"দিলখুশা" মানে "মনপ্রফল্লু"। ১৮৬৬ সাল।
ঢাকার নওয়াব খাজা আবদুল গণি। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খাজা আহসানউল্লাহ। পিতা পুত্রপ্রেমে এতটাই আবেগাপ্লুত ছিলেন যে, পুত্রের মনোরঞ্জনে একটি বাগানবাড়ি বানাতে চাইলেন। জনৈক স্মিথের কাছ থেকে কিনলেন ঢাকা শহরে ৫৪ একর ৫০
শতাংশ জমি। উর্দুভাষী নওয়াব পুত্রের মনপ্রফুল্ল রাখতে এলাকার নাম দিলেন "দিলখুশা বাগানবাড়ী"। আর সেটাই
কালক্রমে হয়ে উঠলো বঙ্গভবন। "রঙমহল" বলেও এর পরিচিতি ছিল।
১৯০৬ নওয়াব সলিমুল্লাহর কাছ থেকে বার্ষিক ১১ হাজার টাকায়
লীজ নিলেন ভারত ভাইসরয় বড়লাট লর্ড কার্জন। নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের
শাসনকর্তার বাসভবন রূপে গড়ে তোলা হলো। নাম হলো "ছোটলাট ভবন"। ১৯৪৭ সালে
"গভর্নর হাউজ"। ১৯৭২ সালের
১২ জানুয়ারী "বঙ্গভবন" নামকরণ করলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ওদিন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেন এবং সয়ং প্রধানমন্ত্রী হলেন। "গণভবন"-কে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে
পরিণত করলেও অফিস হিসেবেই ব্যবহার করতেন বঙ্গবন্ধু। তা়ঁর বাসভবন ছিল বরাবর ধানমন্ডিস্থ বত্রিশ নম্বর সড়কের বাড়িটিই। অপরদিকে দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি
আবু সাঈদ চৌধুরী পরিবারসহ বঙ্গভবনের বাসিন্দা হন। সেই থেকে এটি রাষ্ট্রপতির বাসভবন। আলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবন হিসাবে বঙ্গভবনের যাত্রা শুরু হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুও ছিল লম্বা সময় ধরে। যখন দুই যুগেরও বেশি সময় দেশ পরিচালিত হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত
সরকার ব্যবস্থার অধীনে। সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তিত হলে ক্ষমতা ও গুরুত্ব হারায়
বঙ্গভবন। রাষ্ট্রপতি হয়ে যান নিয়মতান্ত্রিক রাষ্টৃপ্রধান মাত্র। ১৯৯১ সাল থেকে দেশ পরিচালিত হচ্ছে সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে
লেফটেন্যান্ট গর্ভনর বা গর্ভনররাই ছিলেন
এ দেশের ক্ষমতার প্রকৃত মালিক। সেই অর্থে ১৯০৬-২০২৩ সময়ের মধ্যে গভর্নর হাউজ বা বঙ্গভবনই
প্রায় নব্বই বছর ক্ষমতার উৎস ছিল। বিগত একশত ষোল বছরে বঙ্গভবনে যাঁরা বাসিন্দারা- তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের। যাদের
মধ্যে অবশ্য বিস্ময়করভাবে একজনও নেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। অধিকাংশই খ্রীস্ট ধর্মালম্বী বিভিন্ন গোত্রীয় ইংরেজ। অবশিষ্টরা মুসলিম সূন্নী-ইসলাম ধর্মালম্বী। ১৯৪৭ দেশবিভাগপূর্ব বাংলা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের সর্ববৃহত্তম প্রদেশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাভাষী
বাঙালী অথবা হিন্দি বা অসমীয় ভাষাভাষী
কোন অবাঙালী-হিন্দু বাংলার গভর্নর বা রাষ্ট্রপতি হতে
পারেননি। যে কারণে ঢাকার
গভর্নর হাউজ তথা বঙ্গভবনের বাসিন্দা হননি কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। বঙ্গভবনের যারা বাসিন্দা হয়েছেন, তারা কেউ ইংরেজ বিট্রনী, কেউ উর্দুভাষী পশ্চিম-পাকিস্তানী, কেউবা পূর্ব পাকিস্তানী বাংলাভাষী বাঙালী এবং স্বাধীনত্তোর যাঁরা হয়েছেন তাঁরা সকলেই বাংলাদেশী বাঙালী মুসলমান।
১৯০৫ সালে থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ
ও আসাম এবং বাংলা প্রাদেশিক সরকারের হয় লেফটেন্যান্ট গভর্নর,
নয়তো পূর্ববঙ্গ- তথা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং নয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
আজকের যে বঙ্গভবন তা
রূপে-রঙে-নামে শুধু নয়, ক্ষমতার উত্থান-পতনের চরিত্রেও তার রঙ বদলেছে। রূপে
ও রঙে পরিবর্ধিত হয়েছে অবকাঠামোগত স্থাপত্য। সর্বপ্রথম ১৯০৬ সালের ১৮ জানুয়ারি এই
বাসভবনে বাসিন্দা হিসাবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক
সরকারের লেফটেন্যান্ট গভর্নর বামফিল্ড ফুলার সংবর্ধিত হন। সেই থেকে"দিলখুশা বাগানবাড়ি" লোকমুখে পরিচিতিলাভ করে "ছোটলাট ভবন" হিসেবে। এরপর লাটভবনের বাসিন্দা হন স্যার ল্যান্সলট
হেয়ার ও চার্লস স্টুয়ার্ট
বেইলি। তখন প্রবল আন্দোলন বঙ্গভঙ্গ এর বিরুদ্ধে। এই
তিন শাসকের নামে ঢাকার তিনটি রোড এখনও রয়েছে। বৃটিশ পার্লামেন্ট ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে দুই
বাংলাকে আবার একীভূত করে দেয়। ফলে ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী
রূপে যে মর্যাদা পেয়েছিল
তা লুপ্ত হয়ে যায়। তবে বাংলার রাজধানী আবার কলকাতা হলেও ছোটলাট ঢাকায় এলে এখানেই থাকতেন। ১৯৪৭ সালে আবার বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয় পূর্ববঙ্গ ও
পশ্চিম বঙ্গ নামে। স্বাধীন পাকিস্তানের প্রদেশ হিসেবে অঙ্গীভূত হয় পূর্ববঙ্গ। পশ্চিম
বঙ্গ অন্তর্ভুক্ত হয় স্বাধীন ভারতে।
পূর্বপাকিস্তানের প্রথম গর্ভনর হয়ে আসেন স্যার ফ্রেডারিক চার্লমার বোর্ন। ছোটলাট ভবন পরিচিতি লাভ করতে থাকে গর্ভনর হাউজ রূপে। ১৯৫০ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত
স্যার বোর্ন দায়িত্ব
পালন করেন। সেই থেকে গর্ভনর হাউজের বাসিন্দা হন বিচারপতি আবু
সালেহ মোহাম্মদ আকরাম, মালিক ফিরোজ খান নুন (পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী), চৌধুরী খালেকুজ্জামান, আব্দুর রহমান সিদ্দিকী (অস্থায়ী), মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি), বিচারপতি স্যার টমাস হার্বার্ট এলিস, বিচারপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন, বিচারপতি আমিরউদ্দিন, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মোহাম্মদ হামিদ আলী (অস্থায়ী), সুলতানউদ্দিন আহমদ, জাকির হোসেন, লেঃ জেনারেল আজম খান, সৈয়দ হাসিম রেজা, গোলাম ফারুক, আব্দুল মোনয়েম খান, ডঃ মীর্জা নূরুল
হুদা, মেজর জেনারেল মোজাফফর উদ্দিন, ভাইস এডমিরাল এস এম আহসান,
সাহেবজাদা এম ইয়াকুব খান,
লেঃ জেনারেল টিক্কা খান ও ডাঃ এ
এম মালিক। এ়ঁরা গভর্নর হাউজে বসেই পূর্বপাকিস্তান শাসন বা শোষণ করতেন।
১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের
আত্মসমর্পণের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর গভর্নর
পদটির অস্তিত্ব লুপ্ত হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের অনুগত গভর্নর
ছিলেন ডাঃ আব্দুল মোত্তালিব মালিক। তিনি গর্ভনর হাউজ থেকে পালিয়ে রেডক্রস ভুক্ত নিরাপদ জোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং পরবর্তীতে দালাল আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত হন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণকারী
অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
আহমদ ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর রাজধানী
কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করে গভর্নর হাউজে ওঠেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হবার পর ১৯৭২ সালের
১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে
প্রধানমন্ত্রী হন এবং দেশে
সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
নতুন রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু
সাঈদ চৌধুরী। কিন্তু তিনি নিজেকে ক্ষমতাহীন মনে করে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ
করেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন স্পীকার মোহাম্মদ
উল্লাহ। এই দুই রাষ্ট্রপতিই
বঙ্গভবনে থেকেছেন সপরিবারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সাংবিধানিক
বিপ্লব সংঘটিত করে রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেন।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ উল্লাহ
দু'জনই মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলেও বঙ্গভবন তাঁর আবাসভূমি হয়ে ওঠেনি। বরং তিনি অরক্ষিত ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কের বাসভবনেই ছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কতিপয়
উচ্ছৃঙ্খল বিপদগামী সেনা সদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হন।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অপরাহ্ন
দেড়টায় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমার 'বৈদ্যনাথপুর" গ্রামের আম্রকুঞ্জে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি (কারাবন্দী) সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ রাষ্ট্রপতি
(অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণকারী
সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির
দায়িত্বপালন করেন। ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী কিশোরগঞ্জে
জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ নজরুল ২২ ডিসেম্বর থেকে
১২ জানুয়ারী পর্যন্ত বঙ্গভবনেই ছিলেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি থেকে শিল্পমন্ত্রী হন। বাকশাল হলে তিনি উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১৯২১ সালে টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি করলেও তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করে পদত্যাগ করেন ১৯৭৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর। স্পীকার
মোহাম্মদ উল্লাহকে তখন রাষ্ট্রপতি
করা হয়। ১৯২১ সালে নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণকারী
মোহাম্মদউল্লাহর স্বাক্ষরেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী দেশে
জারি করা হয় রাষ্ট্রপতি শাসিত
সরকার ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে রাষ্ট্রপতি হন ১৯১৯
সালে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণকারী খন্দকার মোশতাক আহমদ। সিজিএস বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ব্যর্থসামরিক অভ্যুত্থানে ৮১ দিনের মাথায়
খন্দকার মোশতাকের পতন ঘটে। এর আগেই খন্দকার
মোশতাক তোপের মুখে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন খালেদ মোশাররফকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার এক সপ্তাহের ব্যবধানে
রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক কর্তৃক সেনাপ্রধান হওয়া জেনারেল জিয়াউর রহমান তখন গৃহবন্দী। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি
মোশতাকের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর খুনীরাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী,
অন্যতম মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের "চতুর্থস্তম্ভ" বলে অভিহিত এই জাতীয় চারনেতার
হত্যার খবরে দৃশ্যপট পাল্টে যায় এবং নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের পছন্দে ১৯১৬ সালে রংপুরে জন্মগ্রহণকারী দেশের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। খন্দকার মোশতাককে করা হয় পদচ্যুত। ৭
নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাস থেকে শুরু হয় আরেকটি পাল্টা
সামরিক অভ্যুত্থান- "সিপাহী জনতা ভাই ভাই অফিসারদের রক্ত চাই" হত্যানীতির ভিত্তিতে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের গণবাহিনী
এবং জাসদপন্থী কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এ অভ্যুত্থান সংঘটিত
করে। খালেদ মোশাররফকে তাঁর কয়েকজন সঙ্গীসহ হত্যা করে জেনারেল জিয়াকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করে সেনাপ্রধান জিয়াকে কাঁধে তুলে ট্যাংকবহর সহকারে রাজধানীতে মিছিল করে। তারা রাষ্ট্রপতি পদে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে অধিষ্ঠিত রেখেই জেনারেল জিয়াকে দিয়ে ১২ দফা বাস্তবায়নের
মাধ্যমে ক্ষমতাদখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে জাসদীয় গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক
সংস্থা। কিন্তু ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী বগুড়ায়
জন্মনেয়া জেনারেল জিয়া অভ্যুত্থানকারীদের দাবী অগ্রাহ্য করে উল্টো
মুক্তিদাতা কর্নেল তাহেরকেই ফাঁসিতে
ঝুলিয়ে দেন এবং সামরিক আদালতের মাধ্যমে জাসদের প্রবক্তা সিরাজুল আলম খানসহ শীর্ষ নেতাদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডাদেশ দেন। তন্মধ্যে জাসদ সভাপতি মেজর (অবঃ) এম এ জলিলকে
যাবজ্জীবন, সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রবকে দশ বছর, গণবাহিনী
প্রধান হাসানুল হক ইনুকে সাত
বছর দণ্ডাদেশ
দেয়া হয়। এভাবেই জাসদের ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারী বগুড়ায়
জন্মগ্রহণকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি সায়েমকেও হটিয়ে প্রথমে ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধান
সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি দখল করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমকে পদচ্যুত করে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির
পদেও আসীন হন। জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান তিন
পদে থেকেই। সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীকে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জেনারেল জিয়া।
প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধু হত্যার সপ্তাহের ব্যবধানে সেনাপ্রধান কেএম শফিউল্লাহর আনুগত্য থাকা সত্ত্বেও খুনীদের পছন্দে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান করেন। একই দিন ২৪ আগস্ট পূর্ণমন্ত্রীর
মর্যাদায় রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন জেনারেল ওসমানী। তিনি বঙ্গবন্ধু শাসনামলে নৌ চলাচল মন্ত্রীর
পদ হারিয়ে ছিলেন এবং সংবিধান চতুর্থ সংশোধনীর প্রতিবাদে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে বহুল আলোচিত ছিলেন। ৩ নভেম্বর জাতীয়
চার নেতা হত্যাকান্ডের খবরে কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন পদাতিক বাহিনী বঙ্গভবনে দরজা ভেঙে মন্ত্রিসভা কক্ষে প্রবেশের পর রাষ্ট্রপতি মোশতাকের
দিকে স্টেনগান তাক করে অকথ্য গালিগালাজ করে হত্যায় উদ্যত হলে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল ওসমানী তাকে রক্ষা করেন এবং তার অনুরোধেই বঙ্গবন্ধুর খুনীদেরও বঙ্গভবন থেকেই বিমানে করে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ।
বলা বাহুল্য দ্বিধাবিভক্ত ও দিকভ্রান্ত আব্দুল
মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী
লীগ সেই জেনারেল ওসমানীকেই রাষ্ট্রপতি পদে সমর্থন দিয়ে নৌকা প্রতীক দিয়ে দেয়। স্পীকার মালেক উকিল মোশতাক সরকারের প্রতি আস্থা রেখেই স্পীকারদের এক আন্তঃমহাদেশীয় সম্মেলনে
যোগ দেন এবং যোগদান শেষে লন্ডনে সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু হত্যা প্রসঙ্গে তোপের মুখে পড়ে বলেন,"দেশ ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।"
বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি হয়ে
৬ নভেম্বর জাতীয়
সংসদ বাতিল করেন। খালেদ মোশাররফের সামনে একটি সাংবিধানিক পদ খোলা ছিল
- চাইলে তিনি স্পিকার মালেক উকিলকেই রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারতেন। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী মনসুর
আলী ৩ নভেম্বর নিহত
হওয়ার পর স্পীকারই ছিলেন
রাষ্ট্রপতি পদের দাবিদার। প্রকৃতপক্ষে খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফেরাতে চাননি। তার মা বরং জাতীয়
চার নেতা হত্যার প্রতিবাদে বের হওয়া মিছিলে শামিল হওয়ার খবর শুনে নিজের পতনের পদধ্বনিই শুনতে পেয়েছিলেন।
জেনারেল জিয়া, জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল তাহের
মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর উত্তমেরই লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা। তিনজনই পরিচালিত হচ্ছিলেন অবৈধ পন্থায়। জিয়া ক্ষমতার স্বাদ পেলেও ১৯৮১ সালের ৩০ মে মুক্তিযুদ্ধের
আরেক বীর উত্তমের হাতেই নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হন। ফিরে আসছি মূল বিষয়ে। জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে পদচ্যুত রাষ্ট্রপতি সায়েমেরই বিশেষ সহকারী বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে উপরাষ্ট্রপতি করেন। জিয়া নিহত হলে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন। জেনারেল জিয়া বঙ্গভবনকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করলেও পরিবার নিয়ে বাস করতেন ক্যান্টনমেন্টেই। ১৯০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্ম নেয়া আব্দুস সাত্তার ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি
নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ
প্রার্থী ডঃ কামাল হোসেনকে
হারিয়ে। তাঁরও সুখ সইলো না। তাঁকেও বঙ্গভবন ছাড়তে হয়। জেনারেল জিয়া কর্তৃক নিযুক্ত সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঘুম হারাম করে দিয়ে বঙ্গভবনে নীরব সামরিক অভিযান চালালে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। জেনারেল
এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ২৭ মার্চ রাষ্ট্রপতি
পদে বসিয়ে দিলেন দূরসম্পর্কের আত্মীয় বিচারপতি আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে। ১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী রাষ্ট্রপতি চৌধুরীরও বিদায় ঘটলো অসৌজন্যমূলকভাবে। বঙ্গভবন ত্যাগ করতে হলো তাঁকেও। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রধান
সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদ নিজেই রাষ্ট্রপতির পদ দখলে নিলেন।
১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারী জন্মনেয়া
এরশাদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও দিলেন। যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর
খুনী কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানও তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় হাফেজ্জী হুজুরের
সঙ্গে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হয়। জেনারেল এরশাদও বঙ্গভবন ব্যবহার করলেও পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন ক্যান্টনমেন্টেই। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর তা়ঁকে পদত্যাগ
করতে হয় তিনজোটের রূপকথার
আলোকে। উপরাষ্ট্রপতি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ পদত্যাগ করলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। তারপর এরশাদ পদত্যাগ করলে উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন অস্থায়ী
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গভবনে থাকতেন পরিবার নিয়ে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয়
সংসদ নির্বাচনের পর সরকার পদ্ধতি
নিয়ে তিনজোটের ঐতিহাসিক রূপরেখা নিয়ে অচলাবস্থা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন বিএনপি, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ
তিনজোটের রূপরেখার ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ভোটদান করে দেশে
সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে। অবসান ঘটে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতির। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯৯১
সালের ৮ অক্টোবর সংসদ
সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি হন স্পীকার আব্দুর
রহমান বিশ্বাস। ১৯২৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম
আব্দুর রহমান বিশ্বাস প্রথম মেয়াদ পূর্ণ করা দেশের রাষ্ট্রপতি। তবে ক্ষমতাসীন বিএনপির সঙ্গে তার সম্পর্কের টানাপোড়েন চলে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিল পাস করে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিতে হয় ক্ষমতাসীন বিএনপিকে।
প্রতিরক্ষা এসময় রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যাস্ত হয়। প্রধান উপদেষ্টা (প্রধানমন্ত্রী) হন সাবেক প্রধান
বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। ওই সময় সম্ভাব্য
একটি সামরিক অভ্যুত্থান রাষ্ট্রপতি রহমান বিশ্বাস নস্যাৎ করে দেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমসহ কয়েকজন জিওসিকে জেনারেলকে বরখাস্ত করার মাধ্যমে। প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯৬
সালের ১২ জুনের সাধারণ
নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করেন। ১৯৯৬
সালের ৯ অক্টোবর সংসদ
সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ১৯৩০ সালের
১ ফেব্রুয়ারী নেত্রকোনায় জন্মগ্রহণকারী বিচারপতি
সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি সপরিবারে বঙ্গভবনেই থাকতেন। ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রয়ারি জন্মনেয়া
সাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুরত্বের সৃষ্টি হয়। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনকে
আওয়ামী লীগ "সালসা" নির্বাচন বলে অভিহিত করে। সা- মানে রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন, ল-মানে প্রধান
উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান এবং সা- মানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ সাঈদ। বিএনপি-জামাত টু থার্ট মেজররিটি
নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্বে সরকার গঠন করে। ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি
হন অধ্যাপক ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর মুন্সিগঞ্জে
জন্মগ্রহণকারী বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে কয়েকটি নীতিগত প্রশ্নে বিএনপির মতদ্বৈততার সৃষ্টি হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতির মৃত্যুবার্ষিকীর বানীতে
জিয়াউর রহমানকে "স্বাধীনতার ঘোষক" না বলা, জিয়ার
মাজার জিয়াররত করতে না যাওয়া ইত্যাদি এ দ্বন্দ্বের কারণ।
শেষ পর্যন্ত যে সংসদ কর্তৃক
তিনি নির্বাচিত হন সেই সংসদের
সরকারি দলই অভিশংসনের হুমকিপ্রদান করে এবং বিএনপি সংসদীয় দলের সভায় তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। বদরুদ্দোজা চৌধুরী ২০২০ সালের ৬ জুন রাষ্ট্রপতির
পদ ত্যাগ করেন। বদরুদ্দোজা চৌধুরী এরপর বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। ফলে অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
হন স্পীকার
ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার। তিনি তিনমাস দায়িত্ব পালনকালে বঙ্গভবনে থাকেননি। বেইলীরোডে স্পিকারের বাসভবনেই থাকতেন।
২০০২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি
হন ডঃ ইয়াজউদ্দীন আহমেদকে।
১৯৩১ সালের ১ ফেব্রুয়ারী মুন্সিগঞ্জে
জন্মনেয়া ইয়াজউদ্দিন মহাবিতর্কের অবতারণা করেন। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদগ্রহণে বিচারপতি কেম হাসান অস্বীকৃতি জানালে ডঃ ইয়াজউদ্দিন নিজেই
প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করেন।
২০০৬ সালের ২২ জুলাই একতরফা
সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও মতলব আঁটলে মহাজোট তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী মানে
ওয়ান ইলেভেন সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রপতি ডঃ ইয়াজউদ্দিনকে বাধ্য
করা হয় প্রধান উপদেষ্টা
পদ ছাড়তে। সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে প্রধান উপদেষ্টা হন বাংলাদেশ ব্যাংকের
সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদ। নির্বাচনও বাতিল করা হয়। নতুন করে ভোটার তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়। হঠাৎ করেই সামনে নিয়ে আসা হয় "টু মাইনাস থিউরি।"
অর্থাৎ শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা
জিয়াকে রাজনীতি থেকে বিদায় করার ষড়যন্ত্র। শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে কারাবন্দী করা হয়। পরে বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করে কারাবন্দী করা হয়। পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নেয়। খেলার মাঠের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে সংঘর্ষ হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের।
সঙ্গে আস্থার সংকটে পড়ে সেনাবাহিনী প্রধান মইন ইউ আহমেদ ও সেনাসমর্থিত
ফখরুদ্দিন সরকারের। শুরু হয় দুই নেত্রীর
পৃথক মুক্তির
আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগ একাই টুথার্ট মেজররিটি ছাড়িয়ে যায়।
বিএনপি পায় মোটে ২৯টি আসন।
ইতিমধ্যে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও বাতিল ঘোষিত হয়েছিল, তার আলোকে সংসদে সংবিধান সংশোধন বিলও পাস হয়ে যায়। সুপ্রিমকোর্টের রায় অনুযায়ী বাহাত্তরের মূলনীতিও পুনঃস্থাপিত হয় সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে দলের প্রবীন নেতা জিল্লুর রহমানকে। ১৯২৯ সালের ৯ মার্চ কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণকারী জিল্লুর রহমান ২০১৩ সালের ২০ মার্চ লন্ডন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনিও বঙ্গভবনে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর স্পীকার অ্যাডভোকেট মোঃ আব্দুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জে জন্ননেয়া আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি দুই মেয়াদই বঙ্গভবনের বাসিন্দা। তাঁর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন। তিনি আগামী ২৪ এপ্রিল তার শপথ নিবেন। ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনায় জন্মগ্রহণকারী সাহাবুদ্দিন দেশের ২২ তম রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবন হিসাবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হোক, আর নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানের আলংকারিক শোভাবর্ধনকারী হোক, বঙ্গভবন আমাদপর অনুভূতির স্থল। যার আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে উত্থানপতনের স্মৃতিচিহ্ন আর বঙ্গভবনের প্রাচীন ইতিহাস।
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১০:০০ এএম, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি
প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর
রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা
করবেন।
প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে
আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা
নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর। আমার ধারণা যারাই প্রথম আলো কিনেন না
কেন তারা প্রথম দিকে মতিউর রহমান সাহেবকে রাখলেও পরবর্তীতে ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে
সম্পাদক পরিবর্তন করবে। আর প্রথম আলো যদি কোন যুক্তিপূর্ণ লোকের কাছে দেয় তাহলে আমার
মতে এখানে সম্ভবত আনিসুল হক সাহেব সম্পাদক হবেন। কারণ তার প্রতি লোকের অনেক শ্রদ্ধাবোধ
আছে এবং তিনি সবসময় একটা রেড লাইন রক্ষা করে চলেন। এটা আমরা সকলেই জানি। তার সাথে
অনেকেরই ভালো সম্পর্ক এবং তিনি খুবই জ্ঞানী
লোক।
এর আগে মতিউর রহমান যখন একতা থেকে আজকের কাগজে যান, তখন তার উদ্দেশ্যই
ছিল যে, একটি পত্রিকা কীভাবে চলে সেটা শেখা এবং এখান থেকে একসাথে সাংবাদিক নিয়ে বেরিয়ে
যাওয়া। তিনি সেটা করেছিলেন। তারপর ভোরের কাগজ থেকে একই কাজ করেছেন। সুতরাং তার সত্যিকারের
নীতিবোধ বলতে যেটা বোঝায় সেটা দুর্ভাগ্যবশত তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।
তিনি এক সময় কমিউনিস্টদের সাথে থাকলেও এখন তার চেয়ে বড় দক্ষিণপন্থী
পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়াই কঠিন। এ কারণে প্রথম আলো যে বিক্রি হবে এই ব্যাপারে সাধারণ লোকের
ভিতরে এখন আর কোন সন্দেহ নেই।
এখন প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টারের কী হবে এই নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে
এবং এই আলাপ আলোচনা খুব দীর্ঘদিন যে চলবে তা না। আমার মনে হয় জুন-জুলাই মাসের ভিতরেই
এর একটা ফয়সালা হয়ে যাবে। কারণ স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি যে, একটি পত্রিকা পাঠকপ্রিয়তা
পেতে বেশ সময় লাগে। এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার না। আবার ঠিক তেমনিভাবে যখন পাঠকপ্রিয়তা
কমতে থাকে সেটাও একদিন দুইদিনে হয় না। ধীরে ধীরে হয়। এই মিডিয়া জগতের নিয়মই তাই।
আমি ১৯৬১ সালে পত্রিকা বলতে শুধুমাত্র ইত্তেফাক এর কথাই জানতাম।
সেই ধারণা থেকে বলতে পারি এখন প্রথম আলোর যদি কিছু কর্মী এর চেয়ে ভালো কোন সুযোগ সুবিধা
দেখেন তাহলে তারা বিক্রি হওয়ার আগেই চলে যাবেন। কারণ স্বাভাবিকভাবেই একজন সাংবাদিকের
একটা ক্যারিয়ার আছে এবং প্রথম আলোর মতো পত্রিকাতে কাজ করে তিনি তো যে কোন পত্রিকায়
যেতেও পারবেন না। তার কারণ গেলে তার ওই লেখার যে মান সেটা মূল্যায়ন নাও হতে পারে। তবে
আমার ধারণা প্রথম আলোতে কাজ করেছেন এমন যে কাউকে টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে অনেক গুরুত্ব
দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হব না যদি দু এক মাসের ভিতরে দেখা যায় যে আস্তে আস্তে
প্রথম আলো বিভিন্ন কর্মী অন্য পত্রিকায় যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন।
ব্যাংক মার্জারের যেমন একটি ঘটনা বর্তমানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ঠিক
তেমনি পত্রিকা জগতেও শিল্প গোষ্ঠীর যে গন্ডগোলের ঘটনা ঘটেছে এটিও ব্যাংক মার্জারের
ঘটনার পর্যায়ে চলে যাবে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে দেখা যায়, দুটি ব্যাংক একীভূত হচ্ছে। আর
এদিকে দেখা যাবে, সংবাদকর্মীরা অন্য পত্রিকায় চলে যাচ্ছে।
তবে আমার মনে হয় না, এখন যে অবস্থা চলছে এতে প্রথম আলো আর আগের
মতো প্রথম আলো থাকতে পারবে। এটা কিছুতেই সম্ভব না এটি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত। তাই আমার
মনে হয় প্রথম আলো সেই ব্যাংক মার্জারের পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন অন্য পত্রিকা যাদের
আছে, তারাও প্রথম আলো কিনে নিতে পারেন। এটি সম্ভব। এরকম শিল্পগোষ্ঠীর কোন কমতি বর্তমানে
বাংলাদেশে নেই। যে কোন শিল্প গোষ্ঠীই এটা কিনবে।
তবে আমি আশা রাখব, যারাই প্রথম আলো কিনবে, তারা যেন অন্তত পক্ষে
এটা খেয়াল রাখে যাতে সাংবাদিকদের কোন ক্ষতি না হয়। সুতরাং এদেশের একজন সাধারণ নাগরিক
হিসেবে আমার দাবী হচ্ছে সাংবাদিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
এখন টক অফ দ্য কান্ট্রি হচ্ছে প্রথম আলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। যদি প্রথম আলো কে বা কারা কিনবে সেটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত না। তবে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান চাইবেন কোথায় গেলে তার চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। সেভাবেই তিনি বিক্রি করার চেষ্টা করবেন। প্রথম আলো বিক্রির বিষয়টির পাশাপাশি একই রকম আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসছে। আর সেটা হলো প্রথম আলোর পরে কে? তাহলে কি প্রথম আলোর পরে ডেইলি স্টার? তবে এটা নির্ভর করবে প্রথম আলোর কি ভাগ্য হয় তার ওপর
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।