ইনসাইড থট

সমস্যাটা মনে হয় আমার

প্রকাশ: ০৮:০০ এএম, ২২ ডিসেম্বর, ২০২২


Thumbnail

সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে সমস্যাটা মনে হয় আমার একান্তই নিজস্ব। অন্য কাউকে এই সমস্যা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে দেখছি না।

বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক। একবারে হঠাৎ করে দেশে একটা নির্বাচন-নির্বাচন ভাব চলে এসেছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্য এটা খুবই ভালো খবর। বুদ্ধিজীবীদের লেখালেখি করার জন্য এবং টেলিভিশনে টকশো করার জন্য সবসময় কিছু বিষয়ের দরকার হয়। দেশে নির্বাচন-নির্বাচন ভাব চলে আসার কারণে বুদ্ধিজীবীরা লেখালেখি করার জন্য নানারকম বিষয়ের একটা বিশাল বড় সাপ্লাই খুঁজে পেয়েছেন। সরকার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী লীগও এই উপলক্ষে তাদের লেখার নূতন নূতন বিষয় তৈরি করে দিচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন এবং আমি সেগুলো খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। আমি মনে মনে সবসময় আশা করে থাকি তারা লেখাগুলো এইভাবে শেষ করবেন, “আর যাই হোক আমরা আশা করি এই নির্বাচনে কোনো রাজাকার কিংবা রাজাকারের দল অংশ নিতে পারবে না। যে দলই নির্বাচিত হয়ে আসুক তারা হবে পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল।” কিন্তু এই কথাগুলো কেউ লিখছেন না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন এবং আমাদের বোঝান যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে ‘সাম্য’ কিন্তু কেউ এই কথাটা বলেন না যে রাজাকার, কিংবা রাজাকারের দলকে নিয়ে সেই ‘সাম্য’ দেশে আনা যাবে না। রাজাকারদের নিয়ে সাম্যের ভেতরে আর যাই থাকুক সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ছিটেফোঁটা নেই। কাজেই দেশকে নিয়ে আমরা যা ইচ্ছে স্বপ্ন দেখতে পারি, কিন্তু সবার ঝেড়ে কাশতে হবে, অর্থাৎ আমতা আমতা না করে স্পষ্ট গলায় বলতে হবে, এই দেশে রাজাকারদের কোনো জায়গা নেই। (আমরা যারা ৭১-এর ভেতর দিয়ে এসেছি তারা জানি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দলগুলোর মাঝে সবচেয়ে দরিদ্র অশিক্ষিত অনগ্রসর দলটি ছিল রাজাকার। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যেকোনো দল কিংবা মানুষ সবাইকেই ঢালাওভাবে রাজাকার শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয়।)

আমি এক-দুই জায়গায় যেখানে এই বুদ্ধিজীবীরা আছেন সেখানে রাজাকার কিংবা রাজাকারদের দল ছাড়া নির্বাচন করার কথাটি বলে দেখেছি। তারা একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছেন, কেউ কেউ আমতা আমতা করে বলেছেন, “জামায়াতে ইসলামী তো নিবন্ধন পায় নাই।” কেউ কেউ বলেছেন, “এটা সরকারের ব্যাপার, সরকার নিজের স্বার্থে জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করছে না।”অনেকেই আমার কথা না শোনার ভান করে এদিক সেদিক তাকিয়েছেন। বেশিরভাগ সময়েই পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা বুদ্ধিজীবীরা আমার বক্তব্যটুকুই ধরতে পারেননি। তারা সবাই জানেন শুধু ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হবে, অন্য মাসে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে নেহাত ছেলেমানুষি ব্যাপার। বিশাল জনপ্রিয় কোটা বিরোধী আন্দোলনের সময় একজন তরুণ ছাত্র বুকের মাঝে ‘আমি রাজাকার’ লিখে দাঁড়িয়েছিল, সেই ছবি পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সবাই সেটাকে ব্যক্তি স্বাধীনতা হিসেবে সহজভাবে নিয়েছে কারও সেটা নিয়ে সমস্যা হতে দেখিনি। গত নির্বাচনে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের লেখক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন করেছে। ওই নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ধানের শিষ মার্কায় নির্বাচন করেছে, ড. কামাল হোসেন তা হতে দিয়েছেন। সেটাও পত্র-পত্রিকা এবং তাদের কলাম লেখকেরা সবাই যথেষ্ট উদারভাবে নিয়েছেন। এই বিষয়গুলো চিন্তা করলে আমার রক্ত গরম হয় কিন্তু দেখি অন্য কারও সমস্যা হয় না। কাজেই আমার ধারণা হয়েছে সমস্যাটা মনে হয় একান্তভাবেই আমার নিজস্ব! আমার মতো করে ভাবেন এরকম আরও মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, তারা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে অপেক্ষা করেন কিন্তু আমার কাছে যেহেতু কাগজ-কলম আছে আমাকে চুপ করে অপেক্ষা করতে হবে কে বলেছে?

প্রথমেই বলে দিই আমি শুধু ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস করি না। আমি শুধু সারা বছর না প্রতি নিঃশ্বাসে মুক্তিযুদ্ধ এই ফিলোসফিতে বিশ্বাস করি। সেই তরুণ বয়সে আমি মাত্র লেখালেখি শুরু করেছিলাম তখন একজন বয়স্ক লেখক খুবই বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, “তোমার সমস্যাটা কী? যাই লিখো সেখানেই মুক্তিযুদ্ধ ঢুকিয়ে দাও, কারণটা কী?” বলাই বাহুল্য আমি তাকে কোনো সদুত্তর দিতে পারিনি। যেহেতু আমার পৃথিবীর বিশাল ক্যানভাস ব্যবহার করে মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে সাহিত্য জগতে অমর হয়ে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই তাই কিশোর-কিশোরীদের জন্য কিছু লিখতে হলেই আমি কোনো একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প টেনে আনি— সেই গল্পে রাজাকারদের জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিই! সেজন্য কোনো লাভ হয়নি সেটাও সত্যি না, অনেক কিশোর-কিশোরী আমাকে বলেছে তারা আমার বই পড়ে সেই অর্ধ শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া বিস্মৃত মুক্তিযুদ্ধের জন্য এক ধরনের ভালোবাসা অনুভব করেছে, এর চাইতে বেশি তো আমি কিছু চাইনি।

আমি ১৯৯৪ সালে যখন দেশে ফিরে এসেছি তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের দায়িত্বে ছিল ছাত্রদল। তারা সাহিত্য সপ্তাহের আয়োজন করেছে, সেখানে উপস্থিত বক্তৃতার বেশিরভাগের বিষয়বস্তু ছিল রাজাকারদের জন্য ঘৃণাসূচক। বক্তৃতা চলাকালীন সময়ে ওই বক্তব্য সহ্য করতে না পেরে ইসলামী ছাত্র শিবিরের একজন ছাত্রদলের এক নেতার পিঠে চাকু মেরে দিল। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন যোগ দিয়েছি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-কানুন কিছুই জানি না। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে ওই ঘটনার তদন্ত করতে দিল। আমি তদন্ত শুরু করা মাত্রই শহর থেকে বিচিত্র চেহারার লোকজন এসে সেই ছাত্রটিকে ছেড়ে দেয়ার জন্য সুপারিশ করতে লাগল—এরকম যে করা যায় আমি সেটাও জানতাম না। যাই হোক ঘটনা তদন্ত করে আমি শিবিরের ছাত্রটিকে দোষী সাব্যস্ত করে রিপোর্ট দিয়েছি। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলো এবং দুইদিন পর খবর পেলাম সে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় চলে গেছে। কোনোরকম দুর্ভাবনা ছাড়া শিবির যেন শান্তিমতো সন্ত্রাস করতে পারে সেজন্য জামায়াতে ইসলামী যে এরকম চমৎকার ব্যবস্থা করে রেখেছে সেটাও আমি তখন প্রথম জানতে পেরেছি।

যাই হোক তখন দেশে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। বিএনপির একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক একটা গবেষণা করে সিদ্ধান্তে পৌছালেন যে বিএনপি এবং জামায়াত যদি সম্মিলিতভাবে নির্বাচন করে তাহলে তারা খুব সহজে নির্বাচনে জিতে যাবে। আমাদের দেশের 'নিরপেক্ষ সুশীল’ পত্রিকা পুরো বাংলাদেশের ম্যাপ একে বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা দেখিয়ে এবং কোন দলের কত ভোট আছে তা বিশ্লেষণ করে একটি সংবাদ পরিবেশন করল। আমি সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম একদিন ঘোষণা দিয়ে বিএনপি এবং জামায়াত একত্র হয়ে গেল।

সবচেয়ে মজার ঘটনাটি আমার তখনও দেখা বাকি ছিল। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দিয়ে হাঁটছি তখন দেখি একসময় যাদের ভেতর সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল সেই ছাত্রদল এবং ছাত্র শিবিরের ছাত্রেরা একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটামুটি কেন্দ্রীয় এলাকায় দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছে। আমাকে দেখেই তারা আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করেছে এবং আমি সবিস্ময়ে দেখলাম রাজাকারদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ছাত্রদলের যে নেতাটি শিবিরের হাতে চাকু খেয়েছিল এবং আমি যার জন্য তদন্ত করেছিলাম আমার বিরুদ্ধে তার গলা সবার ওপরে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এত গৌরবময় যে শুধু জামায়াতের সাথে একত্রিত হয়েছে বলে রাতারাতি সেই ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করা খুব সহজ নয়! সবাই পারেনি, একজন দুজন ছাত্র যারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছিল তারা খুব মন খারাপ করে আমার কাছে শান্তনার জন্য আসত— আমি সান্ত্বনা দিতাম। এখন তারা কে কেমন আছে কে জানে?

আমি জানি যারা বিএনপি করেন জামায়াতের সাথে তাদের এই আত্মিক বন্ধন নিয়ে সবসময়েই কিছু একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটি শুধুমাত্র নির্বাচনী জোট— আদর্শিকভাবে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন এরকম কথাবার্তা শোনা যায় কিন্তু আমাকে এই ছেলেমানুষি কথাবার্তা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে? আমি এখনো শিউরে উঠে যখন চিন্তা করি এই দেশে বদর বাহিনীর কমান্ডারেরা ক্ষমতায় চলে এসেছিল! বিষয়টি যে নৈতিকভাবে ঠিক আছে সেটা বোঝানোর জন্য ধানাই পানাই জাতীয় যুক্তি দেবেন কিন্তু আমার সেগুলো শোনার ধৈর্য নেই। আমি পরিষ্কার জানি পাকিস্তানি মিলিটারি ১৯৭১ সালে এই দেশে যে গণহত্যা করেছিল, মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল সেই অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটি তাদের সাথে ছিল এই দেশের নাম যদি বাংলাদেশ হয়ে থাকে এবং দেশটি যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পেয়ে থাকি তাহলে এই দেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামী থাকার অধিকার নেই।

আমি যখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তখন একদিন আমেরিকান অ্যাম্বেসির একজন কর্মকর্তা আমার সাথে দেখা করে তাদের একটা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিলেন। সিলেট শহরে সুধীসমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সেখানে তারা কথাবার্তা বলবেন। অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয় তাই আমি ঢেঁকি গেলার জন্য সেই অনুষ্ঠানে যাব বলে কথা দিয়েছি। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময় সেখানে হাজির হয়েছি। সেখানে গিয়ে দেখি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জামায়াতে ইসলামীকেও সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমেরিকান অ্যাম্বেসির যে মানুষটি আমাকে আমন্ত্রণ দিয়ে এনেছেন তিনি পাশে ছিলেন, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই অনুষ্ঠানে আপনারা জামায়াতে ইসলামীকে দাওয়াত দিয়েছেন?”

ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, “সব রাজনৈতিক দলকেই দাওয়াত দেয়া হয়েছে।”

আমি ক্ষিপ্ত হয়ে বললাম, “আপনি আমাকে চেনেন, আমার সম্পর্কে জানেন, তারপরও আমাকে এখানে ডেকেছেন?”

ভদ্রলোক আমতা আমতা করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, আমি কোনো সুযোগ না দিয়ে অত্যন্ত রুঢ় ভাষায় তাকে কিছু একটা বলে অনুষ্ঠান থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করলাম। ঠিক তখন দেখতে পেলাম সিলেট শহরের জামায়াতের নেতা হাজির হয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের নাম শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে দেয়ার জন্য এই মানুষটি এবং তার দল আমার বাসায় বোমা মারা থেকে শুরু করে অনেকভাবে আমার জীবনের ওপর কম হামলা করেনি। তাছাড়া বিএনপি জামায়াতের সম্মিলিত সভায় আমাকে মুরতাদ ঘোষণা দেওয়ার কারণে অনেকেই আমাকে মুরতাদ হিসেবে খুন করে বেহেশতে যাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে।

জামায়াতের নেতা আমাকে দেখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে করমর্দন করার জন্য মুখে হাসি ফুটিয়ে হাত এগিয়ে দিলেন। আমি আমার হাত সরিয়ে বের হয়ে এলাম। পিছন থেকে আমেরিকান অ্যাম্বেসির কর্মকর্তা ছুটে এসে বলল, “স্যার স্যার ঢাকা থেকে অনেক বড় বড় মানুষ আসছেন তাদেরকে আপনার কথা বলা হয়েছে। আপনি চলে গেলে আমি এখন তাদেরকে কি বলব?”

আমি বললাম, “তাদেরকে কি বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার, আমার না।”

আমি জানি অনেকে আমার এরকম ব্যবহারকে যথেষ্ট বিচিত্র বলে মনে করবেন, ১০৭১-এ জামায়াতে ইসলামীর কার্যকলাপের জন্য বর্তমান জামায়াতে ইসলামী বা ছাত্র শিবিরের দায়ী করতে রাজি হবেন না। ‘অতীত ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতের মুখের দিকে তাকিয়ে সবাইকে নিয়ে একত্রে বাংলাদেশ গড়ে তুলি’ এরকম একটা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। যারা এই যুক্তি বিশ্বাস করতে চান তারা করতে পারেন কিন্তু আমার পক্ষে সেই যুক্তি মেনে নেওয়া সম্ভব না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে যতদিন বেঁচে আছি নিজের হাতে জেনে শুনে কোনো যুদ্ধাপরাধী কিংবা তাদের সংগঠনের কারও হাত স্পর্শ করিনি এই অনুভূতিটি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

সিলেটের সেই অনুষ্ঠানে আমি যার হাত স্পর্শ করতে রাজি হইনি সেই মানুষটি বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর আমির। জঙ্গি কার্যকলাপের জন্য তার ছেলেকে মাসখানেক আগে গ্রেফতার করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে খবর পেয়েছি একই কারণে ওই মানুষটিকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

যারা রাজনীতি করেন তারা সবসময় বলেন রাজনীতিতে নাকি কোনো শেষ কথা নেই। আমি সেই কথাটি মানতে রাজি নই। অবশ্যই রাজনীতিতে শেষ কথা আছে, থাকতেই হবে। বাংলাদেশকে এমনি এমনি কেউ হাতে তুলে দেয়নি। ডেইলি টেলিগ্রাফের ভাষায়, রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবী আর কোনো দেশ এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা কিনে আনেনি। সেই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ কথা হচ্ছে, এই দেশে রাজাকাররা রাজনীতি করতে পারবে না। শুধু শেষ কথা নয়, প্রথম কথাটিও তাই।

দেশে প্রায় হঠাৎ করে নির্বাচন-নির্বাচন আবহাওয়া চলে আসার পর জামায়াতে ইসলামী একটা খাঁটি রাজনৈতিক দলের মতো তাদের নিজেদের দাবি-দাওয়া উচ্চারণ করতে শুরু করেছে এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক দল খুবই নিরীহ ভঙ্গিতে বলছে, “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তারা যদি অংশ নিতে চায় তারা নিতেই পারে, এটি তাদের ব্যাপার।” এর পরেই তাদের বলা উচিত, “তবে এই দলটি হচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দল। নৈতিকভাবে এই দেশে রাজনীতি দূরে থাকুক এই দেশে তাদের কোনো ধরনের অস্তিত্ব থাকারই অধিকার নেই।” তবে কোনো রাজনৈতিক দল একথা বলছে না, মজার কথা হচ্ছে প্রগতিশীল বামপন্থী দলগুলোও না। যেহেতু অতীতে আল বদরের কমান্ডাররা এই দেশে মন্ত্রী হয়ে দেশ শাসন পর্যন্ত করেছে কাজেই এই দেশের রাজনৈতিক দলের কাছে আমি আসলে বড় ধরনের কিছু আশা করি না। সত্যি কথা বলতে কি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগে যখন জামায়াতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়েছে তখন থেকে এই দেশের রাজনীতি নিয়ে আমার চাওয়া পাওয়া অনেক কমে গেছে। তবে দেশের মানুষকে কথা দিয়ে সে কথা রেখে এদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য আমি শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কি এই দেশ নিয়ে আমার যে একটি মাত্র সখ অপূর্ণ ছিল, সেটি পূর্ণ হয়েছে। এখন আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।

রাজনৈতিক দলের কাছে চাওয়ার কিছু না থাকতে পারে, কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীদের কাছে অবশ্যই আমার কিছু চাওয়ার আছে। শুধু বুদ্ধিজীবী নয়, পত্রপত্রিকার কাছেও আমার চাওয়ার আছে। প্রধান চাওয়াটি হচ্ছে ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটি নিয়ে। দোহাই আপনাদের, যুদ্ধাপরাধী কিংবা তাদের দলবল এবং অন্য সবাইকে নিয়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবেন না। যখন এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনের ব্যাপারটি আসবে, তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিন। আমি বুদ্ধিজীবীদের বলব সরকারকে কিংবা তাদের দলকে যেভাবে খুশি সমালোচনা করুন, দেশের উন্নতি নিয়ে যেভাবে খুশি তামাশা করতে চান তামাশা করুন, কারও কাছে বেশি কিছু চাইব না, সবাইকে অনুরোধ করব তাদের লেখা শেষে শুধু একবার পরিষ্কার করে লিখবেন, “এই দেশে সবাই রাজনীতি করবে, শুধু রাজাকারদের রাজনীতি করার অধিকার নেই।”

আমার এখন একটিমাত্র শখ, নির্বাচনের রাতে আমি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে দেখব একটি দল নির্বাচনে জিতে এসেছে। যেটাই জিতুক সেটাকে নিয়ে আমার কোনো ভাবনা থাকবে না কারণ এই দেশে সব রাজনৈতিক দলই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল।

এটি কি খুব বেশি কিছু চাওয়া হয়ে গেল? নাকি এটি আমার একটি সমস্যা?


বিএনপি   আওয়ামী লীগ   পত্রিকা   শেখ হাসিনা   রাজাকার   ছাত্রলীগ   ছাত্রদল   গণতন্ত্র   জামায়াত   মুক্তিযুদ্ধ   মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি   জামায়াতে ইসলাম   আমেরিকান অ্যাম্বেসি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

'শেখ হাসিনা' শূন্য থেকে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ


Thumbnail

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭, দিনটি ছিল রবিবার। পাকিস্তান আন্দোলনের সাহসী ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান লেখাপড়ার কারনে তখন ছিলেন কলকাতায়। রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে লেখাপড়ার পাশাপাশি কলকাতার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিরসন এবং লাঞ্চিত, বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানদের অধিকার আদায়ে তিনি তখন প্রচন্ড ব্যস্ত। এমন সময় শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব দম্পতির ঘর আলোকিত করে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃতপল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন ফুটফুটে এক শিশু। নাম রাখা হয় শেখ হাসিনা। পিতা মুজিবকে টেলিগ্রাম করে জানানো হয় নিজের প্রথম কন্যা সন্তানের পৃথিবীতে আগমণের সুসংবাদ। পিতা মুজিব তখন এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, টেলিগ্রাম মারফত নিজের প্রথম কন্যা সন্তানের জন্মের খবর পেয়েও আসতে পারেন নি। এসেছিলেন বেশ কিছুদিন পরে। সেদিনের সেই ছোট্ট শিশু হাসু আজকের সফল রাষ্ট্রনায়ক, জননেত্রী শেখ হাসিনা। 

সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনার জন্য মোটেই সুখকর ছিল না। বসতে শেখার আগেই শিশু শেখ হাসিনাকে ৫ মাস ১৪ দিন বয়সে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হয়! ১৯৪৮ সালের ১১ ই মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হন শিশু শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। ৫ দিন জেল খাটার পর মুক্তি পান তিনি। এরপর কখনো ভাষার জন্য, কখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের জন্য আবার কখনো বা পূর্ব বাংলায় দূর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বারবার পিতা মুজিবকে জেল খাটতে দেখেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা তখন কেবলই এক অবুঝ শিশু। অতপর ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা ২৬ মাস পিতা মুজিবের জেলজীবন ছিল ২৭ মাস বয়সী শেখ হাসিনার জন্য এক মস্ত বড় ধাক্কা। কেবল পিতাকে চিনতে শেখা, বাবা বলে ডাকতে শেখা শেখ হাসিনার জীবন সংগ্রাম সেই যে শুরু, আজ অবধি শেষ হয়নি।

বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ (ইডেন কলেজ) এর জনপ্রিয় ছাত্রলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা যখন ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে কলেজ ছাত্রীসংসদ নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন তখনো পিতা মুজিব কারাগারে বন্দি। ১৯৬৭ সালে পিতা মুজিব জেলে অন্তরীণ অবস্থায় ১৭ ই নভেম্বর ডক্টর এম ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয় শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৭১’র ২৭ শে জুৃলাই হানাদার বাহিনীর নিরাপত্তা প্রহরীর নজরদারীতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালে পুত্র সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রসব! তখন ও পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হিসেবে বন্দী। বন্দী মাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব কেও হাসপাতালে আসার অনুমতি দেয়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। জীবন সংগ্রাম যেন কিছুতেই তার পিছু ছাড়ে না। ১৫ ই আগস্ট পিতামাতা সহ পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকান্ডের পর বিদেশে ৬ বছর অনেক সংগ্রাম করে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে তাকে। 

কথিত আগামির রাষ্ট্রনায়ক জীবন বাঁচাতে মুচলেকা দিয়ে বিদেশে গিয়ে পলাতক জীবন বেছে নিয়েছে। আপন ছোট ভাইয়ের অকাল মৃত্যু, গর্ভধারিণী মায়ের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যাওয়া কিংবা চরম অসুস্থতায় ও দেখতে আসার মত সৎ সাহস হয় নি তার। সরকার চাইলেও তিনি দেশে আসেন নি। আর বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতামাতা সহ পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হারিয়েও এতটুকু ভেঙে পড়েন নি, সাহস হারান নি। ১৯৮১ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর অবৈধ সামরিক শাসক, খুনীদের পৃষ্ঠপোষক জেনারেল জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৭ ই মে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বীরের বেশে দেশের মাটিতে ফিরেছেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের যোগ্য উত্তরসুরির সাথে অন্যদের পার্থক্য এখানেই। সেদিন বিমানবন্দর থেকে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ মানুষ ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে সরকারি বাধা মোকাবিলা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকার সেদিন শেখ হাসিনাকে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করতে দেয় নি। রাস্তায় বসে তাকে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল পড়তে হয়েছে। সেদিন থেকেই শেখ হাসিনার গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ন্যায় বিচার এবং ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুরু। 

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তেইশ বছরের আন্দোলন সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে চার জাতীয় নেতার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় বাঙালির সহস্র বছরের আকাঙ্খিত স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে 'যুদ্ধ বিধ্বস্ত শূন্য বাংলাদেশ' পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। তবে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তা হোঁচট খায় বঙ্গবন্ধু কে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। এরপর শুরু হয় এক ভিন্ন বাংলাদেশের যাত্রা। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাক, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদরা পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ কে পরিচালনা করেন পাকিস্তানি ভাবধারায়। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত সংবিধান ক্ষত-বিক্ষত করা হয়। নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করতে এবং স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করতে করা হয় "ইনডেমনিটি আইন"।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৫ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জনতার ভোটে বিজয়ী হয়ে প্রথম বারের মত রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হন বঙ্গবন্ধুর রক্তের যোগ্য উত্তরসুরি শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে মোশতাক-জিয়ার করা কালাকানুন 'ইনডেমনিটি আইন' বাতিল করে দেশ এবং জাতির ললাট থেকে কলঙ্ক মোচন করেন তিনি। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার বিচার, দেশে ফিরে আসে আইনের শাসন। ১৯৯৬ সালের ১২ ই ডিসেম্বর গঙ্গানদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের লক্ষ্যে ভারতের সাথে 'গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি' সম্পাদন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। ১৯৯৭ সালের ২ রা ডিসেম্বর 'পার্বত্য শান্তি চুক্তি' বাস্তবায়নের মাধ্যমে দীর্ঘ ২৩ বছরের অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনেন তিনি। শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৯৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক "হুপে- বোয়ানি" শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন শেখ হাসিনা। ১৯৯৭ সালে শান্তি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় 'নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু স্মৃতি পুরস্কার' পান তিনি।

খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেন শেখ হাসিনা। ১৯৯৯ সালে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা তাকে 'দ্যা সেরেস মেডেল' প্রদান করে। ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্তি শেখ হাসিনা সরকারের কুটনৈতিক সাফল্যের ফসল। তার সরকারের এসব অর্জন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরে যাওয়া বাংলাদেশে তার যোগ্য নেতৃত্বে আবার ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ২০০১ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতার মেয়াদ শেষে সাংবিধানিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নজির সৃষ্টি করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনে দেশি-বিদেশী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে স্থূল ভোট কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষমতায় আসীন হয় খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার।

খালেদা-নিজামীর নেতৃত্বে দেশ দূর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। পাঁচ বার দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় মদদে ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় নারকীয় গ্রেনেড হামলা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে চিরতরে নেতৃত্বশূন্য করা। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। এ ধরণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। খালেদা-নিজামীর জোট সরকার মেয়াদ শেষে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। জনমতকে উপেক্ষা করে ভূয়া ভোটার সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের নিয়োগকৃত বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে একটি যেনতেন নির্বাচন করে পুনরায় রাষ্ট্রক্ষমতায় বহাল থাকার দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকে তৎকালীন সরকার। 

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে গড়ে ওঠে দূর্বার গণআন্দোলন। গণআন্দোলনে ভেস্তে যায় যেনতেনভাবে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা। ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ১/১১ সরকার। শুরু হয় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়। পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনাকে কারামুক্ত করে ওয়ান ইলেভেন সরকারকে নির্বাচন দিতে বাধ্য করা হয়। ইতিহাসের নজিরবিহীন নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। 

দেশী-বিদেশী সকল ষড়যন্ত্র এবং বাঁধা মোকাবিলা করে নিজস্ব অর্থায়নে বাঙালির অর্ধ শতকের স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু শেখ হাসিনার সাহস এবং সক্ষমতার প্রতীক। ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। যানজটের নগরী ঢাকার মানুষ মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে প্রতিনিয়ত। চট্টগ্রামবাসীর বহুল প্রত্যাশিত কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। আগামী ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পাবনার 'রুপপুর নিউক্লিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র' নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ফোর লেন, ঢাকা-রংপুর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ঢাকা-সিলেট সিক্স লেন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সহ অসংখ্য মেগা প্রকল্পের বেশিরভাগই সম্পন্ন হয়েছে। কোনো কোনোটির কাজ শেষ পর্যায়ে। 

শিক্ষা, যোগাযোগ, কৃষি সহ সকল ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার টানা তিনবারের রাষ্ট্রক্ষমতার মেয়াদে দেশে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭৩ সালে ৩৬,১৬৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করেছিল। পরবর্তীতে আর কোনো সরকার এ ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। শেখ হাসিনার সরকার দীর্ঘ বছর পর একসাথে ২৬,১৯৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে। ২০১০ সাল থেকে ১ম শ্রেণি থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন শিক্ষামাতা শেখ হাসিনা। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সনদের ব্যবস্থা করেছেন 'কওমি জননী' শেখ হাসিনা। সারাদেশে দৃষ্টিনন্দন মডেল মসজিদ নির্মাণ করে শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। কয়েক লক্ষ গৃহহীন মানুষকে সরকারি অর্থায়নে দৃষ্টিনন্দন বাড়ি করে দিয়ে নজীর স্থাপন করেছে শেখ হাসিনার সরকার।

দেশের ৩৭ টি সরকারি মেডিকেল কলেজের ২০ টিই শেখ হাসিনা সরকারের টানা তিন মেয়াদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ১ টি সরকারি ও ৫ টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সবকয়টি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত! দেশের ১৭ টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ টিই শেখ হাসিনার টানা তিন মেয়াদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের সফল কুটনৈতিক তৎপরতায় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের কাছ থেকে বঙ্গোপসাগরের ১৯,৪৬৭ বর্গকি.মি এবং মায়ানমারের কাছ থেকে ১ লক্ষ ১১ হাজার বর্গকি.মি সমূদ্রসীমার অধিকার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার সফল কুটনৈতিক প্রচেষ্টায়  বাংলাদেশের জন্য সমূদ্র সীমা বিজয় এক বিশাল অর্জন। ২০১৫ সালের ১ আগস্ট 'ল্যান্ড বাউন্ডারি এগ্রিমেন্ট' বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের সমস্যার সমাধান করে কুটনৈতিক সফলতার পরিচয় দেন বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকার। এর ফলে ৬৮ বছরের পরিচয়হীন, রাষ্ট্রহীন ছিটমহলবাসী নাগরিকত্ব লাভ করেন। 

শেখ হাসিনা বিশ্বশান্তি রক্ষায় ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ৬৬ তম অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শান্তি মডেল উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রশংসিত হন। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে স্বল্পোন্নত বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। মহাকাশে এখন আছে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। এসব অর্জনের সুফল ভোগ করছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'গ্লোবাল সামিট অব উইমেন ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে অসামান্য নেতৃত্ব দানের জন্য শেখ হাসিনাকে 'গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড' প্রদান করেন। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা প্রায় ১০ লক্ষ অসহায় রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং মানবিকতার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী 'আইপিএস ইন্টারন্যাশনাল এ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড' এবং 'স্পেশাল ডিসটিংশন অ্যাওয়ার্ড ফর লিডারশীপ' পদক পান। 

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সুদূরপ্রসারী কাজের জন্য পলিসি লিডারশীপ ক্যাটাগরিতে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার 'চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ' পুরস্কারে ভূষিত হন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। পাশাপাশি একই বছরে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আইসিটির ব্যবহারে প্রচারণার জন্য ‘আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন তিনি। ২০১৪ সালে নারী ও শিশু শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রসারে তার সরকারের বিশেষ ভূমিকার জন্য শেখ হাসিনা ‘ট্রি অব পিস’ পদক পান। তথ্য-প্রযুক্তি সেবার সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য খাতে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস এবং ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০১৩ ও ২০১৪ সালে তিনি দু'বার সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন ভিশনারি'  পুরস্কারে ভূষিত হন।

নারীর ক্ষমতায়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ইউএন উইমেন ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ পুরস্কার ও ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ পদক প্রদান করে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০১৯ সালে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, স্কটল্যান্ড, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, রাশিয়া, এবং ফ্রান্স সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান এবং বিভিন্ন সম্মাননা পদকে ভূষিত করেছে বিভিন্ন সময়ে। এই অর্জন বঙ্গবন্ধু কন্যার একার নয়, এই অর্জন সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির। 

রাষ্ট্র পরিচালনায় শুধু নয়, বরং বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সফলভাবে মোকাবিলা এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড শক্ত হাতে প্রতিহত করে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রেখেছেন সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। নিজ দল ও সরকারের দূর্নীতিবাজ নেতা, এমপি, মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তিনি। ১৯৮১-২০২৩ দীর্ঘ ৪২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। বারবার তার উপর গ্রেনেড, গুলি, বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বাঙালির দীর্ঘ আকাঙ্খিত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে দেশ ও জনগণের জন্য নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ কর্তৃক 'এসডিজি অগ্রগতি পুরস্কার' এ ভূষিত হয়েছেন তিনি। এভাবে বারবার তিনি যেমন সম্মানিত হয়েছেন তেমনি দেশকে বিভিন্ন অর্জনে করেছেন সমৃদ্ধ। 

১৯৭২-৭৫ মাত্র তিন বছরের শাসনামলে একটি ক্ষুদ্র এবং গরীব রাষ্ট্রের প্রধান হলেও বঙ্গবন্ধু তার বিশাল ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্বগুণ এবং অসাধারণ বাচনভঙ্গির কারনে বিশ্বমঞ্চে সকলের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা বিশ্ব মোড়লদের মাথাব্যথার কারন হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না  পারে সেজন্য আন্তর্জাতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত দেশীয় শক্তির যোগসাজশে বঙ্গবন্ধু কে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। আজকে বঙ্গবন্ধু কন্যার গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ যখন উন্নয়ন এবং অর্জনে সমৃদ্ধির চূড়ান্ত শিখরে, বাংলাদেশ যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা অর্জন করেছে তখন আবার দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার উপর ওরা হস্তক্ষেপ করতে চায়। ইনশাআল্লাহ্ শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রেখে চলমান প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে!

শেখ হাসিনা প্রবল অন্ধকারে আলোর দ্যূতি; যিনি আইনের শাসন বিহীন বাংলাদেশে আইনের শাসন ফিরিয়ে এনেছেন, বিদ্যুতের আলো বিহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন বাংলাদেশকে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করেছেন। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষা, তথ্য, যোগাযোগ এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা পশ্চাৎপদ বাংলাদেশকে তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করেছেন তার ভিশনারী নেতৃত্বগুনে। তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, কৃষি, শিল্প, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার চাওয়া এখন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এই লক্ষ্যে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১ রূপকল্প’ ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশের সাহসি অভিযাত্রার এক অবিকল্প সারথি, সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভিশন-২০৪১ এর সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে  আজকের উন্নত, সমৃদ্ধ, ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক স্মার্ট বাংলাদেশ! ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দেশরত্ন, জননেত্রী শেখ হাসিনার ৭৭ তম শুভ জন্মদিনে এই প্রত্যাশা।

 

মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, ১৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, খুলনা মহানগর।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

দুঃখী মানুষের কষ্টমোচনে শেখ হাসিনা

প্রকাশ: ১১:০০ এএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিবেদিতপ্রাণ। ২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে গণভবন থেকে দেশের ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ৬৯ হাজার ৯শ' ৪ জন ভূমিহীন ও গৃহহীনকে পাকাঘর প্রদান কার্যক্রমের প্রথম পর্যায়ের শুভ উদ্বোধন করেন। পরের মাসে আরো ১ লাখ পরিবার বাড়ি পায়। হস্তান্তরকৃত প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ ও সুপেয় পানি সরবরাহের বন্দোবস্ত করা হয়। প্রতিটি জমি ও বাড়ির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেওয়া।দেশের গৃহহীন প্রতিটি মানুষ ঘর না পাওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আজ আমার অত্যন্ত আনন্দের দিন। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান করতে পারা বড় আনন্দের।’ তাঁর সবচেয়ে আনন্দের ওই দিনটি জনগণের জন্যও সুখের কারণ একসময় আমরা রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে কেবল হাজার হাজার প্রতিশ্রুতি শুনতাম, বাস্তবায়ন ছিল সুদূর দুরাশার। কিন্তু শেখ হাসিনার একটানা শাসনের গত সাড়ে ১৪ বছরে তার বিপরীত চিত্র দেখছি।তিনি কথা দেন এবং সাধ্যমতো জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দেখিয়ে দেন যে তিনিই প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেন।গরিব-দুখী মানুষের জন্য কাজ করার এই প্রবণতা তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। এজন্য এদিন তিনি বলেছেন- ‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের কথাই ভাবতেন। আমাদের পরিবারের লোকদের চেয়ে তিনি গরিব অসহায় মানুষদের নিয়ে বেশি ভাবতেন এবং কাজ করেছেন। এই গৃহ প্রদান কার্যক্রম তারই শুরু করা।’

বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই চলছেন শেখ হাসিনা।‘আমার বাংলাদেশ, আমার ভালোবাসা’ এই অমৃতবাণী বাংলাদেশের তিনিই উচ্চারণ করেছেন।তিনি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত। সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা; গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনন্য রূপকার আর মানব কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ- তার চেয়েও আরো আরো অনেককিছু তিনি। দরদী নেতাটি দুঃখী মানুষের আপনজন; নির্যাতিত জনগণের সহমর্মী তথা ঘরের লোক। তিনি বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ মানবতার দিশারি শেখ হাসিনা দেশের মানুষের জন্য নিজের প্রাণকে তুচ্ছ করতে পারেন নির্দ্বিধায়। সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তিনি। তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের সবকিছু। ২০০৯ সালে লিখেছিলেন- ‘রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম আমার। পিতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। একদিন যে আমাকেও তাঁর মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনা করতে হবে ভাবিনি। সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর যাবৎ জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি।’(ভূমিকা,  শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১)

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে গৃহহীন মানুষের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ একটি নিরাপদ আশ্রয়ে বসবাস করা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। আর এই অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাই বিপন্ন মানুষের আশ্রয় ও গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিত করাকে এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বা ভিশন হিসেবে নিয়ে কাজ করছে শেখ হাসিনা সরকার। প্রকল্পের আপাতত লক্ষ্য বা মিশন হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় গৃহহীন মানুষের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ এবং ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে পুনর্বাসন। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি শেখ হাসিনার অন্যতম মানবিক উদ্যোগ।এর সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও জড়িত। 

২০১৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৯৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এসডিজি অনুমোদন করেন। এসডিজি'র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্যই নেওয়া হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ উদ্যোগ। ১০টি বিশেষ উদ্যোগ ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম সে লক্ষ্যেই পরিচালিত। এ ১০টি উদ্যোগ যথাক্রমে আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষা সহায়তা কর্মসূচি, নারীর ক্ষমতায়ন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কমিউনিটি ক্লিনিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, বিনিয়োগে বিকাশ এবং পরিবেশ সুরক্ষা। আশ্রয়ণ প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নে।তবে আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য তিনটি ১. ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল,অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ২. ঋণ প্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা ৪. আয়বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্যদূরীকরণ।

প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়, এছাড়া অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং আরও নানা আকস্মিক দুর্যোগেও গৃহহীন হয় বহু মানুষ। দেশে রয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গৃহহীন পরিবার। এ কারণেই প্রয়োজন হয়েছে তাদের আশ্রয়ণের ব্যবস্থা। দেশের ভূমি ও গৃহহীন আট লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।পর্যায়ক্রমে এ তালিকার সবাই এই সুবিধা পাবে। উপকারভোগীদের মধ্যে যাদের জমি আছে, তারা শুধু ঘর পাবে। যাদের জমি নেই, তারা ২ শতাংশ জমি পাবে (বন্দোবস্ত)। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি ঘর তৈরিতে খরচ হচ্ছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। সরকারের নির্ধারিত একই নকশায় হচ্ছে এসব ঘর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এই কাজ করছে। খাসজমিতে গুচ্ছ ভিত্তিতে এসব ঘর তৈরি হচ্ছে। কোথাও কোথাও এসব ঘরের নাম দেওয়া হচ্ছে ‘স্বপ্ননীড়’, কোথাও নামকরণ হচ্ছে ‘শতনীড়’, আবার কোথাও ‘মুজিব ভিলেজ’।সরকারের এই উদ্যোগ বিশ্বের ইতিহাসে নতুন সংযোজন বলে জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সেখানকার অভিমত হলো- ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ব ইতিহাসে নতুন রেকর্ড গড়তে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশের বিশাল অর্জন।’

এ কথা সত্য, গৃহহীন মানুষ তার আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পেলে খুব দ্রুত বদলে নিতে পারে নিজের ও পরিবারের জীবনমান। অথচ ১৯৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান সরকার বা তার আগে ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ সরকার- এরা কেউই গৃহহীন মানুষের আশ্রয়ের জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকার কিছু কাজ করলেও ১৯৯৭ সালের আগ পর্যন্ত ঘরবাড়ি হারানো পরিবারগুলোর আশ্রয়ের জন্য সংগঠিতভাবে কোনো চিন্তা কেউ করেননি।উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে গৃহহীন মানুষের দুর্দশা লাঘবে তাদের গৃহে পুনর্বাসনের মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ‘গ্রামে গ্রামে কাজ করো, দুঃখের দিনে মানুষের পাশে দাঁড়াও’- এটি ছিল নেতা-কর্মীদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ।

তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মূলত এসব গৃহহীন পরিবারের আশ্রয়ের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিন্তা শুরু করেন। ওই বছর ১৯ মে কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে বহু পরিবার গৃহহীন হয়। সেসময়ের ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই এলাকা দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি গৃহহারা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সরকারের সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তিন ধাপে আশ্রয়ণ প্রকল্প কাজ করছে।

‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’ স্লোগানকে ধারণ করে ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প কার্যক্রমের চিত্র নিম্নরূপ-

 জুলাই ১৯৯৭-জুন ২০১৯ অবধি প্রকল্প গ্রামের সংখ্যা  ২,০৩১টি , নির্মিত ব্যারাক সংখ্যা ১৯,৮৭৮টি, যার জমি আছে ঘর নেই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ ১,৪৩,৭৭৭টি,  তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের ঘর নির্মাণ ২১৪টি, নির্মিত টং ঘর-২০টি , কবুলিয়ত রেজিস্ট্রি সংখ্যা ১,৪১,৪১৮টি পরিবার, প্রশিক্ষণ প্রদান ২,৭৫,৬৫৬ জন, ঋণ প্রদান ১,৩৮,৭১৮টি পরিবার, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ১,১০১টি । অন্যদিকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প ৩য় সংশোধিত ডিপিপি এর লক্ষ্যমাত্রা (জুলাই ২০১৯-জুন ২০২২) হলো- নির্মিতব্য প্রকল্প গ্রামের সংখ্যা ৪১৮টি, নির্মিতব্য ব্যারাক সংখ্যা ৬,৪৪৫টি, ব্যারাকে পুনর্বাসিতব্য পরিবার সংখ্যা ৩২,২২৫টি, যার জমি আছে ঘর নেই তার নিজ জমিতে নির্মিতব্য গৃহ ২৭,০২৯টি পরিবার, তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের নির্মিতব্য ঘর ৩৬৬টি, কবুলিয়ত রেজিস্ট্রি সংখ্যা ৪৪,৪৯৫টি পরিবার, প্রশিক্ষণ প্রদান ৯৬,১৭০ জন, ঋণ প্রদান ৪৭,১৯৫টি পরিবার, বৃক্ষ রোপণ ৬,২৪,৯৭৫টি বৃক্ষ, বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান ৫৪৬টি পরিবারে। বর্তমানে ২.৫০ লক্ষ ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবার পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ (জুলাই ২০১০-জুন ২০২২) নামে প্রকল্পের কার্যক্রম চলছে। তিনি জাতিসংঘ ভাষণে(২০২৩) বলেছেন, ‘‘ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য আমার সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ “আশ্রয়ণ” প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে।’’

মূলত এখন সারাদেশে গ্রামাঞ্চলে ব্যারাক হাউস এবং বিভাগীয় সদর ও রাজউক, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এলাকা, জেলা ও উপজেলা সদর এবং পৌরসভা এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। প্রকল্পটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দারিদ্র্যবিমোচনমূলক একটি মানবিক উদ্যোগ। পুনর্বাসিত ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্ত ও ছিন্নমূল পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে ভূমির মালিকানা স্বত্বের দলিল/কবুলিয়ত সম্পাদন, রেজিস্ট্রি ও নামজারি করে দেওয়া হয়। পুনর্বাসিত পরিবারসমূহের জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ, কবরস্থান, পুকুর ও গবাদিপশু প্রতিপালনের জন্য সাধারণ জমির ব্যবস্থা করা হয়। পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহারিক ও প্রশিক্ষণদান এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হচ্ছে।

আসলে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য তিনটি সূচককে বিবেচনা করা হয়। এগুলো হচ্ছে- ১. মাথাপিছু আয়, ২. মানবসম্পদ সূচক, ৩, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যা দরকার ছিল- মাথাপিছু আয় বিগত তিন বছরের গড় ১২৩০ মার্কিন ডলার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন ২০৬৪ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল ৬৬ বা তার বেশি। এ সূচকে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়েছে ৭৩.১৫তে। সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানকেও ছাড়িয়ে গেছে মানবসম্পদ সূচকে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ছিল ৩২ বা তার কম স্কোর। এ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ২৫.২২। উন্নয়নের এই সোপানে আরোহণ শেখ হাসিনার অনন্য কৃতিত্ব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পূর্ণ নিজস্ব চিন্তা চেতনা এবং সৃজনশীলতা দ্বারা উদ্ভাবিত বিশেষ ১০টি উদ্যোগসমূহের মধ্যে অন্যতম উদ্যোগ হলো আশ্রয়ণ প্রকল্প। সব গৃহহীন পরিবারকে গৃহায়ণ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে তিনি ‘সবার জন্য গৃহায়ণ’ ঘোষণা করেছিলেন। এক্ষেত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারগুলোর অবস্থার অগ্রগতির জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে এই প্রকল্প।তিনি লিখেছেন- ‘দেশের জন্য, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে।’(বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্যে উন্নয়ন)তাঁর মতে, জনগণের সমস্যা দূর করতে পারলেই তো রাজনীতি জনগণের কল্যাণের জন্য করা বোঝায়। আওয়ামী লীগ সরকার সব সময়ই জনগণকে কিছু দিয়েছে। এদেশের মানুষ যা অর্জন করেছে তার সিংহভাগ আওয়ামী লীগের দেওয়া।শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে এজন্যই আনন্দিত হয়েছেন গৃহহীনদের ঘর দিয়ে, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। তাঁর কারণেই অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে।উজ্জীবিত হয়েছে নিঃস্ব মানুষগুলো।


(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,  বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

আমার কলেজ-জীবন


Thumbnail

আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭ তম জন্মদিন। কেমন ছিলো তার কৈশোর কাল? কিভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন। তার এক খন্ড চিত্র পাওয়া যায় শেখ হাসিনার লেখায়। ‘আমার কলেজ জীবন’ শিরোনামে লেখাটি শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষ্যে বাংলা ইনসাইডার প্রকাশ করলো-

স্কুলজীবন শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। সে কী উৎসাহ উদ্দীপনা। অধিকাংশ বন্ধু গভ. ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হচ্ছে। কাজেই আমিও সেখানে গেলাম, ফর্ম নিলাম, ভর্তি হলাম। বেশ কয়েকদিন অফিসে যেতে হলো। পুরনো কিছু স্কুলের বান্ধবী যারা আমাদের আগের বছর এসএসসি পাস করেছে, তাদের সাথে দেখা হলো। ওরা অনেক সাহায্য করল। বেশ কয়েকদিন অফিসে দৌড়াদৌড়ি করাতে মোটামুটি কলেজ ক্যাম্পাসটি চেনা হয়ে গেল, বিশেষ করে ক্যান্টিনের সাথে পরিচিত হলাম। সাধারণত স্কুলে ক্যান্টিন থাকে না, কিন্তু কলেজে ক্যান্টিন, এক কাপ চা নিয়ে বসে গল্প করা অর্থাৎ রীতিমতো চায়ের কাপে ঝড় তোলা বেশ মজার। রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তারাও বেশ উৎসাহিত, আমি ভর্তি হচ্ছি দেখে।

এর কারণ হলো মেয়েদের মাঝে ছাত্র ইউনিয়ন করার প্রবণতা বেশি। তার ওপর মতিয়া চৌধুরী তখন তুখোড় নেত্রী, তাঁর সংগঠনই বেশি শক্তিশালী। স্কুলে থাকা সময় থেকেই তাঁর সংগ্রামী ভূমিকার কথা জানতাম। বিভিন্ন আন্দোলনে স্কুল থেকে মিছিল নিয়ে বটতলায়ও গিয়েছি। তবে মণি ভাই সব সময় সতর্ক করতেন আমরা আবার মতিয়া চৌধুরীর টানে যেন ভিন্ন রাজনীতিতে চলে না যাই। আমাকে ছাত্রলীগ করতে হবে। তবে আমার সঙ্গে মোটামুটি বন্ধুত্ব সকলের ছিল। নিলুফার পান্না, মঞ্জু, নসিবুন, নিলুফার, রানু, হাসু, টুনটুনি, মাহমুদাসহ অনেক সিনিয়র মেয়েরা যারা ছাত্রলীগ করত তারা খুবই খুশি। ভর্তির সময় অনেক সাহায্য তারা করল। যাহোক ভর্তি হলাম।

প্রথম ক্লাস শুরুর দিন। খুবই উৎসাহ, সারা রাত যেন আর ঘুমই হয় না। সকালে উঠেই তৈরি হলাম। প্রথম দিন কলেজে যাব। নতুন সালোয়ার কামিজ মা তৈরি করে দিয়েছেন। খুবই সুন্দর প্রিন্ট, একেবারে নতুন বাজারে এসেছে। খুব হালকা রঙের মধ্যে, আমার দারুণ পছন্দ। বন্ধু-বান্ধবীদের সাথে সময় ঠিক করে নিলাম, যাতে এক সঙ্গে কলেজে ঢুকতে পারি। আগেই খবর পেয়েছিলাম র‌্যাগিং করবে। কিন্তু কী করবে জানি না। কলেজের গেটের ভিতরে পা রাখলাম। কত স্বপ্ন, মনে কী উৎসাহ, ক্লাসে যাব। ক্লাসরুমগুলো খুঁজে নিতে হবে। রুটিন জানতে হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। মনের মাঝে একটি উদ্বেগও কাজ করছে। কলেজ-জীবনের প্রথম দিন। দারুণ উত্তেজনা, উদ্দীপনা।

মোটামুটি সবাই ঠিক সময় এসেছে। কেউ ভেতরে প্রবেশ করে গেটের পাশেই অপেক্ষা করছে। কয়েকজন বাইরে। আমরা কয়েকজন এক সাথে গেটে ঢুকলাম। কিন্তু যেই গেটের ভেতরে পা দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে ঝপাঝপ রং এসে চোখ- মুখ, কাপড়-চোপড় লাল রঙে ভিজিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আক্রমণ। আচমকা আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেলাম । এত শখের সুন্দর কামিজটি, সাদা সালোয়ার, সাদা ওড়না সব লাল। পুরো ভিজে গেলাম। চোখের চশমাটি ভিজে গেল। ওড়না ও রুমাল দিয়ে চশমাটি মুছে নিলাম। এ ফাঁকে কী করণীয় তাও মনে মনে ঠিক করলাম। কাছেই এক বান্ধবী ছিল। হাতের বইগুলো ওকে ধরিয়ে দিলাম। দেখি বালতি ভরতি রং। সেখান থেকে মগে করে তুলে তুলে ছুড়ে মারছে। আমি কোনো কথা না বলে অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে বালতির দিকে এগুতে থাকলাম। ইতোমধ্যে আরও কয়েক মগ রং আমার দিকে ছুড়ে মারল। কোনো বাধা দিলাম না, প্রতিবাদ করলাম না। শুধু ওদের কাছে পৌঁছলাম বেশ হাসতে হাসতে। কারণ আমার মজাই লাগছিল। প্রথম ধাক্কাটি কাটিয়ে উঠতে যে সময়। কাছে এগিয়ে যেই বালতিটা হাতের নাগালে এসেছে, চকিতে বালতিটা তুলে সব রং ওদের ওপর ঢেলে দিলাম। ওরা বোধ হয় পাল্টা আক্রমণে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। খুবই ক্ষেপে গেল। ওদের যত রং ছিল সবই আমরা ওদের ওপর ছিটালাম। তাতে আমাদের সিনিয়ররা ভীষণ ক্ষেপে গেল। কিছু বিহারি মেয়ে ছিল, নন বেঙ্গলি যাদের বলা হতো, তারা দোয়াতের কালি নিয়ে এল। এক পর্যায়ে তাও কাড়াকাড়ি হলো এবং বেশিরভাগ তাদের গায়েই গেল। এতে ওরা গেল আরও ক্ষেপে। এদিকে আমাদের ওপর যে রং-কিছুক্ষণ পর দেখি রং আর নেই। বেশ বোকা বানালো আমাদের। নন বেঙ্গলিগুলো ভীষণ ক্ষেপেছে আমার ওপর। অনেকক্ষণ তারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, যদিও আমি পুরোনো দালানে উঠে বসে মজা দেখছিলাম। আর একটি বান্ধবীর সাথে বারান্দায় বসে গল্প করছি। যাহোক ওরা অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে যখন হয়রান, আমরা আচমকা আবার এদের হাত থেকে কালির দোয়াত কেড়ে নিয়ে ওদের ওপরই ছিটিয়ে দিলাম। আরও ক্ষেপে গেল ওরা।

যাহোক এ পর্ব শেষ, ক্লাসে যাব। যার জন্য এত উদ্বেগ, উৎসাহ-উদ্দীপনা। রুটিন ও ক্লাসরুম নম্বর আগেই জোগাড় করেছিলাম। কয়েকজন বান্ধবী মিলে রুম নম্বর দেখে ক্লাসে ঢুকতে গেলাম, সেখানে দেখি উঁচু ক্লাসের ক্লাস হচ্ছে, আমাদের ক্লাস না। রুম নম্বর ঠিক অথচ আমাদের ক্লাস না, যখনই ঢুকতে গেলাম সবার সে কী হাসি! সত্যিই বোকা বনে গেলাম। কী ব্যাপার, দেখি সব ক্লাসরুমের নম্বরগুলো কাগজে উল্টোপাল্টা লিখে আমাদের বোকা বানাবার জন্য লাগিয়ে রেখেছে। কাজেই প্রথম দিন ক্লাসরুম নিয়ে ধোঁকা খেয়েই কাটাতে হলো। কলেজের প্রথম দিনটি নানা ঘটনায় বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণই হলো। যাহোক খুব বেশি ক্লাস আর সেদিন করা হলো না। শিক্ষকরা পর্যন্ত ক্লাসরুম নিয়ে ধোঁকা খেয়েছেন। আর ক্লাস খোঁজার জন্য কলেজটি মোটামুটি ঘুরে দেখা হলো। এটিও একটি লাভ হলো। জানি না এখনও নতুন ছাত্রীদের এভাবে পুরনো ছাত্রীরা আপ্যায়ন করে কিনা। আমাদের বড়রা মজা করেছিল।

ইন্টারমিডিয়েট কলেজের জীবন অনেক ঘটনাবহুল। আমাদের কলেজে কোনো শহীদ মিনার ছিল না। আমরা দাবি করলাম একটি শহীদ মিনার কলেজের ভেতরেই করতে। কিন্তু আমাদের প্রিন্সিপাল কিছুতেই করবেন না। করতে দিবেন না। আমরা আন্দোলন গড়ে তুললাম। আমাদের বাজেট, আমাদের টাকা, আমরা শহীদ মিনার করব। কিন্তু না, তিনি তা দেবেন না। একদিন আমরা কিছু ইট জোগাড় করলাম। অবশ্য কলেজেরই কাজ হচ্ছিল, সে ইট নিয়ে এসে ইটের উপর ইট সাজিয়ে একটি শহীদ মিনার বানিয়ে তাতে ফুল দিলাম। এটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। কলেজ শেষে সন্ধ্যায় আমরা একুশের সভা করলাম। আমাদের প্রিন্সিপাল খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে রাতের মধ্যে নিজে এসে সে মিনার ভেঙে ফেললেন। পরদিন কলেজ বন্ধ। তারপরও খবর পেয়ে গেলাম কলেজে। খালি জায়গায় ফুল দিয়ে এলাম।

তার পরদিন কলেজ খুলেছে, আমরা ঠিক করলাম, ঐ জায়গাটাই আবার ফুল দেব। দেখি একজন একজন করে শিক্ষক বসিয়ে রেখে জায়গা পাহারা দেওয়া হচ্ছে যাতে আমরা ফুল দিতে না পারি। আমরাও কম যাই না, হাতে ফুল লুকিয়ে এক একজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর ছুড়ে দিচ্ছি ফুল। সঙ্গে সঙ্গে পাহারারত শিক্ষক তা সরিয়ে ফেলছেন। এ ধরনের লুকোচুরি বেশ চলল ।

এক সময় প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে তাঁর রুমে বসিয়ে রাখলেন, অনেকটা বন্দি। বের হতে দেবেন না। তাঁর ভাষায় আমিই নাকি মূল হোতা। পরে অবশ্য মেয়েরা এক হয়ে তাঁর রুমের সামনে যখন স্লোগান দিতে শুরু করেছে, আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য দাবি করছে, তখন আমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

আমাদের আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। শহীদ মিনার আমাদের চাই। ঢাকার ডিসিকে প্রিন্সিপাল খবর দিলেন। আমাকে হুমকি দিলেন অ্যারেস্ট করার। আব্বা তখন জেলে, নাজিমুদ্দিন রোড বকশীবাজার থেকে বেশি দূরে না। চার আনা রিকশা ভাড়া লাগে। প্রায় ১৫ দিন পরপর আব্বার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেতাম। কলেজ থেকে প্রায়ই যেতাম। আমাকে যখন হুমকি দেওয়া হলো গ্রেপ্তারের, বললাম, আপত্তি নেই। কারণ প্রায়ই তো যাচ্ছি। আর আব্বা যখন ভেতরে আছেনই আমি যাব জেলে। যাহোক ডিসি এলেন। সবাই আমরা ঠিক করলাম, ডিসি যেই বের হবেন, তাঁকে ঘেরাও করব। শহীদ মিনার আমাদের চাই- ই। যে কথা সেই কাজ। গ্রুপ গ্রুপ মেয়ে তৈরি। যেই বের হলেন ডিসি, আমরা ঘেরাও করলাম। আমাদের দাবি মানতেই হবে। আমাদের কলেজের বাজেট থেকেই আমরা করব । কিন্তু করতে দিতে হবে। মেয়েদের দ্বারা ঘেরাও হবে সেটি বোধ হয় বুঝতে পারেননি। কাজেই অনেকক্ষণ আটক থেকে কথা দিলেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করবেন এবং শহীদ মিনার যাতে হয় তা দেখবেন। আমি ভিপি এবং আমার জিএস-এর সঙ্গে আরও দু'একজন প্রতিনিধি যেন তাঁর সাথে এ ব্যাপারে পরে যোগাযোগ করি। তাঁর কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমরা তাকে ছেড়ে দিলাম। এরপর সময় নির্ধারণের জন্য তাঁর কাছে ফোন করি, আর ফোনও ধরে না, সময়ও দেয় না। আমাদের সাথে ভালো ধোঁকাবাজি দিয়েছে। শেষে একদিন কলেজের মেয়ে নিয়ে জিএসসহ ডিসি অফিসে গেলাম। আমরা কলেজের কথা বলি। তিনি আমাকে আব্বার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কোনো পারমিশন লাগলে দেবেন ইত্যাদি কথা বলেন, চা-পানি খাওয়ান। আসল কথা আর বলেন না। যাহোক আমরা ছাড়ি না। অবশেষে বলে এলাম, শহীদ মিনার এ কলেজে হবেই। একদিন করবই। এছাড়া কলেজের অন্যান্য অসুবিধার কথাও এ সুযোগে বলে এলাম। (অবশ্য কলেজে শহীদ মিনার পরে হয়েছে)। তবে আমি ততদিন কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আমার পর ছাত্র ইউনিয়ন থেকে কলেজে ভিপি হয়েছিল। মনে আছে বাজেটে সই করিনি, কারণ বাজেটে শহীদ মিনারের বরাদ্দ ছিল না। ৪/৫ ঘণ্টা আমাকে সেদিনও বন্দি করে রাখা হয়েছিল প্রিন্সিপালের রুমে। বার বার প্রিন্সিপাল ও অন্য শিক্ষকরা বলায় জিএস আগে সই করল, অবশেষে আমাকেও করতে হলো। যাহোক, পরে শহীদ মিনার হয়েছে। আমাদের আন্দোলন বৃথা যায়নি। সে প্রিন্সিপালকে ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনে আইয়ুবের পতনের পর বদলি করে অন্য জায়গায় পাঠানো হয়। ছাত্র ইউনিয়ন কলেজ-সংসদে ছিল। অবশ্য আমাকে ওরা একবার খবরও দেয়নি, বলেওনি। খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আমি এত আন্দোলন করলাম, অথচ সেই শহীদ মিনার তৈরি হলো, আমাকে একবার জানালো না। উদারতার এত অভাব, না হীনম্মন্যতা? এ কলেজ থেকে বিপুল ভোটে কলেজ ইউনিয়নে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হই। প্রকৃতপক্ষে সক্রিয় রাজনীতি এ কলেজ-জীবন থেকে শুরু। তারপর থেকে আজও চলছে। অনেক স্মৃতিভরা কলেজ-জীবন কত আর লেখা যায়। সময়েরও অভাব। আরও অনেক স্মৃতি ধীরে ধীরে সময় পেলে লিখব। খুব ভালো লাগছে। এ অনুষ্ঠানটি হচ্ছে বলে কিছু কথা বলার সুযোগ হলো। কত সুযোগ, বান্ধবীদের সঙ্গে দেখার সুযোগ হবে, শিক্ষকদের সঙ্গে দেখার সুযোগ হবে। আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ।

স্মৃতি বড় মধুর। কলেজে আট আনায় এক প্লেট বিরিয়ানি, চার আনায় কাবার, দুই আনার পরোটা, দুই আনায় এককাপ চা, আহ্ স্বাদটি যেন এখনও লেগেই আছে মুখে।

সুবর্ণজয়ন্তি উৎসব স্মরণিকা (১৯৪৮-১৯৯৮)

 

(শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১।। পৃষ্টা: ২৫১-২৫৪)

 


প্রধানমন্ত্রী   শেখ হাসিনা   জন্মদিন  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের উল্লসিত হওয়ার দিন

প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

২৬ সেপ্টেম্বর খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের উল্লসিত দিন এবং পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কময় একটি অধ্যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান জুড়ে এক অদ্ভুত কেলেঙ্কারির ইতিহাস রচিত হয়। প্রণীত হয় ইনডেমনিটি বিল। ইনডেমনিটি হলো কোনো বিচারকার্যকে বাঁধা প্রদান সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন। কোনো অভিযান বা অভ্যুত্থানের ক্ষয়ক্ষতি আদালতের বহির্ভূত রাখার জন্য আইনসভা যে বিল পাস করে তাকেই  ইনডেমনিটি বিল বলে। এই শব্দের অর্থ শাস্তি এড়াইবার ব্যবস্থা অর্থাৎ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হলো সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

২০২৩ সালে এই দায়মুক্তি আইনটি কেন আমরা স্মরণ করছি। কারণ এটি প্রণয়ন করেছিল খুনিদের প্রধান খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমেদ। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনি ব্যবস্থা থেকে শাস্তি এড়ানোর জন্য বাংলাদেশে এ আইন করা হয়েছিলো। তখন বাংলাদেশে সংসদ অধিবেশন না থাকায় আওয়ামী লীগের একজন ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহযোগী হয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মোশতাক আহমেদ অধ্যাদেশ আকারে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে এ আইন প্রণয়ন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে খন্দকার মোশতাকই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেছিল। আইনটি ১৯৭৫ সালের ৫০ নং অধ্যাদেশ হিসেবে অভিহিত ছিলো। ১৯৭৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদন দেওয়া হয়। এটি ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর পর সংশোধিত আইনে বাংলাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনটি বাতিল করেন। যার ফলে বঙ্গন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ আবার খুলে যায়। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘১৯৯৬ সালে যখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করি তখন সমালোচনা করা হয়েছিল, অনেকেই বলেছিল আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি। বিএনপি সেদিন খুনীদের রক্ষা করতে হরতাল ডেকেছিল। বিচারপতির পরিবারের ওপর হামলা হয়েছিল। একজন সাধারণ মানুষের হত্যার বিচার যেভাবে হয়, জাতির জনকের হত্যার বিচারও সেভাবেই হয়েছে।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হলেও কয়েকজন খুনি এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যেদিন স্বাক্ষরিত হয় সেদিন ছিলো শুক্রবার। ‘দি বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাক স্বাক্ষরিত। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর অধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পেশ করেন। এই ব্যক্তি রাজাকারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। অধ্যাদেশটিতে দুটি অংশ আছেÑ প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। সংবিধানের গণতন্ত্র বিষয়টি খর্ব হবে বলে অনেকে বিরোধিতা করলেও রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতা বলে সংশোধনী বিল পাশ করায়।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল জিয়া রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে নেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান এবং নিজে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সকল অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিলো সংবিধান (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত হয়েছিলো, যা পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়।

পঞ্চম সংশোধনীকে বৈধতা না দিলে জিয়াউর রহমানের আমলে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করা যেত কিন্তু জিয়াউর রহমান তা করেননি। এই সামরিক জান্তা বরং খুনিদের সুবিধা দিয়ে চাকরি দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা রহিত করেননি। ফলে দায়মুক্তি পেয়ে খুনিরা হত্যার কথা প্রকাশ্যে বলে বেড়াত। এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল না করে আবার নিজের সুবিধার জন্য দ্বিতীয়বার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন যা ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় এবং সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীতে এটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদ সরকারের জারিকৃত সকল প্রকার সামরিক আইন, অধ্যাদেশ, বিধি নির্দেশ ইত্যাদি বৈধতাদানের উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পরে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ যৌথ অভিযান দায়মুক্তি বিল ২০০৩ নামে সর্বশেষ ইনডেমনিটি আইন পাস হয়।

বাংলাদেশে মোট তিনবার ইনডেমনিটি আইন পাস করা হয়। ২০১০ সালে এসব অধ্যাদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ইনডেমনিটি ছিল এমন একটি আইন যা ইতিহাসে লজ্জাজনক। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, ইন্দিরা গান্ধী, বেনজির ভুট্টো, বন্দর নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হলেও সেসব দেশে ইনডেমনিটি আইন জারি করা হয়নি কিন্তু বাংলাদেশে এমনটি করা হয়েছিল। পৃথিবীর কোনো সংবিধানে লেখা নেই যে, খুনিদের বিচার করা যাবে না। অথচ তা বাংলাদেশেই প্রথম ঘটেছিলো; এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ২০ বছর পার হলেও কোন রাষ্ট্রপতি বা সরকার প্রধান সেটি বাতিল না করে উল্টো নিজেদের সুবিধা নেওয়ার জন্য ইনডেমনিটি বহাল রাখেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বিল বাতিলের জন্য দি ইনডেমিনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬ নামে একটি বিল উত্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর মানবতা ও সভ্যতা বিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল হয়। পরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারে গতি ফিরে আসে। উল্লেখ্য, জিয়া সরকার খুনিদের বিচার না করে সরকারের উপর মহলে এবং বিদেশের দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করেছিল। তারা পালিয়ে যায়; এখনও অনেকে পালিয়ে আছে। জাতির পিতার খুনিদের মধ্যে এখনও পলাতক রয়েছেÑখন্দকার আবদুর রশিদ, এ এম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। বঙ্গবন্ধুর এই পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের ভয়াল দিনের কথা বলা আমরা শেষ করতে চাই।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

'বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা' সাহস দৃঢ়তায় অনন্য যে যুগল

প্রকাশ: ০৯:০০ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের পরিপূরক। তবে স্ত্রীগণ সবসময়ই স্বামীর উপর একটু বেশি নির্ভরশীল। আধুনিক তথ্য, প্রযুক্তির এই যুগে এই নির্ভরতা কিছুটা কমলেও স্বামী সবসময়ই একজন স্ত্রীর যে কোনো প্রয়োজনে এবং বিপদে-আপদে সবচেয়ে বড় অবলম্বন, সবচেয়ে নির্ভরতার প্রতীক। অথচ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব তার দাম্পত্য জীবনে স্বামী বঙ্গবন্ধু কে কাছে পেয়েছেন খুব কমই। তবে এ নিয়ে তার কোনো ক্ষোভের কথা জানা যায় নি কখনোই। বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে স্বামী শেখ মুজিবুর রহমান বারবার কারাবরণ এবং কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। স্ত্রী এবং সন্তানদের সময় দিতে পারেননি। গ্রামের  সহজ, সরল গৃহবধূ বেগম মুজিব দেশের মানুষের স্বার্থে সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে পরিবার সামলেছেন দৃঢ়তার সাথে। নিজের সুখের জন্য কখনোই শাসকগোষ্ঠীর সাথে আপোষ করেননি। 

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় দীর্ঘদিন ধরে বন্দী বঙ্গবন্ধু কে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিলে বঙ্গবন্ধুর দু'একজন শুভাকাঙ্খী তাকে প্যারোলে মুক্ত হতে পরামর্শ দেন। কিন্তু বেগম মুজিব স্বামী বঙ্গবন্ধু কে প্যারোলে মুক্তি নিতে সুস্পষ্টভাবে নিষেধ করেন। দীর্ঘদিন ধরে বন্দী স্বামীকে কোনো স্ত্রী যে কোনো মূল্যে মুক্ত করতে চাইবেন- এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। অথচ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব সেটি চান নি, উল্টো নিঃশর্ত মুক্তি না দিলে তাকে জেলেই থাকার পরামর্শ দেন। ফলে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব কে বঙ্গবন্ধু প্রত্যাখান করেন। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় মনোভাব এবং আন্দোলনের ব্যাপকতায় বাধ্য হয়ে ৫-৬ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু কে মুক্তি দিতে বাধ্য হন জেনারেল আইয়ুব খান। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বেগম মুজিবের দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রমাণ পাওয়া যায়। 

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার অপরাধে ধানমন্ডি ৩২ নং সড়কের বাসভবনের চারিদিক ঘিরে ফেলেন। উদ্দেশ্য ছিল তাকে যে কোনো মূল্যে গ্রেফতার করা। কমান্ডো স্টাইলে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ভবনের দোতলায় উঠতে থাকেন সৈন্যরা এবং বঙ্গবন্ধু কে বাড়ির বাইরে আসার জন্য বলতে থাকেন। গোলাগুলিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির একজন রক্ষী নিহত হন। গুলির মুখে দাঁড়িয়েও অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে সৈন্যদের পায়ের শব্দ শুনে দরজা খুলে বজ্রকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন- "তোমরা গুলি করছো কেন? গুলি থামাও, গুলি থামাও।" তিনি আরও বলেন, "আমাকে মারতে চাইলে আমি তো এখানেই আছি। আমার লোকজনকে মারছো কেন?" 

এক পর্যায়ে সৈন্যরা গুলি থামিয়ে তাঁকে গ্রেফতারের কথা জানান। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিপে উঠার মুহূর্তে তাঁর পাইপ এবং তামাকের কথা মনে করে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। তাঁকে গ্রেফতার করা সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, "আমার পাইপ এবং তামাক ফেলে রেখে এসেছি। পাইপ আমার লাগবেই।" মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও একজন মানুষ কতটা নির্ভিক চিত্ত হলে পাইপের কথা ভাবতে পারেন! বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। অতঃপর সৈন্যবেষ্টিত বঙ্গবন্ধু হেঁটে ঘরে গিয়ে প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের হাত থেকে তাঁর প্রিয় পাইপ আর তামাক নিয়ে তার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে আর্মি জিপে ওঠেন বীরের মত। বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন তিনি হয়ত আর জীবিত ফেরত আসবেন না। তাই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সেভাবেই বিদায় নিয়েছিলেন। বেগম মুজিব ও জানতেন বঙ্গবন্ধু কে মেরে ফেলা হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতা কেউই পালানোর চেষ্টা করেননি কিংবা পাকিস্তানি আর্মির সৈন্যদের কাছে মাথানত করেননি। অনুনয়-
বিনয় করেননি। 

বঙ্গবন্ধু কে গ্রেফতারের পর শেখ কামাল ছাড়া বঙ্গমাতা সহ পরিবারের সকল সদস্যকে বন্দী করে ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি একতলা বাড়িতে রাখা হয়। শেখ কামাল ঐ রাতেই এবং শেখ জামাল কিছুদিন পর পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বন্দি অবস্থায় পাকসেনারা বারবার মানসিক টর্চার করেন শেখ জামাল কে। শেখ হাসিনার পুত্র সন্তান জয়ের জন্মের সময় বেগম মুজিবকে একবারের জন্যও ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে যেতে দেয়নি পাকিস্তানি সেনারা। তারপরও তিনি ভেঙে পড়েননি। 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে ১৭ ডিসেম্বর  সকালে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়েই বেগম মুজিব বাড়ির ছাদ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আগুন ধরিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে থাকতেন, বেগম মুজিব তখন থাকতেন খোলা কারাগারে। কারন বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় সবাই বেগম মুজিব কে এড়িয়ে চলতেন, তেমন একটা খোঁজখবর নিতেন না। ছেলেমেয়েকে কলেজে-স্কুলে ভর্তি করতেও সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। তারপরও তিনি সংসার সামলেছেন, জেলখানায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর খোঁজ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের জানিয়েছেন। তার মানসিক শক্তি এবং দৃঢ়তা ছিল অতুলনীয়। বহু প্রতিকূলতা সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করেছেন, কখনও ভেঙে পড়েননি। 

জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা সহ ১২টি অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে। এসব অভিযোগের ছয়টির শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে পাকিস্তানের আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান "মার্শাল ল" আইন জারি করেন। তখন লয়ালপুরে সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর বিচার কাজ শুরু হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু তাঁর পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন এই প্রহসনের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানিরা মূলত তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য একটি সার্টিফিকেট তৈরি করতে চায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজি থাকুন বা নাই থাকুন তাঁর পক্ষে একজন আইনজীবী আদালতে বাধ্যতামূলকভাবে রেখে আইন করা হয়। এই কালো আইনের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব কে দেখানো যে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের একতরফা বিচার করছে না। তাকে ডিফেন্ড করার জন্য সকল সুযোগ দেয়া হচ্ছে বাস্তবে যা ছিল আইওয়াশ! 

ডিসেম্বরের ৪ তারিখ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে বিচার কাজ শেষ হয়। দিনটি ছিল ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধের দ্বিতীয় দিন। পূর্ব পাকিস্তান পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যূদয় এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। 
বিচার কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সামরিক আদালতের সকল সদস্যকে রাউয়ালপিন্ডিতে ডেকে পাঠান এবং জরুরি ভিত্তিতে মামলার রায়ের খসড়া তৈরি করতে বলেন। কিন্তু, ইয়াহিয়া খান দেখলেন সামরিক কর্তকর্তারা রায় লিখবেন কখন, সবাই যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। যুদ্ধ সংঘাতের মাঝে জেনারেল  ইয়াহিয়া তার পূর্বপরিকল্পিত রায় আর ঘোষণা করতে পারেননি। ৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুকে লয়ালপুর থেকে মিয়ানওয়ালী কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 

মিয়ানওয়ালী লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর জন্মস্থান। পাকিস্তানের সামরিক সরকার যুদ্ধের মাঝখানে জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে জেনারেল নিয়াজীকে পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার হিসেবে পাঠান। নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে ১৫ ডিসেম্বর মিয়ানওয়ালী কারাগারে পাকিস্তানী কয়েদীদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, বাঙালিরা নিয়াজীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে যেন পরদিন ১৬ ই ডিসেম্বর সকাল ৬ টায় সেলের দরজা খোলার সাথে সাথে সেখানকার কয়েদীরা শেখ মুজিবকেও জেলের ভেতর পিটিয়ে মেরে ফেলে। এই প্রস্তাব কয়েদীরা খুবই উৎসাহের সাথে নিয়েছিল। কিন্তু এই ভয়ানক পরিকল্পনা জেনে যাওয়ার পর বাধ সাধেন জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট। তিনি ভোর ৪ টায় এসে সেলের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন এবং বঙ্গবন্ধু কে তৎক্ষনাৎ তার সাথে অন্যত্র যেতে হবে বলে জানান। 

তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে কিনা সুপারিনটেন্ডেন্ট এর কাছে জানতে চান। কারণ, কিছু দিন আগে বঙ্গবন্ধু দেখেছেন জেলের অভ্যন্তরে একটি কবর খোঁড়া হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জেল কর্মকর্তাকে বললেন, যদি তাঁকে ফাঁসি দেয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে যেন তাঁকে শেষ নামাজ পড়ার জন্য কয়েক মিনিট সময় দেয়া হয়। জেল কর্মকর্তা এমন কিছু নয় বলে বঙ্গবন্ধু কে অভয় দেন এবং জেল থেকে বেরিয়ে যাবার সময় তাকে হত্যার চক্রান্তের কথা জানান। তিনি বঙ্গবন্ধু কে আরও বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধু কে প্রায় এক মাইল দূরে তার নিজের বাড়িতে রেখে আসবেন যাতে তার দেখা কেউ না পায়। সেখানে তাঁকে দু’দিন থাকতে হবে বলেও জানান। এর কারণ হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধু কে বলেন, যুদ্ধ প্রায় শেষের দিকে। তাই, সামরিক কর্মকর্তারা তাদের করণীয় নিয়ে বিভ্রান্ত। যে কোন অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাই, তাঁকে বাঁচানোর জন্য এই ব্যবস্থা। এরপর কয়েকদিন বঙ্গবন্ধু কে জেলের বাইরে নিরাপদ জায়গায় রাখা হয়।

১৬ ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের পরাজয়ের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়ার স্থলাভিষিক্ত হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তখন  বঙ্গবন্ধুকে মিয়ানওয়ালী থেকে রাউয়ালপিন্ডি আনা হয় এবং প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউসে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধু কে ফাঁসিতে ঝুলাতে না পারার জন্য আক্ষেপ করেন এবং বিদায় লগ্নে নতুন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কে সেই কাজটি করার অনুরোধ করেন। কয়েকদিন পর ভুট্টো গৃহবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন। তখন অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেছিলেন,"আমি প্রথমেই একটি বিষয় জানতে চাই- তা হচ্ছে আমি কি মুক্ত, নাকি বন্দী। যদি আমি মুক্ত হই, আমাকে যেতে দিন। যদি আমি মুক্ত না হই, তাহলে তো আমি কথা বলতে পারি না।’ জবাবে ভুট্টো বলেন, ''আপনি মুক্ত। কিন্তু, আপনাকে যেতে দেয়ার আগে আমার কয়েকদিন সময় প্রয়োজন।"

৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তৃতীয় এবং শেষ বারের মত বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেন, "আপনার উচিত আমাকে আজ রাতেই মুক্ত করে দেয়া। এছাড়া, আর কোন পথ খোলা নাই। হয় আমাকে মুক্তি দিন, না হয় মেরে ফেলুন।" বঙ্গবন্ধু কে ফাঁসিতে ঝুলানোর ইয়াহিয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করে
অবশেষে ৮ জানুয়ারী তাঁকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠান ভুট্টো। কারন তিনি জানতেন, বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ফাঁসি দিলে বাঙালীরা বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈন্যকে মেরে ফেলবে। তাদের পরিবার এজন্য ভুট্টোকে দায়ী করবে এবং ভুট্টোর নতুন সরকারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে। বিদায় জানানোর সময় এমনকি বারবার সাক্ষাতের সময় ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানান। তবে বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে দেশের মানুষের সাথে কথা না বলে তার পক্ষে জনাব ভুট্টোকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয় বলে দৃঢ়তার সাথে তাকে জানান। 

১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি-৩২ নম্বর বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘাতকরা বাড়ির মেইনগেটের ভিতর ঢুকে। ভিতরে ঢুকেই নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের পায়ে গুলি করে মেজর হুদা। তখন তিনি "আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল" বলার সাথে সাথে খুনী হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে শেখ কামালকে। গুলি লাগে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম এবং পুলিশের বিশেষ শাখার ডিএসপি নূরুল ইসলামের পায়ে। অভ্যর্থনা কক্ষের সামনের বারান্দা রক্তে রঞ্জিত হয়। মেজর মহিউদ্দিন সহ ঘাতক দলের কয়েকজন এরপর গুলি করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গৃহকর্মী আব্দুল কে গুলি করে। এরপর কিছু সময়ের জন্য গোলাগুলি থামিয়ে বঙ্গবন্ধুর কক্ষের বাইরে অবস্থান নেয় ঘাতকরা। গোলাগুলির শব্দ থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বের হন। এসময় ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধু কে ঘিরে ধরেন। মেজর মহিউদ্দিন সহ সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু কে তাদের সাথে আসতে বলেন। বঙ্গবন্ধু তাদের সাথে সিঁড়িতে আসেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন ইতোমধ্যে তার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত কে তার বাড়িতে এবং তাঁর বাড়ির নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে হত্যা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ গৃহকর্মী আব্দুল কে দেখেছেন কাতরাতে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারছিলেন হয়ত তাকেও হত্যা করা হবে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ও তিনি এতটুকু ভীত হননি। ঘাতকদের কাছে অনুনয়-বিনয় করেন নি, প্রাণ ভিক্ষা চান নি। বরং তাঁর দিকে অস্ত্র তাক করে থাকা হিংস্র খুনীর দলকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু তর্জনী উঁচিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন, "কি চাস তোরা? বেয়াদবি করছিস কেন?" বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে ঘাবড়ে যান মেজর মহিউদ্দিন। আমতা আমতা করে বলেন, "আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।" বঙ্গবন্ধু বলেন, "তোরা আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাস?" বলতে বলতে সিঁড়ির দু-তিন ধাপ নামেন বঙ্গবন্ধু। এমন সময় দোতলা এবং নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেওয়া মেজর বজলুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন নূর মহিউদ্দিন এবং তার সাথে থাকা সৈন্যদের সরে যেতে বললে তারা সরে যান। সাথে সাথে হুদা এবং নূরের স্টেনগানের মুহূর্মুহু বুলেটে স্বদেশের মানচিত্র সম বিশালদেহী বঙ্গবন্ধু সিঁড়িতে লুটিয়ে পড়েন। সিঁড়ি গড়িয়ে রক্তস্রোত নিচে নামতে থাকে। 

জাতির পিতার রক্ত মাড়িয়ে এরপর খুনীরা উপরে উঠে তার রুমের দরজায় গুলি করেন এবং দরজা ধাক্কাতে থাকেন খোলার জন্য। গুলি আর ধাক্কায় একসময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম মুজিব। সবাইকে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দেয় ঘাতকরা। নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা। নামার সময় সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার দিয়ে বলেন, "ওনাকে তোমরা মারলে কেন? আমি কোথাও যাব না।" স্বামী দেশের রাষ্ট্রপতি শুধু নন, রাষ্ট্রের স্থপতি এবং জাতির পিতা। খুনীর দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকেও হত্যা করা হয়েছে আগেই। পুত্র এবং স্বামীর এই নির্মম হত্যাকান্ডের পরও নিজে বাঁচার জন্য তাদের পায়ে ধরেননি, আকুতি করেননি বরং মাথা উঁচু করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চেয়েছেন। খুনীদের মন গলানোর কোনো চেষ্টা তিনি করেন নি, বরং বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহধর্মিণীর পরিচয় দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর মতই হুংকার ছুড়ে- "আমাকে এখানেই মেরে ফেল।" বেগম মুজিবের দৃঢ়তায় তাকে নিচে নামাতে পারেনি ঘাতকরা। তখন ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বেগম তাকে। নিথর, নিস্তব্ধ বেগম মুজিবের দেহ পড়ে থাকে ঘরের দরজায়! 

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজের বুকে তাক করে থাকা বুলেটের দিকে তাকিয়ে ও অসীম সাহসিকতা আর দৃঢ়তা নিয়ে খুনীর দলকে হুঙ্কার দেওয়ার এমন নজীর পৃথিবীর আর কোনো যুগলের আছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তাই তো সাহস এবং দৃঢ়তায় অনন্য বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা যুগল।

লেখকঃ মোঃ নজরুল ইসলাম, কলামিস্ট এবং তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা, খুলনা।


মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন