ইনসাইড থট

কই তদন্ত কমিশন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পথপ্রশস্তকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলো!


Thumbnail কই তদন্ত কমিশন? বঙ্গবন্ধু হত্যার পথপ্রশস্তকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেলো!

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কি স্রেফ একটি সামরিক হত্যাকাণ্ড? কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল উচ্চবিলাসী নিম্নপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বাধীন হত্যাকাণ্ড? নাকি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড? আওয়ামী লীগ দাবি করে আসছে, একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জাতীয় চার নেতা হত্যার হত্যার মাধ্যমে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। এই ধারণার উদ্রেকের কারণ হচ্ছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের স্রোতধারায় একই খুনীদের পরিকল্পনায় ৮১ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর রাতের অন্ধকারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজিবনগর সরকারের নেতাদের হত্যাকাণ্ড। যে সরকারের নেতৃত্বে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্থাৎ পাকিস্তানের পরাজয়ের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান ভূখণ্ডে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিকনায়ক ও রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হত্যার শিকারকালীনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের অপসারিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দিয়েই মুজিব নগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামানকে বন্দীদশা অবস্থায় হত্যা করায় আওয়ামী লীগে এ ধারণার উদ্রেককে যথার্থই মনে হতে পারে। এ ধারণাকে প্রকট বা প্রগাঢ় করে তোলে যখন পর্যবেক্ষক মহল দেখতে পান নিহত মুজিব নগর সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের পরামর্শেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃকই খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারান এবং ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাজধানী কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তরত্তোর যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভা বা সরকার গঠন করা হয়, তা থেকে দূরে রাখা হয় বা দূরে থাকেন খন্দকার মোশতাক। জানা যায়, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিদ্যুৎমন্ত্রী হিসেবে খন্দকার মোশতাককে শপথ নিতে বলা হয়েছিল, কিন্তু মোশতাকই অস্বীকৃতি জানান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। নতুন মন্ত্রিসভায় যোগদান করে খন্দকার মোশতাকও মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে নবাগত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শপথগ্রহণ করেন। সরকারের অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দলে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করে আত্মতুষ্টিতে ভুগেছিলেন খন্দকার মোশতাক। কেননা মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ারূপেই উপরাষ্ট্রপতি- তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের পরামর্শক্রমেই পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে অপসারিত করা হয়েছিল। স্বভাবতই সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দীনের পরিণতিতে মোশতাক বেজায় খুশী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু উপরাষ্ট্রপতির পদ বিলোপ করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্পমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর স্থলে তাজউদ্দীনকে অর্থমন্ত্রী করা ছিল, মোশতাকের প্রাথমিক জয়। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফেরার ছয় দিন আগেই চার জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মুজিব বাহিনীর দুই শীর্ষনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের সমর্থক দুই গ্রুপের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও আচরণ আমাদেরকে ভাবিয়ে তোলে। এ কথাটি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ও তথ্য-বেতার মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে দায়িত্বপালনকারী মিজান চৌধুরীর মতে, স্বাধীনতার পর সরকার গঠন প্রশ্নে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী মনোভাব ও অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দেয়। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপই তাদের শক্তি প্রদর্শনের মহড়া করে। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রায়, তখন বঙ্গবন্ধু দুই গ্রুপকেই ডেকে দ্বন্দ্ব নিরসনে সমঝোতা করে ফেলার নির্দেশ দেন। সিরাজুল আলম খান গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শক্তির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি জানিয়ে গণপরিষদ বাতিল করার পক্ষে অবস্থান নেয়। অপরদিকে শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা-কে "মুজিববাদ" আখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে সাংবিধানিক সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। মুজিববাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনির গ্রুপে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও ডাকসু জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে সিরাজুল আলম খানের গ্রুপে ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ সমর্থকরা আত্মপ্রকাশ করে। ১৯ জুলাই ১৯৭২, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ সিরাজ পন্থীরা পল্টন ময়দানে এবং মনি পন্থীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের আয়োজন করে। দুটি সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করা হয়। বঙ্গবন্ধু দৃশ্যত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যোগদান করে একটি পক্ষ অবলম্বন করায় সিরাজুল আলম খান গ্রুপ তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ফেলে। ছাত্রলীগের এই বিভক্তি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ সিরাজুল আলম খানের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিলকে সভাপতি, আসম আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজকে যুগ্ম সম্পাদককে করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ। ছাত্রলীগও পৃথক হয়ে যায়। মুজিববাদী ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয় বেগম মুজিবের বোনের ছেলে তৎকালীন সরকারি তথ্য কর্মকর্তা শেখ শহীদুল ইসলামকে এবং সাধারণ সম্পাদক করা হয় এম এ রশীদকে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র পন্থী ছাত্রলীগের সভাপতি হন আফম মাহবুবুল হক ও সাধারণ সম্পাদক হন মাহামুদুর রহমান মান্না।


মিজানুর রহমান চৌধুরীর মতে, ওই সময়ে সংগঠনে বঙ্গবন্ধুর একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং যে ভাবমূর্তি তাতে করে তাঁর নেয়া সমঝোতা উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত কেন সফলকাম হলো না তা রহস্যাবৃত। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয় মধ্য ফেব্রুয়ারিতে - বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে। দলের সমাজ কল্যাণ সম্পাদক পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি কে এম ওবায়দুর রহমান প্রথম বক্তা হিসাবে জোড়ালো যুক্তি দিয়ে বলেন,"বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সভাপতি দুই পদেই থাকবেন।" সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন বলেন, বঙ্গবন্ধু আপনি যেখানেই থাকুন - দলের নেতা আপনিই, যদি সভাপতি পদ ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলেও যেমন, তেমনি প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে শুধু দলের সভাপতি থাকলেও সবাই আপনার কাছেই আসবে। মওলানা তর্কবাগীশ যখন দলের সভাপতি ছিলেন, তখনো নেতাকর্মীরা আপনার (সাধারণ সম্পাদক) কাছেই যেতেন। একটি গণতান্ত্রিক ট্রাডিশন সৃষ্টির লক্ষ্যে আপনি দুটির একটি বেছে নিন। সেক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব আপনি সরকার প্রধান থাকবেন। এতে সভায় মিশ্রপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হঠাৎ পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নেয় আব্দুল মান্নানের দুঃসাহসিক এক বক্তব্যে। বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আব্দুল মান্নান বলেন, " কাদের সিদ্দিকীর অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, কাদের তুই চারজনকে মেরেছিস, চারশ' লোক মারলেও আমি তোকে কিছুই বলতাম না। প্রকাশ্য সরকার প্রধানের এই বক্তব্যের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা কি করে প্রতিষ্ঠা হবে? উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু এতোটাই উদার ছিলেন যে, সেই টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নানকেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করেন এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকে করেন তথ্যমন্ত্রী। পরবর্তীতে মিজানুর রহমান চৌধুরী ত্রান মন্ত্রী হন এবং মন্ত্রীত্ব হারান। ১৯৭৫ সালের বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলোচনার সূত্রপাত করেন এই বলে "বঙ্গবন্ধু, আপনি সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটা আসলে কি এবং কেনো তা নিজ মুখে বলুন। আপনি যা বলবেন তাই গৃহীত হবে এবং পরে তা আইনে পরিণত করা হবে।" বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, আমি সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করতে আগ্রহী, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চাই। যারা আমার বক্তব্য সমর্থন করো, তারা হাত উঠাও।" পলকের মধ্যে সভাস্থলে সবার হাত উঠে গেলো। জেনারেল (অবঃ) এম এ জি ওসমানী, ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন ওদিনের বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫ এর সংসদীয় দলের বৈঠকে জেনারেল ওসমানী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করে বলেন, "আমরা আইউব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবুর রহমান খান হিসাবে দেখতে চাইনা।" বঙ্গবন্ধু সভা কর্তৃক সর্বময় ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর পরই বৈঠক শেষ করেন এবং ডেকে পাঠিয়ে জেনারেল ওসমানীকে বলেন,"Don't be excited my old friend, people are fed up with fiery speeches. They want some revolutionary changes in the social, political and economic system. " বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে খন্দকার মোশতাক একদিন বিকেলে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসি লেনস্থ বাসভবনে যেতে অনুরোধ করেন। মোশতাক তখন বানিজ্য মন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর জামাতা ওয়াজেদ মিয়া খন্দকার মোশতাকের বাসভবনে যেয়ে দেখেন ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনকে। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর খন্দকার মোশতাক ডঃ ওয়াজেদকে বলেন, "তোমার শশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্মন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? বঙ্গবন্ধুর এটা করা মারাত্মক ভুল হবে। " এম এ ওয়াজেদ প্রতিত্তোরে বলেন," কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন। খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, "মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।" একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে তলেতলে সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যারা তাদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক ছাড়াও ছিলেন বাকশাল সরকারেরই তিন প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন অবশ্য একদলীয় শাসন পদ্ধতির পক্ষে ভোট না দিয়ে সংসদ সদস্য পদ হারান। মিজানুর রহমান চৌধুরী ও নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্যপ্রবণ ছিলেন বলে পক্ষেই ভোটদান করেন। তবে মিজান চৌধুরীর ভাষ্য মতে, ওদিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবি গোনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের চার খলিফাখ্যাত ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষ নামটিই অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকীর হাতে আজও তসবি রয়েছে। ২৪ জানুয়ারি ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, "আগামীকাল তোর আব্বা রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই তোদের বাসায়ই বসবাস করবি " শেখ কামাল জবাবে বলেন, "না, না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।" ওই দিন বিকেল পাঁচটার দিকে বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ ওয়াজেদ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে দেখেন খন্দকার মোশতাক গেইট হতে বের হচ্ছেন। ওয়াজেদকে দেখে একটু দূরে নিয়ে ফিসফিস করে মোশতাক বলেন, "আগামীকাল তোমার শশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু মারাত্মক ভুলই হবে না, দেশে বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তিও অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলাতে গিয়ে তোমার শশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো। আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।" ডঃ ওয়াজেদ কিছু বলবেন বলে ঠিক করলেও তা আর হয়ে ওঠেনা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী তখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনারত। রাত সাড়ে দশটায় শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ঢোকেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়।

২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। যেদিন বঙ্গবন্ধু "দ্বিতীয় বিপ্লব" ঘোষণা করে সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সংসদ কক্ষেই রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণের পর স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল সংসদের শীতকালীন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মূলতবি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরস্থ সড়কের বাসভবনে ফিরেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। বঙ্গবন্ধুরই জ্যেষ্ঠ জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়ার একটি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা নিয়ে যে ঘরে বাইরে ব্যাপক মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু ২৬ জানুয়ারি বিকেলে মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১১ ফেব্রুয়ারী জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করে সংসদ সদস্য পদে ইস্তফা দেন। কিন্ত অনেকেই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে আসলেও সংসদ সদস্য পদ হারানোর ভয়ে পক্ষেই ভোট দেন। তাদের প্রায় সবাই মন্ত্রিসভায়ও যোগ দেন। কমরেড মনি সিং এর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি - ন্যাপ বাকশালে যোগ দিলে জাতীয় সংসদের ৮ জন বিরোধী সদস্যের ৪ জন প্রবীণ নেতা অধুনালুপ্ত পূর্বপাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, জাসদের আব্দুস সাত্তার, সৈয়দ কামরুল ইসলাম, মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ও মিস্টার খোয়াই বেয়োজরও বাকশালে যোগদান করেন। যাহোক একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেও যারা বাকশালের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেই তাদের স্বরূপ উন্মোচন করার চেষ্টা করছি। ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া একদলীয় শাসন পদ্ধতি নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। যে অসন্তোষ লক্ষ্য করা যায় তাঁর " বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে কিছু ঘটনা" শীর্ষক গ্রন্থটিতে। তিনি লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু দেশ বিদেশে একজন জাতীয়তাবাদী গনতন্ত্রী ও প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরূপে পরিচিত। সারা বিশ্বের যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এতো সম্মান মর্যাদা দিয়েছেন, যাদের মধ্যে বিভ্রান্তি শুধু নয়,তাঁর ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়ে যাবে। দাতা দেশগুলো সরকারকে যে অর্থ প্রযুক্তি সাহায্যদানে ইতস্ততই শুধু করবে না, বরং এদের কেউ কেউ তা একেবারে বন্ধও করে দিতে পারে। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বিকেল পশ্চিম জার্মানির উদ্দেশ্যে ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। অপরদিকে একই বছর ২৯ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেন বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (দুইশিশুসন্তানসহ), শেখ রেহানা। তারা বাংলাদেশে ফেরার আগেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এরপর পশ্চিম জার্মানি থেকেই ভারতের দিল্লিতে গমন করেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফেরার আগে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফিরে যাচ্ছি একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের প্রক্রিয়ার বিষয়ে।

আগেই বলেছি জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর কথা ভ্রুক্ষেপ না করে একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ থেকে ইস্তফা দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের ব্যবধানে ২৪ আগস্ট জেনারেল ওসমানী অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত জিয়াউর রহমানকেও একই দিন প্রেসিডেন্ট মোশতাক সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। এর আগের দিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলীকে কারারুদ্ধ করেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। জেনারেল ওসমানী নিশ্চয়ই জেনেশুনে অবৈধ প্রেসিডেন্টের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর এতোটাই আনুগত্য ছিল যে, জাতীয় চার নেতা হত্যার খবরে যখন বঙ্গভবনে মোশতাক ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা খালেদ-শাফায়েত বাহিনীর হাতে নাজেহাল হচ্ছিল, তখন তাদের বাঁচাতে এগিয়ে যান জেনারেল ওসমানী। জাতির পিতার হত্যাকারী বাস্টার্ড গালি দিয়ে যখন অভ্যুত্থানকারীরা প্রেসিডেন্ট মোশতাকের দিকে স্টেনগান তাক করেন তখন জেনারেল ওসমানী তাকে রক্ষা করেন। নিহত জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বাধীন মুজিব নগর সরকারেরই অধীনে এমএজি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়োগলাভ করেছিলেন। আওয়ামী লীগকে বড় করুণ পরিণতি হজম করতে হয়েছে। যেমন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন করে জেনারেল ওসমানীকেই "নৌকা" প্রতীক দিয়ে আওয়ামী লীগের মোকাবিলা করতে হয়েছে। যাক ফিরছি বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন বিষয়ে। এ পদ্ধতি প্রবর্তনের আগে মোশতাক আহমেদ বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে তার আগামসিহ লেনস্থ বাড়িতে দাওয়াত করেন। মোশতাক তখনও বানিজ্যমন্ত্রী। ডঃ ওয়াজেদ বাড়িতে পৌঁছে দেখেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের সঙ্গে আলাপরত। মঈনুল হোসেন চলে যাবার পর মোশতাক ওয়াজেদকে বলেন," তোমার শশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্মন্ধে তুমি কি কিছু জানো কিংবা শুনেছো কিনা? তোমার শশুরের এটা করা মারাত্মক ভুল হবে। "ওয়াজেদ মিয়া প্রতিত্তোরে বলেন," কাকা আমি স্বাধীনতার পর থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে কথাবার্তা বলি না। আপনি বরং শেখ মনির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন।" খন্দকার মোশতাক তখন বলেন, "মনিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তোমার শশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।" একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে সংগোপনে মোশতাকের সঙ্গে যোগসাজশ গড়ে উঠেছিল বাকশাল মন্ত্রিসভার তিন সদস্য (প্রতিমন্ত্রী) তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, কে এম ওবায়দুর রহমান ও চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের। মোশতাক প্রেসিডেন্ট হবার পর উপরোক্ত চার নেতা তারও প্রতিমন্ত্রী হন এবং জাতীয় চারনেতাকে বাসা থেকে তারাই বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়েছিলেন। মোশতাকের মুখের ওপর সরকারে যোগদানের প্রস্তাব ছুঁড়ে মাড়ার কারণে চার নেতাকে কারারুদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর খুনীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়। ১৯৬৬-১৯৭২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বপালনকারী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে অপসারিত মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধের খলিফা খ্যাত চার ছাত্রনেতার মধ্যে শীর্ষে অবস্থানকারী অনলবর্ষী বক্তা নূরে আলম সিদ্দিকী একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতোটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাকশাল পদ্ধতির পক্ষেই সংসদে ভোট দিয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান চৌধুরীর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, "একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনের দিন থেকেই নূরে আলম সিদ্দিকী হাতে তসবিহ গুনতে শুরু করেন।" বলা বাহুল্য মিজান চৌধুরী পরলোকে। কিন্তু নূরে আলম সিদ্দিকী আজও হাতে সারাক্ষণ তসবিহ গুনেন। আওয়ামী লীগ (মিজান) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রীত্বের টোপ গিলে বিএনপিতে এবং পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মূল আওয়ামী লীগে ফিরে গেলে নূরে আলম সিদ্দিকী সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে তিনিও মূল আওয়ামী লীগে ফিরে এলেও বর্তমানে নিস্ক্রিয় রয়েছেন। তাঁর পুত্র তাহজিব সিদ্দিকী অবশ্য আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগ (মিজান) সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৫ দল ছেড়ে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ গিলেন। পরবর্তীতে এরশাদের বিরুদ্ধেও পৃথক জাতীয় পার্টি করেন। শেষ বয়সে আওয়ামী লীগে ফেরার কিছুদিন পর ইন্তেকাল করেন। ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠাতা তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বড়পুত্র ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন। আসাযাওয়া ছিল বঙ্গবন্ধু বাড়িতেও। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন অর্থাৎ সংবিধান চতুর্থ সংশোধন বিল পাস হবার একদিন আগে ২৪ জানুয়ারি(১৯৭৫) বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে শেখ কামালকে বলেন, "আগামীকাল তোর আব্বা প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন, অতএব তোরা প্রেসিডেন্টের বঙ্গভবনে নাকি ধানমন্ডিস্থ এই বাড়িতেই থাকবি?" শেখ কামাল বলেছিলেন, "না,না না, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবো না।" ওদিন বিকেলে খন্দকার মোশতাকও একদলীয় শাসন পদ্ধতির বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন। বঙ্গবন্ধুর সায় না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ মেজাজ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন মোশতাক। গেইটে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর জামাতা ডঃ ওয়াজেদের সঙ্গে। মোশতাক একটু অদূরে ওয়াজেদকে টেনে নিয়ে বিড়বিড় করে বলছিলেন,"আগামীকাল তোমার শশুর সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাচ্ছেন সেটা শুধু ভুলই হবে না, দেশবিদেশে তাঁর ভাবমূর্তি অপূরণীয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তেতলায় গিয়ে তোমার শশুরকে বিষয়টি অনুধাবন করানোর চেষ্টা করো। খন্দকার মোশতাক ডঃ ওয়াজেদকে আরও বলেন যে, "আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনোরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ফিরে যাচ্ছি।" ডঃ ওয়াজেদ শশুরের সঙ্গে দেখা করে একথা বলবেন ভাবলেও তা আর হয়ে ওঠে না। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এম মনসুর আলীকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে দশটায় বাড়িতে ফিরে শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি কক্ষে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। রাত দেড়টা পর্যন্ত কথাবার্তা শেষ হলে শেখ মনি তার বাসায় চলে যান। পরদিন ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫। সংবিধান চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে দেশে কায়েম হয় একদলীয় রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা। এ আমূল পরিবর্তন বঙ্গবন্ধুর ভাষায় "দ্বিতীয় বিপ্লব।" প্রেসিডেন্টের আদেশে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ - সংক্ষিপ্ত নাম যার বাকশাল। দলে দলে সরকারি বেসরকারি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আবেদন করে সদস্য প্রাপ্তির জন্য। দ্রুত সুফলও লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তাতে কি! দেশবিদেশের ষড়যন্ত্র থেমে থাকে? মোটেই নয় বরং ষড়যন্ত্র চক্রান্ত আরও প্রকট হয়ে ওঠে। সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত যে সত্যাসত্য তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয় গোটা জাতির। খন্দকার মোশতাক আহমেদ একদলীয় শাসনপদ্ধতির বিরোধিতা করেও বাকশালের অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলেন। ছিলেন বানিজ্যমন্ত্রী। সেই মোশতাকই কিনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর প্রেসিডেন্টের মসনদে উপবিষ্ট হলেন। খুনী ফারুক-রশিদদের "সূর্য সন্তান" হিসাবে অভিহিত করে বললেন," অন্য কোন উপায়ে স্বৈরাচারী শেখ মুজিবকে উৎখাত করা সম্ভব ছিল না, বিধায় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সামনে স্বর্ণ দ্বার খুলে দিয়েছে। অথচ ২০/২৫ জন জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাসহ গোলন্দাজ ও ট্যাংকবাহিনীর ১৪০০ সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। মোশতাকের চারপাশে জড়ো হলো কয়েকঘন্টা আগেও যারা বঙ্গবন্ধুর মোসাহেবি করেন সেইসব মন্ত্রীরা। বঙ্গবন্ধুর দুই রাষ্ট্রপতির একজন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আট আগস্ট দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নেন। সেই তিনি খন্দকার মোশতাকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। আরেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ কিনা মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হলেন। দুই শিক্ষাবিদ ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক ও ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু যথাক্রমে শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী করেছিলেন, অথচ সেই দুই ব্যক্তিই মোশতাকের মন্ত্রী হয়ে বসলেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুল মান্নান, আব্দুল মোমিন, মনোরঞ্জন ধর, আসাদুজ্জামান খান, ফণিভূষণ মজুমদার, সোহরাব হোসেন, প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মোমিন উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ ক্ষীতিশ চন্দ্র মন্ডল, রিয়াজুদ্দিন আহমেদ ভোলা মিয়া, মোসলেম উদ্দিন খান ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন। শুধুমাত্র ফণিভূষণ মজুমদারকে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে মন্ত্রীপদে শপথ পড়ানোর কথা শোনা গেলেও অন্যান্যের মন্ত্রীগ্রহণে কোন জোরজবরি ছিল বলে ইতিহাসের সূত্র সাক্ষ্য দেয় না। বরং কে কোন দফতর পাবেন সে নিয়েও খুনীদের দিয়ে তদবির করেন বলে জানা যায়। উপরোক্তদের মধ্যে কেবল মোসলেম উদ্দিন হাবু মিয়া বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সরকারের মন্ত্রী ছিলেন না। ২৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় মন্ত্রিসভার সর্বসম্মতিক্রমে। মন্ত্রিসভায় চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিলো "জাতীয় টুপি" আইন ঘোষণা। খন্দকার মোশতাক গাঢ় ছাই রঙের কিস্তি টুপিটাই হয়ে গেলো জাতীয় টুপি। তবে তাসের ঘরের মতো মাত্র ৮১ দিনের মাথায় অবৈধ ক্ষমতা মোশতাক সরকারের মাথার ওপর ভেঙে পড়লো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে মোকাবিলা করতে হয়েছে দেশবিদেশের ষড়যন্ত্র শুধু নয়, নিজ দলের নেতাদেরও নানা চক্রান্তকে। বড় ট্রাজেডি যে, দল পরিচালনা করতে গিয়ে মোশতাক মন্ত্রিসভারও বহু সদস্যকে অনিবার্য কারণে মেনে নিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে যে সুবিচারের প্রশ্ন স্বভাবতই আসতে পারে। যেমন আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠন করে। ইনডেমনিটি বাতিল হওয়ার পর শুরু হয় সাধারণ আদালতে বিচার প্রক্রিয়া। মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যদের অনেকে ইন্তেকাল করলেও বেঁচে ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বডি প্রেসিডিয়ামে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান এবং সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল মোমিন, বিশেষ দূত মহিউদ্দিন আহমেদ। মোশতাকের প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীও তখনো আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। উল্লেখিত নেতারা সংসদ সদস্য হলেও শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি। এতে নেতাকর্মীদের মনে বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয় যে, নীতিগতভাবে মোশতাক মন্ত্রিসভার কাউকে শেখ হাসিনার সরকারে দেখা যাবে না। বর্তমানে মোশতাক মন্ত্রিসভার কেউ বেঁচে নেই। কিন্তু অনেক ছিলেন যাদের অবস্থান স্বীকার করেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পরিচালনা করতে হয়। মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যে ব্যক্তিটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানশেষে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিকদের বলেন, "বাংলাদেশ ফেরাউনের হাত হতে রক্ষা পেয়েছে", সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন স্পীকার আব্দুল মালেক উকিল। তাকেও প্রেসিডিয়ামে রেখে শেখ হাসিনাকে পথ চলতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাত্তোর কাউন্সিলে সেই মালেক উকিলই আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আব্দুল মালেক উকিল পরাজিত হওয়ায় যাকে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়, সেই আসাদুজ্জামান খানও খুনী মোশতাকের মন্ত্রী হন। বিরোধী দলের উপনেতা পদটিতেও যে মহিউদ্দিন আহমেদকে সেই তিনিও মোশতাকের বিশেষ দূত হয়ে মস্কো সফর করেন সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন এনে দিতে। বহুল আলোচিত সমালোচিত "বাকশাল" নামকরণকারী ব্যক্তিটি আর কেউ নন,১৯৭৩ সালে ন্যাপ (মোঃ) ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানকারী এই মহিউদ্দিন আহমেদই। লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।

তদন্ত কমিশন   বঙ্গবন্ধু হত্যা  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

"মনোযোগের প্রতি মনোযোগী হোন"


Thumbnail

এরিক আর্থার ব্লেয়ার (১৯০৩-১৯৫০) কালউত্তীর্ণ  সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখক। ব্রিটিশভারতে জন্মগ্রহণকারী "এনিমেল ফার্ম" খ্যাত এই ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "1984" প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই বিখ্যাত উপন্যাসটিতে যে সকল সংকটের কথা কল্পনা করা হয়েছিল এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে তথ্যের স্বল্পতা। ভবিষ্যতের শাসকরা আরো বেশি করে তথ্য আটকে রাখবে, তথ্য পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটেনি। তথ্যের স্বল্পতা ১৯৮৪ সালে প্রকট হয়নি। আর এখন তো সবচেয়ে সহজে যা পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে 'তথ্য'। অন্যান্য পণ্যের মতো তথ্যও উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করা যায়। পণ্য হচ্ছে, "anything that can be offered to a market for attention, acquisition, use or consumption that might satisfy want or need" (Kotler, 2022)। পণ্যের সংজ্ঞায় দখল, ব্যবহার এবং ভোগের আগেই 'মনোযোগ' শব্দটি গুরুত্ব পেয়েছে। William James তাঁর Principles of Psychology (1980) বইয়ে মনোযোগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, "attention is the taking possession by the mind, in clear and vivid form, of one out of what may seem several simultaneously possible objects of trains of thought ... It implies withdrawal from something in order to deal effectively with others. 

" মনোযোগ বলতে নির্দিষ্ট একটা বিষয়কে ফোকাস করাকে বুঝায় না, একই সাথে এটা অসংখ্য প্রতিযোগী তথ্য এবং উদ্দীপককে অগ্রাহ্য করাকেও বুঝায়। যা এ মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয় সেটাকে এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি আকর্ষিত হওয়াই মনোযোগ ( Kendra Cherry, 2022)। কোন পণ্যকে ভোক্তা কিভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা অনেকাংশেই তাঁর প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের একটি পূর্বশর্ত। কোন নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রীয় সমূহকে নিবদ্ধ করার নামই হলো মনোযোগ। যে মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক বিষয় থেকে চেতনাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ বিষয়ে চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা হয় তাকে মনোযোগ বলে। ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের খরচ গত দুই দশকের ৭ থেকে ৯ গুন বেড়ে গেছে। ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করা মার্কেটিংয়ের কাজ। মার্কেটিংয়ের চুম্বকীয় বার্তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে সেটা ক্রেতার মনোযোগ দখল করতে পারে। এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েও কোন লাভ হবে না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোন বিকল্প নেই (Rebecca Riserbalo,2021)। "মনোযোগ বারজাতকরণ" শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন Steve Jerry, পরবর্তীতে এটাকে জনপ্রিয় করে তোলেন Seth Godin. মনোযোগ বাজারজাতকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Rebecca Riserbalo বলেন, '"Attention marketing is the concept that marketing is all about capturing and engaging your audience's attention. This is usually done through non-invasive means, like social media. With attention marketing you'll focus on how to capture someone's limited attention"(Rebecca Riserbalo, "Attention Marketing", 2021)। Microsoft এর এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গড়ে ব্যক্তির মনোযোগের স্থায়িত্বকাল ৪ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে একজন মানুষ একটানা গড়ে কোন বিষয়ে ১২ সেকেন্ড মনসংযোগ করতে পারতেন, ২০১৫ সালে এটা ছিল ৮ সেকেন্ড। এর মানে হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, অন্যথায় সে স্করল (scorl) করে অন্যদিকে চলে যাবে। মনোযোগ হল কোন বিশেষ তথ্যের উপর কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের  চেতনায় আসে। আমরা বিশেষ কোনো তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেই কোন পদক্ষেপ নিব কি, নিব না (Davenport & John, 2001)। মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে (Crawford ,2015)। এক সাথে অনেকগুলো বিষয়ে মনোযোগ দেয়া প্রায় অসম্ভব। দানবীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন google, মেটা, Apple, আমাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তথ্য সেবা দিচ্ছে। আর আমরা মনোযোগ দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করছি। (একই প্রক্রিয়ায় দেশে বিদেশে অবস্থানকারী কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইউটিউবারের (বাটপার) মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্ভট কন্টেন্ট দেখে দর্শকরা তাদের ভরণপোষণ করছে।

কেউ কেউ গত দুই দশকের অর্থনীতিকে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন। মনোযোগের অর্থনীতি কথাটি বহু পুরাতন। আজ থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, ১৯৯৭ সালে মাইকেল গোল্ডহেবার "Wired" সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর "Attention Shoppers" নিবন্ধে প্রথম মনোযোগ অর্থনীতির বিষয়টির অবতারণা করেন। কোন অর্থনীতিতে অনেক মানুষ যখন তথ্য ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে সেটাকে তথ্য অর্থনীতি বলে। 

গোল্ডহেবার বলেন, তথ্য অর্থনীতি কথাটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোন সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো কিভাবে ব্যবহার করবে তার চর্চা। ("Economics is the science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which  have alternative uses"- Lionel Robbins)। আজকের দিনে তথ্য কোন দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়। যেটা দুষ্প্রাপ্য সেটা হচ্ছে মনোযোগ। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অর্থনীতির মূল নির্ধারক মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।

মানব ইতিহাসের সিংহভাগ জুড়ে তথ্য ছিল দুষ্প্রাপ্য। কয়েক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া জানতো না। আধুনিক যুগে সবাই সবকিছু প্রায় বিনামূল্যে পড়ছে। মানুষের সময় এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষমতা একটুও বাড়েনি। মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ। একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অন্যটির প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। প্রচুর তথ্য সম্পদ মনোযোগের দারিদ্র্য তৈরি করে। ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী মনোবিজ্ঞানী হারবার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, "একটি তথ্য সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছুর ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা হলো তথ্য যা ভোগ করে। তথ্য কি ভোগ করে? এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে। মার্কেটিংয়ে তথ্য নিজেই একটি পণ্য, অপরদিকে এটি একটি মার্কেটিংয়ের কৌশলগত হাতিয়ার। মনোযোগ হচ্ছে বিনামূল্যে পাওয়া তথ্যের জন্য প্রদেয় ক্রেতার মূল্য (Herbert Simon, 1971)। তথ্য বিস্ফোরণ (information overload) বাজারজাতকরণকে সহজ করার পরিবর্তে জটিল করে তুলেছে। "Information overload is the difficulty in understanding an issue and effectively making decisions when one has too much information (TMI) about that issue,  and is generally associated with the excessive quantity of daily information". ১৯৭০ সালের প্রকাশিত বেস্ট সেলার বই "Future Shock" এর লেখক Alvin Toffler তথ্য বিস্ফোরণ বা information overload বিষয়টি নিয়ে সবাইকে মাথা ঘামাতে বলেন। মানুষের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার অতিরিক্ত তথ্য যখন তাঁর নিকট চলে আসে তখনই তথ্য বিস্ফোরণ ঘটে (infobesity), এর ফলে সিদ্ধান্তের মান কমে যায়। খুব বেশি তথ্য নিয়েই বরং ক্রেতা সমস্যায় পড়ে যায় (information anxiety), সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে অথবা শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনা (Alvin Toffler,1970)।

বাজারজাতকরণকারীর সরবরাহকৃত তথ্য যাতে প্রতিযোগিতা করে অন্য কোম্পানির তথ্যের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে সেজন্য তথ্যকে প্রাসঙ্গিক, আগ্রহজনক এবং ব্যক্তিবিশেষের আগ্রহ অনুযায়ী নির্বাচন ও উপস্থাপন করতে হবে। তথ্যের মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণ করতে হলে তাঁকে একটা সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা প্রদান করতে হবে। বিক্রেতাকে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ক্রেতার সাথে ঘনিষ্ঠতা (engagement) বাড়াতে হবে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের পূর্বশর্ত। একই পরিস্থিতিকে বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষণ করে। ভিন্ন প্রত্যক্ষণের কারণ হচ্ছে যদিও আমরা প্রত্যেকেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তথ্য (উদ্দীপক) গ্রহণ করি, কিন্তু এ ইন্দ্রিয়ে সাড়া জাগানো তথ্যগুলোকে আমরা নিজেদের মতো গ্রহণ, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করি। প্রত্যক্ষন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে ব্যক্তি জগতের অর্থবহ চিত্র (উদ্দীপক) থেকে তথ্য নির্বাচন, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করে। একই উদ্দীপক বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিভিন্ন প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করার কারণ হচ্ছে তিনটি প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া (perceptual process): নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া( selective exposure), নির্বাচিত বিকৃতকরণ (selective distortion) এবং নির্বাচিত ধারণ (selective retention)। প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিন অসংখ্য উদ্দীপকের মুখোমুখি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একজন ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে কয়েক শত বিজ্ঞাপনের সম্মুখীন হয়। কোন ব্যক্তির পক্ষেই সবগুলো বিজ্ঞাপনের (উদ্দীপকের) প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগই পর্দার অন্তরালে চলে যায়। বাজারজাতকরণ যোগাযোগকারীর প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোন্ উদ্দীপক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে সেটা ঠিক করা। গবেষণা থেকে দেখা গেছে মানুষ তার বর্তমান প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপকটির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। যে যেই সমস্যায় থাকে সে সেই সমস্যার সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। ভুক্তভোগীর প্রত্যেকটি সমস্যার এক একটি সমাধানই হচ্ছে 'পণ্য' (product is a solution to customers problem)। তাঁরা প্রত্যাশিত উদ্দীপকের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়ার কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে ভোক্তা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিশেষ করে চেষ্টা চালাতে হবে। তাঁদের অফার(offer) হয়তো এমন ব্যক্তিদের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে যারা পণ্য গ্রহণের বাজারে নেই। অন্যদের অফারের সমুদ্রে নিজের অফারকে স্বাতন্ত্র্য (পৃথকীকরণকৃত) করতে না পারলে বাজারে অবস্থানকারী সম্ভাব্য ক্রেতাদেরদেরও মনোযোগ আকৃষ্ট হবে না। এমনকি যেসব উদ্দীপক ভোক্তার দৃষ্টি কাড়ে তাও আবার সব সময় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তি আগত তথ্যকে তাঁর পূর্বস্থিরকৃত মনের অবস্থা (মনের মাধুরী মিশিয়ে) দিয়ে মিলাতে চেষ্টা করে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের অর্থ হচ্ছে তথ্যের ব্যক্তিগত অভিযোজন প্রবণতা। যোগাযোগকারী যাই বলুক না কেন বা দেখাক না কেন ভোক্তা তাঁর নিজের পূর্বস্থিতরকৃত মনের অবস্থা দ্বারা উপসংহারে আসবে। মানুষ উদ্দীপককে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় যা সে ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে তা যেন সমর্থিত হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, পোশাক, সংগীত, খাদ্য এসকল প্রায় সব ব্যাপারেই মানুষের একটা মনোভাব থাকে। মনোভাব দ্বারা ব্যক্তির কোন ধারণা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে দৃঢ় (consistent )মূল্যায়ন, অনুভূতি এবং প্রবণতা নির্ধারিত হয়। মনোভাব মানুষের মনে এমন একটি মানসিক কাঠামো তৈরি করে যার দ্বারা সে কোন কিছুকে পছন্দ করে ওই দিকে এগিয়ে যায় অথবা দূরে সরে আসে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের তাৎপর্য হচ্ছে বারজাতকরণকারীকে ভোক্তার মনের পূর্বকথা এবং এগুলো কিভাবে বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় তথ্যকে প্রভাবিত করবে তা অনুধাবন করা।

মানুষ যা শিখে তার অনেক কিছুই ভুলে যায়, যা তাদের বিশ্বাস এবং মনোভাবকে সমর্থন করে ওইসব তথ্য মনে রাখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেশি থাকে। নির্বাচিত ধারণ( মনে রাখা) প্রবণতার কারণে ভোক্তা কোন পণ্যের ভালো গুণগুলোই বেশি মনে রাখবে,  প্রতিযোগী পণ্যের গুণাগুণ গুলো ভুলে যাবে। ক্রেতা তাঁর পছন্দের পণ্যের ভালো পয়েন্টগুলো মনে রাখে এবং পণ্য পছন্দের সময় ওই কথাগুলোই বারবার স্মরণ (rehearses) করে। তিনটি প্রত্যক্ষন উপাদান- নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া, বিকৃতকরন এবং ধারণের তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে তার বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছাতে হলে কঠোর অনুশীলন করতে হবে। এই উপাদানগুলো দ্বারা অভীষ্ট বাজারে বার্তা প্রেরণের পৌন:পুনিকতা, এবং নাটকীয়তার সামর্থনে ব্যাখ্যা দেয়া যায় । আরেকটি কৌতুহরী ব্যাপার হচ্ছে যদিও বেশিরভাগ বাজারজাতকরণকারী তাঁর আবেদন ভোক্তারা আদৌ প্রত্যক্ষণ করবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দিহান থাকে, একই সময়ে একদল ভোক্তাও আবার শঙ্কিত থাকে এজন্য যে, তেমন কিছু না জেনেই বাজেজাতকরণ বার্তা দ্বারা সে ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হবে কিনা।

মনোযোগ বরজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রথম কাজ হচ্ছে যাদের নিকট তথ্য পৌঁছানো হবে তাদের ব্যবহৃত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্লাটফর্মটি নির্বাচন করা। তারপরের কাজ হচ্ছে অতি সুস্পষ্ট একটি বার্তা তৈরি করা। ক্রেতারা যে সকল বিষয়কে মূল্যবান( value) মনে করে কেবলমাত্র সেই বিষয়গুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করা। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভ্যালু বিবৃতি তৈরি করতে হবে। বিবৃতি তৈরীর সময় যে ফরমেটটি এক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয় সেটি হচ্ছে,  "To...our.. is ..that"  ফরম্যাট । এক্ষেত্র "To" হচ্ছে সুনির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স । "our" হচ্ছে ব্র্যান্ডের নাম, "is" হচ্ছে জিনিসটি কি? আর "that" হচ্ছে এই জাতীয় অন্যান্য অফারের সাথে কোম্পানির অফারের পার্থক্য(POD)। বার্তা প্রেরণের জন্য একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করলে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে । বিভিন্ন 

মিডিয়ায় প্রচারিত বার্তায় একটি গল্প থাকতে হবে যার মধ্যে  বাজারজাতকরণের আবেগীয় আবেদনের উপাদান থাকতে হবে। কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করছে না এমন অন্য ব্র্যান্ডকেও ক্রেতার মনোযোগ মনোযোগ আকর্ষণের কাজে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে(co-branding)। যেহেতু দেশের প্রায় ৭০% লোক ইন্টারেক্টিভ অনলাইনে সংযুক্ত অতএব মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একটি আকর্ষণীয় ওয়েবসাইট থাকতেই হবে। মনোহারী যোগাযোগ এবং অন্যান্য উপায়ে ক্রেতার মনে অবস্থান( position) তৈরি করার বিষয়টি স্বীকার করেও বলা যায়, ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে স্থান(place) এবং প্যাকেজিং এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ । ওয়ালমার্টের একটি সুপারসেন্টারে প্রায় ১ লক্ষ ৪২ হাজার আইটেম থাকে। ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতি চারটির মধ্যে তিনটি সিদ্ধান্ত দোকানে গিয়ে গ্রহণ করে,  এবং এসময়ে তাঁরা প্রতি মিনিটে তিনশোটি আইটেম অতিক্রম করে। অসংখ্য প্রতিযোগী পণ্যের মধ্যে 

দোকানী আপনার পণ্যটি কোন্ রেকে (shelf) এবং রেকের কোন্ অবস্থানে (রেকের নিচের দিকে, চোখের সমান উচ্চতায়, মাথার উপরে) রেখেছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বিক্রেতার জন্য ক্রেতার মনোযোগের আকর্ষণের সর্বশেষ হাতিয়ার হতে পারে পন্যের প্যাকেট। আকর্ষণীয় প্যাকেট মনোযোগ ছাড়াও পণ্যের সাথে ক্রেতার এংগেজমেন্ট বা ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেয়,  যা অন্য কোন মাধ্যমে সম্ভব নয়।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা ও দেশি দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তা


Thumbnail

আমেরিকা আমার 'খুউব' পছন্দের দেশ। পছন্দের অন্যতম কারণ হলো, সে দেশের পররাষ্ট্র অনুষদের কর্মকান্ড। দেশটি তাদের নাগরিকদের খুব ভালোবাসে। তাদের নিরাপত্তায় সর্বদা উদ্বিগ্ন। নাগরিক বিদেশে গেলে সে দেশে কোথায় যাবে না যাবে, কোথায় নিরাপদ, কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ, কেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তার একটি দিক নির্দেশনা সময়ে সময়ে দিয়ে থাকে। এমন নির্দেশনা সরকার তাদের নাগরিকদের দিলে সে নাগরিকের গর্ববোধ করা উচিত। সে জন্যই দেশটিকে 'খুউব' পছন্দ করি।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গত ২১ মে সে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি করেছে। সতর্কবার্তার নাম দিয়েছে  ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’। বার্তায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ বাড়তে পারে। বিক্ষোভ হতে পারে। বিক্ষোভের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। সে দেশের নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।

‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’টি যখন দেয়া হয়, তখন দেশের রাজনীতির আকাশে সংঘাত, সহিংসতা বা বিক্ষোভের কোন ঘনঘটা ছিল না। কিন্তু তার দুদিন পর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে যে তুলকালাম ঘটে গেল তাতে অনুমেয় যে দূতাবাস একেবারে মোক্ষম সময়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে। তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয়। দেশটির জনগণের প্রতি তাদের সরকার যে মায়া মমতা ও উদ্বিগ্নতা, সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা, সেটি আজকের বিষয়বস্তু নয়। কোন দেশে এ ধরণের বা এর চেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি হলে আমাদের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা বা নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রায় সোয়া কোটি দেশি রেমিটেন্স যোদ্ধা রয়েছে বিদেশে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী যাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণে। প্রতিনিয়ত সংঘাত, সহিংসতা, বিক্ষোভ চলছে দেশে দেশে। কখনো শুনি না যে দেশি দূতাবাস গুলো এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো এ ব্যাপারে সর্বদাই নিষ্ক্রিয়।

ফিরে যাই মার্কিন মুলুকে। সেখানে বন্দুক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ৩২ বছরে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ লাখের বেশি মানুষ। ২০২১ সালে বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে প্রায় ৪৯ হাজার, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সার্বোচ্চ। আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে ৫২টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত ২০৫। গত ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি, নিহত ৪৬, আহত ১৫০। গত মার্চে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, নিহত ৫৬, আহত ১৩৬। গত এপ্রিলে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এসব ঘটনায়  নিহত ৬২, আহত ২৪৪। এপ্রিলের শেষ দিনে ১১টি ঘটনা ঘটেছে। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ নামের একটি গবেষণা সংস্থার ওয়েবসাইটে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত 'গান পলিসি' নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বন্দুক হামলায় মারা যায় দেড় হাজার জন। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় সাড়ে ২৮ হাজার জন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুন। জনসংখ্যা অনুপাতে সেদেশে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে দশগুণ বেশি। 

যুক্তরাষ্ট্রে এসব বন্দুক হামলার  সংঘাতের ঘটনাস্থল সর্বত্র।  শপিংমল, পার্ক, স্কুল, হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, রেল স্টেশন, ব্যাংক থেকে শুরু করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান, মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানস্থল, স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান যেখানে প্রতিনিয়ত বন্দুক হামলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশী বাস করে, বেড়াতে যায়, কাজে যায়, সভা-সেমিনারে যায়। আমেরিকার ভিসা দপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী নন ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়েছে। তার মানে, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যায়। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রী সেখানে পড়াশুনা করে । এসব প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্র বা টুরিস্টদের প্রতি বাংলাদেশী দূতাবাসের কি কোন দয়া মায়া নেই ? উদ্বিগ্নতা নেই ? তারাও তো পারে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বন্দুক হামলার প্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে আমাদেরকে সতর্কবার্তা দিতে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী দূতাবাস যুগ যুগ ধরে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক সংকেত দিচ্ছে না। শপিংমল, রেল স্টেশন, ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল, পার্ক ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার বা সাবধানে চলার পরামর্শ দিচ্ছে না। কিন্তু কেন ? দেশের নাগরিকদের প্রতি তাদের কি কোন দায়িত্ববোধ নেই?

এ বি এম কামরুল হাসান

প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে সাধারণ মানুষের কি আসে যায়?

প্রকাশ: ০৭:০১ পিএম, ২৯ মে, ২০২৩


Thumbnail

আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।

২.
জন ড্যানিলভিচ-এর লেখার সূত্র ধরে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকারের চিন্তা পুরোটাই হাস্যকর। কারণ তাদের নিজেদের দেশেই রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।২০২০ সালের জুন মাসে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারানো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ছিল সেদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য ঘটনা।সেসময় যখন দেশটির নানা জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, তখন সেসব বিক্ষোভের সময়ও পুলিশি নির্মমতার বেশ কিছু ভিডিও মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানের মতো জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ।আর আমেরিকার বন্দিদের প্রতি আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী জানে।মহাদেশটির মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে স্থাপিত(২০০২) গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, 'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়।নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় বর্ণের মানুষ সমপরিমাণে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত রয়েছে। এ সত্ত্বেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকহারে আটক এবং বিচার করা হয়।আমেরিকার জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী হলেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে আটক ব্যক্তিদের ২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকায় সাদাদের তুলনায় কালো মানুষদের ছয় গুণ বেশি আটকের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হাতে অধিক হারে নিরস্ত্র আফ্রিকান-আমেরিকান হত্যার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য ঘটনা।আসলে নানা অপকর্মর জন্য মার্কিনীদের ‘লজ্জা’থাকলেও তারা অপর দেশের সমস্যা নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে হরহামেশায়।তবে তাদের উদ্বেগে আমরা আদৌ উদ্বিগ্ন নই।

৩.
যেমন, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সতর্কবার্তা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ২৭ মে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের আবেদন করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, ‘যদি এই আইনের (ভিসা নীতি) কারণে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ হয়, তা হবে আশীর্বাদ।’ উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এই নতুন ভিসানীতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য তারা নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। এই ভিসানীতিতে ইমিগ্রেশন আইনের ২১২ ধারা প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। ২১২ ধারা অনুযায়ী, কোন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যদি কেউ অন্তরায় সৃষ্টি করে, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে বা নির্বাচনে অন্য উপায় অবলম্বনের চেষ্টায় সচেষ্ট থাকে- তাহলে তার ভিসা রহিত করা হবে এবং তাকে ভিসা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকৃতি জানাবে। সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল নির্বাচনের পরে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনের আগেই আগাম ঘোষণা দিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হলো। এর ফলে যদি কোনো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রশাসনের ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকার বা বিরোধী দলের সদস্য কিংবা অন্য কেউ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।এই নীতির কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নতুন মার্কিন ভিসানীতি বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে কোনো সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করবে। মার্কিন এই নীতির কারণে এখন বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচন প্রতিহত করার অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় বিচলিত নয়। এই ভিসা-নীতি নির্বাচনে সহিংসতাকারীদের জন্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা চাইব এই ভিসা নীতির আওতায় জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করো। কারণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ে যারা একবার জ্বলেছে, এখন জীবিত আছে, তাদের চেহারার দিকে তাকালে বড় দুঃখ পাবেন। আমরা আর জ্বালাও-পোড়াও চাই না। ৩ হাজার ৮০০ যানবাহন পোড়ানো হয়েছে।সুতরাং জ্বালাও-পোড়াও কারা করে? আপনারা জানেন। যারা করে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার। তাদের নেতৃত্বের সতর্ক হওয়া দরকার।’ অর্থাৎ ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত যে ধরনের জ্বালাও- পোড়াওয়ের মতো নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তাদের জন্য অশনি সংকেত। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে যেতে পারবে। আর জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভয় তৈরি হবে। রাজনীতিতে একটা সুস্থির পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যারা ইতিবাচকভাবে বা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, তাদের এই ভিসানীতিতে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যেকোনোভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে, ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির মতো কাজ দিয়ে, তারা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা ভিসার জন্য বিবেচিত হবেন না। এর মাধ্যমে আমেরিকা যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক গতিতে চলার জন্য যদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাহলে তিনি যেই হোন না কেন, তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থান থাকবে।সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের একটা অংশের সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তারা সেখানে সম্পত্তি গড়ে তুলে তুলেছেন, বাড়ি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে অনেকের। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকেরই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অবৈধ পথেই সেখানে পাঠিয়েছেন। এ কারণে তারা বেশি ভীত ও সন্ত্রস্ত। এই তালিকায় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরাও। এই ভিসা-নীতির ফলে এখন থেকে অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের মতে, ‘ভিসা (যুক্তরাষ্ট্রের) বড়লোকেরা নেয়। সরকারি কর্মচারী, কিছু বড় ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ—তাঁদের ভিসার দরকার হয়, যাঁদের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়ে, বিদেশে বাড়ি বানিয়েছেন, যাঁরা টাকা পাচার করেছেন। এতে হয়তো আশা করি টাকা পাচার কমবে। কারণ ওনারা নিয়ে গিয়ে তো স্থাপনা তৈরি করেন। আর যারা গরিব লোক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্ট হয়, তারা তো ভিসার জন্য আসেই না।’

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণির। তাদের বেশিরভাগেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে না। তাদের সন্তানরাও সেখানে পড়তে যায় না। কাজেই এই ভিসা নীতি সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। গত নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্য ছিলেন ৬ লাখ ০৮ হাজার আর বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৩ হাজারের মতো ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে। কাজেই এই ভিসানীতি নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের পাট শিল্প ও পাটজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক, তুলাসহ নানা ক্ষেত্রেই আমেরিকার ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে আগ্রহী। কাজেই বাণিজ্যে তেমন প্রভাব ফেলবে না। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কোনো অধিকার নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং জনগণের অধিকার আদায় ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এটি সহায়ক হতে পারে। কাজেই সাধারণ মানুষের এই ভিসানীতি নিয়ে ‍উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

৪.
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষিত ভিসা-নীতিতে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না।আমরা জানি এদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামবাসী। সেখানে আছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মী, যারা মানুষের অধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সংখ্যায় বেশি এসব মানুষের কোনো যায় আসে না যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-নীতিতে। এজন্য তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আগে যেমনটি বলেছি ভিসা-নীতির কঠোরতায় অর্থপাচার কমবে। দেশের টাকা দেশে থাকবে এবং তা উন্নয়নে কাজে লাগবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার জন্ম তার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। দেশটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষায় তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১৪ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নতিতে এদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমাদের দরজা খোলার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণিত হয়েছে।এটা দুর্ভাগ্যজনক যে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সকল সমালোচনা মোকাবেলা করে সরকার এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।এজন্য মানবাধিকারের উন্নয়নে এবং শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতাকে তারা বিবেচনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পূজারি। আমরা এ দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরাই গণতন্ত্রের মধ্যে সব সময় নির্বাচিত হয়েছি।’

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

যুক্তরাষ্ট্র   ভিসা নীতি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘পত্রিকায় সংবাদ হলে সেটার আগে সমাধান, তারপর প্রতিবাদ’


Thumbnail

যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।

তখন স্বাভাবিক নিয়মে আমার কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা বললেন, ‘স্যার একটা প্রতিবাদ দিতে হয়।’

তখন আমি বললাম, আমিতো পড়েছি। আমি ভোরবেলাতে যে পত্রিকাগিুলো পড়ি, তার মধ্যে নঈম নিজাম এবং এখনকার যে বুদ্ধিভিত্তিক কলামিস্ট আমার অনুজপ্রতীম সৈয়দ বোরহান কবিরের লেখাগুলো পড়ি। তারা একটা রৈখনি নিয়ে এসেছে। একটা প্রতিবাদ, সরকারিভাবে যা লেখা হয়, এটা না, ওটা।

আমি বললাম, ‘তোমরা ওই কমিউনিটি ক্লিনিকটা শেষ কে কবে পরিদর্শন করেছ?

তারা কেউই সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না। আমি বললাম, নঈম নিজাম এবং সৈয়দ বোরাহান কবির- এরা কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে তাদের যে পেশাগত সম্পর্ক সেটা জড়িয়ে ফেলে না। উদাহরণসরূপ বলছি, আমি তখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করে সৈয়দ বোরহান কবির। আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে বেশ কিছু বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু আমার সাথে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সে সেটা বিবেচনা না করে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সে এটা করেছে। সেটা নিয়ে তার সাথে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি। কারণ হচ্ছে, সে তার পেশায় ঠিক আছে, আমি আমার পেশায় ঠিক আছি।

আমার কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটা উল্লেখ করা তার দায়িত্ব। নঈম নিজামের পত্রিকায় যেহেতু সংবাদ ছাপা হয়েছে। সুতরাং নঈম নিজামকে আমি আলাদা চোখে দেখি।

তারা বললো, ‘স্যার সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে।’

আমি বললাম, সিভিল সার্জন নয়, একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাও। তারপর প্রতিবাদ ছাপাতে হয়, আর্টিকেল লিখতে হয়, আমি দেখবো।

তারপর একজনকে পাঠানো হলো। তিন দিনে রিপোর্ট দিলো। তারপর দেখা গেলো, বাংলাদেশ প্রতিদিনে যা ছাপা হয়েছে। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তখন আমি এইটার ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম, যেন ওটা ঠিকমতো চলে এবং সমস্যাটির সমাধান করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কোনো লেখা বা নঈম নিজামকে ফোন করার আর কোনো প্রয়োজন পড়লো না। আমি দেখেছি, আমার ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্বও আমার। যেহেতু এটা আমার দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সুতরাং আমি মনে করেছি, সে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমার পক্ষে না বিপক্ষে গেলো, সেটা কোনো বিষয় নয়।

সম্প্রতিককালে দেখলাম, আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং তাদের যে কাজের গাফিলতি সম্পর্কে লিখেছে বলে তারা তার প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। প্রতিবাদটি আমি পড়লাম। প্রতিবাদটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, অনেক আমলারা কাঁচা হাতের কাজ করে সেরকম। এই প্রতিবাদটি ছাপানোর আগে, যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়গুলোর সমাধান করাতো বেশি দরকার। এরা দেশের ভালো করতেছে না খারাপ করতেছে, সেটা বিচার করার সময় এসেছে। আমারতো কোনো পত্রিকার সাথে কোনো জমি নিয়ে বা কোনো বিরোধ বা কোনো গন্ডগোল নেই, সে আমার বিরুদ্ধে কেন লিখবে? লিখলে আমিসহ সকলে যে যেখানে দায়িত্বে আছে, সকলের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জিনিসটা সঠিক কি না, সেটার চুলচেরা বিচার করা।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে লিখেছে, সেটাকে অবশ্যই দেখাশোনা করা, যাতে ওই ভুলটটা ভবিষ্যতে আর না হয়। নঈম নিজাম কেন, দুনিয়ার কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভুলটা বুঝতে পারা এবং ভুলটা সঠিক করা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই আমরা এটা করতে পারি না। সেজন্য সবাইকে বলবো, যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু আসলে প্রতিবাদ পাঠানোর আগে কি লিখেছে, বরং সেটার সমাধান আগে করে তারপর প্রতিবাদ পাঠান।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বিধিনিষেধের আড়ালে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে?


Thumbnail

আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে। উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত  মানুষদেরকে আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায়  ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না ? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের ?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে।  কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল।  কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন , সমস্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।  

বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না।  যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো।  সেখানে কেন গণতন্রের জন্য মনোযোগ দেয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।  এখানে কার্ল মার্কস এর দর্শনের সাফল্য।  অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।  তার পরেও আমাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়।  এটি দেশের বিরোধী দলের দেনদরবার বা  তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে।  সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি এক মাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ ? একটি অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড়োরকম ভুল না করে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর।  গতকাল একটি বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে - তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে।  সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে।  সেখানে লেখা আছে "আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই। " ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বিদেশী দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবং আরেকটি মহল মনে করেন - যুক্তরাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবে , এবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্ততঃ গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি অমানুল্লার জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ঐদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন।  আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন।  সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি ? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পায়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। 

জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।  ভোট ও ভাতের  স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব। বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগনমুখী - কূটনীতিবিদমুখী নয়।আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিতে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের।  বিদেশী কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়।  আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি।  বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি।  তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন