৮ জানুয়ারি ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার
পর ১৯৭২ সালের ১০
জানুয়ারি পৃথিবীর মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে মাতৃভূমিতে ফিরে
এলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান।তাঁর ফিরে আসার মধ্য
দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী বাঙালি জাতির বিজয় পূর্ণতা পেলো।
বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে নয় মাস
পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা
হয়েছিল। লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) জেলের অপরিসর একটি কুঠুরি ছিল
সেই বন্দির বাসস্থান। তাঁর জগৎ বলতে
সেখানে ছিল চার দেওয়াল,
একটি জানালা ও একটি উঁচু
বিছানা। ১৯৭১ সালের ১৬
ডিসেম্বরের পর তাঁকে সরিয়ে
নেয়া হয় কারাগার থেকে
দূরে আরো দুর্গম জায়গায়।
২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে
রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়।
পর্যায়ক্রমে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়
পাকিস্তানি শাসক।
একাত্তরে
পাকিস্তানের কারাভ্যন্তরে বন্দি ছিলেন ঠিকই; কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন
জানতেন না তিনি কোন
শহরে আছেন। কেবল জানতেন পাকিস্তানি
সামরিক বাহিনী তাঁকে বন্দি করে তৎকালীন পশ্চিম
পাকিস্তানের জেলে রেখেছে। কারাজগৎ
সম্পর্কে তাঁর ভালোভাবেই ধারণা
ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি
ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে
প্রায়শই বলতেন যে, প্রথম দফার
স্বল্পকালের কারাবাস ছাড়া তাঁকে কারাগারে
বরাবর নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিল।
দৈহিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও
নানাভাবে মানসিকভাবে হয়রানি করা হয় তাঁকে।কারা-কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে বন্দির আচার-আচরণ সম্পর্কে
ইসলামাবাদে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাতো। এই রিপোর্টে উল্লেখ
থাকতো তিনি কি খাবার
খেয়েছেন, তিনি কেমন ঘুমিয়েছেন,
সেলের মধ্যে এক দেয়াল থেকে
অন্য দেয়াল অবধি পায়চারি করেছেন,
কি করেননি। বন্দির কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব উৎসুক ছিলেন।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু সেলে প্রবেশকারী গার্ডদের
সালামের প্রতি-উত্তর দেওয়া ছাড়া সবসময় নীরবই
থাকতেন।
পাকিস্তানের
কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার
সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো যোগাযোগ না
থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগাযোগ
ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক
কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও
নয়।... যখন বিপদ আমাকে
আচ্ছন্ন করতো, আমি বুঝতে পারতাম
আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা
ভোগ করছে। যখন আমার মনের
দিগন্তে দেখা দিতো চকিত
আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা
সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে। ... একে বলতে পারেন
প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা
অন্য যা খুশি তাই।
কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের
ঐশী প্রেরণা; আমি যেটা জানি
তা হলো আমার মন
বলছিল বিজয় আমাদের হবেই।
এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে
না। রক্ত সেই অতীব
জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে
জীবনকে এবং এমনি রক্তদান
যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা
বাঁচিয়ে রাখবে।’ বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবার
সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী খবর
ছড়ানো হতো। বন্দি থাকাকালে
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ-
‘সেই
সময়ে আমার সেলে যাঁরাই
এসেছিলেন তাঁদেরই দেখাতো অনেক কম আস্থাবান
ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেতো
না। বরং কোনো অজানা
দুশ্চিন্তা যেন তাঁদের পীড়িত
করতো।...
...এটা
আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময়
মনে হয়েছিল। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে
এমন কোনো বিবৃতি আমার
কাছ থেকে আদায়ের জন্য
উপর্যুপরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন
মিলেছিলো। আমি অনুভব করেছিলাম,
তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত।
এর ফলে আমার মধ্যে
প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে
তাদের দিন ভালো যাচ্ছে
না। আমি তাদের কথা
মান্য করতে অস্বীকার করি।
আমি কোনো কিছু বলতে,
লিখতে বা সই করতে
অস্বীকার করি।...’
বঙ্গবন্ধুকে
গ্রেফতার ও বন্দি অবস্থায়
করাচী নিয়ে যাবার প্রসঙ্গে
গবেষক এস. এ. করিম
উল্লেখ করেছেন- ‘করাচী পৌঁছানোর পর বঙ্গবন্ধুকে লায়ালপুর
বর্তমানে পাঞ্জাবের ফয়সালাবাদ কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁকে একটি
অতি ক্ষুদ্র সেলে রাখা হয়-
যেখান থেকে লোহার শিক
দ্বারা বেষ্টিত ছোট্ট ফাঁকা জায়গা থেকে এই বিশ্বজগৎ
প্রায় আবছা। প্রচণ্ড গরম অথচ কোনো
বৈদ্যুতিক পাখা ছিলো না-
পরবর্তী সময়ে একটি পুরোনো
বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো হলো-
যা মূলত ঘরের গরমকে
আরও ছড়িয়ে দেবার জন্যই। এছাড়াও আরও নানা রকমের
অত্যাচার ছিলো সেখানে। বঙ্গবন্ধু
এসব তোয়াক্কা করেননি, তবে বেদনাবোধ করেছেন
বাংলাদেশের জন্য- যে বাংলাদেশটি তখন
জন্ম নেবার জন্যে লড়ছে।’
এই যন্ত্রণাদায়ক বন্দিজীবন থেকে ১৯৭২ সালের
৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে
পৌঁছান।লল্ডন থেকে ৯ জানুয়ারি
রাতে রওনা হয়ে ১০
জানুয়ারি দুপুরে দিল্লিতে উপস্থিত হন বিকাল চারটায়
দেশে ফেরার ঠিক আগে।দিল্লি বিমানবন্দরে
স্বাধীন বাংলাদেশের এই মহানায়ককে স্বাগত
জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিমানবন্দরে এ উপলক্ষে আয়োজিত
অভ্যর্থনা সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য
রাখেন বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী।তিনি
সেদিন বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধী
ও ভারতের জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন
করেন। অন্যদিকে ইন্দিরা গান্ধী হিন্দিতে দেওয়া তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে
উদ্দেশ করে বলেন- ‘তাঁর
শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও
তাঁর আত্মাকে কেউ বন্দি করে
রাখতে পারেনি। তাঁর প্রেরণায় বাংলাদেশের
মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে
স্বাধীন করেছে। তিনি প্রেরণা দিতে
এখন ভারতে আমাদের কাছে এসেছেন। এই
যুদ্ধের সময় আমরা ভারতের
পক্ষ থেকে তাদের জন্য
তিনটি কাজ করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলাম। এক. যে শরণার্থীরা
ভারতে আছে তারা সময়
হলে ফিরে যাবে। দুই.
আমরা মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করবো ও বাংলাদেশের
জনগণের পাশে দাঁড়াবো তিন.
শেখ সাহেবকে (শেখ মুজিবুর রহমান)
আমরা দ্রুত জেল থেকে মুক্তির
ব্যবস্থা করবো। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি
রেখেছি।’
এরপর
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ ইংরেজিতে
শুরু করলে উপস্থিত হাজার
হাজার ভারতীয় দর্শক একসঙ্গে সমস্বরে চিৎকার করে তাঁকে বাংলায়
ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন। তাদের
দাবির মুখে খানিকটা বিব্রত
হয়ে পাশে দাঁড়ানো ভারতের
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দিকে তাকালে তিনিও
স্মিত হেসে বলেন, ‘দে
নিড বেঙ্গলি’। তিনি বঙ্গবন্ধুকে
বাংলায় বক্তৃতা করার আহ্বান জানান।বঙ্গবন্ধু
তাঁর দরাজ কণ্ঠে বাংলায়
বক্তৃতা শুরু করেন। ‘ভাই
ও বোনেরা’ বলতেই উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারতের
অভ্যর্থনা সভার জনস্রোত। এই
ভাষণে তিনি কৃতজ্ঞতা জানান
ভারতের সকল সহায়তার জন্য।একইদিন
ঢাকার ভাষণেও তা পুনরায় উচ্চারিত
হয়।দিল্লিতে তিনি বলেন-
‘আপনাদের
প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও
সহানুভূতি আমার দুখী মানুষকে
দেখিয়েছে চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে
না। ব্যক্তিগতভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের
অন্ধকার সেলের (কারাকক্ষ) মধ্যে বন্দি ছিলাম কিছুদিন আগেও। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার
এমন জায়গা নাই যেখানে তিনি
চেষ্টা করেন নাই আমাকে
রক্ষা করার জন্য। আমি
ব্যক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।
আমার সাড়ে সাত কোটি
মানুষ তার কাছে এবং
তার সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। আমার
জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর
যেভাবে এক কোটি লোকের
খাওয়ার বন্দোবস্ত এবং থাকার বন্দোবস্ত
আপনারা করেছেন...আমি জানি ভারতবর্ষের
মানুষ খুব দুখী আছে
সেখানে, তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও
অভাব অভিযোগ আছে—তা থাকতেও
তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোকরে সাহায্য
করার জন্য, চিরদিন আমরা তা ভুলতে
পারবো না।...আপনারা জানেন বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে,
আমি সকল প্রকার সাহায্য
সহানুভূতি আশা করি এবং
এও আশা করি দুনিয়ার
শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে
তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে
সাহায্য করার জন্য।...আমি
বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি
বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি
বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে।...আমাকে
প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন?
আমি বলি, এটা আদর্শের
মিল, এটা নীতির মিল,
এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্ব
শান্তির মিল।...’
বঙ্গবন্ধু
এই ভাষণে তাঁর ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র
পরিচালনার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় তুলে ধরেন। পরে
যা বাংলাদেশের সংবিধানেও সংযুক্ত করা হয়। তার
মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্যতম।
অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতিতেও যুক্ত হয় সবার সঙ্গে
বন্ধুত্বের নীতি।উপরন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তিও করেন তিনি।
১৯৭২
সালের ১০ জানুয়ারিতে ঢাকার
মাটি স্পর্শ করার পর উপস্থিত
জনতার ঢল দেখে নিজের
অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু।
বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জাতিকে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ
দেন, ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি জানান-‘আমি
আজ বক্তৃতা করতে পারবো না।’
কিন্তু জানিয়েছেন- ‘আজ আমি যখন
এখানে নামছি আমি আমার চোখের
পানি ধরে রাখতে পারি
নাই।
যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি,
যে মানুষ কে আমি এত
ভালোবাসি, যে জাত কে
আমি এত ভালোবাসি, আমি
জানতাম না সে বাংলায়
আমি যেতে পারবো কিনা।
আজ আমি বাংলায় ফিরে
এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ
আজ স্বাধীন।’
তিনি
এই ঐতিহাসিক ভাষণে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাঁদের
প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে মুক্ত
মানুষের দিকে চেয়ে বলেন-
‘আমি আজ বাংলার মানুষ
কে দেখলাম, বাংলার মাটি কে দেখলাম,
বাংলার আকাশ কে দেখলাম
বাংলার আবহাওয়া কে অনুভব করলাম।
বাংলাকে আমি সালাম জানাই
আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি
বোধহয় তার জন্যই আমায়
ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি
আশা করি দুনিয়ার সব
রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন
আমার রাস্তা নাই আমার ঘাট
নাই আমার খাবার নাই
আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা,আমার মানুষ পথের
ভিখারী। তোমরা আমার মানুষ কে
সাহায্য করো মানবতার খাতিরে
তোমাদের কাছে আমি সাহায্য
চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্র এর
কাছে আমি সাহায্য চাই।
তোমরা আমার বাংলাদেশকে তোমরা
রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ
দাও দিতে হবে, উপায়
নাই দিতে হবে। আমি
আমরা হার মানবো না
আমরা হার মানতে জানি
না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘‘সাত কোটি বাঙ্গালির
হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি
করে মানুষ করো নাই।’’ কবিগুরু
আজ মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে
গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ
মানুষ। আমার বাঙালি আজ
দেখিয়ে দিয়েছে দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি,
এত লোক জান দেয়
নাই। তাই আমি বলি
আমায় দাবায় রাখতে পারবা না।… এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত
না পায়, এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
বাংলার মা-বোনেরা কাপড়
না পায়, এ স্বাধীনতা
আমার পূর্ণ হবে না যদি
এদেশের যুবক যারা আছে
তারা চাকরি না পায়।...’
ভাষণে
মুক্ত স্বদেশে মানুষের অধিকারের কথা তিনি শুনিয়ে
দিলেন, তিনি জানিয়ে দিলেন
দালালদের বিচার করার কথা, তিনি
সরকারি কর্মচারীদের সাবধান করে দিলেন, ঘুষ
গ্রহণের বিরুদ্ধে বললেন, তিনি আমেরিকার জনসাধারণকে
ধন্যবাদ জানালেন এবং বারবার স্মরণ
করলেন ১ কোটি উদ্বাস্তু
মানুষকে ভারতের আশ্রয় দেওয়ার কথা।রক্ত আর যন্ত্রণার সিঁড়ে
বেয়ে যে স্বাধীনতা এসেছে
তা যে ষড়যন্ত্র মুক্ত
নয় তাও স্মরণ করিয়ে
দিয়েছিলেন সেদিন।অন্যদিকে নিজের আত্মপরিচয়, দেশপ্রেম আর নিজের বাঙালিত্বকে
দেশবাসীর কাছে পুনরায় স্পষ্ট
করলেন পাকিস্তানের কারাগারের স্মৃতিচারণ করার সময়-‘আমায়
আপনারা পেয়েছেন আমি আসছি। জানতাম
না আমার ফাঁসির হুকুম
হয়ে গেছে আমার সেলের
পাশে আমার জন্য কবর
খোড়া হয়েছিলো। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম,
বলেছিলাম আমি বাঙালি আমি
মানুষ, আমি মুসলমান একবার
মরে ২ বার মরে
না। আমি বলেছিলাম আমার
মৃত্যু আসে যদি আমি
হাসতে হাসতে যাবো আমার বাঙালি
জাত কে অপমান করে
যাবো না তোমাদের কাছে
ক্ষমা চাইবো না। এবং যাবার
সময় বলে যাবো জয়
বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালি আমার জাতি, বাংলা
আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।…আমি কারাগারে ছিলাম
৯ মাস আমাকে কাগজ
দেয়া হয় নাই। এ
কথা সত্য আসার সময়
ভুট্টো আমায় বললেন শেখ
সাব দেখেন ২ অংশের কোন
একটা বাঁধন রাখা যায় নাকি
আমি বললাম আমি বলতে পারি
না আমি বলতে পারবো
না আমি কোথায় আছি
বলতে পারি না আমি
বাংলায় গিয়ে বলবো। আজ
বলছি ভুট্টো সাহেব সুখে থাকো বাঁধন
ছিঁড়ে গেছে আর না।
তুমি যদি কোন বিশেষ
শক্তির সাথে গোপন করে
আমার বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে চাও
মনে রেখ দলের নেতৃত্ব
দিবে শেখ মুজিবুর রহমান
মরে যাব স্বাধীনতা হারাতে
দিবো না।’
১০ জানুয়ারির ভাষণেই তিনি দেশগঠনের আহ্বান
জানান জনগণকে।মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদাররা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল
তাতে পুরো দেশই ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। এজন্য সকলকে নিয়ে দেশগঠনের প্রত্যাশা
ব্যক্ত করেন তিনি।একতাবদ্ধ থাকতে
বলেন সকলকে। ‘স্বাধীন যখন হয়েছি স্বাধীন
থাকবো আজীবন’- এই প্রত্যয়ও ঘোষণা
করেন তিনি।১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা যেমন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতাপ্রাপ্তি তেমনি দেশের মুক্ত মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার
স্বপ্ন বুননেরও দিন।এজন্যই তিনি বলেছেন-‘নতুন
করে গড়ে উঠবে এই
বাংলা, বাংলার মানুষ হাসবে বাংলার মানুষ খেলবে বাংলার মানুষ মুক্ত হয়ে বাস করবে
বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত
খাবে এই আমার সাধনা
এই আমার জীবনের কাম্য
আমি যেন এই কথা
চিন্তা করেই মরতে পারি
এই আশীর্বাদ এই দোয়া আপনার
আমাকে করবেন।’
বঙ্গবন্ধু
স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে জনগণকে উদ্দেশ্য
করে ১০ জানুয়ারি যে
বক্তব্য দিয়ে গেছেন তাতে
পরিষ্কারভাবে দেশ পরিচালনার নির্দেশনা
ছিল। কিন্তু তিনি যে ষড়যন্ত্রের
কথা সেদিন বলেছিলেন তাও সত্য হয়েছিল।১৯৭৫
সালের ১৫ আগস্ট সেই
ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয় এবং
দেশের স্বাধীনতা অপহৃত হয়ে চলে যায়
পাকিস্তানবাদী রাজনীতির কাছে।এভাবেই বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী ও নির্ভীক নেতার
আসনে থেকেও নির্মমতার শিকার হয়েছেন।কিন্তু তিনি ইতিহাসে অমর
এক দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। তিনি বিজয়ী বীরের
মতো ভালোবাসা নিয়ে স্বদেশে ফিরে
এসেছিলেন। তাঁর চলার পথ
ছিল জনগণের আশীর্বাদে স্নিগ্ধ। কিন্তু তিনি তাঁর স্বপ্ন
সম্পন্ন করে যেতে পারেননি।
বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা। ছয় বছরের নির্বাসিত
জীবন ছেড়ে তিনিও ১৯৮১
সালের ১৭ মে ভারত
থেকে দেশে ফিরে হাল
ধরেন গণতন্ত্রের।বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন আর শেখ হাসিনার
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ আজ
বিশ্বজুড়ে অভিনন্দিত রাষ্ট্র।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি
প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা
করবেন।
প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে
আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা
নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না
কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে
সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার
মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ
আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে
অনেকেরই ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী
লোক।
এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই
ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে
যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের
নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।
তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী
পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের
ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে
এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই
এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা
পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা
কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।
আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম।
সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা
দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের
একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায়
যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে
আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব
দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে
প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।
ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক
তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের
ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর
এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।
তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের
মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার
মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের
আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে
বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।
তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে
এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক
হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।