শুরু হলো বিজয়ের মাস। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য এরকম-‘এই বাংলাদেশ লালন শাহ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দের বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশ শাহজালাল, শাহ পরান, শাহ মকদুম, খান জাহান আলীর বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ, ধর্মান্ধ নয়। তাই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করবেন না। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রাখেন। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান- সকল ধর্মের-বর্ণের মানুষের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে।’প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটের মধ্যে বিজয় দিবস পালিত হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে, মানুষের এগিয়ে চলার মহামন্ত্র আজ বিশ্ববাসী শুনতে পাচ্ছে। আসলে গভীরতর অর্থে, চেতনার পরিমাপে মুক্তিযুদ্ধের একটি ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক রূপ রয়েছে। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি অপশাসন-বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের সেই অনিবার্য চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। ‘মুক্তি’ আন্দোলনের গণজাগরণ ও সংগ্রামী চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল আমাদের জনতা। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সময়েও চলিষ্ণু। সংগত কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে নতুন করে মূল্যায়ন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যুদ্ধোত্তরকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় ছিল ভয়ঙ্কর ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এসময় থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের নবতর অভিযাত্রা ব্যাহত হয়। যুগান্তকারী সব পরিবর্তন-সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবার পরই আবার রুদ্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মুক্ত চেতনা, গণতন্ত্র ও শিল্পবিপ্লবের অবাধ বিকাশ হয় প্রলম্বিত। দীর্ঘ ২১ বছর পর পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন, জয় বাংলা ধ্বনিত হলো এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হলো। আর ২০০৮ ও ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে একাধারে সাড়ে ১৩ বছর ক্ষমতায় থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আপামর জনগণের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্ম তথা আড়াই কোটি তরুণ ভোটার আজ উজ্জীবিত। এজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়। তাঁর মতে, সংবিধান ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে সামগ্রিক উন্নয়ন অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এসময়ে এ কথার গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি বলেছেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জাতির পিতা স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। আমি সেই লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’ রাষ্ট্রনায়কের এই কথার মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিব্যক্তি রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করা হয়েছিল। আর সেই চেতনা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রধান কর্তব্য জনগণের সেবা করা যা বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম আর সরকার প্রধান হিসেবে দেখিয়ে গেছেন। দেশপ্রেমিক শাসক আর জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার লালন করার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশ পায়। তবে স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে গেছে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পরও আমরা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করতে পারিনি। আমরা মনে করেছিলাম, রণাঙ্গনের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পাকিস্তানপন্থীদের অস্তিত্ব বিলীন হবে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখলাম বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর ওই বাংলাদেশ বিরোধীরাই ২১ বছর একাধারে এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। এবং উপহার দিয়েছে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাস আর দুর্নীতি। অবশ্য একথা মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে।
এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আওয়ামী লীগের দিক থেকে উত্থাপিত হয়েছে বারবার। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক মতাদর্শের দিক থেকে প্রগতিপন্থী। কেননা আমরা তাদেরই নেতৃত্বে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু বিএনপির স্লোগানই হচ্ছে গণতন্ত্র। আর সেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিএনপির প্রধান সহযোগী হচ্ছে জামায়াতে ইসলাম। গণতন্ত্র বিরোধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? শুধু তাই নয় বিএনপির নিজের ভাবমূর্তি গণতান্ত্রিক কি? গত ১৩ বছরে তাদের সুযোগ ছিল বিরোধী দল হিসেবে জনগণের আস্থার জায়গা তৈরি করা। বিশেষ করে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ, ১৫ আগস্টের নির্মমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বর্জন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দল থেকে বহিঃষ্কার করা- তবেই তাদের দলীয় ভাবমূর্তি স্বচ্ছ হতো।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম অনুধ্যান। কারণ আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির একেবারে মর্মমূলে রয়েছে গণন্ত্রের আদর্শ। বাঙালির গণতান্ত্রিক চেতনাকে যখন রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল তথাকথিত পাকিস্তান, তারই প্রতিবাদে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলকে একাত্তরে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হয়নি বলে গণযুদ্ধ হয়েছিল। এটা তাৎক্ষণিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। অবশ্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বাংলাদেশের মানুষকে বঞ্চিত করার ঘটনা অনেকদিনের। সেই ইতিহাসে বাংলাদেশের মানুষকে, নানান প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ ও আপসহীন নেতৃত্বে ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৬২এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬এর ৬-দফা, ৬৯এর ১১-দফা ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগষ্ঠিরতা অর্জন করে। ফলে বৈধ ভিত্তি পায় বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা। আবার এ কথাও সত্য যে, দীর্ঘ ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথ মসৃণ ছিল না। কখনো একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় আর একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থানে পিছিয়ে পড়েছে এদেশ। ২০২২ সালে যুদ্ধের সংকটের মধ্যে যখন বাংলাদেশ বিজয় দিবস পালন করা হচ্ছে তখন গণতন্ত্রের মূল্যায়ন হচ্ছে পুনরায়। বিএনপি-জামায়াতের জনসমাবেশের নামে তাণ্ডবের আশঙ্কা বারবার জেগে উঠছে। ফলে ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গ।
২. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সংগীত। ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭১-এ। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তির যে ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখান থেকে যাত্রারম্ভে অতীতের সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎপ্রসারি করতে হবে দৃষ্টিভঙ্গিকে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথম বাংলাদেশ সরকার হিসেবে খ্যাত এই সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, ‘১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল।... সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি।’
সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা’ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অন্যদিকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৪টি মূলনীতিও আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অংশ। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় বাংলাদেশের সংবিধান। গত ৫০ বছরে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসে এই সংবিধানের চার মূলনীতিও বদলে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখা হয় এ সংশোধনীতে। এছাড়া এ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭২র সংবিধানের চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবিধান অনুসারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো স্বাধীন ভাবে আমাদের বেঁচে থাকা; ব্যক্তিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক মুক্তি, সকল মৌলিক অধীকার সমানভাবে নিশ্চিত করা; অর্থাৎ বৈষম্যহীন, মুক্ত এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, রাষ্ট্রে বলিষ্ঠ জাতি হিসেবে আমাদের বিকাশের সুযোগ থাকা এবং রাষ্ট্রে বেড়ে ওঠা আমাদের মানব সত্তা বিশ্বে মর্যাদা পাওয়া- সব মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনের কথা বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
৩. পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের বিজয়গাথার কথা মনে রেখে বলতে হয় বাঙালির যা কিছু গৌরবের তার স্বীকৃতি ঘটেছে আন্তর্জাতিক পরিসরে যার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ সরাসরি সম্পৃক্ত। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে করণীয় বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য’ ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার-এ অন্তর্ভুক্ত করে ‘বিশ্বপ্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার জোর দাবি উঠেছে। কানাডা প্রবাসী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের উদ্যোগে এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রা, নকশিকাঁথা এবং সিলেটের শীতল পাটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-তালিকায় স্থান পেয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অগ্রসর না হলে এসব অর্জন সম্ভব হতো না।
৪. কিন্তু দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও চেতনাকে অবমাননা করছে। সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আদর্শ ও নৈতিকতা। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। তাঁর শাসনামলে ১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘... সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেশ গড়তে হলে দেশবাসীকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না- চরিত্রের পরিবর্তন না হলে এই অভাগা দেশের ভাগ্য ফেরানো যাবে কি না সন্দেহ। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সকলকে আত্মসমালোচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। কিন্তু সেই চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি, আইনকানুন প্রণয়ন ও প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; তার জন্য সামগ্রিক এবং নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ প্রয়োজন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘নেশন মাস্ট বি ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট করাপশন। পাবলিক ওপিনিয়ন মবিলাইজ না করলে শুধু আইন দিয়ে করাপশন বন্ধ করা যাবে না।’ স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় বহুবিধ আইন, বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আরো কিছু নতুন আইন প্রণয়ন করেছে, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ কিছু নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে এবং এগুলির ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতির উন্নয়ন সাধন করা হয়েছে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) শেখ হাসিনা সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রণীত ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০-২০২১’ শীর্ষক দলিলে দুর্নীতি দমনকে একটি আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এই আন্দোলনে সবাইকে অংশীদার হতে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। এছাড়া দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম যেসব আইন গত মহাজোট সরকারের সময় প্রণীত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯, তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন, ২০০৯, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯, চার্টার্ড সেক্রেটারিজ আইন, ২০১০, জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২, প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২ ইত্যাদি। এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে দুর্নীতিমুক্ত রাখার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর আওতাধীন অপরাধও দুর্নীতি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুর্নীতিকে কেবল আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দমন করা সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, সুশীল সমাজ ও নাগরিকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করতে দেশের যুবসমাজ বড় শক্তি এবং অপার সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ বলতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বাংলাদেশকে বুঝতে হবে। এই বাংলাদেশে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয়েছে। যে শিক্ষানীতি ২০১০-এ ছাত্রদের চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তিন- অংশে বলা হয়েছে : ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলি (যেমন: ন্যায়বোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ, কর্তব্যবোধ, মানবাধিকার সচেতনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা, শৃঙ্খলা, সৎ জীবনযাপনের মানসিকতা, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি) বিকাশ ঘটানো হবে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত।’
৫. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে রাষ্ট্র এজন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে ৮১ বছরের পরিকল্পনা সংযুক্ত হয়েছে। ২০০৮ সালে দিনবদলের সনদ নামে নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশের প্রতিশ্রুতি ছিল আওয়ামী লীগের। টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারের স্লোগান ছিল শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই ইশতেহারে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছিল দলটি। ১৩ বছরে এই দুই ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল সেগুলোই ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির পর এখন লক্ষ্য মধ্যম আয়ের দেশ গড়ে তোলা। গত ইশতেহারে ৮১ বছরের অর্থাৎ ২০১৯ সাল থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। ডেল্টা প্ল্যানের কথা ইতোমধ্যে সকলে অবগত হয়েছেন। এ ছাড়া ইশতেহারে সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ এবং মাদক নির্মূলের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত। দ্বিতীয় পদ্মা ও যমুনা সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয় ছিল গত ইশতেহারে। দেশের প্রবৃদ্ধি যেন দুই অঙ্কে পৌঁছায় সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের ঘোষণা ছিল সেখানে। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশবাসী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এখন, অপুষ্টির অভিশাপ দূর হতে যাচ্ছে; দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচেছে, নিরক্ষরতা দূর হচ্ছে, শিক্ষিত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে, শিল্প-সভ্যতার ভিত্তি রচিত হয়েছে; প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেকারত্বের অবসান ও কোটি কোটি যুব সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটচ্ছে; যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হচ্ছে, পরিকল্পিত নগর-জনপদ গড়ে উঠছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ সমৃদ্ধির সোপানে পা রাখছে। রাজনীতি থেকে হিংসা, হানাহানি, সংঘাতের অবসান হচ্ছে, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নের ধারা থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে; গড়ে উঠেছে একটি সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
বর্তমান সরকারের আমলে উন্নয়নমূলক অনেক কাজ ত্বরান্বিত হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে জাতিকে উপহার দেওয়া হবে নতুন ভিশন- নতুন প্রেক্ষিত পরিকল্পনা রূপকল্প-২১০০। আর ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের পর্যায় পেরিয়ে এক শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী এবং উন্নত জনপদ। সুশাসন, জনগণের সক্ষমতা ও ক্ষমতায়ন হবে এই অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র।
৬. মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রকাঠামো পেয়েছি। যে রাষ্ট্রের ভিত্তি গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য এবং মৌলিক অধিকার চর্চা। আজ আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে উচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত। যে রাজনৈতিক সংগ্রাম আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম সেই ইতিহাসকে যথাযথ উপলব্ধি করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই চেতনার মধ্যে গণতান্ত্রিক দাবি আদায়ের আদর্শ রয়েছে, মুক্তির স্বপ্ন আছে আর আছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না করার মূল্যবোধ। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য ও মানবাধিকার আমাদের বর্তমান বাংলাদেশের অগ্রগতির অন্যতম অনুপ্রেরণা যা আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম অনুষঙ্গ।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৬:৩০ পিএম, ২৭ মে, ২০২৩
যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু
দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন
করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে
পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ
ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।
তখন স্বাভাবিক নিয়মে আমার কমিউনিটি ক্লিনিকে যারা কাজ করেন, তারা বললেন, ‘স্যার
একটা প্রতিবাদ দিতে হয়।’
তখন আমি বললাম, আমিতো পড়েছি। আমি ভোরবেলাতে যে পত্রিকাগিুলো পড়ি, তার মধ্যে নঈম
নিজাম এবং এখনকার যে বুদ্ধিভিত্তিক কলামিস্ট আমার অনুজপ্রতীম সৈয়দ বোরহান কবিরের লেখাগুলো
পড়ি। তারা একটা রৈখনি নিয়ে এসেছে। একটা প্রতিবাদ, সরকারিভাবে যা লেখা হয়, এটা না, ওটা।
আমি বললাম, ‘তোমরা ওই কমিউনিটি ক্লিনিকটা শেষ কে কবে পরিদর্শন করেছ?
তারা কেউই সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারে না। আমি বললাম, নঈম নিজাম এবং সৈয়দ বোরাহান
কবির- এরা কখনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের সাথে তাদের যে পেশাগত সম্পর্ক সেটা জড়িয়ে ফেলে
না। উদাহরণসরূপ বলছি, আমি তখন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক। তখন ‘পরিপ্রেক্ষিত’ অনুষ্ঠানটি
পরিচালনা করে সৈয়দ বোরহান কবির। আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিপক্ষে বেশ কিছু
বক্তব্য প্রচার করে। কিন্তু আমার সাথে তার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সে সেটা বিবেচনা না
করে পেশাগত দায়িত্ব থেকে সে এটা করেছে। সেটা নিয়ে তার সাথে আমার কোনোদিন আলাপ হয়নি।
কারণ হচ্ছে, সে তার পেশায় ঠিক আছে, আমি আমার পেশায় ঠিক আছি।
আমার কোনো ভুলভ্রান্তি হলে সেটা উল্লেখ করা তার দায়িত্ব। নঈম নিজামের পত্রিকায়
যেহেতু সংবাদ ছাপা হয়েছে। সুতরাং নঈম নিজামকে আমি আলাদা চোখে দেখি।
তারা বললো, ‘স্যার সিভিল সার্জনের সাথে কথা হয়েছে।’
আমি বললাম, সিভিল সার্জন নয়, একজন বিশ্বস্ত লোককে পাঠাও। তারপর প্রতিবাদ ছাপাতে
হয়, আর্টিকেল লিখতে হয়, আমি দেখবো।
তারপর একজনকে পাঠানো হলো। তিন দিনে রিপোর্ট দিলো। তারপর দেখা গেলো, বাংলাদেশ
প্রতিদিনে যা ছাপা হয়েছে। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তখন আমি এইটার ব্যবস্থা গ্রহণ
করলাম, যেন ওটা ঠিকমতো চলে এবং সমস্যাটির সমাধান করলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিনে কোনো লেখা
বা নঈম নিজামকে ফোন করার আর কোনো প্রয়োজন পড়লো না। আমি দেখেছি, আমার ভুল-ভ্রান্তি হচ্ছে।
সুতরাং এর দায়-দায়িত্বও আমার। যেহেতু এটা আমার দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, সুতরাং আমি
মনে করেছি, সে আমাকে সহায়তা করেছে। এখন আমার পক্ষে না বিপক্ষে গেলো, সেটা কোনো বিষয়
নয়।
সম্প্রতিককালে দেখলাম, আমাদের একটি মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রী এবং তাদের যে কাজের
গাফিলতি সম্পর্কে লিখেছে বলে তারা তার প্রতিবাদ পাঠিয়েছে। প্রতিবাদটি আমি পড়লাম। প্রতিবাদটি
বাংলাদেশ প্রতিদিনে ছাপা হয়েছে। আমার কাছে মনে হলো, অনেক আমলারা কাঁচা হাতের কাজ করে
সেরকম। এই প্রতিবাদটি ছাপানোর আগে, যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সে বিষয়গুলোর সমাধান
করাতো বেশি দরকার। এরা দেশের ভালো করতেছে না খারাপ করতেছে, সেটা বিচার করার সময় এসেছে।
আমারতো কোনো পত্রিকার সাথে কোনো জমি নিয়ে বা কোনো বিরোধ বা কোনো গন্ডগোল নেই, সে আমার
বিরুদ্ধে কেন লিখবে? লিখলে আমিসহ সকলে যে যেখানে দায়িত্বে আছে, সকলের প্রধান দায়িত্ব
হচ্ছে জিনিসটা সঠিক কি না, সেটার চুলচেরা বিচার করা।
দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি নিয়ে লিখেছে, সেটাকে অবশ্যই দেখাশোনা করা, যাতে ওই ভুলটটা
ভবিষ্যতে আর না হয়। নঈম নিজাম কেন, দুনিয়ার কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু ভুলটা বুঝতে
পারা এবং ভুলটা সঠিক করা কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই আমরা
এটা করতে পারি না। সেজন্য সবাইকে বলবো, যে কোনো মিডিয়াতে কোনো কিছু আসলে প্রতিবাদ পাঠানোর
আগে কি লিখেছে, বরং সেটার সমাধান আগে করে তারপর প্রতিবাদ পাঠান।
মন্তব্য করুন
আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে। উন্নত দেশগুলো রাষ্ট্রীয় সীমারেখার দেয়াল তুলে শান্ত হয়নি, বিভিন্ন রকম আন্তর্জাতিক কৌশল অবলম্বন করে তারা দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষদেরকে আরও সুশীল বানাতে চাইছে। গণতন্রের পূজারী উন্নত বিশ্ব তাদের স্বার্থে সুশীল বানানো প্রক্রিয়ায় ধনী দেশগুলোতে সেভাবে চাপ প্ৰয়োগ করে না, যেভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বেলায় যেভাবে কূটনীতিবিদরা সক্রিয় তাতে আমাদের স্বাধীনতা কি ক্ষুন্ন হচ্ছে না ? এ দায় কি কেবল নিপীড়িত মানুষের ?
বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নানা আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হয়েছে। কিছুদিন সেই চাপ কমেছিল। কিন্তু আবার নতুন করে চাপে ফেলা হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হতে পারে? বিরোধী জোটে যারা আছেন তারা বলবেন- তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন করুন , সমস্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় নেমে আসবে। কিন্তু আমার ভিন্ন রকম উপলব্ধি।
বাংলাদেশের সরকার নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত তাতে কারও কিছু যায় আসে না। যদি নির্বাচন মুখ্য বিষয় হতো তবে আরব রাষ্ট্রে বিরাজমান রাজতন্ত্র অবসানে তারা মনোযোগী হতো। সেখানে কেন গণতন্রের জন্য মনোযোগ দেয়া হয়না তার অনুসন্ধানে যারা লিখেছেন তাদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এখানে কার্ল মার্কস এর দর্শনের সাফল্য। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তত্ত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে উন্নত দেশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। তার পরেও আমাদের উপর একের পর এক বিধিনিষেধ আরোপ গভীর ভাবনার বিষয়। এটি দেশের বিরোধী দলের দেনদরবার বা তদবিরের ফলে হচ্ছে মনে করলে হয়তো ভুল হবে। সুষ্ঠু অবাধ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি এক মাত্র ভাবনা ওই সব বিধিনিষেধ আরোপের কারণ ? একটি অবাধ সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কি বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট ? আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত তাদের মনোযোগ এখানে একান্তভাবে কাম্য যাতে সরকার চাপের মুখে কোনো বড়োরকম ভুল না করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বাতিঘর। গতকাল একটি বিবৃতিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বলেছে - তারা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তিনিও সুষ্ঠু নির্বাচন চান এবং আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সারা বিশ্বে যেভাবে নির্বাচন হয়ে থাকে সেইভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে। সম্প্রতি একটি পোস্টার আমার নজরে এসেছে। সেখানে লেখা আছে "আমার ভোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দিতে চাই। " ওই পোস্টার নিয়ে দলের লোকদেরসঙ্গে কথা বলে জানা যায় তারা বিদেশী দূতাবাসের আশীর্বাদ পেয়েছেন। এবং আরেকটি মহল মনে করেন - যুক্তরাষ্ট্র যে সব বিধিনিষেধ দিচ্ছে তার লক্ষ্য হলো পর্যাক্রমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কৌশল। এটাকে বিস্তৃত করলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যর অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
পত্রিকাতে দেখেছি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করবে , এবং এখন আগের তুলনায় সরকার বিরোধী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে না। অন্ততঃ গত মঙ্গলবার গাবতলীতে সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি অমানুল্লার জনসভা দেখে আমার ধারণা হয়েছে। ঐদিন ধানমন্ডিতে সভা হয়েছে বটে কিন্তু কিছু মানুষ বাস পোড়ানোর মতো বিশৃঙ্খলা ঘটিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার করছে। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। আমাদের কাছে অনেকেই বলেন আগামী নির্বাচন যাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয় সেজন্য আন্দোলন করবেন। সেই আন্দোলন যে শান্তিপূর্ণ হবে সেটা ভাবা যায় কি ? আমার মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র কোনো পক্ষই অবলম্বন করবে না যদি তারা কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আমাদের মনে পড়ে অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন হয়েছে তাতে আমাদের সামাজিক শান্তি ও অর্থনীতি হুমকিতে পড়েছে।আরেকটি ১/১১ সৃষ্টির যে পায়তারা চলছে তা কোনোভাবেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে বলে মনে হয় না।কারণ যেই হারবে সেই দাবি করবে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।
জনগণের কষ্ট সৃষ্টি করে কেউই ক্ষমতায় আসতে পারবে না বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। ভোট ও ভাতের স্বাধীনতা অর্জনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি অর্জন করতে হয় তবে তা জনগণের কষ্টে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যদিয়েই সম্ভব। বাংলাদেশ আশা করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হয়েই থাকবে। তাদের আরোপিত বিধিনিষেধ কেন সেটা অনুসন্ধানে সময় না দিয়ে আমার সমস্যা নিয়ে আমি ভাবতে ও সমাধানের চেষ্টা করতে চাই। রাজনীতির লক্ষ্য হোক জনগনমুখী - কূটনীতিবিদমুখী নয়।আমাদের আরও সহনশীল হতে হবে এবং সৎ মানুষগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য থাকতে হবে। আমি মনে করি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবার সুযোগ আছে রাজনীতিবিদেরকে আলোর পথের সন্ধান দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বক্তব্য তারই প্রতিফলন।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে স্বপ্ন আমাদের সকলের। বিদেশী কূটনীতিবিদরা যেভাবে যুক্ত হচ্ছে তা থেকে বের হয়ে আসার দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়। আমরা বঙ্গবন্ধুর শান্তি পুরস্কার বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি পালন করছি। বঙ্গবন্ধুর শান্তি ভাবনা যেন আমাদের রাজনীতিতে সুবাতাস বয়ে আনে সেই কামনা করছি। তাহলেই কূটনৈতিক বিজয় অর্জন সম্ভব হবে।
মন্তব্য করুন
‘‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম—আফিম—নেশা/
ধ্বংস করেছি ধর্মযাজকী পেশা,/ ভাঙি মন্দির, ভাঙি
মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক
মানবের একই রক্ত মেশা/
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!’’
‘‘পূজিছে
গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব
শোন মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।’’
‘‘গাহি
সাম্যের গান— মানুষের চেয়ে
বড় কিছু নাই, নহে
কিছু মহিয়ান। নাই দেশ—কাল—পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে
ঘরে—ঘরে তিনি মানুষের
জ্ঞাতি।’’
‘‘মানবতার
এই মহান যুগে একবার/গণ্ডী কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে,/তুমি
ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও,
হিন্দু নও, মুসলমানও নও,/তুমি মানুষÑ তুমি
ধ্রুব সত্য।’’
উপরের উদ্ধৃতিগুলো স্মরণে রেখে কাজী নজরুল ইসলামের(১৮৯৯—১৯৭৬) ১২৪তম জন্ম—জয়ন্তীতে তাঁর প্রবন্ধে প্রকাশিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনা সম্পর্কে আলোকপাত করা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খুবই তাৎপর্যবহ। এদেশ এখনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কিন্তু যে দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাঁধে নিয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ছিল তাও সম্পন্ন হয়নি। এজন্য একমাত্র ভরসা রবীন্দ্রনাথ—নজরুল। বিশেষত নজরুলের জীবনব্যাপী(সুস্থ ছিলেন ১৯৪২ পর্যন্ত) সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বলে যাওয়ার মধ্যে রয়েছে অনুপ্রেরণার অজেয় উৎস। কেবল তাঁর কবিতা—গান নয় প্রবন্ধে রয়েছে বিবেক জাগানিয়া অনন্যসব ভাবনাসমূহ। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু, সাপ্তাহিক লাঙল, গণবাণী, সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য—পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকায়Ñ এ সম্পর্কে নজরুলের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ এবং অভিভাষণের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। পরে সেগুলো যুগবাণী, রাজবন্দীর জবানবন্দী, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র—মঙ্গল গ্রন্থে প্রবন্ধ সংকলনে স্থান পায়। বলাবাহুল্য তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু সমকালীন প্রসঙ্গ নিঃসৃত। আর এই সমসাময়িক প্রসঙ্গের অবতারণার জন্য তাঁর প্রবন্ধসমূহ মূল্যবান হয়ে উঠেছে। ১৯৪২ সাল পর্যন্ত বিশ্ব পরিমণ্ডল ও ভারতবর্ষের সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক ইতিহাস নজরুল—সাহিত্যকে আলোড়িত করেছে। তবে তিনি তাঁর অভিমতসমূহ ব্যক্ত করার সময় সর্বজনীন মানুষের কল্যাণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ সা¤প্রদায়িক বিভেদ ও বিদ্বেষের বিপরীতে তিনি সম্প্রীতির প্রত্যাশায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। একইসঙ্গে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে ধর্ম, শিক্ষা ও সমাজ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তাঁর ভাবনাসমূহ গুরুত্ব বহন করে।
অধ্যাপক
ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ নজরুলের অসাম্প্রদায়িক
চেতনা সম্পর্কে লিখেছেনÑ‘উপনিবেশকে আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর
কৌশলে সাপ্রদায়িক বিভেদ
সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম—সাপ্রদায় পরস্পর
বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারবার। এর পশ্চাতে ছিল
একাধিক রাজনৈতিক দলের ইন্ধন। এই
সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে
হিন্দু—মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়—নিরপেক্ষ
স¤প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন। সত্য—সুন্দর—কল্যাণের
পূজারি নজরুল চেয়েছেন স¤প্রদায়ের উর্ধ্বে
মানুষের মুক্তি। বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তাঁর মানসলোকে সম্প্রদায়—নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছেÑহিন্দু
ও মুসলমান বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তাঁর
চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার
পরিপূরক দুই শক্তি।’ (উত্তর—ঔপনিবেশিক তত্ত্ব ও নজরুলসাহিত্য, সৃষ্টি
সুখের উল্লাসে, ২য় খণ্ড, পৃ
৩৩৬) সম্প্রদায়ে
সম্প্রদায়ে বিভেদ ও অনৈক্য সম্পর্কে
নজরুল ইতিবাচক চিন্তা করেছেন। সা¤প্রদায়িক কলহের
দুর্বলতা দিয়ে ভারতের মুক্তি সম্ভব নয়। নজরুল এ—কারণেই ভারতীয়দের শক্তির দুর্বলতর সূত্রগুলি ‘যুগবাণী’ ও অন্যান্য পর্বের
সম্পাদকীয় রচনায় বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি জানতেন হিন্দু
মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ শক্তির দুর্বার আঘাতেই ব্রিটিশ শাসনশৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব। নজরুল
আহ্বানও জানিয়েছেন ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের।
তিনি
হিন্দু—মুসলমান উভয়ের ইতিহাস—ঐতিহ্য—চিন্তা—চেতনার ভাব বিনিময়ে গুরুত্বারোপ
করেছিলেন। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রাম
এডুকেশন (মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা, রুদ্র—মঙ্গল) সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে অনুষ্ঠানের সভাপতির ভাষণে নজরুল বলেছেন : ‘ভারত যে আজ
পরাধীন এবং আজো যে
স্বাধীনতার পথে তার যাত্রা
শুরু হয়নি শুধু আয়োজনেরই ঘটা
হচ্ছে এবং ঘটাও ভাঙছে
তার একমাত্র কারণ আমাদের হিন্দু—মুসলমানের পরস্পরের প্রতি হিংসা ও অশ্রদ্ধা।’
হিন্দু—মুসলমানের মিলন কামনার এই
তীব্রতা নজরুলের মানবতাবোধ থেকে উৎসারিত। তাঁর
সাহিত্যচিন্তার অন্যতম স্তম্ভও এটি ছিল। এজন্য
তাঁর ‘আমার সুন্দর’ প্রবন্ধের
একটি অংশ স্মরণীয়Ñ ‘আমার
কেবলই যেন মনে হত
আমি মানুষকে ভালোবাসতে পেরেছি। জাতি—ধর্ম—ভেদ
আমার কোনদিনই ছিল না, আজও
নেই। আমাকে কোনোদিন তাই কোনো হিন্দু
ঘৃণা করেনি। ব্রাহ্মণেরাও ঘরে ডেকে আমাকে
পাশে বসিয়ে খেয়েছেন ও খাইয়েছেন। এই
আমি আমার যৌবন—সুন্দর,
প্রেম—সুন্দরকে দেখলাম।’
নিজে
মুসলিম হয়েও হিন্দু নারী প্রমীলাকে বিবাহ
করা এবং একাধিক ঘনিষ্ঠ
বন্ধু সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় নজরুলের পক্ষে এ ধরনের কথাই
স্বাভাবিক। তিনি সাম্য ও
মানবকল্যাণে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে সর্বপ্রকার বন্ধন
ও অধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। সমাজজীবনের অনাচার অসঙ্গতি তিনি অন্তর দিয়ে
উপলব্ধি করেছিলেনশুধু রাজনৈতিক সূত্র
থেকে তা অর্জন করেননি।
সমাজকে ভেঙে গড়বার স্বপ্ন
ও উদ্যম ছিল তাঁর ক্লান্তিহীন।
‘মোহররম’ প্রবন্ধে মাতম—অভিনয়কে ধিক্কার
দিয়ে সত্যের পক্ষ নিয়ে নির্যাতনের
প্রতিবাদে রক্ত দেবার আহ্বান
জানিয়েছেন নজরুল। প্রথার অন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। লিখেছেনÑ‘এস ভাই হিন্দু!
এস মুসলমান! এস বৌদ্ধ! এস
ক্রিশ্চিয়ান! আজ আমরা সব
গণ্ডি কাটাইয়া, সব সঙ্কীর্ণতা, সব
মিথ্যা, সব স্বার্থ চিরতরে
পরিহার করিয়া প্রাণ ভরিয়া ভাইকে ভাই বলিয়া ডাকি।’
‘মন্দির
ও মসজিদ’ আর ‘হিন্দু—মুসলমান’
নামে দুটি রচনাতে ভারতবর্ষের
প্রধান দুই সম্প্রদায়ের পরস্পর
বিদ্বেষ এবং হানাহানিকে নজরুল
তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি
সবসময়ই সচেতন ছিলেন। ‘মন্দির ও মসজিদ’—এ
দাঙ্গা নিয়ে তাঁর বেদনাঘন কথা
আছে। মানবতার দিকে যারা ফিরেও
তাকায় না তারা ছোরা
আর লাঠি নিয়ে নিজের
ধর্মস¤প্রদায় রক্ষা করে! নজরুলের মতে,
‘ইহারা ধর্মমাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে
নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ শাস্ত্রীয়প্রথাকে
নজরুল সবসময়ই মানবতার নিচে স্থান দিয়েছেন।
তাঁর মতে, ‘মারো শালা যবনদের!’
আর ‘মারো শালা কাফেরদের!’
হাঁক ছেড়ে মাতালের চিৎকার দিয়ে তারা নাকি আল্লাহ্র
এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’
রক্ষা করে। আর মারণ
আঘাতে লুটিয়ে পড়লে তারা সকলেই আল্লাহ্
বা মা কালীকে না
ডেকে ‘বাবা গো, মা
গো’ বলে চিরকালের বাঙালির
মতো একইভাবে কাতরায়! ‘হিন্দু—মুসলমান’ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে নজরুল
বলেছেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের,
তাকে কাটা যায়, কিন্তু
ভিতরের ন্যাজ কাটবে কে?’ টিকি আর
দাড়ি হচ্ছে মানুষের সেই ন্যাজ। এ
ন্যাজ মাথায় আর মুখে নয়,
গজিয়েছে মনের গভীরে; তা
থেকেই এত বিদ্বেষ। আর,
দাড়ি কামানো খায়রু মিয়া ছুরি খেলে, কিংবা
‘তুর্কিছাঁট—দাড়ির শশধর বাবু’ ছুরি
খেলে প্রথম ক্ষেত্রে মুসলমান আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে
হিন্দু শব নিয়ে কবরস্থান
বা শ্মশানে ছোটে না। দুঃখ
এই, ‘মানুষ আজ পশুতে পরিণত
হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে
ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা
মুখে। ওরা মারছে... টিকিকে,
দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির
কি অবসান নেই!’
আসলে
‘হিন্দু—মুসলমান ঐক্য’ নজরুলের অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল। যৌবনের প্রতি
এই কবির আবেদন, ‘আমার
ধর্ম যেন অন্য ধর্মকে
আঘাত না করে, অন্যের
মর্মবেদনার সৃষ্টি না করে।’ একই
দেশের ফুলে—ফসলে পুষ্ট
দুই স¤প্রদায়ের বিরোধ
অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সা¤প্রদায়িক—রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ স¤প্রদায়কে ‘ধর্মের নামে উগ্র মদ
পান’ করিয়ে অযথা মাতাল করে
তুলে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। আর শিক্ষা—বঞ্চিত
সাধারণ মানুষকে করে তুলেছেন নিজেদের
হাতের পুতুল। রাজনৈতিক নেতারা চারপাশে ‘ভাড়াটিয়া মোল্লা মৌলবি পণ্ডিত পুরুত’ জুটিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে আপন আপন স¤প্রদায়ের পক্ষে ওকালতির ব্যবস্থা করেন। নজরুলের কথা, তরুণরা যেন
‘কদর্য’ হানাহানির ঊর্ধ্বে থাকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম কোনো অন্য
ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করিতে আদেশ
দেন নাই। ইসলামের মূলনীতি
সহনশীলতা। পরমত সহনশীলতার অভাবে
অশিক্ষিত প্রচারকদের প্রভাবে আমাদের ধর্ম বিকৃতির চরম
সীমায় গিয়া পৌঁছিয়াছে।’ যুবসমাজের উদ্দেশে বলেছেন, ‘মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে যদি না
পারেন, তবে বৃথাই আপনি
মুসলিম।’ মুসলমানদের ভুল আর পশ্চাদ্পদতা
বিষয়ে লেখকের ওই দুর্ভাবনা এ
যুগের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের ‘শেষকথা’, ‘আমরা যৌবনের পূজারী,
নব—নব সম্ভাবনার অগ্রদূত...।’ পৃথিবীর অগ্রগামী
পথিকদের সঙ্গে সমতালে পথ চলব। পরস্পর
যাবতীয় বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ
করবার চেষ্টা করেছেন তিনি।
কাজী
নজরুল ইসলাম লক্ষ করেছেন ভারতবর্ষের
অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, আভিজাত্যবোধের কারণে। হিন্দু—মুসলমানের ঐক্য সাধনের মাধ্যমে
অগ্রগতি ত্বরান্বিত করায় নজরুল ছিলেন আন্তরিক। হিন্দু—মুসলমান বিরোধের মূলে উভয় স¤প্রদায়ের পারস্পরিক জ্ঞানবিমুখতাকে নজরুল চিহ্নিত করেছেন। সমাজ—অন্তর্গত একটি
স¤প্রদায়ের মানুষ কুসংস্কার, গেঁাড়ামি, বৈষম্য, সংঘাত, দাঙ্গায় সভ্যতা—সমাজ—সময়—রাষ্টে্রর
গতিশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে; নজরুল সেই স¤প্রদায়—অন্তর্গত সকল মানুষকে রক্ষণশীল
কুসংস্কারাচ্ছন্ন জগত থেকে আলোকিত
পৃথিবীতে পদচারণার আহ্বান জানিয়ে বলেছেনÑ ১. আজ বাঙালি
মুসলমানদের মধ্যে, একজনও চিত্রশিল্পী নাই, ভাস্কর নাই,
সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই,
ইহা অপেক্ষা লজ্জার আর কি আছে?’(তারুণ্যের সাধনা) ২.
দেয়ালের পর দেয়াল তুলে
আমরা ভেদ—বিভেদের জিন্দাখানার
সৃষ্টি করেছি; কত তার নাম
সিয়া, সুন্নি, শেখ, সৈয়দ, মোগল,
পাঠান, হানাফি, শাফি, হাম্বলি, মালেকি, লা—মাজহাবি, ওহাবি
ও আরো কত শত
দল। ... সকল ভেদ—বিভেদের
প্রাচীর নিষ্ঠুর আঘাতে ভেঙ্গে ফেল।’(বাংলার মুসলিম বাঁচাও)
এভাবেই
উভয় স¤প্রদায়ের বিরোধের
প্রাচীর ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন
কবি। নজরুল অন্য ধর্মের কূপমণ্ডুকতা,
কুসংস্কার আর প্রাচীন প্রথার
অবরোধগুলো উন্মোচন করে মানুষের পারস্পরিক
মিলনের মাধ্যমে সম্প্রীতি তৈরি করতে চেয়েছেন।
হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্যতা সম্বন্ধে কবির অভিমতÑ ‘হিন্দু
ধর্মের মধ্যে এই ঘূত্মা্করূপ কুষ্ঠ
রোগ যে কখন প্রবেশ
করিল তাহা জানি না,
কিন্তু ইহা যে আমাদের
হিন্দু ভ্রাতৃদের একটা বিরাট জাতির
অস্থিমজ্জায় ঘুণ ধরাইয়া একেবারে
নির্বীর্য করিয়া তুলিয়াছে, ...।’(ছঁুৎমার্গ)
আবার
কবি মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, হিন্দু যেমন আরবি—ফারসি—উর্দু জানে না, তেমনি
সাধারণ মুসলমান বাংলাও ভালো করে আত্মস্থ
করে না, সেখানে আরবি—ফারসি শিক্ষার প্রশ্ন অবান্তর। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁকে লিখিত একটি পত্রে নজরুল
জানিয়েছেনÑ ‘হিন্দু—মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না
পারলে যে, এ পোড়া
দেশের কিছু হবে না...।’ সা¤প্রদায়িক
সম্প্রীতির জন্য নজরুল সাহিত্য
পাঠের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। কোনো স¤প্রদায়ের
সমাজে তিনি মানুষকে বন্দি
করেননি। শৃঙ্খলিত—নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম, হতভাগ্যের জাগরণ, পদানত—শোষিত মানুষের মুক্তি—প্রত্যাশায় তিনি মানুষকে জাতি—ধর্ম—সমাজ মন্দির—মসজিদ ও গ্রন্থের ঊর্ধ্বে
তুলে ধরেছেন, মানবতার সপক্ষে বাজিয়েছেন সাম্যের সুরধ্বনি। ১৯২৬ সালে হিন্দু—মুসলিম দাঙ্গার সময় অসা¤প্রদায়িক
চেতনায় বিশ্বাসী নজরুলের হৃদয়—উৎসারিত বাণী হলোÑ‘যিনি
সকল মানুষের দেবতা, তিনি আজ মন্দিরের
কারাগারে, মসজিদের জিন্দাখানায়, গীর্জার মধ্যে বন্দী। মোল্ল¬া—পুরুত, পাদরী—ভিক্ষু জেল—ওয়ার্ডের মত
তাহাকে পাহারা দিতেছে। আজ শয়তান বসিয়াছে
¯্রষ্টার সিংহাসনে।... মানুষের কল্যাণের জন্য ঐ—সব
ভজনালয়ের সৃষ্টি, ভজনালয়ের মঙ্গলের জন্য মানুষ সৃষ্টি
হয় নাই। আজ যদি
আমাদের মাতলামির দরুন ঐ ভজনালয়ই
মানুষের অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠেÑ
যাহার হওয়া উচিত ছিল কল্যাণের।
সেহেতু ভাঙ্গিয়া ফেল ঐ মন্দির—মসজিদ!’(মন্দির ও মসজিদ)
ধর্মের
ব্যাপারে নজরুল ছিলেন উদার। ড. আহমদ শরীফ
লিখেছেনÑ‘নজরুল ইসলাম কোন বিশেষ ধর্মের
অনুসারী ছিলেন বলা যায় না।
তিনি দেশ জাতি ধর্ম
বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সমান
উদারতায় ভালবাসতে পেরেছেন।’ (বিচিত্র—চিন্তা) এক ধর্মের সত্য—সন্ধানীরা অন্য ধর্মকে ঘৃণা
করতে পারে না বলে
তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মুসলমান সমাজে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তাঁর আন্তরিকতার
প্রকাশ রয়েছে ‘আমার লীগ কংগ্রেস’
প্রবন্ধে। নজরুল তাঁর এক ভাষণে
বলেছিলেন, ‘কেউ বলেন, আমার
বাণী যবন, কেউ বলেন,
কাফের। আমি বলি ও
দুটোর কিছুই নয়’। অসা¤প্রদায়িক চেতনায় উদ্বোধিত নজরুল হিন্দু—মুসলিম মিথকে একইসঙ্গে প্রবন্ধের বক্তব্যে ব্যবহার করেছেন। যেমনÑক) আজ
নারায়ণ আর ক্ষীরোদসাগরে নিদ্রিত
নন। (নবযুগ) খ) ঐ শোনো
মুক্তিপাগল মৃত্যুঞ্জয় ঈশানের মুক্তি—বিষাণ। ঐ শোনো মহামাতা
জগদ্ধাত্রীর শুভ—শঙ্খ! ঐ
শোনো ইসরাফিলের শিঙ্গায় নব সৃষ্টির উল্ল¬াস ঘন রোল!
(নবযুগ)। এ সম্পর্কে
কবি লিখেছেনÑ‘আমি হিন্দু—মুসলমানের
পরিপূর্ণ মিলনে বিশ্বাসী; তাই তাদের এ
সংস্কারে আঘাত হানার জন্যই
মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি,
বা হিন্দু দেব—দেবীর নাম
নিই। অবশ্য এর জন্য অনেক
জায়গায় আমার কাব্যের সৌন্দর্যহানি
হয়েছে। তবু আমি জেনেশুনেই
তা করেছি।’
বস্তুত
বিশ শতকজুড়ে হিন্দু—মুসলমানে দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ,
অভাব; অন্যদিকে লোভী মানুষের ব্যাংকে
কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের
মতো জমা হয়ে থাকাÑ
এই অসাম্য, এই ভেদজ্ঞান দূর
করতেই নজরুল বাংলা সাহিত্যে আবিভূর্ত হয়েছিলেন; কবিতা ও প্রবন্ধে সাম্য,
কল্যাণ ও ঐক্যের বাণী
শুনিয়েছিলেন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার সেই প্রচেষ্টাকে স্মরণে
রেখে, অনুশীলন করে একুশ শতকে
সামনে এগিয়ে যেতে হবে। গড়ে
তুলতে হবে সাম্যবাদী সমাজ।
মন্তব্য করুন
সাম্প্রতিক দুটি অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। কয়েক দিন আগে ভারতের লাক্ষাদ্বীপে জি২০-এর একটি সাইড কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আগামী সেপ্টেম্বরে জি২০-এর যে শীর্ষ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের আলোচনার জন্য নানা বিষয়ভিত্তিক প্রস্তাব তৈরির জন্য ভারতজুড়ে ৬৫টি শহরে মোট ২০০টি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছে এই বছরজুড়ে। ইউনিভার্সাল হলিস্টিক হেলথের ওপর এমন একটি কনফারেন্সে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের মনোনয়নে আমার লাক্ষাদ্বীপ যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে সেখানে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য।
বাংলাদেশ জি২০-এর সদস্য রাষ্ট্র না হলেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের যে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, তার সূত্র ধরেই এ বছর জি২০-এ অবজারভার কান্ট্রির মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ। জি২০-এর বাইরে অবজারভার দেশগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশকেই লাক্ষাদ্বীপের এই কনফারেন্সটির মূল অধিবেশনে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং সে কারণেই এই কনফারেন্সে আমার বক্তব্য দেওয়া।
বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে বলতে গিয়ে আমার একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। সম্মেলনটিতে জি২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও জি৭ভুক্ত বেশ কিছু সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
তাঁরা যত না অবাক হয়েছেন বাংলাদেশের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিকের কথা জেনে, তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক আমি হয়েছি এটি জানতে পেরে যে পৃথিবীর এই নেতৃস্থানীয় উন্নত দেশগুলোর কোনোটিতেই আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো অমন তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এমন সুসংগঠিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য অবকাঠামো নেই। আর লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে তাঁরা যতটা না বিস্মিত হয়েছেন, তার চেয়েও ঢের বেশি বিস্মিত তাঁদের মনে হচ্ছিল এটি জানতে পেরে যে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে পাশাপাশি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে ইনসুলিনসহ ২০টি কমন ওষুধ, কিন্তু অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কথা বিবেচনায় এনে তুলে নেওয়া হয়েছে যাবতীয় অ্যান্টিবায়োটিক।
লাক্ষাদ্বীপে আমার প্রেজেন্টেশনের পর বেশির ভাগ ডেলিগেট আমাদের ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিয়ে যে মন্তব্যটি আমার কাছে করেছেন, তার অনুরণন আমি শুনতে পেলাম এই কয়েক দিন আগে ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের ইভেন্টে যোগদানের সুযোগ পেয়ে। সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে এই ইভেন্টটির আলোচ্য বিষয়বস্তু ছিল স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কিভাবে আমরা বাংলাদেশে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজকে দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারি।
ইভেন্টটির প্রথম সেশনে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যা নাতনি সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বিশেষ অতিথির আসনটি অলংকৃত করেন নিউজিল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাইট অনারেবল হেলেন ক্লার্ক, যিনি বর্তমানে চ্যাথাম হাউস কমিশন নামে ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার সংক্রান্ত বিশ্বের একটি শীর্ষস্থানীয় থিংকট্যাংকের কো-চেয়ারের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন। প্রাণবন্ত আলোচনার শেষ পর্যায়ে তিনি জানালেন যে তাঁর বিবেচনায় বাংলাদেশ ২০৩০ সালে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টে গোলটি অর্জন করতে যাচ্ছে এবং অবশ্যই এই বিশাল অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো মূল ব্যাকবোনের ভূমিকাটি পালন করছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে সফল উদাহরণ। এই ক্লিনিকগুলো স্থাপনের জমি আসে ব্যক্তিগত কন্ট্রিবিউশিন থেকে আর ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি আর মানবসম্পদ সরবরাহ করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাস্থ্যকে এ দেশের নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার মস্তিষ্কপ্রসূত কনসেপ্ট এই কমিউনিটি ক্লিনিক, যা মানুষের এই মৌলিক অধিকারটির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। জোট সরকারের শাসনামলে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে তখন দিনে চরত গরু। রাতে বসত মদ আর জুয়ার আসর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্ব পেলে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। একে একে চালু করা হয় বিএনপির সময় বন্ধ করে দেওয়া ক্লিনিকগুলো আর পাশাপাশি স্থাপন করা হয় আরো নতুন নতুন কমিউনিটি ক্লিনিক। ওই সময়টায় সরকারের মাঠ পর্যায়ের একজন তরুণ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের এই ধ্বংসযজ্ঞ এবং অতঃপর নব-উত্থান আমার নিজ চোখে দেখা। বঙ্গবন্ধুকন্যার এই মৌলিক কনসেপ্ট, ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ এবার বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেল। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সম্প্রতি বাংলাদেশের উত্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক সংক্রান্ত একটি রেজল্যুশন পাস হয়েছে। এই রেজল্যুশনটিতে জাতিসংঘ বিশ্বের তাবৎ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেল অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। কয়েক দিন আগেই শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট আশ্রয়ণ প্রকল্প তাঁর মেধাস্বত্ব হিসেবে কপিরাইট পেয়েছে। আর মাস ঘুরতে না ঘুরতে এবার তাঁর আরেকটি মৌলিক কনসেপ্ট কমিউনিটি ক্লিনিক পেল বিশ্বস্বীকৃতি। অজস্র ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী। আপনি জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি, আপনি জাতির গৌরব।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্যসচিব সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
মন্তব্য করুন
আমেরিকার South Asia Perspectives পত্রিকায় ২৮ মে(২০২৩) প্রকাশিত মিথ্যাচারে পূর্ণ Jon Danilowicz এর U.S. Visa Policy: What Next? শিরোনামে লেখাটি মনোযোগ সহকারে পড়লে দেখা যাবে এক সময়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তা কী কৌশলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।তিনি যেভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিগুলো তুলে ধরেছেন এবং বিএনপি-জামায়াতের অপতৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন তা সৎ লেখকের কাজ নয়। তিনি যেন কোনো লবিস্ট কর্তৃক নিযুক্ত লেখক। যার নুন খান তার গুণগান করেন। এ ধারার জন ড্যানিলভিচ মার্কা লেখক ও বক্তারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় বসে শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্রের কথা ব্যক্ত করার পরিবর্তে মিথ্যাভাষণে সরকার বিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত। এদের বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন থাকতে হবে।
যে বিষয়টির সাথে আমি নিজে জড়িত, সে বিষয়টি নিয়ে একটু অবতারণা করছি। বেশ কিছু দিন আগে- প্রায় ছয় থেকে আট মাস আগে বাংলাদেশ প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে এবং তাতে বলা হয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক এমন জরাজীর্ণ অবস্থায়, যে কোনো সময় ভেঙ্গে পড়ে যাবে। যারা সেবা গ্রহীতা, তারা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে বা মৃত্যুবরণ করতে পারে- এ ধরনের একটি সংবাদ তারা প্রকাশ করে।
আমি আন্তর্জাতিক বিষয়ে অধ্যায়ন করিনি। তবে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো আমাকে আকৃষ্ট করে। একজন নাগরিক হিসেবে আমি খুবই শংকিত! কারণ, বিশ্বে শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চললেও দীর্ঘদিন পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে যুদ্ধ, মানুষ হত্যা , নিপীড়ন , নারী ও শিশু নির্যাতন, মানব পাচার, অভিবাসন করতে গিয়ে প্রাণহানি আমাদেরকে শংকিত করে তুলছে।