রাজনীতিতে
নানা পথ অবলম্বন করেন
নেতারা। তারা বেছে নেন উদারপন্থা, মধ্যপন্থা ও কট্টরপন্থা। স্বাধীনতার
আগে এবং পরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লিখিত তিনটি পন্থারই প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য কোন পন্থা কী পরিণতি বয়ে
এনেছে, সে দিকে চোখ
রাখা যেতে পারে।
প্রথমেই কট্টরপন্থা নিয়ে পথচলা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের কথা বলছি। জাসদ ছাত্রলীগের একটি প্রশাখা। মুজিব বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক সিরাজুল আলম খানের তন্ত্রমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব, ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া সংবাদপত্রে বিবৃতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার গঠন করে দেশে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েমের আহ্বান জানান। এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মুজিব বাহিনীর আরেক অধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মণির নির্দেশনায় ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, ডাকসু জি এস আবদুল কুদ্দুস মাখন ও ইসমত কাদির গামা দাবি করেন, দেশ পরিচালিত হতে হবে মুজিববাদের ভিত্তিতে।
তারা জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে ‘মুজিববাদ’ বলে আখ্যা দেন। ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই শেখ মণিপন্থি ছাত্রলীগ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং সিরাজুল আলম খানপন্থি ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে সম্মেলন ডাকে। উভয় গ্রুপই বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করে। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন শেখ মণিপন্থি ছাত্রলীগের সম্মেলনে।
ফলে সিরাজুল আলম খান গ্রুপ ভিন্ন পথে তাদের রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ছাত্রলীগের উচ্চাকাক্সক্ষী, মেধাবী, প্রতিভাবান, কট্টরপন্থি ও বিপ্লবী বলে পরিচিত অংশটি জাসদে শামিল হয়। কাজী আরেফ আহমেদ, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু, খলীকুজ্জমান, নূরুল আলম জিকু, এ বি এম গোলাম মোস্তফা, শাজাহান খান, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান, এ বি এম শাজাহান, জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ উদীয়মান নেতারাও জাসদের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হন। রোমান্টিসিজম আদর্শিক ভাবালুলতা, মাঠ গরম করা ও বিপ্লবী বক্তৃতা-বিবৃতি রাতারাতি জাসদকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়।কিন্তু অচিরেই নেতৃত্বের অদূরদর্শিতা ও হঠকারিতায় বিপর্যয়ের সম্মুখীনও হয় দলটি।
১৯৭২ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাসদ প্রথম কাউন্সিল করে। মেজর এম এ জলিল সভাপতি, আ স ম আবদুর রব সাধারণ সম্পাদক ও শাজাহান সিরাজ যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। জাসদ ঘোষণাপত্রে বলে, ‘প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম সম্ভব নয়। শ্রেণিসংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিপ্লব ছাড়া সমাজতন্ত্রকে আইনের মাধ্যমে কার্যকর করতে গেলে শোষক সম্প্রদায়কে উৎখাত করা যায় না। শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণির জঙ্গি ঐক্য গড়ে তোলার জন্য কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন। নির্বাচন সাধারণ মানুষকে ঠকানোর বুদ্ধি ছাড়া কিছু নয়। ভোট দেওয়ার যে রীতি তা হলো, মানুষের বিক্ষুব্ধ মনকে দমিয়ে দেওয়ার একটা কৌশল মাত্র। নির্বাচনে মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তি কোনো দিন আসে না। ’ আশ্চর্যের বিষয় ঘোষণাপত্রের এসব নীতিনৈতিকতা জলাঞ্জলি দিল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চের প্রথম সাধারণ নির্বাচনেই। তারা অংশ নিল। আ স ম আবদুর রব ও এম এ আউয়াল ঢাকার সংসদীয় আসনে জাতির পিতার বিরুদ্ধেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন। তারা জামানতও হারালেন। জিঘাংসা এতটাই ভয়ংকর যে, ছাত্রলীগের এই দুই সাধারণ সম্পাদক এম এ আউয়াল, আ স ম রব রাতারাতি জাতির পিতার সুদীর্ঘকালের অপরিসীম স্নেহ-ভালোবাসার কথা অবলীলায় ভুলে যেতে পেরেছেন।
জাসদ সরকারের মোকাবিলায় সশস্ত্র গোপন পন্থা অবলম্বন করে প্রকারান্তরে আত্মাহুতির পথ বেছে নিয়েছিল। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে জাসদ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিনের প্রতিও সম্মান দেখানোর কথা ভুলে যায়। তারা এ জন্য ওই দিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মালেক উকিলের মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবনে সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশের সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষের জের ধরে জাসদ কার্যত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। নেতাদের নিক্ষিপ্ত হতে হয় কারাগারে। জাসদের সশস্ত্র গণবাহিনীর প্রকাশও ছিল একটা চরমপন্থা। দলের কর্মীরা আত্মঘাতী ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। তারা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অগ্রযাত্রার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান। জাসদ ও গণবাহিনীর সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের প্রকাশ্য ঘোষণায় যুক্ত হয় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি, নিষিদ্ধ ঘোষিত মাওবাদী বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিও। দেশের থানা, ফাঁড়িতে হামলা করে অস্ত্র লুট আর রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে জাসদের সংঘর্ষের খবর, আওয়ামী লীগের পাঁচজন সংসদ সদস্য হত্যা প্রভৃতি ঘটনাই বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয় বিপ্লবের ‘বাকশাল’ কর্মসূচি দিতে বাধ্য করেছিল। জাসদের আরেকটি হীনমন্যতা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। প্রথম বিজয় দিবসে রাজধানীতে নাশকতার হুংকার দেয় সর্বহারা পার্টি। অন্তরালে জাসদ। টহলরত পুলিশের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে পুলিশের গুলিতে আহত হন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল। জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের শিরোনাম করা হলো, ‘ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল পুলিশের গুলিতে আহত’। সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা এ খবরটি প্রচার করে জাসদ চরম এক অসভ্যতার নজির স্থাপন করেছিল। জাসদের বঙ্গবন্ধুকে অস্ত্রবলে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করার দিবাস্বপ্নটিকে মনে হয় ছোট্টবেলার ‘ডাকাত-পুলিশ’ খেলা। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হয়েছিল জাসদের কারণেই। এ দলটির কারণেই দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের সম্মুখীন হন। এক কথায় জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার পথ প্রশস্ত করে দেয়। ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে, জাসদের ভ্রান্ত রাজনীতির মোহে পড়ে স্বাধীনতা-উত্তর সম্ভাবনাময় দুটি প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে গেছে।
দলটির উদ্ভট ও ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাৎ হয়েছে। ৭ নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি বিপ্লব ছিল জাতির জন্য এক অভিশাপ বার্তা। জাসদের গণবাহিনী ও কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটায়। কিন্তু জিয়াকে দিয়ে ক্ষমতা দখলের অভিসন্ধিও নস্যাৎ হয়ে যায়। জাসদ ক্ষমতা দখলের জন্য জেনারেল খালেদ মোশাররফ বীরউত্তমসহ তার সঙ্গীদের হত্যা করে। জেনারেল জিয়ার চরম বিশ্বাসঘাতকতায় কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।
জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিলের হয় যাবজ্জীবন। সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রবের ১০ বছর, হাসানুল হক ইনুর সাত বছর, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ আরও অনেক জাসদ নেতাকে দন্ডিত হতে হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ডে। পরবর্তীতে জাসদের এসব নেতা জিয়ার অনুকম্পায় মুক্তি পেলেও নিজেদের বিবাদ-বিগ্রহে দলীয়ভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। হায়! জাসদ ভেঙে জাসদ (আউয়াল), জাসদ (রব), জাসদ (সিরাজ), জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), বাসদ (মাহবুব), বাসদ (খলিকুজ্জামান) আরও কত কী। মাহমুদুর রহমান মান্নারা তো জাসদ নামই পরিহার করে ভিন্ন পথে চলছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও গণবাহিনীরও অস্তিত্ব নেই। জাসদ (ইনু) সমর্থিত ছাত্রলীগেরও বিকাশ নেই। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব একখানা ছাত্র সংগঠন মাত্র। জাসদের বহু নেতা এখন বিএনপি-আওয়ামী লীগে। জাতীয় পার্টিতেও আছেন-যারা মন্ত্রিত্বের টোপ গিলে এরশাদের চামচা বনে যান। জাসদ সভাপতি এম এ জলিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র চুলোয় দিয়ে শেষ জীবনে ইসলামিক মুক্তি দল করেছিলেন।
শাজাহান সিরাজ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাসদ থেকে জয়ী হয়ে বিএনপিতে দলবলসহ বিলীন হয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রী হন। অবশ্য ২০০১ সালে ধানের শীষ নিয়ে জয়ী হওয়ার পর পূর্ণমন্ত্রী হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে বিএনপিতে ছিলেন অগাছা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সালের মন্ত্রিসভার সদস্য হন আ স ম আবদুর রব। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর বন্দনা করতেন। কিন্তু ভোল পাল্টে এখন শেখ হাসিনা-বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর কথা উচ্চারণই করেন না। আ স ম আবদুর রব ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এরশাদের গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা বলে পরিচিত হন। জাসদের কার্যকর নেতা বলতে এখন হাসানুল হক ইনুকে বোঝায়। তাঁর নেতৃত্বাধীন জাসদ আওয়ামী লীগের ১৪ দলে রয়েছে। তিনি তথ্যমন্ত্রী ছিলেন। নিজ দলের প্রতীকে ঝুঁকি নেননি। নৌকা প্রতীকেই বারবার বিজয়ী হন। হাসানুল হক ইনুর দলেও উপদলীয় বিবাদ বিগ্রহ রয়েছে। রব, সিরাজ, ইনুরা যাদের অনুকম্পায় মন্ত্রিত্ব করেন তাদের সঙ্গে তাদের আদর্শগত বৈপরীত্য কোথায় গেল? জাসদের কঙ্কালসারশূন্য দেহবল্লরীতে নেই যৌবন। পড়ে আছে যেন দেহাবশেষ।
এবার আলোচনা করব রাজনীতির আরেকটি পথ নিয়ে। সেটি হলো- সার্বভৌম কর্তৃত্ব করা। সার্বভৌম নেতা একাই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিম্নস্থদের ওপর চাপিয়ে দেন। নিম্নস্থদের মতামত জানতে চান না। এ কারণে যে, অবচেতন মনে নেতা আশঙ্কা করেন, নিম্নস্থ ন্যায্য কথা বলছেন, যা তার পক্ষে মানা সম্ভব নয়। এমনকি সম্মানহানিকর। নেতার এসব একাধিপত্য বেশি দিন টেকে না। অল্প সময় দলের কর্মীরা কপট আনুগত্য দেখায়, তবে অচিরেই দলে বিক্ষোভ দেখা দেয়। প্রতিভাবান কর্মীরা কর্মকান্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়, আর যারা লোভী তারা ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়। ফলে দলে কোন্দল ও দ্বন্দ্বের মুখে স্থবিরতা নেমে আসে। এতে সার্বভৌম নেতার কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। যার ফল ভোগ করে কর্মীরা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রের মতো পূর্ববাংলায় আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ১৯৫৪-এর নির্বাচন মানে হক-শহীদ-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বোঝাত। অথচ বিস্ময়কর যে, ওই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রার্থী হননি। যুক্তফ্রন্টের রূপরেখায় তিন নেতার সিদ্ধান্ত ছিল-নির্বাচনে মুসলিম লীগকে হারিয়ে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলে পূর্ববাংলার আইন পরিষদের নেতা হবেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পাকিস্তান গণপরিষদ নেতা হবেন সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানীর উদার পন্থা গ্রহণ ছিল একটি দৃষ্টান্ত। ১৪৩টি আসন পেয়েও আওয়ামী লীগ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়। অবশ্য এ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। মার্কিনিদের সঙ্গে সিয়াটো চুক্তিতে আওয়ামী লীগ পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আবার কী, আমিই আওয়ামী লীগ- আমিই মেনিফেস্টো। ’ আওয়ামী লীগে তাঁর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া এতটাই তীব্র ছিল যে, সোহরাওয়ার্দীর অতি অনুগত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী পদত্যাগ করেন। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও নেতার বক্তব্য সমর্থন করেননি, বরং তিনি মর্মাহত হন। কট্টরপন্থি সোহরাওয়ার্দী সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট শুধু ভাঙেনি, আওয়ামী লীগও কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে ভেঙে যায়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। একটা পর্যায়ে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হারাতে হয়। নেতা-কর্মীদের জীবনে নেমে আসে চরম নিপীড়ন নির্যাতন। তার আগে নেতৃত্বের দ্বিতীয় প্রণালিটির কথা উল্লেখ করছি। এটি হলো, হিমশীতল, যন্ত্রবৎ, নিয়মানুবর্তী কর্মিপন্থা। অথচ হিমশীতল নিস্পৃহ পদ্ধতিতে কর্মনিপুণতা আনার চেষ্টা যথাযথ নয়। যেসব ‘মেশিন’ শাসক বা নেতার অধীনে কাজ করে তারা নিজেদের সম্পূর্ণ কর্মদক্ষতা প্রয়োগ করে না। এই পথ অবলম্বনকারীরা আক্ষরিক অর্থে পুস্তিকার আলোকে পথ চলেন। প্রতিটি প্রণালি সাধারণ বিষয়গুলোর জন্য পথনির্দেশ মাত্র-এটা তারা বুঝতে চান না। বিশ্লেষকদের মতে, এ নেতারা সাধারণ মানুষকে যন্ত্র মনে করেন। আর মানুষ যেসব জিনিস ঘোর অপছন্দ করে তার মধ্যে একটা হলো যন্ত্রের মতো আচরণ। আর তৃতীয় পন্থা অবলম্বনকারী হলেন, ‘মানবিক বোধসম্পন্ন নেতা’-যিনি শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব দিতে পারেন। নেতৃস্থানীয় বলতে বোঝায় প্রচন্ড ব্যস্ত নেতা। নেতৃস্থানীয়রা কর্মযুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়ান। তবে নেতৃস্থানীয়রা কিন্তু বেশ খানিকটা সময় কাটান, যখন তাদের একমাত্র সঙ্গী হয় ভাবনাচিন্তা। বিভিন্ন ধর্মের মহাপুরুষরা, প্রত্যেকেই বেশ খানিকটা সময় একা থাকতেন। অনেক নেতার মধ্যেই এভাবে উদারতার সৃষ্টি হয়, হয়ে ওঠেন মধ্যপন্থি। মহানবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিশু, বুদ্ধ, কনফিউসিয়াস জীবনের ঘোরপ্যাঁচ থেকে দূরে একা নিজের সঙ্গে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তাঁরা একাকীত্বে পেয়েছেন চিন্তার স্বাধীনতা, চিন্তার গভীরতা।
ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট পোলিও আক্রান্ত হওয়ার পর সেরে ওঠার সময় যদি একা না থাকতেন, তাহলে আদৌ নিজের অসাধারণ নেতৃত্বের ক্ষমতা বিকশিত করতে পারতেন কি না সন্দেহ।
হ্যারি ট্রুম্যান দীর্ঘ সময় মিসোরিতে একাকী কাটিয়েছেন। অ্যাডলফ হিটলার বেশ কিছু বছর জেলজীবন কাটিয়ে ছিলেন বলেই ক্ষমতার পাহাড় গড়ে তুলেছিলেন। এই জেলে বসেই কুখ্যাত ‘মাই কেম্ফ’ লেখার সুযোগ পেয়েছিলেন, যাতে বিশ্বজয়ের কূটকৌশলের উল্লেখ ছিল এবং জার্মানরা যার অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কট্টরপন্থা তাঁকে ধ্বংস করে। কমিউনিজমের কূটনীতিতে সুদক্ষ লেনিন, স্ট্যালিন, মার্কস সব নেতা জেলে বসেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্বিঘ্নে তৈরি করার সুযোগ পান। মহাত্মা গান্ধী একাকীত্বের কারণেই তাঁর ভিতরে অহিংসবাদী চিন্তাভাবনা গড়ে ওঠে। একইভাবে নেলসন ম্যান্ডেলাও বিকশিত হন জেলবন্দি হয়ে। যেমন দীর্ঘ কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুও বিকশিত হয়েছেন।
মানবিক পন্থা অনুসরণ করে সুদক্ষ হয়ে উঠেছিলেন ও তাঁর সুফলও উপভোগ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মানবিকতাবোধের পরিণাম প্রশংসনীয় ছিল। বঙ্গবন্ধুকে গোপনেও নিন্দা করা হতো না। তিনি নিজের অধীনস্থদের কাজে বেশি নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। যে কারণে তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতিতে সহকর্মীরা একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। দেশে ফিরে কর্মযজ্ঞেও সম্পূর্ণ নিরাপত্তা পেয়েছিলেন। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির চিরবন্ধুর পথ পরিহার করে যখনই সার্বভৌম ক্ষমতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্রত হলেন, তখনই নিজ দলের মধ্যেই সহকর্মীরা অনেকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হলো। সেই ষড়যন্ত্রের কুৎসিত চেহারা ফুটে ওঠে খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা গোটা বাঙালি জাতির জন্য মহা ট্র্যাজেডি। মোশতাকের পতনের পর আওয়ামী লীগের পুনর্জীবনের মাধ্যমে ‘বাকশাল’-কে না বলার মধ্যে স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করছিল, যে ‘সার্বভৌম কর্তৃত্ব’ পন্থা অবলম্বন সঠিক ছিল না। খুনি মোশতাকও ১৫ দিনের মাথায় বাকশাল আদেশ বাতিল করে সার্বভৌম ক্ষমতার পথ এড়িয়ে চলছিলেন।
হিমশীতল যন্ত্রবৎ নিয়মানুবর্তী কর্মিপন্থা অনুসরণকারী মানে কমিউনিস্ট পন্থা। এটার প্রতিও মানুষের আস্থা সৃষ্টি হয়নি।
সংসদের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সংসদীয় পদ্ধতির মধ্যে নিহিত। সংসদ সার্বভৌম অর্থ প্রকারান্তরে জনগণই সার্বভৌম। সেই সংসদের প্রধান নেতা নিঃসন্দেহে সর্বদিক দিয়ে প্রশংসনীয়। কিন্তু সদস্যরা কতটা মানবিকতাবোধ সম্পন্ন এবং এর সংখ্যা কত সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি এ দেশের মানুষের আস্থা শতভাগ। আর সেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া খুবই কঠিন। তবে হাঁটি হাঁটি করে গণতন্ত্রের জন্যই হাঁটছে বাংলাদেশ। অবিরাম এ হাঁটার কারণেই এবং জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বদৌলতেই শেকড় থেকে শিখরে-অগ্রসরমান সমুজ্জ্বল বাংলাদেশ।
সোহেল সানি, লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
১০ই এপ্রিল ‘স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র’ (প্রোক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) -এর
৫৩ বছর পূর্তি।আজ থেকে পাঁচ দশক আগে এই দিন ঢাকা শহর থেকে দূরে নিভৃত এক গ্রামের
আম্রকাননে উদ্ভাসিত হয়েছিল এর অবিনাশী বাক্যগুলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনী নৃশংস পৈশাচিকতায় বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে। আর সে রাতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পৃথিবীর বুকে
যুদ্ধরত বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। অন্যদিকে মাত্র ১৫ দিনের
মাথায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৭ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে
শপথ নেয় এই সরকার।এই সরকারের নেতৃত্বেই ৯ মাসের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর
পাকিস্তানি সৈন্যদের সারেন্ডারের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
একাধিক গবেষণাগ্রন্থ ও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত
সূত্র মতে, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী
লীগের তৎকালীন নেতাদের আলাদা দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই
প্রথমে তাজউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য
৩০ মার্চ ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। সেখান থেকে মেহেরপুর
মহকুমার প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত
অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসা পর্যন্ত পুরো সময়টাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি
হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল। কারণ তাজউদ্দিন সেটা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে শুরু থেকেই দৃঢ় অবস্থানের মাধ্যমে। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা
গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে তাজউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে
যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে একটি প্রশাসনিক কাঠামো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ১৯৭০ সালের
নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন
প্রতিনিধি হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সাহায্য-সহযোগিতা
করার জন্য আলোচনা করেন। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে
পূর্ব পরিকল্পনা এবং ভারতের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন,
সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবে তাজউদ্দিনের
সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশের কারণে
তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি না দিলেও ভারত বাংলাদেশের এই নতুন সরকারকে মুক্তিফৌজের আশ্রয়-ট্রেনিং-অস্ত্র
থেকে শুরু করে সকল রকম সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়
এবং সবধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে এই বৈঠকের সূত্র ধরেই
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (M.N.A) এবং এমপিএ (M.P.A)-দের কুষ্টিয়া জেলার
সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার
জন্য মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রীপরিষদ এবং এমএনএ এবং এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা
করেন। তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর
অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার
মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল
এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।
১৯৭১
সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রের
প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১
সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন-
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ তিনটি ঘটনা
একসূত্রে গাঁথা।’ তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন।
১০ এপ্রিলের ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ
গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে স্বদেশ
ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত
পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য প্রথম সরকার গঠন করা হয়।’ সেসময় যিনি এই ঘোষণাপত্রটি
রচনা করেছিলেন তাঁর স্মৃতিতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র; যা
৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে পেনসিলভানিয়া প্রাদেশিক আইনসভায় অনুষ্ঠিত ২য় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে
গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধরত তেরটি মার্কিন উপনিবেশ নিজেদের ব্রিটিশ
শাসনের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র নামে নতুন রাষ্ট্র
গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় জুলাইয়ের ৪ তারিখ, যে তারিখে স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়েছিল সেই তারিখেই। ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কারণ ঘোষণাপত্রে লেখা হয়েছে- ‘আমাদের এই স্বাধীনতার
ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।’
ঘোষণাপত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো বঙ্গবন্ধুর
২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিহিত
করা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে আরও সিদ্ধান্ত
ঘোষণা করা হয় যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। কোনো কারণে
যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা
তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব
উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। বর্ণিত ঘটনা অনুসারে আমরা জানি, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর
থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র
রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি
আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া
খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা বন্ধ
ঘোষণা করেন। উপরন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত
এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে গণহত্যা চালায়। উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক
কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত
নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার
প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের
অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ নামের
এই দলিল যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন
সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল।ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ এরকম-
‘‘যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে
প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত
বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯
জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং
যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্য জেনারেল
ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার
জন্য আহ্বান করেন, এবং
যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও
বেআইনিভাবে নির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, এবং
যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি
রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি
অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং
যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের
জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে
ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার
জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, এবং
যেহেতু একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনায়
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর
নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনও অনবরত করিয়া চলিতেছে,
এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ
চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের
প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের জন্য একটি সরকার
প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা
ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
করিয়াছে।
সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ,
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকার জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা
রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা
করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত
করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং এতদ্দ্বারা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন
করিলাম, এবং এতদ্দ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত
না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং
সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের
সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সকল নির্বাহী ও
আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয়
অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, কর আরোপণ ও অর্থ ব্যয়ন ক্ষমতার অধিকারী
হইবেন, গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবিকরণ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ
সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন।
আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ
আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোন কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার
কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাহার ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্দ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির
থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমণ্ডলীর
সদস্য হিসেবে আমাদের উপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং
জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার
এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত করিতেছি যে, এই দলিল কার্যকর
করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ
আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করিলাম।’’
উল্লেখ্য, এটি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মুজিবনগরে
ঘোষিত ও জারিকৃত এবং ২৩ মে, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫০(১) অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে
স্বীকৃত হবে।
পঞ্চদশ
সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের
সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ {সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ}
একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
পেয়েছে। ফলে ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অপরিবর্তনীয় বিধান। ৫৩ বছর আগে
ঘোষিত ‘স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র’ ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। এজন্য একাত্তরে পাকিস্তানিদের
গণহত্যার খবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী
আন্দোলন না বলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বীকৃতি দান করা হয়।২৪
বছরের নিপীড়ন-অত্যাচারের পথ অতিক্রম করে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি গণতান্ত্রিক
নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়েছিল বলেই আমাদের স্বাধীনতার লড়াই
আইনসম্মত হয়ে উঠেছিল।আর ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’
ছিল সেই আইনগত বৈধতা অর্জনের অন্যতম স্তম্ভ, যার বাক্যাবলি আজও অবিনাশী।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি,
কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য,
সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)
মন্তব্য করুন
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।