ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি: তার সাম্প্রতিক সফরের পর রাশিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময়, বিদায় মুহুর্তে চীনা শীর্ষ নেতা শি জিংপিং রাষ্ট্রপতি পুতিনকে বলেছিলেন "একত্রে আমাদের উচিত এই পরিবর্তনগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যা গত ১০০ বছর ধরে ঘটেনি"। এই পরিবর্তনটা কি? তারা কি তাদের গোপন পরামর্শের সময় ডলার এবং পশ্চিমা মুদ্রার আধিপত্য, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য কমানোর বিষয়ে আলোচনা করেছিল? ১০০ বছরের আধিপত্য বদলানোর লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা কি একটি কৌশল নিয়ে আলোচনা করে সম্মত হয়েছিল? আমরা সেটা জানি না তবে শি জিংপিংয়ের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, আর সেই পরিবর্তন নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর কি প্রভাব ঘটাবে, আমাদের সকলের তা গভীর বিশ্লেষণ এবং বোঝার প্রয়োজন। চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে উঠেছে এবং ক্রমবর্ধমান সামরিক শক্তি শীঘ্রই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম বা ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়া এখনও পরমাণু অস্ত্রের বিশাল ভাণ্ডারের পরাশক্তি। এশিয়া, আফ্রিকা (যেখানে ফরাসিদের আধিপত্য কমছে), ল্যাটিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে রাসিয়া আর চীনের প্রভাব বাড়ছে। ভারত বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ক্রমবর্ধমানভাবে ভূ-রাজনীতিতে তার শক্ত পদচিহ্ন রাখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলি ভারতকে তাদের স্বার্থ এবং আগ্রহ নিয়ে কথা বলার জন্য দুর্বার চাপ দিচ্ছে। উন্নত বাজার আর ১.৪ বিলিয়ন জনগনের ভারতের সমর্থন তাদের অনেক প্রয়োজন (ভারতের টাটা ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি মূল্যের ৪৫০টির বেশি বোয়িং এবং এয়ারবাস বিমানের অর্ডার দেওয়ার পরে, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি বাইডেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সুনাক ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার মুদির সাথে ফোনে কথা বলে তাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন)। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গা, ওয়ারশ চুক্তি এবং ১২০টি দেশের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM) বিলুপ্ত হবার পর থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী পুলিশ ম্যান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে একক সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন দেশে তাদের ইচ্ছামতো আক্রমণ করে এবং প্রয়োজনে শাসক আর শাসন পরিবর্তন করছে। সামরিক শক্তির চেয়ে বেশি, পেট্রো ডলার আর ডলার বিশ্বের একমাত্র রিজার্ভ কারেন্সি হয়ে উঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশাল প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে।
নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের আর জাপানের বেশিরভাগ শিল্প, অবকাঠামো, আর্থিক সক্ষমতা আর সামরিক আধিপত্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমেরিকায় পার্ল হারবার বন্দর ছাড়া আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। আমেরিকার শিল্প ও অর্থনীতি অক্ষত ছিল। পুনর্গঠনের জন্য ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের (অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ন্যাটো আক্রমণে মার্কিনকে সমর্থন করেছিল) কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ছিল না। এই দেশগুলি তাদের অস্ত্র এবং পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিয়েছিল, যা তাদের ফেরত দিতে হয়েছে বা এখনও ফেরত দিতে হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে যুক্তরাজ্যকে ৪.৩৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রসারিত করেছিল, যার ফলে যুক্তরাজ্য তার প্রায় সমস্ত সম্পদ অর্ধ দশক ধরে যুদ্ধে নিয়োজিত করার পর দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা পায়। আজকের টাকায় ১১৯ বিলিয়ন পাউন্ডের সমতুল্য এই ঋণটি সেই সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতির দ্বিগুণ ছিল। সে সময় কানাডা যুক্তরাজ্যকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ব্রিটেন ঋণের অর্থ পরিশোধ করছে আর ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্য তার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছে।
এই ভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তির ঘর আর সামরিক শক্তির দেশে পরিণত হয়। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলার বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অন্যান্য ৪৪টি পশ্চিমা দেশ বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ তৈরি করে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড় শেয়ার হোল্ডার এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মালিক হয়ে উঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তখন স্বর্ণের রিজার্ভ অনুযায়ী জাতীয় মুদ্রার মান পরিমাপ করা হতো। ১৯৭০ এর দশকে পেট্রো ডলারের (ডলারে পেট্রোল বিক্রি এবং কেনা) উত্থান মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্যকে আরও সুসংহত করেছিল। ১৯৭১ সালে আমেরিকা একতরফাভাবে মার্কিন ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্যতা বন্ধ করে দেয় - ব্রেটন উডস চুক্তির সমাপ্তি হয়। ১৯৭৩ সালে, ১৫টি দেশের ২৩৯টি ব্যাংক একত্রে ক্রস বর্ডার পেমেন্টের সুবিধার্থে SWIFT তৈরি করে। সদর দপ্তর হয় বেলজিয়ামে। যদিও সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর অনেক নিয়ন্ত্রণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থাকে। ডলারের আধিপত্যের কারণে আমেরিকা প্রয়োজনে তার মিত্রসহ যেকোনো দেশের ওপর যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার শক্তি অর্জন করে। তাই আজ তাদের অর্থনীতি ও নাগরিকদের সমৃদ্ধি রক্ষায় বিশ্বের কোনো দেশই আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায় না।
এখন ভূ-রাজনৈতিক ও আর্থিক আধিপত্যের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। কিছু দেশে পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি অন্যান্য বড় দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একক সামরিক শক্তির আধিপত্য কমছে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং প্রভাব বজায় রাখতে অর্থনৈতিক আধিপত্য, ডলারের আধিপত্য ধরে রাখতে হবে - যা আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নিরাপত্তার উদ্বেগের কারন। আমি আশা করি সবার ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেনের (গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল একটা অজুহাত) পেট্রোলের মূল্য ডলারে নয়, ইউরোতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মূল পাপ আর এর পরিণতির কথা মনে আছে। একই ভুল লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি এবং ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ করেছিলেন। এই তিনটি দেশকে কোনো করুণা ছাড়াই তার সিদ্ধান্তের জন্য ভুগতে হচ্ছে। অন্যদিকে চীন একক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। কিন্তু যুদ্ধের কারনে ইউক্রেন এবং এর জনগণ ব্যাপক ধ্বংস, প্রাণহানি এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলি ইউরোপীয় অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক ভাবে বাড়ছে। ইউরোপের দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আবার সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
আমি জানি এটি আমার একান্ত নিজস্ব, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এবং জ্ঞান দ্বারা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি খুব সরল ওভারভিউ। তবে আমি আশা করি আমার সরল বর্ণনা চিন্তা এবং আরও বিশ্লেষণের জন্য কিছু তথ্য সরবরাহ করবে।
বর্তমান পরিস্থিতি: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গা এবং জার্মানির একীকরণের পর ন্যাটো রাশিয়ার দোরগোড়ায় প্রসারিত হয়। কিছু ন্যাটো দেশ পারমাণবিক অস্ত্রাগার সহ, বিমান ও সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে উঠে। ইউক্রেন যুদ্ধ আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোকে রাশিয়াকে কিছুটা হলেও দমন করার সুযোগ দিয়েছে। তাই আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর মূল লক্ষ্য এখন চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭৫০টি বিদেশী সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সম্প্রতি তারা আবার ফিলিপাইনে ঘাঁটি খুলেছে। নতুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তথাকথিত "চতুর্ভুজ" গঠন হয়েছে। ফ্রান্সের সাথে চুক্তি বাতিল করে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক সাবমেরিন কেনার জন্য এবং তার রক্ষণাবেক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সাথে সম্মত হয়েছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আরও বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। তাইওয়ান একটি গরম ইস্যু হয়ে উঠছে। সুতরাং, চীন ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা বেষ্টিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, চীন আজ আর ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের দেশ নয়, অবাধ বাণিজ্য এবং নৌ চলাচলের স্বাধীনতার নামে আফিম ব্যবসার একটি অতি দরিদ্রের দেশ নয়, যে দেশকে ধ্বংসাত্মক প্রথম এবং দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। চীনা জনগণ তাদের অতীত ইতিহাস ও নিপীড়নকে কখনো ভুলতে পারবে না। চীন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং ধীরে ধীরে সুদূরপ্রসারী পারমাণবিক সক্ষমতা সহ তার সামরিক, বিমান ও নৌ বাহিনী গড়ে তুলছে। চীনের এখন চীনের বাইরে আটটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। ভারত আর ভিয়েতনামের সাথে সীমান্ত বিরোধে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ ছাড়া, চীন কোন দেশ আক্রমণ করেনি। চীনকে এখন রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া এবং অন্যান্য ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সীমান্ত (সমুদ্র সীমানার দাবি ছাড়া) নিয়ে বেশী মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। ভারতের সাথে এখনও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং সীমান্ত বিরোধ চলছে। তবুও ভারত ব্রিকস (BRICS) জটে চীনের সাথে যোগ দিয়েছে। চীনের সাথে মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা এবং সামরিক সরকারের সাথে চীনের সুসম্পর্ক এবং প্রভাব রয়েছে।ঐতিহাসিক কারণে জাপান মিয়ানমারের সাথে তার সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক সমর্থন বজায় রেখেছে। যদিও চীন সামরিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে এবং আমেরিকার জন্য এখন বড় হুমকির কারন নয়। চীন সক্রিয়ভাবে ডলারের পরিবর্তে নতুন রিজার্ভ কারেন্সি ব্যবহার সক্রিয়ভাবে প্রচার আর প্রসারিত করছে এবং নিজের বিশাল সোনার রিজার্ভ তৈরি করছে। চীন এশিয়ান, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিচ্ছে। উপরন্তু, ঋণ খেলাপি হওয়া থেকে অনেক দেশকে রক্ষা করার জন্য একটি বিকল্প আইএমএফের মত ঋণ দিচ্ছে। চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্য বিশাল হয়ে উঠছে। চীন এসব দেশেও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করছে। ১.৪ বিলিয়ন লোকের দেশ চীনের জনগণের ক্রয় ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলির তাদের নিজস্ব অর্থনীতির জন্য চীনের সাথে বাণিজ্য করার ছাড়া অল্প কিছু বিকল্পের পথ দেখতে পারছে। সুতরাং, সামরিকভাবে নয়, চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক আধিপত্যের কারনে চীন যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আর নিরাপত্তার হুমকি হয়ে উঠছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলির আন্তর্জাতিক নিয়ম এবং জাতিসংঘের সনদকে সম্মান না করে সামরিক শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, রিজার্ভ মুদ্রার অস্ত্রায়ন, সুইফট এবং ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলি এবং সামরিক শক্তিগুলি ক্রমশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে এবং এই প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে এবং একটি বহুমুখী বিশ্ব গড়তে চাইছে। ব্রিকস (BRICS) দেশ এবং জোটে যোগদান করার জন্য ক্রমবর্ধমান অন্যান্য দেশেও আবেদন করছে। ব্রিকস তার নিজস্ব ব্যাংক চালু করেছে। ব্রিকস একটি পাওয়ার হাউসে পরিণত হচ্ছে। আমেরিকান রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রক্ষিত আফগানিস্তানের ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেয়াপ্ত করা, আর ইউক্রেন যুদ্ধের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর রাশিয়ার ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশী অর্থ বাজেয়াপ্ত করার কারনে চীন সহ অনেক দেশের, যাদের বিপুল পরিমান অর্থ মার্কিন রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রয়েছে, তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ছে, এবং তারা SWIFT এর বিপরিত ভিন্ন ক্রস-ফাইনান্সিয়াল পেমেন্ট সিস্টেমের পাশাপাশি ডলারের পরিবর্তে বিভিন্ন রিজার্ভ মুদ্রার বিভিন্ন প্রক্রিয়া খুঁজছে। চীন এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে তাই চীন মার্কিন আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এটি বন্ধ করতে, এমনকি এর মিত্রদের ভোগান্তির মূল্যে হলেও যুক্তরাষ্ট্র সব কিছু করছে এবং করবে।
এবার রোহিঙ্গা, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে ফিরে আসা যাক: মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতা দখল করার পর মিয়ানমারের জনগণ অবস্থার পরিবর্তনের সন্ধান খুঁচছে এবং সংগ্রাম করছে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের অধিকাংশই মুসলিম এবং তাদের মধ্যে কিছু জঙ্গি, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পাশাপাশি কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী দলও রয়েছে। আগেই বলেছি জাপানের মিয়ানমারে থাকার ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। যদিও চীন ও ভারতের নিজস্ব দ্বন্দ্ব রয়েছে, তবুও চীনের পাশাপাশি ভারত, উভয় দেশ ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমার নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী, চিন্তিত এবং জড়িত। মিয়ানমারে আমেরিকার স্বার্থ কী হবে? চীনকে ঠেকাতে যেমনটি আমি বর্ণনা করেছি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় উপস্থিতি রয়েছে (প্রায় ৪০০ ঘাঁটি, প্রায় ৩০০,০০০ সৈন্য এবং ৬০% মার্কিন নৌবাহিনীর নৌবহর শুধুমাত্র প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় আছে)। পাকিস্তানেও, বিশেষ করে সেনা জেনারেলদের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় প্রভাব রয়েছে। কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে বিবেচিত হলেও গত বছর ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর, ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র লাওসের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়ন করছে। মঙ্গোলিয়া এবং উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি প্রভাব নাও থাকতে পারে। ইউক্রেন যুদ্ধ, ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা এবং রিজার্ভ তহবিল বাজেয়াপ্ত করার কারনে রাশিয়া ও চীন অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তারের এবং ন্যাটো সম্প্রসারণের মতো চীনকে আরও ঘেরাও করতে সেখানে হয়তো একটি সেনা ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করবে। মার্কিন সমর্থনে মিয়ানমারে সামরিক সরকার বা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনই হবে তা অর্জনের সর্বোত্তম উপায়।
আমরা জানি আফগানিস্তানে রাশিয়াকে পরাজিত করতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ব্যবহার করে সেখানে থাকা শত শত আফগান শরণার্থীর মধ্যে থেকে তালেবান তৈরি করেছে এবং আল কায়েদা উপাদানের জন্ম দিয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহ করেছে। কেন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ধর্মান্ধ মুসলিম গোষ্ঠীকে বেছে নিয়েছিল? কারণ তারা জানে মুসলিম ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দলগুলো কমিউনিস্টদের (অবিশ্বাসী) ঘৃণা করে এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাদের জীবন দিতে দ্বিধা করবে না – সেটা রাশিয়া হোক বা চীন। মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমানে কিছু গ্রুপ ইতিমধ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের প্রয়োজন। কিছু বিভিন্ন উৎস থেকে তারা এখন তাদের অস্ত্র পাচ্ছে। কমিউনিস্ট বিরধি মুসলিম ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মধ্য থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জান্তাকে পরাজিত করার লক্ষে তালিবানের মত রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করা কঠিন কাজ হবে না। তবে তাদের প্রশিক্ষণে সমর্থন করতে বা দিতে এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করতে পাকিস্তানের মতো একটি দেশের দরকার। এমন কাজে ভারতের সহায়তা প্রশ্নের বাইরে। যদিও বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে চিত্তাকর্ষকভাবে এগিয়েছে, তবুও এটি এখনও অনেক ক্ষেএে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশে এখনো যথেষ্ট সংখ্যক লোক আছে যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না এবং মোস্তাকের মত বিপুল সংখ্যক মানুষ, নেতা, ব্যবসায়ী মানুষ, সংবাদ মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবীদের এখনো কেনা সহজ। তাই পাকিস্তানের মত তাদের লক্ষ্য সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশে চাপ সৃষ্টি করা বা দেওয়া সহজ হতে পারে। প্রয়োজনে শাসন পরিবর্তনের জন্য সমর্থন প্রদান করা। সর্বপরি একটা সহযোগিতামূলক এবং আনুগত্যকারী সরকারের সাথে তাদের ইচ্ছা আর স্বার্থ অর্জন করা অনেক সহজ হবে। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে দশটি ট্রাক পূর্ণ অস্ত্র বাংলাদেশের সাহায্যে স্থানান্তরের চেষ্টা করা হয়েছিল।
আমাদের প্রশ্ন করা দরকার, কেন হঠাৎ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা বা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বা দুর্নীতি নিয়ে এত সোচ্চার হয়ে উঠছেন? ১৯৭৫ সালের মতো মার্কিন দূতাবাসে অবস্থানরত অজানা সিআইএ প্রধান কী ভাবছেন বা করছেন? কেন একের পর এক উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ বাংলাদেশে আসছেন? কেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের জন্য আমন্ত্রণ জানাননি (উদাহরণস্বরূপ মিশর এবং পাকিস্তানকে আমন্ত্রণ জানানো বিবেচনা করলে বলা যা, এটি গণতন্ত্রের কোন বিষয়ে নয়)? কেন এই বছর আমেরিকান তৈরি মানবাধিকার রিপোর্টে বাংলাদেশকে খারাপভাবে প্রতিফলিত করা হল, এত বছর পর ২০১৮ সালের নির্বাচন উত্থাপিত হল? প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে নির্বাচনের কথা বললেন কেন? কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যুক্তরাষ্ট্রে তার মার্কিন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে হলো? কেন আমরা দেখছি বাংলাদেশে এবং বাইরের কিছু গোষ্ঠী সহ সংবাদ মাধ্যম হঠাৎ করেই মিথ্যা এবং ভুয়া খবর প্রচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে (মনে রাখবেন ১৯৭৪/৭৫ সালে কী ঘটেছিল, কি পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল এবং জাতির পিতাকে হত্যা করে শাসন পরিবর্তনের ঘটনার কথা)। উদাহরণ স্বরূপ মিশর, পাকিস্তান, কয়েকটি আরব দেশ এবং ইজরায়েলের প্রতি তাদের সমর্থনের দিকে তাকালে মনে হয় কি তারা সত্যিই মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা বা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিশ্বাস করে? এটা কি আসলেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা বা মানবাধিকার নিয়ে, নাকি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো প্রশিক্ষণ বা অস্ত্রের ঘাঁটিতে পরিণত করতে বর্তমান সরকারকে রাজি করাতে বাধ্য করার জন্য একটা সাজানো ভয়ঙ্কর খেলা চালানো হচ্ছে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বেশি স্বাধীন বা দৃঢ়চেতা হয়ে উঠছে। যদিও আমরা জানি না পর্দার আড়ালে কী ঘটছে। যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন হুকুম না মানেন, তাহলে এটা কি শাসন পরিবর্তনের করে, তাদের কথা মানার শাসককে বসানার পরিকল্পনা বা হুমকি?
ভারত বাংলাদেশকে বিদ্রোহের ঘাঁটিতে পরিণত করার জন্য দুইবার চিন্তা করবে, কারণ এটি দীর্ঘমেয়াদে নিজের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে। মিয়ানমারের স্বৈরশাসকরাও অলসভাবে বসে থাকবেন না। চীনও প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে এবং পশ্চিমা শক্তির সহায়তায় বাংলাদেশ যদি কখনো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করে তাহলে চীন নিশ্চয় মিয়ানমারকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। সে অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘর্ষ, বিমান, নৌ ও কামান বিনিময় হলে বাংলাদেশ কি পারবে দেশের অনেক বছরে কঠোর প্রচেষ্টার দেশের অবকাঠামো ও শিল্প-কারখানার ব্যাপক ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে? বন্ধ করতে পারবে আরো শরণার্থী বাংলাদেশে আসার এবং সকল অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবার? বাংলাদেশ পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো, একটি ব্যর্থ দেশে পরিণত না হবার? কিছু দল, বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদ মিডিয়া সহ আমাদের নিজেদের কিছু বাংলাদেশিদের সক্রিয় মিথ্যা, নোংরামির খেলা দেখে আমি সত্যিই উদ্বিগ্ন। মনে রাখতে হবে মিরজাফররা বারবার বাংলার মাটিতেই জন্মেছে।
এটি কেবলমাত্র আমার সীমিত ছোট মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ, যা সত্য নাও হতে পারে তবে আমাদের অবশ্যই বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে এবং আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমি আশা করি, বাংলাদেশের জনগণও ভাববে, যদি আমরা ভুলভাবে দেশি-বিদেশি উপাদান দ্বারা ভুলভাবে প্রভাবিত হই তাহলে বাংলাদেশের কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা আরও উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি চায় কি না, নিজের এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত তৈরি করতে চায় নাকি অনিশ্চয়তা ও দারিদ্রের মধ্যে এবং কোনো আশা ছাড়াই বাস করতে চায়। আসন্ন মাস এবং বছর আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরা যখন ভোট কেন্দ্রে যাবো এবং আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেব তখন আমাদের সাবধানে চিন্তা করতে হবে। আমরা কি গর্বিত ও স্বাধীন হতে চাই নাকি বিদেশী সরকারের অধীন হতে চাই? বাংলাদেশে আপামর জনগন গত কয়েক দশক বিশ্বকে দেখিয়েছে যে তারা একটি উদাহরণ/পার্থক্য সহ, দেশের উন্নয়ন করতে পারে এবং মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভবিষ্যত প্রজন্মের অনেক লাভ বা ক্ষতি করার সুযোগ আছে, যদি তারা সঠিক বা ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। আসুন আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং অহংকার রক্ষা করতে একসাথে থাকি, যাতে কেউ বা কোন শক্তি যেন আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কেড়ে নিতে না পারে। হয়ত সবচেয়ে খারাপের মধ্য থেকে আমাদের সার্বভৌমত্বের সমর্থক কম খারাপ/সেরাদের বেছে নিতে হবে। আমি মনে করি আমাদের কাছে এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় বিকল্প নেই। আমাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য, একটি গর্বিত জাতি হতে, আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমাদের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি প্রয়োজন।
Prof Dr Quazi Monirul Islam, MBBS, MPH, FRCOG
Epidemiology Department, Prince of Songkla University, Hat Yai, Thailand
Senior Specialist, International Centre for Migration, Health and Development
Former Senior Specialist (Maternal and Newborn), Liverpool School of Tropical Medicine, UK
Former WHO Director and Country Representative to Thailand and Namibia
মন্তব্য করুন
প্রকাশ: ০৯:০৬ পিএম, ১৫ এপ্রিল, ২০২৪
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্য করুন
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।
তবুও, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যাপকভাবে বয়কট করা হয়েছে। এর মূল কাওন হিসেবে তারা বলছেন, বিরোধী দলে নির্বাচন বয়কট এবং বিরোধীদের বয়কটের আহ্বানের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সাধারণ জনগণের ভোট বর্জন।
অংশগ্রহণ নাকি বয়কট?
দেশটির প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তার মিত্ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও সব বিরোধী দল অবশ্য তাদের অনুসরণ করেনি। নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সাতাশটি দল প্রার্থী দিয়েছিল। এছাড়া প্রায় ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রায় ১৯০০ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তাই নির্বাচনে বিএনপির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, একাধিক নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে এবং ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করেছে।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৪১.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনের তুলনায় এই সংখ্যা কম হলেও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সংখ্যাকে কম বলার সুযোগ নেই। অনেকে এটিকে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কট জনমনে প্রতিফলিত হয়েছে বলে দেখছে। বিরোধীদের বয়কট নিঃসন্দেহে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব ফেলেলেও, কম ভোটার উপস্থিতি মানেই জনগণ ভোটকে প্রত্যাখ্যান করেছে এওনটি ভাবার কোন সুযোগ নেই। মূলত বিএনপির বিভিন্ন নির্বাচন বিরোধী কর্মসূচী, বিক্ষোভ, সমাবেশ, গাড়িতে ট্রেনে বাসে অগ্নিসংযোগ, ভোটের আগের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল-অবরোধের ডাক দেশের পরিস্থিতিকে অস্থির করে তোলে। যার ফলে নিজদের নিরাপত্তার জন্যই অনেক ভোটার নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে বাড়িতে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
তবে যে সব নির্বাচনী এলাকায় একাধিক জনপ্রিয় প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। আবার যেস এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা কম ছিল সেসব এলাকায় ভোটার উপস্থতি ছিল কম। অর্থাৎ ভোটাররা বিএনপির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে নির্বাচন বর্জন করেনি; প্রতিদ্বন্দ্বিতাই মূলত ভোটার উপস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট করা ভোটারদের পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দুপুরে নির্বাচন কমিশনের করা প্রেস ব্রিফিংয়ে ভোটার উপস্থিতি মাত্র ২৭ শতাংশ ঘোষণা করা হলেও, শেষে ৪১.৮ শতাংশ চূড়ান্ত ভোটার উপস্থিত ঘোষণা করা হয়। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশন জানায়, দুপুরের সংখ্যাটি প্রকৃত সময়ে ছিল না। যেহেতু বাংলাদেশে ম্যানুয়াল পেপার ব্যালট সিস্টেম ব্যবহার করা হয় যেখানে ভোটগুলি হাতে গণনা করা হয় এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে ফলাফল প্রেরণে কয়েক ঘন্টা পিছিয়ে ছিল। যা দুপুরের ভোটার উপস্থতি এবং সর্বশেষ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে ব্যবধান ব্যাখ্যা করে। সেক্ষেত্রে মোট ভোটের ১৪ শতাংশ শুধু শেষ সময়ে দেয়া হয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়।
নির্বাচন কমিশন হয়ত সঠিক। কিন্তু যেহেতু সন্দেহের তীর ছোড়া হয়েছে সেহেতু, নির্বাচন কমিশন সমস্ত ভোটকেন্দ্রের প্রতি ঘণ্টায় ভোট গণনার বিস্তারিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে সন্দেহের সমাধান করতে পারে। এ ধরনের স্বচ্ছতা ভোটদানের প্রশ্নে স্পষ্টতা প্রদান করবে এবং যেকারো বিভ্রান্তি দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশ কি একদলীয় রাষ্ট্র?
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আরেকটি নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর অনেকেই বাংলাদেশ একটি একদলীয় রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২৩টি আসনে এবং আওয়ামী লীগের অনুগত স্বতন্ত্ররা আরও ৬২টি আসনে জয়লাভ করে। যার ফলে সংসদে ৯৫ শতাংশ নির্বাচিত সংসদ সদস্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে এবং সংসদে কোন অর্থবহ বিরোধী দলের অস্তিত্ব নেই।
তবে বিষয়টি এত সরল নয়। প্রথমত, সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের আওয়ামী লীগের ল্যাপডগ বলে উপেক্ষা করা বাংলাদেশের রাজ্নৈতিক প্রেক্ষাপটে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লী প্রার্থীর সাথে তীব্র নির্বাচনী লড়াইয়ের পরই বিজয়ী হয়েছেন। তারা সংসদে তাদের ভোট এবং তাদের বক্তৃতায়র পুরো স্বাধীনতা ভোগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্যদের তাদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী কোন দলের অধীনে না থাকায় তারা এই বিধিনিষেধের বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আ.লীগ প্রশংসার যোগ্য। আ.লীগ দলের সিনিয়র ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দিয়ে, অবশ্যই সম্ভাব্য অন্তর্দলীয় বিরোধের ঝুঁকিতে পড়েছে। তবুও, এটি ভোটারদের প্রকৃত নির্বাচনী বিকল্প প্রদান এবং সংসদে মত বৈচিত্র্যকে প্রসারিত করেছে।
উপরন্তু, একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অপ্রতিরোধ্য সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা একটি দল একদলীয় রাষ্ট্রের সমতুল্য নয়। বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্র না বানিয়ে অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই রকমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। একইভাবে ভারত ও জাপান বহুদলীয় গণতন্ত্র না হারিয়ে একদলীয় আধিপত্য অর্জন করেছে। মূল প্রশ্ন হল আওয়ামী লীগ নিজে এই অতি সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদের আয়োজন করেছিল নাকি বিএনপির নির্বাচন বয়কটের কারণে এটি অনেকটা অনিবার্য ছিল।
বিএনপি যদিও যুক্তি দেবে—যে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কখনোই ছিল না এবং ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের পর বিএনপি নেতাদের দমন-পীড়ন ও গণগ্রেপ্তার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ এবং তাদের অংশগ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে, ২৮ অক্টোবরের আগেও বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ইতিমধ্যেই নির্বাচনে নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন কমিশনের ডাকা একটি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার জন্যই ২৮ অক্টোবরের বিক্ষোভ করেছিল দলটি। ফলে সেই সময়ে কমিশনের কর্তৃত্বের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, অরাজকতা দমনে এবং নির্বাচনের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে শক্তি প্রয়োগ করেছিল। এটি কোনভাবে নির্বাচন বর্জনের কারণ হতে পারে। বলপ্রয়োগের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার আলাদা মূল্যায়নের প্রয়োজন, তবে এটি নির্বাচনী নয় বরং আইন-শৃঙ্খলার চোখে দেখাই উত্তম।
দায়বদ্ধতা
এমন উদ্বেগজনক দাবি করার পরিবর্তে, পর্যবেক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল যে প্রাথমিক বিরোধী দল বিএনপি কেন মাঠ হারাল। সরকার যেমন শক্তিপ্রয়োগের জন্য যাচাই-বাছাইয়ের পরোয়ানা দেয়, তেমনি বিএনপিকে তার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
১৭ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব ছিল সংসদে ভোটারদের আওয়াজ দেওয়া। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না এমন অনুমানের উপর ভিত্তি করে নির্বাচন বর্জন করে, তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং জনগণের অধিকারকে উপেক্ষা করেছে। তর্কের খাতিরে আ. লীগের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না ধরে নিলেও, বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত মে ২০১১ সালে এটিকে অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিল। তাছাড়া, পূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তার ম্যান্ডেটকে অতিক্রম করেছিল, জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করেছিল এবং দলীয় নেতাদের বন্দী করেছিল রাজনীতিকে বাধাগ্রস্থ করেছিল।
নির্বাচন বয়কট শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সুফল এনে দিয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণের ম্যান্ডেট অনুসরণ করার চেয়ে তত্ত্বাবধায়ক শাসনের মধ্যে একটি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষা করেছিল। গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও মূলত বিএনপি’র এই আত্ম বিধ্বংসী এবং অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই আওয়ামী লীগের ক্ষমতার পথ সুগম করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যাপক বয়কট সর্বজন গৃহীত
মন্তব্য করুন
১০ই এপ্রিল ‘স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র’ (প্রোক্লেমেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স) -এর
৫৩ বছর পূর্তি।আজ থেকে পাঁচ দশক আগে এই দিন ঢাকা শহর থেকে দূরে নিভৃত এক গ্রামের
আম্রকাননে উদ্ভাসিত হয়েছিল এর অবিনাশী বাক্যগুলো। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি
সেনাবাহিনী নৃশংস পৈশাচিকতায় বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে
পড়ে। আর সে রাতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পৃথিবীর বুকে
যুদ্ধরত বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। অন্যদিকে মাত্র ১৫ দিনের
মাথায় ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গঠিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৭ই এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে
শপথ নেয় এই সরকার।এই সরকারের নেতৃত্বেই ৯ মাসের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ই ডিসেম্বর
পাকিস্তানি সৈন্যদের সারেন্ডারের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
একাধিক গবেষণাগ্রন্থ ও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত
সূত্র মতে, ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী
লীগের তৎকালীন নেতাদের আলাদা দিকনির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই নির্দেশনা অনুযায়ীই
প্রথমে তাজউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য
৩০ মার্চ ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার পথে পশ্চিম বাংলার সীমান্তে পৌঁছান। সেখান থেকে মেহেরপুর
মহকুমার প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে সীমান্ত
অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। ভারতে প্রবেশের মুহূর্ত থেকে ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসা পর্যন্ত পুরো সময়টাই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের
সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি
হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল। কারণ তাজউদ্দিন সেটা আদায় করে নিতে পেরেছিলেন
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে শুরু থেকেই দৃঢ় অবস্থানের মাধ্যমে। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা
গান্ধির সঙ্গে বৈঠকে বসার আগে তাজউদ্দিন উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে
যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে একটি প্রশাসনিক কাঠামো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ১৯৭০ সালের
নির্বাচনের ম্যান্ডেট অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন
প্রতিনিধি হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং সাহায্য-সহযোগিতা
করার জন্য আলোচনা করেন। যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে
পূর্ব পরিকল্পনা এবং ভারতের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন,
সুতরাং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতিনিধি হিসেবে তাজউদ্দিনের
সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধির এই বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছিল। আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশের কারণে
তাৎক্ষণিক স্বীকৃতি না দিলেও ভারত বাংলাদেশের এই নতুন সরকারকে মুক্তিফৌজের আশ্রয়-ট্রেনিং-অস্ত্র
থেকে শুরু করে সকল রকম সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়
এবং সবধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে এই বৈঠকের সূত্র ধরেই
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ (M.N.A) এবং এমপিএ (M.P.A)-দের কুষ্টিয়া জেলার
সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার
জন্য মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রীপরিষদ এবং এমএনএ এবং এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা
করেন। তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর
অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার
মোশতাক আহমেদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। ১১ এপ্রিল
এম এ জি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।
১৯৭১
সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্রের
প্রথম সংবিধান। এই ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম সরকার বা মুজিবনগর সরকার কর্তৃক ১৯৭১
সালের ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়। ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম লিখেছেন-
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এ তিনটি ঘটনা
একসূত্রে গাঁথা।’ তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ‘তাজউদ্দীন আহমদ ৭০’র নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন।
১০ এপ্রিলের ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ
গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা ও পাক হানাদার বাহিনীকে স্বদেশ
ভূমি থেকে বিতাড়িত করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত এবং নির্দেশিত
পথে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের জন্য প্রথম সরকার গঠন করা হয়।’ সেসময় যিনি এই ঘোষণাপত্রটি
রচনা করেছিলেন তাঁর স্মৃতিতে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র; যা
৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে পেনসিলভানিয়া প্রাদেশিক আইনসভায় অনুষ্ঠিত ২য় কন্টিনেন্টাল কংগ্রেসে
গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধরত তেরটি মার্কিন উপনিবেশ নিজেদের ব্রিটিশ
শাসনের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র নামে নতুন রাষ্ট্র
গঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় জুলাইয়ের ৪ তারিখ, যে তারিখে স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়েছিল সেই তারিখেই। ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসারে
২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। কারণ ঘোষণাপত্রে লেখা হয়েছে- ‘আমাদের এই স্বাধীনতার
ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে।’
ঘোষণাপত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো বঙ্গবন্ধুর
২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিহিত
করা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করে আরও সিদ্ধান্ত
ঘোষণা করা হয় যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের
রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। কোনো কারণে
যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা
তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব
উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। বর্ণিত ঘটনা অনুসারে আমরা জানি, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর
থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র
রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি
আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া
খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেও বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা বন্ধ
ঘোষণা করেন। উপরন্তু জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত
এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে গণহত্যা চালায়। উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক
কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত
নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার
প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের
অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ নামের
এই দলিল যতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলেছে ততদিন মুজিবনগর সরকার পরিচালনার অন্তর্বর্তীকালীন
সংবিধান হিসেবে কার্যকর ছিল।ঘোষণাপত্রের পূর্ণ বিবরণ এরকম-
‘‘যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে
প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত
বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯
জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং
যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্য জেনারেল
ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার
জন্য আহ্বান করেন, এবং
যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও
বেআইনিভাবে নির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, এবং
যেহেতু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি
রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি
অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং
যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের
জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে
ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার
জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, এবং
যেহেতু একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনায়
পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ, অন্যান্যের মধ্যে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর
নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনও অনবরত করিয়া চলিতেছে,
এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ
চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের
প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের জন্য একটি সরকার
প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা
ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা
করিয়াছে।
সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ,
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকার জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা
রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা
করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত
করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং এতদ্দ্বারা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন
করিলাম, এবং এতদ্দ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত
না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং
সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের
সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সকল নির্বাহী ও
আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়োগ করিবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাহার বিবেচনায় প্রয়োজনীয়
অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, কর আরোপণ ও অর্থ ব্যয়ন ক্ষমতার অধিকারী
হইবেন, গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবিকরণ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ
সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন।
আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ
আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোন কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার
কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাহার ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্দ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির
থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়োগ ও পালন করিবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমণ্ডলীর
সদস্য হিসেবে আমাদের উপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং
জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার
এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত করিতেছি যে, এই দলিল কার্যকর
করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ
আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়োগ করিলাম।’’
উল্লেখ্য, এটি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে মুজিবনগরে
ঘোষিত ও জারিকৃত এবং ২৩ মে, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫০(১) অনুচ্ছেদ এবং চতুর্থ তফসিলে উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের একটি ক্রান্তিকালীন অস্থায়ী বিধান হিসেবে সাংবিধানিকভাবে
স্বীকৃত হবে।
পঞ্চদশ
সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রটি এখন সম্পূর্ণ আকারে বাংলাদেশের
সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ {সংবিধানের ৭(খ) অনুচ্ছেদ}
একটি মৌলিক কাঠামো রূপে সাংবিধানিক স্বীকৃতি
পেয়েছে। ফলে ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি অপরিবর্তনীয় বিধান। ৫৩ বছর আগে
ঘোষিত ‘স্বাধীনতার
ঘোষণাপত্র’ ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র। এজন্য একাত্তরে পাকিস্তানিদের
গণহত্যার খবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী
আন্দোলন না বলে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বীকৃতি দান করা হয়।২৪
বছরের নিপীড়ন-অত্যাচারের পথ অতিক্রম করে জনগণের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি গণতান্ত্রিক
নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের মাধ্যমে উত্থাপিত হয়েছিল বলেই আমাদের স্বাধীনতার লড়াই
আইনসম্মত হয়ে উঠেছিল।আর ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’
ছিল সেই আইনগত বৈধতা অর্জনের অন্যতম স্তম্ভ, যার বাক্যাবলি আজও অবিনাশী।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু গবেষক,
অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশিষ্ট লেখক, কবি,
কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য,
সম্প্রীতি বাংলাদেশ email-drmiltonbiswas1971@gmail.com)
মন্তব্য করুন
‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক/যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক/ মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ অর্থাৎ ১৪৩১ বঙ্গাব্দে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া স্মৃতি, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি ও জরা মুছে যাক, ঘুচে যাক; নববর্ষে পুরাতন বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক। রমজান ও ঈদের পর দেশের মানুষের জীবনে আরো একটি উৎসবের ব্যস্ততা নতুন বছরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় উদ্ভাসিত।ফিলিস্তিনবাসীর উপর হামলা আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে এর মধ্যে মারা গেছেন অসংখ্য মানুষ।তবু মৃত্যুর মিছিলে জীবনের গান ফুল হয়ে ফুটেছে। যুদ্ধের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ পৃথিবীর মৃত্যু উপত্যকা পেরিয়ে এদেশে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে।
সমাজ, রাষ্ট্রে নেতার ছড়াছড়ি। নেতাদের পোস্টার, ফেস্টুনে ভরে গেছে শহর, গ্রাম। তবে এদের বেশিরভাগই সুবিধাভোগী, অর্থলোভী। এদের মধ্যে আদর্শের লেশমাত্র নেই। সততা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি ন্যুনতম দায়বদ্ধতা নেই। এদের কোনো পেশা নেই। রাজনীতি কে এরা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। নেতা নয়, বরং এদেরকে নির্দ্বিধায় চাঁদাবাজ, দখলদার, মাদক ব্যাবসায়ী বলা যায়। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে এরা হেন অপকর্ম নেই যা করে না। এদের অনেকে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধভাবে দখল এবং মাদক ব্যাবসার মত জঘন্য কাজের সাথে সম্পৃক্ত। এসব আদর্শহীন, অসৎ, সুবিধাভোগী, অর্থলোভী নেতাদের ভীড়ে সৎ, দেশপ্রেমিক, আদর্শিক নেতাদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। সমাজ, রাষ্ট্রে এমন নেতাও আছেন যারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তাদের সর্বস্ব উজাড় করে দেন। ষাট, সত্তর, আশি এবং নব্বইয়ের দশকে এমন নেতার সংখ্যা ছিল বেশি। বর্তমানে হাজারো অসৎ নেতার মধ্যে এমন সৎ, আদর্শিক, দেশপ্রেমিক নেতা খুঁজে পেতে মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। দিন দিন যেভাবে রাজনীতিতে অসৎ নেতাদের দাপট বাড়ছে, আগামিতে প্রকৃত নেতাদের খুঁজতে হয়ত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ প্রয়োজন হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সোনালী যুগ পার করছেন। ইতিমধ্যে টানা চার মেয়াদে তুমুল ম্যান্ডেটের সাথে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকার প্রধানের লরেল ধরে রেখেছেন। জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ের মধ্য দিয়ে তিনি পঞ্চম্বারের মত ক্ষমতা নিশ্চিত করে এই অঞ্চলের প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসার কুড়িয়েছেন। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কারও নেতৃত্বে থাকার ব্যাপারে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন এবং ভারত উভয়ই একমত। শেখ হাসিনা সেই বিরল একটি দৃষ্টান্ত। মত কিংবা রাজনৈতিক আদর্শ, নির্বিশেষে সকল আঞ্চলিক শক্তিগুলো তার আসন্ন প্রশাসনকে অভিনন্দন জানায়। তবে জানুয়ারির নির্বাচনের পরে বেশিরভাগেরই দৃষ্টি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে স্থির ছিল। কারণ বাংলাদেশের গনতন্ত্র নিয়ে নির্বাচনের আগে থেকেই বেশ সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়নি বললেও মার্কিন কর্মকর্তারা নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং একসঙ্গে কাজ করারও আশাবাদ ব্যক্ত করে। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের উপর যে মার্কিন চাপ দৃশ্যমান ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা সরকারের উপর সেই মার্কিন চাপ অনেকটাই কমছে এবং তার আগামী পথচলাকে অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে।