ইনসাইড থট

জাসদের কঙ্কালসারশূন্য দেহাবশেষ!

প্রকাশ: ০১:০২ পিএম, ২৩ জানুয়ারী, ২০২৩


Thumbnail

রাজনীতিতে নানা পথ অবলম্বন করেন নেতারা। তারা বেছে নেন উদারপন্থা, মধ্যপন্থা কট্টরপন্থা। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লিখিত তিনটি পন্থারই প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য কোন পন্থা কী পরিণতি বয়ে এনেছে, সে দিকে চোখ রাখা যেতে পারে।

প্রথমেই কট্টরপন্থা নিয়ে পথচলা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কথা বলছি। জাসদ ছাত্রলীগের একটি প্রশাখা।   মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক সিরাজুল আলম খানের তন্ত্রমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ডাকসু ভিপি আবদুর রব, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ শরীফ নূরুল আম্বিয়া সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার গঠন করে দেশেবৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকায়েমের আহ্বান জানান। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মুজিব বাহিনীর আরেক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশনায় ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ডাকসু জি এস আবদুল কুদ্দুস মাখন ইসমত কাদির গামা দাবি করেন, দেশ পরিচালিত হতে হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে।

তারা জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রকেমুজিববাদবলে আখ্যা দেন। ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই শেখ মণিপন্থি ছাত্রলীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং সিরাজুল আলম খানপন্থি ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে সম্মেলন ডাকে। উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করে। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন শেখ মণিপন্থি ছাত্রলীগের সম্মেলনে।

ফলে সিরাজুল আলম খান গ্রুপ ভিন্ন পথে তাদের রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ছাত্রলীগের উচ্চাকাক্সক্ষী, মেধাবী, প্রতিভাবান, কট্টরপন্থি বিপ্লবী বলে পরিচিত অংশটি জাসদে শামিল হয়। কাজী আরেফ আহমেদ, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু, খলীকুজ্জমান, নূরুল আলম জিকু, বি এম গোলাম মোস্তফা, শাজাহান খান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, বি এম শাজাহান, জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ উদীয়মান নেতারাও জাসদের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হন। রোমান্টিসিজম আদর্শিক ভাবালুলতা, মাঠ গরম করা বিপ্লবী বক্তৃতা-বিবৃতি রাতারাতি জাসদকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়।কিন্তু অচিরেই নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা হঠকারিতায় বিপর্যয়ের সম্মুখীনও হয় দলটি।

১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাসদ প্রথম কাউন্সিল করে। মেজর এম জলিল সভাপতি, আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাসদ ঘোষণাপত্রে বলে, ‘প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব নয়। শ্রেণিসংগ্রাম সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্রকে আইনের মাধ্যমে কার্যকর করতে গেলে শোষক সম্প্রদায়কে উৎখাত করা যায় না। শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির জঙ্গি ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন। নির্বাচন সাধারণ মানুষকে ঠকানোর বুদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। ভোট দেওয়ার যে রীতি তা হলো, মানুষের বিক্ষুব্ধ মনকে দমিয়ে দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। নির্বাচনে মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তি কোনো দিন আসে না।আশ্চর্যের বিষয় ঘোষণাপত্রের এসব নীতিনৈতিকতা জলাঞ্জলি দিল ১৯৭৩ সালের মার্চের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই। তারা অংশ নিল। আবদুর রব এম আউয়াল ঢাকার সংসদীয় আসনে জাতির পিতার বিরুদ্ধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। তারা জামানতও হারালেন। জিঘাংসা এতটাই ভয়ংকর যে, ছাত্রলীগের এই দুই সাধারণ সম্পাদক এম আউয়াল, রব রাতারাতি জাতির পিতার সুদীর্ঘকালের অপরিসীম স্নেহ-ভালোবাসার কথা অবলীলায় ভুলে যেতে পেরেছেন।

জাসদ সরকারের মোকাবিলায় সশস্ত্র গোপন পন্থা অবলম্বন করে প্রকারান্তরে আত্মাহুতির পথ বেছে নিয়েছিল। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জাসদ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনের প্রতিও সম্মান দেখানোর কথা ভুলে যায়। তারা জন্য ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিলের মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের জের ধরে জাসদ কার্যত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। নেতাদের নিক্ষিপ্ত হতে হয় কারাগারে। জাসদের সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রকাশও ছিল একটা চরমপন্থা। দলের কর্মীরা আত্মঘাতী অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। তারা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান। জাসদ গণবাহিনীর সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের প্রকাশ্য ঘোষণায় যুক্ত হয় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, নিষিদ্ধ ঘোষিত মাওবাদী বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিও। দেশের থানা, ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট আর রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জাসদের সংঘর্ষের খবর, আওয়ামী লীগের পাঁচজন সংসদ সদস্য হত্যা প্রভৃতি ঘটনাই বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয় বিপ্লবেরবাকশালকর্মসূচি দিতে বাধ্য করেছিল। জাসদের আরেকটি হীনমন্যতা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। প্রথম বিজয় দিবসে রাজধানীতে নাশকতার হুংকার দেয় সর্বহারা পার্টি। অন্তরালে জাসদ। টহলরত পুলিশের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে পুলিশের গুলিতে আহত হন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের শিরোনাম করা হলো, ‘ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল পুলিশের গুলিতে আহত সম্পূর্ণ বানোয়াট মিথ্যা খবরটি প্রচার করে জাসদ চরম এক অসভ্যতার নজির স্থাপন করেছিল। জাসদের বঙ্গবন্ধুকে অস্ত্রবলে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার দিবাস্বপ্নটিকে মনে হয় ছোট্টবেলারডাকাত-পুলিশখেলা। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল জাসদের কারণেই। দলটির কারণেই দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সম্মুখীন হন। এক কথায় জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ প্রশস্ত করে দেয়। ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে, জাসদের ভ্রান্ত রাজনীতির মোহে পড়ে স্বাধীনতা-উত্তর সম্ভাবনাময় দুটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে।

দলটির উদ্ভট ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে স্বাধীনতার মূল্যবোধ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ হয়েছে। নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি বিপ্লব ছিল জাতির জন্য এক অভিশাপ বার্তা। জাসদের গণবাহিনী কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটায়। কিন্তু জিয়াকে দিয়ে ক্ষমতা দখলের অভিসন্ধিও নস্যাৎ হয়ে যায়। জাসদ ক্ষমতা দখলের জন্য জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমসহ তার সঙ্গীদের হত্যা করে। জেনারেল জিয়ার চরম বিশ্বাসঘাতকতায় কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।

জাসদ সভাপতি মেজর এম জলিলের হয় যাবজ্জীবন। সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবের ১০ বছর, হাসানুল হক ইনুর সাত বছর, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও অনেক জাসদ নেতাকে দন্ডিত হতে হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ডে। পরবর্তীতে জাসদের এসব নেতা জিয়ার অনুকম্পায় মুক্তি পেলেও নিজেদের বিবাদ-বিগ্রহে দলীয়ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। হায়! জাসদ ভেঙে জাসদ (আউয়াল), জাসদ (রব), জাসদ (সিরাজ), জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), বাসদ (মাহবুব), বাসদ (খলিকুজ্জামান) আরও কত কী। মাহমুদুর রহমান মান্নারা তো জাসদ নামই পরিহার করে ভিন্ন পথে চলছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গণবাহিনীরও অস্তিত্ব নেই। জাসদ (ইনু) সমর্থিত ছাত্রলীগেরও বিকাশ নেই। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব একখানা ছাত্র সংগঠন মাত্র। জাসদের বহু নেতা এখন বিএনপি-আওয়ামী লীগে। জাতীয় পার্টিতেও আছেন-যারা মন্ত্রিত্বের টোপ গিলে এরশাদের চামচা বনে যান। জাসদ সভাপতি এম জলিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র চুলোয় দিয়ে শেষ জীবনে ইসলামিক মুক্তি দল করেছিলেন।

শাজাহান সিরাজ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাসদ থেকে জয়ী হয়ে বিএনপিতে দলবলসহ বিলীন হয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী হন। অবশ্য ২০০১ সালে ধানের শীষ নিয়ে জয়ী হওয়ার পর পূর্ণমন্ত্রী হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বিএনপিতে ছিলেন অগাছা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের মন্ত্রিসভার সদস্য হন আবদুর রব। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর বন্দনা করতেন। কিন্তু ভোল পাল্টে এখন শেখ হাসিনা-বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর কথা উচ্চারণই করেন না। আবদুর রব ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলে পরিচিত হন। জাসদের কার্যকর নেতা বলতে এখন হাসানুল হক ইনুকে বোঝায়। তাঁর নেতৃত্বাধীন জাসদ আওয়ামী লীগের ১৪ দলে রয়েছে। তিনি তথ্যমন্ত্রী ছিলেন। নিজ দলের প্রতীকে ঝুঁকি নেননি। নৌকা প্রতীকেই বারবার বিজয়ী হন। হাসানুল হক ইনুর দলেও উপদলীয় বিবাদ বিগ্রহ রয়েছে। রব, সিরাজ, ইনুরা যাদের অনুকম্পায় মন্ত্রিত্ব করেন তাদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত বৈপরীত্য কোথায় গেল? জাসদের কঙ্কালসারশূন্য দেহবল্লরীতে নেই যৌবন। পড়ে আছে যেন দেহাবশেষ।

এবার আলোচনা করব রাজনীতির আরেকটি পথ নিয়ে। সেটি হলো- সার্বভৌম কর্তৃত্ব করা। সার্বভৌম নেতা একাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিম্নস্থদের ওপর চাপিয়ে দেন। নিম্নস্থদের মতামত জানতে চান না। কারণে যে, অবচেতন মনে নেতা আশঙ্কা করেন, নিম্নস্থ ন্যায্য কথা বলছেন, যা তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এমনকি সম্মানহানিকর। নেতার এসব একাধিপত্য বেশি দিন টেকে না। অল্প সময় দলের কর্মীরা কপট আনুগত্য দেখায়, তবে অচিরেই দলে বিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রতিভাবান কর্মীরা কর্মকান্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, আর যারা লোভী তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। ফলে দলে কোন্দল দ্বন্দ্বের মুখে স্থবিরতা নেমে আসে। এতে সার্বভৌম নেতার কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। যার ফল ভোগ করে কর্মীরা।

প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রের মতো পূর্ববাংলায় আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ১৯৫৪-এর নির্বাচন মানে হক-শহীদ-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বোঝাত। অথচ বিস্ময়কর যে, ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রার্থী হননি। যুক্তফ্রন্টের রূপরেখায় তিন নেতার সিদ্ধান্ত ছিল-নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে পূর্ববাংলার আইন পরিষদের নেতা হবেন শেরেবাংলা কে ফজলুল হক এবং পাকিস্তান গণপরিষদ নেতা হবেন সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর উদার পন্থা গ্রহণ ছিল একটি দৃষ্টান্ত। ১৪৩টি আসন পেয়েও আওয়ামী লীগ শেরেবাংলা কে ফজলুল হককে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়। অবশ্য নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। মার্কিনিদের সঙ্গে সিয়াটো চুক্তিতে আওয়ামী লীগ পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবার কী, আমিই আওয়ামী লীগ- আমিই মেনিফেস্টো।আওয়ামী লীগে তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র ছিল যে, সোহরাওয়ার্দীর অতি অনুগত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও নেতার বক্তব্য সমর্থন করেননি, বরং তিনি মর্মাহত হন। কট্টরপন্থি সোহরাওয়ার্দী সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট শুধু ভাঙেনি, আওয়ামী লীগও কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে ভেঙে যায়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) একটা পর্যায়ে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হারাতে হয়। নেতা-কর্মীদের জীবনে নেমে আসে চরম নিপীড়ন নির্যাতন। তার আগে নেতৃত্বের দ্বিতীয় প্রণালিটির কথা উল্লেখ করছি। এটি হলো, হিমশীতল, যন্ত্রবৎ, নিয়মানুবর্তী কর্মিপন্থা। অথচ হিমশীতল নিস্পৃহ পদ্ধতিতে কর্মনিপুণতা আনার চেষ্টা যথাযথ নয়। যেসবমেশিনশাসক বা নেতার অধীনে কাজ করে তারা নিজেদের সম্পূর্ণ কর্মদক্ষতা প্রয়োগ করে না। এই পথ অবলম্বনকারীরা আক্ষরিক অর্থে পুস্তিকার আলোকে পথ চলেন। প্রতিটি প্রণালি সাধারণ বিষয়গুলোর জন্য পথনির্দেশ মাত্র-এটা তারা বুঝতে চান না। বিশ্লেষকদের মতে, নেতারা সাধারণ মানুষকে যন্ত্র মনে করেন। আর মানুষ যেসব জিনিস ঘোর অপছন্দ করে তার মধ্যে একটা হলো যন্ত্রের মতো আচরণ। আর তৃতীয় পন্থা অবলম্বনকারী হলেন, ‘মানবিক বোধসম্পন্ন নেতা’-যিনি শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারেন। নেতৃস্থানীয় বলতে বোঝায় প্রচন্ড ব্যস্ত নেতা। নেতৃস্থানীয়রা কর্মযুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়ান। তবে নেতৃস্থানীয়রা কিন্তু বেশ খানিকটা সময় কাটান, যখন তাদের একমাত্র সঙ্গী হয় ভাবনাচিন্তা। বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষরা, প্রত্যেকেই বেশ খানিকটা সময় একা থাকতেন। অনেক নেতার মধ্যেই এভাবে উদারতার সৃষ্টি হয়, হয়ে ওঠেন মধ্যপন্থি। মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিশু, বুদ্ধ, কনফিউসিয়াস জীবনের ঘোরপ্যাঁচ থেকে দূরে একা নিজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তাঁরা একাকীত্বে পেয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা, চিন্তার গভীরতা।

ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পোলিও আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠার সময় যদি একা না থাকতেন, তাহলে আদৌ নিজের অসাধারণ নেতৃত্বের ক্ষমতা বিকশিত করতে পারতেন কি না সন্দেহ।

হ্যারি ট্রুম্যান দীর্ঘ সময় মিসোরিতে একাকী কাটিয়েছেন। অ্যাডলফ হিটলার বেশ কিছু বছর জেলজীবন কাটিয়ে ছিলেন বলেই ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। এই জেলে বসেই কুখ্যাতমাই কেম্ফলেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, যাতে বিশ্বজয়ের কূটকৌশলের উল্লেখ ছিল এবং জার্মানরা যার অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কট্টরপন্থা তাঁকে ধ্বংস করে। কমিউনিজমের কূটনীতিতে সুদক্ষ লেনিন, স্ট্যালিন, মার্কস সব নেতা জেলে বসেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে তৈরি করার সুযোগ পান। মহাত্মা গান্ধী একাকীত্বের কারণেই তাঁর ভিতরে অহিংসবাদী চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। একইভাবে নেলসন ম্যান্ডেলাও বিকশিত হন জেলবন্দি হয়ে। যেমন দীর্ঘ কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুও বিকশিত হয়েছেন।  

মানবিক পন্থা অনুসরণ করে সুদক্ষ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সুফলও উপভোগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মানবিকতাবোধের পরিণাম প্রশংসনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধুকে গোপনেও নিন্দা করা হতো না। তিনি নিজের অধীনস্থদের কাজে বেশি নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। যে কারণে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতে সহকর্মীরা একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেশে ফিরে কর্মযজ্ঞেও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চিরবন্ধুর পথ পরিহার করে যখনই সার্বভৌম ক্ষমতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্রত হলেন, তখনই নিজ দলের মধ্যেই সহকর্মীরা অনেকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হলো।   সেই ষড়যন্ত্রের কুৎসিত চেহারা ফুটে ওঠে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা গোটা বাঙালি জাতির জন্য মহা ট্র্যাজেডি। মোশতাকের পতনের পর আওয়ামী লীগের পুনর্জীবনের মাধ্যমেবাকশাল’-কে না বলার মধ্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছিল, যেসার্বভৌম কর্তৃত্বপন্থা অবলম্বন সঠিক ছিল না। খুনি মোশতাকও ১৫ দিনের মাথায় বাকশাল আদেশ বাতিল করে সার্বভৌম ক্ষমতার পথ এড়িয়ে চলছিলেন।

হিমশীতল যন্ত্রবৎ নিয়মানুবর্তী কর্মিপন্থা অনুসরণকারী মানে কমিউনিস্ট পন্থা। এটার প্রতিও মানুষের আস্থা সৃষ্টি হয়নি।

সংসদের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সংসদীয় পদ্ধতির মধ্যে নিহিত। সংসদ সার্বভৌম অর্থ প্রকারান্তরে জনগণই সার্বভৌম। সেই সংসদের প্রধান নেতা নিঃসন্দেহে সর্বদিক দিয়ে প্রশংসনীয়।   কিন্তু সদস্যরা কতটা মানবিকতাবোধ সম্পন্ন এবং এর সংখ্যা কত সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা শতভাগ। আর সেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া খুবই কঠিন। তবে হাঁটি হাঁটি করে গণতন্ত্রের জন্যই হাঁটছে বাংলাদেশ। অবিরাম হাঁটার কারণেই এবং জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বদৌলতেই শেকড় থেকে শিখরে-অগ্রসরমান সমুজ্জ্বল বাংলাদেশ।          

সোহেল সানিলেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক  কলামিস্ট।



মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘আসিফ নজরুল একজন কাঁচা মানের বুদ্ধিজীবী’


Thumbnail

এদেশে বিএনপির বুদ্ধিজীবীদের প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে বেশ পছন্দ করি। দুটি কারণে আমি তাকে পছন্দ করি।

একটি কারণ হচ্ছে তার ব্যবহার খুবই ভাল। বয়সের বিবেচনায় আমার ছোট বলে তিনি যেভাবে কথাবার্তা বলেন তাতে আমার মনে হয় যে একজন ছোট ভাই আমার সাথে কথা বলছে। আরেকটি কারণে তাকে পছন্দ করি। সেটা হল তিনি তার লেখাতে কোন রাখঢাক করেন না। তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেটাই করেন এবং তিনি যে বিএনপির একজন খাঁটি বুদ্ধিজীবী নেতা এটা বোঝা যায়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অধ্যাপনা সেটা কেবল পরিচয়ের কারণে। তার আসল কাজ হচ্ছে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসাবে কাজ করা।

বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার কাজ মূলত ২টি। প্রথমত বিএনপিকে কি করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ দেয়া এবং দ্বিতীয়ত বিএনপিকে কিভাবে উপরে তোলা যায় এবং আওয়ামী লীগকে কিভাবে নিচে নামানো যায় সেটি জনগনকে প্রচার করা। কিন্তু সম্প্রতি তার একটি ফেসবুক পোস্ট আমার নজরে আসে এবং তাতে তার সম্বন্ধে আমার যে ধারনা ছিল সেটি সেটু ভুল প্রমাণিত হল। তাকে একজন বড় মাপের বুদ্ধিজীবী মনে করলেও এখন মনে হচ্চে তিনি একজন কাঁচা মানে বুদ্ধিজীবী। ফেসবুক পোস্ট আসিফ নজরুল লিখেছেন, ৭ জানুয়ারি দেশে কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। এটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে তার ডামি প্রার্থী বা অনুগত দলগুলোর প্রার্থীদের নির্বাচন। কাজেই এটিকে নির্বাচন না বলে একদলীয় নির্বাচন বলা যেতে পারে।

কিন্তু জাতীয় পার্টি এতদিন ধরে বিরোধী দলে থাকলো সেটি নিয়ে আসিফ নজরুল কোন লেখা লিখলেন না। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল হিসেবে সর্বজন গৃহীত হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এটি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি। এছাড়া শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির অনেক নেতাও নির্বাচন করছে এবং এর বাইরে ১৪ দল সহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে আসছে। এখানে শুধু আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের নির্বাচন হচ্ছে এমনটি ভাবার কোন কারন নেই।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র। কারন তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনেই ছিল। আমি দুইবার নির্বাচিত সিনেট সদস্য ছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ডিন ছিলাম। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার নারীর সম্পর্ক। সেই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি খুবই মর্মাহত যে, এখন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাড়াটিয়াদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়? যারা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কথা বলবে? এদের মত শিক্ষকদের জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বে লিডিং ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে থাকতে পারে না। এদের দ্বারা যারা ভবিষ্যতে শিক্ষিত হবে তারা আসলে কি শিখবে? তারাতো আরও নিন্মগামী হবে। এসব শিক্ষকরা টাকার জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও লেকচার দেন। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু টাকার বিনিময়ে একজন শিক্ষক কোন রাজনৈতিক দলের ভাড়া খাটবেন এটা মানা যায় না। আমি নিজেও জীবনে অনেকটা সময় শিক্ষকতা করেছি। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছি এবং আমি নিজেও একজন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি। কিন্তু তারা এত তারাতারি কিভাবে পচে গেলেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আসিফ নজরুলের মত এমন বেশকিছু বুদ্ধিজীবী যাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক রয়েছে, কিছু মিডিয়ার পণ্ডিত আছেন এবং অন্য পেশার অনেকে আছেন যারা বিদেশিদের টাকায়, লন্ডনের টাকায় তাদের বুদ্ধি বিক্রি করছেন। আমার মতে ওনাদের মধ্যে এবং টাকার জন্য যারা অন্যের বিছানায় যায়, তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বরং যারা বুদ্ধি বিক্রি করে তারা আরও নিকৃষ্ট এ কারনে যে তারা দেশের মানুষের সাথে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করছে। তারা দেশকে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যতই আন্তর্জাতিক চাপ আসুক না কেন এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে। অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে। নির্বাচনকে যারা বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করবে এবং নির্বাচন নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়াবে তারা দেশের শত্রু, জনগনের শত্রু এবং গণতন্ত্রের শত্রু। 


বুদ্ধিজীবী   আসিফ নজরুল  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

কিসিঞ্জারহীন পৃথিবী ও শতবর্ষী বাংলাদেশের স্বপ্ন


Thumbnail

কিসিঞ্জার কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’-র এই বাংলাদেশ যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সত্যিই ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখন কিসিঞ্জারের চোখে তা আর ধরা পড়েনি! ৯৬ বছর বয়সী কিসিঞ্জার ২০১৯ সালের নভেম্বরে চীন সফর করেন কারণ তখনও তাঁর আরাধ্য চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়ন। অথচ এই এশিয়ারই আর এক দেশ কিসিঞ্জারের শত বাধা সত্ত্বেও যখন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তখন থেকেই বাংলাদেশ তাঁর ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ আর কৌতুকের বিষয় ছিল। এদের কুশিলবী ষড়যন্ত্রের কৌশলে বাংলাদেশ তার জাতির পিতাকে হারায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট। বিস্ময়ের কোন কারণ ছিল না যখন ১৬ অগাস্ট সকালে কিসিঞ্জার তার দপ্তরে বসে খুবই নির্লিপ্ত কণ্ঠে তাঁর সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন, “বাংলাদেশ সম্পর্কে আলাপ শুরু কর, কী হয়েছে সেখানে”?

২০১৬ সাল থেকে আমি, শহীদ সন্তান তৌহিদ রেজা নুর ও সাংবাদিক ফারজানা রূপা আমাদের দীর্ঘ পরিকল্পনা অনুসরণ করে কিসিঞ্জারের সাথে দেখা করার চেষ্টা করছিলাম; আমি তাঁর অফিসের সাথে বেশ কিছু ই-মেইল যোগাযোগ করেছি। তাঁর নির্বাহী সহকারী কুর্টনি গ্লিক আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কিসিঞ্জার দেখা করতে রাজি হয়েছেন কিন্তু আমাদের প্রথমে প্রশ্ন শেয়ার করতে হবে। এই বিষয়ে আমরা গ্যারি বাসের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছিলাম যিনি প্রিন্সটনের একজন অধ্যাপক The Blood Telegram: Nixon, Kissinger, and a Forgotten Genocideবইয়ের লেখক। অবশেষে আমাদের প্রশ্ন ছিল একটি লাইন- ‘ডক্টর কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত কিনা’। যদিও আমাদের বলা হয়েছিল যে তিনি আমাদের সাথে দেখা করতে পারেন কিন্তু তাঁর ব্যস্ততার অজুহাতে সেই প্রশ্নের উত্তর নিতে সাক্ষাৎ আর হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সুযোগ এখন চলে গেছে।

একবার নাটকীয়ভাবে তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছিল তাঁর সচিবের সদয় সহযোগিতায়। কুর্টনি গ্লিক আমাকে জানিয়েছিলেন যে আমি দেখা করতে পারি কিন্তু সেই পরিবেশে আমার সেই বিশেষ প্রশ্ন করা উচিত হবে না। আমি দেখা করার এই সুযোগটি ব্যবহার করতে রাজি হ এবং জানতে পারি যে ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের কেন্ট মেমোরিয়াল লাইব্রেরীর রিডিং রুমে “Kissinger on Kissinger: Reflections on Diplomacy, Grand Strategy and Leadership”- বইয়ে স্বাক্ষর দিতে কিসিঞ্জার ঘন্টা দেড়-দুই অবস্থান করবেন। তাঁর সচিবের কাছ থেকে এই সংবাদ ও ঠিকানা পেয়ে আমি আমার গবেষণা কর্মস্থল ওয়াহোর কলম্বাস থেকে সেখানে তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলাম। আমার উদ্দেশ্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি এসে ও বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী সামনে রেখে তাঁর কাছ থেকে বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু মতামত সংগ্রহ করা। এই সাক্ষাতে কিসিঞ্জার আমার প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর না দিয়ে কৌশিক বসুর লেখা পড়েছি কিনা জানতে চান ও সেদিন ব্যস্ততার অজুহাতে পরে আবার যোগাযোগ করতে বলেন।

এই কূট-কৌশলী উত্তরের মধ্যে সেই দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে কিসিঞ্জারের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও তাঁর সাথে আমার সাক্ষাতের মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হয়নি ও আরও সাক্ষাতের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল কিন্তু আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের অগ্রগতির সব খবর তিনি রাখতন। আমি অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বাংলাদেশ বিষয়ে রচনা-মন্তব্য ও বিশ্লেষণের সাথে পরিচিত ছিলাম ফলে ১৯৭১ সালে আমাদের আশা আকাঙ্খার প্রতিরোধক ও ’৭৫-এর ঘটনাবলীর জন্যে অভিযুক্ত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের ক্রীড়ণক এইসব কূটনীতিকদের বিদ্রূপ অতিক্রম করে বাংলাদেশ কেমন করে এই অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের দেশ হলো তা আমাদের ভালো করে অনুধাবন করা দরকার বলে মনে করছি।

সেই অনুধাবনের পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের দিকে। আমরা সকলেই জানি ১৯৭১ সালে গোপনে চীন সফর করে কিসিঞ্জার চীনের সাথে নিক্সন সরকার তথা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ শুরু করেন যা তাঁর কূটনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বলা বাহুল্য চীনের সাথে সেই সম্পর্কের নানারকম টানাপোড়েনে হোয়াইট হাউস তাঁকেই সবার আগে স্মরণ করেএমন কি ৯৬ বছর বয়সে চীন সফর করে চীনা প্রেসিডেন্টের এই ঐতিহাসিক মন্তব্যও কিসিঞ্জার অর্জন করেন, Xi appreciated the sincere feelings and positive efforts Kissinger devoted to promoting the development of Sino-U.S. relations over the decades, saying that Kissinger will be remembered for his important contributions in history” (জিনহুয়া, ২২ নভেম্বর ২০১৯)।

বাংলাদেশের ইতিহাসও কিসিঞ্জারকে স্মরণ করবে তাঁর হঠকারী ভূমিকার জন্যে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে চীনও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এমনকি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পেতেও ভূমিকা রেখেছে। সেসব ভূমিকাই পোক্ত হয়েছিল ’৭১ সালে কিসিঞ্জারের চীন সফরের মধ্য দিয়ে কারণ পাকিস্তান তখন চীন বলয়ের মধ্যে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিল। এই দুই পরাশক্তির সন্ধির উদ্দেশ্য মূলত ছিল ভারত-রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের শক্তি জোরদার করা কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ তাদের সকল শক্তি সমাবেশ প্রক্রিয়া সত্ত্বেও চূড়ান্ত রূপ লাভ করে নতুন মানচিত্র অর্জন করে, চীন-মার্কিন-পাকিস্তানী আঁতাত তা ভুলে গেছে বা সে শক্তি ইতিহাস হয়ে গেছে মনে করা আমাদের কিছুতেই উচিত হবে না।

ফলে আজ যে উন্নয়ন কাঠামোয় বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ সেই চ্যালেঞ্জকেই মোকাবেলা করতে হবে যার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৭১ সালে নানারকম আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কূটকৌশলের রাজনীতির মাধ্যমে। যারা দেখছেন বাংলাদেশের উন্নয়নের গতি উর্ধমুখী, তাদের চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক কেমন করে একে থামিয়ে দেয়া যায় বা শ্লথ করা যায়। একই কাজ তারা করেছিল ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে। ফলে এখন সে ষড়যন্ত্র থেমে গেছে এটা ভাবা কিছুতেই উচিত নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত এই সবই একই সূত্রে গাঁথা। গত এক দশকে নানারকম পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে এই সরকারের অগ্রগতি ও তাঁর নেতৃত্বের সাফল্যকে ম্লান করে দেবার জন্যে। কিন্তু কিছুই যখন সফল হয়নি তখন আমাদেরও আত্মপ্রসাদের সুযোগ নেই, বাংলাদেশের যুগান্তরের ইতিহাস বলে তাকে চিরকাল বাধা অতিক্রম করেই এগুতে হয়েছে।

এখন আমাদের প্রজন্মান্তর বিকাশের কৌশল ঠিক করে নেয়া দরকার। আমরা যারা জীবনের ছয় দশক পার হয়ে এসেছি তখন আমাদের পেছনে রয়েছে কুড়ি থেকে ষাট বয়সের চার চারটি দশকের প্রজন্ম। যদি মনে মনে ভাবি কী রেখে যাচ্ছি তখন নিজের অবদান অতি সামান্য হলেও আমাদের সামগ্রিক অবদান মোটেই সামান্য নয়। কিন্তু আজ যে কুড়ি বছর বয়সী তাঁর যখন চল্লিশ বছর পরে ষাট হবে তখন তাঁর নিজের ও সামগ্রিক অর্জন সে কী দেখবে? সে পথ কি আমরা তৈরি করে রেখে যাচ্ছি যে পথ পাড়ি দিয়ে সে স্বাধীনতার শতবর্ষে পা দেবে?

আমাদের ভাবতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে, এসবের মান তখন কী দাঁড়াবে? আমাদের প্রশাসন কেমন হবে? আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা, ইতিহাস অনুশীলন ও নেতৃত্বদানের কৌশল কতোটা মানবিক হবে? আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালী, পরিবেশ-প্রতিবেশের সুরক্ষা ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ কতোটা আধুনিক হয়েছে? বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার এই বাংলাদেশ তখন ইতিহাসের যে প্রান্তে পৌঁছে যাবে তাঁর সংস্কৃতি কতোটা নদী-মাতৃক থাকবে? কৌশিক বসু লিখেছেন, “To what does Bangladesh owe its quiet transformation? As with all large-scale historical phenomena, there can be no certain answers, only clues” – (Why Is Bangladesh Booming? Project syndicate প্রকাশনা, ২৩ এপ্রিল ২০১৮)

সে সুত্রগুলো নিয়ে একদিন অবশ্যই গবেষণা হবে, উত্তরও খুঁজে নেয়া হবে, কিন্তু আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ পেয়েছি, আজ আমরা যারা শেখ হাসিনাকে দেখতে পাই – তাঁদের কেউই হয়তো শতবর্ষের বাংলাদেশে থাকবো না, কিন্তু আমরা তো স্বপ্ন দেখতেই পারি সেই বাংলাদেশ, যে ইতিহাস অর্থনীতির সকল সূত্র প্রমাণ করে বিশ্ব-জগতে নতুন এক মানবিক ইতিহাস তৈরি করেছে, সকল মুক্তিকামী দেশ ও সেসব দেশের মানুষ বাংলাদেশকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।                        

রেজা সেলিম, পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প

ই-মেইলঃ rezasalimag@gmail.com


কিসিঞ্জারহীন পৃথিবী   বাংলাদেশ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

পার্বত্য এলাকায় শান্তিচুক্তির প্রভাব

প্রকাশ: ১২:০৩ পিএম, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৩


Thumbnail

পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পার্বত্য শান্তিচুক্তির প্রভাব বিশ্ববাসীর কাছে একটি বিরল ঘটনা।জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম : শান্তির অন্বেষায়’ প্রবন্ধে ১৯৯৮ সালে লিখেছেন, ‘পাহাড়ে বসবাসকারী কি পাহাড়ি কি বাঙালি সকলেই দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। শান্তি স্থায়ী করতে হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করতে হবে।... শিক্ষায় স্বাস্থ্যকর্মে উন্নত সমাজ গড়তে পারলেই স্থায়ী শান্তি স্থাপন হবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিই হচ্ছে শান্তির পক্ষে। সকলেই শান্তি চায়।’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-১, পৃ ২৩৯) শান্তির এই প্রত্যয়কে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় ধারণ করে শেখ হাসিনার উদ্যোগে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পার্বত্য সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। সেসময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য অন্যান্য স্থান থেকে মানুষ স্থানান্তর করেন। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল অগ্রহণযোগ্য। তৎকালীন সরকারি প্রশাসন সমতল জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের নদীভাঙ্গা ভূমিহীন, দিনমজুর, অসহায় দুস্থ পরিবারগুলোকে এনে সরকারি খাস ভূমিতে পুনর্বাসন করে। এই পুনর্বাসনের কয়েক বছর যেতে না যেতেই শান্তিবাহিনী নামক উপজাতীয় গেরিলারা সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে পুনর্বাসিত বাঙালিদের উপর হামলা চালায়। বাঙালি হত্যা ও নিপীড়ন মাত্রা অতিক্রম করে। সুরক্ষিত ওই অঞ্চলে ভারতের জঙ্গিরা সহায়তা করত শান্তিবাহিনীদের। সেখানে বাংলাদেশ সরকারের জড়িত হওয়াটা ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়েছে দৃঢ়চিত্তে। ১৯৯৭ সালের আগে ৬ জন তরুণ অফিসার, ১ মেজর, ৩ ক্যাপ্টেন ও ২ লেফটেন্যান্টসহ ৩১২ জন সৈনিক পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার কিলোমিটার রাস্তার অর্ধেকের বেশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক নির্মিত। নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ-বিদেশী হাজার হাজার পর্যটক বান্দরবানের নীলগিরিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যেসব স্পটে ছুটে যান তার পুরো অবদানটাই সেনাবাহিনীর। নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ ও রাস্তা নির্মাণ না করা হলে রাত্রিযাপন করে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করা দূরের কথা, সেখানে কেউ যাওয়ার কল্পনাও করতেন না। বর্তমানে অপহরণ একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারতের সঙ্গে পুনরায় সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে চট্টগ্রামের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমাপ্তি ঘটে।    

শান্তি চুক্তি ২৭ বছরে পদাপর্ণ করেছে। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি-পাহাড়িদের সঙ্গে বাঙালি ও সরকারি বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধ এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৬ বছর আগে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিষিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছিল। দুই দশক স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চাকা বন্ধ ছিল। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় পার্বত্য এলাকা তার স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়; সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন হিসেবে গণ্য হয়। এ কারণে শেখ হাসিনার ইউনেস্কো পুরস্কার প্রাপ্তি ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য অবদানের স্বীকৃতি। চুক্তির পর পুরো পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সুষ্ঠু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশ যথেষ্ট বেগবান হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৬ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সফলভাবে পরিচালনার উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত থেকে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অপরিহার্যতা লক্ষ করা যায়। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। একসময় শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে উপস্থিত হয়ে বলেছিলেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তাঁর সরকার। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বব্যাপী সচেতন মানুষ আজ জানতে পেরেছে শান্তি, গণতন্ত্র, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতা ও অবদানের কথা। ‘কাউন্টার টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা স্মরণ করা হচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে। শান্তি ও উন্নয়নের মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে তুলে ধরার মধ্যে আমাদের নেতৃত্বের সাফল্য গুরুত্বের সঙ্গে যুদ্ধ সংকটের মধ্যেও উপস্থাপিত হচ্ছে দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে। অন্যদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে গত কয়েক বছর জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে। সেখানে স্বল্পোন্নত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের প্রসঙ্গ জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়। এজন্য দারিদ্র্য বিমোচনে উন্নত বিশ্বের আর্থিক প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার উপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্বশান্তির জন্য এখন প্রয়োজন অর্থনৈতিক মন্দা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভবিষ্যৎ-প্রসারী ও প্রজ্ঞাময় কর্মসূচি প্রণয়ন যা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎসরূপে গণ্য হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার পক্ষ থেকে প্রায় বলা হয়, ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পরে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার ৩ বছর ৮ মাস ক্ষমতায় থাকাকালে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন; আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; ভারত থেকে জুম্ম শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন, চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি ও ভূমি টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর ব্যতীত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে একটানা সাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার কালে জুম চাষ, মাধ্যমিক শিক্ষা, জন্ম-মৃত্যু ও অন্যান্য পরিসংখ্যান, মহাজনী কারবার ও পর্যটন- এ পাঁচটি বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়েছে। সন্তু লারমার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এসব হস্তান্তরকরণ যথাযথভাবে হয়নি, আংশিক বা ত্রুটিপূর্ণভাবে হয়েছে। এমনকি রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্যবাসীর মতামত ও স্বার্থকে পদদলিত করে। এছাড়া তিনি তিন জেলায় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় ভূমি আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছিলেন। সেখানকার উপজাতি নারীদের উপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে জানিয়েছিলেন। 

লেখাবাহুল্য, ২০১৩ সালে সন্তু লারমা এক সংবাদ সম্মেলন করে পার্বত্য এলাকায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের বিরোধিতা করেছিলেন। যদিও সেই বিরোধিতা টেকেনি। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি দাবিতে রাজধানীর এক হোটেলে ওই বছর ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্বত্যবাসী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের জন্য এখনো প্রস্তুত নয়। এগুলো বহিরাগত অনুপ্রবেশের দ্বারে পরিণত হবে। তাই চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যন্ত এসব প্রকল্প স্থগিত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।’ উপরন্তু দেশের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাহাড়ি ছাত্রছাত্রীদের অধিকসংখ্যক কোটা সংরক্ষণের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

তাঁর কথার সূত্র ধরে বলা দরকার, পার্বত্য এলাকার বেশির ভাগ উপজাতি জনগোষ্ঠী কোটা সুবিধা গ্রহণ করে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, অনেক সরকারি অফিসে উচ্চ পদে আসীন হয়েছেন। এ কারণে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সমতলবাসীদের তরফ থেকে এই কোটা সুবিধা বাতিলের কিংবা কমানোর যে দাবি উঠেছিল তা অযৌক্তিক নয়। ২০১৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সফরের সময় জনসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই এর পক্ষে-বিপক্ষে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। অথচ পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, অনুন্নত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী পাস করে আওয়ামী লীগ ’৭২-এর সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। সকল ধর্মের সমান অধিকার এবং দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-জাতিগোষ্ঠী ও উপজাতিদের অধিকার ও মর্যাদার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ধর্মীয় ও নৃ-জাতিসত্তাগত সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান এবং তাদের জীবন, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দৃঢ়ভাবে সমুন্নত থাকবে। অনগ্রসর ও অনুন্নত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সন্তানদের শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা এবং সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত থাকবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির অবশিষ্ট অঙ্গীকার ও ধারাসমূহ বাস্তবায়িত করা হবে। পার্বত্য জেলাগুলোর উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হবে এবং তিন পার্বত্য জেলার ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখা, বনাঞ্চল, নদী-জলাশয়, প্রাণিসম্পদ এবং গিরিশৃঙ্গগুলোর সৌন্দর্য সংরক্ষণ করে তোলা হবে। এই তিন জেলায় পর্যটন শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।’ 

অর্থাৎ বর্তমান সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবেই সন্তু লারমাসহ সব ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠীর জানমাল ও সম্পদ সুরক্ষার বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। গত মহাজোট সরকারের শাসনামলে তিন পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যে দুর্গম এলাকা মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল সে স্থানগুলো তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। যেখানে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও বাজারের সংকট ছিল সেসব জায়গা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা হলো স্থানীয় ক্ষুদ্রজাতি জনগোষ্ঠী কর্তৃক সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতার বাস্তবতা। সেখানে রয়েছে শান্তিচুক্তিবিরোধী ইউপিডিএফের ‘সশস্ত্র সন্ত্রাসী’ কার্যকলাপ। তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা ইত্যাদি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যদিও একই অভিযোগ রয়েছে সন্তু লারমার ‘জেএসএস’-এর বিরুদ্ধেও। গোপন সূত্রে সংবাদ পাওয়া গেছে, কিছুদিন আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) তাদের কৃষিভিত্তিক খামারের প্রজেক্ট এই উভয় গ্রুপের টানাটানিতে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। সেবামূলক প্রকল্পটিতে বরাদ্দ করা বিদেশি সাহায্যের টাকাও ফেরত গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাঙালির সম্প্রীতি রক্ষার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, ২৬ বছর আগের (১৯৯৭) ২ ডিসেম্বর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষর করেন। ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের দ্বার উন্মুক্ত হলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংগঠন ও দেশী-বিদেশী এনজিও তাদের সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করে। তবে চুক্তি অনুযায়ী গঠিত ‘হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল’ ও ‘রিজিওনাল কাউন্সিলে’র চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে মূলত জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতারা নির্বাচিত না হয়েও সম্মান, সম্পদ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হয় যা ‘শান্তিচুক্তি’ বিরোধী উপজাতীয় নেতৃত্বস্থানীয়দের অন্তর্জ্বালা আরও বাড়িয়ে দেয়। এই কারণে আঞ্চলিক উপজাতীয় রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়ে পড়ে এবং ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের প্রায় এক বছরের মাথায় ২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে পার্বত্য রাজনীতিতে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী ও ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এ সংস্থা আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস অ্যান্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করেছে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমিট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভূত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে বর্তমান সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অবশ্য কয়েকটি মৌলবাদ সমর্থিত পত্রিকা পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে অধিকাংশ জাতীয় দৈনিকে ইউপিডিএফের সদস্যদের অস্ত্রসহ আটকের সংবাদ ছাপানো হয়েছে। পার্বত্যচুক্তি বিরোধী ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে’র (ইউপিডিএফ) সদস্যদের এ ধরনের তৎপরতা এখনও বহাল রয়েছে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। প্রকাশ্যে তারা বর্তমান সরকারের চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ও নিন্দা প্রকাশ করে। এছাড়া জনসংহতি সমিতির সঙ্গে রয়েছে তাদের দ্বন্দ্ব। পরস্পর পরস্পরের কর্মী হত্যাকাণ্ডের বিবাদেও জড়িত। অন্যদিকে প্রতি বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয়(সন্তু) লারমা পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুসারে উপজাতিদের অধিকার সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছেন। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে বিভিন্ন মহলের দাবি থেকে স্পষ্ট যে চুক্তিটির গুরুত্ব এখন অপরিসীম। কয়েক বছর আগে সুশীল নেতারা বলেছেন, ‘দেশের সব নাগরিক সমানভাবে নাগরিক অধিকার পাচ্ছে না- এটা বাস্তবতা।’ আমাদের মতে, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে সবাইকে সমান সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়। সমতলের মানুষ যে সুযোগ পাচ্ছে, সেই সমান সুযোগ পাহাড়ের মানুষ পাবে না। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো অবশ্যই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ। বিশেষ অঞ্চল বলেই দেশের মধ্যে কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী সেখানকার সকল বিষয় দেখভাল করার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন। ১৪৫টির বেশি এনজিও পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের যাবতীয় উন্নয়নের জন্য নিরলস কাজ করছে। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে কেবল শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই।  রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের উন্নয়নের জন্য বছর বছর মোটা অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। তবে সরকারের গৃহীত প্রকল্পের শতকরা ৯০ভাগ উপজাতীয়রা এবং ১০ভাগ বাঙালিরা অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ সিংহভাগ ব্যয় হয় উপজাতিদের উন্নয়নের জন্য। এক্ষেত্রে আমাদের অভিমত হলো, উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয়দের উন্নয়ন ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। আর্থ-সামাজিক ভারসাম্য বজায় না থাকলে তা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উপর চাপ সৃষ্টি করে থাকে। মূলধারার রাজনীতি চালু থাকলে সেখানকার সামগ্রিক উন্নয়নের বিষয় সর্বাগ্রে প্রাধান্য পেত। এজন্য পার্বত্য অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রমে সর্বদা একটা বৈষম্য দেখা যায় বলেই মাঝেমধ্যে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ লেগে যায়। উল্লেখ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব-স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-শান্তিচুক্তির পর আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ক্যাম্পও বৃদ্ধি করেনি। বর্তমানেও চলমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশবাহিনী যথেষ্ট সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন। বরং চুক্তি বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত করতে ইউপিডিএফ ক্রমবর্ধমান হত্যাকাণ্ড ও সশস্ত্র সংঘাত সৃষ্টি করে থাকে। আবার তাদের রুখতে অন্যেরা অস্ত্র ধরেছে। অথচ ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গেরিলা যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। একসময় বিভিন্ন দলের ভেতর কোন্দল এবং বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেওয়ায় চাঁদাবাজি, খুন, অপহরণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতিও পাল্টে গেছে। কিন্তু তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন ও চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিকে সামনে রেখে সহজ উপায়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের জীবনে অভ্যস্ত বিচিত্র দলের কর্মীরা অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে মাঝে-মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে উঠছে। সরকারের দ্রুত ব্যবস্থাপনায় অনেক সমস্যার এখন পর্যন্ত সমাধান হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য পাহাড়ি বাঙালিদের প্রতি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী বা উপজাতিরা সদয় দৃষ্টি দেবে- এ প্রত্যাশাও রয়েছে শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষের জনশক্তির।  

উল্লেখ্য, শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক উন্নয়ন চিত্রে। পাহাড়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অধিকাংশই স্থানীয় উপজাতিদের কল্যাণে পরিচালিত হচ্ছে। চাকমা উপজাতির জন্য মোট প্রকল্প ১৮৬ টি(৪৫%),  অন্যান্য উপজাতিগুলোর জন্য মোট প্রকল্প ১৯৪টি(৪৬%)। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের জন্য মোট প্রকল্প ৩৮০টি(৯১%)। পক্ষান্তরে  বাঙালিদের জন্য মোট  প্রকল্প ৩৬ টি (৯%)। পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ মোট সদস্য সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে ১২টি অ-উপজাতির জন্য রাখা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদটি সবসময়ের জন্য উপজাতি গোত্রের জন্য সংরক্ষিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়দের জন্য দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কিছু বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট ২১৭টি ভর্তি কোটা ছিল।অবশ্য কোটা বাতিল হলেও শেখ হাসিনা জানিয়েছেন যে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের বিশেষ বিবেচনায় দেখা হবে। 

মূলত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সমসাময়িক কালে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সফল রাজনৈতিক পরিসমাপ্তি আমাদের দেশের জন্য এক বিরল অর্জন ছিল। এ কারণে শেখ হাসিনার নানান ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্তিও ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অনন্য স্বীকৃতি। তবে শান্তিচুক্তিতে বর্ণিত সকল নাগরিকের অধিকার সমুন্নত রাখার প্রত্যয় বাস্তবায়নে পাহাড়ি-বাঙালির যৌথ প্রচেষ্টা দরকার। অর্থাৎ পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ।

(লেখক: ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)


পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

ডামি বনাম দামি প্রার্থী


Thumbnail

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দল মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য কোন দলের প্রার্থী মাঠে না থাকলে দলের আসল বা দামি প্রার্থী যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত না হতে পারে সে জন্যই এ নির্দেশ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি। গত ২৬ নভেম্বর তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে এ সব তথ্য দেন তিনি। সেই থেকে দেশের রাজনীতিতে ডামি ও দামি প্রার্থী নিয়ে আলোচনা চলছে বেশ জোরে সোরে।

 

দামি প্রার্থী হল দল মনোনীত আসল প্রার্থী। কিন্তু ডামি প্রার্থী কে হবেন? ডামি মানে কি? এ সব নিয়ে ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যার যেন অন্ত নেই। অক্সফোর্ড অভিধান বলছে, ডামি মানে মানুষের একটি মডেল বা প্রতিরূপ। এক্ষেত্রে মানুষ হচ্ছে, প্রার্থী যিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অপর কথায়, ডামি হচ্ছে বাস্তব বা স্বাভাবিকের বিকল্প হিসাবে সাদৃশ্য একটি প্রতিরূপ । ডামি মানে নকল, জাল। সাধারণত সস্তা উপকরণ দিয়ে তৈরি। যেমন, বাড়ির ডামি শাটার। যেগুলো আসলে ভিনাইল দিয়ে তৈরি এবং শুধুমাত্র সাজসজ্জার জন্য। কেমব্রিজ অভিধানও অনুরূপ বলছে। তারা বলছে, ডামি হচ্ছে, মানুষের একটি বড় মডেল। বিশেষত একটি দোকানে কাপড় দেখাতে যা ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কাপড়ের দোকানে যে পুতুলগুলোর গায়ে জামা কাপড় পরানো থাকে সেটাই ডামি। সোজা বাংলায়, ডামি হচ্ছে একটি মূর্তি বা পুতুল, কৃত্তিম বা সাজানো জিনিস, সাক্ষী গোপাল ধরণের। কোন ব্যক্তি বা বস্তুর নকল যা আসল ব্যক্তি বা বস্তুর উপস্থিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে।

 

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, একজন ডামি প্রার্থী হলেন একজন প্রার্থী যিনি সাধারণত কোন উদ্দেশ্য বা জয়ের বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা ছাড়াই নির্বাচনে দাঁড়ান। নানা কারণে বিভিন্ন দেশে ডামি প্রার্থী দেয়ার নজির রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য এবং কোন নির্দিষ্ট  প্রার্থীর ভোট কমানোর জন্য  ডামি প্রার্থী মাঠে নামাতে পারে। ২০১৪ সালের ভারতীয় সাধারণ নির্বাচনে, চান্দু লাল সাহু নামে সাতজন এবং চান্দু রাম সাহু নামে আরও চারজন প্রার্থী ছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টির চান্দু লাল সাহু মাত্র ১২১৭ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। ডামি প্রার্থীরা তার জন্য নির্ধারিত ভোটে ভাগ বসান । তাদের মধ্যে একজন 'সাহু' নির্বাচনী এলাকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। এর পর থেকে ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের ছবি সহ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করে। বিখ্যাত মার্কিন অভিনেতা এডি মারফির সিনেমা 'দ্য ডিস্টিংগুইশড জেন্টলম্যান' নির্বাচন প্রার্থীর নাম বিভ্রাটের উপর কিছুটা ভিত্তি করে তৈরি হয়।

বিজ্ঞাপন বা প্রচারণার অর্থায়নের সীমা অতিক্রম করতে একজন আসল বা দামি প্রার্থী একজন ডামি প্রার্থীকে ব্যবহার করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে আসল বা দামি প্রার্থীরা তাদের ভোটের খরচ বিতরণের জন্য একাধিক ডামি প্রার্থী কে মাঠে নামানোর ঘটনা ঘটেছে। খরচ দামি  প্রার্থীর প্রচারে পরিচালিত হয়, তবে ডামি প্রার্থীদের নামে নির্বাচন কমিশনকে দেখানো হয়।

১৯৮২ সালের গ্লাসগো হিলহেড উপনির্বাচনে, রায় হ্যারল্ড জেনকিন্স নামে একজন প্রার্থী ছিলেন। ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য একজন ব্যক্তির নাম পরিবর্তন করে "রয় হ্যারল্ড জেনকিন্স" রাখেন। এবং তাকে ডামি প্রার্থী করা হয়। সে নির্বাচনে 'রায়' হ্যারল্ড জেনকিন্স ১০১০৬ ভোটে পেয়ে বিজয়ী হন। ডামি প্রার্থী 'রয়' হ্যারল্ড জেনকিন্স ২৮২ ভোট পান।  


আবার ফিরে আসি ডামির অর্থ নিয়ে। ব্রিটানিয়া অভিধান আরেকধাপ এগিয়ে বলছে, ডামি মানে স্টুপিড বা বোকা। সপ্তাহখানেক আগে যাঁরা নিজেদেরকে দামী প্রার্থী মনে করতেন, তাঁরা এখন নিজেদেরকে ডামি বানিয়ে স্টুপিড বা বোকা হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর দেয়া এই ইংরেজি শব্দকে তাঁরা অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদেরকে বোকার জাতে সামিল করছেন। দলের মধ্যে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করছেন। দলে সংকট তৈরি করছেন । ডামি এবং দামি প্রার্থীর মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। গন্ডগোল পাকিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আর ডামি প্রার্থীর মধ্যে।

 

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি একটু পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেন, ডামি প্রার্থী জেতার প্রার্থী নয়। এটা বলা হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাতে নির্বাচন না হয় সেজন্য। আর স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীর ব্যাখ্যা অন্য জিনিস। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করতে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছে। তিনি আরো বলেন, যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কিনেছিলেন তারা কোনো অবস্থাতেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করতে পারবেন না। কেউ করলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে।

 

দলের যে সকল বিদ্রোহী নিজেকে ডামি প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা দিচ্ছেন, তাঁরা দলীয় প্রধানের নির্দেশকে তোয়াক্কা করছেন না। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দল মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকে একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ দেন। কিন্তু এসব স্বঘোষিত ডামি 'দল ঘোষিত মনোনীত প্রার্থীদের' মনোনীত নন। দলের মনোনয়নধারী প্রার্থীর কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছেন না। নিজেদেরকে ডামি হিসাবে সাফাই গাইলেও তাঁরা বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। বস্তুত তাঁরা ইতিমধ্যেই দলের নির্দেশ অমান্য করেছেন। প্রকারান্তরে নিজেদেরকে তাঁরা ইতিমধ্যেই বিদ্রোহী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছেন।

 

ডামি ও বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে ইতিমধ্যে মাঠে পর্যায়ে অন্তদ্বন্দ ও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকা দলটিতে কোন্দল শুরু হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ততই সেটি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। সেটি অব্যাহত থাকলে ভোটের ময়দানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ভোটাররা ভোট কেন্দ্র বিমুখ হয়ে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের দলীয় কৌশল ব্যর্থ হবার আশংকা রয়েছে।

দলটির প্রথম সারির নেতারা ইতিমধ্যে আশ্বস্ত করেছেন যে, মনোনীত প্রত্যেক প্রার্থীকেই একজন করে দলীয় ডামি প্রার্থী রাখার নির্দেশ- একটি দলীয় নির্বাচনী কৌশল। পরিস্থিতি বুঝে কৌশল পরিবর্তিত হতে পারে। সবখানেই ডামি প্রার্থী থাকবে না। বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীদের মাঠে ছাড়ার নির্দেশ আসবে যে কোন সময়। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ আসবে। তবে সেটা যত দ্রুত আসবে, ততই মঙ্গল দলীয় প্রার্থীদের জন্য, ভোটের মাঠের জন্য, ভোটারদের জন্য, ভোটের জন্য।


নির্বাচন   ডামি প্রার্থী   জাতীয় সংসদ  


মন্তব্য করুন


ইনসাইড থট

‘জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা নাই’


Thumbnail

আমি গত তিন বছর ধরে বাংলা ইনসাইডার এবং অল্প কিছু লেখা বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছি। এর মূল সুর একটিই। আর তা হল বাংলাদেশে নির্বাচন সঠিক সময়ে হবে এবং সংবিধান অনুযায়ী হবে। নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং যার ভোট তিনিই দেবেন। এর মূল কারণও ছিল একটিই। বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তিনি এ দেশের মানুষের ভোটের এবং ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তার হাত ধরে মানুষের ভোটের অধিকার থাকবে না সম্ভব না। আমি এটাও বলেছিলাম যে বিএনপি কোনো না কোনোভাবে অবশ্যই নির্বাচনে থাকবে এবং নির্বাচন খুব কঠিন নির্বাচন হবে। এবং আওয়ামী লীগের নেতারা যেন শুধুমাত্র নমিনেশন পাওয়ার জন্য দৌঁড়োদৌঁড়ি না করে বরং জনগণের ভিতরে তিনটি কাজ করবেন। এটা বারবার লিখেছি আবারও বলছি। সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তাদের জনগণকে বারবার জানানো যে দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্যই কি করছেন? 

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২০০১ সালে বিএনপি এসে বাংলাদেশের ওপরে কি অত্যাচার করেছিল সাধারণ মানুষের ওপরে। এবং তৃতীয়টি হচ্ছে যে যদি আবার দার্শনিক নায়ক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন তাহলে দেশ স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কি বোঝায় সেটা প্রতিটি জনগণই বুঝতে পারবে। এটি আমার মূল সুর ছিল। এর ভেতর আমি এটাও বলেছিলাম যে এবার মোটামুটি ভাবে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। 

জাতীয় পার্টির প্রধান হওয়ার পর জিএম কাদের প্রচেষ্টা চালালেন যে জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দলের ভূমিকায় না রেখে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা অবতীর্ণ করার। এটা আমার মতে খুব ভালো প্রচেষ্টা। কিন্তু কথায় আছে না স্মার্ট হওয়া ভাল, কিন্তু ওভারস্মার্ট হওয়া ভালো না। তিনি (জিএম কাদের) করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে গেলেন যে মনে করলেন দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বোধহয় জাতীয় পার্টির ওপর নির্ভর করেই এদেশে গণতন্ত্র রক্ষা করবে অথবা ক্ষমতায় আসবে। এটা যে কত বড় ভুল এখন তারা বোধহয় বোঝা শুরু করেছে। বাস্তব অবস্থাটা হচ্ছে এখন নির্বাচনে বিএনপি প্রক্সির মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন লোক বিভিন্ন দল করে আসবে নির্বাচন। নির্বাচনও কঠিন হবে এবং আমার মতে কমপক্ষে ৩০ জন যে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যান্ডিডেট তারা নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে আসবে। এখন সেই জায়গায় জাতীয় পার্টি যে তাদের ফরম বিক্রি করছে, যা বিশ্বের ইতিহাসে নাই। আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব কি করব না কিন্তু ফরম বিক্রি করে যে টাকাটা নিচ্ছি সেটা কিসের জন্য? এটা তো কোন রাজনীতির পরিভাষায় তা পড়ে না। তার মানে কি তার নির্বাচনে আসবেন? 

এখন জিএম কাদেররা বুঝে ফেলেছেন যে নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয় তাহলে জাতীয় পার্টির বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। এবার বিরোধী দল হয়তো অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষ পাবে। কারণ জাতীয় পার্টি তো আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া আসনগুলো জয়ী হয়ে আসে। কিন্তু এবার এসব কিছু হবে না। কারণ রওশন এরশাদ আলাদা হয়ে গেছে। তিনিও হয়তো শেষ নির্বাচনে তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। জাতীয় পার্টিও হয়তো এবার মুসলিম লীগের মতো হবে। এবার অন্য নতুন কোন দল আসবে। আর সেটা হওয়ার উচিত বলে আমি মনে করি। নেত্রী সব সময় বলেন যে, একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। এই মুহূর্তে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল না পেলেও আগামীতে হয়তো পাবো। কারণ বিরোধী দল হিসেবে যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা যথেষ্ট বিগ্ক এবং তারা সংসদ সজীব রাখতে সক্ষম হবে বলে আমার মনে হয়। তবে সুযোগ হারাবে জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি। তারা বিরোধী দল থেকে এখন তিন নম্বর দলে চলে যাবে। বিরোধী দলে আমরা হয়তো এবার নতুন দলকে দেখব। সব সময় নির্বাচন এলে জাতীয় পার্টি যেন একটা খেলা জমিয়ে ফেলে। কিন্তু একই নিয়ম যে সবসময় চলে না এই উপলদ্ধি জাতীয় পার্টি করতে পারেনি। কথায় আছে ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হয় কিন্তু একইভাবে পুনরাবৃত্তি হয় না।




মন্তব্য করুন


বিজ্ঞাপন