতে দেখেছি জেলখানার ঘুষের মতো বৈজ্ঞানিকভাবে ঘুষ বোধ হয় কোনো ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীরা নিতে জানে না। কোনো দুর্নীতি দমন বিভাগের কর্মচারীর উপায় নাই যে সে ঘুষ ধরে! জেলখানা, পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্ট, কাস্টম্স, কোর্ট-কাচারি, সাব রেজিস্ট্রার অফিস, ইনকাম ট্যাক্স, কারো চেয়ে কেউ কম না, এই ধারণাই আমার শেষ পর্যন্ত হয়েছে। জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এই দুর্নীতি কঠোরভাবে দমন করা দরকার। নিরাপত্তা আইন যদি ব্যবহার করতে হয় তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করলে বোধ হয় জনসাধারণ এই নিরাপত্তা আইনের কোনো সমালোচনা করতো না। সকলের চেয়ে দুঃখের কথা হলো, অনেক দুর্নীতিপরায়ণ নেতা দেশে আছে যারা শাসকগোষ্ঠীর সাথে হাত মিলাইয়া চোরাকারবার করে লক্ষ লক্ষ টাকা উপায় করে। যখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো সৎ কর্মচারী মামলা দায়ের করতে চায় তখনই বড় বড় মন্ত্রীরা এই সমস্ত কর্মচারীদের বদলি করে মামলা ধামাচাপা দেয়।’(পৃ ১০৪)

৪.

বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলের অপরিসর একটি কুঠুরিতে রাখা হয়েছিলো। তাঁর জগৎ বলতে সেখানে ছিল চার দেওয়াল, একটি জানালা ও একটি উঁচু বিছানা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাঁকে সরিয়ে নেয়া হয় কারাগার থেকে দূরে আরো দুর্গম জায়গায়। ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক।

একাত্তরে পাকিস্তানের কারাভ্যন্তরে বন্দি ছিলেন ঠিকই; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন জানতেন না তিনি কোন শহরে আছেন। কেবল জানতেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে বন্দি করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে রেখেছে। কারাজগৎ জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভালোভাবেই ধারণা ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে প্রায়শই বলতেন যে, প্রথম দফার স্বল্পকালের কারাবাস ছাড়া তাঁকে কারাগারে বরাবর নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিল। দৈহিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও নানাভাবে মানসিক হয়রানি করা হয় তাঁকে।  কারা-কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে বন্দির আচার-আচরণ সম্পর্কে ইসলামাবাদে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতো। এই রিপোর্টে উল্লেখ থাকতো তিনি কি খাবার খেয়েছেন, তিনি কেমন ঘুমিয়েছেন, সেলের মধ্যে এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়াল অবধি পায়চারি করেছেন কি করেননি। বন্দির কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব উৎসুক ছিলেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু সেলে প্রবেশকারী গার্ডদের সালামের প্রতি-উত্তর দেওয়া ছাড়া সবসময় নীরবই থাকতেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়।...যখন বিপদ আমাকে আচ্ছন্ন করতো, আমি বুঝতে পারতাম আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। যখন আমার মনের দিগন্তে দেখা দিতো চকিত আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে।... একে বলতে পারেন প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা; আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই। এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। রক্ত সেই অতীব জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে জীবনকে এবং এমনি রক্তদান যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা বাঁচিয়ে রাখবে।’ বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর পরিবার সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী খবর ছড়ানো হতো। বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ :

‘সেই সময়ে আমার সেলে যাঁরাই এসেছিলেন তাঁদেরই দেখাতো অনেক কম আস্থাবান ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেতো না। বরং কোনো অজানা দুশ্চিন্তা যেন তাঁদের পীড়িত করতো।...

... এটা আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে এমন কোনো বিবৃতি আমার কাছ থেকে আদায়ের জন্য উপর্যুপরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন মিলেছিলো। আমি অনুভব করেছিলাম, তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত। এর ফলে আমার মধ্যে প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে তাদের দিন ভালো যাচ্ছে না। আমি তাদের কথা মান্য করতে অস্বীকার করি। আমি কোনো কিছু বলতে, লিখতে বা সই করতে অস্বীকার করি।’

৫.

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সাহিত্যিকরা তাঁদের ব্যক্তিগত কারা-অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে রূপায়ণ করেছেন। কখনো তা লেখকের সমকালীন ইতিহাস ও যুগকে আলোকপাত করে স্মৃতিকথা কিংবা গদ্য রচনায় উপস্থাপিত; কখনো বা বাস্তবতা-নির্ভর কথাসাহিত্যের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণে একই রকমের কারাজগৎ বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বে নানা বর্ণ ও প্রকৃতিতে স্বতন্ত্র মাত্রা লাভ করেছে। আসলে কারা-সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের একটি স্বতন্ত্র রূপ হিসেবে স্বীকৃত। লেখক সাধারণ কয়েদির মতো জেলহাজতে বন্দি কিংবা গৃহে অন্তরীণ সে সময় তিনি যে দিনপঞ্জি, স্মৃতিকথা কিংবা সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনা করেছেন তাকে কারা-সাহিত্য বলা হয়। আবার জেলের বাইরে থেকে যে কোনো মুক্ত ব্যক্তিও কারাভ্যন্তরের ঘটনাবলি নিয়ে কারা-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির ‘কারাজীবনের অন্তরালের ঘটনা, জেলখানার রীতিনীতি, শাসনপ্রণালি, পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং সেখানকার অন্যান্য বন্দি ও কর্মচারীবৃন্দ’-এর সবকিছু উন্মোচিত হওয়া আবশ্যক। বলা যায় কারা-সাহিত্য কারাগারের ভেতরের চিত্র তুলে ধরে। তবে বন্দিশালা সবসময়ই লেখকের জন্য একটি সংকীর্ণ পরিসর। তাঁর স্বাধীনতা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও সমঝোতার সুযোগ সেখানে সংকুচিত। অবশ্য অবারিত তাঁর কল্পনার আঙিনা। অনেক লেখককে পাওয়া যায় যাঁরা বন্দি হওয়ার পূর্বেই লেখনি ধারণ করেছেন। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এঁদের অন্যতম। তবে তাঁর রাজবন্দীর জবানবন্দী ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বসে লেখা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে নজরুলের মতো অসংখ্য কারাবন্দি তাঁদের জীবনাভিজ্ঞতা লিখে গেছেন। কেউ কেউ বন্দি জীবনের অভিজ্ঞতায় নির্যাতনের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার স্বাধীন দেশেও বন্দিত্বের যন্ত্রণার কথা লেখা হয়েছে। তবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭) ও আমার দেখা নয়াচীন (২০২০) কারা-সাহিত্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। প্রথম গ্রন্থটি তিনি ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ অবস্থায় লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টিও কারাবাসের সময় লিখিত। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বন্দি অবস্থায় করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে এস. এ. করিম উল্লেখ করেছেন- ‘করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে একটি অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়- যেখান থেকে লোহার শিক দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না- পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো- যা মূলত ঘরের গরমকে আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন বাংলাদেশের জন্য- যে বাংলাদেশটি তখন জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।’ কারা-সাহিত্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো- ক) কারাসাহিত্যে সমকালীন দেশ ও কালের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। খ) সমাজের অপরাধী জনগোষ্ঠী কারাজগতের জীবন্ত অংশ তেমনি জেলপ্রশাসনের দুর্নীতি ও অত্যাচারী প্রশাসনও তার অঙ্গ। গ) কারাকাহিনিতে রাজনৈতিক চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাস নেই; আছে রূপান্তর। ভারতের সন্ত্রাসবাদী স্বাধীনতাকামীদের আত্ম-উপলব্ধি, আত্মজিজ্ঞাসার প্রকাশ দেখা যায় অনেক রচনায়। ঘ) ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের অমানবিক নির্যাতন করা হতো। সিপাইরা প্রতিনিয়ত রাজবন্দিদের চরমতম অত্যাচারের জাল বিস্তার করত। ঙ) কারা গ্রন্থগুলি যে কোনো দেশের এবং কালের বিপ্লব আন্দোলনে এবং বিপ্লবী প্রেরণার ক্ষেত্রে স্থায়ী উপাদান হিসেবে ভাস্বর। চ) পৃথিবীতে যতদিন কারাগার এবং দ-ব্যবস্থা বর্তমান থাকবে ততদিনই কারাগারের অসামাজিক মানুষগুলিকে কেন্দ্র করে তাদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, ইন্দ্রিয় পীড়ন এবং বিভীষিকাময় মানসিক অবস্থা সাহিত্যের উপাদান হয়ে উঠবে। ছ) পাশবিকতা ও বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রাণের মৃত্যুঞ্জয়ী কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছে কোনো কোনো কারা-সাহিত্যে। জ) পৃথিবীর কোনো কোনো কারারুদ্ধ বিদগ্ধ সাহিত্যিক রাজা বা সরকারের কাছে মার্জনা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন যা ছিল দাসত্ব ও চাটুকারিতার সামিল এবং আত্মবিক্রিত মনোভাবের পরিচায়ক। ঝ) কারা-সাহিত্যে সমাজবিশ্লিষ্ট মানুষের নৈতিকতা অনেক গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে।

৬.

কারাসাহিত্যের বৈশিষ্ট্যানুযায়ী এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা ও আমার দেখা নয়া চীন-এই তিনটি গ্রন্থ পর্যালোচনার পর আমরা বলতে পারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারা-কাহিনিতে অবরুদ্ধ কারাপ্রাচীরে পিষ্ট মানবতা, কয়েদি জীবনের ব্যথা-বেদনার সঙ্গে তাদের সংকীর্ণতা, দলবাজি ও রাজনৈতিক মতান্তরে সৃষ্ট কলহ, শাসকদের স্বার্থবুদ্ধি ও আদর্শচ্যুতি; সর্বোপরি রাজবন্দির পরিবার ও সন্তানদের জন্য মর্মবেদনা প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম-ইতিহাস উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।বঙ্গবন্ধুর ৩০৫৩ দিনের কারাজীবনের বিবরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের ইতিহাসের কথাই বলবে।

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

বঙ্গবন্ধু   রাষ্ট্রপতি   জাতির পিতা   বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন   জন্মদিন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

এক বছরের রাষ্ট্রপতির যত অর্জন


Thumbnail

আজ ২৪ এপ্রিল। গত বছর এই দিনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সে হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আজ এক বছর পূর্ণ হল। অঙ্কের হিসেবে এক বছর সময় অনেক কম মনে হলেও এই সময় তিনি সেরা সাফল্য অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন যে সময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন সে সময়টা ছিল নির্বাচনী বছর। বাংলাদেশে নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত কোন দিকে যাবে ইত্যাদি নানা রকম শঙ্কা ছিল অনেকের মধ্যে। দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রপতির প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচন বিষয়টি যদিও নির্বাচন কমিশনের কাজ। কমিশন এটা আয়োজন করে থাকে। কিন্তু এর পিছনে আসল কাজটি করেছেন রাষ্ট্রপতি।

দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা এবং সেটাকে দেশে-বিদেশি সবার কাছে যোগ্য করে তোলার আসল কাজটি করতে হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। এই কাজটি রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেষ পর্যন্ত খুব ভালো ভাবে এবং সফল ভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন। গত এক বছরে এটিই এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সেরা অর্জন বা সেরা সাফল্য বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রপতি যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ ভাবে না করতে পারতেন তাহলে দেশের গণতন্ত্র এক বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি সেটি ভালো ভাবে সামাল দিতে পেরেছেন। আমাদের গণতন্ত্র রক্ষা পেয়েছে, গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।

আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ কথা না বললেই নয় যে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে নিয়ে আমি ব্যক্তিগত ভাবে গর্বিত। কারণ দেশের এক নম্বর নাগরিক বা রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্বেও তিনি যেভাবে সবার সাথে মিশেন সেটা অতুলনীয়। একজন মানুষ প্রকৃত অর্থেই মাটির মানুষ না হলে তার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। এখনও রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের গায়ে গ্রামের সেই ধুলোবালির গন্ধ পাওয়া যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যে ধ্যান ধারণা থাকার কথা সেটাও তার মধ্যে অত্যন্ত প্রখর এবং সেই চেতনা তিনি সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন বলেই আমার কাছে দৃশ্যমান হয়। সেজন্য আমি ব্যক্তিগত ভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ ধন্যবাদ দিতে চাই যে, তারা এ রকম একজন রাষ্ট্রপতিকে এই পদে মনোনয়ন দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিনের মনোনয়ন শুরুতে সবাইকে অবাক করলেও সেটা ছিল আমাদের অগত্যা। কারণ অনেকে তার সম্পর্কে সঠিক ভাবে জানতেন না। অথচ তিনি একজন স্থানীয় নেতা হয়েও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি পাবনার মত একটি জেলা শহরে থেকে তিনি এটি করেছেন। আমরা সেটার মাহাত্ম্য বুঝতে না পারলেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকরী ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আর সেজন্য রাষ্ট্রপতিকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। আমি প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন ইউসুফের কাছে শুনেছি যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং তার (প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন ইউসুফ হাত পা খাটের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এভাবে অনেক দিন তিনি জেল খেটেছেন। এরপর তিনি জেলে থেকেই আইন পাশ করেন। তিনি পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেন এবং জেলা জজ পর্যন্ত হয়ে তিনি তার চাকরির জীবন শেষ করেন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত হন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য হিসেবে এবং আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের নির্বাচন কমিশনের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন। রাষ্ট্রপতি হলেও এখনও তিনি আগের মতই সহজ-সরল রয়ে গেছেন। তার এই সরলতা ইতিমধ্যে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছে।

গত এক বছরে রাষ্ট্রপতির আরেকটি উল্লেখ্য করার মত সাফল্য হল যে, তিনি এমন ভাবে দায়িত্ব পালন করছেন বা এখন পর্যন্ত তার কাজকর্ম কিংবা সিদ্ধান্তগুলো দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি আগে কখনও কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে তিনি তার নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পেরেছেন। রাষ্ট্রের সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সহ সর্বশেষ তিনজন রাষ্ট্রপতি গণ মানুষের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে পেরেছেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, এরপর অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ এবং মো. সাহাবুদ্দিন তারা প্রত্যেকই অতি সাধারণ জীবন যাপন করে আপামর জনগণের মন জয় করে নিতে পেরেছেন। রাষ্ট্রপতি হবার আগে যে সাধারণ জীবন যাপন করেছেন রাষ্ট্রপতি হবার পরও একই ভাবে থেকেছেন।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের তালিকায় এমন রাষ্ট্রপতিও আছেন যারা রাষ্ট্রপতি হবার আগে এক রকম ছিলেন পরে আবার অন্যরকম ভাবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি হবার আগে যে আদর্শ ধারণ করতেন রাষ্ট্রপতির চেয়ার বসলে তাদের সেই আদর্শের বিচ্যুক্তি ঘটে। কিন্তু এক্ষেত্রে এই তিনজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা আগে যা ছিলেন রাষ্ট্রপতি হবার পর একই রকম থেকেছেন, আদর্শচ্যুত হননি। মো. সাহাবুদ্দিন যে আদর্শ ধারণ করেন সেই আদর্শে তিনি তার কাজকর্ম সফলতা সাথে করে যাচ্ছেন। আমরা তার উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি।


রাষ্ট্রপতি   মো. সাহাবুদ্দিন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনা ছাড়া কেউই অপরিহার্য নয়


Thumbnail

প্রথম দফায় উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন শেষ হয়েছে গতকাল। কিন্তু অবাক করার বিষয় যে, একমাত্র পলকের শ্যালক ছাড়া আর কেউই মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। অথচ আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনা আছে যে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী, এমপিদের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় স্বজনরা কেউ নির্বাচন করতে পারবেন। দলের সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগ সভাপতির এই নির্দেশনা ইতোমধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। মন্ত্রী, এমপিদের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে যারা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন তাদেরকে প্রত্যাহারের জন্য তিনি নির্দেশও দিয়েছেন। তিনি শেষ পর্যন্ত কেউই তা মানেননি। এতে করে সুস্পষ্ট ভাবে তারা আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনাকে অমান্য করেছে। যা দলীয় সিদ্ধান্তের লঙ্ঘন এবং গুরুতর অপরাধও বলে আমি মনে করি।

আওয়ামী লীগ যদি আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি টিকে থাকতে চায় তাহলে দলকে এবার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। এটা এখন সময়ের দাবি। যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি তারা ইনিয়ে বিনিয়ে এখন নানান অজুহাত তৈরি করছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের উচিত হবে এ সমস্ত অজুহাত না শোনা। কারণ যিনি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেছেন তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত পরিপন্থি কাজ করেছেন এটা সুস্পষ্ট। সুতরাং এখানে দল উচিত তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দল করলে তাকে দলীয় শৃঙ্খলা মানতেই হবে। অনথায় দল থেকে বাদ দিতে হবে। যারা দলীয় সিদ্ধান্তের পরিপন্থী কাজ করেন তারা কখনই দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এদের মত আট-দশ দলে না থাকলে আওয়ামী লীগের কিছু যায়-আসে না। একমাত্র আওয়ামী লীগ সভাপতি দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক ছাড়া আর কেউই আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য নয়। শেখ হাসিনাই কেবল মাত্র আওয়ামী লীগ এবং দেশের স্বার্থে অপরিহার্য। সুতরাং, এখন আমরা দেখতে চাই শৃঙ্খলা পরিপন্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

যারা আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্দেশনা অমান্য করেছেন তিনি দলের যত বড় নেতাই হোন না কেন তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। দরকার হলে দল থেকে তাদেরকে বাদ দিতে হবে কিংবা বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। শুধু বহিষ্কারই নয়, তাদের প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করতে হবে। এতে করে কারও যদি এমপিত্ব চলে যায় তো যাবে। কিন্তু দলের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে দলের স্বার্থে। তাদের আসনে যে কাউকে নির্বাচন করে জিতে আসতে পারবেন। কোন মন্ত্রী এমপি আওয়ামী লীগের জন্য অপরিহার্য নয়। যারা দলের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন উপজেলা গুলো প্রার্থী দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে দল কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখার জন্য গোটা দেশের মানুষ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের দিকে তাকিয়ে আছে।

অতীতে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে। বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও কঠোর পদক্ষেপ নেবেন এমনটি আশা আওয়ামী লীগের প্রতিটি তৃণমূল নেতাকর্মীর। এখন আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় আমরা সেটার অপেক্ষা আছি।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

শেখ হাসিনার সমালোচনা করলেও কেউই তার বিকল্প খুঁজে পান না


Thumbnail

দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর ১১ জানুয়ারি যে নতুন সরকার গঠন করেন আজ তার ১০০ তম দিন। এক কঠিনতম সময়ে তিনি এই সরকার গঠন করেছেন। কিছু বুদ্ধিজীবী নির্বাচনের আগে আগে নানান রকম কথাবার্তা বললেও সাধারণ মানুষ ঠিকই জানত যে, শেখ হাসিনাই আবার সরকার গঠন করবেন। কারণ তারা জানেন যে, শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। সরকার গঠনের পরও কিন্তু তাকে কঠিনতম সময় পার করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফলতা পাচ্ছেন। এজন্য একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমিও মনে করি যে, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার বিকল্প শেখ হাসিনাই। 

দার্শনিক শেখ হাসিনা এখন আগে দার্শনিক পরে রাষ্ট্রনায়ক। এতদিন তিনি ছিলেন আগে রাষ্ট্রনায়ক পরে এবং দার্শনিক। এখন তিনি আগে দার্শনিক পরে রাষ্ট্রনায়ক। কারণ তিনি একের পর এক দর্শনকে যেভাবে স্থায়ী রূপ দিয়ে যাচ্ছেন তাতে এদেশের সকলের মনোবলও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন মন্ত্রিসভাতেও তিনি দর্শনের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তিনি পুরনোদের সাথে নতুনদের যুক্ত করে নেতৃত্বের একটি চমৎকার ভারসাম্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। যা আমরা এই ১০০ দিনে বুঝতে পেরেছি এই নতুন মন্ত্রিসভার কাজকর্মে। সেদিক থেকে আমি অনুধাবন করতে পারি যে, এই ১০০ দিনে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত শতভাগ সফল।

গোটা বিশ্ব এখন যুদ্ধের মধ্যে পড়েছে। করোনার পর থেকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ গোটা বিশ্ব অর্থনীতিতে টলটলয়মান করে দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে। বলা যায় বিশ্বে একটা মিনি বিশ্ব যুদ্ধ চলছে। গাজায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরকম পরিস্থিতিতে দার্শনিক শেখ হাসিনার সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে আশার কথা যে, এখন পর্যন্ত তিনি সঠিক পথে আছেন এবং সফল ভাবে পুরো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। বিশ্বের অস্থির পরিস্থির কথা অনুধাবন করে তিনি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রকম নির্দেশনা দিচ্ছেন। যেমন-বিশ্ব বাজারে নতুন নতুন বাজারের সন্ধান। আমাদের যেন খাদ্য ঘাটতি পড়তে না হয় সেজন্য তিনি আগাম আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতেও তিনি জোরালো ভাবে আহ্বান করেছেন। 

একজন জেনারেলকে কীভাবে বিচার করা হয়? তিনি কয়টি ব্যাটল জয় করলেন সেটা দিয়ে কিন্তু নয়। তাকে বিচার করা হয় যখন তিনি একটা ব্যাটলে হেরে যান এবং তার সৈন্যরা যখন পুরো ভেঙে পড়েন ঠিক সে সময় তিনি কীভাবে তার সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে পারলেন সেটা বিবেচনায় নেওয়া হয়। দার্শনিক শেখ হাসিনাও সে রকম একজন জেনারেল, যে জেনারেল কঠিন সময়ে সাধারণ জনগণকে সবচেয়ে কম কষ্টে রেখে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও যেন তিনি সফল ভাবে নিয়ে যাবেন সেটা বলাই বাহুল্য। অনেকে তার সমালোচনা করছেন ঠিক কিন্তু কেউ তার বিকল্পের কথা বলতে পারছেন না। তিনি দলকে যেমন ধরে রেখেছেন বা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঠিক তেমনিভাবে সরকারকেও সঠিক পথে পরিচালনা করছেন। সুতরাং শেখ হাসিনার বিকল্প যে শেখ হাসিনাই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নতুন সরকারের প্রথম ১০০ দিনের মত সামনের দিনগুলোতে সাফল্য ধরে রাখবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

কতিপয় সাংবাদিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর


Thumbnail

বারো বছর আগের কথা। ডেভিড ক্যামেরুন তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। সে সময় একদিন তিনি একটি হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকে পড়লেন। রোগীর অনুমতি সাপেক্ষে রোগীর সাথে ছবি তুলতে গেলেন। বাঁধ সাধলেন ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা একজন চিকিৎসক। জীবাণু প্রতিরোধের কোন পদক্ষেপ না নিয়ে এবং চিকিৎসকের অনুমতি ব্যতিরেকে তিনি ওই কাজটি করছিলেন। ডেভিড ক্যামেরুন তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন সাথে সাথে। ক্ষমা চাইলেন এবং ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ভিন্ন চিত্র দেখলাম শনিবার সকালে বরিশাল সদর হাসপাতালে। দায়িত্বরত চিকিৎসক ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে যেয়ে দেখেন দুজন টিভি সাংবাদিক ওয়ার্ডে ভিডিও করছেন। ভিডিও শেষ হবার পর চিকিৎসক তাঁর রাউন্ড শুরু করলেন। রাউন্ড শুরু করতেই দুজন সাংবাদিক আবার ক্যামেরা ধরে চিকিৎসকের সাথে কথা বলা শুরু করলেন। চিকিৎসক তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। বিনয়ের সাথে নিচু স্বরে একে একে ২০ বার (গুনে নিশ্চিত হয়েই বলছি) সাংবাদিকের নাম জিজ্ঞেস করলেন, পরিচয় জানতে চাইলেন। উক্ত সাংবাদিক নাম বলেননি, পরিচয় দেননি। বরং উচ্চস্বরে উল্টা পাল্টা কথা বলেছেন, পাল্টা প্রশ্ন করেছেন। অবশেষে কর্তব্যরত চিকিৎসক উর্ধতন কাউকে ফোন দেয়ার পর সাংবাদিক সাহেব তার নাম বলেছেন। এখানে দুটি প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।  প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, সাংবাদিক দুজন কি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর হয়ে গেছেন ? দ্বিতীয় প্রশ্ন, সাংবাদিক দুজনকে কেন নাম বলতে হবে ? নাম, পদবি, পরিচয় থাকবে তাদের বুকে বা কোমরে প্রদর্শিত আই ডি কার্ডে। এখন দেখার বিষয়,  প্রদর্শিত স্থানে আই ডি ছিল কিনা ? না থাকলে থাকবে না কেন?

সাংবাদিক ও চিকিৎসকবৃন্দ ঘটনার ভিডিও চিত্র সমূহ পৃথকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন। সব গুলো ভিডিও কয়েকবার দেখেছি, পর্যালোচনা করেছি। দায়িত্বরত চিকিৎসক কখনোই উচ্চস্বরে কথা বলেননি। তিনি যথেষ্ট ধৈর্য্য, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। পক্ষান্তরে সাংবাদিক দুজন বারবার উচ্চস্বরে কথা বলেছেন। তাদের কথা বলার ধরণ দেখে মনে হয়েছে, এটি একটি মগের মুল্লুক। কর্তব্যরত চিকিৎসক ওয়ার্ড রাউন্ড শুরু করার আগে প্রতি রোগীর সাথে একজন এটেন্ডেন্ট ব্যাতিরেকে সবাইকে বের হবার কথা বলেছেন। সবাই বেরিয়ে না গেলে তিনি চিকিৎসা শুরু করতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন। সেটাই নিয়ম।  সারা দুনিয়ায় সেটাই হয়ে থাকে। সাংবাদিকদ্বয় সেটি শুনতে নারাজ। এখানে তারা স্পষ্টতই সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করেছেন, যা আইনত দণ্ডনীয়।  

দিন শেষে বেসরকারি টিভি চ্যানেলে দেখলাম সাংবাদিকদের হেনস্থা করেছে ডাক্তার। অথচ ভিডিও গুলি পর্যালোচনা করলে যে কেউ বলবেন, ডাক্তারকে হেনস্থা করেছে সাংবাদিকরা। আসলেই মগের মুল্লুক। ঘটনা কি ? আর সংবাদ শিরোনাম কি? এসব মগের মুল্লুকের রাজত্ব  থেকে জাতিকে পরিত্রান দেয়া প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিএমএ, এফডিএসএর, বিডিএফ ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ সমন্বয়ে একটি কমিটি করে দেয়া দরকার। কমিটি হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে ও তাদের দায়িত্ব নির্ধারণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে। সে নীতিমালায় যাতে স্বাস্থ্য কর্মীদের কাজে বাধা প্রদান না করা হয়, রোগীর অনুমতি ব্যাতিরেকে তাদের ছবি, ভিডিও বা রোগ সংক্রান্ত কোন তথ্য প্রকাশ বা প্রচার না করা হয়, সেসব বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে হাসপাতাল সমূহে এ ধরণের অরাজকতা হতেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে।  

লেখকঃ প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

প্রথম আলোর পর কী ডেইলি স্টারও বিক্রি হবে?


Thumbnail

এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন।

প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে অনেকেরই  ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী লোক।

এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।

তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।

এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।

আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম। সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায় যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।

ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।

তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।

তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।


প্রথম আলো   ডেইলি স্টার  


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন