ইনসাইড থট

শুভ জন্মদিন, পৌনে এক শতাব্দীতে আওয়ামী লীগ, অবিস্মরণীয় অর্জন!


Thumbnail

প্রায় পৌনে এক শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে যে আওয়ামী লীগ, যার নেতৃত্বে অর্জিত বাঙালির ভাষা-স্বাধীনতা, সংবিধান ও দেশ-জাতিগঠনে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন আর আর তাঁর কন্যার রূপকল্প। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির একবুক জ্বালা নিয়ে  শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সোনা বাংলা বিনির্মানে সব অর্জন অবিস্মরণীয় ও অকল্পনীয়। বাঙালির জীবনে সে তো  রূপকথার গল্পের ন্যায়। পদ্মাবতী খরস্রোতার নদীর বুকে পদ্মাসেতু উৎসব ধ্বনি প্রতিধ্বনির  আকাশে-বাতাসে যে অনুরণন,তা তো  আওয়ামী লীগের মহা অর্জন। সেই আওয়ামী লীগের  ভূমিষ্ঠকালীন বেদনা, মাতৃত্বকালীন প্রসব বেদনার ন্যায় অসহনীয় কষ্টের। 

আগেই দলের রূপকার করাচী হতে স্টিমারযোগে সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে গতিরোধ করা হয় নারায়ণগঞ্জে।তাকে মানহানিকর অবস্থায় ফিরে যেতে হয় করাচীতে। পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মুসলিম লীগের নাম "জাতীয়তাবাদী লীগ" রাখার প্রস্তাব করে  সদস্য পদ থেকেই বহিষ্কৃত হন। পাকিস্তান প্রস্তাবক সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তিনি। সেই তাঁকেই "ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুকুর"  বলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান।

মুসলিম লীগের সভাপতি খলীকুজ্জমান চৌধুরী সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীদের লীগে প্রবেশ বন্ধ করে দেন।   

পাকিস্তান অভ্যুদয়ের পরের বছর ভাষাসংগ্রাম শুরু হলে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে। উপনির্বাচনে বিজয়ী শামসুল হকের কেড়ে নেয়া হয় পরিষদ সদস্য পদ। তার আগে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের ওই একই আসনে  মওলানা ভাসানী বিজয়ী হলেও তাঁর সদস্য পদ কেড়ে নিয়ে নির্বাচনেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। 

এরকম এক বৈরী পরিস্থিতিতে দল গঠনে ডাকা হয় "মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন"। ঢাকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় খান সাহেব ওসমান আলীর অনুপ্রেরণায় নারায়ণগঞ্জের রহমতগঞ্জ ইনস্টিটিউটে সেখানেও বাধা। তারপর পাইকপাড়া। সেখানেও বিপত্তি। সরকারি পেটোয়া বাহিনীর রক্তচক্ষুর আড়ালে ঢাকা মিউনিসিপাল করপোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী বশীর হুমায়ুন বললেন, "সম্মেলন করুন আমার  রোজগার্ডেন-এ। সরকারি চোখ ফাঁকি দিয়ে সম্মেলনের  দু'দিন আগেই রাতের আঁধারে শওকত আলী গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘোড়ার গাড়িতে করে ভাসানীকে পৌঁছে দেন রোজগার্ডেনে।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুনের ঢাকার স্বামীবাগের বিখ্যাত রোজ গার্ডেন। প্রায় তিন শত কর্মীর ওই সম্মেলনে প্রথমে পবিত্র কুরআন থেকে তেলওয়াত পরিবেশন করেন মওলানা রাগীব আহসান। 

শামসুল হক "মূল দাবি" নামে একটি  প্রস্তাবটি উত্থাপন করে বলেন,  "ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ কেবল মুসলমানের নয়, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। ......  মানবতার চূড়ান্ত মুক্তিসংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়া এক কাতারে সমবেত হইতেই মুসলিম লীগ কর্মী-সম্মেলন আহবান জানাইতেছে। "পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ" নামে দল গঠনের ঘোষণা দেয়া হলে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানায় কর্মীরা। সম্মেলন চলে গভীর রাত পর্যন্ত। 

সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের এককালীন সভাপতি অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে নবগঠিত দলকে স্বাগত জানিয়ে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করে চলে যান।  

তখন চলছিল পাকিস্তানে চরমতম রাজনৈতিক সংকট। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে প্রথমে বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববাংলাকে বেছে নেয়া হয় দল গঠনের জন্য। পাকিস্তান প্রস্তাবক  স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলগঠনের মূল ভরসা। বাংলার প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় সর্বস্ব হারিয়ে করাচীতে আসেন। তাঁর পড়লো পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আড়চোখ। অথচ সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের  বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ভারতের প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলায় কেবল নিরঙ্কুশ জয় পায়। সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ববাংলায় নিষিদ্ধ করলেন যে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সেই তিনি গণপরিষদের সদস্য হন সোহরাওয়ার্দীরই ছেড়ে দেয়া কলকাতার আসনের উপ-নির্বাচনে। এরপর ১৯৪৯ সালের ৯ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ববাংলা আসেন। তিনি পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কপার্স মামলা পরিচালনার কথা বলে। তিনি একান্ত অনুগামী শওকত আলীর পরামর্শে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের পুরানো ঢাকায় "নূরজাহান বিল্ডিং" এসে ওঠেন। পুরান ঢাকার ১৫০ মোগলটুলীর মুসলিম লীগের নবীন কর্মীরা দলের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা জানান নেতাকে। সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে ইতিপূর্বে টাঙ্গাইলে ফেরা আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে ঢাকায় ঘাটি বাঁধতে বলেন। শাহজাহানের  বাসায় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে দলগঠন নিয়ে শলাপরামর্শ হয়। মওলানা ভাসানী আসামের ধুবড়ী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং আলী আমজাদ খানের বাসায় ওঠেন। যাহোক বৈঠকে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমেদ, ঢাকার শওকত আলী, আলী আমজাদ খান, খন্দকার আব্দুল হামিদ ও ইয়ার মোহাম্মদ খানও ছিলেন। বৈঠকে প্রস্তুতি কমিটি গঠন নিয়ে শুরুতেই বিরোধ হয়। আলী আমজাদ খানকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করা হলে শওকত আলী ও খন্দকার আব্দুল হামিদ বিরোধিতা করেন। পরে মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। খান সাহেব ওসমান আলীর আশ্বাসের বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় 
সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে না পারলেও তাঁরই  দিকনির্দেশনায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। নিজে সভাপতির আসন অলংকৃত করে অবাঙালি মাহমুদুল হক ওসমানীকে সাধারণ সম্পাদক করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি করা হয় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে। শামসুল হককে  সাধারণ সম্পাদক করে কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। পাঁচজন সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন,অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ খান, আলী আহমেদ খান ও আব্দুস সালাম খান। যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও আরেকজন ছিলেন  খন্দকার মোশতাক আহমেদ। সহ যুগ্ম সম্পাদক করা হয় এ কে রফিকুল হোসেনকে। পরের দিন আরমানীটোলায় জনসভা করা হলো। কিন্তু সরকারের ঈশারায় সেই ২৪ জুনের জনসভায় বাদশা বাহিনীর দল হামলা চালালো।  ১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর দ্বিতীয় জনসভাও আরমানীটোলায়। ওদিন ঢাকায় আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান। খাদ্য সংকটের প্রতিবাদে আরমানীটোলা থেকে  আওয়ামী মুসলিম লীগ বিক্ষোভ প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে গর্ভনর হাউজ অভিমুখে রওয়ানা হয়। পথিমধ্যে গ্রেফতার হন ভাসানী, শামসুল হকসহ অনেক নেতা। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ মুজিব করাচীতে নেতা সোহরাওয়ার্দীর কাছে চলে গেলেও এসেই গ্রেফতার হন। 

১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে ঢাকার ৯০ নবাবপুর একটা রুমে দুইটা টুল একটা টেবিল, দুইটা চেয়ার নিয়ে অফিস খুলে বসেন। ওখানে দলে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ভবঘুরে মোহাম্মদউল্লাহ (পরে রাষ্ট্রপতি ও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনি মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি ) কাজ চাইলে শেখ মুজিব তাকে দপ্তর সম্পাদক করেন।  

ছাত্রলীগই কার্যত আওয়ামী লীগের মাতৃসংগঠন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলার মানুষকে কোণঠাসা করে রাখার কারণে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ এই দল।

পাকিস্তানি শাসকবর্গ এবং মুসলিম লীগ নতুন দলটির আবির্ভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীকে ‘ভারতীয় চর’ বলে প্রচার চালিয়ে বাঙালিদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগের ৪০ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি দলকে দ্রুত একটি শক্তিমান সংগঠনে পরিণত করতে থাকে।

নতুন দলটির অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার (যার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন ও সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন) সন্ত্রাস, গোলযোগ সৃষ্টি এবং দমন-নিপীড়ন চালাতে থাকে। তারা আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে নতুন দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। তবুও দলটি বিকশিত হতেই থাকে। প্রতিরোধের মুখে পড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ সংগ্রামী দল হিসেবে আরও দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। চলতে থাকে তাদের গণমুখী আন্দোলন-সংগ্রাম।

আগেই বলেছি মওলানা ভাসানী ও শামসুল হককে ১৯৪৯ সালের ১৪ অক্টোবর এবং শেখ মুজিবকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সর্বপর্যায়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়গুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে। শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবিতে কারাগারের ভিতর অনশন শুরু করেন। এতে আন্দোলন হয়ে ওঠে আরও বেগবান। একই বছর পুনরায় ভাসানী ও শামসুল হক গ্রেফতার হন। কারাগারে শামসুল হকের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হলে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

"প্রথম কাউন্সিল" 
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষণায় আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকারসহ পূর্ব বাংলার জন্য লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, কৃষকদের মধ্যে কৃষি জমির বণ্টন, তে-ভাগা নীতির বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে সমবায় ও যৌথ কৃষি ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সব দেশি ও বিদেশি মৌলিক শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানকে সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশি প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করার অঙ্গীকারও ছিল এ ঘোষণায়। ১৯৫৩ সালের ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে পূর্ব-বাংলার আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে অন্য দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগ শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টির সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। পরে এই ফ্রন্টে আরও যুক্ত হয় গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টি, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা নির্বাচনী ঘোষণায় পূর্ববাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দাবি আদায়ের কথা বলা হয়। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ২৩৭ আসনের মধ্যে ২২৭টি আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়। এর মধ্যে ১৪৩টি আসন পায় আওয়ামী মুসলিম লীগ। কৃষক-শ্রমিক পার্টি লাভ করে ৪৮টি আসন। মুসলিম লীগ মাত্র ১০টি আসন পায়।  

একই বছরে ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয় ফজলুল হক মন্ত্রীসভা। আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রথমে এতে যোগ না দিলেও পরে আবুল মনসুর আহমেদ, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রী করা হয়। যুক্তফ্রন্ট তথা আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্য এই নির্বাচনী বিজয় যুগান্তকারী ঘটনা হলেও পরবর্তীতে ফ্রন্ট ও দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলার কারণে অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার এই সুযোগে ৯২-ক ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। একই সঙ্গে রাজনৈতিক তৎপরতাও নিষিদ্ধ করা হয়। প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার করে জেলে নিক্ষেপ করা হয়।

"দ্বিতীয় কাউন্সিল" 
মওলানা ভাসানী ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন পল্টন ময়দানের সমাবেশ এবং ২৩ জুন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পূর্ব বাংলায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ আগের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। দলের হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার  শক্তিশালী সাংগঠনিক বিস্তৃতির জন্য ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর (১৯৫৫) ঢাকার রোজ গার্ডেনে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক ও অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়।

এ অধিবেশনেই দলকে অসাম্প্রদায়িক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা বাতিলের দাবিতে ১৯৫৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রস্তাব তোলে। প্রাদেশিক পরিষদের ২৯৭ সদস্যের মধ্যে ২০০ জন এতে স্বাক্ষর দেন। বাধ্য হয়ে আবু হোসেন সরকার ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট পদত্যাগ করেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ৬ সেপ্টেম্বর। এর মাত্র কয়েকদিন পর ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার পতন১৯৫৫ সালের ১১ আগস্ট চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। কেন্দ্রে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ১২ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার। বৈদেশিক সিয়াটো চুক্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর মধ্যে।

প্রসঙ্গত: সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর দ্বন্দ্বের আগে যুক্তফ্রন্টের দ্বন্দ্ব ও কোন্দল পাকিস্তানের রাজনীতিকে টালমাটাল করে দিয়েছিল। যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, পূর্বপাকিস্তান আইন পরিষদের নেতা হবেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নেতা হবেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইল দক্ষিণ আসনের নির্বাচনে জমিদার খুররম খানের বিরুদ্ধে  বিজয়ী হয়েও অকৃতকার্য হওয়ার পরই ঘোষণা করেছিলেন তিনি কোনদিন নির্বাচন করবেন না। সে কথা তিনি রেখেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৩ টি আসন পেলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৪৮ আসন পাওয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির শেরেবাংলাকেই মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সরকার গঠনের সুযোগ দেন সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী নেতৃত্ব।  

কিন্তু বিস্ময়করভাবে শেরেবাংলা তার দলের পাঁচজনকে নিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৫ দিনের মাথায় শেরেবাংলা আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। আর সেই সময় পাকিস্তানী চক্রান্তে আদমজীতে লাগানো হয় দাঙ্গা। বিহারী-বাঙালী দাঙ্গা। বহু প্রাণ ঝরে পড়ে ওই দাঙ্গায়। মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ৯২- ক ধারা জারি করে শাসন ক্ষমতা কেন্দ্রের অধীনে নেয়া হয়। পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে গা দেন বাঙালী নেতারাও। শেরেবাংলা পূর্বপাকিস্তানের গর্ভনর হয়ে কৃষক-শ্রমিক পাটি ও আওয়ামী লীগকে দিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব আইন পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। তাতে সরকারের পতন ঘটে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে আওয়ামী লীগ। মুখ্যমন্ত্রী হন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আতাউর রহমান খান। আবুল মনসুর আহমদ, আব্দুস সালাম খান, খয়রাত হোসেন, হাশিমুদ্দিন আহমেদ, কংগ্রেস দলের মনোরঞ্জন ধর, গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী মন্ত্রিসভায় স্থান পান।বেশ কয়েকবার মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। একবার আওয়ামী লীগ আরেকবার কৃষক-শ্রমিক পার্টি। একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের ২৩ জন আইন পরিষদ সদস্য শেরেবাংলার কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যোগদান করে মন্ত্রিত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু পাদগ্রহণ করে আবু হোসেন সরকারকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শেরেবাংলার সরকারে যোগ দিয়ে এর মধ্যে হাশিমুদ্দিন মন্ত্রী হন, খন্দকার মোশতাক আহমেদ চিফ হুইপ  এবং খালেক নেওয়াজ খান হুইপ হন। সর্বশেষ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যখন পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় তখন সারা পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে ক্ষমতায়। ডাঃ খান সাহেবের রিপাবলিকান পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তখন ইস্কান্দার মির্জা। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কর্তৃক খাজা নাজিমুদ্দিনের পতনের পর বাঙালি মোহাম্মদ আলী, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফিরোজ খান নুন ও আই আই চুন্দ্রিগর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্ব করেন। এর মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ১৩ মাসের অধিক প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী বিরোধ এ সময় চরমে পৌঁছে বৈদেশিক নীতি নিয়ে। ভাসানী সিয়াটো চুক্তি মানছিলেন না। দলের নেতৃত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে তাঁর অনুসারীরা ভাসানীকে উস্কে দিচ্ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক পদে অলি আহাদ উঠে আসার জন্য বিশেষভাবে কলকাঠি নাড়ছিলেন।

এক পর্যায়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে অলি আহাদ প্রশ্ন তুলেন যে, গঠনতন্ত্রে স্পষ্টত বলা রয়েছে যারা মন্ত্রী হবেন তারা কেউ দলীয় পদে থাকবেন না। মূলত, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল। ধারনা করা হচ্ছিল যে মন্ত্রিত্ব রেখে শেখ মুজিব সাধারণ সম্পাদক পদ ছেড়ে দেবেন, কিন্তু সে ধারণার মৃত্যু ঘটে সঙ্গে সঙ্গেই শেখ মুজিব মন্ত্রী পদে ইস্তফা দেয়ায়। এরপরই শুরু হয় নতুন চক্রান্ত। 
 
প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর এক ইউনিট ফর্মুলা ও সিয়াটো চুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগে চরম বিরোধ দেখা দেয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী পদত্যাগ করেন। প্রকৃতঅর্থে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বিরোধের প্রথম সূত্রপাত ঘটে '৫৫ সালে যখন দলকে না জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী মোহাম্মদ আলীর আইনমন্ত্রী হিসাবে যোগদান করেন। শুধু তিনিই নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন শেরেবাংলাও। করাচীতে সাংবাদিকরা নবনিযুক্ত আইনমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে প্রশ্ন করেন যে, মন্ত্রীত্বগ্রহণ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও মেনিফেস্টো পরিপন্থী কিনা? সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, "আওয়ামী লীগ আবার কি,সোহরাওয়ার্দী গর্জে উঠে বলেন, "আওয়ামী লীগ আবার কি, আমিই আওয়ামী লীগ, আমিই মেনিফেস্টো আমিই গঠনতন্ত্র। " আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এনিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও সোহরাওয়ার্দীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে কোন নেতা টু-টা শব্দটি উচ্চারণ না করলেও দলীয় নেতৃত্বে চরম অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। কাউন্সিলে সিয়াটো চুক্তি বিপক্ষে ভোটদানের ব্যবস্থা করা হলে সোহরাওয়ার্দীর পক্ষে পড়ে ৫০০ ভোট, অপরদিকে ৩৫ টি ভোট পড়ে চুক্তির বিরুদ্ধে। এমন পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগ পদত্যাগ করে বসেন। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বরাবরে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রটি শেখ মুজিবুর রহমানকে দিতে বলা হয়। অলি আহাদ সাধারণ সম্পাদককে না দিয়ে সংবাদ অফিসে চলে যান। জহুর হোসেন চৌধুরীর হাতে তুলে দেন পদত্যাগপত্রটি। যা পরের দিন প্রকাশিত হলে আওয়ামী লীগে অলি আহাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। বৈঠকে অলি আহাদকে বহিষ্কার করা হয়।

১৯৫৩ সালে আব্দুর রহমান বহিষ্কার হলে অলি আহাদ প্রচার সম্পাদক হন। '৫৫ সালের কাউন্সিলে কোরবান আলীর স্থলে অলি আহাদ সাংগঠনিক হন। অলির পক্ষে  ১১ জন নেতা পদত্যাগ করেন। আইন পরিষদের এসব নেতা  সদস্য হলেন শ্রম সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদ, মহিলা সম্পাদিকা সেলিনা বানু, ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম, প্রথম সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান অন্যতম। আওয়ামী লীগ ভাসানীর পদত্যাগ পদ ফিরিয়ে দিয়ে কাউন্সিল ডেকে আবারও সভাপতি করে। ১৬ জুন অসুস্থ ভাসানী হাসপাতাল থেকে এক বিবৃতিতে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন। ১৭ জুন অপর এক বিবৃতিতে ২৫ ও ২৬ জুলাই তিনি ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান ‘গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন’ ডাকেন। দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব ১৩ জুলাই বিবৃতিতে এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের যোগদান না করার আহ্বান জানান। ২৫ জুলাই গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। কেন্দ্র ও প্রদেশের সভাপতি হন ভাসানী এবং কেন্দ্রে সাধারণ সম্পাদক করা হয় মাহমুদুল হক ওসমানীকে। প্রদেশে সাধারণ সম্পাদক হন মাহমুদ আলী।  

এরপর আইন পরিষদ অধিবেশনে ঘটে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যা। স্বভাবতই আসে সামরিক শাসন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হটিয়ে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন তিনি। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে নিক্ষেপ করা হয় কারাগারে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন : সামরিক শাসন প্রত্যাহারের আগে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ জেনারেল আইয়ুব খান একটি শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করেন, যার মধ্যে গণতন্ত্রের লেশমাত্রও ছিল না। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা এবং এই প্রেসিডেন্টকে নির্বাচিত করার জন্য উভয় প্রদেশে ৪০ হাজার করে ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ নির্বাচনের বিধান ছিল এই শাসনতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান এবং নূরুল আমীনের মতো মুসলিম লীগ নেতাও আইয়ুবের প্রবর্তিত এই শাসনতন্ত্র বাতিল করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন (নয় নেতার বিবৃতি, ২৫ জুন ১৯৬২)।

১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতে গণতন্ত্রের মানুষ পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রহস্যময় মৃত্যু ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদসহ দলের প্রবীণ নেতারা  বিরোধিতা করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে শেখ মুজিবের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ৬ মার্চ প্রায় এক হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মাওলানা তর্কবাগীশকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।  

ঐতিহাসিক ছয় দফা : ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় কনভেনশনে শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেন। এতে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ছয় দফাকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি’ বলে আখ্যায়িত করে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলেন, ‘শেখ মুজিবের এসব দাবি অস্ত্রের ভাষায় মোকাবিলা করতে হবে। ’

শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ ঢাকার হোটেল ইডেনে আহ্বান করেন সামরিক শাসনোত্তর দলের বৃহত্তম কাউন্সিল অধিবেশন। প্রায় পনেরোশ’ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এই অধিবেশনেই ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে ছয় দফা কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়। এ কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। কাউন্সিল অধিবেশনের পর শেখ মুজিবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছয় দফার প্রচারণায় নেমে পড়েন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশদ্রোহী সাব্যস্ত করার জন্য সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। গর্জে ওঠে ছাত্রজনতা। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সংঘটিত হয় উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। কারাগার হতে মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন শেখ মুজিব। ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া খান বসেন প্রেসিডেন্টের গদিতে। অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। যে নির্বাচনে ছয় দফার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। ফলাফলের পর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। জাতীয় পরিষদে মাত্র ৮৮টি আসন লাভকারী পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টোর ষড়যন্ত্রের মূল হোতা।  

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে সাংবাদিকদের কাছে শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে অভিহিত করে গেলেও পাকিস্তানে গিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করেন। "৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান  ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুঁসে উঠে পূর্বপা২ মার্চ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।  

৩ মার্চ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ডাকসু কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে 'জাতির পিতা" হিসেবেও অভিহিত করা হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতারের প্রাক্কালে বাংলাদেশ স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বার্তা প্রেরক হিসাবে এম হান্নান এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ঘোষণা করেন। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব হাতে নেয় মুক্তিযুদ্ধের।

যে সরকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থ মন্ত্রী এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে গঠিত হয়। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী, হুইপ আব্দুল মান্নান ও ব্যারিস্টার আমির উল ইসলাম। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন।

এছাড়াও শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স- বিএলএফ) নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্ব ছিল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। নয় মাসের যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় তা অর্জিত হয় তা বঙ্গবন্ধুর নামে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। "৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে। কিন্তু ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে দেশে সংসদীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল করেন- '৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু সভাপতি হয়ে সাধারণ সম্পাদক করেন জিল্লুর রহমানকে। '৭৪ সালের কাউন্সিল করে বঙ্গবন্ধু সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। এইচ এম কামরুজ্জামানকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক করেন।

এরপর বাকশাল প্রতিষ্ঠার কথা আগেই তুলে ধরেছি। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় ১৯৭৭ সালের ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছিলেন। আওয়ামী লীগেরআওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, প্রচার সম্পাদক সরদার আমজাদ হোসেন প্রমুখ নেতা কারাগারে বন্দী থাকায় সরকারের কাছে রাজনৈতিক দলবিধি আইনের আওতায় দলের অনুমোদনের জন্য আবেদন পত্র যাবে কার নামে? সেই প্রশ্ন দেয়। সভাপতি এএইচএম কামরুজ্জামান নিহত হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। মহিলা সম্পাদিকা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আইন মন্ত্রণালয় বরাবরে রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেন।  

কিন্তু দলীয় মেনিফেস্টোতে বঙ্গবন্ধুর নাম থাকায় তা অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে বৈঠকে বসে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিতে হয় নতুন মেনিফেস্টো ছাপাবার। পীড়াদায়ক হলেও সেদিন আওয়ামী লীগকে "বঙ্গবন্ধুর" নাম বাদ দিয়েই মেনিফেস্টো ছাপিয়ে পুনরায় আবেদন করতে হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ৪ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে অনুমোদন দেয়া হয়। মিজানুর রহমান চৌধুরীর বাড়ির ছাদে সামিয়ানা টাঙ্গিয়ে আওয়ামী লীগ পুনর্জীবনের বৈঠক করা হয়।  

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও মিজানুর রহমান চৌধুরী যৌথভাবে দলের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। কাউন্সিলে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে আহবায়ক করা হলেও ১৯৭৮ সালে আবার কাউন্সিল করা হয়। এতে সভাপতি হন আবদুল মালেক উকিল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পাল্টা কমিটি গঠিত হয়। ফলে আওয়ামী লীগ (মালেক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) আত্মপ্রকাশ করে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষ্যমতে, তাঁকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আওয়ামী যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ভূমিকাই প্রথম। আওয়ামী যুবলীগের যখন চেয়ারম্যান আমির হোসেন আমু এবং ছাত্রলীগের সভাপতি যখন ওবায়দুল কাদের। গত ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই একথা বলেন।

১৯৮১ সালের কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা সভাপতি ও আবদুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দিলে তাঁকেসহ বেশকিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। মহিউদ্দিন আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাক মিলে আবার বাকশাল পুনর্জীবন করেন। আবদুর রাজ্জাক বহিষ্কার হলে  যুগ্ম-সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯২ সালের কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে জিল্লুর রহমানকে নির্বাচিত হন।

১৯৯৭ সালের কাউন্সিলেও শেখ হাসিনাকে সভাপতি ও জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ২০০২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের কাউন্সিলে শেখ হাসিনা ও আবদুল জলিল এবং ২০০৯ সালের ২৪ জুলাই কাউন্সিলে সভাপতি পদে শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নির্বাচিত হন।  

২০১৩ সালের কাউন্সিলেও এ দুজনই যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। পরের দুটি কাউন্সিলে শেখ হাসিনা সভাপতি ও ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরই মধ্যে মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় আগামী ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল নিয়েও তোরজোড় শুরু হয়েছে। দীর্ঘ সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয় এবং সেটা ২১ বছর পর।

২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে চরম আন্দোলন করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে চরম নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। অলৌকিকভাবে তিনি বেঁচে গেলেও আইভি রহমান, মোশতাক আহমেদ সেন্টুসহ ২৪ জন নিহত হয়। ২৯ বার বিভিন্ন হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা ওয়ান ইলেভেন সরকারের রোষানলে পড়ে দুবছর কারাবন্দী ছিলেন।  তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে মহাজোটের আসন ছাড়াই দলগতভাবেই টু-থার্ট মেজরিটি নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল পাস করে সুপ্রিমকোর্টের ঐতিহাসিক রায়েয় ভিত্তিতে ফেরা সম্ভব হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে। অর্থাৎ  জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র তার মূলমন্ত্র স্বাধীনতায় প্রবর্তন করেছে, যাতে লেপ্টে রয়েছে এক সাগর শহীদের রক্ত ও  মা-বোনেরা সম্ভ্রম। শেখ হাসিনার সুদক্ষ শাসনে পৃথিবীর বুক দেশ বাংলাদেশ এক  উন্নয়নের রোল মডেল। আইনের শাসনও প্রাতিষ্ঠানিকরূপলাভ করেছে। বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের। ফাঁসিতে ঝুলেছে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। শেখ হাসিনার প্রশংসা পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রনায়কের মুখে। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে বাংলাদেশের একেকটি অগ্রগতির দিকে। পদ্মাসেতুর দিকে  বিশ্বব্যাংকের অনুকম্পায় নয়,  পদ্মাসেতু আজ দৃশ্যমান আমার টাকায়, আমাদের টাকায়। পদ্মার দুপারের চোখ ২৫ জুনের দিকে। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী উৎসবের দিকে। পৃথিবীর চোখে বাংলার বুকে পদ্মাসেতু যেনো "অষ্টম আশ্চর্য"। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, আর স্বাধীনতার সূর্য উদয়ের পথে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্মে ছিলো আওয়ামী লীগ।  মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। তাঁর নির্দেশিত পথে মুজিব নগর সরকারের নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক বাংলাভাষা ভিত্তিক একটি বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের। ইতিহাসের কী অপূর্ব যোগসূত্র, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপত বঙ্গবন্ধু এবং সেই স্বাধীন দেশের আধুনিক স্থপতি তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা আজ এক ও অভিন্ন সত্তা।     

আওয়ামী লীগের এ জন্মদিনে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি দলটির স্বপ্নদ্রষ্টা গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আওয়ামী লীগ শুভ জন্মদিনে অনিঃশেষ অভিনন্দন তোমায়। তুমি বেঁচে আছো বলেই তো বাংলাদেশের মুখে আজ হাসির ফোয়ারা! 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।

আওয়ামী লীগ   প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

"মনোযোগের প্রতি মনোযোগী হোন"


Thumbnail

এরিক আর্থার ব্লেয়ার (১৯০৩-১৯৫০) কালউত্তীর্ণ  সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখক। ব্রিটিশভারতে জন্মগ্রহণকারী "এনিমেল ফার্ম" খ্যাত এই ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "1984" প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই বিখ্যাত উপন্যাসটিতে যে সকল সংকটের কথা কল্পনা করা হয়েছিল এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে তথ্যের স্বল্পতা। ভবিষ্যতের শাসকরা আরো বেশি করে তথ্য আটকে রাখবে, তথ্য পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটেনি। তথ্যের স্বল্পতা ১৯৮৪ সালে প্রকট হয়নি। আর এখন তো সবচেয়ে সহজে যা পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে 'তথ্য'। অন্যান্য পণ্যের মতো তথ্যও উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করা যায়। পণ্য হচ্ছে, "anything that can be offered to a market for attention, acquisition, use or consumption that might satisfy want or need" (Kotler, 2022)। পণ্যের সংজ্ঞায় দখল, ব্যবহার এবং ভোগের আগেই 'মনোযোগ' শব্দটি গুরুত্ব পেয়েছে। William James তাঁর Principles of Psychology (1980) বইয়ে মনোযোগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, "attention is the taking possession by the mind, in clear and vivid form, of one out of what may seem several simultaneously possible objects of trains of thought ... It implies withdrawal from something in order to deal effectively with others. 

" মনোযোগ বলতে নির্দিষ্ট একটা বিষয়কে ফোকাস করাকে বুঝায় না, একই সাথে এটা অসংখ্য প্রতিযোগী তথ্য এবং উদ্দীপককে অগ্রাহ্য করাকেও বুঝায়। যা এ মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয় সেটাকে এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি আকর্ষিত হওয়াই মনোযোগ ( Kendra Cherry, 2022)। কোন পণ্যকে ভোক্তা কিভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা অনেকাংশেই তাঁর প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের একটি পূর্বশর্ত। কোন নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রীয় সমূহকে নিবদ্ধ করার নামই হলো মনোযোগ। যে মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক বিষয় থেকে চেতনাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ বিষয়ে চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা হয় তাকে মনোযোগ বলে। ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের খরচ গত দুই দশকের ৭ থেকে ৯ গুন বেড়ে গেছে। ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করা মার্কেটিংয়ের কাজ। মার্কেটিংয়ের চুম্বকীয় বার্তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে সেটা ক্রেতার মনোযোগ দখল করতে পারে। এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েও কোন লাভ হবে না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোন বিকল্প নেই (Rebecca Riserbalo,2021)। "মনোযোগ বারজাতকরণ" শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন Steve Jerry, পরবর্তীতে এটাকে জনপ্রিয় করে তোলেন Seth Godin. মনোযোগ বাজারজাতকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Rebecca Riserbalo বলেন, '"Attention marketing is the concept that marketing is all about capturing and engaging your audience's attention. This is usually done through non-invasive means, like social media. With attention marketing you'll focus on how to capture someone's limited attention"(Rebecca Riserbalo, "Attention Marketing", 2021)। Microsoft এর এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গড়ে ব্যক্তির মনোযোগের স্থায়িত্বকাল ৪ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে একজন মানুষ একটানা গড়ে কোন বিষয়ে ১২ সেকেন্ড মনসংযোগ করতে পারতেন, ২০১৫ সালে এটা ছিল ৮ সেকেন্ড। এর মানে হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, অন্যথায় সে স্করল (scorl) করে অন্যদিকে চলে যাবে। মনোযোগ হল কোন বিশেষ তথ্যের উপর কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের  চেতনায় আসে। আমরা বিশেষ কোনো তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেই কোন পদক্ষেপ নিব কি, নিব না (Davenport & John, 2001)। মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে (Crawford ,2015)। এক সাথে অনেকগুলো বিষয়ে মনোযোগ দেয়া প্রায় অসম্ভব। দানবীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন google, মেটা, Apple, আমাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তথ্য সেবা দিচ্ছে। আর আমরা মনোযোগ দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করছি। (একই প্রক্রিয়ায় দেশে বিদেশে অবস্থানকারী কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইউটিউবারের (বাটপার) মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্ভট কন্টেন্ট দেখে দর্শকরা তাদের ভরণপোষণ করছে।

কেউ কেউ গত দুই দশকের অর্থনীতিকে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন। মনোযোগের অর্থনীতি কথাটি বহু পুরাতন। আজ থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, ১৯৯৭ সালে মাইকেল গোল্ডহেবার "Wired" সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর "Attention Shoppers" নিবন্ধে প্রথম মনোযোগ অর্থনীতির বিষয়টির অবতারণা করেন। কোন অর্থনীতিতে অনেক মানুষ যখন তথ্য ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে সেটাকে তথ্য অর্থনীতি বলে। 

গোল্ডহেবার বলেন, তথ্য অর্থনীতি কথাটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোন সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো কিভাবে ব্যবহার করবে তার চর্চা। ("Economics is the science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which  have alternative uses"- Lionel Robbins)। আজকের দিনে তথ্য কোন দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়। যেটা দুষ্প্রাপ্য সেটা হচ্ছে মনোযোগ। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অর্থনীতির মূল নির্ধারক মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।

মানব ইতিহাসের সিংহভাগ জুড়ে তথ্য ছিল দুষ্প্রাপ্য। কয়েক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া জানতো না। আধুনিক যুগে সবাই সবকিছু প্রায় বিনামূল্যে পড়ছে। মানুষের সময় এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষমতা একটুও বাড়েনি। মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ। একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অন্যটির প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। প্রচুর তথ্য সম্পদ মনোযোগের দারিদ্র্য তৈরি করে। ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী মনোবিজ্ঞানী হারবার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, "একটি তথ্য সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছুর ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা হলো তথ্য যা ভোগ করে। তথ্য কি ভোগ করে? এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে। মার্কেটিংয়ে তথ্য নিজেই একটি পণ্য, অপরদিকে এটি একটি মার্কেটিংয়ের কৌশলগত হাতিয়ার। মনোযোগ হচ্ছে বিনামূল্যে পাওয়া তথ্যের জন্য প্রদেয় ক্রেতার মূল্য (Herbert Simon, 1971)। তথ্য বিস্ফোরণ (information overload) বাজারজাতকরণকে সহজ করার পরিবর্তে জটিল করে তুলেছে। "Information overload is the difficulty in understanding an issue and effectively making decisions when one has too much information (TMI) about that issue,  and is generally associated with the excessive quantity of daily information". ১৯৭০ সালের প্রকাশিত বেস্ট সেলার বই "Future Shock" এর লেখক Alvin Toffler তথ্য বিস্ফোরণ বা information overload বিষয়টি নিয়ে সবাইকে মাথা ঘামাতে বলেন। মানুষের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার অতিরিক্ত তথ্য যখন তাঁর নিকট চলে আসে তখনই তথ্য বিস্ফোরণ ঘটে (infobesity), এর ফলে সিদ্ধান্তের মান কমে যায়। খুব বেশি তথ্য নিয়েই বরং ক্রেতা সমস্যায় পড়ে যায় (information anxiety), সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে অথবা শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনা (Alvin Toffler,1970)।

বাজারজাতকরণকারীর সরবরাহকৃত তথ্য যাতে প্রতিযোগিতা করে অন্য কোম্পানির তথ্যের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে সেজন্য তথ্যকে প্রাসঙ্গিক, আগ্রহজনক এবং ব্যক্তিবিশেষের আগ্রহ অনুযায়ী নির্বাচন ও উপস্থাপন করতে হবে। তথ্যের মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণ করতে হলে তাঁকে একটা সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা প্রদান করতে হবে। বিক্রেতাকে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ক্রেতার সাথে ঘনিষ্ঠতা (engagement) বাড়াতে হবে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের পূর্বশর্ত। একই পরিস্থিতিকে বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষণ করে। ভিন্ন প্রত্যক্ষণের কারণ হচ্ছে যদিও আমরা প্রত্যেকেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তথ্য (উদ্দীপক) গ্রহণ করি, কিন্তু এ ইন্দ্রিয়ে সাড়া জাগানো তথ্যগুলোকে আমরা নিজেদের মতো গ্রহণ, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করি। প্রত্যক্ষন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে ব্যক্তি জগতের অর্থবহ চিত্র (উদ্দীপক) থেকে তথ্য নির্বাচন, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করে। একই উদ্দীপক বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিভিন্ন প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করার কারণ হচ্ছে তিনটি প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া (perceptual process): নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া( selective exposure), নির্বাচিত বিকৃতকরণ (selective distortion) এবং নির্বাচিত ধারণ (selective retention)। প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিন অসংখ্য উদ্দীপকের মুখোমুখি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একজন ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে কয়েক শত বিজ্ঞাপনের সম্মুখীন হয়। কোন ব্যক্তির পক্ষেই সবগুলো বিজ্ঞাপনের (উদ্দীপকের) প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগই পর্দার অন্তরালে চলে যায়। বাজারজাতকরণ যোগাযোগকারীর প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোন্ উদ্দীপক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে সেটা ঠিক করা। গবেষণা থেকে দেখা গেছে মানুষ তার বর্তমান প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপকটির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। যে যেই সমস্যায় থাকে সে সেই সমস্যার সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। ভুক্তভোগীর প্রত্যেকটি সমস্যার এক একটি সমাধানই হচ্ছে 'পণ্য' (product is a solution to customers problem)। তাঁরা প্রত্যাশিত উদ্দীপকের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়ার কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে ভোক্তা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিশেষ করে চেষ্টা চালাতে হবে। তাঁদের অফার(offer) হয়তো এমন ব্যক্তিদের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে যারা পণ্য গ্রহণের বাজারে নেই। অন্যদের অফারের সমুদ্রে নিজের অফারকে স্বাতন্ত্র্য (পৃথকীকরণকৃত) করতে না পারলে বাজারে অবস্থানকারী সম্ভাব্য ক্রেতাদেরদেরও মনোযোগ আকৃষ্ট হবে না। এমনকি যেসব উদ্দীপক ভোক্তার দৃষ্টি কাড়ে তাও আবার সব সময় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তি আগত তথ্যকে তাঁর পূর্বস্থিরকৃত মনের অবস্থা (মনের মাধুরী মিশিয়ে) দিয়ে মিলাতে চেষ্টা করে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের অর্থ হচ্ছে তথ্যের ব্যক্তিগত অভিযোজন প্রবণতা। যোগাযোগকারী যাই বলুক না কেন বা দেখাক না কেন ভোক্তা তাঁর নিজের পূর্বস্থিতরকৃত মনের অবস্থা দ্বারা উপসংহারে আসবে। মানুষ উদ্দীপককে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় যা সে ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে তা যেন সমর্থিত হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, পোশাক, সংগীত, খাদ্য এসকল প্রায় সব ব্যাপারেই মানুষের একটা মনোভাব থাকে। মনোভাব দ্বারা ব্যক্তির কোন ধারণা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে দৃঢ় (consistent )মূল্যায়ন, অনুভূতি এবং প্রবণতা নির্ধারিত হয়। মনোভাব মানুষের মনে এমন একটি মানসিক কাঠামো তৈরি করে যার দ্বারা সে কোন কিছুকে পছন্দ করে ওই দিকে এগিয়ে যায় অথবা দূরে সরে আসে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের তাৎপর্য হচ্ছে বারজাতকরণকারীকে ভোক্তার মনের পূর্বকথা এবং এগুলো কিভাবে বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় তথ্যকে প্রভাবিত করবে তা অনুধাবন করা।

মানুষ যা শিখে তার অনেক কিছুই ভুলে যায়, যা তাদের বিশ্বাস এবং মনোভাবকে সমর্থন করে ওইসব তথ্য মনে রাখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেশি থাকে। নির্বাচিত ধারণ( মনে রাখা) প্রবণতার কারণে ভোক্তা কোন পণ্যের ভালো গুণগুলোই বেশি মনে রাখবে,  প্রতিযোগী পণ্যের গুণাগুণ গুলো ভুলে যাবে। ক্রেতা তাঁর পছন্দের পণ্যের ভালো পয়েন্টগুলো মনে রাখে এবং পণ্য পছন্দের সময় ওই কথাগুলোই বারবার স্মরণ (rehearses) করে। তিনটি প্রত্যক্ষন উপাদান- নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া, বিকৃতকরন এবং ধারণের তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে তার বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছাতে হলে কঠোর অনুশীলন করতে হবে। এই উপাদানগুলো দ্বারা অভীষ্ট বাজারে বার্তা প্রেরণের পৌন:পুনিকতা, এবং নাটকীয়তার সামর্থনে ব্যাখ্যা দেয়া যায় । আরেকটি কৌতুহরী ব্যাপার হচ্ছে যদিও বেশিরভাগ বাজারজাতকরণকারী তাঁর আবেদন ভোক্তারা আদৌ প্রত্যক্ষণ করবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দিহান থাকে, একই সময়ে একদল ভোক্তাও আবার শঙ্কিত থাকে এজন্য যে, তেমন কিছু না জেনেই বাজেজাতকরণ বার্তা দ্বারা সে ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হবে কিনা।

মনোযোগ বরজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রথম কাজ হচ্ছে যাদের নিকট তথ্য পৌঁছানো হবে তাদের ব্যবহৃত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্লাটফর্মটি নির্বাচন করা। তারপরের কাজ হচ্ছে অতি সুস্পষ্ট একটি বার্তা তৈরি করা। ক্রেতারা যে সকল বিষয়কে মূল্যবান( value) মনে করে কেবলমাত্র সেই বিষয়গুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করা। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভ্যালু বিবৃতি তৈরি করতে হবে। বিবৃতি তৈরীর সময় যে ফরমেটটি এক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয় সেটি হচ্ছে,  "To...our.. is ..that"  ফরম্যাট । এক্ষেত্র "To" হচ্ছে সুনির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স । "our" হচ্ছে ব্র্যান্ডের নাম, "is" হচ্ছে জিনিসটি কি? আর "that" হচ্ছে এই জাতীয় অন্যান্য অফারের সাথে কোম্পানির অফারের পার্থক্য(POD)। বার্তা প্রেরণের জন্য একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করলে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে । বিভিন্ন 

মিডিয়ায় প্রচারিত বার্তায় একটি গল্প থাকতে হবে যার মধ্যে  বাজারজাতকরণের আবেগীয় আবেদনের উপাদান থাকতে হবে। কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করছে না এমন অন্য ব্র্যান্ডকেও ক্রেতার মনোযোগ মনোযোগ আকর্ষণের কাজে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে(co-branding)। যেহেতু দেশের প্রায় ৭০% লোক ইন্টারেক্টিভ অনলাইনে সংযুক্ত অতএব মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একটি আকর্ষণীয় ওয়েবসাইট থাকতেই হবে। মনোহারী যোগাযোগ এবং অন্যান্য উপায়ে ক্রেতার মনে অবস্থান( position) তৈরি করার বিষয়টি স্বীকার করেও বলা যায়, ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে স্থান(place) এবং প্যাকেজিং এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ । ওয়ালমার্টের একটি সুপারসেন্টারে প্রায় ১ লক্ষ ৪২ হাজার আইটেম থাকে। ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতি চারটির মধ্যে তিনটি সিদ্ধান্ত দোকানে গিয়ে গ্রহণ করে,  এবং এসময়ে তাঁরা প্রতি মিনিটে তিনশোটি আইটেম অতিক্রম করে। অসংখ্য প্রতিযোগী পণ্যের মধ্যে 

দোকানী আপনার পণ্যটি কোন্ রেকে (shelf) এবং রেকের কোন্ অবস্থানে (রেকের নিচের দিকে, চোখের সমান উচ্চতায়, মাথার উপরে) রেখেছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বিক্রেতার জন্য ক্রেতার মনোযোগের আকর্ষণের সর্বশেষ হাতিয়ার হতে পারে পন্যের প্যাকেট। আকর্ষণীয় প্যাকেট মনোযোগ ছাড়াও পণ্যের সাথে ক্রেতার এংগেজমেন্ট বা ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেয়,  যা অন্য কোন মাধ্যমে সম্ভব নয়।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা ও দেশি দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তা


Thumbnail

আমেরিকা আমার 'খুউব' পছন্দের দেশ। পছন্দের অন্যতম কারণ হলো, সে দেশের পররাষ্ট্র অনুষদের কর্মকান্ড। দেশটি তাদের নাগরিকদের খুব ভালোবাসে। তাদের নিরাপত্তায় সর্বদা উদ্বিগ্ন। নাগরিক বিদেশে গেলে সে দেশে কোথায় যাবে না যাবে, কোথায় নিরাপদ, কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ, কেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তার একটি দিক নির্দেশনা সময়ে সময়ে দিয়ে থাকে। এমন নির্দেশনা সরকার তাদের নাগরিকদের দিলে সে নাগরিকের গর্ববোধ করা উচিত। সে জন্যই দেশটিকে 'খুউব' পছন্দ করি।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গত ২১ মে সে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি করেছে। সতর্কবার্তার নাম দিয়েছে  ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’। বার্তায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ বাড়তে পারে। বিক্ষোভ হতে পারে। বিক্ষোভের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। সে দেশের নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।

‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’টি যখন দেয়া হয়, তখন দেশের রাজনীতির আকাশে সংঘাত, সহিংসতা বা বিক্ষোভের কোন ঘনঘটা ছিল না। কিন্তু তার দুদিন পর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে যে তুলকালাম ঘটে গেল তাতে অনুমেয় যে দূতাবাস একেবারে মোক্ষম সময়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে। তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয়। দেশটির জনগণের প্রতি তাদের সরকার যে মায়া মমতা ও উদ্বিগ্নতা, সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা, সেটি আজকের বিষয়বস্তু নয়। কোন দেশে এ ধরণের বা এর চেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি হলে আমাদের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা বা নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রায় সোয়া কোটি দেশি রেমিটেন্স যোদ্ধা রয়েছে বিদেশে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী যাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণে। প্রতিনিয়ত সংঘাত, সহিংসতা, বিক্ষোভ চলছে দেশে দেশে। কখনো শুনি না যে দেশি দূতাবাস গুলো এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো এ ব্যাপারে সর্বদাই নিষ্ক্রিয়।

ফিরে যাই মার্কিন মুলুকে। সেখানে বন্দুক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ৩২ বছরে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ লাখের বেশি মানুষ। ২০২১ সালে বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে প্রায় ৪৯ হাজার, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সার্বোচ্চ। আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে ৫২টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত ২০৫। গত ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি, নিহত ৪৬, আহত ১৫০। গত মার্চে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, নিহত ৫৬, আহত ১৩৬। গত এপ্রিলে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এসব ঘটনায়  নিহত ৬২, আহত ২৪৪। এপ্রিলের শেষ দিনে ১১টি ঘটনা ঘটেছে। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ নামের একটি গবেষণা সংস্থার ওয়েবসাইটে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত 'গান পলিসি' নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বন্দুক হামলায় মারা যায় দেড় হাজার জন। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় সাড়ে ২৮ হাজার জন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুন। জনসংখ্যা অনুপাতে সেদেশে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে দশগুণ বেশি। 

যুক্তরাষ্ট্রে এসব বন্দুক হামলার  সংঘাতের ঘটনাস্থল সর্বত্র।  শপিংমল, পার্ক, স্কুল, হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, রেল স্টেশন, ব্যাংক থেকে শুরু করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান, মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানস্থল, স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান যেখানে প্রতিনিয়ত বন্দুক হামলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশী বাস করে, বেড়াতে যায়, কাজে যায়, সভা-সেমিনারে যায়। আমেরিকার ভিসা দপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী নন ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়েছে। তার মানে, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যায়। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রী সেখানে পড়াশুনা করে । এসব প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্র বা টুরিস্টদের প্রতি বাংলাদেশী দূতাবাসের কি কোন দয়া মায়া নেই ? উদ্বিগ্নতা নেই ? তারাও তো পারে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বন্দুক হামলার প্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে আমাদেরকে সতর্কবার্তা দিতে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী দূতাবাস যুগ যুগ ধরে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক সংকেত দিচ্ছে না। শপিংমল, রেল স্টেশন, ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল, পার্ক ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার বা সাবধানে চলার পরামর্শ দিচ্ছে না। কিন্তু কেন ? দেশের নাগরিকদের প্রতি তাদের কি কোন দায়িত্ববোধ নেই?

এ বি এম কামরুল হাসান

প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে সাধারণ মানুষের কি আসে যায়?

প্রকাশ: ০৭:০১ পিএম, ২৯ মে, ২০২৩


Thumbnail

আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।

২.
জন ড্যানিলভিচ-এর লেখার সূত্র ধরে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকারের চিন্তা পুরোটাই হাস্যকর। কারণ তাদের নিজেদের দেশেই রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।২০২০ সালের জুন মাসে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারানো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ছিল সেদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য ঘটনা।সেসময় যখন দেশটির নানা জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, তখন সেসব বিক্ষোভের সময়ও পুলিশি নির্মমতার বেশ কিছু ভিডিও মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানের মতো জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ।আর আমেরিকার বন্দিদের প্রতি আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী জানে।মহাদেশটির মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে স্থাপিত(২০০২) গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, 'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়।নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় বর্ণের মানুষ সমপরিমাণে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত রয়েছে। এ সত্ত্বেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকহারে আটক এবং বিচার করা হয়।আমেরিকার জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী হলেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে আটক ব্যক্তিদের ২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকায় সাদাদের তুলনায় কালো মানুষদের ছয় গুণ বেশি আটকের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হাতে অধিক হারে নিরস্ত্র আফ্রিকান-আমেরিকান হত্যার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য ঘটনা।আসলে নানা অপকর্মর জন্য মার্কিনীদের ‘লজ্জা’থাকলেও তারা অপর দেশের সমস্যা নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে হরহামেশায়।তবে তাদের উদ্বেগে আমরা আদৌ উদ্বিগ্ন নই।

৩.
যেমন, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সতর্কবার্তা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ২৭ মে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের আবেদন করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, ‘যদি এই আইনের (ভিসা নীতি) কারণে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ হয়, তা হবে আশীর্বাদ।’ উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এই নতুন ভিসানীতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য তারা নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। এই ভিসানীতিতে ইমিগ্রেশন আইনের ২১২ ধারা প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। ২১২ ধারা অনুযায়ী, কোন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যদি কেউ অন্তরায় সৃষ্টি করে, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে বা নির্বাচনে অন্য উপায় অবলম্বনের চেষ্টায় সচেষ্ট থাকে- তাহলে তার ভিসা রহিত করা হবে এবং তাকে ভিসা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকৃতি জানাবে। সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল নির্বাচনের পরে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনের আগেই আগাম ঘোষণা দিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হলো। এর ফলে যদি কোনো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রশাসনের ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকার বা বিরোধী দলের সদস্য কিংবা অন্য কেউ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।এই নীতির কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নতুন মার্কিন ভিসানীতি বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে কোনো সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করবে। মার্কিন এই নীতির কারণে এখন বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচন প্রতিহত করার অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় বিচলিত নয়। এই ভিসা-নীতি নির্বাচনে সহিংসতাকারীদের জন্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা চাইব এই ভিসা নীতির আওতায় জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করো। কারণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ে যারা একবার জ্বলেছে, এখন জীবিত আছে, তাদের চেহারার দিকে তাকালে বড় দুঃখ পাবেন। আমরা আর জ্বালাও-পোড়াও চাই না। ৩ হাজার ৮০০ যানবাহন পোড়ানো হয়েছে।সুতরাং জ্বালাও-পোড়াও কারা করে? আপনারা জানেন। যারা করে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার। তাদের নেতৃত্বের সতর্ক হওয়া দরকার।’ অর্থাৎ ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত যে ধরনের জ্বালাও- পোড়াওয়ের মতো নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তাদের জন্য অশনি সংকেত। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে যেতে পারবে। আর জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভয় তৈরি হবে। রাজনীতিতে একটা সুস্থির পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যারা ইতিবাচকভাবে বা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, তাদের এই ভিসানীতিতে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যেকোনোভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে, ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির মতো কাজ দিয়ে, তারা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা ভিসার জন্য বিবেচিত হবেন না। এর মাধ্যমে আমেরিকা যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক গতিতে চলার জন্য যদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাহলে তিনি যেই হোন না কেন, তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থান থাকবে।সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের একটা অংশের সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তারা সেখানে সম্পত্তি গড়ে তুলে তুলেছেন, বাড়ি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে অনেকের। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকেরই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অবৈধ পথেই সেখানে পাঠিয়েছেন। এ কারণে তারা বেশি ভীত ও সন্ত্রস্ত। এই তালিকায় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরাও। এই ভিসা-নীতির ফলে এখন থেকে অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের মতে, ‘ভিসা (যুক্তরাষ্ট্রের) বড়লোকেরা নেয়। সরকারি কর্মচারী, কিছু বড় ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ—তাঁদের ভিসার দরকার হয়, যাঁদের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়ে, বিদেশে বাড়ি বানিয়েছেন, যাঁরা টাকা পাচার করেছেন। এতে হয়তো আশা করি টাকা পাচার কমবে। কারণ ওনারা নিয়ে গিয়ে তো স্থাপনা তৈরি করেন। আর যারা গরিব লোক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্ট হয়, তারা তো ভিসার জন্য আসেই না।’

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণির। তাদের বেশিরভাগেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে না। তাদের সন্তানরাও সেখানে পড়তে যায় না। কাজেই এই ভিসা নীতি সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। গত নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্য ছিলেন ৬ লাখ ০৮ হাজার আর বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৩ হাজারের মতো ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে। কাজেই এই ভিসানীতি নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের পাট শিল্প ও পাটজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক, তুলাসহ নানা ক্ষেত্রেই আমেরিকার ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে আগ্রহী। কাজেই বাণিজ্যে তেমন প্রভাব ফেলবে না। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কোনো অধিকার নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং জনগণের অধিকার আদায় ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এটি সহায়ক হতে পারে। কাজেই সাধারণ মানুষের এই ভিসানীতি নিয়ে ‍উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

৪.
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষিত ভিসা-নীতিতে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না।আমরা জানি এদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামবাসী। সেখানে আছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মী, যারা মানুষের অধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সংখ্যায় বেশি এসব মানুষের কোনো যায় আসে না যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-নীতিতে। এজন্য তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আগে যেমনটি বলেছি ভিসা-নীতির কঠোরতায় অর্থপাচার কমবে। দেশের টাকা দেশে থাকবে এবং তা উন্নয়নে কাজে লাগবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার জন্ম তার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। দেশটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষায় তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১৪ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নতিতে এদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমাদের দরজা খোলার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণিত হয়েছে।এটা দুর্ভাগ্যজনক যে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সকল সমালোচনা মোকাবেলা করে সরকার এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।এজন্য মানবাধিকারের উন্নয়নে এবং শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতাকে তারা বিবেচনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পূজারি। আমরা এ দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরাই গণতন্ত্রের মধ্যে সব সময় নির্বাচিত হয়েছি।’

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

যুক্তরাষ্ট্র   ভিসা নীতি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘পত্রিকায় সংবাদ হলে সেটার আগে সমাধান, তারপর প্রতিবাদ’


Thumbnail

যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।

তখন স্বাভাবিক নিয়মে আমার কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা বললেন, ‘স্যার একটা প্রতিবাদ দিতে হয়।’

তখন আমি বললাম, আমিতো পড়েছি। আমি ভোরবেলাতে যে পত্রিকাগিুলো পড়ি, তার মধ্যে নঈম নিজাম এবং এখনকার যে বুদ্ধিভিত্তিক কলামিস্ট আমার অনুজপ্রতীম সৈয়দ বোরহান কবিরের লেখাগুলো পড়ি। তারা একটা রৈখনি নিয়ে এসেছে। একটা প্রতিবাদ, সরকারিভাবে যা লেখা হয়, এটা না, ওটা।

আমি বললাম, ‘তোমরা ওই কমিউনিটি ক্লিনিকটা শেষ কে কবে পরিদর্শন করেছ?

তারা কেউই সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না। আমি বললাম, নঈম নিজাম এবং সৈয়দ বোরাহান কবির- এরা কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে তাদের যে পেশাগত সম্পর্ক সেটা জড়িয়ে ফেলে না। উদাহরণসরূপ বলছি, আমি তখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করে সৈয়দ বোরহান কবির। আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে বেশ কিছু বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু আমার সাথে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সে সেটা বিবেচনা না করে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সে এটা করেছে। সেটা নিয়ে তার সাথে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি। কারণ হচ্ছে, সে তার পেশায় ঠিক আছে, আমি আমার পেশায় ঠিক আছি।

আমার কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটা উল্লেখ করা তার দায়িত্ব। নঈম নিজামের পত্রিকায় যেহেতু সংবাদ ছাপা হয়েছে। সুতরাং নঈম নিজামকে আমি আলাদা চোখে দেখি।

তারা বললো, ‘স্যার সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে।’

আমি বললাম, সিভিল সার্জন নয়, একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাও। তারপর প্রতিবাদ ছাপাতে হয়, আর্টিকেল লিখতে হয়, আমি দেখবো।

তারপর একজনকে পাঠানো হলো। তিন দিনে রিপোর্ট দিলো। তারপর দেখা গেলো, বাংলাদেশ প্রতিদিনে যা ছাপা হয়েছে। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তখন আমি এইটার ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম, যেন ওটা ঠিকমতো চলে এবং সমস্যাটির সমাধান করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কোনো লেখা বা নঈম নিজামকে ফোন করার আর কোনো প্রয়োজন পড়লো না। আমি দেখেছি, আমার ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্বও আমার। যেহেতু এটা আমার দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সুতরাং আমি মনে করেছি, সে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমার পক্ষে না বিপক্ষে গেলো, সেটা কোনো বিষয় নয়।

সম্প্রতিককালে দেখলাম, আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং তাদের যে কাজের গাফিলতি সম্পর্কে লিখেছে বলে তারা তার প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। প্রতিবাদটি আমি পড়লাম। প্রতিবাদটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, অনেক আমলারা কাঁচা হাতের কাজ করে সেরকম। এই প্রতিবাদটি ছাপানোর আগে, যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়গুলোর সমাধান করাতো বেশি দরকার। এরা দেশের ভালো করতেছে না খারাপ করতেছে, সেটা বিচার করার সময় এসেছে। আমারতো কোনো পত্রিকার সাথে কোনো জমি নিয়ে বা কোনো বিরোধ বা কোনো গন্ডগোল নেই, সে আমার বিরুদ্ধে কেন লিখবে? লিখলে আমিসহ সকলে যে যেখানে দায়িত্বে আছে, সকলের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জিনিসটা সঠিক কি না, সেটার চুলচেরা বিচার করা।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে লিখেছে, সেটাকে অবশ্যই দেখাশোনা করা, যাতে ওই ভুলটটা ভবিষ্যতে আর না হয়। নঈম নিজাম কেন, দুনিয়ার কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভুলটা বুঝতে পারা এবং ভুলটা সঠিক করা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই আমরা এটা করতে পারি না। সেজন্য সবাইকে বলবো, যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু আসলে প্রতিবাদ পাঠানোর আগে কি লিখেছে, বরং সেটার সমাধান আগে করে তারপর প্রতিবাদ পাঠান।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বিধিনিষেধের আড়ালে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে?


Thumbnail

আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে। উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত  মানুষদেরকে আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায়  ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না ? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের ?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে।  কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল।  কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন , সমস্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।  

বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না।  যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো।  সেখানে কেন গণতন্রের জন্য মনোযোগ দেয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।  এখানে কার্ল মার্কস এর দর্শনের সাফল্য।  অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।  তার পরেও আমাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়।  এটি দেশের বিরোধী দলের দেনদরবার বা  তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে।  সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি এক মাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ ? একটি অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড়োরকম ভুল না করে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর।  গতকাল একটি বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে - তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে।  সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে।  সেখানে লেখা আছে "আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই। " ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বিদেশী দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবং আরেকটি মহল মনে করেন - যুক্তরাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবে , এবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্ততঃ গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি অমানুল্লার জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ঐদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন।  আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন।  সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি ? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পায়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। 

জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।  ভোট ও ভাতের  স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব। বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগনমুখী - কূটনীতিবিদমুখী নয়।আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিতে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের।  বিদেশী কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়।  আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি।  বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি।  তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন