নিপীড়িত,
নিষ্পেষিত আর অধিকার বঞ্চিত
বাঙালিকে নির্মম শাসন- শোষণ, অমানবিক নির্যাতন,সর্বোপরি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে যিনি মুক্ত করেছিলেন, তিনিই বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই সুজলা - সুফলা,
শস্য - শ্যামলা স্বাধীন দেশটি তাঁরই স্বপ্নের ফসল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের আজকের দিনে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।আজ জাতির পিতার ১০৩ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। মাতা সায়েরা খাতুন। এই দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে মুজিব ছিলেন তৃতীয় সন্তান। তার বড় বোন ফাতেমা বেগম, মেজ বোন আছিয়া বেগম, সেজ বোন হেলেন ও ছোট বোন লাইলী;তার ছোট ভাইয়ের নাম শেখ আবু নাসের।
টুঙ্গিপাড়া নামক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া শেখ পরিবারের সেই ছোট্ট খোকাই হয়ে উঠেছেন একটি জাতির মুক্তির মহানায়ক।
বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের ইতিহাস। ২৩ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম ও দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি তাদের সোনালি অর্জন স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ডানাতে ভর করেই বাঙালি বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের জন্মভূমিকে জায়গা করে দিয়েছে। পরাধীনতার এই শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার অদম্য সাহস জুগিয়েছিলেন জাতির পিতা। রাজনৈতিক জীবনের প্রথম লগ্ন থেকেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন দেশের জন্য। দেশ এবং দেশের মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়াই ছিল তার প্রধান ব্রত। তাঁর এই দেশপ্রেম তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাংলাদেশের জাতির জনক হিসেবে পরিচিত করে বিশ্বব্যাপী। ৫৫ বছরের সংগ্রামী জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন। যা তাঁর জীবনের সিকিভাগ। জেল-জুলুমের অমানবিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে তিনি পরিণত হন জাতির জনক ও বিশ্ব নেতৃত্বে।জাতির পিতার সমগ্র শৈশব পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর শৈশব অতিবাহিত করেছেন এ বাংলার জল, কাদা আর পানিতে।মানুষের অত্যন্ত কাছাকাছি থেকেছেন সেই শিশুকাল থেকেই।শৈশব থেকেই তিনি মানুষের হৃদয়ের গভীরে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।যার প্রতিফলন আমরা তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য করি। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানের সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু উপাধি পান। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় বলেন, '... জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি ... আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধু বাংলাদেশ।'৭১- এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁরঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিকে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন - "এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম;এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম"। বঙ্গবন্ধুর ঐ ডাকে বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুত হয়েছিল।তাঁরই প্রেরণায় এবং বজ্রকণ্ঠে অনুপ্রাণিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালি আমজনতা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের সাগরে উদিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য। কয়েক লক্ষ মা-বোনের লুণ্ঠিত সম্ভ্রম ও কোলশূন্য আর্তনাদে বিষাদময় আকাশে-বাতাসে উড্ডীন হয় স্বাধীন সোনার বাংলার লাল সবুজের পতাকা।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি মুক্তি লাভ করল। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার তাদের কারাগারে রাখতে পারল না। বন্দিজীবন থেকে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্যই হয়েছিল পাকিস্তান সরকার। পাকি সরকারের বন্দিশালা থেকে সদ্য মুক্ত হওয়ার পর সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন- " আপনি যে আপনার বাংলাদেশে ফিরে যাবেন সেই দেশ তো এখন ধ্বংসস্তূপ! তখন বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, "আমার বাংলার মানুষ যদি থাকে, বাংলার মাটি যদি থাকে, একদিন এই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আমি আমার বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শস্য- শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করব"।
বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের তাগিদে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি মনে - প্রাণে চেয়েছিলেন এদেশের খেটে খাওয়া,মেহনতি মানুষ যেন সুখে থাকে, পেটে অন্ন থাকে, হাতে পয়সা থাকে। এককথায় বাঙালির জীবন যেন হাসি- খুশিতে ভরপুর থাকে। বঙ্গবন্ধু এমন একজন স্বাপ্নিক সত্ত্বা যিনি স্বপ্ন দেখতেন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নিজস্ব অর্জন দিয়ে সাফল্য লাভ করবে। এমনকি পৃথিবীর বুকে নিজস্ব - অর্জন, সম্পদ,কৃতিত্ব দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। জাতির পিতা শোষণহীন- বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। তিনি প্রতিনিয়ত ভাবতেন বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে। দারিদ্র্যের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব ঘুঁচে যাবে,সমূলে উৎপাটন হবে দুর্নীতির বিষদাঁত।সদ্য স্বাধীন দেশকে সোনার বাংলায় পরিনত করতে স্বপ্ন দেখেছেন।উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠন করতে বহুমুখী পরিকল্পনাও করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু চিরকাল মানুষকে যোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার কথা অকপটে বলে গেছেন। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে তাইতো বলেছেন, "এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে,পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো আত্মা তৃপ্তি পাবে। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা খুব জরুরি "।শেখ মুজিবুর রহমান আপাদমস্তক একজন সত্যিকারের বীর বাঙালি। তিনি চেয়েছিলেন সম্মানের সঙ্গেই বাঙালি জাতি বেঁচে থাকবে। বাংলার মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ভাবে প্রাপ্ত সম্মান ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে অফিস,আদালতসহ সরকারি - বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে। সাধারণ জনগণ সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন কর্মচারীর কাছে ইদানিং যেভাবে অপদস্থ হচ্ছে সেটা জাতির পিতাও পছন্দ করতেন না।তাঁর এই উক্তিতে বিষয়টি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। " সরকারি কর্মচারীদের অনুরোধ করে বলেন, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন"।
বঙ্গবন্ধু বাংলার সাধরণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখলে কখনো স্বাভাবিক থাকতেন না। দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর,চোরাকারবারীদের কারণে বাংলার সহজ সরল মানুষগুলো যখন দুর্ভোগ পোহায় তখন অভিভাবক হয়ে এটা মানতে পারতেন না। তাই তো তিনি বলেছিলেন, " দীর্ঘ ৩ বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি,আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি, চোরে নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই"।বঙ্গবন্ধু এমনই ছিলেন, দেশ ও দেশের মানুষের জন্য তাঁর মন হু হু কাঁদত।বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি বলেছিলেন, " আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।জনগণের ভোটে জনগণের প্রতিনিধিরা দেশ চালায়, এর মধ্যে কারও কোনো হাত থাকা উচিত নয়"।
যুগে যুগে ধর্ম নিয়ে বহুদেশে হানাহানি,সংঘাত,রক্তপাত এমনকি জীবনও দিতে হয়েছে মানুষকে। জাতির জনক সবসময় একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন। " আমার রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানে ধর্মহীনতা নয়।মুসলমান তার ধর্ম- কর্ম করবে, হিন্দু তার ধর্ম- কর্ম পালন করবে বুদ্ধিস্ট তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে, খ্রিষ্টান তার ধর্ম-কর্ম পালন করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ধর্মের নামে আর ব্যবসা করা যাবে না"।বাঙালি এই কথায় বঙ্গবন্ধুর চোখে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের স্বপ্নই দেখতে পেয়েছিল। বাংলা,বাংলার ইতিহাস ও শেখ মুজিবুর রহমান তিনটি অবিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। একটি ছাড়া অন্যটি যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি একটি ছাড়া অন্যটি ব্যাখ্যা করা যায় না।অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধু কখনো সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেন নি।বঙ্গবন্ধু যে সবসময়ে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন, তা ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানি শাসকদের মদতে পূর্ব পাকিস্তানে, বিশেষ করে ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়।সেই দাঙ্গাতে হিন্দু পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার মাধ্যমে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিচয় আমরা পাই । এই যে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীদের সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করা এগুলো অসাম্প্রদায়িকতার চমৎকার উদাহরণ। বাংলার কৃষক,মজুর আজ বেশি লাঞ্চিত ও অবহেলিত। একশ্রেণির মুনাফালোভী, কালোবাজারী স্বার্থান্বেষী মহলের ন্যায্য মূল্য না দেয়া নামক বিষাক্ত ছোবলে অতিষ্ঠ আমার কৃষক ভাইয়েরা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা সেদিনই হবে যেদিন থেকে বাংলার কৃষক ভাইয়েরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। মনে রাখতে হবে কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে। কৃষকই দেশের আসল নায়ক। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের মুখের অন্ন জোগায়। বঙ্গবন্ধুর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকের মুখে হাসি ফোটানো। তাই তিনি সার্বিক কৃষিখাতকে বেশি গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
নারীর প্রতি যথাযথ আস্থা ও সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে তিনি অধিক জোর দিয়েছিলেন। পুরুষের সফলতা বা কোন অর্জনে কোন না কোন নারীর ভূমিকা থাকেই।একজন পুরুষের জীবনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের দিকে দৃষ্টপাত করলেই সেটা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বঙ্গবন্ধু পুরুষদের উদ্দ্যেশে তাই বলেছেন, " পুরুষ ভাইরা আমার যখন কোনো রকমের সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন তাদের মনে রাখা উচিত, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান তাদের দিতে হবে "।শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। শিক্ষার মাধ্যমেই সত্যিকার উন্নতি সম্ভব। এই মহান নেতা দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে,উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করার স্বপ্ন দেখতেন।নকল করে শিক্ষিত না হয়ে, বরং প্রকৃৃত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে শিক্ষিত হওয়ার কথা বলেছেন। তাই ছাত্রদের এবং অভিভাবকদের উদ্দ্যেশে তিনি বলেছেন, " ছাত্র ভাইয়েরা লেখাপড়া করেন। আপনাদের লজ্জা না হলেও আমার মাঝে মধ্যে লজ্জা হয় যখন নকলের কথা শুনি"।অভিভাবকদের উদ্দ্যেশে বলেন, " আমি খবর পাই বাপ- মা নকল নিয়া ছেলেদের - মেয়েদের এগিয়ে দিয়ে আসে। কত বড় জাতি! উঁহু! জাতি কত নিচু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু নকল মুক্ত শিক্ষার স্বপ্ন দেখতেন।বঙ্গবন্ধুর দেশে কোন বেকার থাকুক এটা তিনি কোনভাবেই মানতে পারতেন না। বেকারত্বের অভিশাপ থেকে যুবক ভাইদের মুক্ত করার চেষ্টা উনি প্রতিনিয়ত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, "এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়"। বাংলার যুবকরা বেকারত্বের হিংস্র থাবায় নিঃশেষ হোক এমনটা জাতির পিতা কখনো চাননি। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদা দুর্নীতি, চুরি, লুটপাট, অনিয়মের বিরুদ্ধে ছিলেন।দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন।
বঙ্গবন্ধু তাই বলেছিলেন, "এখনো কিছু সংখ্যক লোক এত রক্ত যাওয়ার পরেও যে সম্পদ আমি ভিক্ষা করে আনি, বাংলার গরিবকে দিয়ে পাঠাই, তার থেকে কিছু অংশ চুরি করে খায়।... এই চোরের দলকে বাংলার মাটিতে শেষ করতে হবে "। অত্যন্ত দুঃখজনক এই যে, চুরি ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ আজও আমরা পাইনি। চুরি, দুর্নীতি নামক অপছায়া আজও বাংলার মাটিতে জিইয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে তরুণ বাঙালি। অন্যায়ের কাছে তিনি কোনোদিন মাথা নত করেননি। শোষণহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। তিনি দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি উৎখাত করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেছেন একাধিক বক্তৃতায়।সামাজিক বৈষম্য কমাতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার নির্মূল করতে। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে স্বীকার করতেন তিনি একজন বাঙালি, তার ভাষা বাংলা এবং দেশ বাংলাদেশ'।
৭৫- এর ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতিকে পরিবার পরিজনসহ হত্যা করা হয়।জাতির পিতার হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ঘাতকদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ঘাতক বিভিন্ন দেশে পলাতক আছে। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ভারতে আত্মগোপন করা বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি আবদুল মাজেদকে ঢাকার মিরপুর থেকে আটক এবং তার ফাঁসি কার্যকর মুজিববর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। তিনি আজ জীবিত থাকলে হয়তো খুবই খুশি হতেন।
জাতির পিতার অসামান্য আত্মত্যাগ আর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা দেখেছি আলোর মুখ।মূলত তাঁরই আলোয় আলোকিত বাংলাদেশ।
"তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি মহৎ/তাই তব জীবনের রথ /পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার /বারম্বার/তাই/চিহ্ন তব পড়ে আছে, তুমি হেথা নাই "।- (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
তিনি নেই ঠিকই কিন্তু তাঁর আদর্শ,তাঁর চেতনা,তাঁর মহৎ কীর্তি, তাঁর স্বপ্ন বুকে ধারণ করে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছেন।হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে অভিহিত করেছিলেন।বাংলাদেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি নাই। পিতা মুজিবের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলা দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, দারিদ্র্যতা দূর করেছেন।তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। শেখ হাসিনা সন্ত্রাস এবং জঙ্গি দমনেও সফল। এছাড়া মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়েছে,২০২১ সালের ডেল্টা প্ল্যানের মত মেগা প্ল্যান হাতে নিয়েছে। পদ্মা সেতু,মেট্রোরেল, বঙঙ্গবন্ধু টানেল,এলিভেটেড এক্সপ্রেস,৪ লেনের মহাসড়ক সর্বোপরি জাতির পিতার প্রদর্শিত পথেই এগিয়ে যাচ্ছে আজকের বাংলাদেশ।
"সাবাস বাংলাদেশ / এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে-পুড়ে ছারখার /তবু মাথা নোয়াবার নয় "।- (সুকান্ত ভট্টাচার্য)।
জাতির পিতার বাংলাদেশ কারো কাছে মাথা নোয়ায়নি আর নোয়াবেও না।
আজকের তরুণ প্রজন্ম আগামী দিনের কাণ্ডারি হয়ে যে যার অবস্থান থেকে দেশের অগ্রযাত্রায় কাজ করবে। তাই আজ আমরা যারা নতুন প্রজন্ম আছি, তারা সবাই বঙ্গবন্ধুর অদম্য সাহস ও প্রজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজারো বঙ্গবন্ধু হয়ে বাংলার মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকবো।আমরা যেন বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে জাতিকে উপহার দিতে পারি অর্থনৈতিক মুক্তি, দিতে পারি মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃত স্বাধীনতা, নির্মূল করতে পারি জঙ্গিবাদ আর দূর করতে পারি হানাহানি।একই সঙ্গে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে তাঁর সুযোগ্য কন্যাকে সহায়তা করবো।জাতির পিতা জন্মদিনে এই হোক প্রত্যয় এই হোক অঙ্গীকার।
মো.আহসান হাবিব
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ১১:৫৯ এএম, ২৬ মার্চ, ২০২৪
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের কথা বলছেন তারা তো ভোরে উঠেই আগে ভারতীয় টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেন। দৈনন্দিন জীবনে যা ব্যবহার করি সবই তো ভারতীয় পণ্য। আমাদের বাজারে কোন জিনিস কিনতে গেলে তো ভারতীয় পণ্যটিই বেশি খুঁজি। তাহলে এখন কি আপনারা পেস্ট দিয়ে ব্রাশ না করে কয়লা ব্যবহার করতে চান? সেটা আপনারা করতে পারেন। কয়লার আজকাল দামও অনেক। আবার ঝামেলা হলো সহজে যাওয়া যায় না। সুতরাং সেটাও আপনাদের জন্য অসুবিধা।
কথায় আছে পাগলে কি না বলে ছাগলে কিনা খায়। সে ধরনের একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি আপনারা দিয়ে দিলেন কোন কিছু না ভেবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মধ্য দিয়ে আপনারা আরও রাজনৈতিক গহ্বরে ঢুকে গেলেন। এখন ভাবে ঢুকছেন সেখান থেকে আর কোন দিন বের হতে পারবেন কিনা সেটা একটা প্রশ্ন।
আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখন বিশ্বের কোন দেশেরই নিজস্ব পণ্য বলে কিছু নেই। আমাদের সবাইকে সবার ওপর নির্ভর করতে হয়। সেখানে আপনারা ভারতকে বর্জন করবেন কি করে। ভারত তো সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশি দেশ। তার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছি। সে সময় আমাদের ৩০ লাখ সহযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। এর সাথে আরও ১০ থেকে ১৫ হাজজার ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের মাটিতে তাদের রক্ত ঝড়িয়েছেন। আামরা না হয় আমাদের দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি। কিন্তু ভারতীয়রা তো জীবন দিয়েছে প্রতিবেশির জন্য। সুতরাং ভারতের সাথে আমাদের কন্ধনটা হলো রক্তের। রক্ত দিয়ে ভারতের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব আপনি পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ করবেন কি করে? বাসায় আপনার বউ থেকে শুরু করে বাসার কাজের মেয়ে সবাই ভারতের শাড়ি ব্যবহার করেন। তাহলে আগে তাকে বলবেন যে, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করুন।
রিজভী সাহেব বঙ্গবাজার থেকে একটি চাদর কিনে এনে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে একটা নাটক করেছেন মাত্র। বঙ্গবাজারে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় যেগুলো ভারতের নামে চলে। এটা আমরা জানি। রমজান মাসে ইফতারে আপনি পিয়াজু রাখছেন। এটা বাঙালিদের ইফতারের একটা ঐতিহ্য বলতে পারেন। এটা আমরা খাবই। কিন্তু পেঁয়াজ তো আসে ভারত থেকে। তাহলে এখন তো আপনাকে ইফতারে পিয়াজুও বাদ দিতে হবে। এভাবে আপনি কত বাদ দিবেন। অনেক সময় ভারত থেকে ঝড় আসে। সে সময় তাহলে বাতাসও আপনি নিবেন না। এটা বর্জন করবেন। এটা কি সম্ভব? যদি সম্ভবই না হয় তাহলে পাগলের প্রলাপ বলে কি আর আন্দোলন হয়। পাগল তো তার নিজের ভালোটা বুঝে। আপনাদের ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান দিন শেষে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকেই লাভবান করবে। কারণ আপনাদের আন্দোলনের কোন গন্তব্যই নেই। কোন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আন্দোলন করলে জনগণের কাছে যেতে পারবেন সেটাও আপনারা বুঝেন না। আপনারা পড়ে আছেন ভারতরে পণ্য বর্জনের ডাক নিয়ে। ফলে জনগণের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু এদিকে চাপা পড়ে যাবে। আর সরকারও মহা আরাশ আয়েশে চলবে। আমি জানি না, কোন উৎস থেকে টাকা পয়সা পেয়ে আপনারা নতুন করে এই স্লোগান শুরু করেছেন। কিন্তু আপনাদের এই ডাকে বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগই। কারণ আপনারা এবার বিএনপিকে দলগতভাবে কবরে নামানোর জন্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন।
মন্তব্য করুন
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড।
২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর
বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে
এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত
হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের
সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
এ কথা সকলের কাছে পরিষ্কার যে, নয়মাসে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হওয়া নিয়ে
কোনো বিতর্ক চলতে পারে না। কারণ রবার্ট পেইন তার Massacre, The Tragedy of
Bangladesh গ্রন্থে ইয়াহিয়া খানের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে- Kill three million of
them and the rest will eat out of our hands. পাকিস্তানি শাসকদের এই সিদ্ধান্তের কারণে
দৈনিক গড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ খুন হয় সারা বাংলাদেশে। এজন্য ১৯৭১ সালে মার্কিন সিনেটর
এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে
সরাসরি গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের
হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের ৫টি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০০২ সালে
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তা বিষয়ক আর্কাইভ’ তাদের অবমুক্তকৃত
দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত
করা হয়। ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন কূটনৈতিকরা সেসময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপক গণহত্যার
বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে বার্তা প্রেরণ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকরা
একাধিক লেখায় এবং বিশ্বখ্যাত পত্রিকা টাইম, নিউইয়র্ক টাইমস প্রভৃতির সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানিদের
গণহত্যা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। উপরন্তু ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে গঠিত
‘হামাদুর রহমান কমিশন’ তাদের পরাজয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রমাণ পায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি
সেনাদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নারী নির্যাতনে ঘটনার। আর এই ভয়ঙ্কর গণহত্যায় কেঁপে উঠেছিল
বিশ্ববিবেক। জর্জ হ্যারিসন ও পণ্ডিত রবিশংকর ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজন করেন। দার্শনিক
আঁদ্রে মালরোর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’। প্যারিস ও লন্ডনে সরব হয়ে ওঠেন
মানবতাবাদী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা ব্যাপক এবং নিষ্ঠুরতার
দলিল হিসেবে আজও বিশ্বকে নাড়া দেয়।
আসলে বিংশ শতাব্দীতেই ঘটেছে কোটি মানুষের প্রাণসংহার। বিশ্বযুদ্ধ
ও জাতিনিধনের সেই পরিকল্পিত ও ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ ‘জেনোসাইড’ অভিধা পেয়েছে। হিটলারের কনসেনট্রেশন
ক্যাম্প থেকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের বন্দিশিবির সেই জেনোসাইডের নির্মম ইতিহাসের কথা
বলে। অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তাঁর ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে
লিখেছেন ‘সারা প্রদেশ জুড়ে হত্যাকাণ্ডের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড বা গণহত্যা
শব্দটির আভিধানিক সংজ্ঞার হুবহু মিল রয়েছে।’ তিনি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং পাকিস্তানি
সেনা কর্মকর্তার মুখ থেকে জেনেছিলেন গণহত্যার লক্ষবস্তু ছিল- ক) বাঙালি সৈনিক, পুলিশ,
আনসার প্রভৃতি খ) হিন্দু সম্প্রদায় গ) আওয়ামী লীগের লোক ঘ) কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঙ) অধ্যাপক ও শিক্ষক যাঁরা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। তবে তিনি এটাও লক্ষ
করেছিলেন যে সেনাবাহিনীর নৃশংসতা ছিল নির্বিচার। নিরপরাধ, সাধারণ মানুষকেও শত্রু হিসেবে
গণ্য করেছিল তারা। তাছাড়া তাদের গণহত্যা ছিল ‘শোধন প্রক্রিয়া’ যাকে শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক
সমস্যার সমাধান বলে মনে করত। সেই সঙ্গে এই বর্বরোচিত উপায়ে প্রদেশটিকে উপনিবেশে পরিণত
করাও ছিল এর অন্যতম উদ্দেশ্য। পাকিস্তানিদের ভাষ্য ছিল- ‘বিচ্ছিন্নতার হুমকি থেকে রক্ষা
করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরদিনের জন্য পবিত্র করতে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সেজন্য
যদি বিশ লাখ লোককে হত্যা করতে হয় এবং প্রদেশটিকে তিরিশ বছরের জন্য উপনিবেশ হিসেবে শাসন
করতে হয়, তবুও।’ শাসকদের এ ধরনের মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমাংশের মানুষের ঐক্য ছিল। আর
এজন্যই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের
জনগণ হলেন গণহত্যার নীরব দর্শক।’
বাংলাদেশে ১৯৭১-এ পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসর আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী পরিকল্পিতভাবে হত্যাযজ্ঞ, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, হিন্দু জনগোষ্ঠী নিধন ও বিতাড়ন, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্যাতন, মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল। বাঙালি জাতির প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে তাদের ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হয়েছিল। সুপরিকল্পিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হয়েছে। হিটলারের নাজি বাহিনী ইহুদি ও রাশিয়ার যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে যে বর্বরতা দেখিয়েছিল ঠিক একইরকম আচরণ ছিল পাকিস্তানিদের। নিষ্ঠুরতা, পাশবিকতা এবং সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছিল ঠিক ইহুদিদের প্রতি নাজিদের মতো। নাজিরা ইহুদিদের নিচুজাতের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করত এবং তাদের নিধনযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ইউরোপের সমস্যা সমাধান করতে চেয়েছিল। অনুরূপভাবে পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের মনোভাব ছিল Bengalees have been cleansed and selected properly for at least one generation. নাজিরা প্রথমে তরুণ, যুবক এবং সমর্থ পুরুষদের হত্যা দিয়ে নিধনযজ্ঞ শুরু করলেও শিশু, বৃদ্ধ, নারীদের নির্বিচারে নিধন করতে থাকে ১৯৪১ সালে বলকান অঞ্চল থেকে। যুদ্ধবন্দি হত্যাসহ অন্যান্য নিষ্ঠুরতায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছায় তারা। তাদের অত্যাচারের সঙ্গে পাকিস্তানের সেনাদের আরো মিল রয়েছে হিন্দু নিধনের ঘটনায়। একাত্তরে হিন্দুদের প্রতি শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সুচিন্তিত ও নির্মম।
কারণ তারা ধর্মভিত্তিক হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করে তুলেছিল। তারা মনে করত পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এই উপমহাদেশের হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র আবাসভূমির জন্য মুসলমানদের বিদ্রোহের কারণে। এই হিন্দু বিদ্বেষ মনোভাব বছরের পর বছর লালিত হয়ে এসেছে। এজন্য জেনোসাইডে হিন্দু নিশ্চিহ্ন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। জনৈক গবেষকের ভাষায়- ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর গোটা দেশে কেবল একটি উদীয়মান ও অস্তগামী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হয়নি একাধিক জাতিগত দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে যায়। এতে উভয়পক্ষের নির্যাতন শুরু হয় তবে এর সূত্রপাত ঘটে ২৫শে মার্চের আক্রমণের পর। পাকিস্তানি সরকারের পরিকল্পনার শিকার হয় দুই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি। এর প্রথম শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়, যাদের কেবল নির্যাতন করা হয়নি বরং তাকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পারিবারিক ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধ্বংসও করা হয়। হিন্দুরা তাদের হৃত অবস্থান কোনদিন উদ্ধার করতে পারেনি বাংলাদেশেও। সম্প্রদায়গতভাবে তারাই ১৯৭১ সালের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।’ এমনকি ধর্ষণকেও তারা বৈধ বলে মনে করত। চীনের নানকিং-এ জাপানি সেনা কর্তৃক ধর্ষণ, রাশিয়াতে নাৎসিদের বলাৎকার এবং আর্মেনিয়া ও বসনিয়ার নারী নির্যাতনের সাযুজ্য রয়েছে বাঙালি নারী ধর্ষণের ঘটনায়। পাকিস্তানিদের বাঙালি নারী ধর্ষণের লক্ষ ছিল পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতিকে মানসিকভাবে আহত ও পঙ্গু করা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে পরাজিত ও বাঙালি জাতিকে বশীভূত করতে না পারার যাতনা তারা মিটাত নারী ধর্ষণ করে। এটা ছিল ভয়ঙ্কর মনোবিকারজাত। সার্বরা মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করেছিল ইথনিক ক্লিনজিং-এর উপায় হিসেবে। দেশ-বিদেশী গবেষক ও সাংবাদিকদের রচনায় যুদ্ধকালীন এসব নির্মম বাস্তবতাই উন্মোচিত হয়েছে।
বিশ শতকের জেনোসাইডের তালিকায় পাকিস্তান একটি অপরাধী রাষ্ট্রের
নাম। কারণ লাখো বাঙালির প্রাণের বিনিময়ে তারা সেদিন তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে
চেয়েছিল। অথচ বাঙালি জাতিগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর
কোনোরূপ অন্যায় পীড়ন করেনি। তবু বাঙালির প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের বর্বর ও
নৃশংস আচরণ বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য মানসিকতাকে প্রকাশ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানিদের
আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড ছিল ফ্যাসিস্টদের মতো। তাই তারা পোষণ করেছিল জাতি বা ধর্ম সম্প্রদায়
বিদ্বেষ; হত্যা করেছিল নিরীহ নিরপরাধ জনসাধারণকে। সেই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড আমাদের
২৫ মার্চের দাবিকে আরো বেশি তাৎপর্যবহ করে তুলেছে। ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’
হবে পৃথিবীর মানব জনগোষ্ঠীকে নির্মম নিধনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উচ্চকণ্ঠ এবং
হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের একমাত্র ভরসার দিন। আশা করা যায় এই
দিবসের চেতনা গণহত্যার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
যার গন্তব্য স্থান কোথায় সেটা ঠিক নাই, তিনি রাস্তায় গাড়ি বা রিক্সা যেভাবেই যান না কেন সে শুধু উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবেন। কারণ তার তো গন্তব্য ঠিক নাই। সে গুলশান যাবে, না নিউ মার্কেট যাবে কোথায় যাবে জানে না। বিএনপির অবস্থা এখন ঠিক তাই। তারা জানেই না তাদের আন্দোলনের গন্তব্য কোথায়। জানে না বলেই তারা একের পর এক ভুল করে রাজনীতির কানাগলিতে ঢুকে যাচ্ছে। এর একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো হঠাৎ করে তারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা বুঝতে হবে যে, ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্ভব কিনা? এখানে একটা কথা উল্লেখ্য করতে চাই যে, এদেশের জনগণ কার কথায় বিশ্বাস করেন? জনগণ বিশ্বাস করেন একমাত্র দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কথা। কারণ তিনি যেটা বলেন সেটা করেন। তিনি যদি কোন প্রশ্নবোধক ডাকও দেন তাহলেও বহু লোক সেটাকে গ্রহণ করবে। কারণ তার প্রতি তাদের বিশ্বাস আছে। আর যে দলের নেতারা প্রায় সবাই হয় সাজাপ্রাপ্ত অথবা জামিনে আছে তাদের কথায় কোন লোক কানে দিবে না।
একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়ালরাত্রি মর্মদাহিক চেতনা প্রবাহের কালখণ্ড। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালোরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। এর আগে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের দাবি ওঠে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে।
বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশের উন্নয়নের জন্য চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সবচেয়ে জরুরি। চিকিৎসার যদি উন্নতি না হয়, চিকিৎসা ব্যবস্থার যদি উন্নতি না হয়, মানুষ যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হন তাহলে দেশ গড়া সম্ভব নয়। সেজন্য বঙ্গবন্ধু একটা সুন্দর নীতিমালা পরিকল্পনা গড়ে তোলেন। ওই সময়ই সেটা ছিল আধুনিক যুগোপযোগী এবং বিজ্ঞানসম্মত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বঙ্গবন্ধু যে নীতিমালা তখন চালু করে গিয়েছেন সেই পদ্ধতিতে আজকের দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা একে এক করে বাস্তবায়ন করে চলেছেন। যার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছেন।
সাম্প্রতি ‘স্বাধীনতা সুফল পেতে চাই চিকিৎসা বিজ্ঞান গবেষণা জাতির পিতার হাতে সূচনা, দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা দিলেন দিক নির্দেশনা’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিপ্রেক্ষিতের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ বোরহান কবীর। বৈঠকে আলোচক হিসেবে অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন যে আলোচনা করেছেন তার চুম্বক অংশ প্রকাশ করা হলো।