ইনসাইড থট

প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে মোশতাকের সৃষ্ট কলহে জড়াননি চার নেতা!

প্রকাশ: ০৬:০০ পিএম, ০৩ নভেম্বর, ২০২২


Thumbnail প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়ে মোশতাকের সৃষ্ট কলহে জড়াননি চার নেতা!

"আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আমার আত্মগোপন সম্ভব নয়, আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।" বিশ্বস্ত সহচররা সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কা করে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার তাগিদ দিলে উপর্যুক্ত কথাগুলো বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সত্যাসত্যই বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডিস্থ বত্রিশ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাসভবন অবস্থান করছিলেন এবং রাতে পাক-হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ওই ভয়ঙ্কর রাতে গ্রেফতারবরণ করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের আগেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের দুই এপ্রিল পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদ সীমান্ত অতিক্রম করে দিল্লিতে পৌঁছেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। অথচ অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় ১০ এপ্রিল এবং শপথগ্রহণ করা হয় ১৭ এপ্রিল। ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদ গঠন হওয়া সত্ত্বেও শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয় একটি অনিবার্য কারণে। কুষ্টিয়ার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক বাঙালিদের হাতে নিহত হবার পর চুয়াডাঙ্গায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা আবারও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে যাওয়ায় শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে শপথের জন্য মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে বেছে নেয়া হয়।

বিএসএফ'র এক কমান্ডারের মাধ্যমে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদের সাক্ষাৎ ছিল এক অভিনব ঘটনা। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদের পরিচয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, ”শেখ মুজিব কোথায়?” জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে অদৃশ্য স্থান থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন –তাঁর নির্দেশেই আমি এসেছি। আপনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আমাদের অস্থায়ী সরকারের প্রতি সমর্থন দিন।"

তাজউদ্দীন আহমদ ২৫ মার্চ রাত আটটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে ধানমন্ডিস্থ নিজের বাড়িতে চলে যান। এরপর ডঃ কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামও বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে বেরিয়ে পড়েন। দু'নেতাই তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে যান। একটু পরেই শুরু হয়ে যায় গণহত্যার তান্ডবলীলা।

ডঃ কামাল ও ব্যারিস্টার আমীরকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন তাজউদ্দীন আহমেদ। পথিমধ্যে ডঃ কামাল গাড়ি থেকে নেমে যান। ব্যারিস্টার আমীরকে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমেদ কিভাবে মেহেরপুর কুষ্টিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতীয় বিএসএফ ফাঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার বর্ণনা করার আগে অস্থায়ী সরকার গঠন নিয়ে কলহের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শোনা যাক।

মুজিবনগর সরকার গঠন ও পদপদবি নিয়ে পাঁচ সদস্যের ‘হাইকমান্ড’ জড়িয়ে পড়েছিল চরম এক অন্তঃকলহে। বঙ্গবন্ধুই হাইকমান্ড গঠন করে রেখেছিলেন যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নেতৃত্বের শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সয়ং। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সেই সূত্র ধরে শেখ মুজিবকে "পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী" বলে সম্মোধনও করেছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চের গণহত্যা পরবতী ২৬ মার্চ গ্রেফতারত্তোর বঙ্গবন্ধু কর্তৃক “বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন” ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে শুরু হয়ে যায় যুদ্ধ। স্বভাবতই পাকিস্তানের সরকার কাঠামোর পরিবর্তে বাংলাদেশের সরকার কাঠামোর ভিন্ন চিন্তা আসে হাইকমান্ডের মাথায়। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে ঘোষণা করে একটি সরকার কাঠামো গঠন করা হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় ভাইস প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট। প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা এম মনসুর আলী পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন অস্থায়ী সরকারের স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। ফলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এএইচএম কামরুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাঁকে হাইকমান্ডের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ কথা বলে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে এম মনসুর আলী হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে হবেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান। হাইকমান্ডের অপর সদস্য ড. কামাল হোসেন অবশ্য গ্রেপ্তার হয়ে যান ২৬ মার্চ রাতেই।

সরকারের পদপদবী নিয়ে সৃষ্ট অন্তঃকলহের সূত্রপাত ঘটে ৮ এপ্রিল। কলকাতার ভবানীপুরের রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে। ওখানে উপস্থিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের অধিকাংশ তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রীর পদগ্রহণ নিয়ে পরিস্থিতি সরগরম করে তোলেন। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও যুবনেতাদের পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনি জোরেশোরে এ প্রশ্নের অবতারণা করেন। চরম বাকবিতণ্ডায় হয় তাদের মধ্যে।

স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়নের অবশ্যকীয় শর্ত-সরকার গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সরকারকাঠামোর প্রকৃতি নিয়ে এ মতবিরোধ দেখা দেয়াটা ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। তাজউদ্দীন আহমেদের নীতি নৈতিকতা নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিদার মনসুর আলী এসময় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তিনি বলেন,মতভেদ থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা এক। তিনি তাজউদ্দীনের প্রতি সদয় হয়ে সেদিন যে উদারতা প্রদর্শন করেন তা বিরল। তিনি অস্থিরতাহীন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীশক্তি দ্বারা অসীম নৈব্যর্ত্তিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা নিয়ে কটাক্ষ করে মনসুর আলী বলেন, তিনি এটা ঠিক করেননি, তবুও বিরাজমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীরূপে তাজউদ্দীন আহমেদকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। বস্তুত মনসুর আলীই প্রথমে কামরুজ্জামানকে সম্মত করান। খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দাবি করায় সমস্যায় পড়েন তাজউদ্দীন আহমদ। এ দফতরটি নিজের হাতে রাখতে চাইছিলেন। শেষে মোশতাকেই আইন ও পররাষ্ট্র দফতর দেয়া হয়। মোশতাক প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে রাখার চাল চাললেও সৈয়দ নজরুল ইসলামের অসাধারণ মানসিকতার কারণে তা ভেস্তে যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তান্ডব। এরপর একেক করে আওয়ামী লীগের নেতারা সীমান্তে গিয়ে জড়ো হন। বঙ্গবন্ধু আগেই তাদের আত্নগোপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, ইয়াহিয়ার অধীনে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ ডিসেম্বর সকল প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করেই ঘনিয়ে এলো মহা বিপর্যয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদেই নয়, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় পাকিস্তানের এ রাজনৈতিক সংকটের কারণ। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ব্যতিক্রমী এক গণশপথ গ্রহণ করিয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বললেন,”কেউ বেঈমানী করলে তাকে জ্যান্ত কবর দেবেন।” বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা হিসাবে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের (ন্যাশনাল এসেম্বলি) নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন এম মনসুর আলী। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলি এবং হুইপ করা হয় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে। অচিরেই বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতির আলোকে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির পক্ষে একটি সাব-কমিটি গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ওই সাব-কমিটির পদবী ক্রমানুসারে সদস্যরা হলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী,খন্দকার মোশতাক আহমেদ, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম কামরুজ্জামান, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেউ নির্বাচনে জয়ী না হওয়ায় সাব-কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। নির্বাচনী ফলাফল অনুযায়ী জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল হিসাবে আত্মপ্রকাশকারী পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো শাসনতন্ত্র নিয়ে আলোচনার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। ভুট্টোর প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি দলের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে শাসনতন্ত্র রচনা নিয়ে বৈঠক হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বৈঠকে ভুট্টোর একটি চমকপ্রদ উক্তি “ডোন্ট ফরগেট শেখ মুজিব, দ্যাট আই গট লা লার্জেস্ট নাম্বার অব ভোটস ইন দি ক্যান্টনমেন্ট’। সামরিকজান্তা ইয়াহিয়ার গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে ভুট্টো কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা সকলেই বুঝতে সক্ষম হন। ৩১ জানুয়ারি ভুট্টো সদলবলে ঢাকা থেকে করাচী উড়াল দেন। এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। পহেলা মার্চের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সফররাজ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা যোগ দেন।

সর্বসম্মতিক্রমে খসড়া শাসনতন্ত্র অনুমোদন লাভ করলেও তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ক্ষমতাদান করা হয় পার্লামেন্টারী পার্টিকে দেয়া হয়। পূর্বানী হোটেলে বঙ্গবন্ধু যখন অনুমোদিত শাসনতন্ত্রের খুটিনাটি নিয়ে বৈঠকরত তখনই ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। মূহুর্তে ছাত্র-জনতার ঢলে ঢাকার রাস্তা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘৬ দফা না এক দফা – এক দফা, এক দফা’ শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। পল্টনে বিরাট জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ, ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব ও জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন। নেতৃবৃন্দ হোটেল পূর্বাণীতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেলা সাড়ে চার টায় জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, আমরা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহবান জানান বঙ্গবন্ধু।

তিনি বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে ভবিষ্যত কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। ওদিন একটি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী হাইকমান্ড গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও যাতে নেতৃত্ব পরিচালিত হয় সেজন্যই ওই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও তাজউদ্দীন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেনকে নিয়ে সেই হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের লাইব্রেরির কক্ষটিকে “কন্ট্রোল রুম” হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ছিলেন নেতৃবৃন্দকে সহায়তা করার দায়িত্বে। ২ মার্চ ছাত্রলীগ আয়োজিত জনসমুদ্রে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব। পরদিন ৩ মার্চ পল্টন ময়দানের জনসভায় ছাত্রলীগের আয়োজিত জনসমাবেশ থেকে সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা করেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বরের বাসভবনটি ছিল সংগ্রামের সুতিকাগার। সকালে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা ভীড় জমান ওখানে।

পার্লামেন্টারী পার্টির হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায়, ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করলাম, “বঙ্গবন্ধু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। সারাদেশের মানুষের ভালোবাসা তাঁকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথাই যেন বাঙালীর প্রাণের কথা। বঙ্গবন্ধুর মনের কথা যেন তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন। ইঙ্গিতই তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল। তাজউদ্দীন আহমদ মুষ্টিবদ্ধ হাত মুখে রেখে বঙ্গবন্ধুর কথা কান পেতে শুনতেন। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি খসড়া তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি করে দেয়া হলেও সর্বময় ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর ওপরই ন্যস্ত করা হয়। ৭ মার্চ অপরাহ্নে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বসে তাঁর ভাষণ শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। ভাষণের প্রতিটি শব্দ, ভাষা ও ভঙ্গির মধ্যে তিনি একটি ইতিহাস আবৃত্তি করলেন। আবেগময়ী সেই ভাষণে বাঙালী জাতিকে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহবান জানিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির বানী শোনালেন। সেই ভাষণ ছিল একদিকে জ্বালাময়ী অপরদিকে নির্ভুল যুক্তি ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ী। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষে বাড়িতে ফিরে সমবেত সহকর্মীদের বললেন, স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। এখন দেশবাসীর দায়িত্ব হলো হানাদার বাহিনীকে এ দেশ থেকে বিতাড়িত করা।”
১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। ওই নির্দেশের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর জন্মদিনে সকালেই আওয়ামী লীগের সভা ডাকেন। বৈঠকে সবাই মত দেন যে সশস্ত্র পন্থায়ই পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হবে। বৈদেশিক সাহায্য সমর্থন নিয়েও আলোচনা হয় সভায়। তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের সংগ্রামকে গণনভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত করতে হবে। সবশেষে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারাদেশে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বাংলাদেশের সর্বত্র উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। ওদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খানের হাতে বৈঠককালে বঙ্গবন্ধু একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেন পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। কিন্তু ২৪ মার্চও তিনি নীরব থাকেন। উল্টো সামরিক বাহিনীর লোকেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে।

ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের দাবি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে ” সোয়াত জাহাজে” করে অস্ত্র আসছে। বঙ্গবন্ধু হাজী গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে একটি নির্দেশ পাঠান। কিন্তু জিয়ার কাছ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ২৪ মার্চ এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সকলকে ঢাকা ছেড়ে যাবার জন্য নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু বাসভবনের পেছনে গিয়ে এক মিনিট করে উপস্থিত সকল নেতার সঙ্গে কথা বলেন। বিকেল থেকেই বাসভবনে থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। বিকেল থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ, অন্যতম হুইপ আব্দুল মান্নান, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ নেতাদের প্রায় সকলে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনের জন্য চাপ দেন। কিন্তু তিনি অস্বীকার করেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “আমাকে নিয়ে তোরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আমার আত্মগোপন সম্ভব নয়, আমার হয়তো মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।“

২৫ মার্চ বিকেলে পুনরায় তাজউদ্দীন আহমদ, ডঃ কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম আত্মগোপনের প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাত সাড়ে আটটায় সাংবাদিকদের কাছে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায়, রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হন ডঃ কামাল হোসেন ও আমীর উল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুকে তাঁরা আবার আত্মগোপনের কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমরা ওয়াদা করেছো, আমি যা নির্দেশ করবো তাই শুনবে। এই মূহুর্তে আমার বাসভবন ছেড়ে তোমরা চলে যাও। শহরের সব খবর আমার কাছে আছে। ইয়াহিয়া ঢাকা ছাড়ার পরপরই আক্রমণ শুরু হবে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে ঢাকার সকল লোককে ওরা হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক এটা আমি চাইনা। ওখান থেকে আমি এবং ডঃ কামাল হোসেন তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে যাই। বিডিআরের একজন হাবিলদার এসে বললেন, পাকবাহিনী হামলা করছে। শয়ন কক্ষ থেকে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবি পরিহিত তাজউদ্দীন আহমদ কাঁধে একটি ব্যাগ ও ঘাড়ে একটি রাইফেল ঝুলিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি ডঃ কামাল হোসেন নেমে গেলেন। তাজউদ্দীন আহমদ লালমাটিয়ার রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল গফুরের বাসায় গেলেন। গফুরের বাড়ির অসম্পূর্ণ ছাদের ইট-সুরকীর ওপর বসে পাক সৈন্যদের হামলার মুখে ভয়ার্ত মানুষের চিৎকার শুনছিলাম।

মধ্যরাতে ব্রাশফায়ার ও বিকট শব্দ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ কেঁদে উঠলেন। বললেন এবার দস্যুরা ৩২ নাম্বার বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করছে। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিষোদগার করেন। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ৯৭ ভাগ ভোট পাওয়া আওয়ামী লীগকে। সুতীব্র ক্রোধ বেরিয়ে আসে ইয়াহিয়ার ভাষণে। ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর ভারত বা বিশ্বের কোন গণমাধ্যমে প্রচার না হলেও ২৬ মার্চের রাতে অষ্ট্রেলিয়া বেতার এ হত্যার খবর প্রচার করে। এদিকে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ নদী পার হয়ে জিনজিরার দিকে চলে যান। শেখ কামাল ও শেখ জামাল বাড়ি থেকে আগেই বেরিয়ে পড়েছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান কোন খবর পাওয়া যায়নি। তাজউদ্দীন আহমদ নদী পার হয়ে ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে নবাবগঞ্জ চলে যান। এক যুবক পরিচয় দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে মোটরসাইকেল করে তার গ্রামে। পরে মোটরসাইকেলেই ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকেও যুবকটি নিয়ে যায়। সুবেদ আলী টিপু এমপিএ বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। ওখান থেকে আশরাফ চৌধুরী এমপিএ এর বাড়িতে। পদ্মার তীরে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ফরিদপুরে পৌঁছা। শেষে ইমাম উদ্দিন এমপিএ এর বাড়িতে। তাজউদ্দীন সেখানে বসে রাজবাড়ীর মহাকুমা প্রশাসক শাহ ফরিদের কাছ থেকে শুনতে পান কিছু খবর। শাহ ফরিদ চুয়াডাঙ্গায় যোগাযোগ করতে জানতে পারেন যে, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তওফিক এলাহী চৌধুরী চুয়াডাঙ্গার পুলিশ ও বিডিআরের সঙ্গে যোগোযোগ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঝিনাইদহ, যশোর, কুষ্টিয়ার জনগন পাক সেনার বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু শাহ ফরিদ পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। অনেক রাতে তাজউদ্দীন আহমদ মাগুরায় গিয়ে দেখলেন মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকী মুক্তিযোদ্ধাদের তৈরি করে ফেলেছেন। সেখানে সোহরাব হোসেন এমএনএ সংগ্রাম করছেন। সেখান থেকে সোহরাব হোসেন তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে নিয়ে জীপে করে ঝিনাইদহ পৌঁছেন। আব্দুল আজিজের বাসায় গিয়ে ওঠেন। সেখানে বসে এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে খবর পাঠানো হয়। যশোর সেনানিবাস জনগন ও মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। চুয়াডাঙ্গা মহাকুমা প্রশাসক অবাঙালি হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়। কুষ্টিয়ার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসকও বন্দী। মেজর ওসমান চুয়াডাঙ্গায় নেতৃত্ব করেন। বেলা তিনটার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ সীমান্তের পথে রওয়ানা হন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, তাওফিক এলাহি, মাহবুব উদ্দিন তার সঙ্গে।

সিদ্ধান্ত নেন ভারতে যাওয়ার। বেলা তিনটার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে সঙ্গে সীমান্তের পথে রওয়ানা হলেন। এর আগে তিনি ডাঃ আসহাবুল হক এমপিএ, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি, মেজর ওসমান ও পুলিশের মাহবুব উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে চুয়াডাঙ্গায় বৈঠক করেন। সীমান্ত থেকে কিছু দূরে একটি জঙ্গলের মাঝে খালের ওপর একটি বৃটিশ আমলের তৈরি কালভার্টের ওপর তাজউদ্দীন বসে থাকলেন। প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় সীমান্ত ফাঁড়িতে পাঠালেন তৌফিক এলাহি ও মাহবুব উদ্দিনকে। কিছুক্ষণ পর একজন ভারতীয় সামরিক অফিসার জানালেন আপনাদের আগমনের খবর ইতিমধ্যে কলকাতায় পৌঁছে গেছে। রাত আটটার দিকে বিএসএফ এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদকে জানান, তাদের হাইকমান্ডের নির্দেশেই তিনি এসেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তির সংগ্রামে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্যের আবেদন জানালে গোলক মজুমদার বলেন, কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীজী এবিষয়ে বলবেন। দিল্লীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব নয় জানিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে আশ্বস্ত করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিবেন। মজুমদার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে দমদম বিমান বন্দরে নিয়ে যান। সেখানে বিএসএফ এর প্রধান ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিরাপত্তা প্রধান রুস্তমজীর সঙ্গে পরিচয় হলো তাজউদ্দীনের। বিএসএফ প্রধান তাঁর গাড়িতে চড়িয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথমেই প্রশ্ন করেন, আপনাদের নেতা শেখ মুজিব কোথায়? উত্তরে বলা হলো তিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর নির্দেশেই আমি এসেছি। এরপর ‘আসাম হাউজ’ নামে একটি বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। রুস্তমজী অতিরিক্ত কোন পোশাকআশাক না দেখে তাঁর পায়জামা ও কোর্তা দিলেন। ছয় ফুট লম্বা বিএসএফ প্রধানের কোর্তা তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সামাল দেয়া কষ্টকর হলো। বিএসএফ এর বিভিন্ন প্রধানরা গভীর রাতে জড়ো হলে বাড়িটিতে। আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএ সহ ছাত্র ও যুবনেতাদের তালিকা তৈরি করা হলো। যোগাযোগের জন্য বিএসএফ দায়িত্ব গ্রহণ করে।

তাজউদ্দীন তাদের জানান ইতিমধ্যে যশোর সেনানিবাস অবরুদ্ধ, কুষ্টিয়া সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে, চুয়াডাঙ্গা শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসম্ভব সাহায্য দিতে বিএসএফ রাজী হলো। পরদিন সকালে বিএসএফ নিজস্ব রেডিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার কথা প্রচার করা হয়। প্রথমে চুয়াডাঙ্গাকে বিপ্লবী সরকারের রাজধানী করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সরকার গঠন পরিকল্পনা করা হয়। চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলে মেজর ওসমানের সঙ্গে তার তেজস্বী স্ত্রীও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য ৬ নভেম্বর রাতে পাক বাহিনীর হাতে বেগম ওসমান নিহত হন। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তাজউদ্দীন আহমদ। সঙ্গে বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদার।সরজিৎ চট্টোপাধ্যায় পরিধেয় কাপড়চোপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র স্যুটকেসের ভেতর নিয়ে আসেন। ওখান থেকে রাত ১০ টার দিকে জীপে করে একটি মিলিটারি মালবাহী বিমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাজউদ্দীনকে। এই মালবাহী বিমানে নেয়ার কারণ ছিল বিষয়টি গোপন রাখা। ভোরে পৌঁছার পর প্রতিরক্ষা কলোনীর একটি বাড়িতে রাখা হলো। রেহমান সোবহান, ডঃ আনিসুর রহমান, এম আর সিদ্দিকী, সিরাজুল হক বাচ্চু মিয়া ও ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি আব্দুর রউফ তখন দিল্লীতেই অবস্থান করছিলেন। এম আর সিদ্দিকী কাছ থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও নোয়াখালীর খবরাখবর পান তাজউদ্দীন। চট্রগ্রামে কালুরঘাট বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান ও ২৭ মার্চ মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের কথা জানতে পারেন। এমআর সিদ্দিকী আগরতলা ও আবদুর রউফকে রংপুর পাঠিয়ে দেন তাজউদ্দীন। ময়মনসিংহ থেকে রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া ও সৈয়দ সুলতান চিঠি হস্তগত হয় তাজউদ্দীনের। বিএসএফ প্রধান গোলক মজুমদারের মাধ্যমে ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন আহমদকে প্রথম প্রশ্ন করেন,”হাউ ইজ শেখ মুজিব, ইজ হি অল রাইট?” প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ না হলেও আমাদের বিশ্বাস তিনি তাঁর স্থান থেকে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোন মূল্যে আমাদের বিজয়ী হতে হবে। আমাদের অস্ত্র ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য দরকার। ভারতের গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা চাই। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ভাষায় তাজউদ্দীন আহমদ নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেম ও মুজিব প্রেমে উদ্ধুদ্ধ এক সংগ্রামী মানুষ ছিলেন। বেশি কাজ করেও কৃতিত্বের দাবি করতেন না। আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রস্তাব করি তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বুঝবেন না। ঠিক করলেন তাজউদ্দীন নিজেই দেশের নাম হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একটি মনোগ্রাম চারপাশে গোলাকৃতি লাল এর মাঝখানে সোনালী রঙের মানচিত্র। রেহমান সোবহান ও ডঃ আনিসুর রহমান এলেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টির কথা বললেন রেহমান সোবহান। তিনি তাজউদ্দীনের ভাষণে এই কথাটি লিখলেন “Pakistan is dead and burried under mountain of Corpses ( পর্বত প্রমাণ লাশের নীচে পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে) এর সঙ্গে আমীর উল ইসলাম যোগ করেন, ” আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছেলেদের রক্ত ও ঘামে মিশে জন্ম নিচ্ছে নতুন বাংলাদেশের।

৫ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দ্বিতীয় বারের মতো ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় দেন। ইন্দিরা গান্ধীর কাছেই প্রথম তাজউদ্দীন শুনতে পান যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। যাবতীয় সহায়তা দেয়া হবে। ইন্দিরা গান্ধী অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নগেন্দ্র সিং দিলেন। একটি ছোট বিমানও দেয়া হলো। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় আসেন। গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে এইচ এম কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী ছিলেন। সেখানে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদও ছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি বলেন, সরকার গঠনের প্রশ্নে পরিষদ সদস্যরা খুশি নন। তারা প্রিন্সেস স্ট্রিটের এমএলএ হোস্টেলে আছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারলাম। কামরুজ্জামানকে নিয়ে পরিষদ সদস্যরা একটি বৈঠকও করলেন। মিজানুর রহমান চৌধুরীও দ্বন্দ্বে ছিলেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে বৈঠক বসলো। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী, বাংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে। এখন কোন মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে। বৈঠকে প্রায় সকলেই একই সুর। কামরুজ্জামান ছিলেন প্রাণখোলা সরল মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মেনে নিতে তিনি আর দ্বিধা করলেন না। ১০ এপ্রিল বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ মনসুর আলী, শেখ মনি ও তোফায়েল আহমেদ লর্ড সিনহা রোড থেকে সোজা বিমানবন্দর চলে যান আগরতলায় যাওয়ার জন্য। প্রাদেশিক পরিষদের নেতা হিসেবে মনসুর আলীর প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হলেও তাজউদ্দীন আহমদকে মেনে নিলেন।

১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ সম্প্রচারিত হলো ভারত রেডিও থেকে। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের কন্ঠে বলা হলো এখন ভাষণদান করবেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। গোলক মজুমদারকে ১০ এপ্রিল এ ভাষণ সম্প্রচার করতে মানা করলেও তা প্রচার হয়ে যায়। সারা বিশ্ব জেনে গেলো সরকার গঠনের খবর। তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণের পর রাতে কর্নেল নুরুজ্জামান ও আব্দুর রউফ আসেন। খুঁজে পাওয়া গেলো সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে। ওখান থেকে আগরতলা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান তিনি ডাঃ আলীম চৌধুরীর ছোট ভাইয়ের বাসায় আত্মগোপন করেছিলেন। সেই বাসা হতে পরচুলা ও মেয়েদের শাড়ি পরে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। কর্নেল ওসমানীও আগরতলায়। দৃষ্টি আকর্ষণ করা সেই গোঁফ আর নেই। খন্দকার মোশতাককে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন ডঃ টি হোসেন। সিলেট থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ ও চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমেদ চৌধুরীও এসেছেন। তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুবুল হক চাষী আগেই আসেন। আগরতলার সার্কিট হাউজে বসে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান হতে অনুরোধ করা হলো। খন্দকার মোশতাক খুবই মন খারাপ করে আছেন। বললেন তাকে যেন মক্কা পাঠিয়ে দেয়া হয়। টি হোসেনের ভাষ্যমতে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মোশতাক বললো তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিতে হবে। মোশতাক রাজী হওয়ায় জহুর আহমেদ চৌধুরী মোনাজাত করলেন। ১৩ এপ্রিল কলকাতা ফিরে গেলেন সকলে। আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হলো। চুয়াডাঙ্গায়। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাক বাহিনী দখল করে নেয়ায় সে চিন্তা বাদ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলাকে শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে বেছে নেয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামকে দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রের খসড়া তৈরি করালেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরী ঘোষণা পত্রটি দেখে দেন। বিএসএফ ওসমানীর সামরিক পোশাক তৈরি করে দিল। সাংবাদিকদের জড়ো করার দায়িত্ব ছিল আব্দুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেসক্লাবে গেলেন। ১৭ এপ্রিল সারারাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ওসমানী একটি গাড়িতে রওয়া হলেন। আম্রকাননে পৌঁছাতে ১১ টা বেজে গেলো। মাহবুব উদ্দিন ও তৌফিক এলাহি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করলেন। চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলি স্বাধীনতার সনদ পাঠ করেন। কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শপথ অনুষ্ঠানের শুরু। ছোট মঞ্চে আব্দুল মান্নান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ বাক্য পাঠ করান। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও কামরুজ্জামানকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ স্থানটির নাম ‘মুজিব নগর’ নামকরণ করেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব বন্টন করেন।

শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটে মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স – বিএলএফ) এর। তাদের অধিনায়কত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন সহ অধিনায়ক হন। শুরু হয় নয় মরণপর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় পাকবাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যৌথবাহিনীর কমান্ডার জগৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করে ৯৫ হাজার পাক সদস্যের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। পৃথিবীর বুকে অভ্যুদয় ঘটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। ২২ ডিসেম্বর মুজিব নগর সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা রূপে স্বদেশে ফিরে আসেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৭ মার্চ ভারতীয় মিত্রবাহিনী স্বদেশে ফেরানোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিশ্ববাসীর সামনে উজ্জ্বল করে তোলেন।

“মুজিবনগর সরকার যুদ্ধজয়ের পর গ্রহণ করলো মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে” “রক্ত দিয়েই যদি স্বাধীনতার মূল্য নিরূপণ করা হয় তাহলে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এমন স্বাধীনতা অর্জন পৃথিবীর কয়টা দেশ-জাতি পেরেছে, আমার জানা নেই, যার মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।” বৃটেনের বিখ্যাত সংবাদপত্র New Statesmen এর সম্পাদক কিংসলি মার্টিন তাঁর স্বনামে প্রকাশিত এক বিশেষ সম্পাদকীয়তে উপর্যুক্ত মন্তব্যটি করেছিলেন। অথচ, তখনো রমনার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে পূর্বদিগন্তে বিজয় পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেনি। রমনার রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তির ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকামিলা কর।”সেই রেসকোর্স ময়দানেই পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণে বাঙালির বিজয় হলেও তা অপূর্ণ রয়ে যায় তখনো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারাগারে থাকায়। তাঁকে নিয়ে ঘরেবাইরে উৎকন্ঠা আর কতশত গুজব। মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও মুজিব বাহিনীর সৃষ্ট দ্বন্দ্ব গুজবকে প্রকট করে তুলে। মুজিব বাহিনী রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে জনসভা করার ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন এমন গুজব চারদিকে। এমন পরিস্থিতিতে তাজউদ্দিন আহমদ ছুটে যান বেগম মুজিবের কাছে ধানমন্ডির ১৮ নম্বরের বাড়িতে। তিনি মুক্তির বিষয়ে সরকারের তৎপরতা সম্পর্কে বেগম মুজিবকে অবহিত করেন। এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব এবং ইউরোপের অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন। কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তারা শেখ মুজিবের যদি কিছু হয়ে যায়, তবে ফলাফল ভয়াবহ হবে বলে হুকমি দেয়। “৭২ এর ৩ জানুয়ারি করাচির জনসভায় পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের সরকারি সিদ্ধান্তের কথা ঘোষনা করেন। ২২ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকার মুজিব নগর থেকে রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান গভর্নর হাউসে (বঙ্গভবন) এসে ওঠেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ গিয়ে ওঠেন তার আগামসি লেনের বাড়িতে। তাজউদ্দিন নতুন মন্ত্রিসভা করে মোশতাকের স্থলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেন আব্দুস সামাদ আজাদকে। মোশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে কনফেডারেশন গঠনের প্রয়াস চালানোর।আগেই জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতারূপে মোশতাককে বাদ দিয়ে লন্ডনে দায়িত্বরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পাঠানো হয়েছিলো। তারপরও আইনমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিতে বলা হলে অগ্রাহ্য করেন মোশতাক। তিনি অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।

১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাতে বিবিসির খবরে দেয়, বঙ্গবন্ধু একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে রয়েছেন। সেই খবরে মানুষের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। বিবিসি দ্বিতীয় খবরে বলে, বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি সকাল সাড়ে ৬টায় লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। সকাল দশটায় দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবকে বিরল অভিবাদন জানিয়েছেন। ওদিন সন্ধ্যায় ববঙ্গবন্ধু তাঁর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন বাসায় গিয়ে বেগম মুজিবকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশে ফেরার সময়সূচি জানান। বঙ্গবন্ধু ৯ জানুয়ারি রাতে লন্ডন ত্যাগ করে পরদিন দিল্লিতে পৌঁছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ভারতীয় একটি বিমানে কোলকাতায় একঘন্টা যাত্রা বিরতি করে বিকাল চারটার দিকে ঢাকা পৌঁছবেন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। বেগম মুজিব প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে অনুরোধ করে বলেন, দিল্লিতে বিমানে পরিবর্তন করলে বৃটেন মন:ক্ষুন্ন হতে পারে। তাঁর বৃটিশ বিমানেই ঢাকা আসা উচিত। ততক্ষণে তাজউদ্দিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডি পি ধরকে ফোন করে বেগম মুজিবের পরামর্শ জানিয়ে দেন। সে অনুযায়ী ১০ জানুয়ারি দুপুরের দিকে বৃটিশ রাজকীয় বিমান “কমেট” দিল্লির পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রিসভা বিশাল অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এক বিরাট সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে-বাংলাদেশে। সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো, তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ। কারো জন্যে কোনো ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না। মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়,অশুচিতার ওপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে-রক্তস্নাত ওপর শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে। বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি “সাদাকমেট” বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানাতে মন্তিসভার সদস্যরা আগে থেকেই উন্মুখ।
দাঁড়িয়ে ছিলেন এ ছাড়াও মুজিববাহিনী ও ছাত্রলীগ তথা স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এইচএম কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ও আব্দুল কুদ্দুস মাখনও বঙ্গবন্ধুকে মাল্যভূষিত করেন। এরপর একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাত্রা করে রেসকোর্স ময়দান অভিমুখে। ছাত্রনেতাদের নিয়ন্ত্রিত ট্রাকটিতে গাদাগাঁদি করে– দন্ডয়মান ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। বিকাল তিনটায় অবতরণ করেছিলো বিমানটি। ছাত্রলীগ নেতারা ব্যূহের মতো করে মঞ্চের কাছে নিয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকে। লাখ লাখ মানুষের উপচে পড়া ভিড় ঢেলে যখন বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উপবিষ্ট, তখন জয়বাংলার গগণবিদারি শ্লোগানে মুখরিত ময়দানের জনস্রোত।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের কন্ঠ মাইকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে গর্জে উঠে শোনায় শেখ মুজিবের উপস্থিতির বার্তা। তোফায়েল আহমেদ ৬৯ গণঅভ্যুত্থানের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি যে বঙ্গবন্ধু খেতাব দিয়ে ছিলেন সেই অভিধায় শেখ মুজিবকে অভিসিক্ত করে জনসমুদ্রে বললেন, ‘ভাইসব’ বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে তিনি ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধুর এবং আমাদের নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে সবাই বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আশেপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনীর হাত যে কোন জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে।কড়া নজর রাখবেন। তোফায়েল আহমেদের এ বক্তৃতার মধ্যেই চোখের পলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভামঞ্চে এসে হাজির। তিনি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিথর নিরব হয়ে থাকলেন। ময়দানে উত্তেজনার উদ্বেল আনন্দ ধ্বনি। বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নাবিজড়িত কন্ঠে বললেন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আমি বলেছিলাম, “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।,,,,,, ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালির প্রাণ থাকতে এ স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না।”
পাকিস্তানি জেলখানায় নিজের বন্দিদশার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার ফাঁসি র হুকুম হয়েছিলো, আমার সেলের পাশে আমার কবর খোঁড়া হয়েহয়েছিল, আমি মুসলমান, আমি জানি মুসলমান একবারই মরে, তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতিস্বীকার করবো না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময়ও আমি বলবো, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করে জাতির পিতা বলেন, আমি যখন চাইবো ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্য বাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবেন। ভাষণের একপর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি” উদ্ধৃতি করে বলেন, এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। আপনাদের মুজিব ভাই আহবান জানিয়েছিলেন আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন। বাঙালি বীরের জাতি। পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের পদানত করতে পারবে না। বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করে বলেছেন, সম্ভব হলে আমি যেন লুস ফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। তাকে বলেছি, আমার জনসাধারণের নিকট আমি ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবো না। এখন আমি বলতে চাই , ভুট্টো সাহেব আপনারা সুখে শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ সেই স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায় তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য শেখ মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।

বঙ্গবন্ধু জনসভা শেষ করে সদলবলে ছুটে যান শেরেবাংলা ও সোহরাওয়ার্দীর মাজারে। মাজার জিয়াররত করে ওখান থেকে যান শহীদ মিনারে। ততক্ষণে সন্ধ্যা। ওখান থেকে ৩২ নম্বরের সড়কের ধানমন্ডির বাড়িতে। যে বাড়ি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেখানে ফেরেন বাবা, মা, ভাইবোন স্ত্রী, পুত্র-কন্যা মাঝে । এরপর ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলাপে বসেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকান্ড এবং মুজিব বাহিনীর মধ্যে বৈরী সম্পর্কের নেপথ্য ঘটনাগুলো শুনেন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনে যান শেখ মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে। এরপর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা জারি করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। শুরু হয় জাতির পিতার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিনির্মানের স্বপ্ন।


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

"মনোযোগের প্রতি মনোযোগী হোন"


Thumbnail

এরিক আর্থার ব্লেয়ার (১৯০৩-১৯৫০) কালউত্তীর্ণ  সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক লেখক। ব্রিটিশভারতে জন্মগ্রহণকারী "এনিমেল ফার্ম" খ্যাত এই ইংরেজ লেখক জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামেই সমধিক পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস "1984" প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। এই বিখ্যাত উপন্যাসটিতে যে সকল সংকটের কথা কল্পনা করা হয়েছিল এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি হচ্ছে তথ্যের স্বল্পতা। ভবিষ্যতের শাসকরা আরো বেশি করে তথ্য আটকে রাখবে, তথ্য পাওয়া যাবে না। কিন্তু বাস্তবে এমনটি ঘটেনি। তথ্যের স্বল্পতা ১৯৮৪ সালে প্রকট হয়নি। আর এখন তো সবচেয়ে সহজে যা পাওয়া যায়, সেটা হচ্ছে 'তথ্য'। অন্যান্য পণ্যের মতো তথ্যও উৎপাদন এবং বাজারজাতকরণ করা যায়। পণ্য হচ্ছে, "anything that can be offered to a market for attention, acquisition, use or consumption that might satisfy want or need" (Kotler, 2022)। পণ্যের সংজ্ঞায় দখল, ব্যবহার এবং ভোগের আগেই 'মনোযোগ' শব্দটি গুরুত্ব পেয়েছে। William James তাঁর Principles of Psychology (1980) বইয়ে মনোযোগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন, "attention is the taking possession by the mind, in clear and vivid form, of one out of what may seem several simultaneously possible objects of trains of thought ... It implies withdrawal from something in order to deal effectively with others. 

" মনোযোগ বলতে নির্দিষ্ট একটা বিষয়কে ফোকাস করাকে বুঝায় না, একই সাথে এটা অসংখ্য প্রতিযোগী তথ্য এবং উদ্দীপককে অগ্রাহ্য করাকেও বুঝায়। যা এ মুহূর্তে প্রাসঙ্গিক নয় সেটাকে এড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রতি আকর্ষিত হওয়াই মনোযোগ ( Kendra Cherry, 2022)। কোন পণ্যকে ভোক্তা কিভাবে মূল্যায়ন করবে সেটা অনেকাংশেই তাঁর প্রত্যক্ষণের উপর নির্ভর করে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের একটি পূর্বশর্ত। কোন নির্দিষ্ট উদ্দীপকের প্রতি ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রীয় সমূহকে নিবদ্ধ করার নামই হলো মনোযোগ। যে মানসিক ক্রিয়ার মাধ্যমে একাধিক বিষয় থেকে চেতনাকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একটি বিশেষ বিষয়ে চেতনাকে কেন্দ্রীভূত করা হয় তাকে মনোযোগ বলে। ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের খরচ গত দুই দশকের ৭ থেকে ৯ গুন বেড়ে গেছে। ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করা মার্কেটিংয়ের কাজ। মার্কেটিংয়ের চুম্বকীয় বার্তাকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে যাতে সেটা ক্রেতার মনোযোগ দখল করতে পারে। এই প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েও কোন লাভ হবে না, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোন বিকল্প নেই (Rebecca Riserbalo,2021)। "মনোযোগ বারজাতকরণ" শব্দবন্ধ প্রথম ব্যবহার করেন Steve Jerry, পরবর্তীতে এটাকে জনপ্রিয় করে তোলেন Seth Godin. মনোযোগ বাজারজাতকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Rebecca Riserbalo বলেন, '"Attention marketing is the concept that marketing is all about capturing and engaging your audience's attention. This is usually done through non-invasive means, like social media. With attention marketing you'll focus on how to capture someone's limited attention"(Rebecca Riserbalo, "Attention Marketing", 2021)। Microsoft এর এক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে গড়ে ব্যক্তির মনোযোগের স্থায়িত্বকাল ৪ সেকেন্ডে নেমে এসেছে। ২০০০ সালে একজন মানুষ একটানা গড়ে কোন বিষয়ে ১২ সেকেন্ড মনসংযোগ করতে পারতেন, ২০১৫ সালে এটা ছিল ৮ সেকেন্ড। এর মানে হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে, অন্যথায় সে স্করল (scorl) করে অন্যদিকে চলে যাবে। মনোযোগ হল কোন বিশেষ তথ্যের উপর কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের  চেতনায় আসে। আমরা বিশেষ কোনো তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপর সিদ্ধান্ত নেই কোন পদক্ষেপ নিব কি, নিব না (Davenport & John, 2001)। মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে (Crawford ,2015)। এক সাথে অনেকগুলো বিষয়ে মনোযোগ দেয়া প্রায় অসম্ভব। দানবীয় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন google, মেটা, Apple, আমাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তথ্য সেবা দিচ্ছে। আর আমরা মনোযোগ দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভবান করছি। (একই প্রক্রিয়ায় দেশে বিদেশে অবস্থানকারী কিছু রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইউটিউবারের (বাটপার) মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্ভট কন্টেন্ট দেখে দর্শকরা তাদের ভরণপোষণ করছে।

কেউ কেউ গত দুই দশকের অর্থনীতিকে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন। মনোযোগের অর্থনীতি কথাটি বহু পুরাতন। আজ থেকে প্রায় সিকি শতাব্দী আগে, ১৯৯৭ সালে মাইকেল গোল্ডহেবার "Wired" সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর "Attention Shoppers" নিবন্ধে প্রথম মনোযোগ অর্থনীতির বিষয়টির অবতারণা করেন। কোন অর্থনীতিতে অনেক মানুষ যখন তথ্য ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে সেটাকে তথ্য অর্থনীতি বলে। 

গোল্ডহেবার বলেন, তথ্য অর্থনীতি কথাটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোন সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলো কিভাবে ব্যবহার করবে তার চর্চা। ("Economics is the science which studies human behaviour as a relationship between ends and scarce means which  have alternative uses"- Lionel Robbins)। আজকের দিনে তথ্য কোন দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়। যেটা দুষ্প্রাপ্য সেটা হচ্ছে মনোযোগ। ইন্টারনেটের দুনিয়ায় অর্থনীতির মূল নির্ধারক মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।

মানব ইতিহাসের সিংহভাগ জুড়ে তথ্য ছিল দুষ্প্রাপ্য। কয়েক দশক আগেও বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া জানতো না। আধুনিক যুগে সবাই সবকিছু প্রায় বিনামূল্যে পড়ছে। মানুষের সময় এবং তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষমতা একটুও বাড়েনি। মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ। একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অন্যটির প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। প্রচুর তথ্য সম্পদ মনোযোগের দারিদ্র্য তৈরি করে। ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেলবিজয়ী মনোবিজ্ঞানী হারবার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, "একটি তথ্য সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছুর ঘাটতি সৃষ্টি হবে, যা হলো তথ্য যা ভোগ করে। তথ্য কি ভোগ করে? এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে। মার্কেটিংয়ে তথ্য নিজেই একটি পণ্য, অপরদিকে এটি একটি মার্কেটিংয়ের কৌশলগত হাতিয়ার। মনোযোগ হচ্ছে বিনামূল্যে পাওয়া তথ্যের জন্য প্রদেয় ক্রেতার মূল্য (Herbert Simon, 1971)। তথ্য বিস্ফোরণ (information overload) বাজারজাতকরণকে সহজ করার পরিবর্তে জটিল করে তুলেছে। "Information overload is the difficulty in understanding an issue and effectively making decisions when one has too much information (TMI) about that issue,  and is generally associated with the excessive quantity of daily information". ১৯৭০ সালের প্রকাশিত বেস্ট সেলার বই "Future Shock" এর লেখক Alvin Toffler তথ্য বিস্ফোরণ বা information overload বিষয়টি নিয়ে সবাইকে মাথা ঘামাতে বলেন। মানুষের তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার অতিরিক্ত তথ্য যখন তাঁর নিকট চলে আসে তখনই তথ্য বিস্ফোরণ ঘটে (infobesity), এর ফলে সিদ্ধান্তের মান কমে যায়। খুব বেশি তথ্য নিয়েই বরং ক্রেতা সমস্যায় পড়ে যায় (information anxiety), সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে অথবা শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারেনা (Alvin Toffler,1970)।

বাজারজাতকরণকারীর সরবরাহকৃত তথ্য যাতে প্রতিযোগিতা করে অন্য কোম্পানির তথ্যের চেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে সেজন্য তথ্যকে প্রাসঙ্গিক, আগ্রহজনক এবং ব্যক্তিবিশেষের আগ্রহ অনুযায়ী নির্বাচন ও উপস্থাপন করতে হবে। তথ্যের মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণ করতে হলে তাঁকে একটা সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা প্রদান করতে হবে। বিক্রেতাকে অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ক্রেতার সাথে ঘনিষ্ঠতা (engagement) বাড়াতে হবে। মনোযোগ হচ্ছে প্রত্যক্ষনের পূর্বশর্ত। একই পরিস্থিতিকে বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষণ করে। ভিন্ন প্রত্যক্ষণের কারণ হচ্ছে যদিও আমরা প্রত্যেকেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে তথ্য (উদ্দীপক) গ্রহণ করি, কিন্তু এ ইন্দ্রিয়ে সাড়া জাগানো তথ্যগুলোকে আমরা নিজেদের মতো গ্রহণ, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করি। প্রত্যক্ষন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার সাহায্যে ব্যক্তি জগতের অর্থবহ চিত্র (উদ্দীপক) থেকে তথ্য নির্বাচন, সংগঠন এবং ব্যাখ্যা করে। একই উদ্দীপক বিভিন্ন ব্যক্তির নিকট বিভিন্ন প্রত্যক্ষণ সৃষ্টি করার কারণ হচ্ছে তিনটি প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া (perceptual process): নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া( selective exposure), নির্বাচিত বিকৃতকরণ (selective distortion) এবং নির্বাচিত ধারণ (selective retention)। প্রত্যেক ব্যক্তি প্রতিদিন অসংখ্য উদ্দীপকের মুখোমুখি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একজন ব্যক্তি প্রতিদিন গড়ে কয়েক শত বিজ্ঞাপনের সম্মুখীন হয়। কোন ব্যক্তির পক্ষেই সবগুলো বিজ্ঞাপনের (উদ্দীপকের) প্রতি মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয়। বেশিরভাগই পর্দার অন্তরালে চলে যায়। বাজারজাতকরণ যোগাযোগকারীর প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কোন্ উদ্দীপক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে সেটা ঠিক করা। গবেষণা থেকে দেখা গেছে মানুষ তার বর্তমান প্রয়োজনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্দীপকটির প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। যে যেই সমস্যায় থাকে সে সেই সমস্যার সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। ভুক্তভোগীর প্রত্যেকটি সমস্যার এক একটি সমাধানই হচ্ছে 'পণ্য' (product is a solution to customers problem)। তাঁরা প্রত্যাশিত উদ্দীপকের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়। নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়ার কথাটির তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে ভোক্তা মনোযোগ আকর্ষণের জন্য বিশেষ করে চেষ্টা চালাতে হবে। তাঁদের অফার(offer) হয়তো এমন ব্যক্তিদের মাঝে হারিয়ে যেতে পারে যারা পণ্য গ্রহণের বাজারে নেই। অন্যদের অফারের সমুদ্রে নিজের অফারকে স্বাতন্ত্র্য (পৃথকীকরণকৃত) করতে না পারলে বাজারে অবস্থানকারী সম্ভাব্য ক্রেতাদেরদেরও মনোযোগ আকৃষ্ট হবে না। এমনকি যেসব উদ্দীপক ভোক্তার দৃষ্টি কাড়ে তাও আবার সব সময় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয় না। প্রত্যেক ব্যক্তি আগত তথ্যকে তাঁর পূর্বস্থিরকৃত মনের অবস্থা (মনের মাধুরী মিশিয়ে) দিয়ে মিলাতে চেষ্টা করে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের অর্থ হচ্ছে তথ্যের ব্যক্তিগত অভিযোজন প্রবণতা। যোগাযোগকারী যাই বলুক না কেন বা দেখাক না কেন ভোক্তা তাঁর নিজের পূর্বস্থিতরকৃত মনের অবস্থা দ্বারা উপসংহারে আসবে। মানুষ উদ্দীপককে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে চায় যা সে ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করে তা যেন সমর্থিত হয়। ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, পোশাক, সংগীত, খাদ্য এসকল প্রায় সব ব্যাপারেই মানুষের একটা মনোভাব থাকে। মনোভাব দ্বারা ব্যক্তির কোন ধারণা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে দৃঢ় (consistent )মূল্যায়ন, অনুভূতি এবং প্রবণতা নির্ধারিত হয়। মনোভাব মানুষের মনে এমন একটি মানসিক কাঠামো তৈরি করে যার দ্বারা সে কোন কিছুকে পছন্দ করে ওই দিকে এগিয়ে যায় অথবা দূরে সরে আসে। নির্বাচিত বিকৃতকরণের তাৎপর্য হচ্ছে বারজাতকরণকারীকে ভোক্তার মনের পূর্বকথা এবং এগুলো কিভাবে বিজ্ঞাপন ও বিক্রয় তথ্যকে প্রভাবিত করবে তা অনুধাবন করা।

মানুষ যা শিখে তার অনেক কিছুই ভুলে যায়, যা তাদের বিশ্বাস এবং মনোভাবকে সমর্থন করে ওইসব তথ্য মনে রাখার প্রবণতা মানুষের মধ্যে বেশি থাকে। নির্বাচিত ধারণ( মনে রাখা) প্রবণতার কারণে ভোক্তা কোন পণ্যের ভালো গুণগুলোই বেশি মনে রাখবে,  প্রতিযোগী পণ্যের গুণাগুণ গুলো ভুলে যাবে। ক্রেতা তাঁর পছন্দের পণ্যের ভালো পয়েন্টগুলো মনে রাখে এবং পণ্য পছন্দের সময় ওই কথাগুলোই বারবার স্মরণ (rehearses) করে। তিনটি প্রত্যক্ষন উপাদান- নির্বাচিত প্রভাবাধীন হওয়া, বিকৃতকরন এবং ধারণের তাৎপর্য হচ্ছে বাজারজাতকরণকারীকে তার বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছাতে হলে কঠোর অনুশীলন করতে হবে। এই উপাদানগুলো দ্বারা অভীষ্ট বাজারে বার্তা প্রেরণের পৌন:পুনিকতা, এবং নাটকীয়তার সামর্থনে ব্যাখ্যা দেয়া যায় । আরেকটি কৌতুহরী ব্যাপার হচ্ছে যদিও বেশিরভাগ বাজারজাতকরণকারী তাঁর আবেদন ভোক্তারা আদৌ প্রত্যক্ষণ করবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দিহান থাকে, একই সময়ে একদল ভোক্তাও আবার শঙ্কিত থাকে এজন্য যে, তেমন কিছু না জেনেই বাজেজাতকরণ বার্তা দ্বারা সে ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হবে কিনা।

মনোযোগ বরজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রথম কাজ হচ্ছে যাদের নিকট তথ্য পৌঁছানো হবে তাদের ব্যবহৃত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্লাটফর্মটি নির্বাচন করা। তারপরের কাজ হচ্ছে অতি সুস্পষ্ট একটি বার্তা তৈরি করা। ক্রেতারা যে সকল বিষয়কে মূল্যবান( value) মনে করে কেবলমাত্র সেই বিষয়গুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করা। এক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট ভ্যালু বিবৃতি তৈরি করতে হবে। বিবৃতি তৈরীর সময় যে ফরমেটটি এক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয় সেটি হচ্ছে,  "To...our.. is ..that"  ফরম্যাট । এক্ষেত্র "To" হচ্ছে সুনির্দিষ্ট টার্গেট অডিয়েন্স । "our" হচ্ছে ব্র্যান্ডের নাম, "is" হচ্ছে জিনিসটি কি? আর "that" হচ্ছে এই জাতীয় অন্যান্য অফারের সাথে কোম্পানির অফারের পার্থক্য(POD)। বার্তা প্রেরণের জন্য একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করলে এগুলোর মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে । বিভিন্ন 

মিডিয়ায় প্রচারিত বার্তায় একটি গল্প থাকতে হবে যার মধ্যে  বাজারজাতকরণের আবেগীয় আবেদনের উপাদান থাকতে হবে। কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করছে না এমন অন্য ব্র্যান্ডকেও ক্রেতার মনোযোগ মনোযোগ আকর্ষণের কাজে সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে(co-branding)। যেহেতু দেশের প্রায় ৭০% লোক ইন্টারেক্টিভ অনলাইনে সংযুক্ত অতএব মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য একটি আকর্ষণীয় ওয়েবসাইট থাকতেই হবে। মনোহারী যোগাযোগ এবং অন্যান্য উপায়ে ক্রেতার মনে অবস্থান( position) তৈরি করার বিষয়টি স্বীকার করেও বলা যায়, ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে স্থান(place) এবং প্যাকেজিং এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ । ওয়ালমার্টের একটি সুপারসেন্টারে প্রায় ১ লক্ষ ৪২ হাজার আইটেম থাকে। ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতি চারটির মধ্যে তিনটি সিদ্ধান্ত দোকানে গিয়ে গ্রহণ করে,  এবং এসময়ে তাঁরা প্রতি মিনিটে তিনশোটি আইটেম অতিক্রম করে। অসংখ্য প্রতিযোগী পণ্যের মধ্যে 

দোকানী আপনার পণ্যটি কোন্ রেকে (shelf) এবং রেকের কোন্ অবস্থানে (রেকের নিচের দিকে, চোখের সমান উচ্চতায়, মাথার উপরে) রেখেছে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে বিক্রেতার জন্য ক্রেতার মনোযোগের আকর্ষণের সর্বশেষ হাতিয়ার হতে পারে পন্যের প্যাকেট। আকর্ষণীয় প্যাকেট মনোযোগ ছাড়াও পণ্যের সাথে ক্রেতার এংগেজমেন্ট বা ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দেয়,  যা অন্য কোন মাধ্যমে সম্ভব নয়।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

মার্কিন দূতাবাসের সতর্কতা ও দেশি দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তা


Thumbnail

আমেরিকা আমার 'খুউব' পছন্দের দেশ। পছন্দের অন্যতম কারণ হলো, সে দেশের পররাষ্ট্র অনুষদের কর্মকান্ড। দেশটি তাদের নাগরিকদের খুব ভালোবাসে। তাদের নিরাপত্তায় সর্বদা উদ্বিগ্ন। নাগরিক বিদেশে গেলে সে দেশে কোথায় যাবে না যাবে, কোথায় নিরাপদ, কোথায় ঝুঁকিপূর্ণ, কেমন সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, তার একটি দিক নির্দেশনা সময়ে সময়ে দিয়ে থাকে। এমন নির্দেশনা সরকার তাদের নাগরিকদের দিলে সে নাগরিকের গর্ববোধ করা উচিত। সে জন্যই দেশটিকে 'খুউব' পছন্দ করি।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস গত ২১ মে সে দেশের নাগরিকদের জন্য একটি ভ্রমণ সতর্কবার্তা জারি করেছে। সতর্কবার্তার নাম দিয়েছে  ‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’। বার্তায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক সভা সমাবেশ বাড়তে পারে। বিক্ষোভ হতে পারে। বিক্ষোভের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হতে পারে। সংঘাতময় হয়ে উঠতে পারে। সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। সে দেশের নাগরিকদের বড় সমাবেশ ও বিক্ষোভের স্থানগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। নাগরিকদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা পর্যালোচনা করার উপদেশ দেয়া হয়েছে।

‘ডেমোনস্ট্রেশন অ্যালার্ট’টি যখন দেয়া হয়, তখন দেশের রাজনীতির আকাশে সংঘাত, সহিংসতা বা বিক্ষোভের কোন ঘনঘটা ছিল না। কিন্তু তার দুদিন পর রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে যে তুলকালাম ঘটে গেল তাতে অনুমেয় যে দূতাবাস একেবারে মোক্ষম সময়ে সতর্ক বার্তা জারি করেছে। তাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার তারিফ করতে হয়। দেশটির জনগণের প্রতি তাদের সরকার যে মায়া মমতা ও উদ্বিগ্নতা, সঠিক সময়ে সঠিক বার্তা, সেটি আজকের বিষয়বস্তু নয়। কোন দেশে এ ধরণের বা এর চেয়ে বেশি খারাপ পরিস্থিতি হলে আমাদের দূতাবাসগুলোর ভূমিকা বা নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। প্রায় সোয়া কোটি দেশি রেমিটেন্স যোদ্ধা রয়েছে বিদেশে। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী যাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণে। প্রতিনিয়ত সংঘাত, সহিংসতা, বিক্ষোভ চলছে দেশে দেশে। কখনো শুনি না যে দেশি দূতাবাস গুলো এ ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো এ ব্যাপারে সর্বদাই নিষ্ক্রিয়।

ফিরে যাই মার্কিন মুলুকে। সেখানে বন্দুক সহিংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গত ৩২ বছরে দেশটিতে বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ১১ লাখের বেশি মানুষ। ২০২১ সালে বন্দুকের গুলিতে মারা গেছে প্রায় ৪৯ হাজার, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সার্বোচ্চ। আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে ৫২টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব হামলায় ৯৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে, আহত ২০৫। গত ফেব্রুয়ারিতে সেদেশে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৪০টি, নিহত ৪৬, আহত ১৫০। গত মার্চে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৩৯টি, নিহত ৫৬, আহত ১৩৬। গত এপ্রিলে বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে ৫৬টি। এসব ঘটনায়  নিহত ৬২, আহত ২৪৪। এপ্রিলের শেষ দিনে ১১টি ঘটনা ঘটেছে। ‘গান ভায়োলেন্স আর্কাইভ’ নামের একটি গবেষণা সংস্থার ওয়েবসাইটে এ তথ্য উঠে এসেছে।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত 'গান পলিসি' নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ২০০০ সালে বাংলাদেশে বন্দুক হামলায় মারা যায় দেড় হাজার জন। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায় সাড়ে ২৮ হাজার জন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা বাংলাদেশের দ্বিগুন। জনসংখ্যা অনুপাতে সেদেশে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর সংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে দশগুণ বেশি। 

যুক্তরাষ্ট্রে এসব বন্দুক হামলার  সংঘাতের ঘটনাস্থল সর্বত্র।  শপিংমল, পার্ক, স্কুল, হাসপাতাল, মেডিকেল সেন্টার, রেল স্টেশন, ব্যাংক থেকে শুরু করে জন্মদিনের অনুষ্ঠান, মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানস্থল, স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান যেখানে প্রতিনিয়ত বন্দুক হামলা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বাংলাদেশী বাস করে, বেড়াতে যায়, কাজে যায়, সভা-সেমিনারে যায়। আমেরিকার ভিসা দপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১২ হাজার বাংলাদেশী নন ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়েছে। তার মানে, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ৪ হাজার বাংলাদেশী যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে যায়। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার বাংলাদেশি ছাত্র ছাত্রী সেখানে পড়াশুনা করে । এসব প্রবাসী বাংলাদেশী ছাত্র বা টুরিস্টদের প্রতি বাংলাদেশী দূতাবাসের কি কোন দয়া মায়া নেই ? উদ্বিগ্নতা নেই ? তারাও তো পারে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বন্দুক হামলার প্রেক্ষিতে সময়ে সময়ে আমাদেরকে সতর্কবার্তা দিতে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশী দূতাবাস যুগ যুগ ধরে এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশের নাগরিকদের সতর্ক সংকেত দিচ্ছে না। শপিংমল, রেল স্টেশন, ব্যাংক, হাসপাতাল, স্কুল, পার্ক ইত্যাদি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থান এড়িয়ে চলার বা সাবধানে চলার পরামর্শ দিচ্ছে না। কিন্তু কেন ? দেশের নাগরিকদের প্রতি তাদের কি কোন দায়িত্ববোধ নেই?

এ বি এম কামরুল হাসান

প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিতে সাধারণ মানুষের কি আসে যায়?

প্রকাশ: ০৭:০১ পিএম, ২৯ মে, ২০২৩


Thumbnail

আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।

২.
জন ড্যানিলভিচ-এর লেখার সূত্র ধরে বলতে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নিয়ে মানবাধিকারের চিন্তা পুরোটাই হাস্যকর। কারণ তাদের নিজেদের দেশেই রয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।২০২০ সালের জুন মাসে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারানো কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ছিল সেদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘৃণ্য ঘটনা।সেসময় যখন দেশটির নানা জায়গায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে, তখন সেসব বিক্ষোভের সময়ও পুলিশি নির্মমতার বেশ কিছু ভিডিও মানুষকে স্তম্ভিত করেছে।মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও পাকিস্তানের মতো জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ।আর আমেরিকার বন্দিদের প্রতি আচরণের কথা তো বিশ্ববাসী জানে।মহাদেশটির মূল ভূ-খণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে স্থাপিত(২০০২) গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনাবিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, 'ওয়াটার বোর্ডিং'-সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়।নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যের নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনীদের ‘লজ্জা’ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা এইচআরডব্লিউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ উভয় বর্ণের মানুষ সমপরিমাণে মাদক সংক্রান্ত অপরাধে জড়িত রয়েছে। এ সত্ত্বেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকহারে আটক এবং বিচার করা হয়।আমেরিকার জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী হলেও মাদক সংক্রান্ত অপরাধের দায়ে আটক ব্যক্তিদের ২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। আমেরিকায় সাদাদের তুলনায় কালো মানুষদের ছয় গুণ বেশি আটকের ঘটনা ঘটে। পুলিশের হাতে অধিক হারে নিরস্ত্র আফ্রিকান-আমেরিকান হত্যার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্রের জঘন্য ঘটনা।আসলে নানা অপকর্মর জন্য মার্কিনীদের ‘লজ্জা’থাকলেও তারা অপর দেশের সমস্যা নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করে হরহামেশায়।তবে তাদের উদ্বেগে আমরা আদৌ উদ্বিগ্ন নই।

৩.
যেমন, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সতর্কবার্তা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটি নিয়ে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ২৭ মে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি নিয়ে সরকারের আবেদন করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর মতে, ‘যদি এই আইনের (ভিসা নীতি) কারণে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ হয়, তা হবে আশীর্বাদ।’ উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র গত ২৪ মে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন এই নতুন ভিসানীতিতে বলেছেন, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য তারা নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। এই ভিসানীতিতে ইমিগ্রেশন আইনের ২১২ ধারা প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। ২১২ ধারা অনুযায়ী, কোন দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যদি কেউ অন্তরায় সৃষ্টি করে, যদি সুষ্ঠু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করে বা নির্বাচনে অন্য উপায় অবলম্বনের চেষ্টায় সচেষ্ট থাকে- তাহলে তার ভিসা রহিত করা হবে এবং তাকে ভিসা দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অস্বীকৃতি জানাবে। সাম্প্রতিক সময়ে নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নাইজেরিয়াতে এই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল নির্বাচনের পরে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনের আগেই আগাম ঘোষণা দিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হলো। এর ফলে যদি কোনো নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, প্রশাসনের ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সরকার বা বিরোধী দলের সদস্য কিংবা অন্য কেউ অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে এক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।এই নীতির কয়েকটি দিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

নতুন মার্কিন নীতি বরং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করেছে। নীতিটি ভালো, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। নতুন মার্কিন ভিসানীতি বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচন নিয়ে কোনো সহিংসতার বিষয়ে সতর্ক করবে। মার্কিন এই নীতির কারণে এখন বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবি ও নির্বাচন প্রতিহত করার অবস্থানের যৌক্তিকতা থাকবে না। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণায় বিচলিত নয়। এই ভিসা-নীতি নির্বাচনে সহিংসতাকারীদের জন্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা চাইব এই ভিসা নীতির আওতায় জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করো। কারণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ে যারা একবার জ্বলেছে, এখন জীবিত আছে, তাদের চেহারার দিকে তাকালে বড় দুঃখ পাবেন। আমরা আর জ্বালাও-পোড়াও চাই না। ৩ হাজার ৮০০ যানবাহন পোড়ানো হয়েছে।সুতরাং জ্বালাও-পোড়াও কারা করে? আপনারা জানেন। যারা করে, তাদের সতর্ক হওয়া দরকার। তাদের নেতৃত্বের সতর্ক হওয়া দরকার।’ অর্থাৎ ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত যে ধরনের জ্বালাও- পোড়াওয়ের মতো নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, তাদের জন্য অশনি সংকেত। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে যেতে পারবে। আর জ্বালাও পোড়াও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ভয় তৈরি হবে। রাজনীতিতে একটা সুস্থির পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যারা ইতিবাচকভাবে বা স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে, তাদের এই ভিসানীতিতে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে যেকোনোভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করবে, ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি ও কারচুপির মতো কাজ দিয়ে, তারা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা ভিসার জন্য বিবেচিত হবেন না। এর মাধ্যমে আমেরিকা যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক গতিতে চলার জন্য যদি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন তাহলে তিনি যেই হোন না কেন, তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থান থাকবে।সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের একটা অংশের সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন। বৈধ-অবৈধ উপায়ে তারা সেখানে সম্পত্তি গড়ে তুলে তুলেছেন, বাড়ি করেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যও রয়েছে অনেকের। এদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকেরই অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অবৈধ পথেই সেখানে পাঠিয়েছেন। এ কারণে তারা বেশি ভীত ও সন্ত্রস্ত। এই তালিকায় রয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকরাও। এই ভিসা-নীতির ফলে এখন থেকে অবৈধ পথে বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধ হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের মতে, ‘ভিসা (যুক্তরাষ্ট্রের) বড়লোকেরা নেয়। সরকারি কর্মচারী, কিছু বড় ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ—তাঁদের ভিসার দরকার হয়, যাঁদের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়ে, বিদেশে বাড়ি বানিয়েছেন, যাঁরা টাকা পাচার করেছেন। এতে হয়তো আশা করি টাকা পাচার কমবে। কারণ ওনারা নিয়ে গিয়ে তো স্থাপনা তৈরি করেন। আর যারা গরিব লোক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের পোলিং এজেন্ট হয়, তারা তো ভিসার জন্য আসেই না।’

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণির। তাদের বেশিরভাগেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে না। তাদের সন্তানরাও সেখানে পড়তে যায় না। কাজেই এই ভিসা নীতি সাধারণ মানুষের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। গত নির্বাচনে ৪০ হাজার ১৮৩ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন পোলিং এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত স্ট্রাইকিং ফোর্সের সদস্য ছিলেন ৬ লাখ ০৮ হাজার আর বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন প্রায় ৩ হাজারের মতো ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকেরই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার দরকার পড়ে। কাজেই এই ভিসানীতি নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে না। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের পাট শিল্প ও পাটজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক, তুলাসহ নানা ক্ষেত্রেই আমেরিকার ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ ও আমদানি-রপ্তানির বিষয়ে আগ্রহী। কাজেই বাণিজ্যে তেমন প্রভাব ফেলবে না। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কোনো অধিকার নয়। তাই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং জনগণের অধিকার আদায় ও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এটি সহায়ক হতে পারে। কাজেই সাধারণ মানুষের এই ভিসানীতি নিয়ে ‍উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

৪.
আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষিত ভিসা-নীতিতে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না।আমরা জানি এদেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামবাসী। সেখানে আছেন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মী, যারা মানুষের অধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সংখ্যায় বেশি এসব মানুষের কোনো যায় আসে না যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-নীতিতে। এজন্য তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আগে যেমনটি বলেছি ভিসা-নীতির কঠোরতায় অর্থপাচার কমবে। দেশের টাকা দেশে থাকবে এবং তা উন্নয়নে কাজে লাগবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যার জন্ম তার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। দেশটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকার রক্ষায় তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। গত ১৪ বছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উন্নতিতে এদেশ অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমাদের দরজা খোলার মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে মানবাধিকারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণিত হয়েছে।এটা দুর্ভাগ্যজনক যে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র পক্ষপাতমূলক আচরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছে। অথচ শেখ হাসিনা সরকার মানবাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের সকল সমালোচনা মোকাবেলা করে সরকার এক্ষেত্রে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।এজন্য মানবাধিকারের উন্নয়নে এবং শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতাকে তারা বিবেচনা করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পূজারি। আমরা এ দেশে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরাই গণতন্ত্রের মধ্যে সব সময় নির্বাচিত হয়েছি।’

(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)

যুক্তরাষ্ট্র   ভিসা নীতি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘পত্রিকায় সংবাদ হলে সেটার আগে সমাধান, তারপর প্রতিবাদ’


Thumbnail

যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।

তখন স্বাভাবিক নিয়মে আমার কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা বললেন, ‘স্যার একটা প্রতিবাদ দিতে হয়।’

তখন আমি বললাম, আমিতো পড়েছি। আমি ভোরবেলাতে যে পত্রিকাগিুলো পড়ি, তার মধ্যে নঈম নিজাম এবং এখনকার যে বুদ্ধিভিত্তিক কলামিস্ট আমার অনুজপ্রতীম সৈয়দ বোরহান কবিরের লেখাগুলো পড়ি। তারা একটা রৈখনি নিয়ে এসেছে। একটা প্রতিবাদ, সরকারিভাবে যা লেখা হয়, এটা না, ওটা।

আমি বললাম, ‘তোমরা ওই কমিউনিটি ক্লিনিকটা শেষ কে কবে পরিদর্শন করেছ?

তারা কেউই সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না। আমি বললাম, নঈম নিজাম এবং সৈয়দ বোরাহান কবির- এরা কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে তাদের যে পেশাগত সম্পর্ক সেটা জড়িয়ে ফেলে না। উদাহরণসরূপ বলছি, আমি তখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করে সৈয়দ বোরহান কবির। আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে বেশ কিছু বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু আমার সাথে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সে সেটা বিবেচনা না করে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সে এটা করেছে। সেটা নিয়ে তার সাথে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি। কারণ হচ্ছে, সে তার পেশায় ঠিক আছে, আমি আমার পেশায় ঠিক আছি।

আমার কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটা উল্লেখ করা তার দায়িত্ব। নঈম নিজামের পত্রিকায় যেহেতু সংবাদ ছাপা হয়েছে। সুতরাং নঈম নিজামকে আমি আলাদা চোখে দেখি।

তারা বললো, ‘স্যার সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে।’

আমি বললাম, সিভিল সার্জন নয়, একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাও। তারপর প্রতিবাদ ছাপাতে হয়, আর্টিকেল লিখতে হয়, আমি দেখবো।

তারপর একজনকে পাঠানো হলো। তিন দিনে রিপোর্ট দিলো। তারপর দেখা গেলো, বাংলাদেশ প্রতিদিনে যা ছাপা হয়েছে। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তখন আমি এইটার ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম, যেন ওটা ঠিকমতো চলে এবং সমস্যাটির সমাধান করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কোনো লেখা বা নঈম নিজামকে ফোন করার আর কোনো প্রয়োজন পড়লো না। আমি দেখেছি, আমার ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্বও আমার। যেহেতু এটা আমার দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সুতরাং আমি মনে করেছি, সে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমার পক্ষে না বিপক্ষে গেলো, সেটা কোনো বিষয় নয়।

সম্প্রতিককালে দেখলাম, আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং তাদের যে কাজের গাফিলতি সম্পর্কে লিখেছে বলে তারা তার প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। প্রতিবাদটি আমি পড়লাম। প্রতিবাদটি বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, অনেক আমলারা কাঁচা হাতের কাজ করে সেরকম। এই প্রতিবাদটি ছাপানোর আগে, যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়গুলোর সমাধান করাতো বেশি দরকার। এরা দেশের ভালো করতেছে না খারাপ করতেছে, সেটা বিচার করার সময় এসেছে। আমারতো কোনো পত্রিকার সাথে কোনো জমি নিয়ে বা কোনো বিরোধ বা কোনো গন্ডগোল নেই, সে আমার বিরুদ্ধে কেন লিখবে? লিখলে আমিসহ সকলে যে যেখানে দায়িত্বে আছে, সকলের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জিনিসটা সঠিক কি না, সেটার চুলচেরা বিচার করা।

দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে লিখেছে, সেটাকে অবশ্যই দেখাশোনা করা, যাতে ওই ভুলটটা ভবিষ্যতে আর না হয়। নঈম নিজাম কেন, দুনিয়ার কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভুলটা বুঝতে পারা এবং ভুলটা সঠিক করা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই আমরা এটা করতে পারি না। সেজন্য সবাইকে বলবো, যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু আসলে প্রতিবাদ পাঠানোর আগে কি লিখেছে, বরং সেটার সমাধান আগে করে তারপর প্রতিবাদ পাঠান।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

বিধিনিষেধের আড়ালে বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে?


Thumbnail

আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে। উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত  মানুষদেরকে আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায়  ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না ? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের ?

বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে।  কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল।  কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন , সমস্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।  

বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না।  যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো।  সেখানে কেন গণতন্রের জন্য মনোযোগ দেয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।  এখানে কার্ল মার্কস এর দর্শনের সাফল্য।  অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।  তার পরেও আমাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়।  এটি দেশের বিরোধী দলের দেনদরবার বা  তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে।  সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি এক মাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ ? একটি অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড়োরকম ভুল না করে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর।  গতকাল একটি বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে - তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে।  সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে।  সেখানে লেখা আছে "আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই। " ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বিদেশী দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবং আরেকটি মহল মনে করেন - যুক্তরাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।

পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবে , এবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্ততঃ গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি অমানুল্লার জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ঐদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন।  আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন।  সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি ? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পায়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। 

জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়।  ভোট ও ভাতের  স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব। বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগনমুখী - কূটনীতিবিদমুখী নয়।আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিতে।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।  

বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের।  বিদেশী কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়।  আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি।  বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি।  তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।



মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন