বিলম্ব হলেও বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাইনাস ফর্মুলার বিপক্ষে কথা বলেছিলেন--
১৬জুলাই ২০০৭ইং ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কারাবন্দি দিবস। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নীল নক্সায় ধানমন্ডির সুধা সদন থেকে আটক করে এবং সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ কারাগারে দীর্ঘ ১১ মাস আটক রেখেছিলেন। ১১জুন মুক্তি দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক ও সরকারের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মাইনাস ফর্মুলার পক্ষ নিয়ে দলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতাদের অপতৎপরতা বিগত হলেও ভূলে যাবার নয়।
১/১১ এ সেনা সমর্থিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলের শুরুতেই আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা কর্মীরা গ্রেফতার,হয়রানি,নির্যাতনের সম্মূখীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সারির নেতাদের গ্রেফতার,মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির এক পর্যায়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে মিথ্যা মামলা সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনীতিতে মাইনাস ফর্মুলার অংশ হিসেবে প্রথমেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায়ী বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতৃত্বাধীন পর পর পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন সরকার প্রধান খালেদা জিয়াকে প্রথমে আটক না করার পক্ষ অবলম্বন গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিলম্বে বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
মাইনাস ফর্মুলার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় জোটের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক জন নেতার সাথে কতিপয় নেতারা সেনা সমর্থিত অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্বে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লিপ্সায় ছিলেন।
২০০৭ সালের ১৫ জুলাই শেষে ১৬ জুলাই শুরুতে ধানমন্ডির সুধাসদনে বসবাসরত বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বাসভবনে যৌথ বাহিনীর ঘেরাও খবর পেয়ে আতঙ্কিত হলাম। কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে ফোনালাপে অবগত হলাম গন মানুষের নেত্রীকে আটক করার প্রক্রিয়া চলছে। গভীর রাতে জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বন কারী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাইনাস ফর্মুলার প্রতিবাদী কন্ঠ বিশেষ করে অগ্নি কন্যা বেগম মতিয়া চৌধুরী, এডভোকেট সাহারা খাতুন ,ডঃ হাছান মাহমুদ,ক্যাপ্টেন (অবঃ) এ বি তাজুল ইসলাম সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ফোনালাপ করি-আমাদের করণীয় কী। গভীর রাত হওয়ায় শ্রদ্ধেয় নেতা জিল্লুর রহমান,সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কে ঘুমিয়ে যাবার কারনে ফোনে পায়নি। জননেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেফতারের প্রস্তুতিতে ভীত না হয়ে আমাদের অনেকের সাথেই ফোনে কথা বলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাবার সাহস জুগিয়েছিলেন। ১৬ জুলাই ভোরে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে কোর্টে নেয়া প্রাক্কালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকেরা প্রতিবাদের শ্লোগানে মুখরিত করে যৌথ বাহিনীর হামলা,নির্যাতন এবং কয়েকজন নারী নেত্রী গ্রেফতার হয়েছিলেন। পাতানো কোর্টে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতারে শুনানিতে এডভোকেট সাহারা খাতুন সহ আমাদের অন্যান্য আইনজীবীবৃন্দ অংশ গ্রহণ করেন। পাতানো কোর্টে জননেত্রী শেখ হাসিনার জামিন না মঞ্জুর করা হলো। কোর্ট থেকে কারাগারে যাবার প্রাক্কালে কোর্টে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর অন্যতম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন আইন সম্পাদক এডভোকেট সাহারা খাতুন কে ডেকে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জননেতা জিল্লুর রহমানকে দায়িত্ব দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে জাতীয় সংসদ এলাকায় স্থাপিত অস্থায়ী কারাগারে নেয়া হয়। এদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরী কোর্ট এলাকা থেকে আমাকে গাড়ীতে উঠিয়ে গুলশানে জিল্লুর রহমান সাহেবের বাসভবনে যাবার পথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদেরকে। অনেক বাধা-চেষ্টার পর মতিয়া আপা এবং আমি গুলশান আইভি কর্নকডে জিল্লুর রহমান সাহেবের বাসায় পৌছতে সক্ষম হলাম। আমাদের গাড়ীর পিছনে বিভিন্ন টিভি-প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা এসে আইভি কর্নকডে জড়ো হয়। সাংবাদিকদের নীচে অবস্থান করার অনুরোধ করলে তারা অপেক্ষায় থাকেন। মতিয়া আপা আমাকে নিয়ে লিফটে ছয়তলায় উঠে বাসায় শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমান কে নেত্রী গ্রেফতার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন । বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য জিল্লুর রহমান সাহেবকে অবহিত করা হয়। এদিকে ভবনের নীচে অপেক্ষারতঃ সাংবাদিকরা বার বার ফোন করে জিল্লুর রহমান সাহেবের সাক্ষাত নেয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। অনুমতি সাপেক্ষে পরক্ষণেই সাংবাদিকদের উপস্থিতি । ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে জিল্লুর রহমান সাহেব মতিয়া আপা ও আমাকে পাশে রেখে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে অবিলম্বে নেত্রীকে নিঃশর্ত মুক্তির দাবী জানান। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হীন কার্যকলাপের সমালোচনা করেন । উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু কন্যার গ্রেফতারে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষ অবলম্বনকারী মাইনাস ফর্মুলার ষড়যন্ত্রকারীরা উল্যাসিত হয়ে বেশী দিন ঠিকে থাকতে পারেনি। তারাই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে আটক রেখেই জাতীয় নির্বাচনে আগ্রহী ছিলেন। নেতা কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এগারো মাস আটক শেষে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় । তাই মাইনাস ফর্মুলার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সফলতার মুখ দেখেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সংরক্ষিত কারাগারে আটক থাকাকালীন তাঁর নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাজধানী সহ অন্যান্য এলাকার বিভিন্ন পেশার ২৫ লাখ মানুষের গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে (তেজগাঁও- বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল জমা করা হয়েছিল। ২৫ লাখ গণ স্বাক্ষর সংগ্রহ এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে জমা কার্যক্রমে অন্যান্যের সাথে আমার ক্ষুদ্র ভুমিকা ছিল।
এদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি এবং আমেরিকা হতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার আগে ও পরে দলের ত্যাগী,পরীক্ষিত নেতা কর্মীদের তোপের মূখে সংস্কারবাদীরা অপদস্থের পাশাপাশি তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে এসে নিজেদের রক্ষায় সক্ষম হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে যে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আস্হাশীলে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্বিধা বিভক্ত ছিল। সেই সময় জীবনের ঝুকি মোকাবিলা করে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছিলেন তারা অবশ্যই স্মরণীয় থাকবে। শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে রয়েছে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, প্রয়াত এডভোকেট সাহারা খাতুন, ওবায়দুল কাদের, প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, রাজি উদ্দীন রাজু, ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম, স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ডাঃ দিপু মনি, হাবিবুর রহমান সিরাজ, প্রয়াত এডভোকেট রহমত আলী, ডঃ হাছান মাহমুদ, ঢাকা মহানগর নেতৃবৃন্দের মধ্যে এডভোকেট কামরুল ইসলাম, ফয়েজ উদ্দিন মিয়া, বজলুর রহমান, প্রয়াত আসলামুল হক,শাহে আলম মুরাদ, আব্দুল হক সবুজ, ডা দিলীপ রায়, হেদায়েতুল ইসলাম স্বপন, আবুল কালাম আজাদ সহ আরো অনেকে। বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আব্দুল হামিদ ঐ সময় সদ্য বিলুপ্ত সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা ন্যাম ৪নং ভবনে অবস্থান করতেন, একই ভবনে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ছিলেন। দলের একজন কর্মী হিসেবে বহু পূর্ব হতেই মহামান্যের সঙ্গে আমার পরিচয়-যোগাযোগ ছিল, তাছাড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকার পাশ্ববর্তী অঞ্চলের নাগরিক ও আমি। প্রিয় নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নেয়া নেতৃবৃন্দের পরামর্শে মাইনাস ফর্মুলার বিপক্ষে কথা বলানোর জন্য প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের নিয়ে অনেক নেতার দ্বারে দ্বারে ধর্ণা দিয়ে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছি। তেমনি ভাবে তৎকালীন বিরোধী দলীয় উপনেতার অবস্থান ভবনে বার বার ধর্ণা দিয়েছি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং আটক বঙ্গবন্ধু কন্যার মুক্তি আন্দোলনে শরিক হওয়া। তিনি বিলম্ব হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বন করে মিডিয়ায় সাক্ষাত দিয়েছিলেন।
জেনারেল (অব) সুবিদ আলী ভুঞা, প্রয়াত কর্নেল (অব) শওকত আলী, ডঃ এম এ জলিল জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে তৎ সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭জন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে ৬জনই জননেত্রী 'শেখ হাসিনা' মাইনাস ফর্মুলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। মাইনাস ফর্মুলায় দলের কয়েক জন সিনিয়র নেতার ব্যর্থ চেষ্টা সফল হয়নি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সহ আরো নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ব্যারিস্টার সফিক আহমেদ (সাবেক আইন মন্ত্রী), প্রয়াত ব্যারিস্টার রফিকুল হক, এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু সহ অন্যান্য আইনজীবীরা বিশেষ সংস্থার বাধার মোকাবিলা করেও কাজ করেছেন। ইলেকট্রনিক মিডিয়া (টিভি) টকশোতে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বন করে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে এডভোকেট স ম রেজাউল করিম সহ হাতে গোনা ক'জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কথা বলেছেন। আত্ম গোপনে থেকে ও জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বন ও মুক্তি আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভুমিকা রেখেছিলেন মোফাজ্জল হোসেন মায়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আফম বাহাউদ্দিন নাসিম, মির্জা আযম, একেএম এনামুল হক শামীম। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষে অবস্থান ও তাঁর মুক্তি আন্দোলনে সাবেক ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল হক, সুভাষ সিংহ, এস এম কামাল হোসেন, সুজিত রায় নন্দী, এডভোকেট রিয়াজুল কাউছার, বলরাম পোদ্দার, শাহজাহান আলম সাজু,আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এডভোকেট আফজাল হোসেন, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মারুফা আক্তার পপি, সাইফুজ্জামান শিখর প্রমূখ। আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সহ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আস্হাশীল হয়ে কাজ করেছে। তাছাড়া শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আব্দুল জলিল, কামাল আহমেদ মজুমদার, পংকজ দেবনাথ, ডঃ আওলাদ হোসেন সহ অনেকেই গ্রেফতার হয়েছিলেন। যারা সুবিধার প্রলোভনে পড়ে দলে খুনী খোন্দকার মোস্তাকদের ন্যায় বিশ্বস্ততার ভাব নিয়ে সর্বক্ষেত্রেই তাদের বিচরণ রয়েছে।
এতে ত্যাগী,নির্যাতিত,নিপীড়িত নেতাকর্মীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আমি প্রাণপ্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
আল্লাহ্ মহান
জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু
এম এ করিম
সাবেক সহ সভাপতি
বাংলাদেশ কৃষক লীগ -
সাবেক সহ সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
কেন্দ্রীয় উপ কমিটি
মন্তব্য করুন
গত ২২ সেপ্টেম্বর
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর বব মেনেনডেজ ও তাঁর স্ত্রী নাদিন দুর্নীতির অভিযোগ
অভিযুক্ত হয়েছেন। মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মেনেনডেজের
বিরুদ্ধে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো।
যুক্তরাষ্ট্রের
আটর্নি অফিসের সূত্রমতে, মেনেনডেজ ও তাঁর স্ত্রী নিউ জার্সির তিন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে
সোনা, নগদ অর্থ, বিলাসবহুল গাড়ি ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ ঘুষ নিয়েছেন। এসবের পরিমাণ
কয়েক লাখ ডলার। নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটরের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি
তাঁর পদের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিন ব্যবসায়ী ও মিসরের সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন।
অভিযুক্ত তিন ব্যবসায়ীর একজনের পৈতৃক বাড়ি মিসরে।
ক্ষমতার সঙ্গে
দুর্নীতির সম্পর্ক নিবিড়, এটি অতি প্রাচীন একটি কথা।
যুক্তরাষ্ট্র
সম্পর্কে প্রচলিত একটি ধারণা হলো যে, দুর্নীতি শুধুই কম সভ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু
দেশগুলোতেই হয়ে থাকে। দুর্নীতি পুরোপুরি অন্য দেশের ব্যাপার। গণতন্ত্রের প্রতি যাদের
অঙ্গীকারের ঘাটতি রয়েছে, আইনের শাসনের প্রতি যাদের অশ্রদ্ধা রয়েছে, কেবল সেসব দেশেই
দুর্নীতি হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছুই পূতঃপবিত্র আর তাদের কর্মকর্তারা সবাই মহান।
কিন্তু মেনেনডেজের
কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনায় সংবাদমাধ্যমের খবরে যেভাবে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে তাতে বলা
যায়, দুর্নীতি আমেরিকানদের মধ্যে আপেল পাইয়ের (আপেল দিয়ে তৈরি করা কেক) মতোই নিখুঁতভাবে
মিশে আছে। এ–সম্পর্কিত একটি খবরে জানা যাচ্ছে যে মিসরের নিপীড়ক শাসকদের জন্য গত কয়েক
দশকে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন–বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। বিষয়টি একটি বড় কেলেঙ্কারি।
এটা নিশ্চিত
যে এই নিখুঁত আপেল পাইয়ের ভেতর মেনেনডেজই একমাত্র পচা আপেল নন। ক্লারেন্স টমাসের কথাই
ধরা যাক। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের এই বিচারকের দুর্নীতির ঘটনা বিশদ তদন্ত করে
নিউনিয়র্কভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা প্রোপাবলিকা।
প্রোপাবলিকায়
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের পাদটীকায় বলা হয়েছে, ‘ঘড়ির কাঁটার মতোই, টমাস তাঁর
অবকাশের সময়টা ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছেন তাঁর মতাদর্শের এবং তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন এমন
লোকদের সঙ্গে। এটা পুরোপুরি আইনশাস্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড।’
টমাসের এই অবকাশ
যাপনের একটি ফিরিস্তি প্রোপাবলিকার প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। এর মধ্যে কমপক্ষে ৩৮ বার
অবকাশ যাপন, ২৬ বার প্রাইভেট জেট প্লেনে ভ্রমণ, আটবার হেলিকপ্টারে যাতায়াত, বিলাসবহুল
রিসোর্টে কয়েকবার ভ্রমণের হিসাব দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাতের ধনকুবের হারলন
ক্রো, যিনি নাৎসি স্মৃতিচিহ্নের নিবেদিত সংগ্রাহক। ডানপন্থী রাজনীতির এই পৃষ্ঠপোষক
বিচারপতি টমাসের বিলাসবহুল অবকাশযাপনের অন্যতম অর্থদাতা। টমাসের নাতিকে একটি দামি প্রাইভেট
স্কুলে পড়ানোর খরচ জোগানোসহ আরও অসংখ্য কাজে অর্থায়ন করেছেন তিনি।
সেপ্টেম্বর
মাসে প্রোপাবলিকা টমাসের আরেকটি কেলেঙ্কারি ফাঁস করে। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যাতে আরও
বেশি ডানপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে, সে উদ্দেশ্যে গঠিত কোচ নেটওয়ার্কের একটি দাতা সম্মেলনে
গোপনে অংশ নেন টমাস। শিল্প খাতের ধনকুবের কোচ ভাইয়েরা এই নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা।
এ ঘটনায় আপনারা কী জানতে পারছেন? কোচ নেটওয়ার্কের কৌশল কী? যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত
করা যায়, এ রকম মামলা টমাসের আদালতে তোলা।
স্বার্থের সংঘাত
বিষয়টি ধারণা হিসেবে কতটা পুরোনো আর অর্থহীন!
দিন শেষে টমাসের
এই সব কর্মকাণ্ড মার্কিন পুঁজিবাদের একটা খণ্ডাংশের ছবিমাত্র। মার্কিন পুঁজিবাদ গণতন্ত্রের
ছদ্মবেশে অভিজাতদের স্বৈরশাসনই বজায় রাখে। অন্যভাবে, একজন যত দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে
পারেন, এ ব্যবস্থা তত দূর পর্যন্তই দুর্নীতিগ্রস্ত।
অপরাধীদের এই
তালিকা আরও দীর্ঘ। সুপ্রিম কোর্টের আরেক বিচারপতি স্যামুয়েল আলিটো অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের
ব্যবস্থাপক এবং রিপাবলিকান পার্টির বড় দাতা পল সিঙ্গারের কাছ থেকে উপহার নিয়েছিলেন।
২০০৮ সালে আলাস্কায় আলিটোর বিলাসবহুল ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন সিঙ্গার। সুপ্রিম কোর্টে
একটি মামলায় সিঙ্গারের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে রায় দেন আলিটো।
টেক্সাসের অ্যাটর্নি
জেনারেল কেন পাক্সটনের কথা ধরা যাক। গত ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির
অভিযোগে আনা অভিশংসন খারিজ হয়ে যায়। পাক্সটনের বিরুদ্ধে ঘুষ, বিচারে বাধা, জনগণের আস্থা
ভঙ্গ এবং অন্যান্য অসৎ আচরণের অভিযোগ উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পাক্সটন ২০২০ সালের নির্বাচনের ফলাফল
পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টার সহযাত্রী ছিলেন। পাক্সটনের বিরুদ্ধে আরেকটি দুর্নীতির অভিযোগ
তদন্ত করছে এফবিআই। নিরাপত্তাসম্পর্কিত প্রতারণার মামলায় তাঁর বিচার চলছে। টেক্সাস
সিনেটে পাক্সটনের অভিশংসনের প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে
নিজের স্বভাবসুলভ ঢঙে উদযাপন করে লেখেন, ‘কেন পাক্সটনের এই জয় অনেক বড় বিজয়। ওয়াও!!!’
মেরিয়াম–ওয়েবস্টার
অভিধানের অনলাইন সংস্করণে ‘করাপশন’ (দুর্নীতি) শব্দটির কয়েক ধরনের সংজ্ঞা দেওয়া আছে।
প্রথমটি হলো, বিশেষ করে ক্ষমতাবাস লোকদের করা অসৎ ও অবৈধ আচরণ’। দ্বিতীয় সংজ্ঞাটি হলো,
‘অযথাযথ ও অবৈধ উপায়ে অন্যায় করতে প্ররোচিত হওয়া’।
অবক্ষয় ও পচন—কেবল
এ দুটি শব্দ ব্যবহার করে অভিধানটিতে দুর্নীতির আরও একটি বিকল্প সংজ্ঞা দেওয়া আছে। যুক্তরাষ্ট্রের
কর্মকর্তারা যেসব উপায়ে ঘুষকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন এবং ধনিক গোষ্ঠীর শাসন টেকসই রাখতে ডানপন্থীদের
অর্থ যে উপায়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করছে, সামগ্রিকভাবে সেটা একটা অবক্ষয়ের চিত্রকেই তুলে
ধরে।
লেখক: বেলেন
ফার্নান্দেজ (আল–জাজিরার কলামলেখক)
মন্তব্য করুন
ভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট ‘হাসিনা সরকারকে টার্গেট করছে পশ্চিমা-অর্থায়নকৃত মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যেটি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে নিবন্ধটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশ করা হল।
সরকারবিরোধী
অপপ্রচার
শাপলা চত্বরের
ঘটনার পর নানা ধরনের মিথ্যা প্রচারণা শুরু করে বিরোধীরা। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ দেশে সাম্প্রদায়িক
অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা ধরনের অপপ্রচার চালায়। তবে প্রমাণের অভাবে আদিলুর রহমান
এবং তার এনজিও ‘অধিকার’-এর প্রচারণা ব্যর্থ হয়।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন
চারদলীয় জোট সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আদিলুর
রহমান। তার সংগঠন ‘অধিকার’ ওয়েবসাইটে ১০ জুন ২০১৩ তারিখে ‘হেফাজেতে ইসলাম বাংলাদেশ
অ্যাসেম্বলি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শিরোনামে একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদন প্রকাশ
করে।প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, হেফাজত ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে
৬১ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া প্রায় আড়াই হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলেও ওই প্রতিবেদনে
দাবি করা হয়েছে। ‘অধিকার’ তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংবলিত একটি তালিকা প্রকাশ
করেছে।
‘অধিকার’-এর
সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম তাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করে
বিভিন্ন প্রতিবেদন ও খবর প্রকাশ করে, যা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। প্রতিবেদন
প্রকাশের পরপরই সরকার ‘অধিকার’-এর দাবি যাচাই করতে চেয়েছিল। ৬১ জন নিহত হয়েছে বলে
‘অধিকার’ যে দাবি করেছিল- তার সপক্ষে ভিকটিমদের তালিকা চায় সরকার। কিন্তু সংস্থাটি
সেই তালিকা প্রদান করতে অস্বীকার করে এবং উদ্দেশ্যমূলক বিভ্রান্তি ছড়ানো অব্যাহত রাখে।
মামলা হয়েছিল
প্রচলিত আইন অনুসারেই
১১ সেপ্টেম্বর
২০১৩ তারিখে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর
বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। মামলার চার্জশিটে বলা হয়, আসামি
আদিলুর ও এলান হেফাজতে ইসলামীর ৬১ জনের মৃত্যুর বিষয়ে বানোয়াট, উদ্দেশ্যমূলক ও মিথ্যা
তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনসাধারণের মনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ সৃষ্টি
করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিঘ্নিত করার চেষ্টা করেন। তাদের এই প্রচারণায় দেশে-বিদেশে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
এতে আরও বলা
হয়, ‘তারা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন, যা তথ্যপ্রযুক্তি
আইনের ৫৭(১) এবং (২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’ একইভাবে, অভিযুক্তরা ইচ্ছাকৃতভাবে
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির
অবনতি হয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারকে হেয় করা যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার
তদন্তে জানা গেছে, অধিকারের প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত এবং মিথ্যা তথ্য রয়েছে। সেখানে কাল্পনিক
সব ব্যক্তির নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার লেখাসহ
জীবিত ব্যক্তিদের মৃত ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কে এই আদিলুর
রহমান খান?
আদিলুর রহমান
খান মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর সম্পাদক। তিনি মূলত একজন রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্রজীবনে
তিনি বামপন্থি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি একটি বামপন্থি রাজনৈতিক
দলের হয়ে সুনামগঞ্জ জেলা থেকে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। পরে আইন পেশায় প্রবেশ
করে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০০১ সালের পর তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাও
হন। তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নিযুক্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন।
২০০৭ সালে বিএনপি-জামায়াত
সরকার ক্ষমতা হারানোর পর তিনি এই পদ থেকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে মানবাধিকার
ইস্যুতে এই সংগঠনের সম্পাদক হওয়ার পর থেকে আদিলুর রহমান খান বিরোধীদলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে
এই সংগঠনটিকে ব্যবহার করে আসছেন। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আদিলুরের কারাদণ্ড দীর্ঘদিনের মিথ্যাকে পরাজিত করেছে। আদিলুর রহমান
রাষ্ট্রের ঘাড়ে মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন; আদালতের রায়ে সেই কলঙ্ক
দূর করার প্রাথমিক পদক্ষেপ সম্পন্ন হয়েছে। তিনি আদালতে ৬১ জনের তালিকা দিতে পারেননি।
উপযুক্ত প্রমাণ
দিলে তিনি এই শাস্তি থেকে মুক্তি পেতেন। এ জন্য তাদের হাতে সময় ছিল ১০ বছর। দশ বছর
পার হলেও আদালতে সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারেননি তার আইনজীবীরা। এ মামলা চলাকালে এবং
মামলার রায়ের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাস
মামলা বাতিল এবং আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিন এলানের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই মামলায় আদালত একজন মানবাধিকার কর্মীকে শাস্তি
দেননি, বরং শাস্তি দিয়েছে একজন মিথ্যাবাদীকে। যিনি মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক
সম্প্রীতি বিনষ্ট করার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন। তিনি এবং তার সংস্থা আন্তর্জাতিক
অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করতে কাজ করেছেন।
আদিলুরের সাজার
বিরুদ্ধে বিভিন্ন সংগঠনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা।
তারা বলেন, রায়ে কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও আদালতের
রায়ের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা শুরু করে একটি মহল। বিশিষ্টজনরা বলেন, মতপ্রকাশের অধিকার
সমুন্নত রাখাকে আমরা যেমন অপরিহার্য মনে করি, তেমনি মানবতাবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িক
গোষ্ঠী এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী মিত্ররা মতপ্রকাশের অধিকারের অজুহাতে তাদের ঘৃণ্য স্বার্থ
চরিতার্থ করার সুযোগ না পায় তা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এটা আশ্চর্যজনক, কিছু দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই রায় ঘোষণার পর বিতর্কিত, চরমপন্থি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সুরেই প্রতিবাদ করেছে।
মন্তব্য করুন
গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতীয়রা স্বাধীনতা
অর্জন করেছিল, কিন্তু তাঁর একটি পরিচ্ছন্ন ভারতের স্বপ্ন এখনও অপূর্ণ। অবশ্য ভারত সরকার দ্বারা প্রচলিত একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে
‘‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’’(২০১৪) ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।ভারতের
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৮ সালে লিখেছিলেন-‘‘গত চার বছরে(২০১৪-২০১৮)
১৩০ কোটি ভারতীয় স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মধ্য দিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন
করেছেন। প্রত্যেক ভারতীয়ের কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে আজ স্বচ্ছ ভারত অভিযান চার বছর
পূর্ণ করছে এবং এই অভিযান এক গতিশীল ও সুফলদায়ী প্রশংসনীয় গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
সারা দেশের সাড়ে আট কোটিরও বেশি পরিবারে বর্তমানে শৌচালয়ের সুবিধা রয়েছে। ৪০ কোটিরও
বেশি ভারতীয় নাগরিককে আর প্রকাশ্যে মলত্যাগ করতে হয় না। চার বছরের এই ক্ষুদ্র সময়ে
দেশে পরিচ্ছন্নতার সুবিধা ৩৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে। একুশটি রাজ্য ও
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং সাড়ে চার লক্ষ গ্রামকে বর্তমানে প্রকাশ্যে মলত্যাগহীন স্থানে
পরিণত করা সম্ভব হয়েছে।’’ দৃশ্যত গান্ধীজির ভাবনা ও কর্মের অনুপ্রেরণা ‘স্বচ্ছ ভারত
অভিযানে’র অন্যতম দিক।
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন
‘‘স্বাধীনতার চেয়ে স্যানিটেশন বেশি গুরুত্বপূর্ণ’’। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশনকে
গান্ধীবাদী জীবনযাপনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল সবার জন্য
সম্পূর্ণ স্যানিটেশন। শারীরিক সুস্থতা এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি জনসাধারণের এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির উপর প্রভাব ফেলে।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন এবং দুর্বল স্বাস্থ্যকর অবস্থার কারণে
সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জানা প্রত্যেকের জন্য অপরিহার্য। অল্প বয়সে শেখা অভ্যাসগুলো
একজনের ব্যক্তিত্বের মধ্যে গেঁথে যায়। খাওয়ার আগে হাত ধোয়া, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ
করা এবং অল্প বয়স থেকেই স্নান করার মতো কিছু অভ্যাস গড়ে তুললেও আমরা দেশের পাবলিক
প্লেস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে মাথা ঘামাই না। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘‘আমি
কাউকে তাদের নোংরা পা দিয়ে আমার মনের মধ্যে দিয়ে যেতে দেব না।’’
গান্ধীজি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
এবং ভাল অভ্যাসে গড়া জীবন নিয়ে বাস করতেন এবং সুস্বাস্থ্যের সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
নির্দেশ করেছিলেন। কেউ রাস্তায় থুতু বা নাক পরিষ্কার করবেন না। কিছু ক্ষেত্রে, থুতু
এতটাই ক্ষতিকর যে জীবাণুগুলি অন্যদের সংক্রামিত করে। কিছু দেশে রাস্তায় থুথু ফেলা
একটি ফৌজদারি অপরাধ। যারা পান ও তামাক চিবিয়ে থুথু ফেলেন তাদের অন্যের অনুভূতির প্রতি
কোন বিবেচনা থাকে না। থুতু, নাক থেকে শ্লেষ্মা ইত্যাদিও মাটি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
(নবজীবন তারিখ ২ নভেম্বর ১৯১৯)
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গান্ধীর
দ্বিতীয়বার ভারত সফরটি ছিল তাৎপর্যবহ। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশদের দ্বারা ভারতীয়দের
প্রতি দুর্ব্যবহারের প্রতিবিধানের জন্য কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন।
কংগ্রেস ক্যাম্পের স্যানিটারি অবস্থা ছিল ভয়াবহ। কিছু প্রতিনিধি তাদের কক্ষের সামনের
বারান্দাকে ল্যাট্রিন হিসেবে ব্যবহার করেন, অন্যরা এতে আপত্তি করেননি। গান্ধী সঙ্গে
সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা বললে তারা বললেন; ‘‘এটি
আমাদের কাজ নয়, এটি একজন ঝাড়ুদারের কাজ।’’ সেসময় গান্ধী একটি ঝাড়ু চেয়ে ময়লা পরিষ্কার
করেছিলেন। তখন তিনি পশ্চিমা পোশাক পরিহিত। স্বেচ্ছাসেবকরা অবাক হয়েছিলেন কিন্তু কেউ
তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। কয়েক বছর পরে, যখন গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের
পথপ্রদর্শক ও নেতা, স্বেচ্ছাসেবকরা কংগ্রেস ক্যাম্পে একটি ভাঙি (ঝাড়ুদার) স্কোয়াড
গঠন করে যেখানে একসময় ব্রাহ্মণরা ভাঙ্গি হিসেবে কাজ করেছে। হরিপুর কংগ্রেসে ময়লা
ফেলার জন্য দুই হাজার শিক্ষক ও ছাত্রকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। নোংরা
এবং ময়লা পরিষ্কার করার জন্য একদল লোককে অস্পৃশ্য হিসাবে চিহ্নিত করার কথা গান্ধীজি
কখনো ভারতে পারেননি। তিনি ভারতে অস্পৃশ্যতা দূর করতে চেয়েছিলেন। গান্ধী যখনই একটু
পরিচ্ছন্নতার কাজ করার সুযোগ পেতেন, তখনই তিনি খুশি হতেন। তার কাছে, জনগণের পরিচ্ছন্নতার
মান পরীক্ষা ছিল তাদের ল্যাট্রিনের অবস্থা। তিনি নিজেকে একজন ভাঙ্গি হিসেবে পরিচয় দিয়ে
বলেছিলেন যে তিনি ঝাড়ুদার হিসেবে মরতে পারলে সন্তুষ্ট হবেন। এমনকি তিনি গোঁড়া হিন্দুদেরকে
অস্পৃশ্যদের সাথে সামাজিক বয়কটে সহানুভূতি দেখাতে বলেছিলেন।
গান্ধীজি ৪৬ বছর বয়সে তাঁর
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন। সেই বছর হরিদ্বারে কুম্ভ মেলায় যাওয়ার
সময়, তিনি তাঁর ছেলেদের সাথে মেলায় ভাঙ্গি হিসেবে সেবা প্রদান করেন।একই বছর গান্ধী
পুনাতে সার্ভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটির কোয়ার্টার পরিদর্শন করেন। ছোট কলোনির সদস্যরা
একদিন সকালে তাকে ল্যাট্রিন পরিষ্কার করতে দেখেছিল। তারা এটা পছন্দ করেনি। কিন্তু গান্ধী
বিশ্বাস করতেন যে এই ধরনের কাজ স্বরাজের জন্য যোগ্যতম। একাধিকবার তিনি সারা ভারত সফর
করেছেন। যেখানেই এবং যখনই তিনি যেতেন, তিনি কোনও না কোনও আকারে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা
দেখতে পান। তিনি বলেছিলেন, যদিও খুব কম লোকই জুতা কিনতে পারে, ভারতে খালি পায়ে হাঁটা
কল্পনা করা যায় না। এমনকি বোম্বাইয়ের মতো শহরে, আশেপাশের বিল্ডিং দখলকারীদের দ্বারা
থুথু ফেলার ঘটনা ছিল দুঃখজনক।রেলস্টেশন এবং ধর্মশালায় পাবলিক শৌচাগারগুলির নোংরা এবং
দুর্গন্ধ ছিল ভয়াবহ। গান্ধী রেলের বগি নোংরা করা যাত্রীদের অভ্যাসের নিন্দা করেছিলেন।
দরিদ্র গ্রামবাসীদের ব্যবহৃত
রাস্তা এবং তাদের গৃহপালিত ষাঁড়গুলি সর্বদা খারাপ অবস্থায় রাখা হতো। স্নানের জায়গা
বা জল কতটা নোংরা তা না জেনে তিনি মানুষকে তথাকথিত পবিত্র পুকুরে ডুব দিতে দেখেছেন।
তারা নিজেরাই নদীর পাড় নোংরা করেছে। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের মার্বেল মেঝেতে রৌপ্য
মুদ্রা দিয়ে ময়লা সংগ্রহ করা দেখে তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন এবং বিস্মিত হয়ে ভেবেছিলেন
কেন মন্দিরের প্রবেশদ্বারগুলি সরু পিচ্ছিল গলি দিয়ে করা হয়। পৌরসভার সাথে আলাপকালে
গান্ধী প্রায়ই বলতেন; ‘‘আমি আপনাকে আপনার প্রশস্ত রাস্তা, আপনার দৃষ্টিনন্দন আলো এবং
আপনার সুন্দর পার্কগুলির জন্য অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এমন একটি পৌরসভার অস্তিত্বের
যোগ্য নয় যেখানে পানীয় জলের কল নেই এবং যেখানে দিনরাত সব সময় রাস্তা ও গলি পরিষ্কার
রাখা হয় না। আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে ঝাড়ুদাররা কী অবস্থায় থাকে?’’
গান্ধীজি জোর দিয়েছিলেন
যে ভৃত্যদের ঘরগুলি প্রভুদের বাংলোর মতো পরিষ্কার হওয়া উচিত। ‘‘এটা বলে লাভ নেই যে
আমরা ইংরেজদের মতো বাহ্যিক স্যানিটেশনের শিল্প শিখিনি। খুবই কষ্টের বিষয় হল ভাইসরয়
হাউজে নিয়োজিত নিচুজাতের ঝাড়ুদারদের বাসস্থান অত্যন্ত নোংরা।’’ এই অবস্থা আমাদের
নতুন সরকারের মন্ত্রীরা সহ্য করবেন না। যদিও তারা একই সুসংরক্ষিত বাংলো দখল করবে, তবে
তারা দেখবে যে তাদের ভৃত্যদের বাসস্থান তাদের নিজেদের মতো পরিষ্কার রাখা হয়েছে। কর্মীদের
স্ত্রী ও সন্তানদের পরিচ্ছন্নতার দিকেও তাদের নজর দিতে হবে। জওহরলাল এবং সর্দার তাদের
নিজস্ব শৌচাগার পরিষ্কার করতে কোন আপত্তি নেই। কিভাবে তারা তাদের পরিচারকদের থাকার
ঘর পরিষ্কার করতে পারে? জওহরলালের এক সময়ের হরিজন সেবক এখন ইউপি অ্যাসেম্বলির সদস্য।
আমি তখনই সন্তুষ্ট হব যখন মন্ত্রীদের কর্মীদের থাকার জায়গাগুলি তাদের নিজেদের মতো
পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন হবে।’’
গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘‘যতদিন
আপনি ঝাড়ু এবং বালতি হাতে না নেবেন, আপনি আপনার গৃহ এবং শহরগুলিকে পরিষ্কার করতে পারবেন
না।’’
তিনি যখন একটি মডেল স্কুল
পরিদর্শন করেন, তখন তিনি শিক্ষকদের বলেছিলেন: ‘‘আপনারা আপনার প্রতিষ্ঠানকে আদর্শ করে
তুলবেন, যদি ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি আপনি তাদের রাধুনি এবং ঝাড়ুদার তৈরি
করেন।’’ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে, তাঁর পরামর্শ ছিল, ‘‘তুমি যদি নিজের মেথর হও, তবে তুমি
তোমার চারপাশকে পরিষ্কার করবে। ভিক্টোরিয়া ক্রস জেতার চেয়ে একজন বিশেষজ্ঞ মেথর হওয়ার
জন্য কম সাহসের প্রয়োজন নেই।’’
তাঁর আশ্রমের কাছের গ্রামবাসীরা
মাটি দিয়ে মলমূত্র ঢেকে দিতে অস্বীকার করে। তারা বলেছিল-‘‘নিশ্চয়ই এটা ভাঙ্গির কাজ।’’
গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে গ্রামে ময়লার কাজ তদারকি করতেন। দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তিনি
কয়েক মাস ধরে বালতি, ঝাড়ু নিয়ে গ্রামে গ্রামে যেতেন। বন্ধু ও অতিথিরা তাঁর সঙ্গে
থাকতেন। তাঁরা বালতিভর্তি ময়লা ও মল এনে গর্তে পুঁতে দিতেন।তাঁর আশ্রমে সমস্ত ময়লা
পরিচ্ছন্নতার কাজ বাসিন্দারা করত। গান্ধী তাদের পথ দেখান। সেখানে বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম
ও বর্ণের মানুষ বসবাস করত। তাঁর আশ্রমের মাঠে কোথাও কোনো দিন কোনো ময়লা পাওয়া যায়নি।
সমস্ত আবর্জনা সবজির খোসার গর্তে পুঁতে দেওয়া হতো এবং অবশিষ্ট খাবার সারের জন্য একটি
পৃথক গর্তে ফেলে দেওয়া হতো। মলও পুঁতে দেওয়া হতো পরে সার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
বাগান করার জন্য ব্যবহৃত হতো ব্যবহৃত বা দূষিত জল। কোনো পাকা নিষ্কাশন ব্যবস্থা না
থাকলেও আশ্রমের খামারটি মাছি ও দুর্গন্ধমুক্ত ছিল।
গান্ধী এবং তাঁর সহকর্মীরা
পালাক্রমে ঝাড়ুদারের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি বালতি ল্যাট্রিন এবং দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট
ট্রেঞ্চ ল্যাট্রিন চালু করেন। গান্ধী গর্ব সহকারে সমস্ত দর্শনার্থীদের কাছে এই নতুন
উদ্ভাবনটি দেখিয়েছিলেন; ধনী-গরিব, নেতা-কর্মী, ভারতীয় ও বিদেশি সবাইকে এই ল্যাট্রিন
ব্যবহার করতে হতো। এই পরীক্ষাটি ধীরে ধীরে গোঁড়া সহকর্মী এবং আশ্রমের মহিলা বাসিন্দাদের
মন থেকে ময়লা সংগ্রহকারী সম্পর্কে সংস্কার সরিয়ে দেয়। মলের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে ভাঙ্গিকে
দেখলে তিনি অস্বস্তিতে পড়তেন, অসুস্থ বোধ করতেন। তিনি স্বচ্ছতাকে ব্যাখ্যা করলেন কীভাবে
সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা যায়। ময়লা সংগ্রহ একটি সূক্ষ্ম শিল্প
এবং তিনি নিজে নোংরা না হয়ে এটি করেছিলেন।
তিনি লিখেছেন, ‘‘গ্রামের
পুকুরগুলি স্নান, জামাকাপড় ধোয়া এবং পানীয় এবং রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। অনেক
গ্রামের পুকুর গবাদি পশুদের দ্বারাও ব্যবহার করা হয়। মহিষগুলিকে প্রায়শই তাদের মধ্যে
ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হল, পুকুরের জলের এই অপব্যবহার সত্ত্বেও
গ্রামগুলি মহামারি দ্বারা ধ্বংস হয়নি। অথচ চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রমাণ দেখায় যে গ্রামে
বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের অভাব গ্রামবাসীদের অনেক রোগের জন্য দায়ী।’’ (হরিজন, ৮ ফেব্রুয়ারি,
১৯৩৫)
মহাত্মা গান্ধী তাঁর জীবনের
প্রথম দিকে উপলব্ধি করেছিলেন যে তৎকালীন বৃহত্তর গ্রামীণ ভারতে স্যানিটেশন এবং পরিচ্ছন্নতার
বিরাজমান শোচনীয় অবস্থা বিশেষত পর্যাপ্ত টয়লেটের অভাব স্বরাজ অর্জনের পথের কাঁটা।
তিনি বলেছিলেন, যতক্ষণ না আমরা ‘‘আমাদের নোংরা অভ্যাস থেকে নিজেদেরকে পরিত্রাণ না করি
এবং ল্যাট্রিন উন্নত না করি, ততক্ষণ আমাদের জন্য স্বরাজের কোনো মূল্য থাকতে পারে না।’’
তিনি তাঁর জীবদ্দশায়(১৮৬৯-১৯৪৮) দক্ষিণ আফ্রিকায় মানুষের মুক্তির লড়াই এবং ভারতের
স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সাথে, স্যানিটেশন, পরিচ্ছন্নতা এবং সমস্ত শ্রেণির বর্জ্যের
দক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অবিরাম সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি স্যানিটেশনের
প্রযুক্তিগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক-এবং এর ব্যক্তিগত, গার্হস্থ্য ও কর্পোরেটের প্রায়
সমস্ত দিক নিয়ে কাজ করেছেন।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই
গান্ধী শহীদ হন। স্বাধীনতার পর বিক্ষিপ্তভাবে স্যানিটেশনের বিষয়টি সরকারের দৃষ্টি
আকর্ষণ করে। তাঁর পরিচ্ছন্নতার ধারণাগুলোর আরও প্রসারিত বাস্তবায়ন দরকার।তিনি বলেছিলেন
যে মশা এবং মাছির মতো এজেন্টরা রোগ ছড়ায় এবং আমরা নিজেরাই বোম্বাইয়ের খারাপ পরিস্থিতির
জন্য দায়ী। তিনি সকলকে উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন ‘‘ময়লা পরিষ্কার করা এবং স্বরাজের
মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।’’ তিনি বলেছিলেন, ‘‘মহামারির জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা অযৌক্তিক।’’
গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত যেখানে ‘‘কর্পোরেট স্যানিটেশনের
প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভূত হয় না’’- সেখানে ‘‘পশ্চিম থেকে পৌর স্যানিটেশনের বিজ্ঞান’’
আমাদের অবশ্যই শিখতে হবে। অবশ্যই ‘‘আমাদের
প্রয়োজনীয়তা অনুসারে স্যানিটেশনের পশ্চিমা পদ্ধতিগুলি সংশোধন করতে হবে।’’ মানুষের
মলমূত্রকে ‘‘মূল্যবান সার’’-এ রূপান্তরিত করে কাজে লাগানোর সবচেয়ে সস্তা এবং কার্যকর
পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি নিজেই ডাঃ পুরের কাছে ঋণী ছিলেন। ইংরেজদের মতো, তিনি ময়লাকে
‘‘ম্যাটার ডিসপ্লেসড’’ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। তিনি নিজেকে একজন ‘ময়লা সংগ্রহকারী’
বলে অভিহিত করেছেন এবং ‘‘পৌরসভার পরিষেবাকে উপেক্ষা করা আমাদের জনজীবনের একটি প্রবণতা’’
বলে নিন্দা করেছিলেন।
তিনি মাদ্রাজের শ্রমিকদের
উন্মাদনা, নোংরামি এবং রোদ-বাতাসহীন নোংরা বাড়িতে বসবাস ত্যাগ করতে বলেছিলেন। একটি
‘‘শৌচাগার একটি ড্রয়িং রুমের মতো পরিষ্কার হতে হবে।’’ খোলা জায়গায় মলত্যাগ শুধুমাত্র
নির্জন স্থানে মাটিতে খনন করা গর্তে করা যেতে পারে এবং ল্যাট্রিনে একটি কমোড ব্যবহার
করা দরকার। তিনি ‘‘পশ্চিম থেকে এটি শিখেছিলেন।’’ তিনি ‘‘একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর
হয়েছিলেন’’ বলে দাবি করেছিলেন এবং ফিনিক্স সেটেলমেন্টে (দক্ষিণ আফ্রিকা) মলকে জৈব
সারে রূপান্তরিত করার পরীক্ষা করেছিলেন এবং সবরমতী আশ্রমে এই পদ্ধতিটি চালিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন যে ‘‘পুরনো কুসংস্কার এবং পুরানো অভ্যাস’’- এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে,
টেকসই শিক্ষা এবং আইন প্রণয়ন অপরিহার্য।
‘‘আমাদের উন্মাদনা’’ শিরোনামে
একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন, বেশ কয়েকটি রোগের প্রকোপ সরাসরি উন্মাদনার সাথে সনাক্ত
করা যেতে পারে এবং ‘‘স্বরাজ কেবল সাহসী এবং পরিচ্ছন্ন লোকদের দ্বারাই হতে পারে।’’-‘‘একটি
পরিষ্কার শরীর একটি অপরিষ্কার শহরে বাস করতে পারে না।’’ ‘‘পরিচ্ছন্নতাই ধার্মিকতা’’।
তিনি চেয়েছিলেন স্যানিটারি অ্যাসোসিয়েশনগুলি নোংরা পরিষ্কার করার জন্য ‘‘ঝাড়ু, বেলচা
এবং বালতি’’ গ্রহণ করুক। আমাদের চারপাশ নোংরা করে আমরা গীতার শিক্ষা লঙ্ঘন করি।ময়লা
স্থানচ্যুত পদার্থ, যেমন মানুষের মলমূত্রকে ‘‘সোনার সারে’’ রূপান্তরিত করা যেতে পারে
এবং একটি শহরের চওড়া ও পরিষ্কার রাস্তা উন্নত স্বাস্থ্য, আয়ুষ্কাল এবং ভালো কিছুর
মাধ্যমে ‘‘একটি অর্থনৈতিক লাভ’’ সম্ভব। এমনকি তিনি বলেছিলেন, ‘‘যেখানে নোংরামি, কলঙ্ক
এবং দুঃখ সেখানে কোন সঙ্গীত হতে পারে না।’’
মায়াভরমে একজন নারীকে দুর্গন্ধভরা
পুকুর থেকে তার পাত্র ভর্তি করতে দেখে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘যেকোনো পৌর জীবনের প্রথম শর্ত
হল শালীন স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের অবিরাম সরবরাহ।’’ তিনি স্মরণ করেন কিভাবে
তার জন্মস্থানে একজন ইংরেজ প্রশাসক একদিনে রাস্তা থেকে ‘‘ভয়ংকরভাবে অশুদ্ধ গোবরের
স্তূপ’’ সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মূলত
দৈনিক স্নান এবং আমাদের ঘর পরিষ্কার রাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং, আমাদের গ্রামগুলি
গোবরের স্তূপ, আমাদের রাস্তাগুলি হাঁটার অযোগ্য, এবং আমাদের নদীগুলি অপরিষ্কার। কৃষ্ণা
নদী পার হওয়ার সময় তিনি শত শত লোককে তীরের কাছে মলত্যাগ করতে দেখেন কিন্তু একই স্রোত
থেকে স্নান ও পানীয় জল গ্রহণ করতেও দেখা যায় সেখানে। তিনি বলেছিলেন, মলকে সারে রূপান্তরিত
করা ‘‘একটি অর্থনৈতিক বর্জ্য’’ এবং ‘‘জাতীয় স্যানিটেশন সংরক্ষণ স্বরাজের কাজ।’’ স্যানিটেশনের
এই সংস্কার শেষ পর্যন্ত অর্থকরী হয়ে উঠেছিল।হরিদ্বার সম্পর্কে, তিনি বর্ণনা করেছেন
যে কীভাবে ‘‘চিন্তাহীন অজ্ঞ’’ লোকেরা এমনকি পবিত্র নদীগুলিকেও অপবিত্র করেছে এবং ‘‘ধর্ম,
বিজ্ঞান এবং স্যানিটেশন আইন লঙ্ঘন করেছে।’’ তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কীভাবে ল্যাট্রিন
এবং রান্নাঘর ‘‘একই কাজের বিভিন্ন দিক’’ এবং বিস্তারিতভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন কীভাবে
দুটি গর্ত তৈরি করতে হবে এবং এগুলিকে পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করতে হবে শৌচাগার থেকে সারে
রূপান্তরিত করার জন্য।
তিনি সম্ভবত প্রথম নেতা
যিনি বারবার জোর দিয়েছিলেন যে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের দায়িত্ব ব্যক্তিগত,
গার্হস্থ্য এবং কর্পোরেট স্তরে সমানভাবে প্রযোজ্য। তিনি এমনকি বলেছিলেন, আমরা যদি ‘‘আমাদের
নোংরা অভ্যাস থেকে নিজেকে পরিত্রাণ না করি এবং ল্যাট্রিন উন্নত না করি, আমাদের জন্য
স্বরাজের কোন মূল্য থাকতে পারে না।’’ তিনি
বর্জ্য বা ময়লাকে ‘‘বস্তু স্থানচ্যুত’’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন এবং অবিচল ছিলেন
যে, যতদূর সম্ভব, সমস্ত বর্জ্যকে দরকারি সম্পদ হিসেবে যথাযথভাবে পুনর্ব্যবহৃত করা উচিত।
এভাবে, তিনি চেয়েছিলেন সমস্ত মানুষের বর্জ্য, গোবর, আবর্জনা এবং অন্যান্য জৈব-ক্ষয়যোগ্য
বর্জ্য ‘সোনার মতো’ সারে রূপান্তরিত হোক। তিনি স্যানিটেশনের সমস্ত দিকগুলিতে একটি বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতি দিয়ে সমর্থন করেছিলেন এবং স্যানিটেশনের বিষয়ে পশ্চিমের কাছ থেকে শিখতে চেয়েছিলেন।
তিনি একজন ছাত্র হিসেবেও ‘‘পরিচ্ছন্নতা ধার্মিকতার পাশে’’ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু পরে
এটিকে ‘‘পরিচ্ছন্নতাই ধার্মিকতা’’য় পরিবর্তন করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে তার অনুসারীরা
প্রতিরোধযোগ্য রোগ, ভুল ব্যবস্থাপনা এবং বর্জ্য হিসেবে মূল্যবান সম্পদের ক্ষতির মতো
উপায়গুলির মাধ্যমে ঘটে যাওয়া ‘‘অর্থনৈতিক অপচয়ের পুরো বিষয়’’ গ্রহণ করুন। তিনি
ময়লা ফেলার কাজটিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছিলেন, এমনকি একজন মা তার সন্তানের জন্য
যা করতে পারেন তার চেয়েও উচ্চতর।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, ভারত সরকার এবং
রাজ্য সরকারগুলির পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে ড. বিন্দেশ্বর পাঠকের সুলভ
ইন্টারন্যাশনাল, ভারতে স্যানিটেশন বিপ্লবের কাজ করছে। সরকারি সংস্থাগুলি বিভিন্ন কর্মসূচি
গ্রহণ করছে, যা অবশ্যই জনজীবনে প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু চাহিদা ক্রমবর্ধমানভাবে বেশি।
গান্ধীজি ১৯১৫ সালে ভারতে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতার জন্য তাঁর আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
তখন থেকে ভারতের জনসংখ্যা ৭ থেকে ৮ গুণ বেড়েছে, ভারতীয় সমাজ ক্রমবর্ধমানভাবে নগরায়ণ
হয়েছে এবং আর্থ-সামাজিক কাঠামো আধুনিকীকরণ করা হচ্ছে এবং উন্নত দেশগুলির বৈশ্বিক মানের
দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই, স্যানিটেশনের অভাব এবং বর্জ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলির জটিলতা
বাড়ছে। অবশ্য ‘‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’’(২০১৪)
পরিচ্ছন্নতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।আগেই বলা হয়েছে, গান্ধীজির সবরমতী আশ্রম যেসব
ইতিহাসের সাক্ষী তার সঙ্গে নৈমিত্তিক পরিচ্ছন্নতার একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সেখানে
পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে কোনরকম সমঝোতা করা হতো না। সবরমতী আশ্রম থেকে প্রেরণা নিয়ে আজ পরিচ্ছন্নতাই
সকল ভারতীয়দের স্বভাব হয়ে উঠেছে। তাদের শিরা ও ধমনীতে, অস্তিত্ব ও ভাবনায়, আচার-আচরণে
পরিচ্ছন্নতা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। গান্ধীজি বলতেন, স্বাধীনতা ও পরিচ্ছন্নতার
মধ্যে তাঁর প্রথম পছন্দ পরিচ্ছন্নতা। তার মানে তিনি স্বাধীনতাকে অপরিচ্ছন্নতার হাত
থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন। এই অগ্রাধিকার ছিল মনোজগতের বিষয়। তিনি সুন্দর মন, সুস্থ
চিন্তার পূজারি ছিলেন। আর এখানেই তাঁর স্বচ্ছতার ধারণা মহিমান্বিত।
মন্তব্য করুন
নোবেল প্রাইজের জন্ম ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। সেই থেকে এ যাবৎকালে পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংঘটিত হয়েছে, বহু কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত হরেক রকমের চমকপ্রদ ঘটনা। নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যানকারীদের কথা শোনা যাক। লেখক-সাহিত্যিক জাঁ-পল সার্ত্র। তিনি ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করতে গিয়ে যে দু-চারটি বাক্য খরচ করেন, তাতেই উপলব্ধি করা যায়, তাঁর ব্যক্তিত্বের আকাশচুম্বী গভীরতা। জাঁ-পল সার্ত্র বলেন, ‘লেখকরা সমগ্র পৃথিবীর, তাঁদের কোনো প্রতিষ্ঠানের হওয়া উচিত নয়।’
১৯৭৩ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ভিয়েতনামী রাজনীতিক দিউথো। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন নীতি-নৈতিকতার বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনামে যুদ্ধবিরতি স্থাপনের জন্যে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল যৌথভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ও ভিয়েতনামী দিউথোকে।
কিন্তু বাস্তবিক অর্থে তখনও শান্তি স্থাপিত হয়নি। এই কারণে থো নোবেল শান্তি প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করেন।
নোবেল প্রাইজ পেয়েও যাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হন, সেই তাঁদের কথা শোনা যাক। সংখ্যায় তাঁরা চারজন। এদের তিনজনই জার্মানির। জার্মান শাসক এডলফ হিটলার তাঁদের নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করতে দেননি। এঁরা হলেন, অ্যাডলফ বাটেননানডট, গারহার্ড ডোমাগক ও
বরিস পাস্তারনাক। প্রথম তিনজন নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করতে পারেননি, অ্যাডলফ হিটলারের কারণে। শেষোক্ত জন সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের কারণে। জার্মান রসায়নবিদ অ্যাডল্ফ বাটেননানডট নোবেল প্রাইজে ভূষিত হয়েছিলেন, সেক্স হরমোন নিয়ে গবেষণার জন্য। আরেক জার্মান রসায়নবিদ রিচার্ড কাহন নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ভিটামিন নিয়ে কাজ করার জন্যে। প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারক হিসেবে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন জার্মান নাগরিক গারহার্ড ডোমাগক। এসবই ঘটেছিলো চল্লিশ দশকে অর্থাৎ হিটলারের রাজত্বকালে। অপরদিকে ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন রাশিয়ান লেখক বরিস পাস্তারনাক। তিনি নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করলেও সোভিয়েত সরকারের চাপে তা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন।সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় নোবেল শান্তি প্রাইজকে। রাজনৈতিক প্রকৃতির কারণে এই প্রাইজটি অন্য পাঁচটি প্রাইজের চেয়ে অনেক বেশি বিতর্ক তৈরি করেছে।
এই বিতর্কিত শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত ব্যক্তিদের বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুসও রয়েছেন।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল শান্তি প্রাইজে ভূষিত হন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন যার ভূমিকা বিশ্বময় বিতর্কিত। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশ) পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যাকে সমর্থন করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ক্ষিপ্র হয়ে ওঠার মূলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার। তিনি ত্রিশ লাখ বাঙালি হত্যার পরও পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে যখন শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন, তখননও তিনি কম্বোডিয়ায় বোমা বর্ষণ, দক্ষিণ আমেরিকায় সামরিক শাসনকে সমর্থন করছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন নোবেল কমিটির দু-জন সদস্য। নিউইয়র্ক টাইমস পুরস্কারটিকে আখ্যায়িত করে ‘নোবেল ওয়ার প্রাইজ’ হিসেবে।
১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পান অং সান সূচি। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে পার্লামেন্ট কক্ষেআততায়ীর হাতে নিহত তাঁর পিতা অং সান। মিয়ানমারের জাতির পিতা অং সানের কন্যা হিসেবে তিনি পরিচিত। শান্তিতে সূচির এ নোবেল প্রাইজ মূলত, নিজ দেশ মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের জন্য। কিন্তু সূচি মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঘটলো রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা। রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন এতোটাই হয় যে, রাখাইনের ঘটনাকে জাতিসংঘ গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ওয়াঙ্গারি মাথাই। প্রয়াত এই কেনিয়ান পরিবেশবাদী প্রথম আফ্রিকান নারী। ২০০৪ সালে নোবেল প্রাইজলাভ করেন। কিন্তু তার প্রাইজ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠে। যখন এইচআইভি ও এইডস নিয়ে তার একটি মন্তব্য সামনে চলে আসে। ওয়াঙ্গারি মাথাই বলেছিলেন, এইচআইভি ভাইরাস জীবাণু অস্ত্র হিসেবে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে, যার লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শেষ করা।
১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পান ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত। একইসাথে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন প্যারেজকেও নোবেল শান্তি প্রাইজে ভূষিত হন। সেনিয়ে তখন তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মূলত, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব অবসানে 'অসলো শান্তি চুক্তি'র জন্য তাদের যৌথভাবে এ নোবেল প্রাইজ দেয়া হয়েছিল। তাঁদের মনোনয়ন নিয়ে নোবেল কমিটিই বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারপরও নোবেল প্রাইজ দেয়া হলে প্রতিবাদে নোবেল কমিটির একজন সদস্য পদত্যাগ করেন।
২০০৯ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেয়া হয় বারাক ওবামাকে। এ প্রাইজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র নয় মাসের মাথায়। সমালোচকরা এ প্রাইজ দেওয়ার সিদ্ধান্তকে 'অপরিপক্ক' বলে তিরস্কার করেন। কারণ বারক ওবামার প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার ১২ দিনের মধ্যেই পুরস্কারের জন্য নাম জমা দেয়ার সময় উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নোবেল কমিটির পরিচালক গের লান্ডেটস্ট্যাড বিবিসিকে তখন বলেছিলেন, যে কমিটি ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বারাক ওবামা সয়ং নোবেল প্রাইজের খবরে আকাশ থেকে পড়েন। তিনি নিজের স্মৃতিকথায় ওই ঘোষণার প্রথম প্রতিক্রিয়া হিসেবে লিখেছেন "কিসের জন্য?" লক্ষনীয় বারাক ওবামার দুই মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র বাহিনী আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় যুদ্ধরত ছিল।
২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত হন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। ইরিত্রিয়ার সাথে দীর্ঘ দিনের সীমান্ত সংঘাত নিরসনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই এ পুরস্কারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। কারণ নিজে দেশের টাইগ্রের উত্তরাঞ্চলে সেনা মোতায়েন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েন। সেখানে লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। যাকে জাতিসংঘ একে 'হৃদয় বিদারক বিপর্যয়' হিসেবে আখ্যায়িত করে। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে শান্তিতে নোবেল প্রাইজে ভূষিত বাংলাদেশের ড. মুহাম্মদ ইউনুস। অর্থনীতিতে নোবেল না পেয়ে শান্তিতে কেনো নোবেল প্রাইজ, সে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তিনি এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে এ প্রাইজ লাভ করেন। গ্রামীণ ব্যাংকের অমানবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। ভুক্তভোগীদের চোখে গ্রামীণ ব্যাংক শোষণের হাতিয়ার আর শোষক ড. মুহাম্মদ ইউনুস। বহু মানুষ আর্থিকভাবে নিঃস্ব রিক্ত হয়েগেছে এই গ্রামীণ অর্থনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে। ড. ইউনুস স্বদেশে বিতর্কিত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন তিনি। মহামান্য রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমতি না নিয়ে নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করায়। ৩০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো নাগরিক কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোনো উপাধি, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।’
২০০৬ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে ড. ইউনুস ও তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক শান্তিতে নোবেল প্রাইজে মনোনীত বা নির্বাচিত হওয়ার আগে পরে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের কোনো অনুমতি বা অনুমোদন নেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় রাষ্ট্র হচ্ছে, সংবিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারি, আধা সরকারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামরিক বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যাংক, বীমাসহ সকল সায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে বুঝায়। নোবেল প্রাইজ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি নরওয়ে ও সুইডেনের সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। সেদেশের ব্যাংকিং খাত থেকে আসা সুদ বা লাভাংশ থেকেই নোবেল প্রাইজের আর্থিক ব্যয়নির্বাহ করা হয়। এছাড়াও আজ অবধি ড. ইউনুস বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনারে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অপর্ণ না করে সাংস্কৃতিক প্রথাও ভঙ্গ করেন। বারবার মনোনীত হয়েও নোবেল প্রাইজ পাননি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। সেই না পাওয়াদের মধ্যে অন্যতম মহাত্মা গান্ধী ও টলস্টয়। টলস্টয় জীবনকালে অত্যধিক জনপ্রিয় ও মেধাবী ছিলেন। লেভ নিকোলায়েভিচ টলস্টয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবারই সাহিত্যে নোবেল প্রাইজের জন্য এবং ১৯১০ সালে শান্তিতে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু একবারও নোবেল পাননি। যা নোবেল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা। রাশিয়ান সাহিত্যের যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হচ্ছেন টলস্টয়, পুশকিন ও গোর্কি। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।’
১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপ ভ্রমণকালে ভিক্টর হুগোর সঙ্গে টলস্টয়ের পরিচয়। হুগোর ‘লা মিজারেবল’ তার জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। যার প্রতিফলন ঘটে টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ উপন্যাসে। এই উপন্যাস লেখেন নেপোলিয়নের রুশ আক্রমণের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে, যেখানে তিনি তার যুদ্ধ ও শান্তি সম্পর্কে মতামত দিয়েছেন।
টলস্টয়ের একটি উপন্যাসের নাম ‘সাড়ে তিন হাত জমি’ হাজারটা উপন্যাসের সমান। ১৩ সন্তানের জনক টলস্টয়ের ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর জীবন অবলম্বনে লেখা অপূর্ব এক সৃষ্টি। টলস্টয় সাহিত্যিক কেবল নন, দার্শনিকও ছিলেন। তাঁর দর্শন ছিল চার্চের বিরুদ্ধে আসল ধর্মচর্চা করা এবং অভিজাততন্ত্রকে বর্জন করা। বিখ্যাত অক্টোবর বিপ্লবের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। একটি মৃত্যুদন্ড স্বচক্ষে দেখে টলস্টয় বলেন, ‘সত্যি কথা হলো রাষ্ট্র একটি ষড়যন্ত্র যা শুধু শোষণের জন্যই তৈরি হয়েছে।’ ‘দ্য মিডিয়েটর’ ‘চাইল্ডহুড’ ‘বয়হুড’ ও ‘ইয়ুথ’ টলস্টয়ের অনবদ্য রচনা।
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় ভারত জাতির পিতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে। অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন জমাদানের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীজিকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও।
ইতঃপূর্বে নোবেল শান্তি প্রাইজ মরণোত্তর কাউকে দেয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি মোতাবেক, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর শান্তিতে নোবেল দেয়া যেত। ফলে গান্ধীজিকে নোবেল দেয়ারও রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও, নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীজিকে শান্তিতে নোবেল প্রাইজ দেয়নি। এর পেছনে কারণ হিসেবে তারা বলে, গান্ধীজি কোনো সংগঠনের অংশীদার ছিলেন না, তিনি কোনো সম্পদ রেখে যাননি, কোনো উইলও করে যাননি, ফলে তার পুরস্কার গ্রহণ করার মতো কী নেই। এ কারণে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি শেষ পর্যন্ত একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর তারা জানায়, ‘কোনো যোগ্য জীবিত প্রার্থী না থাকায় এ বছর কাউকে পুরস্কারটি প্রদান করা হবে না।’
নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাড আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, ‘নোবেল প্রাইজ ছাড়াও চলে যায় গান্ধীজির। তবে গান্ধীজিকে ছাড়া নোবেল কমিটি নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।’
নরওয়েজিন নোবেল কমিটির সেক্রেটারি লিন্ডস্ট্যাডের মতে, ‘১০৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাদ পড়াটা (গ্রেটেস্ট অমিশন) হল নিঃসন্দেহে মহাত্মা গান্ধীর কখনও নোবেল প্রাইজ না-পাওয়া।’ পাঁচবার নোবেল প্রাইজের জন্য শর্টলিস্টেড হন গান্ধীজি। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দু বার। শতাব্দী ধরে নোবেল কমিটি যে ঘরে বসে প্রাইজপ্রাপকদের নাম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসছিলেন, সেই ঘরে বসেই লিন্ডস্ট্যাড জানান, ‘তবে এটা ঐতিহাসিক একটা সত্যি হয়ে থেকে গিয়েছে যে গান্ধী কখনও নোবেল পুরস্কার পাননি।’ তাঁর মতে, এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল নোবেল কমিটির সদস্যদের ইউরোপ-কেন্দ্রিক মনোভাব। গান্ধীজির স্বাধীনতা সংগ্রামকে ছোট করে দেখিয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন নোবেল কমিটির সদস্যরা। গান্ধীজির ‘সঙ্গতিহীন শান্তিবাদ’-এরও বিরোধিতা করেন তাঁরা। বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীজির গুরুত্বপূ্র্ণ ভূমিকা থাকলেও তাঁর সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়। লিন্ডস্ট্যাডের মতে, ১৯৪৮ সালে গান্ধীজিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হবে, এটা একরকম ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। তবে তার কিছুদিনের মধ্যেই চরমপন্থি মুসলিম বিদ্বেষী নাথুরাম গডসে তাঁকে হত্যা করে।
মহাত্মা গান্ধীর নোবেল পুরস্কার না জেতার কারণ সম্পর্কে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দৃষ্টিভঙ্গি বুঝি খুবই সংকীর্ণ ছিল? কমিটির সদস্যরা কি স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে নন-ইউরোপিয়ানদের সংগ্রামকে স্বীকৃতি প্রদানে নারাজ ছিলেন? নাকি তারা নিছকই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন যে মহাত্মা গান্ধীর হাতে প্রাইজ তুলে দিলে গ্রেট ব্রিটেনের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর যা-ই হোক, এ ব্যাপারে অনেকের মনেই কোনো সন্দেহ নেই যে মহাত্মা গান্ধীই হলেন ‘যোগ্য দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও শান্তিতে নোবেল না জেতার’ সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তাই তো ১৯৮৯ সালে যখন দালাই লামাকে শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়, তিনি ঘোষণা দেন যে গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবেই তিনি পুরস্কারটি গ্রহণ করছেন। ২০০৬ সালে, গান্ধীজির মৃত্যুর অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় পরে, নোবেল কমিটি জনসম্মুখে স্বীকার করে নেয়, মহাত্মা গান্ধীকে পুরস্কৃত না করা ছিল তাদের মস্ত বড় একটি ভুল।
লেখকঃ
সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।
মন্তব্য করুন
ভারতীয় ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্ট ‘হাসিনা সরকারকে টার্গেট করছে পশ্চিমা-অর্থায়নকৃত মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে যেটি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাংলা ইনসাইডারের পাঠকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে নিবন্ধটির প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হল।
কয়েক
ডজন এনজিও বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছে। এগুলোর
বেশিরভাগই চলে পশ্চিমা বিশ্বের
অর্থায়নে। আর এই সুস্পষ্ট
কারণে, তারা কোথা থেকে
পরিচালিত হয় সেটা তাদের
মনেও রাখতে হয়।
স্বাধীনতার
পর থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ
বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ নানান সময়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের
শিকার হয়েছেন। এর পাশাপাশি ধর্মীয়
মৌলবাদীদের দ্বারা নির্যাতিতও হয়েছেন তারা। তবে মানবাধিকার নিয়ে
কাজ করা এনজিওগুলো এসব
বিষয়ে কথা বলেছে এমন
কোনো নজির নেই।
সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বড় কয়েকটি ঘটনা
প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। যশোরের অভয়নগর কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, হিন্দুদের বাড়িছাড়ার ঘটনা এখনো সবার
মনে দাগ কাটে।
সংখ্যালঘু
নিপীড়নের এসব ঘটনায় পশ্চিমা
অর্থায়নে পরিচালিত কোনো এনজিও মানবাধিকার
প্রতিবেদন প্রকাশে এগিয়ে আসেনি। এনজিওগুলোর কার্যক্রমে এটা স্পষ্ট যে,
ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান নিয়ে পশ্চিমারা মোটেই চিন্তিত নয়।
তবে
ধর্মীয় মৌলবাদীদের পাশে দাঁড়াতে ভূমিকা
রাখতে দেখা গেছে এসব
এনজিওকে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে এসব এনজিও মৌলবাদীদের
পক্ষে মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে বাংলাদেশের
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করেছে
এমন অভিযোগও রয়েছে।
২০১৩
সালে, বাংলাদেশের একটি শীর্ষ ধর্মীয়
মৌলবাদী গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশকে ঘিরে
চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল দেশ এবং দেশের
বাইরে। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র
করে ‘অধিকার’ নামে একটি মানবাধিকার
সংস্থার একটি মিথ্যা মানবাধিকার
প্রতিবেদন বিশ্ব মিডিয়ার উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল।
সরকার
তখন এই মানবাধিকার সংস্থাটির
বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়।
এই মামলায় সম্প্রতি প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মীয় মৌলবাদী
সংগঠন হেফাজত ইসলামের করা রাইটস রিপোর্ট
ছিল মিথ্যা।
এ কারণে সংগঠনটির প্রধানসহ এনজিওর দুই কর্মকর্তাকে কারাগারে
পাঠানো হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব এখন এই দুই
সাজাপ্রাপ্তের সাজার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে! বিষয়টা নিয়ে এখন লেখালেখি হচ্ছে
বিশ্ব মিডিয়ায়। এই নিবন্ধটি সেই
ঘটনার বিশ্লেষণ তুলে ধরছে।
মিথ্যা
ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে মানবাধিকার
প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের ভাবমূর্তি
ক্ষুণ্ন করার অপরাধে ‘অধিকার’
সম্পাদক আদিলুর রহমান খানের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমালোচনা করেছে বাংলাদেশ।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঘোষিত
রায়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এএম জুলফিকার হায়াত
বলেন, তার পর্যবেক্ষণে- প্রতিবেদনের
মাধ্যমে আদিলুরের সংগঠন মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেশের
ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন,
এই রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের একটি মিথ্যার পরাজয়
ঘটেছে।
৫ মে ২০১৩ তারিখে
ঢাকায় ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে সংঘটিত সহিংসতা ও দাঙ্গার বিরুদ্ধে
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান সম্পর্কে ‘অধিকার’ একটি অপপ্রচারমূলক প্রতিবেদন
প্রকাশ করে। যেখানে বলা
হয়, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে সমাবেশে হেফাজতে ইসলামের অন্তত ৬১ সদস্য নিহত
হয়েছেন। যদিও এই বানোয়াট
দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ সরকারের
কাছে উপস্থাপন করতে পারেননি আদিলুর।
বিশ্লেষকরা
বলছেন, আদিলুরের নেতৃত্বাধীন সংগঠন ‘অধিকার’ মূলত ক্ষমতাসীন সরকারকে
বিব্রত করতে এবং মানবাধিকার
ইস্যুতে দেশকে কলঙ্কিত করতে এই ভুয়া
প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন
প্রকাশের দায়ে আদালতের দেওয়া কারাদণ্ডে তা আরও স্পষ্টভাবে
প্রমাণিত হয়েছে।
সেদিন
কী ঘটেছিল শাপলা চত্বরে?
৫ মে, ২০১৩ তারিখে
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে একটি সমাবেশ ও
'ঢাকা অবরোধ' কর্মসূচির আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম।
বাংলাদেশে
যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গঠিত গণজাগরণ মঞ্চের
নেতাকর্মীদের নাস্তিক ও মুরতাদ ঘোষণা
করে তাদের শাস্তির দাবি জানায় সংগঠনটি।
হেফাজতে ইসলাম সারাদেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার
হাজার হাজার নিরীহ ছাত্রকে এই সমাবেশে নিয়ে
আসে। সমাবেশে ১৩টি সংবিধানবিরোধী ও
মধ্যযুগীয় পয়েন্ট ঘোষণা করা হয়। সরকার
পতনের হুমকিও দেওয়া হয়েছিল সেই সমাবেশ থেকে।
হেফাজতের
কর্মসূচি শুধু সমাবেশে সীমাবদ্ধ
ছিল না। সকাল থেকেই
ঢাকার প্রবেশপথ অবরোধের পাশাপাশি নিরাপত্তা চেকপোস্টে আগুনও দেওয়া হয়। বায়তুল মোকাররম
মার্কেট, ট্রাফিক পুলিশ অফিস, হাউস বিল্ডিং, জনপ্রশাসন
মন্ত্রণালয়ের পরিবহন পুল, মুক্তি ভবনসহ
অনেক প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটে ভাঙচুর
চালানো হয়।
অগণতান্ত্রিক
প্রক্রিয়ায় সরকার পতনের পরিকল্পনায় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট হেফাজতের এ
আন্দোলনকে সর্বোচ্চ সমর্থন দেয়। দিনভর চলা হেফাজত ইসলামের
নাশকতা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয়
দেয়। নির্ধারিত সময়ে সমাবেশ শেষ করে তাদের
বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য
অনুরোধ জানানো হয়।
কিন্তু
সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
বারবার শান্তিপূর্ণ আহ্বান উপেক্ষা করে শাপলা চত্বরে
রাত কাটানো এবং তাণ্ডব চালিয়ে
যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে হেফাজত।
জনগণের জানমাল রক্ষায় ৫ মে রাতে
অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে কমলাপুর স্টেশনমুখী সড়ক ও বঙ্গভবনের
পাশের সড়ক ফাঁকা রেখে
দৈনিক বাংলা মোড় এলাকা, দিলকুশা,
ফকিরাপুল, নটরডেম কলেজ এলাকায় অবস্থান
নেয়।
অভিযান চলাকালে সমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হেফাজত কর্মীরা কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই শাপলা চত্বর ত্যাগ করে। প্রাণহানি এড়াতে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পুলিশের ধারণামতে অভিযানে ১১ জন নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে পথচারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন। তাদের অধিকাংশই নিহত হয়েছিলেন দিনব্যাপী সংঘর্ষের ফলে। (প্রথম পর্ব)
মন্তব্য করুন
গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতীয়রা স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, কিন্তু তাঁর একটি পরিচ্ছন্ন ভারতের স্বপ্ন এখনও অপূর্ণ। অবশ্য ভারত সরকার দ্বারা প্রচলিত একটি জাতীয় প্রকল্প হিসেবে ‘‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’’(২০১৪) ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৮ সালে লিখেছিলেন-‘‘গত চার বছরে(২০১৪-২০১৮) ১৩০ কোটি ভারতীয় স্বচ্ছ ভারত অভিযানের মধ্য দিয়ে মহাত্মা গান্ধীকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন।